অরূপরতন
 


এটি রবীন্দ্রনাথের রচিত একটি নাটকএটি রাজা নামক নাটকের অভিনয়যোগ্য সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। উল্লেখ্য রাজা নাটকটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩১৭ বঙ্গব্দের (১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ) পৌষ মাসে। রাজা'র কাহিনী অবলম্বনে রচিত এই নাটকটি রবীন্দ্রনাথ ১৩২৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে রচনা করেন। এই বৎসরেই এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ১৩৪২ বঙ্গাব্দে এর পুনঃপরিবর্তন করেন। বর্তমানে গ্রন্থটি বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলীর ত্রয়োদশ খণ্ডে পাওয়া যায়। রবীন্দ্ররচনাবলীর ত্রয়োদশ খণ্ড থেকে নিচের পাঠটি তুলে ধরা হলো।

                                                                      ভূমিকা
সুদর্শনা রাজাকে বাহিরে খুঁজিয়াছিল। যেখানে বস্তুকে চোখে দেখা যায়, হাতে ছোঁওয়া যায়, ভাণ্ডারে সঞ্চয় করা যায়, যেখানে ধনজন খ্যাতি, সেইখানে সে বরমাল্য পাঠাইয়াছিল। বুদ্ধির অভিমানে সে নিশ্চয় স্থির করিয়াছিল যে, বুদ্ধির জোরে সে বাহিরেই জীবনের সার্থকতা লাভ করিবে। তাহার সঙ্গিনী সুরঙ্গমা তাহাকে বলিয়াছিল, অন্তরের নিভৃত কক্ষে যেখানে প্রভু স্বয়ং আসিয়া আহ্বান করেন সেখানে তাঁহাকে চিনিয়া লইলে তবেই বাহিরে সর্বত্র তাঁহাকে চিনিয়া লইতে ভুল হইবে না; — নহিলে যাহারা মায়ার দ্বারা চোখ ভোলায় তাহাদিগকে রাজা বলিয়া ভুল হইবে। সুদর্শনা এ-কথা মানিল না। সে সুবর্ণের রূপ দেখিয়া তাহার কাছে মনে মনে আত্মসমর্পণ করিল। তখন কেমন করিয়া তাহার চারিদিকে আগুন লাগিল, অন্তরের রাজাকে ছাড়িতেই কেমন করিয়া তাহাকে লইয়া বাহিরের নানা মিথ্যা রাজার দলে লড়াই বাধিয়া গেল, সেই অগ্নিদাহের ভিতর দিয়া কেমন করিয়া আপন রাজার সহিত তাহার পরিচয় ঘটিল, কেমন করিয়া দুঃখের আঘাতে তাহার অভিমান ক্ষয় হইল এবং অবশেষে কেমন করিয়া হার মানিয়া প্রাসাদ ছাড়িয়া পথে দাঁড়াইয়া তবে সে তাহার সেই প্রভুর সঙ্গলাভ করিল, যে-প্রভু সকল দেশে, সকল কালে, সকল রূপে, আপন অন্তরের আনন্দরসে যাঁহাকে উপলব্ধি করা যায়,—এ নাটকে তাহাই বর্ণিত হইয়াছে।

এই নাট্য-রূপকটি ‘রাজা’ নাটকের অভিনয়যোগ্য সংক্ষিপ্ত সংস্করণ – নূতন করিয়া পুনর্লিখিত।

মাঘ ১৩২৬                                                                                                         শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 

              প্রস্তাবনা
               গান

       চোখ যে ওদের ছুটে চলে গো —
ধনের বাটে মানের বাটে রূপের হাটে
              দলে দলে গো॥
দেখবে বলে করেছে পণ,
       দেখবে কারে জানে না মন,
প্রেমের দেখা দেখে যখন
         চোখ ভেসে যায় চোখের জলে গো॥
     আমায় তোরা ডাকিস না রে,
আমি যাব খেয়ার ঘাটে অরূপ রসের পারাবারে।
উদাস হাওয়া লাগে পালে,
          পারের পানে যাবার কালে
চোখ দুটোরে ডুবিয়ে যাব
          অকূল সুধা-সাগর তলে গো॥
 



                                                               অরূপরতন
                                                                    ১
                                                              প্রাসাদকুঞ্জ
সুরঙ্গমা। প্রভু, একটা কথা আছে।
নেপথ্যে। কী বলো।
সুরঙ্গমা। রাজকন্যা সুদর্শনা যে তোমাকেই বরণ করতে চায়, তাকে কি দয়া করবে না?
নেপথ্যে। সে কি আমাকে চেনে?
সুরঙ্গমা। না প্রভু, সে তোমাকে চিনতে চায়। তুমি তাকে নিজেই চিনিয়ে দেবে, নইলে তার সাধ্য কী।
নেপথ্যে। অনেক বাধা আছে।
সুরঙ্গমা। তাই তো তাকে কৃপা করতে হবে।
নেপথ্যে। বহু দুঃখে যে আবরণ দূর হয়।
সুরঙ্গমা। সেই দুঃখই তাকে দিয়ো, তাকে দিয়ো।
নেপথ্যে। আমার নাম নিয়ে সকলের চেয়ে বড়ো হবে, এই অহংকারে সে আমাকে চায়।
সুরঙ্গমা। এই সুযোগে তার অহংকার দাও ভেঙে। সকলের নিচে নামিয়ে তোমার পায়ের কাছে নিয়ে এস তাকে।
নেপথ্যে। সুদর্শনাকে বলো, আমি তাকে গ্রহণ করব অন্ধকারে।
সুরঙ্গমা। বাঁশি বাজবে না? আলো জ্বলবে না? সমারোহ হবে না?
নেপথ্যে। না।
সুরঙ্গমা। বরণডালায় সে কি ফুলের মালা তোমাকে দেবে না?
নেপথ্যে। সে ফুল এখনো ফোটে নি।
সুরঙ্গমা। সেই ভালো মহারাজ। অন্ধকারেই বীজ থাকে, অঙ্কুরিত হলে আপনিই আসে আলোয়।

বাহির হতে আহ্বান। ‘সুরঙ্গমা’!

সুরঙ্গমা। ওই আসছেন রাজকুমারী সুদর্শনা।

                         সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনা। তোমার এখানে আকাশে যেন অর্ঘ্য সাজানো, যেন শিশির-ধোওয়া সকালবেলার স্পর্শ। তুমি এখানকার বাতাসে কী ছিটিয়ে দিয়েছ বলো দেখি।
সুরঙ্গমা। সুর ছিটিয়েছি।
সুদর্শনা। আমাকে সেই রাজাধিরাজের কথা বলো সুরঙ্গমা, আমি শুনি।
সুরঙ্গমা। মুখের কথায় বলে উঠতে পারি নে।
সুদর্শনা। বলো, তিনি কি খুব সুন্দর?
সুরঙ্গমা। সুন্দর? একদিন সুন্দরকে নিয়ে খেলতে গিয়েছিলুম, খেলা ভাঙল যেদিন, বুক ফেটে গেল, সেইদিন বুঝলুম সুন্দর কাকে বলে। একদিন তাকে ভয়ংকর বলে ভয় পেয়েছি, আজ তাকে ভয়ংকর বলে আনন্দ করি – তাকে বলি তুমি ঝড়, তাকে বলি তুমি দুঃখ, তাকে বলি তুমি মরণ, সব শেষে বলি – তুমি আনন্দ।
 

                    গান
       আমি যখন ছিলেম অন্ধ,
সুখের খেলায় বেলা গেছে পাই নি তো আনন্দ॥
       খেলাঘরের দেয়াল গেঁথে
       খেয়াল নিয়ে ছিলেম মেতে,
ভিত ভেঙে যেই আসলে ঘরে
                  ঘুচল আমার বন্ধ,
সুখের খেলা আর রোচে না
                     পেয়েছি আনন্দ॥
        ভীষণ আমার, রুদ্র আমার,
        নিদ্রা গেল ক্ষুদ্র আমার,
উগ্র ব্যথায় নূতন করে
                বাঁধলে আমার ছন্দ।
           যেদিন তুমি অগ্নিবেশে
           সব-কিছু মোর নিলে এসে,
সেদিন আমি পূর্ণ হলেম ঘুচল আমার দ্বন্দ্ব,
দুঃখ সুখের পারে তোমায় পেয়েছি আনন্দ॥
 


সুদর্শনা। প্রথমটা তুমি তাঁকে চিনতে পার নি?
সুরঙ্গমা। না।
সুদর্শনা। কিন্তু দেখো তাঁকে চিনতে আমার একটুও দেরি হবে না। আমার কাছে তিনি সুন্দর হয়ে দেখা দেবেন।
সুরঙ্গমা। তার আগে একটা কথা তোমাকে মেনে নিতে হবে।
সুদর্শনা। নেব, আমার কিছুতে দ্বিধা নেই।
সুরঙ্গমা। তিনি বলেছেন, অন্ধকারেই তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে।
সুদর্শনা। চিরদিন?
সুরঙ্গমা। সে-কথা বলতে পারি নে।
সুদর্শনা। আচ্ছা আমি সবই মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমার কাছে তিনি লুকিয়ে থাকতে পারবেন না। দিন যদি স্থির হয়ে থাকে সবাইকে তো জানাতে হবে।
সুরঙ্গমা। জানিয়ে কী করবে। সে অন্ধকারে সকলের তো স্থান নেই।
সুদর্শনা। আমি রাজাধিরাজকে লাভ করেছি সে-কথা কাউকে জানাতে পারব না?
সুরঙ্গমা। জানাতে পার কিন্তু কেউ বিশ্বাস করবে না।
সুদর্শনা। এতবড়ো কথাটা বিশ্বাস করবে না, সে কি হয়?
সুরঙ্গমা। লোক ডেকে প্রমাণ দিতে পারবে না যে।
সুদর্শনা। পারবই, নিশ্চয় পারব।
সুরঙ্গমা। আচ্ছা, চেষ্টা দেখো।
সুদর্শনা। সুরঙ্গমা, তোমার মতো আমি অত বেশি নম্র নই, আমি শক্ত আছি। সকলের কাছে তিনি আমাকে স্বীকার করে নেবেন – এ তিনি এড়াতে পারবেন না।
সুরঙ্গমা। সে-কথা আজকে ভাববার দরকার নেই রাজকুমারী, তুমি নিজে তাঁকে সম্পূর্ণ স্বীকার করে নিয়ো, তাহলেই সব সহজ হবে।
সুদর্শনা। ও-কথা কেন বলছ? আমি তো সেইজন্যেই প্রস্তুত হয়ে রয়েছি। আর কিন্তু বিলম্ব কোরো না।
সুরঙ্গমা। তাঁর দিকে সমস্তই প্রস্তুত হয়েই আছে। আজ আমরা তবে বিদায় হই।
সুদর্শনা। কোথায় যাচ্ছ?
সুরঙ্গমা। বসন্ত-উৎসব কাছে এল, তার আয়োজন করতে হবে।
সুদর্শনা। কী রকমের আয়োজনটা হওয়া চাই?
সুরঙ্গমা। মাধবীকুঞ্জকে তো তাড়া দিতে হয় না। আমের বনেও মুকুল আপনি ধরে। আমাদের মানুষের শক্তিতে যার যেটা দেবার সেটা সহজে প্রকাশ হতে চায় না। কিন্তু সেদিন সেটা আবৃত থাকলে চলবে না। কেউ দেবে গান, কেউ দেবে নাচ।
সুদর্শনা। আমি সেদিন কী দেব সুরঙ্গমা।
সুরঙ্গমা। সে-কথা তুমিই বলতে পার।
সুদর্শনা। আমি নিজ হাতে মালা গেঁথে সুন্দরকে অর্ঘ্য পাঠাব।
সুরঙ্গমা। সে-ই ভালো।
সুদর্শনা। তাঁকে দেখব কী করে॥
সুরঙ্গমা। সে তিনিই জানেন।
সুদর্শনা। আমাকে কোথায় যেতে হবে?
সুরঙ্গমা। কোথাও না, এইখানেই।
সুদর্শনা। কী বল সুরঙ্গমা, অন্ধকারের সভা এইখানেই? যেখানে চিরদিন আছি এইখানেই? সাজতে হবে না?
সুরঙ্গমা। নাই-বা সাজলে। একদিন তিনিই সাজাবেন যে-সাজে তোমাকে মানায়।

 

