[২৩শ আগস্ট ১৯২৯ সালে 'নবশক্তি' পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠি)
শ্রদ্ধাস্পদ,
শ্রীযুক্ত 'নবশক্তি' সম্পাদক মহাশয়,
সবিনয় নিবেদন,
আপনার সাপ্তাহিকের “মেঘদূত' বিভাগের আমি নিয়মিত পাঠক। মেঘদূতের বার্তা যিনি
প্রেরণ করেন, তিনি বিরহী কি-না জানিনা। তবে তিনি যে একজন সত্যিকারের রসিক
সুজন তাতে কোন সন্দেহ নেই। শুধু কথা রসিক নন, গীত রসিক। গীত রসিক বলছি-
আমিও একজন প্রায় বেতারবাহী সঙ্গীত শ্রোতা বলে। ...আমার নিজের দিক থেকে কিন্ত
গোটাকতক কথা বলার আছে এ নিয়ে। তার কারণে আমার গান প্রত্যহই কোন না কোন
আটিস্ট রেডিওতে গেয়ে থাকেন। আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত তা শুনেও ফেলি।
এক উমাপদ ভট্টাচার্য মহাশয় এবং ক্বচিৎ দু-একজন গাইয়ে ছাড়া অধিকাংশ ভদ্রলোক
বা মহিলাই আমার গান ও সুরকে অসহায় ভেবে (বা একা পেয়ে) তার পিণ্ডি এমন করে
চটকান যে, মনে হয় ওর গয়ালাভ ওখানেই হয়ে গেল। সে একটা রীতিমতো
সবার যুদ্ধ।
একদিন শুনলাম কোনো একজন আমার ঠুমরী চালের দুর্গা সুরের “নহে নহে প্রিয় এ
নয় আখিজল' গানটিকে ধ্রুপদের ইমন সুরে গাইছেন এবং তা শুনে আমার গানের আঁখিজল আমার চোখে দেখা দিল। অবশ্য অনুরাগে নয়, রাগে এবং দুঃখে। ভাগ্যিস
গান এবং গাইয়ে দুই-ই ছিল নাগালের বাইরে, নইলে সেদিন ভালো করেই সুরাসুরের
যুদ্ধ বেধে যেত। আর একদিন একজন রেডিও স্টার (মহিলা) আমার 'আমারে চোখ
ইশারায়' গানটার ন্যাজামুড়ো হাত পা নিয়ে এমন করে তাল গোল পাকিয়ে দিলেন যা
দেখে মনে হল বুঝি বা গানটার ওপরে একটা মটোর লরি চলে গেছে। ...
এ রকম প্রায় প্রত্যহই হয়। বেতারের গাইয়ে গুণীজন যাঁরা আমার গান দয়া করে
গেয়ে থাকেন, তারা আর একটু দয়া করে গানগুলোর মোটামুটি সুর ও গানের কথাগুলোর
মোটামুটি সুর ও গানের কথা জানবার কষ্ট স্বীকার করেন না।... আর একটা কথা, বেতারবার্তার বাঙালি কর্তা মহাশয়
প্রায় ভুলে যান গীত রচয়িতার নাম ঘোষণা করতে। তাতে করে অনেক অনুকারকের
প্রাপ্য প্রশংসা হয়ত আমাদের ওপর এসে পড়ে। গজল-ঠুংরীর নিত্যনব অনুকারক ও
অনুকারিকার গানকে শ্রোতারা আমাদের গান মনে করে প্রায়ই অভিযোগ করেন। গালই
খেতে হয় বেশির ভাগ। গালই হোক আর প্রশংসাই হোক, যার যেটা প্রাপ্য তার থেকে
তাকে বঞ্চিত করা মস্ত বড় অন্যায়। তার চেয়েও বড় অন্যায় সেই গালি বা প্রশংসা যখন
কোন নির্দোষ বেচারার কাঁধে এসে পড়ে। আমাদের গান গীত হবার বদলে কিছুই পাইনে,
কাজেই বেতার কর্তৃপক্ষের কাছে এটুকু সৌজন্য হয়তো প্রত্যাশা করতেই পারি যে,
তিনি অস্তত গানটা যাঁর রচনা তাঁর নামটা উল্লেখ করেন। এতে হয়তো তাদের ব্যবসার
কিছু ক্ষতি হবে না। আমাদের যা ক্ষতি হচ্ছিল তা তো হচ্ছেই।
বিনীত,
নজরুল ইসলাম