৮/১, পান বাগান লেন
ইন্টালি কলিকাতা।
২.১.২৯
কল্যাণীয়েষু,
তোমায় চিঠি লিখছি দেখে তোমার চেয়ে বিস্মিত আমিই বেশি হচ্ছি। চিঠি না লেখাটাই মুখস্থ হয়ে গেছে, কাজেই ওটাকে যখন দায়ে পড়ে হস্তস্থ করতে হয়, তখন হাতের চেয়ে মনটা যে বেশি বিব্রত হয়ে পড়ে।
আমি চিঠি-পত্তর দিইনে বলে তোমাদের অভিমান যদি কখনো হয় তা হলে অন্তত এইটুকু ভেবে সান্ত্বনা লাভ কোরো যে, আমার চিঠি পায় বলে কেউ আমার সুনাম ঘোষণা করেনি কোনোদিন! রবিবাবু চিঠি পেয়েই তার উত্তর দিয়ে ভদ্রতা রক্ষা করেন, তিনি মস্ত বড়ো কবি। আমি চিঠি পেয়ে তার উত্তর না দিয়েই আমার অভদ্রতার প্রিন্সিপল রক্ষা করি। আমি মুসাফির কবি। ভদ্রতা, সৌজন্য, স্নেহ, প্রীতির খাতির কোনোদিনই করিনি। এই যা সান্ত্বনা। রবিবাবুকে চিঠি দিয়ে লোকে ভাবে, উত্তর এল বলে। আমাকে চিঠি দিয়ে কারুর অসোয়াস্তির আশঙ্কা নেই; সে দিব্যি নিশ্চিন্ত থাকে, তার চিঠির উত্তর কোনোদিনই পাবে না। ব্যবসাদরির কথাটা আগে বলে নিই, তারপর কবির অকাজের কথা হবে।
এতদিন আমার পাবলিশাররাই আমায় ঠকিয়ে এসেছে। আমার বোধোদয় হয়েছে। তাই মনে করছি – এবার তার শোধ নেব। এবার থেকে বইগুলো নিজেই প্রকাশ করব। ‘চক্রবাক’ নাম দিয়ে আমার একখানা কবিতার বই ছাপাতে দিয়েছি। তারই বিজ্ঞাপন পাঠালাম পাঁচখানা তোমার কাছে। তুমি (১) ‘জাগরণে’ (২) ‘সঞ্চয়ে’ (৩) ‘আল ফারুকে’ (৪) ‘আমানে’ ও (৫) ‘আজাদে’ গিয়ে দিয়ে এসো। যেন তাঁরা তাঁদের কাগজে প্রকাশ করেন। আমি আমার সাধ্যমতো তাঁদের কবিতা দিয়ে সাহায্য করব– যদি তাঁরা সাহায্য করেন। ঐ কাগজের সম্পাদকদের আলাদা আলাদা চিঠি দিতে পারলাম না সময়ের ও ধৈর্যের অভাবে। তোমার মারফতেই আমার অনুরোধ জানাচ্ছি সম্পাদক সাহেবানদের।
তুমি তো ফেল করতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছ জসীমের সাথে, কাজেই এই হাঁটাহাঁটি করিয়ে তোমার পড়ার ক্ষতি করতে আমার এতটুকু দ্বিধা নেই। আশা করি এবারও পাশ না করার জন্য তুমি চেষ্টার ত্রুটি করছ না।
ডিগ্রি যদি না-ই পাও, অন্তত তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। ডিগ্রিটা থাকে শেষের দিকে অর্থাৎ ওটা ন্যাজের শামিল। আর ও জিনিসটা অর্জন করার জন্য গর্ব আর যাঁরাই করুন আমি পাইনি বলে বিধাতাকে তার জন্য ধন্যবাদ দিই। ন্যাজ নিয়ে গর্ব করবার মতো বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়নি আমার। আমি মানুষের স্তরে উঠে গেছি; আমি নির্লাঙ্গুল।
তোমার কাব্য-সাধনা তোমায় যে ডিগ্রি দান করেছে বা দেবে, তা হবে তোমার মাথার অলঙ্কার – শিরোপা। এটাই তোমার সত্যিকার গর্ব করবার জিনিস।
তুমি আর জসীম যেন একই নদীর জোয়ারভাটা একই স্রোতের রকমফের।
একটু উপদেশের ঢিল ছুঁড়ব? তুমি আজকের মানুষকে খুশি করতে গিয়ে
কালকের অনাগতদের অসম্মান অর্জন কোরো না যেন! ঐ রোগে আমার
যে সর্বনাশ করেছে, তার ক্ষতিপূরণ বুঝি সারা জীবনেও হবে না। বহুদিন আনন্দলোকের
দ্বারে বসে কনসার্টই বাজিয়েছি হাতের বাঁশি ফেলে। তাতে বুকের ব্যথা বেড়েছে বৈ
কমেনি। আজ সেই ব্যথার কথাই যখন সুরের সুতোয় গাঁথলাম, তখন ব্যথাও যেমন কমেছে,
ক্ষতটাও তেমনই মালায় ঢাকা পড়েছে। আমার চোখের জলে সকলের চোখের জল এসে মিশেছে। আমার
বেদনালোক তীর্থলোকে পরিণত হয়েছে। সরব হাততালির লোভের চেয়ে নীরব চোখের জলের অর্ঘ্য
তোমার কাম্য হোক – এর চেয়ে বড়ো প্রার্থনা আমার নেই। তোমাদের দেখে কত আশাই না পোষণ
করি! মনে হয়, আমার গান থামলেও গানের পাখির অভাব হবে না এই নতুন বুলবুলিস্তানে।
আবদুল মজিদ সাহিত্যরত্নের সঙ্গে আলাপ
হল – অনেক কথা। তার মনটাই বড়ো রত্ন। আরশির মতো স্বচ্ছ। আর আর খবর দিয়ো। ইতি–
শুভার্থী
নজরুল ইসলাম