|
পাহাড়-মাঠ
পঞ্চকের গান
এ পথ গেছে কোন্খানে গো কোন্খানে—
তা কে জানে তা কে জানে।
কোন্ পাহাড়ের পারে, কোন্ সাগরের ধারে,
কোন্ দুরাশার দিক-পানে—
তা কে জানে তা কে জানে।
এ পথ দিয়ে কে আসে যায় কোন্খানে
তা কে জানে তা কে জানে।
কেমন যে তার বাণী, কেমন হাসিখানি,
যায় সে কাহার সন্ধানে
তা কে জানে তা কে জানে।
পশ্চাতে আসিয়া শোণপাংশুদলের নৃত্য
পঞ্চক। ও কী রে! তোরা কখন পিছনে এসে নাচতে লেগেছিস?
প্রথম শোণপাংশু। আমরা নাচবার সুযোগ পেলেই নাচি, পা-দুটোকে স্থির রাখতে পারি নে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। আয় ভাই, ওকে সুদ্ধ কাঁধে করে নিয়ে একবার নাচি।
পঞ্চক। আরে না না, আমাকে ছুঁস নে রে, ছুঁস নে।
তৃতীয় শোণপাংশু। ঐ রে! ওকে অচলায়তনের ভূতে পেয়েছে। শোণপাংশুকে ও ছোঁবে না।
পঞ্চক। জানিস, আমাদের গুরু আসবেন?
প্রথম শোণপাংশু। সত্যি নাকি! তিনি মানুষটি কী রকম? তাঁর মধ্যে নতুন কিছু আছে?
পঞ্চক। নতুনও আছে, পুরোনোও আছে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। আচ্ছা, এলে খবর দিয়ো—একবার দেখব তাঁকে।
পঞ্চক। তোরা দেখবি কী রে। সর্বনাশ। তিনি তো শোণপাংশুদের গুরু নন। তাঁর কথা তোদের
কানে পাছে এক অক্ষরও যায় সেজন্যে তোদের দিকের প্রাচীরের বাইরে সাত সার রাজার সৈন্য
পাহারা দেবে। তোদেরও তো গুরু আছে— তাকে নিয়েই—
তৃতীয় শোণপাংশু। গুরু! আমাদের আবার গুরু কোথায়! আমরা তো হলুম দাদাঠাকুরের দল।
এ-পর্যন্ত আমরা তো কোনো গুরুকে মানি নি।
প্রথম শোণপাংশু। সেইজন্যেই তো ও-জিনিসটা কী রকম দেখতে ইচ্ছা করে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। আমাদের মধ্যে একজন, তার নাম চণ্ডক—তার কী জানি ভারি লোভ হয়েছে;
সে ভেবেছে তোমাদের কোনো গুরুর কাছে মন্ত্র নিয়ে আশ্চর্য কী-একটা ফল পাবে—তাই সে
লুকিয়ে চলে গেছে।
তৃতীয় শোণপাংশু। কিন্তু শোণপাংশু বলে কেউ তাকে মন্ত্র দিতে চায় না; সেও ছাড়বার ছেলে
নয়, সে লেগেই রয়েছে। তোমরা মন্ত্র দাও না বলেই মন্ত্র আদায় করবার জন্যে তার এত জেদ।
প্রথম শোণপাংশু। কিন্তু পঞ্চকদাদা, আমাদের ছুঁলে কি তোমার গুরু রাগ করবেন?
পঞ্চক। বলতে পারি নে—কী জানি যদি অপরাধ নেন। ওরে তোরা যে সবাই সবরকম কাজই করিস—
সেইটে যে বড়ো দোষ। তোরা চাষ করিস তো?
প্রথম শোণপাংশু। চাষ করি বৈকি, খুব করি। পৃথিবীতে জন্মেছি পৃথিবীকে সেটা খুব ক’ষে
বুঝিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ি।
গান
আমরা চাষ করি আনন্দে।
মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে।
রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে বাঁশের বনে পাতা নড়ে,
বাতাস ওঠে ভরে ভরে চষা মাটির গন্ধে।
সবুজ প্রাণের গানের লেখা রেখায় রেখায় দেয় রে দেখা,
মাতে রে কোন্ তরুণ কবি নৃত্যদোদুল ছন্দে।
ধানের শিষে পুলক ছোটে সকল ধরা হেসে ওঠে,
অঘ্রানেরি সোনার রোদে পূর্ণিমারই চন্দ্রে।
পঞ্চক। আচ্ছা, নাহয় তোরা চাষই করিস সেও কোনোমতে সহ্য হয়—কিন্তু কে বলছিল তোরা
কাঁকুড়ের চাষ করিস।
প্রথম শোণপাংশু। করি বৈকি।
পঞ্চক। কাঁকুড় ! ছি ছি! খেঁসারিডালেরও চাষ করিস বুঝি?
তৃতীয় শোণপাংশু। কেন করব না? এখান থেকেই তো কাঁকুড় খেঁসারিডাল তোমাদের বাজারে যায়।
পঞ্চক। তা তো যায়, কিন্তু জানিস নে কাঁকুড় আর খেঁসারিডাল যারা চাষ করে তাদের আমরা
ঘরে ঢুকতে দিই নে।
প্রথম শোণপাংশু। কেন?
পঞ্চক। কেন কী রে! ওটা যে নিষেধ।
প্রথম শোণপাংশু। কেন নিষেধ?
পঞ্চক। শোনো একবার! নিষেধ, তার আবার কেন! সাধে তোদের মুখদর্শন পাপ! এই সহজ কথাটা
বুঝিস নে যে কাঁকুড় আর খেঁসারিডালের চাষটা ভয়ানক খারাপ।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। কেন? ওটা কি তোমরা খাও না?
পঞ্চক। খাই বৈকি, খুব আদর করে খাই—কিন্তু ওটা যারা চাষ করে তাদের ছায়া মাড়াই নে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। কেন?