                    গান
       প্রভু, বলো বলো কবে
তোমার, পথের ধুলার রঙে রঙে
          আঁচল রঙিন হবে।
তোমার বনের রাঙা ধূলি
ফুটায় পূজার কুসুমগুলি,
সেই ধূলি হায় কখন আমায়
          আপন করি লবে॥
প্রণাম দিতে চরণতলে
      ধুলার কাঙাল যাত্রিদলে
      চলে যারা, আপন ব’লে
              চিনবে আমায় সবে॥

সুদর্শনা। আমার তো আর একটুও দেরি করতে ইচ্ছে করছে না।
সুরঙ্গমা। কোরো না দেরি – তাঁকে ডাকো, এইখানেই দয়া করবেন।
সুদর্শনা। সুরঙ্গমা, আমি তো মনে করি যে ডাকছি, সাড়া পাই নে। বোধ হয় ডাকতে জানি নে। তুমি আমার হয়ে ডাকো না– তোমার কণ্ঠ তিনি চেনেন।

                    সুরঙ্গমার গান
খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর
              বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে।
দাও সাড়া দাও, এই দিকে চাও
                   এসো দুই বাহু বাড়ায়ে॥
              কাজ হয়ে গেছে সারা,
              উঠেছে সন্ধ্যাতারা,
আলোকের খেয়া হয়ে গেল দেয়া
                   অস্তসাগর পারায়ে॥
ভরি লয়ে ঝারি এনেছি তো বারি
           সেজেছি তো শুচি দুকূলে,
বেঁধেছি তো চুল, তুলেছি তো ফুল
             গেঁথেছি তো মালা মুকুলে।
         ধেনু এল গোঠে ফিরে
         পাখিরা এসেছে নীড়ে,
পথ ছিল যত জুড়িয়া জগত
             আঁধারে গিয়েছে হারায়॥

ধীরে ধীরে আলো নিবে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল

সুদর্শনা। অন্ধকারে আমি যে কিছুই দেখতে পাচ্ছি নে। তুমি কি এর মধ্যে আছ?
নেপথ্যে। এই তো আমি আছি।
সুদর্শনা। আমি তোমাকে বরণ করব, সে কি না দেখেই?
নেপথ্যে। চোখে দেখতে গেলে ভুল দেখবে – অন্তরে দেখো মন শুদ্ধ করে।
সুদর্শনা। ভয়ে যে আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠছে।
নেপথ্যে। প্রেমের মধ্যে ভয় না থাকলে রস নিবিড় হয় না।
সুদর্শনা। এই অন্ধকারে তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?
নেপথ্যে। হাঁ পাচ্ছি।
সুদর্শনা। কী রকম দেখছ?
নেপথ্যে। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার মধ্যে দেহ নিয়েছে যুগযুগান্তরের ধ্যান, লোকলোকান্তরের আলোক, বহু শত শরৎ-বসন্তের ফুল ফল। তুমি বহুপুরাতনের নূতন রূপ।
সুদর্শনা। বলো বলো এমনি করে বলো। মনে হচ্ছে যেন অনাদিকালের গান জন্মজন্মান্তর থেকে শুনে আসছি। কিন্তু প্রভু, এ যে কঠিন কালো লোহার মতো অন্ধকার, এ যে আমর উপর চেপে আছে ঘুমের মতো, মূর্ছার মতো, মৃত্যুর মতো। এ জায়গায় তোমাতে আমাতে মিল হবে কেমন করে? না না, হবে না মিলন, হবে না। এখানে নয়, চোখের দেখার জগতেই তোমাকে দেখব – সেইখানেই যে আমি আছি।
নেপথ্যে। আচ্ছা দেখো। তোমাকে নিজে চিনে নিতে হবে।
সুদর্শনা। চিনে নেব, লক্ষ লোকের মধ্যে চিনে নেব, ভুল হবে না।
নেপথ্যে। বসন্ত-পূর্ণিমার উৎসবে সকল লোকের মধ্যে আমাকে দেখবার চেষ্টা করো। সুরঙ্গমা।
সুরঙ্গমা। কী প্রভু।
নেপথ্যে। বসন্ত-পূর্ণিমার উৎসব তো এল।
সুরঙ্গমা। আমাকে কী কাজ করতে হবে?
নেপথ্যে। আজ তোমার কাজের দিন নয়, সাজের দিন। পুষ্পবনের আনন্দে মিলিয়ে দিয়ো প্রাণের আনন্দ।
সুরঙ্গমা। তাই হবে প্রভু।
নেপথ্যে। সুদর্শনা আমাকে চোখে দেখতে চান।
সুরঙ্গমা। কোথায় দেখবেন?
নেপথ্যে। যেখানে পঞ্চমে বাঁশি বাজবে, পুষ্পকেশরের ফাগ উড়বে, আলোয় ছায়ায় হবে গলাগলি সেই দক্ষিণের কুঞ্জবনে।
সুরঙ্গমা। চোখে ধাঁধা লাগবে না?
নেপথ্যে। সুদর্শনার কৌতূহল হয়েছে।
সুরঙ্গমা। কৌতূহলের জিনিস তো পথে ঘাটে ছড়াছড়ি। তুমি যে কৌতূহলের অতীত।

                    গান
কোথা    বাইরে দূরে যায় রে উড়ে, হায় রে হায়,
তোমার  চপল আঁখি বনের পাখি বনে পালায়॥
ওগো    হৃদয়ে যবে মোহন রবে বাজবে বাঁশি,
তখন    আপনি সেধে ফিরবে কেঁদে পরবে ফাঁসি,
তখন    ঘুচবে ত্বরা ঘুরিয়া মরা হেথা হোথায় –
আহা    আজি সে আঁখি বনের পাখি বনে পালায়॥
চেয়ে    দেখিস না রে হৃদয়-দ্বারে কে আসে যায়,
তোরা    শুনিস কানে বারতা আনে দখিন বায়।
আজি    ফুলের বাসে সুখের হাসে আকুল গানে
চির      বসন্ত যে তোমারি খোঁজে এসেছে প্রাণে,
তারে     বাহিরে খুঁজি ফিরিছ বুঝি পাগল প্রায়,
আহা     আজি সে আঁখি বনের পাখি বনে পালায়॥
                                                 [ উভয়ের প্রস্থান

                                                                ২
                                                          উৎসব-ক্ষেত্র
                                             বিদেশী পথিকদল ও প্রহরীর প্রবেশ
বিরাজদত্ত। ওগো মশায়।
প্রহরী। কেন গো?
ভদ্রসেন। রাস্তা কোথায়? এখানে রাজাও দেখি নে রাস্তাও দেখি নে। আমরা বিদেশী, আমাদের রাস্তা বলে দাও।
প্রহরী। কিসের রাস্তা?
মাধব। ঐ যে শুনেছি আজ অধরা-রাজার দেশে উৎসব হবে। কোন্‌ দিক দিয়ে যাওয়া যাবে?
প্রহরী। এখানে সব রাস্তাই রাস্তা। যেদিক দিয়ে যাবে ঠিক পৌঁছোবে। সামনে চলে যাও।
বিরাজদত্ত। শোনো একবার কথা শোনো। বলে, সবই এক রাস্তা। তাই যদি হবে তবে এতগুলোর দরকার ছিল কী?
মাধব। তা ভাই রাগ করিস কেন? যে দেশের যেমন ব্যবস্থা। আমাদের দেশে তো রাস্তা নেই বললেই হয় — বাঁকাচোরা গলি, সে তো গোলকধাঁধা। আমাদের রাজা বলে, খোলা রাস্তা না থাকাই ভালো — রাস্তা পেলেই প্রজারা বেরিয়ে চলে যাবে। এদেশে উলটো, যেতেও কেউ ঠেকায় না, আসতেও কেউ মানা করে না — তবু মানুষও তো ঢের দেখছি — এমন খোলা পেলে আমাদের রাজ্য উজাড় হয়ে যেত।
বিরাজদত্ত। ওহে মাধব, তোমার ওই একটা বড়ো দোষ।
মাধব। কী দোষ দেখলে?
বিরাজদত্ত। নিজের দেশের তুমি বড়ো নিন্দে কর। খোলা রাস্তাটাই বুঝি ভালো হল? বলো তো ভাই ভদ্রসেন, খোলা রাস্তাটাকে বলে কিনা ভালো।
ভদ্রসেন। ভাই বিরাজদত্ত, বরাবরই তো দেখে আসছ মাধবের ঐ একরকম ত্যাড়া বুদ্ধি। কোন্‌দিন বিপদে পড়বেন – রাজার কানে যদি যায় তাহলে ম’লে ওকে শ্মশানে ফেলবার লোক পাবেন না।
বিরাজদত্ত। আমাদের তো ভাই এই খোলা রাস্তার দেশে এসে অবধি খেয়ে শুয়ে সুখ নেই — দিনরাত গা-ঘিনঘিন করছে।
কে আসছে কে যাচ্ছে তার কোনো ঠিক-ঠিকানাই নেই – রাম রাম।
ভদ্রসেন। সেও তো ওই মাধবের পরামর্শ শুনেই এসেছি। আমাদের গুষ্টিতে এমন কখনো হয় নি। আমার বাবাকে তো জান– কতবড়ো মহাত্মা লোক ছিল– শাস্ত্রমতে ঠিক উনপঞ্চাশ হাত মেপে গণ্ডি কেটে তার মধ্যেই সমস্ত জীবনটা কাটিয়ে দিলে – একদিনের জন্যে তার বাইরে পা ফেলে নি। মৃত্যুর পর কথা উঠল ওই উনপঞ্চাশ হাতের মধ্যেই তো দাহ করতে হয় – সে এক বিষম মুশকিল – শেষকালে শাস্ত্রী বিধান দিলে উনপঞ্চাশে যে দুটো অঙ্ক আছে তার বাইরে যাবার জো নেই; অতএব ওই চার নয় উনপঞ্চাশকে উলটে নিয়ে নয় চার চুরানব্বই করে দাও – তবেই তো তাকে বাড়ির বাইরে পোড়াতে পারি, নইলে ঘরেই দাহ করতে হত। বাবা, এত আঁটাআঁটি! এ কি যে-সে দেশ পেয়েছ!
বিরাজদত্ত। বটেই তো, মরতে গেলেও ভাবতে হবে এ কি কম কথা।
ভদ্রসেন। সেই দেশের মাটিতে শরীর, তবু মাধব বলে কিনা, খোলা রাস্তাই ভালো।
                                                                                     [ সকলের প্রস্থান

                     সদলে ঠাকুরদার প্রবেশ
ঠাকুরদা। ওরে দক্ষিনে হাওয়ার সঙ্গে সমান পাল্লা দিতে হবে — হার মানলে চলবে না — আজ সব রাস্তাই গানে ভাসিয়ে দিয়ে চলব।

                            মেয়ের দলের প্রবেশ
প্রথমা। ঠাকুরদা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, উৎসবটা হচ্ছে কোথায়?
ঠাকুরদা। যেদিক চাইবে সেইদিকেই।
প্রথমা। একেই বলে তোমাদের রাজাধিরাজের উৎসব!
ঠাকুরদা। আমরা তো তাই বলি।
দ্বিতীয়া। আমাদের দেশের সব চেয়ে খুদে সামন্তরাজও এর চেয়ে ঘটা করে পথে বেরোয়।
ঠাকুরদা। নিজেকে না চেনাতে পারলে তারা যে বঞ্চিত।
তৃতীয়া। আর তোমরা যে কোন্‌ না-দেখা রাজার কথা বলছ?
ঠাকুরদা। তাঁকে না চিনতে পারলে আমরাই বঞ্চিত।
প্রথমা। চেনবার উপায়টা কী করেছ?
ঠাকুরদা। তাঁর সঙ্গে সুর মেলাচ্ছি। এই যে দখিন হাওয়া দিয়েছে, আমের বোল ধরেছে, সমান সুরে সাড়া দিতে পারলে ভিতরে ভিতরে জানাজানি হয়।
দ্বিতীয়া। তোমাদের কর্তারা ঢাকঢোলের বায়না দেন নি বুঝি? তোমাদের উপরেই সব বরাত?
ঠাকুরদা। তা নয় তো কী। ভাড়া করে সমারোহ? তোমরা আমরা আছি কী করতে? ওরে তোরা ধর-না ভাই গান।