পঞ্চক। ফের কেন! তোরা যে এতবড়ো নিরেট মূর্খ তা জানতুম না। আমাদের পিতামহ বিষ্কম্ভী
কাঁকুরের মধ্যে জন্মগ্রহণ
করেছিলেন, সে খবর রাখিস নে বুঝি?
দ্বিতীয় শোণপাংশু। কাঁকুড়ের মধ্যে কেন?
পঞ্চক। আবার কেন! তোরা যে ঐ এক কেন’র জ্বালায় আমাকে অতিষ্ঠ করে তুললি।
তৃতীয় শোণপাংশু। আর, খেঁসারির ডাল?
পঞ্চক। একবার কোন্ যুগে একটা খেঁসারিডালের গুঁড়ো উপবাসের দিন কোন্ এক মস্ত বুড়োর
ঠিক গোঁফের উপর উড়ে পড়েছিল; তাতে তাঁর উপবাসের পুণ্যফল থেকে ষষ্টিসহস্র ভাগের এক
ভাগ কম পড়ে গিয়েছিল; তাই তখনই সেইখানে দাঁড়িয়ে উঠে তিনি জগতের সমস্ত খেঁসারিডালের
খেতের উপর অভিশাপ দিয়ে গেছেন। এত-বড়ো তেজ। তোরা হলে কী করতিস বল্ দেখি।
প্রথম শোণপাংশু। আমাদের কথা বল কেন? উপবাসের দিনে খেঁসারিডাল যদি গোঁফের উপর
পর্যন্ত এগিয়ে আসে তা হলে তাকে আরও একটু এগিয়ে নিই।
পঞ্চক। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, সত্যি করে বলিস্—তোরা কি লোহার কাজ করে
থাকিস?
প্রথম শোণপাংশু। লোহার কাজ করি বৈকি, খুব করি।
পঞ্চক। রাম! রাম! আমরা সনাতন কাল থেকে কেবল তামা-পিতলের কাজ করে আসছি। লোহা গলাতে
পারি কিন্তু সব দিন নয়। ষষ্ঠীর দিনে যদি মঙ্গলবার পড়ে তবেই স্নান করে আমরা হাপর
ছুঁতে পারি, কিন্তু তাই বলে লোহা পিটোনো—সে তো হতেই পারে না!
তৃতীয় শোণপাংশু। আমরা লোহার কাজ করি, তাই লোহাও আমাদের কাজ করে।
গান
কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন ,
ও তার ঘুম ভাঙাইনু রে!
লক্ষযুগের অন্ধকারে ছিল সংগোপন,
ওগো, তায় জাগাইনু রে।
পোষ মেনেছে হাতের তলে,
যা বলাই সে তেমনি বলে,
দীর্ঘ দিনের মৌন তাহার আজ ভাগাইনু রে।
অচল ছিল, সচল হয়ে
ছুটেছে ঐ জগৎ জয়ে,
নির্ভয়ে আজ দুই হাতে তার রাশ বাগাইনু রে।
পঞ্চক। সেদিন উপাধ্যায়মশায় একঘর ছাত্রের সামনে বললেন শোণপাংশু জাতটা এমনই বিশ্রী
যে, তারা নিজের হাতে লোহার কাজ করে। আমি তাঁকে বললুম, ও বেচারারা পড়াশুনো কিছুই করে
নি সে আমি জানি— এমন-কি, এই পৃথিবীটা যে ত্রিশিরা রাক্ষসীর মাথামুড়োনো চুলের জটা
দিয়ে তৈরি তাও ঐ মূর্খেরা জানে না, আবার সে কথা বলতে গেলে মারতে আসে— তাই বলে
ভালোমন্দর জ্ঞান কি ওদের এতটুকুও নেই যে, লোহার কাজ নিজের হাতে করবে। আজ তো স্পষ্টই
দেখতে পাচ্ছি, যার যে বংশে জন্ম তার সেইরকম বুদ্ধিই হয়।
প্রথম শোণপাংশু। কেন, লোহা কী অপরাধটা করেছে।
পঞ্চক। আরে, ওটা যে লোহা সে তো তোকে মানতেই হবে।
প্রথম শোণপাংশু। তা তো হবে।
পঞ্চক। তবে আর কি—এই বুঝে নে না।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। তবু একটা তো কারণ আছে।
পঞ্চক। কারণ নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু কেবল সেটা পুথির মধ্যে। সুতরাং মহাপঞ্চকদাদা ছাড়া
আর অতি অল্প লোকেরই জানবার সম্ভাবনা আছে। সাধে মহাপঞ্চকদাদাকে ওখানকার ছাত্রেরা
একেবারে পূজা করে! যা হোক ভাই, তোরা যে আমাকে ক্রমেই আশ্চর্য করে দিলি রে। তোরা তো
খেঁসারিডাল চাষ করছিস আবার লোহাও পিটোচ্ছিস, এখনো তোরা কোনো দিক থেকে কোনো পাঁচ-চোখ
কিংবা সাত-মাথাওয়ালার কোপে পড়িস নি?
প্রথম শোণপাংশু। যদি পড়ি তবে আমাদেরও লোহা আছে, তারও কোপ বড়ো কম নয়।
পঞ্চক। আচ্ছা, তোদের মন্ত্র কেউ পড়ায় নি?
দ্বিতীয় শোণপাংশু। মন্ত্র! কিসের মন্ত্র।
পঞ্চক। এই মনে কর্ যেমন বজ্রবিদারণ মন্ত্র—তট তট তোতয় তোতয়—
তৃতীয় শোণপাংশু। ওর মানে কী!
পঞ্চক। আবার! মানে! তোর আস্পর্ধা তো কম নয়। সব কথাতেই মানে! কেয়ূরী মন্ত্রটা জানিস?
প্রথম শোণপাংশু। না।
পঞ্চক। মরীচি?
প্রথম শোণপাংশু। না।
পঞ্চক। মহাশীতবতী?
প্রথম শোণপাংশু। না।
পঞ্চক। উষ্ণীষবিজয়?
প্রথম শোণপাংশু। না।
পঞ্চক। নাপিত ক্ষৌর করতে করতে যেদিন তোদের বাঁ গালে রক্ত পাড়িয়ে দেয় সেদিন করিস কী।
তৃতীয় শোণপাংশু। সে দিন নাপিতের দুই গালে চড় কষিয়ে দিই।
পঞ্চক। না রে না, আমি বলছি সে দিন নদী পার হবার দরকার হলে তোরা খেয়া-নৌকোয় উঠতে
পারিস?
তৃতীয় শোণপাংশু। খুব পারি।
পঞ্চক। ওরে, তোরা আমাকে মাটি করলি রে। আমি আর থাকতে পারছি নে। তোদের প্রশ্ন
জিজ্ঞাসা করতে আর সাহস হচ্ছে না। এমন জবাব যদি আর-একটা শুনতে পাই তা হলে তোদের বুকে
করে পাগলের মতো নাচব, আমার জাত-মান কিছু থাকবে না। ভাই, তোরা সব কাজই করতে পাস?
তোদের দাদাঠাকুর কিছুতেই তোদের মানা করে না?
শোণপাংশুগণের গান
সব কাজে হাত লাগাই মোরা সব কাজেই।
বাধাবাঁধন নেই গো নেই।
দেখি, খুঁজি, বুঝি,
কেবল ভাঙি, গড়ি, যুঝি,
মোরা সব দেশেতেই বেড়াই ঘুরে সব সাজেই।
পারি, নাইবা পারি,
নাহয় জিতি কিংবা হারি,
যদি অমনিতে হাল ছাড়ি, মরি সেই লাজেই।
আপন হাতের জোরে
আমরা তুলি সৃজন করে,
আমরা প্রাণ দিয়ে ঘর বাঁধি, থাকি তার মাঝেই।
পঞ্চক। সর্বনাশ করলে রে—আমার সর্বনাশ করলে। আমার আর ভদ্রতা রাখলে না। এদের তালে
তালে আমারও পা-দুটো নেচে উঠছে। আমাকে সুদ্ধ এরা টানবে দেখছি। কোন্ দিন আমিও লোহা
পিটব রে, লোহা পিটব—কিন্তু খেঁসারির ডাল—না না, পালা ভাই, পালা তোরা। দেখছিস নে,
পড়ব বলে পুঁথি সংগ্রহ করে এনেছি।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। ও কী পুঁথি দাদা? ওতে কী আছে?
পঞ্চক। এ আমাদের দিক্চক্রচন্দ্রিকা—এতে বিস্তর কাজের কথা আছে রে।
প্রথম শোণপাংশু। কিরকম?
পঞ্চক। দশটা দিকের দশ রকম রঙ গন্ধ আর স্বাদ আছে কি না এতে তার সমস্ত খোলসা করে
লিখেছে। দক্ষিণ দিকের রঙটা হচ্ছে রুইমাছের পেটের মতো, ওর গন্ধটা দধির গন্ধ, স্বাদটা
ঈষৎ মিষ্টি; পুব দিকের রঙটা হচ্ছে সবুজ, গন্ধটা মদমত্ত হাতির মতো, স্বাদটা বকুলের
ফলের মতো কষা—নৈর্ঋত কোণের—
দ্বিতীয় শোণপাংশু। আর বলতে হবে না দাদা। কিন্তু দশ দিকে তো আমরা এ-সব রঙ গন্ধ দেখতে
পাইনে।
পঞ্চক। দেখতে পেলে তো দেখাই যেত। যে ঘোর মূর্খ সেও দেখত। এ-সব কেবল পুঁথিতে পড়তে
পাওয়া যায়, জগতে কোথাও দেখবার জো নেই।
প্রথম শোণপাংশু। তা হলে দাদা তুমি পুঁথিই পড়ো, আমরা চললুম।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। এদের মতো চোখকান বুজে যদি আমাদের বসে বসে ভাবতে হত তা হলে তো
আমরা পাগল হয়ে যেতুম।
তৃতীয় শোণপাংশু। চল্ ভাই, ঘুরে আসি, শিকারের সন্ধান পেয়েছি। নদীর ধারে গণ্ডারের
পায়ের চিহ্ন দেখা গেছে। [ প্রস্থান
পঞ্চক। এই শোণপাংশুগুলো বাইরে থাকে বটে, কিন্তু দিনরাত্রি এমনি পাক খেয়ে বেড়ায় যে,
বাহিরটাকে দেখতেই পায় না। এরা যেখানে থাকে সেখানে একেবারে অস্থিরতার চোটে চতুর্দিক
ঘুলিয়ে যায়। এরা একটু থেমেছে অমনি সমস্ত আকাশটা যেন গান গেয়ে উঠেছে। এই শোণপাংশুদের
দেখছি ওরা চুপ করলেই আর কিছু শুনতে পায় না—ওরা নিজের গোলমালটা শোনে সেইজন্যে এত গোল
করতে ভালোবাসে। কিন্তু এই আলোতে ভরা নীল আকাশটা আমার রক্তের ভিতরে গিয়ে কথা কচ্ছে,
আমার সমস্ত শরীরটা গুন গুন করে বেড়াচ্ছে।
গান
ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে।
আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে।
আলোতে কোন্ গগনে
মাধবী জাগল বনে,
এলো সেই ফুল জাগানোর খবর নিয়ে।
সারাদিন সেই কথা সে যায় শুনিয়ে।
কেমনে রহি ঘরে,
মন যে কেমন করে,
কেমনে কাটে যে দিন দিন গুনিয়ে।
কী মায়া দেয় বুলায়ে;
দিল সব কাজ ভুলায়ে,
বেলা যায় গানের সুরে জাল বুনিয়ে।
আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে।
শোণপাংশুদলের পুনঃপ্রবেশ
প্রথম শোণপাংশু। ও ভাই পঞ্চক, দাদাঠাকুর আসছে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। এখন রাখো তোমার পুঁথি রাখো—দাদাঠাকুর আসছে।
দাদাঠাকুরের প্রবেশ
প্রথম শোণপাংশু। দাদাঠাকুর!