                    গান
আজি      দখিন দুয়ার খোলা—
            এসো হে, এসো হে, এসো হে, আমার
                        বসন্ত এসো।
দিব        হৃদয়-দোলায় দোলা,
            এসো হে, এসো হে, এসো হে, আমার
                        বসন্ত এসো।
নব        শ্যামল শোভন রথে
এসো     বকুল-বিছানো পথে,
এসো     বাজায়ে ব্যাকুল বেণু,
মেখে      পিয়াল ফুলের রেণু,
            এসো হে, এসো হে, এসো হে, আমার
                       বসন্ত এসো।
এসো     ঘনপল্লবপুঞ্জে
            এসো হে, এসো হে, এসো হে।
এসো     বনমল্লিকাকুঞ্জে
            এসো হে, এসো হে, এসো হে।
মৃদু        মধুর মদির হেসে
এসো     পাগল হাওয়ার দেশে,
তোমার   উতলা উত্তরীয়
তুমি       আকাশে উড়ায়ে দিয়ো,
            এসো হে, এসো হে, এসো হে, আমার
                       বসন্ত এসো॥
                                       [ মেয়েদের প্রস্থান

পূব দুয়ারটা হল। এবার চলো পশ্চিম দুয়ারটার দিকে।

                    দেশী পথিকদলের প্রবেশ
কৌণ্ডিল্য। ঠাকুরদা, এই প্রাচীন বয়সে ছেলের দলকে নিয়ে মেতে বেড়াচ্ছ যে?
ঠাকুরদা। নবীনকে ডাক দিতে বেরিয়েছি।
জনার্দন। সেটা কি তোমাকে শোভা পায়?
ঠাকুরদা। ওরে পাকা পাতাই তো ঝরবার সময় নতুন পাতাকে জাগিয়ে দিয়ে যায়।

                    গান
আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলায় বারে বারে
         ডাক দিয়ে যায় নতুন পাতার দ্বারে দ্বারে।

কৌণ্ডিল্য। ডাক দিয়েছ সেতো দেখতে পাচ্ছি, পাড়া অস্থির করে তুলেছ। কিন্তু এর দরকার ছিল কি।
ঠাকুরদা। আমারই নবীন বয়সকে ওদের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছি – বুড়োটা ঢাকা পড়ে গেল।

                    গান
তাই তো আমার এই জীবনের বনচ্ছায়ে
ফাগুন আসে ফিরে ফিরে দখিন বায়ে,
নতুন সুরে গান উড়ে যায় আকাশ পারে,
নতুন রঙে ফুল ফোটে তাই ভারে ভারে॥

কৌণ্ডিল্য। তা তুমি নতুন হয়েই রইলে সে-কথা সত্যি, বুড়ো হবার সময় পেলে না।
ঠাকুরদা। নিজে নতুন না হলে সেই নতুনকে যে পাই নে।

                    গান
ওগো আমার নিত্য নূতন দাঁড়াও হেসে
চলব তোমার নিমন্ত্রণে নবীন বেশে।
দিনের শেষে নিবল যখন পথের আলো,
সাগরতীরে যাত্রা আমার যেই ফুরাল,
তোমার বাঁশি বাজে সাঁঝের অন্ধকারে
শূন্যে আমার উঠল তারা সারে সারে॥

কৌণ্ডিল্য। রাখো দাদা, তোমার গান রাখো। আজকের দিনে একটা কথা মনে বড়ো লাগছে।
ঠাকুরদা। কী বলো দেখি।
কৌণ্ডিল্য। এবার দেশবিদেশের লোক এসেছে, সবাই বলছে সবই দেখেছি ভালো কিন্তু রাজা দেখি নে কেন — কাউকে জবাব দিতে পারি নে। এখানে ঐটে বড়ো একটা ফাঁকা রয়ে গেছে।
ঠাকুরদা। ফাঁকা! আমাদের এই দেশে রাজা এক জায়গায় দেখা দেয় না বলেই তো সমস্ত রাজ্যটা এবেবারে রাজায় ঠাসা হয়ে রয়েছে — তাকে বল ফাঁকা! সে যে আমাদের সবাইকেই রাজা করে দিয়েছে।

                    গান
আমরা     সবাই রাজা আমাদের এই
                    রাজার রাজত্বে।
নইলে     মোদের রাজার সনে
                   মিলব কী স্বত্বে॥
             আমরা যা খুশি তাই করি
             তবু   তাঁর খুশিতেই চরি,
আমরা     নই বাঁধা নই দাসের রাজার
                   ত্রাসের দাসত্বে।
            নইলে মোদের রাজার সনে
                   মিলব কী স্বত্বে।
            রাজা    সবারে দেন মান
            সে মান আপনি ফিরে পান,
মোদের  খাটো করে রাখে নি কেউ
                    কোনো অসত্যে,
           নইলে মোদের রাজার সনে
                   মিলব কী স্বত্বে।
         আমরা   চলব আপন মতে
         শেষে    মিলব তাঁরি পথে,
মোরা   মরব না কেউ বিফলতার
                    বিষম আবর্তে।
         নইলে মোদের রাজার সনে
                    মিলব কী স্বত্বে?

কুম্ভ। কিন্তু দাদা, যা বল তাঁকে দেখতে পায় না বলে লোকে অনায়াসে তাঁর নামে যা খুশি বলে, সেইটে অসহ্য হয়।
জনার্দন। এই দেখো না, আমাকে গাল দিলে শাস্তি আছে কিন্তু রাজাকে গাল দিলে কেউ তার মুখ বন্ধ করবার নেই।
ঠাকুরদা। ওর মানে আছে; প্রজার মধ্যে যে-রাজাটুকু মিশিয়ে আছে তারই গায়ে আঘাত লাগে, তাকে ছাড়িয়ে যিনি তাঁর গায়ে কিছুই বাজে না। সূর্যের যে তেজ প্রদীপে আছে তাতে ফুঁটুকু সয় না, কিন্তু হাজার লোকে মিলে সূর্যে ফুঁ দিলে সূর্য অম্লান হয়েই থাকেন।
                                                        [ সকলের প্রস্থান
                        বিদেশীদলের পুনঃপ্রবেশ
বিরাজদত্ত। দেখো ভাই ভদ্রসেন, আসল কথাটা হচ্ছে, এদের মূলেই রাজা নেই। সকলে মিলে একটা গুজব রটিয়ে রেখেছে।
ভদ্রসেন। আমারও তো তাই মনে হয়েছে। সকল দেশেই রাজাকে দেখে দেশসুদ্ধ লোকের আত্মাপুরুষ বাঁশপাতার মতো হীহী করে কাঁপতে থাকে, আর এখানে রাজাকে খুঁজেও মেলে না! কিছু না হোক, মাঝে মাঝে বিনা কারণে এক-একবার যদি চোখ পাকিয়ে বলে, বেটার শির লেও, তাহলেও বুঝি রাজার মতো রাজা আছে বটে।
মাধব। কিন্তু এ-রাজ্যে আগাগোড়া যেমন নিয়ম দেখছি, রাজা না থাকলে তো এমন হয় না।
বিরাজদত্ত। এতকাল রাজার দেশে বাস করে এই বুদ্ধি হল তোমার? নিয়মই যদি থাকবে তাহলে রাজা থাকবার দরকার কী?
মাধব। এই দেখো-না, আজ এত লোক মিলে আনন্দ করছে – রাজা না থাকলে এরা এমন করেই মিলতেই পারত না।
বিরাজদত্ত। ওহে মাধব, আসল কথাটাই যে তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ। একটা নিয়ম আছে – সেটা তো দেখছি, উৎসব হচ্ছে সেটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সেখানে তো কোনো গোল বাধছে না – কিন্তু রাজা কোথায়, তাকে দেখলে কোথায় সেইটে বলো।
মাধব। আমার কথাটা হচ্ছে এই যে, তোমরা তো এমন রাজ্য জান যেখানে রাজা কেবল চোখেই দেখা যায় কিন্তু রাজ্যের মধ্যে তার কোনো পরিচয় নেই, সেখানে কেবল ভূতের কীর্তন – কিন্তু এখানে দেখো –
ভদ্রসেন। আবার ঘুরে ফিরে সেই একই কথা! তুমি বিরাজদত্তর আসল কথাটার উত্তর দাও-না হে – হাঁ, কি, না? রাজাকে দেখেছ, কি, দেখ নি?
বিরাজদত্ত। রেখে দাও ভাই ভদ্রসেন, ওর ন্যায়শাস্ত্রটা পর্যন্ত এ-দেশী রকমের হয়ে উঠেছে। বিনা চক্ষে ও যখন দেখতে শুরু করেছে তখন আর ভরসা নেই। বিনা অন্নে কিছুদিন ওকে আহার করতে দিলে আবার বুদ্ধিটা সাধারণ লোকের মতো পরিষ্কার হয়ে আসতে পারে।

                                                            বাউলের প্রবেশ

                    গান
আমার      প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
              তাই হেরি তায় সকল খানে।
আছে সে   নয়নতারায় আলোকধারায়,
                             তাই না হারায়,
ওগো        তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
              তাকাই আমি যেদিক পানে॥
              আমি তার মুখের কথা
              শুনব বলে গেলাম কোথা,
              শোনা হল না, হল না,
আজ       ফিরে এসে নিজের দেশে
                   এই যে শুনি,
শুনি        তাহার বাণী আপন গানে॥
             কে তোরা খুঁজিস তারে
             কাঙাল-বেশে দ্বারে দ্বারে,
                 দেখা মেলে না মেলে না—
ও তোরা আয় রে ধেয়ে দেখ্‌ রে চেয়ে
                   আমার বুকে –
ওরে      দেখ্‌ রে আমার দুই নয়ানে॥
                                      [প্রস্থান