দাদাঠাকুর। কী রে?
দ্বিতীয় শোণপাংশু। দাদাঠাকুর।
দাদাঠাকুর। কী চাই রে?
তৃতীয় শোণপাংশু। কিছু চাই নে—একবার তোমাকে ডেকে নিচ্ছি।
পঞ্চক। দাদাঠাকুর!
দাদাঠাকুর। কী ভাই, পঞ্চক যে।
পঞ্চক। ওরা সবাই তোমায় ডাকছে, আমারও কেমন ডাকতে ইচ্ছে হল। যতই ভাবছি ওদের দলে মিশব
না ততই আরো জড়িয়ে পড়ছি।
প্রথম শোণপাংশু। আমাদের দাদাঠাকুরকে নিয়ে আবার দল কিসের। উনি আমাদের সব দলের শতদল
পদ্ম।
গান
এই একলা মোদের হাজার মানুষ
দাদাঠাকুর।
এই আমাদের মজার মানুষ
দাদাঠাকুর।
এই তো নানা কাজে,
এই তো নানা সাজে,
এই আমাদের খেলার মানুষ
দাদাঠাকুর।
সব মিলনে মেলার মানুষ
দাদাঠাকুর।
এই তো হাসির দলে,
এই তো চোখের জলে,
এই তো সকল ক্ষণের মানুষ
দাদাঠাকুর।
এই তো ঘরে ঘরে,
এই তো বাহির করে,
এই আমাদের কোণের মানুষ
দাদাঠাকুর।
এই আমাদের মনের মানুষ
দাদাঠাকুর।
পঞ্চক। ও ভাই, তোদের দাদাঠাকুরকে নিয়ে তোরা তো দিনরাত মাতামাতি করছিস, একবার আমাকে
ছেড়ে দে, আমি একটু নিরালায় বসে কথা কই। ভয় নেই, ওঁকে আমাদের অচলায়তনে নিয়ে গিয়ে
কপাট দিয়ে রাখব না।
প্রথম শোণপাংশু। নিয়ে যাও না। সে তো ভালোই হয়। তা হলে কপাটের বাপের সাধ্য নেই বন্ধ
থাকে। উনি গেলে তোমাদের অচলায়তনের পাথরগুলো-সুদ্ধ নাচতে আরম্ভ করবে, পুঁথিগুলোর
মধ্যে বাঁশি বাজবে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। আচ্ছা, আয় ভাই, আমাদের কাজগুলো সেরে আসি। দাদাঠাকুরকে নিয়ে
পঞ্চকদাদা একটু বসুক।
[ প্রস্থান
পঞ্চক। ঐ শোণপাংশুগুলো গেছে, এইবার তোমার পায়ের ধুলো নিই দাদাঠাকুর। ওরা দেখলে হেসে
অস্থির হত তাই ওদের সামনে কিছু করি নে।
দাদাঠাকুর। দরকার কী ভাই পায়ের ধুলোয়।
পঞ্চক। নিতে ইচ্ছে করে। বুকের ভিতরটা যখন ভরে ওঠে, তখন বুঝি তার ভারে মাথা নিচু হয়ে
পড়ে— ভক্তি না করে যে বাঁচি নে।
দাদাঠাকুর। ভাই, আমিও থাকতে পারি নে। স্নেহ যখন আমার হৃদয়ে ধরে না, তখন সেই স্নেহই
আমার ভক্তি।
পঞ্চক। অচলায়তনে প্রণাম করে করে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেছে। তাতে নিজেকেই কেবল ছোটো
করেছি, বড়োকে পাই নি।
দাদাঠাকুর। এই আমার সবার বাড়া বড়োর মধ্যে এসে যখন বসি তখন যা করি তাই প্রণাম হয়ে
ওঠে। এই-যে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মন তোমাকে
আশীর্বাদ করছে—এও আমার প্রণাম।
পঞ্চক। দাদাঠাকুর, তোমার দুই চোখ দিয়ে এই-যে তুমি কেবল সেই বড়োকে দেখছ, তোমাকে যখন
দেখি তখন তোমার সেই দেখাটিকেও আমি যেন পাই। তখন পশুপাখি গাছপালা আমার কাছে আর কিছুই
ছোটো থাকে না। এমন-কি, তখন ঐ শোণপাংশুদের সঙ্গে মাতামাতি করতেও আমার আর বাধে না।
দাদাঠাকুর। আমিও যে ওদের সঙ্গে খেলে বেড়াই সে খেলা আমার কাছে মস্ত খেলা। আমার মনে
হয় আমি ঝরনার ধারার সঙ্গে খেলছি, সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে খেলছি।
পঞ্চক। তোমার কাছে সবই বড়ো হয়ে গিয়েছে।
দাদাঠাকুর। না ভাই, বড়ো হয় নি, সত্য হয়ে উঠেছে —সত্য যে বড়োই, ছোটোই তো মিথ্যা।
পঞ্চক। তোমার বাধা কেটে গেছে দাদাঠাকুর, সব বাধা কেটে গেছে। এমন হাসতে খেলতে, মিলতে
মিশতে, কাজ করতে, কাজ ছাড়তে কে পারে! তোমার ঐ ভাব দেখে আমার মনটা ছট্ফট্ করতে
থাকে। ঐ যে কী একটা আছে—চরম, না পরম, না কী, তা কে বলবে—তার জন্যে দিনরাত যেন আমার
মন কেমন করে। থেকে থেকে এক-একবার চমকে উঠি, আর ভাবি এইবার বুঝি হল, বুঝি পাওয়া গেল।
দাদাঠাকুর, শুনছি আমাদের গুরু আসবেন।
দাদাঠাকুর। গুরু! কী বিপদ। ভারি উৎপাত করবে তা হলে তো।
পঞ্চক। একটু উৎপাত হলে যে বাঁচি। চুপচাপ থেকে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে।
দাদাঠাকুর। তোমার যে শিক্ষা কাঁচা রয়েছে, মনে ভয় হচ্ছে না?
পঞ্চক। আমার ভয় সব-চেয়ে কম—আমার একটি ভুলও হবে না।
দাদাঠাকুর। হবে না?
পঞ্চক। একেবারে কিছুই জানি নে, ভুল করবার জায়গাই নেই। নির্ভয়ে চুপ করে থাকব।
দাদাঠাকুর। আচ্ছা বেশ, তোমার গুরু এলে তাঁকে দেখে নেওয়া যাবে। এখন তুমি আছ কেমন বলো
তো।
পঞ্চক। ভয়ানক টানাটানির মধ্যে আছি ঠাকুর। মনে মনে প্রার্থনা করছি গুরু এসে যেদিকে
হোক একদিকে আমাকে ঠিক করে রাখুন—হয় এখানকার খোলা হাওয়ার মধ্যে অভয় দিয়ে ছাড়া দিন,
নয় তো খুব কষে পুঁথি চাপা দিয়ে রাখুন; মাথা থেকে পা পর্যন্ত আগাগোড়া একেবারে সমান
চ্যাপটা হয়ে যাই।
দাদাঠাকুর। তা, তোমার গুরু তোমার উপর যত পুঁথির চাপই চাপান না কেন, তার নীচের থেকে
তোমাকে আস্ত টেনে বের করে আনতে পারব।
পঞ্চক। তা তুমি পারবে সে আমি জানি। কিন্তু দেখো ঠাকুর, একটা কথা তোমাকে
বলি—অচলায়তনের মধ্যে ঐ- যে আমরা দরজা বন্ধ করে আছি, দিব্যি আছি। ওখানে আমাদের সমস্ত
বোঝাপড়া একেবারে শেষ হয়ে গেছে। ওখানকার মানুষ সেইজন্যে বড়ো নিশ্চিন্ত। কিছুতে কারও
একটু সন্দেহ হবার জো নেই। যদি দৈবাৎ কারও মনে এমন প্রশ্ন ওঠে যে, আচ্ছা ওই যে
চন্দ্রগ্রহণের দিনে শোবার ঘরের দেওয়ালে তিনবার সাদা ছাগলের দাড়ি বুলিয়ে দিয়ে আওড়াতে
হয় “হুন হুন তিষ্ঠ তিষ্ঠ বন্ধ বন্ধ অমৃতের হূঁ ফট স্বাহা” এর কারণটা কী— তা হলে
কেবলমাত্র চারটে সুপুরি আর এক মাষা সোনা হাতে করে যাও তখনই মহাপঞ্চকদাদার কাছে,
এমনি উত্তরটি পাবে যে আর কথা সরবে না। হয় সেটা মানো, নয় কানমলা খেয়ে বেরিয়ে যাও,
মাঝে অন্য রাস্তা নেই। তাই সমস্তই চমৎকার সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু ঠাকুর, সেখান থেকে
বের করে তুমি আমাকে এই যে জায়গাটাতে এনেছ এখানে কোনো মহাপঞ্চকদাদার টিকি দেখবার জো
নেই—বাঁধা জবাব পাই কার কাছে। সব কথারই বারো আনা বাকি থেকে যায়। তুমি এমন করে
মনটাকে উতলা করে দিলে—তার পর?
দাদাঠাকুর। তার পর?
গান
যা হবার তা হবে।
যে আমাকে কাঁদায় সে কি অমনি ছেড়ে রবে।
পথ হতে যে ভুলিয়ে আনে, পথ যে কোথায় সেই তা জানে,
ঘর যে ছাড়ায় হাত সে বাড়ায় সেই তো ঘরে লবে।
পঞ্চক। এতবড়ো ভরসা তুমি কেমন করে দিচ্ছ ঠাকুর! তুমি কোনো ভয় কোনো ভাবনাই রাখতে দেবে
না, অথচ জন্মাবধি আমাদের ভয়ের অন্ত নেই। মৃত্যু-ভয়ের জন্যে অমিতায়ুর্ধারিণী মন্ত্র
পড়ছি, শত্রুভয়ের জন্যে মহাসাহস্রপ্রমর্দিনী, ঘরের ভয়ের জন্যে গৃহমাতৃকা, বাইরের
ভয়ের জন্যে অভয়ংকরী, সাপের ভয়ের জন্যে মহাময়ূরী, বজ্রভয়ের জন্যে বজ্রগান্ধারী,
ভূতের ভয়ের জন্যে চণ্ডভট্টারিকা, চোরের ভয়ের জন্যে হরাহরহৃদয়া। এমন আর কত নাম করব।
দাদাঠাকুর। আমার বন্ধু এমন মন্ত্র আমাকে পড়িয়েছেন যে তাতে চিরদিনের জন্য ভয়ের
বিষদাঁত ভেঙে যায়।
পঞ্চক। তোমাকে দেখে তা বোঝা যায়। কিন্তু সেই বন্ধুকে পেলে কোথা ঠাকুর।
দাদাঠাকুর। পাবই বলে সাহস করে বুক বাড়িয়ে দিলুম, তাই পেলুম। কোথাও যেতে হয় নি।
পঞ্চক। সে কী রকম।
দাদাঠাকুর। যে ছেলের ভরসা নেই সে অন্ধকারে বিছানায় মাকে না দেখতে পেলেই কাঁদে, আর
যার ভরসা আছে সে হাত বাড়ালেই মাকে তখনই বুক ভরে পায়। তখন ভয়ের অন্ধকারটাই আরো নিবিড়
মিষ্টি হয়ে ওঠে। মা তখন যদি জিজ্ঞাসা করে, ‘আলো চাই’? ছেলে বলে, ‘তুমি থাকলে আমার
আলোও যেমন অন্ধকারও তেমনি’।
পঞ্চক। দাদাঠাকুর, আমার অচলায়তন ছেড়ে অনেক সাহস করে তোমার কাছ অবধি এসেছি, কিন্তু
তোমার ওই বন্ধু পর্যন্ত যেতে সাহস করতে পারছি নে।
দাদাঠাকুর। কেন তোমার ভয় কিসের?