                    একদল পদাতিক ও দেশী পথিকের প্রবেশ
প্রথম পদাতিক। সরে যাও সব, সরে যাও। তফাত যাও।
কৌণ্ডিল্য। ইস, তাই তো। মস্ত লোক বটে। লম্বা পা ফেলে চলছেন। কেন রে বাপু, সরব কেন? আমরা সব পথের কুকুর না কি?
দ্বিতীয় পদাতিক। আমাদের রাজা আসছেন।
জনার্দন। রাজা? কোথাকার রাজা?
প্রথম পদাতিক। আমাদের এই দেশের রাজা।
কুম্ভ। লোকটা পাগল হল নাকি? আমাদের এই অবাক দেশের রাজা পাইক নিয়ে হাঁকতে হাঁকতে আবার রাস্তায় কবে বেরোয়?
দ্বিতীয় পদাতিক। মহারাজ আজ আর গোপন থাকবেন না, তিনি স্বয়ং আজ উৎসব করবেন।
জনার্দন। সত্যি না কি ভাই?
দ্বিতীয় পদাতিক। ওই দেখো না নিশেন উড়ছে।
কৌণ্ডিল্য। তাই তো রে, ওটা নিশেনই তো বটে।
দ্বিতীয় পদাতিক। নিশেনে কিংশুক ফুল আঁকা আছে, দেখছ না?
কুম্ভ। ওরে কিংশুক ফুলই তো বটে, মিথ্যে বলে নি — একেবারে টকটক করছে।
প্রথম পদাতিক। তবে! কথাটা যে বড়ো বিশ্বাস হল না!
জনার্দন। না দাদা, আমি তো অবিশ্বাস করি নি। ওই কুম্ভই গোলমাল করেছিল। আমি একটি কথাও বলি নি।
প্রথম পদাতিক। ওটা বোধ হয় শূন্যকুম্ভ, তাই আওয়াজ বেশি।
দ্বিতীয় পদাতিক। লোকটা কে হে? তোমাদের কে হয়?
কৌণ্ডিল্য। কেউ না, কেউ না। আমাদের গ্রামের যে মোড়ল, ও তার খুড়শ্বশুর — অন্য পাড়ায় বাড়ি।
দ্বিতীয় পদাতিক। হাঁ হাঁ, খুড়শ্বশুর গোছের চোহারা বটে, বুদ্ধিটাও নেহাত খুড়শ্বশুরে ধাঁচার।
কুম্ভ। অনেক দুঃখে বুদ্ধিটা এইরকম হয়েছে। এই যে সেদিন কোথা থেকে এক রাজা বেরোল, নামের গোড়ায় তিনশো পঁয়তাল্লিশটা শ্রী লাগিয়ে ঢাক পিটোতে পিটোতে শহর ঘুরে বেড়াল – আমি তার পিছনে কি কম ফিরেছি? কত ভোগ দিলেম কত সেবা করলেম, ভিটেমাটি বিকিয়ে যাবার জো হল। শেষকালে তার রাজাগিরি রইল কোথায়? লোকে যখন তার কাছে তালুক চায়, মুলুক চায় সে তখন পাঁজিপুঁথি খুলে শুভদিন কিছুতেই খুঁজে পায় না। কিন্তু আমাদের কাছে খাজনা নেবার বেলায় মঘা অশ্লেষা ত্র্য’স্পর্শ কিছুই তো বাধত না।
দ্বিতীয় পদাতিক। হাঁ হে কুম্ভ, আমাদের রাজাকে তুমি সেই রকম মেকি রাজা বলতে চাও।
কুম্ভ। না বাবা, রাগ করো না। আমি নাকে খত দিচ্ছি – যতদূর সরতে বল তত দূরই সরে দাঁড়াব।
দ্বিতীয় পদাতিক। আচ্ছা, বেশ এইখানে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকো। রাজা এলেন বলে – আমরা এগিয়ে গিয়ে রাস্তা ঠিক করে রাখি।
                                                                     [পদাতিকদের প্রস্থান
জনার্দন। কুম্ভ, তোমার ওই মুখের দোষেই তুমি মরবে!
কুম্ভ। না ভাই জনার্দন, ও মুখের দোষ নয়, ও কপালের দোষ। যেবারে মিছে রাজা বেরোল একটি কথাও কই নি – অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো নিজের সর্বনাশ করেছি – আর এবার হয়তো-বা সত্যি রাজা বেরিয়েছে, তাই বেফাঁস কথাটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ওটা কপাল।
জনার্দন। আমি এই বুঝি, রাজা সত্যি হউক মিথ্যে হউক, মেনে চলতেই হবে। আমরা কি রাজা চিনি যে বিচার করব। অন্ধকারে ঢেলা মারা – যত বেশি মারবে একটা না একটা লেগে যাবে। আমি তাই একধার থেকে গড় করে যাই – সত্যি হলে লাভ, মিথ্যে হলেই বা লোকসান কী।
কুম্ভ। ঢেলাগুলো নেহাত ঢেলা হলে ভাবনা ছিল না – দামি জিনিস – বাজে খরচ করতে গিয়ে ফতুর হতে হয়।
কৌণ্ডিল্য। ওই যে আসছেন রাজা। আহা রাজার মতন রাজা বটে। কী চেহারা। যেন ননির পুতুল। কেমন হে কুম্ভ, এখন কী মনে হচ্ছে।
কুম্ভ। দেখাচ্ছে ভালো – কী জানি ভাই হতে পারে।
কৌণ্ডিল্য। ঠিক যেন রাজাটি গড়ে রেখেছে। ভয় হয়, পাছে রোদ্দুর লাগলে গ’লে যায়।
                                                   রাজবেশধারীর প্রবেশ
সকলে। জয় মহারাজের জয়।
জনার্দন। দর্শনের জন্যে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে। দয়া রাখবেন।
কুম্ভ। বড়ো ধাঁধাঁ ঠেকছে, ঠাকুরদাকে ডেকে আনি।
                                        [সকলের প্রস্থান
                    বিদেশী পথিকদলের প্রবেশ
মাধব। ওরে রাজা রে রাজা। দেখবি আয়।
বিরাজদত্ত। মনে রেখো রাজা, আমি কুশলীবস্তুর উদয়দত্তর নাতি। আমার নাম বিরাজদত্ত। রাজা বেরিয়েছে শুনেই ছুটেছি, লোকের কারও কথায় কান দিই নি – আমি সক্কলের আগে তোমাকে মেনেছি।
ভদ্রসেন। শোনো একবার, আমি যে ভোর থেকে এখানে দাঁড়িয়ে—তখনও কাক ডাকে নি – এতক্ষণ ছিলে কোথায়? রাজা, আমি বিক্রমস্থলীর ভদ্রসেন – ভক্তকে স্মরণ রেখো।
রাজবেশী। তোমাদের ভক্তিতে বড়ো প্রীত হলাম।
বিরাজদত্ত। মহারাজ, আমাদের অভাব বিস্তর – এতদিন দর্শন পাই নি, জানাব কাকে?
রাজবেশী। তোমাদের সমস্ত অভাব মিটিয়ে দেব।
                              [রাজবেশীর প্রস্থান
দেশী পথিকদের প্রবেশ
কৌণ্ডিল্য। ওরে পিছিয়ে থাকলে চলবে না – ভিড়ে মিশে গেলে রাজার চোখে পড়ব না।
বিরাজদত্ত। দেখ্‌ দেখ্‌ একবার নরোত্তমের কাণ্ডখানা দেখ্‌! আমরা এত লোক আছি, সবাইকে ঠেলেঠুলে কোথা থেকে এক তালপাতার পাখা নিয়ে রাজাকে বাতাস করতে লেগে গেছে।
কৌণ্ডিল্য। তাই তো হে, লোকটার আস্পর্ধা তে কম নয়।
মাধব। ওকে জোর করে ধরে সরিয়ে দিতে হচ্ছে – ও কি রাজার পাশে দাঁড়াবার যুগ্যি।
কৌণ্ডিল্য। ওহে রাজা কি আর এটুকু বুঝবে না? এ যে অতিভক্তি।
বিরাজদত্ত। না হে না – রাজাদের যদি মগজই থাকবে তাহলে মুকুট থাকবার দরকার কী। ওই তালপাখার হাওয়া খেয়েই ভুলবে।
                                                 [সকলের প্রস্থান
                       ঠাকুরদাকে লইয়া কুম্ভের প্রবেশ
কুম্ভ। এখনই এই রাস্তা দিয়েই যে গেল।
ঠাকুরদা। রাস্তা দিয়ে গেলেই রাজা হয় নাকি রে।
কুম্ভ। দাদা, একেবারে স্পষ্ট চোখে দেখা গেল – একজন না দুজন না, রাস্তার দুধারের লোক তাকে দেখে নিয়েছে।
ঠাকুরদা। সেইজন্যেই তো সন্দেহ। কবে আমার রাজা রাস্তার লোকের চোখ ধাঁধিয়ে বেড়ায়।
কুম্ভ। তা আজকে যদি মর্জি হয়ে থাকে, বলা যায় কী।
ঠাকুরদা। বলা যায় রে বলা যায় – আমার রাজার মর্জি বরাবর ঠিক আছে – ঘড়ি-ঘড়ি বদলায় না।
কুম্ভ। কিন্তু কী বলব দাদা – একেবারে ননির পুতুলটি। ইচ্ছে করে সর্বাঙ্গ দিয়ে তাকে ছায়া করে রাখি।
ঠাকুরদা। তোর এমন বুদ্ধি কবে হল? আমার রাজা ননির পুতুল, আর তুই তাকে ছায়া ক’রে রাখবি।
কুম্ভ। যা বল দাদা, দেখতে বড়ো সুন্দর – আজ তো এত লোক জুটেছে অমনটি কাউকে দেখলুম না।
ঠাকুরদা। আমার রাজা তোদের চোখেই পড়ত না।
কুম্ভ। ধ্বজা দেখতে পেলুম যে গো। লোকে যে বলে, এই উৎসবে রাজা বেরিয়েছে।
ঠাকুরদা। বেরিয়েছে বৈকি। কিন্তু সঙ্গে পাইক নেই, বাদ্যি নেই।
কুম্ভ। কেউ বুঝি ধরতেই পারে না?
ঠাকুরদা। হয়তো কেউ কেউ পারে।
কুম্ভ। যে পারে সে বোধ হয় যা চায় তাই পায়।
ঠাকুরদা। সে কিচ্ছু চায় না। ভিক্ষুকের কর্ম নয় রাজাকে চেনা। ছোটো ভিক্ষুক বড়ো ভিক্ষুককেই রাজা বলে মনে করে বসে।
                                [সকলের প্রস্থান
          রাজা বিজয়বর্মা, বিক্রমবাহু ও বসুসেনের প্রবেশ
বসুসেন। এই উৎসবের রাজা কি আমাদেরও দেখা দেবে না?
বিক্রম। এর রাজত্ব করবার প্রণালী কী রকম? রাজার বনে উৎসব, সেখানেও সাধারণ লোকের কারো কোনো বাধা নেই?
বিজয়। আমাদের জন্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জায়গা তৈরি করে রাখা উচিত ছিল।
বিক্রম। জোর করে নিজেরা তৈরি করে নেব।
বিজয়। এই-সব দেখেই সন্দেহ হয়, এখানে রাজা নেই, একটা ফাঁকি চলে আসছে।
বিক্রম। কিন্তু কান্তিকরাজকন্যা সুদর্শনা তো দৃষ্টিগোচর।
বিজয়। তাঁকে দেখা চাই। যিনি দেখা দেন না তাঁর জন্যে আমার ঔৎসুক্য নেই, কিন্তু যিনি দেখবার যোগ্য তাঁকে না দেখে ফিরে গেলে ঠকতে হবে।
বিক্রম। একটা ফন্দি দেখাই যাক-না।
বসুসেন। ফন্দি জিনিসটা খুব ভালো, যদি তার মধ্যে নিজে আটকা না পড়া যায়।
বিক্রম। এদিকে এরা কারা আসছে? সং না কি? রাজা সেজেছে!
বিজয়। এ তামাশা এখানকার রাজা সইতে পারে কিন্তু আমরা সইব না তো।
বসুসেন। কোথাকার গ্রাম্যরাজা হতেও পারে।
                          পদাতিকগণের প্রবেশ
বিক্রম। তোমাদের রাজা কোথাকার?
প্রথম পদাতিক। এই দেশের। তিনি আজ উৎসব করতে বেরিয়েছেন।
                                           [পদাতিকগণের প্রস্থান
বিজয়। এ কী কথা! এখানকার রাজা বেরিয়েছে!
বসুসেন। তাই তো। তা হলে এঁকেই দেখে ফিরতে হবে! অন্য দর্শনীয়টা?
বিক্রম। শোন কেন? এখানে রাজা নেই বলেই যে-খুশি নির্ভাবনায় আপনাকে রাজা বলে পরিচয় দেয়। দেখছ-না, যেন সেজে এসেছে – অত্যন্ত বেশি সাজ।
বসুসেন। কিন্তু লোকটাকে দেখাচ্ছে ভালো, চোখ ভোলাবার মতো চেহারাটা আছে।
বিক্রম। চোখ ভুলতে পারে কিন্তু ভালো করে তাকালেই ভুল থাকে না। আমি তোমাদের সামনেই ওর ফাঁকি ধরে দিচ্ছি।
                                  রাজবেশী সুবর্ণের প্রবেশ
সুবর্ণ। রাজগণ, স্বাগত। এখানে তোমাদের অভ্যর্থনার কোনো ত্রুটি হয় নি তো?
রাজগণ। (কপট বিনয়ে নমস্কার করিয়া) কিছু না।
বিক্রম। যে অভাব ছিল তা মহারাজের দর্শনেই পূর্ণ হয়েছে।
সুবর্ণ। আমি সাধারণের দর্শনীয় নই কিন্তু তোমরা আমার অনুগত, এই জন্যই একবার দেখা দিতে এলুম।
বিক্রম। অনুগ্রহের এত আতিশয্য সহ্য করা কঠিন।
সুবর্ণ। আমি অধিকক্ষণ থাকব না।
বিক্রম। সেটা অনুভবেই বুঝেছি — বেশিক্ষণ স্থায়ী হবার ভাব দেখছি নে।
সুবর্ণ। ইতিমধ্যে যদি কোনো প্রার্থনা থাকে —
বিক্রম। আছে বৈকি। কিন্তু অনুচরদের সামনে জানাতে লজ্জা বোধ করি।
সুবর্ণ। (অনুবর্তীদের প্রতি) ক্ষণকালের জন্য তোমরা দূরে যাও —(রাজগণের প্রতি) এইবার তোমাদের প্রার্থনা অসংকোচে জানাতে পারো।
বিক্রম। অসংকোচেই জানাব — তোমারও যেন লেশমাত্র সংকোচ না হয়।
সুবর্ণ। না, সে আশঙ্কা কোরো না।
বিক্রম। এস তবে — মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আমাদের প্রত্যেককে প্রণাম করো।
সুবর্ণ। বোধ হচ্ছে আমার ভৃত্যগণ বারুণী মদ্যটা রাজশিবিরে কিছু মুক্তহস্তেই বিতরণ করেছে।
বিক্রম। ভণ্ডরাজ, মদ যাকে বলে সেটা তোমার ভাগেই অতিমাত্রায় পড়েছে সেই জন্যেই এখন ধুলোয় লোটাবার অবস্থা হয়েছে।
সুবর্ণ। রাজগণ, পরিহাসটা রাজোচিত নয়।
বিক্রম। পরিহাসের অধিকার যাদের আছে তারা নিকটেই প্রস্তুত। সেনাপতি!
সুবর্ণ। আর প্রয়োজন নেই। স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি আপনারা আমার প্রণম্য। মাথা আপনিই নত হচ্ছে, কোনো তীক্ষ্ণ উপায়ে তাকে ধুলায় টানবার দরকার হবে না। আপনারা যখন আমাকে চিনেছেন তখন আমিও আপনাদের চিনে নিলুম। অতএব এই আমার প্রণাম গ্রহণ করুন। যদি দয়া করে পালাতে অনুমতি দেন তাহলে বিলম্ব করব না।
বিক্রম। পালাবে কেন? তোমাকেই আমরা এখানকার রাজা করে দিচ্ছি—পরিহাসটা শেষ করেই যাওয়া যাক। দলবল কিছু আছে?
সুবর্ণ। আছে। আরম্ভে যখন আমার দল বেশি ছিল না, তখন সবাই সন্দেহ করছিল – লোক যত বেড়ে গেল, সন্দেহ ততই দূর হল। এখন ভিড়ের লোক নিজেদের ভিড় দেখেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে, আমাকে কোনো কষ্ট পেতে হচ্ছে না।
বিক্রম। বেশ কথা। এখন থেকে আমরা তোমায় সাহায্য করব। কিন্তু তোমাকে আমাদেরও একটা কাজ করে দিতে হবে।
সুবর্ণ। আপনাদের দত্ত আদেশ এবং মুকুট আমি মাথায় করে রাখব।
বিক্রম। আর কিছু চাই নে, রাজকুমারী সুদর্শনাকে দেখতে চাই – সেইটে তোমাকে করে দিতে হবে।
সুবর্ণ। যথাসাধ্য চেষ্টার ত্রুটি হবে না।
বিক্রম। তোমার সাধ্যের উপর ভরসা নেই, আমাদের বুদ্ধিমতো চলতে হবে। আমার পরামর্শ শোনো, ভুল কোরো না।
সুবর্ণ। ভুল হবে না।
বিক্রম। করভোদ্যানের মধ্যেই রাজকুমারী সুদর্শনার প্রাসাদ।
সুবর্ণ। হাঁ মহারাজ।
বিক্রম। সেই উদ্যানে আগুন লাগাবে। তারপর অগ্নিদাহের গোলমালে কাজ সিদ্ধ করব।
সুবর্ণ। অন্যথা হবে না।
বিক্রম। দেখো হে ভণ্ডরাজ, আমরা মিথ্যা সাবধান হচ্ছি, এদেশে রাজা নেই।
সুবর্ণ। আমি সেই অরাজকতা দূর করতে বেরিয়েছি, সাধারণের জন্যে সত্য হোক মিথ্যা হোক, একটা রাজা খাড়া করা চাই; নইলে অনিষ্ট ঘটে। একটা কথা বুঝতে পারছি নে মহারাজ।
বিক্রম। আমার অনেক কথাই তুমি বুঝতে পারবে না। তবু বলো শুনি।
সুবর্ণ। রাজকুমারীর পিতা-মহারাজের কাছে দূত পাঠিয়ে কন্যাকে যথারীতি প্রার্থনা করুন-না।
বিক্রম। সে তো সকলেই করে থাকে। আমি তো সকলের দলে নই। আগুন করবে আমার ঘটকালি, আমি বিপদ ঘটিয়ে বিপদের পারে যাব।
সুবর্ণ। আপনি তো পারে যাবেন মহারাজ, আমি সামান্য লোক, পার পর্যন্ত না পৌঁছোতেও পারি।
বিক্রম। অসম্ভব নয়। কিন্তু তাতে কী আসে যায়। সামান্য লোক, কাজে লাগবে এই যথেষ্ট, তার পরে থাকবে কি না-থাকবে সেটা ভাববার কথাই নয়। — চলো আর বিলম্ব কোরো না।
বিজয়। দেখো দেখো, সেই লোকটা আবার একদল লোক নিয়ে আসছে।
বসুসেন। ও যেন উৎসবের খেয়া পার করছে; নতুন নতুন দলকে দ্বারের কাছ পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছে।
                                সদলে ঠাকুরদার প্রবেশ
বিজয়। কী হে, তুমি যে কখন কোথা দিয়ে ঘুরে আসছ, তার ঠিকানা পাবার জো নেই।
ঠাকুরদা। আমরা নটরাজের চেলা, তিনি ঘুরছেন আর ঘুরিয়ে বেড়াচ্ছেন। কোথাও দাঁড়িয়ে থাকবার জো কী – শিঙ্গা যে বেজে উঠছে।