পঞ্চক। খাঁচায় যে পাখিটার জন্ম, সে আকাশকেই সব চেয়ে ডরায়। সে লোহার শলাগুলোর মধ্যে
দুঃখ পায় তবু দরজাটা খুলে দিলে তার বুক দুর্ দুর্ করে, ভাবে, ‘বন্ধ না থাকলে বাঁচব
কী করে’। আপনাকে যে নির্ভয়ে ছেড়ে দিতে শিখি নি। এইটেই আমাদের চিরকালের অভ্যাস।
দাদাঠাকুর। তোমরা অনেকগুলো তালা লাগিয়ে সিন্দুক বন্ধ করে রাখাকেই মস্ত লাভ মনে
কর—কিন্তু সিন্দুকে যে আছে কী তার খোঁজ রাখ না।
পঞ্চক। আমার দাদা বলে, জগতে যা-কিছু আছে সমস্তকে দূর করে ফেলতে পারলে তবেই আসল
জিনিসকে পাওয়া যায়। সেইজন্যেই দিনরাত্রি আমরা কেবল দূরই করছি—আমাদের কতটা গেল সেই
হিসাবটাই আমাদের হিসাব—সে হিসাবের অন্তও পাওয়া যাচ্ছে না।
দাদাঠাকুর। তোমার দাদা তো ঐ বলে, কিন্তু আমার দাদা বলে, যখন সমস্ত পাই তখনই আসল
জিনিসকে পাই। সেইজন্যে ঘরে আমি দরজা দিতে পারি নে—দিনরাত্রি সব খুলে রেখে দিই।
আচ্ছা পঞ্চক, তুমি যে তোমাদের আয়তন থেকে বেরিয়ে আস কেউ তা জানে না?
পঞ্চক। আমি জানি যে আমাদের আচার্য জানেন। কোনোদিন তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে কোনো কথা হয়
নি—তিনিও জিজ্ঞাসা
করেন না, আমিও বলি নে। কিন্তু আমি যখন বাইরে থেকে ফিরে যাই তিনি আমাকে দেখলেই বুঝতে
পারেন। আমাকে তখন কাছে নিয়ে বসেন, তাঁর চোখের যেন একটা কী ক্ষুধা তিনি আমাকে দেখে
মেটান। যেন বাইরের আকাশটাকে তিনি আমার মুখের মধ্যে দেখে নেন। ঠাকুর, যেদিন তোমার
সঙ্গে আচার্যদেবকে মিলিয়ে দিতে পারব সেদিন আমার অচলায়তনের সব দুঃখ ঘুচবে।
দাদাঠাকুর। সেদিন আমারও শুভদিন হবে।
পঞ্চক। ঠাকুর, আমাকে কিন্তু তুমি বড়ো অস্থির করে তুলেছ। এক-একসময় ভয় হয় বুঝি
কোনোদিন আর মন শান্ত হবে না।
দাদাঠাকুর। আমিই কি স্থির আছি ভাই? আমার মধ্যে ঢেউ উঠেছে বলেই তোমারও মধ্যে ঢেউ
তুলছি।
পঞ্চক। কিন্তু তবে যে তোমার ঐ শোণপাংশুরা বলে তোমার কাছে তারা খুব শান্তি পায়, কই,
শান্তি কোথায়! আমি তো দেখি নে।
দাদাঠাকুর। ওদের যে শান্তি চাই। নইলে কেবলই কাজের ঘর্ষণে ওদের কাজের মধ্যেই দাবানল
লেগে যেত, ওদের পাশে কেউ দাঁড়াতে পারত না।
পঞ্চক। তোমাকে দেখে ওরা শান্তি পায়?
দাদাঠাকুর। এই পাগল যে পাগলও হয়েছে শান্তিও পেয়েছে। তাই সে কাউকে খ্যাপায়, কাউকে
বাঁধে। পূর্ণিমার চাঁদ সাগরকে উতলা করে যে মন্ত্রে, সেই মন্ত্রেই পৃথিবীকে ঘুম
পাড়িয়ে রাখে।
পঞ্চক। ঢেউ তোলো ঠাকুর, ঢেউ তোলো। কূল ছাপিয়ে যেতে চাই। আমি তোমায় সত্যি বলছি আমার
মন খেপেছে, কেবল জোর পাচ্ছি নে—তাই দাদাঠাকুর, মন কেবল তোমার কাছে আসতে চায়—তুমি
জোর দাও—তুমি জোর দাও—তুমি আর দাঁড়াতে দিয়ো না।
গান
আমি কারে ডাকি গো
আমার বাঁধন দাও গো টুটে।
আমি হাত বাড়িয়ে আছি
আমায় লও কেড়ে লও লুটে।
তুমি ডাকো এমনি ডাকে
যেন লজ্জা ভয় না থাকে,
যেন সব ফেলে যাই, সব ঠেলে যাই,
যাই ধেয়ে যাই ছুটে।
আমি স্বপন দিয়ে বাঁধা,
কেবল ঘুমের ঘোরের বাধা,
সে যে জড়িয়ে আছে প্রাণের কাছে
মুদিয়ে আঁখিপুটে;
ওগো দিনের পরে দিন
আমার কোথায় হল লীন,
কেবল ভাষাহারা অশ্রুধারায়
পরান কেঁদে উঠে।
আচ্ছা দাদাঠাকুর, তোমাকে আর কাঁদতে হয় না? তুমি যাঁর কথা বল তিনি তোমার চোখের জল
মুছিয়েছেন?
দাদাঠাকুর। তিনি চোখের জল মোছান, কিন্তু চোখের জল ঘোচান না।
পঞ্চক। কিন্তু দাদা, আমি তোমার ঐ শোণপাংশুদের দেখি আর মনে ভাবি, ওরা চোখের জল ফেলতে
শেখে নি। ওদের কি তুমি একেবারেই কাঁদাতে চাও না।
দাদাঠাকুর। যেখানে আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ে না সেখানে খাল কেটে জল আনতে হয়। ওদেরও রসের
দরকার হবে, তখন দূর থেকে বয়ে আনবে। কিন্তু দেখেছি ওরা বর্ষণ চায় না, তাতে ওদের কাজ
কামাই যায়, সে ওরা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না, ঐ রকমই ওদের স্বভাব।
পঞ্চক। ঠাকুর, আমি তো সেই বর্ষণের জন্যে তাকিয়ে আছি। যতদূর শুকোবার তা শুকিয়েছে,
কোথাও একটু সবুজ আর কিছু বাকি নেই, এইবার তো সময় হয়েছে—মনে হচ্ছে যেন দূর থেকে গুরু
গুরু ডাক শুনতে পাচ্ছি। বুঝি এবার ঘন নীল মেঘে তপ্ত আকাশ জুড়িয়ে যাবে, ভরে যাবে।
গান
দাদাঠাকুর। বুঝি এল, বুঝি এল, ওরে প্রাণ।
এবার ধর্ দেখি তোর গান।
ঘাসে ঘাসে খবর ছোটে
ধরা বুঝি শিউরে ওঠে,
দিগন্তে ওই স্তব্ধ আকাশ পেতে আছে কান।
পঞ্চক। ঠাকুর, আমার বুকের মধ্যে কী আনন্দ যে লাগছে সে আমি বলে উঠতে পারি নে। এই
মাটিকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে। ডাকো ডাকো, তোমার একটা ডাক দিয়ে এই আকাশ ছেয়ে ফেলো।
গান
আজ যেমন করে গাইছে আকাশ
তেমন করে গাও গো।
যেমন করে চাইছে আকাশ
তেমনি করে চাও গো।
আজ হাওয়া যেমন পাতায় পাতায়
মর্মরিয়া বনকে কাঁদায়,
তেমনি আমার বুকের মাঝে
কাঁদিয়া কাঁদাও গো।
শুনছ দাদা, ঐ কাঁসর বাজছে।
দাদাঠাকুর। হাঁ বাজছে।
পঞ্চক। আমার আর থাকবার জো নেই।
দাদাঠাকুর। কেন।
পঞ্চক। আজ আমাদের দীপকেতন পূজা।
দাদাঠাকুর। কী করতে হবে।
পঞ্চক। আজ ডুমুরতলা থেকে মাটি এনে সেইটে পঞ্চগব্য দিয়ে মেখে বিরোচন মন্ত্র পড়তে
হবে। তার পরে সেই মাটিতে ছোটো ছোটো মন্দির গড়ে তার উপরে ধ্বজা বসিয়ে দিতে হবে। এমন
হাজারটা গড়ে তবে সূর্যাস্তের পরে জলগ্রহণ।
দাদাঠাকুর। ফল কী হবে।
পঞ্চক। প্রেতলোকে পিতামহদের ঘর তৈরি হয়ে যাবে।
দাদাঠাকুর। যারা ইহলোকে আছে তাদের জন্যে—
পঞ্চক। তাদের জন্যে ঘর এত সহজে তৈরি হয় না। চললুম ঠাকুর, আবার কবে দেখা হবে জানি
নে। তোমার এই হাতের স্পর্শ নিয়ে চললুম—এ-ই আমার সঙ্গে সঙ্গে যাবে—এ-ই আমার
নাগপাশ-বাঁধন আলগা করে দেবে। ওই আসছে শোণপাংশুর দল—আমরা এখানে বসে আছি দেখে ওদের
ভালো লাগছে না, ওরা ছট্ফট্ করছে। তোমাকে নিয়ে ওরা হুটোপাটি করতে চায়—করুক, ওরাই
ধন্য, ওরা দিনরাত তোমাকে কাছে পায়।
দাদাঠাকুর। হুটোপাটি করলেই কি কাছে পাওয়া যায়। কাছে আসবার রাস্তাটা কাছের লোকের
চোখেই পড়ে না।
শোণপাংশুদলের প্রবেশ
প্রথম শোণপাংশু। ও কী ভাই পঞ্চক, যাও কোথায়?
পঞ্চক। আমার সময় হয়ে গেছে, আমাকে যেতেই হবে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। বাঃ, সে কি হয়? আজ আমাদের বনভোজন, আজ তোমাকে ছাড়ছি নে।
পঞ্চক। না ভাই, সে হবে না— ঐ কাঁসর বাজছে।
তৃতীয় শোণপাংশু। কিসের কাঁসর বাজছে?
পঞ্চক। তোরা বুঝবি নে। আজ দীপকেতন পূজা—আজ ছেলেমানুষি না। আমি চললুম। (কিছুদূর গিয়া
হঠাৎ ছুটিয়া ফিরিয়া আসিয়া)
গান
হারে রে রে রে রে—
আমায় ছেড়ে দে রে দে রে।
যেমন ছাড়া বনের পাখি
মনের আনন্দে রে।
ঘন শ্রাবণধারা
যেমন বাঁধনহারা
বাদল বাতাস যেমন ডাকাত
আকাশ লুটে ফেরে।
হারে রে রে রে রে
আমায় রাখবে ধরে কে রে।
দাবানলের নাচন যেমন
সকল কানন ঘেরে।
বজ্র যেমন বেগে
গর্জে ঝড়ের মেঘে
অট্টহাস্যে সকল বিঘ্নবাধার বক্ষ চেরে।
প্রথম শোণপাংশু। বেশ বেশ পঞ্চকদাদা, তা হলে চলো আমাদের বনভোজনে।
পঞ্চক। বেশ, চলো। (একটু থামিয়া দ্বিধা করিয়া) কিন্তু ভাই, ওই বন পর্যন্তই যাব, ভোজন
পর্যন্ত নয়।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। সে কি হয়! সকলে মিলে ভোজন না করলে আনন্দ কিসের!