                   নৃত্য ও গীত
মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ।
হাসিকান্না হীরাপান্না দোলে ভালে,
কাঁপে ছন্দে ভালোমন্দ তালে তালে,
নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে,
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ।
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ,
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ।
                                       [প্রস্থান

বসুসেন। লোকটার মধ্যে কিছু কৌতুক আছে।
বিক্রম। কিন্তু এ-সব লোকের কৌতুকে যোগ দেওয়া কিছু নয় – প্রশ্রয় দেওয়া হয় - চলো সরে যাই।
                                              [রাজাদের প্রস্থান

                                                                           ৩
                                                                    কুঞ্জ-বাতায়ন

         সুরঙ্গমার গান
বাহিরে ভুল হানবে যখন
       অন্তরে ভুল ভাঙবে কি?
বিষাদ-বিষে জ্বলে শেষে
       তোমার প্রসাদ মাঙবে কি?
রৌদ্রদাহ হলে সারা
নামবে কি ওর বর্ষাধারা?
       লাজের রাঙা মিটলে, হৃদয়
       প্রেমের রঙে রাঙবে কি?
যতই যাবে দূরের পানে
    বাঁধন ততই কঠিন হয়ে
    টানবে না কি ব্যথার টানে?
অভিমানের কালো মেঘে
বাদল হাওয়া লাগবে বেগে,
     নয়নজলের আবেগ তখন
     কোনোই বাধা মানবে কি?

                          সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনা। সুরঙ্গমা, ভুল তোরা করতে পারিস, কিন্তু আমার কখনোই ভুল হতে পারে না। আমি হব রানী। ঐ তো আমার রাজাই বটে।
সুরঙ্গমা। কাকে তুমি রাজা বলছ?
সুদর্শনা। ওই যার মাথায় ফুলের ছাতা ধরে আছে।
সুরঙ্গমা। ওই যাঁর পতাকায় কিংশুক আঁকা?
সুদর্শনা। আমি তো দেখবামাত্রই চিনেছি, তোর মনে কেন সন্দেহ আসছে।
সুরঙ্গমা। ও তোমার রাজা নয়। আমি যে ওকে চিনি।
সুদর্শনা। ও কে?
সুরঙ্গমা। ও সুবর্ণ। ও জুয়ো খেলে বেড়ায়।
সুদর্শনা। মিথ্যে কথা বলিস নে। সবাই ওকে রাজা বলছে। তুই বুঝি সকলের চেয়ে বেশি জানিস।
সুরঙ্গমা। ও যে সবাইকে মিথ্যে লোভ দেখাচ্ছে, সেইজন্যে সবাই ওর বশ হয়েছে। যখন ভুল ভাঙবে তখন হায় হয়ে করে মরবে।
সুদর্শনা। তোর বড়ো অহংকার হয়েছে। তুই আমার চেয়ে চিনিস?
সুরঙ্গমা। যদি আমার অহংকার থাকত, তাহলে আমি চিনতে পারতুম না।
সদর্শনা। আমি ওকেই মালা পাঠিয়ে দিয়েছি।
সুরঙ্গমা। সে মালা সাপ হয়ে তোমাকে এসে দংশন করবে।
সুদর্শনা। আমাকে অভিসম্পাত? তোর তো আস্পর্ধা কম নয়! যা এখান থেকে চলে, আমি তোর মুখ দেখব না।
                                                                           [সুরঙ্গমার প্রস্থান
আমার মন আজ এমনই চঞ্চল হয়েছে! এমন তো কোনোদিন হয় না। সুরঙ্গমা!
                         সুরঙ্গমার প্রবেশ
সুদর্শনা। আমার মালা কি ভুল পথেই গেছে?
সুরঙ্গমা। হাঁ।
সুদর্শনা। আবার সেই একই কথা? আচ্ছা বেশ, ভুল করেছি, বেশ করেছি। তিনি কেন নিজে দেখা দিয়ে ভুল ভাঙিয়ে দেন না? কিন্তু তোর কথা মানব না। যা আমার কাছ থেকে – মিছিমিছি আমার মনে ধাঁধাঁ লাগিয়ে দিস নে।
                                              [সুরঙ্গমার প্রস্থান
ভগবান চন্দ্রমা, আজ আমার চঞ্চলতার উপরে তুমি কেবলই কটাক্ষপাত করছ। স্মিত কৌতুকে সমস্ত আকাশ ভরে গেল যে! প্রতিহারী!
                                            প্রতিহারীর প্রবেশ
প্রতিহারী। কী রাজকুমারী?
সুদর্শনা। ওই যে আম্রবনবীথিকায় উৎসববালকেরা গান গেয়ে যাচ্ছে, ডাক্ ডাক্, ওদের ডেকে নিয়ে আয়। একটু গান শুনি।
                                          [প্রতিহারীর প্রস্থান
                             বালকগণের প্রবেশ
এসো এসো সব মূর্তিমান কিশোর বসন্ত, ধরো তোমাদের গান। আমার সমস্ত দেহমন গান গাইছে, কণ্ঠে আসছে না। আমার হয়ে তোমরা গাও।

          বালকগণের গান
কার হাতে এই মালা তোমার পাঠালে
আজ      ফাগুনদিনের সকালে।
   তার   বর্ণে তোমার নামের রেখা,
           গন্ধে তোমার ছন্দ লেখা,
সেই মালাটি বেঁধেছি মোর কপালে
           আজ ফাগুনদিনের সকালে॥
গানটি তোমার চলে এল আকাশে
আজ    ফাগুন দিনের বাতাসে।
     ওগো    আমার নামটি তোমার সুরে
          কেমন করে দিলে জুড়ে,
লুকিয়ে তুমি ঐ গানেরি আড়ালে,
             আজ ফাগুনদিনের সকালে॥

সুদর্শনা। হয়েছে হয়েছে, আর না। তোমাদের এই গান শুনে চোখে জল ভরে আসছে – আমার মনে হচ্ছে যা পাবার জিনিস তাকে হাতে পাবার জো নেই – তাকে হাতে পাবার দরকার নেই।
                                 [প্রণাম করিয়া বালকগণের প্রস্থান
                                     কুঞ্জদ্বার
                    ঠাকুরদা ও দেশী পথিকদের প্রবেশ
ঠাকুরদা। কী ভাই, হল তোমাদের?
কৌণ্ডিল্য। খুব হল ঠাকুরদা। এই দেখো-না একেবারে লালে লাল করে দিয়েছে। কেউ বাকি নেই।
ঠাকুরদা। বলিস কী? রাজাগুলোকে সুদ্ধ রাঙিয়েছে না কি?
জনার্দন। ওরে বাস রে! কাছে ঘেঁষে কে! তারা সব বেড়ার মধ্যে খাড়া হয়ে রইল।
ঠাকুরদা। হায় হয়ে বড়ো ফাঁকিতে পড়েছে। একটুও রং ধরাতে পারলি নে? জোর করে ঢুকে পড়তে হয়।
কুম্ভ। ও দাদা, তাদের রাঙা, সে আর-এক রঙের। তাদের চক্ষু রাঙা, তাদের পাইকগুলোর পাগড়ি রাঙা, তার উপরে খোলা তলোয়ারের যে রকম দেখলুম একটু কাছে ঘেঁষলেই একেবারে চরম রাঙা রাঙিয়ে দিত।
ঠাকুরদা। বেশ করেছিস ঘেঁষিস নি। পৃথিবীতে ওদের নির্বাসনদণ্ড – ওদের তফাতে রেখে চলতেই হবে।

           বাউলের প্রবেশ ও গান
           যা ছিল কালো ধলো
তোমার রঙে রঙে রাঙা হল।
যেমন রাঙাবরন তোমার চরণ
          তার সনে আর ভেদ না র’ল॥
    রাঙা হল বসন ভূষণ,
    রাঙা হল শয়ন স্বপন,
মন   হল কেমন দেখ্ রে,যেমন
             রাঙা কমল টলোমলো!