পঞ্চক। না রে, তোদের সঙ্গে ঐ জায়গাটাতে আনন্দ চলবে না।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। কেন চলবে না? চালালেই চলবে।
পঞ্চক। চালালেই চলে এমন কোনো জিনিস আমাদের ত্রিসীমানায় আসতে পারে না তা জানিস?
মারলে চলে না, ঠেললে চলে না, দশটা হাতি জুড়ে দিলে চলে না, আর তুই বলিস কিনা চালালেই
চলবে!
তৃতীয় শোণপাংশু। আচ্ছা ভাই, কাজ কী। তুমি বনেই চলো, আমাদের সঙ্গে খেতে বসতে হবে না।
পঞ্চক। খুব হবে রে খুব হবে। আজ খেতে বসবই, খাবই—আজ সকলের সঙ্গে বসেই খাব—আনন্দে আজ
ক্রিয়াকল্পতরুর ডালে ডালে আগুন লাগিয়ে দেব—পুড়িয়ে সব ছাই করে ফেলব। দাদাঠাকুর, তুমি
ওদের সঙ্গে খাবে না?
দাদাঠাকুর। আমি রোজই খাই।
পঞ্চক। তবে তুমি আমাকে খেতে বলছ না কেন।
দাদাঠাকুর। আমি কাউকে বলি নে ভাই, নিজে বসে যাই।
পঞ্চক। না দাদা, আমার সঙ্গে অমন করলে চলবে না। আমাকে তুমি হুকুম করো, তা হলে আমি
বেঁচে যাই। আমি নিজের সঙ্গে কেবলই তর্ক করে মরতে পারি নে।
দাদাঠাকুর। অত সহজে তোমাকে বেঁচে যেতে দেব না পঞ্চক। যেদিন তোমার আপনার মধ্যে হুকুম
উঠবে সেইদিন আমি হুকুম করব।
একদল শোণপাংশুর প্রবেশ
দাদাঠাকুর। কী রে, এত ব্যস্ত হয়ে ছুটে এলি কেন?
প্রথম শোণপাংশু। চণ্ডককে মেরে ফেলেছে।
দাদাঠাকুর। কে মেরেছে?
দ্বিতীয় শোণপাংশু। স্থবিরপত্তনের রাজা।
পঞ্চক। আমাদের রাজা? কেন, মারতে গেল কেন।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। স্থবিরক হয়ে ওঠবার জন্যে চণ্ডক বনের মধ্যে এক পোড়ো মন্দিরে
তপস্যা করছিল। ওদের রাজা
মন্থরগুপ্ত সেই খবর পেয়ে তাকে কেটে ফেলেছে।
তৃতীয় শোণপাংশু। আগে ওদের দেশের প্রাচীর পঁয়ত্রিশ হাত উঁচু ছিল, এবার আশি হাত উঁচু
করবার জন্যে লোক লাগিয়ে দিয়েছে, পাছে পৃথিবীর সব লোক লাফ দিয়ে গিয়ে হঠাৎ স্থবিরক
হয়ে ওঠে।
চতুর্থ শোণপাংশু। আমাদের দেশ থেকে দশজন শোণপাংশু ধরে নিয়ে গেছে, হয়তো ওদের কালঝন্টি
দেবীর কাছে বলি দেবে।
দাদাঠাকুর। চলো তবে।
প্রথম শোণপাংশু। কোথায়।
দাদাঠাকুর। স্থবিরপত্তনে।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। এখনই?
দাদাঠাকুর। হাঁ, এখনই।
সকলে। ওরে, চল্ রে চল্।
দাদাঠাকুর। আমাদের রাজার আদেশ আছে—ওদের পাপ যখন প্রাচীরের আকার ধরে আকাশের জ্যোতি
আচ্ছন্ন করতে উঠবে তখন সেই প্রাচীর ধুলোয় লুটিয়ে দিতে হবে।
প্রথম শোণপাংশু। দেব ধুলোয় লুটিয়ে।
সকলে। দেব লুটিয়ে।
দাদাঠাকুর। ওদের সেই ভাঙা প্রাচীরের উপর দিয়ে রাজপথ তৈরি করে দেব।
সকলে। হাঁ, রাজপথ তৈরি করে দেব।
দাদাঠাকুর। আমাদের রাজার বিজয়রথ তার উপর দিয়ে চলবে।
সকলে। হাঁ, চলবে। চলবে।
পঞ্চক। দাদাঠাকুর, এ কী ব্যাপার!
দাদাঠাকুর। এই আমাদের বনভোজন।
প্রথম শোণপাংশু। চলো পঞ্চক, তুমি চলো।
দাদাঠাকুর। না না, পঞ্চক না। যাও ভাই, তুমি তোমার অচলায়তনে ফিরে যাও। যখন সময় হবে
দেখা হবে।
পঞ্চক। কী জানি ঠাকুর, যদিও আমি কোনো কর্মেরই না, তবু ইচ্ছে করছে তোমাদের সঙ্গে
ছুটে বেরিয়ে পড়ি।
দাদাঠাকুর। না পঞ্চক, তোমার গুরু আসবেন, তুমি অপেক্ষা করো গে।
পঞ্চক। তবে ফিরে যাই। কিন্তু ঠাকুর, যতবার বাইরে এসে তোমার সঙ্গে দেখা হয় ততবার
ফিরে গিয়ে অচলায়তনে আমাকে যেন আর ধরে না। হয় ওটাকে বড়ো করে দাও, নয় আমাকে আর বাড়তে
দিয়ো না।
দাদাঠাকুর। আয় রে, তবে যাত্রা করি।
|