ঠাকুরদা। বেশ ভাই, বেশ – খুব খেলা জমেছিল?
বাউল। খুব খুব। সব লালে লাল। কেবল আকাশের চাঁদটাই ফাঁকি দিয়েছে – সাদাই রয়ে গেল।
ঠাকুরদা। বাইরে থেকে দেখাচ্ছে যেন বড়ো ভালোমানুষ। ওর সাদা চাদরটা খুলে দেখতিস যদি তাহলে ওর বিদ্যে ধরা পড়ত। চুপি চুপি ও যে আজ কত রং ছড়িয়েছে এখানে দাঁড়িয়ে সব দেখেছি। অথচ ও নিজে কি এমনি সাদাই থেকে যাবে?

                 গান
আহা      তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা
                প্রিয় আমার ওগো প্রিয়।
বড়ো     উতলা আজ পরান আমার
               খেলাতে হার মানবে কি ও?
কেবল   তুমিই কি গো এমনি ভাবে
               রাঙিয়ে মোরে পালিয়ে যাবে?
তুমি      সাধ করে নাথ ধরা দিয়ে
                আমারও রং বক্ষে নিয়ো—
এই       হৃৎকমলের রাঙা রেণু
                রাঙাবে ওই উত্তরীয়।
                            [সকলের প্রস্থান।

                        সুবর্ণ ও রাজা বিক্রমবাহুর প্রবেশ
সুবর্ণ। এ কী কাণ্ড করেছ রাজা বিক্রমবাহু?
বিক্রম। আমি কেবল এই প্রাসাদের কাছটাতেই আগুন ধরাতে চেয়েছিলুম, সে আগুন যে এত শীঘ্র এমন চারি দিক ধরে উঠবে সে আমি মনেও করি নি। এ বাগান থেকে বেরোবার পথ কোথায় শীঘ্র বলে দাও।
সুবর্ণ। পথ কোথায় আমি তো কিছুই জানি নে। যারা আমাদের এখানে এনেছিল তাদের একজনকেও দেখছি নে।
বিক্রম। তুমি তো এদেশেরই লোক – পথ নিশ্চয় জান।
সুবর্ণ। অন্তঃপুরের বাগানে কোনোদিনই প্রবেশ করি নি।
বিক্রম। সে আমি বুঝি নে, তোমাকে পথ বলতেই হবে, নইলে তোমাকে দু-টুকরো করে কেটে ফেলব।
সুবর্ণ। তাতে প্রাণ বেরোবে, পথ বেরোবার কোনো উপায় হবে না।
বিক্রম। তবে কেন বলে বেড়াচ্ছিলে তুমিই এখানকার রাজা?
সুবর্ণ। আমি রাজা না, রাজা না। (মাটিতে পড়িয়া জোড়করে) কোথায় আমার রাজা, রক্ষা করো। আমি পাপিষ্ঠ, আমাকে রক্ষা করো। আমি বিদ্রোহী, আমাকে দণ্ড দাও, কিন্তু রক্ষা করো।
বিক্রম। অমন শূন্যতার কাছে চীৎকরে করে লাভ কী? ততক্ষণ পথ বের করবার চেষ্টা করা যাক।
সুবর্ণ। আমি এইখানেই পড়ে রইলুম – আমার যা হবার তাই হবে।
বিক্রম। সে হবে না। পুড়ে মরি তো একলা মরব না – তোমাকে সঙ্গী নেব।
নেপথ্যে হইতে। রক্ষা করো, রক্ষা করো! চারিদিকে আগুন!
বিক্রম। মূঢ়, ওঠো, আর দেরি না।
                           সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনা। রাজা, রক্ষা করো। আগুনে ঘিরেছে।
সুবর্ণ। কোথায় রাজা? আমি রাজা নই।
সুদর্শনা। তুমি রাজা নও?
সুবর্ণ। আমি ভণ্ড আমি পাষণ্ড! (মুকুট মাটিতে ফেলিয়া) আমার ছলনা ধূলিসাৎ হউক।
                                          [রাজা বিক্রমের সহিত প্রস্থান
সুদর্শনা। রাজা নয়? এ রাজা নয়? তবে ভগবান হুতাশন, দগ্ধ করো আমাকে; আমি তোমারই হাতে আত্মসমর্পণ করব।
নেপথ্যে। ওদিকে কোথায় যাও। তোমার অন্তঃপুরের চারি দিকে আগুন ধরে গেছে, ওর মধ্যে প্রবেশ করো না।
                           সুরঙ্গমার প্রবেশ
সুরঙ্গমা। এসো।
সুদর্শনা। কোথায় যাব?
সুরঙ্গমা। ঐ আগুনের ভিতর দিয়েই চলো।
সুদর্শনা। সে কী কথা?
সুরঙ্গমা। আগুনকে বিশ্বাস করো, যাকে বিশ্বাস করেছিলে, এ তার চেয়ে ভালো।
সুদর্শনা। রাজা কোথায়?
সুরঙ্গমা। রাজাই আছেন ওই আগুনের মধ্যে। তিনি সোনাকে পুড়িয়ে নেবেন।
সুদর্শনা। সত্যি বলছিস?
সুরঙ্গমা। আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি, আগুনের ভিতরকার রাস্তা জানি।
                                        [উভয়ের প্রস্থান
                              গানের দলের প্রবেশ

                 গান
     আগুনে হল আগুনময়।
            জয় আগুনের জয়।
     মিথ্যা যত হৃদয় জুড়ে
     এইবেলা সব যাক-না পুড়ে,
মরণ-মাঝে তোর জীবনের হোক রে পরিচয়॥
    আগুন এবার চলল রে সন্ধানে
    কলঙ্ক তোর লুকিয়ে কোথায় প্রাণে।
           আড়াল তোমার যাক-না ঘুচে,
           লজ্জা তোমার যাক রে মুছে,
চিরদিনের মতো তোমার ছাই হয়ে যাক ভয়॥
                             [গানের দলের প্রস্থান

                        সুদর্শনা ও সুরঙ্গমার পুনঃপ্রবেশ
সুরঙ্গমা। ভয় নেই, তোমার ভয় নেই।
সুদর্শনা। ভয় আমার নেই – কিন্তু লজ্জা! লজ্জা যে আগুনের মতো আমার সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। আমার মুখ চোখ, আমার সমস্ত হৃদয়টাকে রাঙা করে রেখেছে।
সুরঙ্গমা। এ দাহ মিটতে সময় লাগবে।
সুদর্শনা। কোনোদিন মিটবে না, কোনোদিন মিটবে না।
সুরঙ্গমা। হতাশ হোয়ো না। তোমার সাধ তো মিটেছে, আগুনের মধ্যেই তো আজ দেখে নিলে।
সুদর্শনা। আমি কি এমন সর্বনাশের মধ্যে দেখতে চেয়েছিলুম? কী দেখলুম জানি নে, কিন্তু বুকের মধ্যে এখনও কাঁপছে।
সুরঙ্গমা। কেমন দেখলে?
সুদর্শনা। ভয়ানক, সে ভয়ানক। সে আমার স্মরণ করতেও ভয় হয়। কালো, কালো। আমার মনে হল ধূমকেতু যে আকাশে উঠেছে সেই আকাশের মতো কালো – ঝড়ের মেঘের মতো কালো— কূলশূন্য সমুদ্রের মতো কালো।
                                                  [প্রস্থান
সুরঙ্গমা। যে কালো দেখে আজ তোমার বুক কেঁপে গেছে সেই কালোতেই এক দিন তোমার হৃদয় স্নিগ্ধ হয়ে যাবে। নইলে ভালোবাসা কিসের?
 

                 গান
আমি    রূপে তোমায় ভোলাব না,
              ভালোবাসায় ভোলাব।
আমি    হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো
              গান দিয়ে দ্বার খোলাব॥
        ভরাব না ভূষণভারে,
        সাজাব না ফুলের হারে,
        প্রেমকে আমার মালা করে
             গলায় তোমার দোলাব॥
       জানবে না কেউ কোন্‌ তুফানে
       তরঙ্গদল নাচবে প্রাণে,
       চাঁদের মতো অলখ টানে
            জোয়ারে ঢেউ তোলাব॥

                              সুদর্শনার পুনঃ প্রবেশ
সুদর্শনা। কিন্তু কেন সে আমাকে জোর করে পথ আটকায় না? কেশের গুচ্ছ ধরে কেন সে আমাকে টেনে রেখে দেয় না? আমাকে কিছু সে বলছে না, সেই জন্যেই আরও অসহ্য বোধ হচ্ছে।
সুরঙ্গমা। রাজা কিছু বলছে না, কে তোমাকে বললে?
সুদর্শনা। অমন করে নয়, চীৎকার করে বজ্রগর্জনে — আমার কান থেকে অন্য সকল কথা ডুবিয়ে দিয়ে। রাজা, আমাকে এত সহজে ছেড়ে দিয়ো না, যেতে দিয়ো না।
সুরঙ্গমা। ছেড়ে দেবেন, কিন্তু যেতে দেবেন কেন?
সুদর্শনা। যেতে দেবেন না? আমি যাবই।
সুরঙ্গমা। আচ্ছা যাও।
সুদর্শনা। আমার দোষ নেই। আমাকে জোর করে তিনি ধরে রাখতে পারতেন কিন্তু রাখলেন না। আমাকে বাঁধলেন না — আমি চললুম। এইবার তাঁর প্রহরীদের হুকুম দিন, আমাকে ঠেকাক।
সুরঙ্গমা। কেউ ঠেকাবে না। ঝড়ের মুখে ছিন্ন মেঘ যেমন অবাধে চলে তেমনি তুমি অবাধে চলে যাও।
সুদর্শনা। ক্রমেই বেগ বেড়ে উঠছে — এবার নোঙর ছিঁড়ল। হয়তো ডুবব কিন্তু আর ফিরব না।
                                                [দ্রুত প্রস্থান

                                           ৪
                                      রাজপথ
                               নাগরিকদলের প্রবেশ
প্রথম। এটি ঘটালেন আমাদের রাজকন্যা সুদর্শনা।
দ্বিতীয়। সকল সর্বনাশের মূলেই স্ত্রীলোক আছে। বেদেই তো আছে,— কী আছে বলো-না হে বটুকেশ্বর— তুমি বামুনের ছেলে।
তৃতীয়। আছে, আছে বৈকি। বেদে যা খুঁজবে তাই পাওয়া যাবে— অষ্টাবক্র বলেছেন, নারীণাঞ্চ নখিনাঞ্চ শৃঙ্গিণাং শস্ত্রপাণিনাং—অর্থাৎ কিনা–
দ্বিতীয়। আরে, বুঝেছি বুঝেছি – আমি থাকি তর্করত্নপাড়ায়— অনুস্বার -বিসর্গের একটা ফোঁটা আমার কাছে এড়াবার জো নেই।
প্রথম। আমাদের এ হল যেন কলির রামায়ণ। কোথা থেকে ঘরে ঢুকে পড়ল দশমুণ্ড রাবণ, আচমকা লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দিল।
তৃতীয়। যুদ্ধের হাওয়া তো চলছে, এদিকে রাজকন্যা যে কোথায় অদর্শন হয়েছেন কেউ খোঁজ পায় না। মহারাজ তো বন্দী, এদিকে কে যে লড়াই চালাচ্ছে তারও কোনো ঠিকানা নেই।
দ্বিতীয়। কিন্তু আমি ভাবছি, এখন আমাদের উপায় কী? আমাদের ছিল এক রাজা এখন সাতটা হতে চলল, বেদে পুরাণে কোথাও তো এর তুলনা মেলে না।
প্রথম। মেলে বৈকি – পঞ্চপাণ্ডবের কথা ভেবে দেখো।
তৃতীয়। আরে সে হল পঞ্চপতি –
প্রথম। একই কথা। তারা হল পতি, এরা হল নৃপতি। কোনোটারই বাড়াবাড়ি সুবিধে নয়।
তৃতীয়। আমাদের পাঁচকড়ি একেবারে বেদব্যাস হয়ে উঠল হে — রামায়ণ মহাভারত ছাড়া কথাই কয় না।
দ্বিতীয়। তোরা তো রামায়ণ মহাভারত নিয়ে পথের মধ্যে আসর জমিয়েছিস, এদিকে আমাদের নিজের কুরুক্ষেত্রে কী ঘটছে খবর কেউ রাখিস নে।
প্রথম। ওরে বাবা – সেখানে যাবে কে? খবর যখন আসবে তখন ঘাড়ের উপর এসে আপনি পড়বে— জানতে বাকি থাকবে না।
দ্বিতীয়। ভয় কিসের রে?
প্রথম। তা তো সত্যি। তুমি যাও না।
তৃতীয়। আচ্ছা, চলো-না ধনঞ্জয়ের ওখানে। সে সব খবর জানে।
দ্বিতীয়। না জানলেও বানিয়ে দিতে জানে।
                                                          [সকলের প্রস্থান
                                                সুদর্শনা ও সুরঙ্গমার প্রবেশ
সুদর্শনা। একদিন আমাকে সকলে সৌভাগ্যবতী বলত, আমি যেখানে যেতুম সেখানেই ঐশ্বর্যের আলো জ্বলে উঠত। আজ আমি এ কী অকল্যাণ সঙ্গে করে এনেছি। তাই আমি ঘর ছেড়ে পথে এলুম।
সুরঙ্গমা। মা, যতক্ষণ না সেই রাজার ঘরে পৌঁছোবে ততক্ষণ তো পথই বন্ধু।
সুদর্শনা। চুপ কর, চুপ কর, তার কথা আর বলিস নে।
সুরঙ্গমা। তুমি যে তাঁর কাছেই ফিরে যাচ্ছ।
সুদর্শনা। কখনোই না।
সুরঙ্গমা। কার উপরে রাগ করছ মা!
সুদর্শনা। আমি তার নাম করতেও চাই নে।
সুরঙ্গমা। আচ্ছা, নাম কোরো না, তাঁর সবুর সইবে।
সুদর্শনা। আমি পথে বেরোলুম, সঙ্গে সে এল না?
সুরঙ্গমা। সমস্ত পথ জুড়ে আছেন তিনি।
সুদর্শনা। একবার বারণও করলে না? চুপ করে রইলি যে? বল-না, তোর রাজার এ কী রকম ব্যবহার?
সুরঙ্গমা। সে তো সবাই জানে, আমার রাজা নিষ্ঠুর। তাঁকে কি কেউ কোনোদিন টলাতে পারে?
সুদর্শনা। তবে তুই এমন দিনরাত ডাকিস কেন?
সুরঙ্গমা। সে যেন এমনি পর্বতের মতোই চিরদিন কঠিন থাকে। আমার দুঃখ আমার থাক্, সেই কঠিনেরই জয় হউক।
                                                 [সুদর্শনার প্রস্থান

                 সুরঙ্গমার গান
       ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর,
তোমার প্রেম তোমারে এমন করে
                  করেছে নিষ্ঠুর।
তুমি       বসে থাকতে দেবে না যে,
            দিবানিশি তাই তো বাজে
            পরান মাঝে এমন কঠিন সুর॥
   ওগো    আমার প্রাণের ঠাকুর,
              তোমার লাগি দুঃখ আমার
                       হয় যেন মধুর।
              তোমার খোঁজা খোঁজায় মোরে,
              তোমার বেদন কাঁদায় ওরে,
              আরাম যত করে কোথায় দূর॥
                                [সুরঙ্গমার প্রস্থান

                 রাজা বিক্রম ও সুবর্ণের প্রবেশ
বিক্রম। কে যে বললে সুদর্শনা এই পথ দিয়ে পালিয়েছে। যুদ্ধে তার বাপকে বন্দী করা মিথ্যে হবে যদি সে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়।
সুবর্ণ। পালিয়ে যদি গিয়ে থাকে, তাহলে তো বিপদ কেটে গেছে। এখন ক্ষান্ত হোন।
বিক্রম। কেন বলো তো?
সুবর্ণ। দুঃসাহসিকতা হচ্ছে।
বিক্রম। তাই যদি না হবে, তবে কাজে প্রবৃত্ত হয়ে সুখ কী?
সুবর্ণ। কান্তিকরাজকে ভয় না করলেও চলে কিন্তু –
বিক্রম। ওই কিন্তুটাকে ভয় করতে শুরু করলে জগতে টেকা দায় হয়।
সুবর্ণ। মহারাজ, ওই কিন্তুটাকে না হয় মন থেকে উড়িয়ে দিলেন, কিন্তু ও যে বাইরে থেকেই হঠাৎ উড়ে এসে দেখা দেয়। ভেবে দেখুন-না, বাগানে কী কাণ্ডটা হল। খুব করেই আটঘাট বেঁধেছিলেন, তার মধ্যে কোথা থেকে অগ্নিমূর্তি ধরে ঢুকে পড়ল একটা কিন্তু।
                                বসুসেন ও বিজয়বর্মার প্রবেশ
বসুসেন। অন্তঃপুরে ঘুরে এলুম কোথাও তো তাকে পাওয়া গেল না। দৈবজ্ঞ যে বলেছিল, আমাদের যাত্রা শুভ, সেটা বুঝি মিথ্যা হল।
বিজয়। পাওয়ার চেয়ে না পাওয়াতেই হয়তো শুভ, কে বলতে পারে?
বিক্রম। এ কী উদাসীনের মতো কথা বলছ।
বসুসেন। এ কী! ভূমিকম্প না কি!
বিক্রম। ভূমিই কাঁপছে বটে, কিন্তু তাই বলে পা কাঁপতে দেওয়া হবে না।
বসুসেন। এটা দুর্লক্ষণ।
বিক্রম। কোনো লক্ষণই দুর্লক্ষণ নয়, যদি সঙ্গে ভয় না থাকে।
বসুসেন। দৃষ্ট কিছুকে ভয় করি নে কিন্তু অদৃষ্ট পুরুষের সঙ্গে লড়াই চলে না।
বিক্রম। অদৃষ্ট দৃষ্ট হয়েই আছেন, তখন তাঁর সঙ্গে খুবই লড়াই চলে।
                       দূতের প্রবেশ
দূত। মহারাজ, সৈন্যরা প্রায় সকলে পালিয়েছে।
বিক্রম। কেন?
দূত। তাদের মধ্যে অকারণে কেমন একটা আতঙ্ক ঢুকে গেল — কাউকে আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
বিক্রম। আচ্ছা, তাদের ফিরিয়ে আনছি। যুদ্ধের পর হারা চলে কিন্তু যুদ্ধের আগে হার মানতে পারব না।
                                                    [বিক্রমবাহু ও দূতের প্রস্থান
বিজয়। যার জন্য যুদ্ধ সেও পালায়, যাদের নিয়ে যুদ্ধ তারাও পালায়, এখন আমাদেরই কি পালানো দোষের।
বসুসেন। মনে ধাঁধাঁ লেগেছে, কিছু স্থির করতে পারছি নে।
                                            [উভয়ের প্রস্থান
সুরঙ্গমার প্রবেশ

                     গান
         বসন্ত, তোর শেষ করে দে রঙ্গ,
ফুল ফোটাবার খ্যাপামি, তার
            উদ্দাম তরঙ্গ॥
    উড়িয়ে দেবার, ছড়িয়ে দেবার
    মাতন তোমার থামুক এবার,
    নীড়ে ফিরে আসুক তোমার
          পথহারা বিহঙ্গ॥
    সাধের মুকুল কতই পড়ল ঝরে
তারা ধুলা হল, ধুলা দিল ভরে।
     প্রখর তাপে জরো-জরো
     ফল ফলাবার শাসন ধরো,
     হেলাফেলার পালা তোমার
     এই বেলা হোক ভঙ্গ॥

                                সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনা। এ কী হল? ঘুরে ফিরে সেই একই জায়গায় এসে পড়ছি। ঐ যে গোলমাল শোনা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে আমার চারি দিকেই যুদ্ধ চলছে। ঐ যে আকাশ ধুলোয় অন্ধকার। আমি কি এই ঘূর্ণি ধুলোর সঙ্গে সঙ্গেই অনন্তকাল ঘুরে বেড়াব? এর থেকে বেরোই কেমন করে?
সুরঙ্গমা। তুমি যে কেবল চলে যেতেই চাচ্ছ, ফিরতে চাচ্ছ না,সেই জন্য কোথাও পৌঁছোতে পাচ্ছ না।
সুদর্শনা। কোথায় ফেরবার কথা তুই বলছিস?
সুরঙ্গমা। আমাদের রাজার কাছে। আমি বলে রাখছি, যে-পথ তাঁর কাছে না নিয়ে যাবে সে-পথের অন্ত পাবে না কোথাও।
                 সৈনিকের প্রবেশ
সুদর্শনা। কে তুমি?
সৈনিক। আমি নগরের রাজপ্রাসাদের দ্বারী।
সুদর্শনা। শীঘ্র বলো সেখানকার খবর কী।
সৈনিক। মহারাজ বন্দী হয়েছেন।
সুদর্শনা। কে বন্দী হয়েছেন?
সৈনিক। আপনার পিতা।
সুদর্শনা। আমার পিতা! কার বন্দী হয়েছেন?
সৈনিক। রাজা বিক্রমবাহুর।
                           [সৈনিকের প্রস্থান
সুদর্শনা। রাজা, রাজা, দুঃখ তো আমি সইতে প্রস্তুত হয়েই বেরিয়েছিলেম, কিন্তু আমার দুঃখ চারদিকে ছড়িয়ে দিলে কেন? যে আগুন আমার বাগানে লেগেছিল সেই আগুন কি আমি সঙ্গে করে নিয়ে চলেছি। আমার পিতা তোমার কাছে কী দোষ করেছেন?
সুরঙ্গমা। আমরা যে কেউ একলা নই। ভালোমন্দ সবাইকেই ভাগ করে নিতে হয়। সেইজন্যেই তো ভয়, একলার জন্যে ভয় কিসের?
সুদর্শনা। সুরঙ্গমা!
সুরঙ্গমা। কী রাজকুমারী!
সুদর্শনা। তোর রাজার যদি রক্ষা করবার শক্তি থাকত, তাহলে আজ তিনি কি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারতেন?
সুরঙ্গমা। আমাকে কেন বলছ? আমার রাজার হয়ে উত্তর দেবার শক্তি কি আমার আছে? উত্তর যদি দেন তো নিজেই এমনি করে দেবেন যে কারও কিছু বুঝতে বাকি থাকবে না।
সুদর্শনা। রাজা, আমার পিতাকে রক্ষা করবার জন্যে যদি তুমি আসতে, তাহলে তোমার যশ বাড়ত বই কমত না।
                                       [প্রস্থানোদ্যম
সুরঙ্গমা। কোথায় যাচ্ছ?
সুদর্শনা। রাজা বিক্রমের শিবিরে। আমাকে বন্দী করুন তিনি, আমার পিতাকে ছেড়ে দিন। আমি নিজেকে যতদূর নত করতে পারি করব, দেখি কোথায় এসে ঠেকলে তোর রাজার সিংহাসন নড়ে।
                                [উভয়ের প্রস্থান
বসুসেন ও বিজয়বর্মার প্রবেশ
বসুসেন। যুদ্ধের আরম্ভেই যুদ্ধ শেষ হয়ে আছে, ভাঙা সৈন্য কুড়িয়ে এনে কখনো লড়াই চলে?
বিজয়। বিক্রমবাহুকে কিছুতেই ফেরাতে পারলুম না।
বসুসেন। সে আত্মবিনাশের নেশায় উন্মত্ত।
বিজয়। কিন্তু কে আমাকে বললে, রণক্ষেত্রে সে যেমনি গিয়ে পৌঁছেছে অমনি তার বুকে লেগেছে ঘা। এতক্ষণে তার কী হল কিছুই বলা যায় না।
বসুসেন। আমার কাছে এইটেই সব চেয়ে অদ্ভুত ঠেকছে যে, আমরা আয়োজন করলুম কতদিন থেকে, সমারোহ হল ঢের, কিন্তু শেষ হবার বেলায় এক পলকেই কী যে হয়ে গেল ভালো বুঝতে পারা গেল না।
বিজয়। রাত্রির সমস্ত তারা যেমন প্রভাতসূর্যের এক কটাক্ষেই নিবে যায়।
বসুসেন। এখন চলো।
বিজয়। কোথায়?
বসুসেন। ধরা দিতে।
বিজয়। ধরা দিতে, না পালাতে?
বসুসেন। পালানোর চেয়ে ধরা দেওয়া সহজ হবে।
                                     [উভয়ের প্রস্থান

             সুরঙ্গমার প্রবেশ
                   গান
এখনো গেল না আঁধার,
       এখনো রহিল বাধা।
এখনো মরণ-ব্রত
       জীবনে হল না সাধা।
কবে যে দুঃখজ্বালা
হবে রে বিজয়মালা,
ঝলিবে অরুণরাগে
      নিশীথরাতের কাঁদা।
এখনো নিজেরি ছায়া
      রচিছে কত যে মায়া।
এখনো কেন যে মিছে
চাহিছে কেবলি পিছে,
চকিতে বিজলি আলো
     চোখেতে লাগাল ধাঁধাঁ।

                       সুদর্শনার প্রবেশ
সুরঙ্গমা। এ লজ্জা কাটবে!
সুদর্শনা। কাটবে বৈকি সুরঙ্গমা – সমস্ত পৃথিবীর কাছে আমার নিচু হবার দিন এসেছে। কিন্তু কই রাজা এখনও কেন আমাকে নিতে আসছেন না? আরও কিসের জন্যে তিনি অপেক্ষা করছেন?
সুরঙ্গমা। আমি তো বলেছি, আমার রাজা নিষ্ঠুর – বড়ো নিষ্ঠুর।
সুদর্শনা। সুরঙ্গমা, তুই যা একবার তাঁর খবর নিয়ে আয় গে।
সুরঙ্গমা। কোথায় তাঁর খবর নেব তা তো কিছুই জানি নে। ঠাকুরদাকে ডাকতে পাঠিয়েছি— তিনি এলে হয়তো তাঁর কাছ থেকে সংবাদ পাওয়া যাবে।
সুদর্শনা। হায় কপাল, লোককে ডেকে ডেকে তাঁর খবর নিতে হবে আমার এমন দশা হয়েছে! না না, দুঃখ করব না যা হওয়া উচিত ছিল তাই হয়েছে ভালোই হয়েছে কিছু অন্যায় হয় নি।
                ঠাকুরদার প্রবেশ
সুদর্শনা। শুনেছি তুমি আমার রাজার বন্ধু – আমার প্রণাম গ্রহণ করো, আমাকে আশীর্বাদ করো।
ঠাকুরদা। করো কী, করো কী। আমি কারও প্রণাম গ্রহণ করি নে। আমার সঙ্গে সকলের হাসির সম্বন্ধ।
সুদর্শনা। তোমার সেই হাসি দেখিয়ে দাও – আমাকে সুসংবাদ দিয়ে যাও। বলো আমার রাজা কখন আমাকে নিতে আসবেন?
ঠাকুরদা। ওই তো বড়ো শক্ত কথা জিজ্ঞাসা করলে। আমার বন্ধুর ভাব-গতিক কিছুই বুঝি নে, তার আর বলব কী। যুদ্ধ তো শেষ হয়ে গেল, তিনি যে কোথায় তার কোনো সন্ধান নেই।
সুদর্শনা। চলে গিয়েছেন?
ঠাকুরদা। সাড়াশব্দ তো কিছুই পাই নে।
সুদর্শনা। চলে গিয়েছেন? তোমার বন্ধু এমনি বন্ধু!
ঠাকুরদা। সেইজন্যে লোকে তাকে নিন্দেও করে সন্দেহও করে। কিন্তু আমার রাজা তাতে খেয়ালও করে না।
সুদর্শনা। চলে গেলেন? ওরে, ওরে, কী কঠিন, কী কঠিন! একেবারে পাথর, একেবারে বজ্র। সমস্ত বুক দিয়ে ঠেলেছি – বুক ফেটে গেল – কিন্তু নড়ল না! ঠাকুরদা, এমন বন্ধুকে নিয়ে তোমার চলে কী করে?
ঠাকুরদা। চিনে নিয়েছি যে – সুখে দুঃখে তাকে চিনে নিয়েছি – এখন আর সে কাঁদাতে পারে না।
সুদর্শনা। আমাকেও কি সে চিনতে দেবে না?
ঠাকুরদা। দেবে বৈকি। নইলে এত দুঃখ দিচ্ছে কেন? ভালো করে চিনিয়ে তবে ছাড়বে, সে তো সহজ লোক নয়।
সুদর্শনা। আচ্ছা আচ্ছা, দেখব তার কতবড়ো নিষ্ঠুরতা। পথের ধারে আমি চুপ করে পড়ে থাকব – এক পা-ও নড়ব না – দেখি সে কেমন না আসে।
ঠাকুরদা। দিদি, তোমার বয়স অল্প – জেদ করে অনেকদিন পড়ে থাকতে পারো – কিন্তু আমার যে এক মুহূর্ত গেলেও লোকসান হয়। পাই না-পাই একবার খুঁজতে বেরোব।
                                      [ প্রস্থান
সুদর্শনা। চাই নে, তাকে চাই নে। সুরঙ্গমা, তোর রাজাকে আমি চাই নে। কিসের জন্যে সে যুদ্ধ করতে এল? আমার জন্যে একেবারেই না? কেবল বীরত্ব দেখাবার জন্যে?
সুরঙ্গমা। দেখাবার ইচ্ছে তাঁর যদি থাকত তাহলে এমন করে দেখাতেন কারও আর সন্দেহ থাকত না। দেখান আর কই?
সুদর্শনা। যা যা চলে যা – তোর কথা অসহ্য বোধ হচ্ছে। এত নত করলে তবু সাধ মিটল না? বিশ্বসুদ্ধ লোকের সামনে এইখানে ফেলে রেখে দিয়ে চলে গেল?
                            [উভয়ের প্রস্থান
                      নাগরিক দলের প্রবেশ
প্রথম। ওহে এতগুলো রাজা একত্র হয়ে লড়াই বাধিয়ে দিলে, ভাবলুম খুব তামাশা হবে — কিন্তু দেখতে দেখতে কী যে হয়ে গেল, বোঝাই গেল না।
দ্বিতীয়। দেখলে না, ওদের নিজেদের মধ্যে গোলমাল লেগে গেল, কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না।
তৃতীয়। পরামর্শ ঠিক রইল না যে। কেউ এগোতে চায় কেউ পিছোতে চায় — কেউ এদিকে যায় কেউ ওদিকে যায়, একে কি আর যুদ্ধ বলে? কিন্তু লড়েছিল রাজা বিক্রমবাহু, সে-কথা বলতেই হবে।
প্রথম। সে যে হেরেও হারতে চায় না।
দ্বিতীয়। শেষকালে অস্ত্রটা তার বুকে এসে লাগল।
তৃতীয়। সে যে পদে পদেই হারছিল, তা যেন টেরও পাচ্ছিল না।
প্রথম। অন্য রাজারা তো তাকে ফেলে কে কোথায় পালাল, তার ঠিক নেই।
                                [সকলের প্রস্থান
                          অন্য দলের প্রবেশ
প্রথম। শুনেছি বিক্রমবাহু মরে নি।
তৃতীয়। না, কিন্তু বিক্রমবাহুর বিচারটা কী রকম হল?
দ্বিতীয়। শুনেছি বিচারকর্তা স্বহস্তে রাজমুকুট পরিয়ে দিয়েছে।
তৃতীয়। এটা কিন্তু একেবারেই বোঝা গেল না।
দ্বিতীয়। বিচারটা যেন কেমন বেখাপ রকম শোনাচ্ছে।
প্রথম। তা তো বটেই। অপরাধ যা কিছু করেছে, সে তো ওই বিক্রমবাহুই।
দ্বিতীয়। আমি যদি বিচারক হতুম, তাহলে কি আর আস্ত রাখতুম? ওর আর চিহ্ন দেখাই যেত না।
তৃতীয়। কী জানি,বিচারকর্তাকে দেখি নে, তার বুদ্ধিটাও দেখা যায় না।
প্রথম। ওদের বুদ্ধি ব’লে কিছু আছে কি! এর মধ্যে সবই মর্জি। কেউ তো বলবার লোক নেই।
দ্বিতীয়। যা বলিস ভাই, আমাদের হাতে শাসনের ভার যদি পড়ত, তাহলে এর চেয়ে ঢের ভালো করে চালাতে পারতুম।
তৃতীয়। সে কি একবার করে বলতে!
                            [সকলের প্রস্থান
              ঠাকুরদাদা ও বিক্রমবাহুর প্রবেশ
ঠাকুরদা। একি বিক্রমরাজ, তুমি পথে যে।
বিক্রম। তোমার রাজা আমাকে পথেই বের করেছে।
ঠাকুরদা। ওই তো তার স্বভাব।
বিক্রম। তার পরে আর নিজের দেখা নেই।
ঠাকুরদা। সেও তার এক কৌতুক।
বিক্রম। কিন্তু আমাকে এমন করে আর কতদিন এড়াবে? যখন কিছুতেই তাকে রাজা বলে মানতেই চাই নি তখন কোথা থেকে কালবৈশাখীর মতো এসে এক মুহূর্তে আমার ধ্বজা পতাকা ভেঙে উড়িয়ে ছারখার করে দিলে আর আজ তার কাছে হার মানবার জন্যে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তার আর দেখাই নেই।
ঠাকুরদা। তা হোক, সে যতবড়ো রাজাই হোক হার-মানার কাছে তাকে হার মানতেই হবে। কিন্তু রাজন, রাত্রে বেরিয়েছ যে।
বিক্রম। ঐ লজ্জাটুকু এখনও ছাড়তে পারি নি। রাজা বিক্রম থালায় মুকুট সাজিয়ে তোমার রাজার মন্দির খুঁজে বেড়াচ্ছে, এই যদি দিনের আলোয় লোকে দেখে তাহলে যে তারা হাসবে।
ঠাকুরদা। লোকের ঐ দশা বটে। যা দেখে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে যায় তাই দেখেই বাঁদররা হাসে।
বিক্রম। কিন্তু ঠাকুরদা, তুমিও পথে যে?
ঠাকুরদা। আমিও সর্বনাশের পথ চেয়ে আছি।

                     গান
আমার সকল নিয়ে বসে আছি
               সর্বনাশের আশায়।
আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি
               পথে যে জন ভাসায়॥

বিক্রম। কিন্তু ঠাকুরদা, যে ধরা দেবে না তার কাছে ধরা দিয়ে লাভ কী বলো।
ঠাকুরদা। তার কাছে ধরা দিলে এক সঙ্গেই ধরাও দেওয়া হয় ছাড়াও পাওয়া যায়।

                     গান
যে জন      দেয় না দেখা— যায় যে দেখে
           ভালোবাসে আড়াল থেকে,
আমার      মন মজেছে সেই গভীরের
            গোপন ভালোবাসায়॥       [উভয়ের প্রস্থান

             সুরঙ্গমার প্রবেশ
                  গান
পথের সাথি, নমি বারংবার।
    পথিক জনের লহো নমস্কার॥
       ওগো বিদায়, ওগো ক্ষতি
       ওগো দিনশেষের পতি,
              ভাঙা-বাসার লহো নমস্কার॥
ওগো নব প্রভাতজ্যোতি,
ওগো চিরদিনের গতি,
    নব আশার লহ নমস্কার॥
        জীবনরথের হে সারথি,
        আমি নিত্য পথের পথী,
            পথে চলার লহ নমস্কার॥

                  সুদর্শনার প্রবেশ
সুদর্শনা। বেঁচেছি, বেঁচেছি সুরঙ্গমা। হার মেনে তবে বেঁচেছি। ওরে বাস রে। কী কঠিন অভিমান। কিছুতেই গলতে চায় না। আমার রাজা কেন আমার কাছে আসতে যাবে – আমিই তার কাছে যাব, এই কথাটা কোনোমতেই মনকে বলাতে পারছিলুম না। সমস্ত রাতটা পথে পড়ে ধুলোয় লুটিয়ে কেঁদেছি – দক্ষিনে হাওয়া বুকের বেদনার মতো হু হু করে বয়েছে, আর কৃষ্ণচতুর্দশীর অন্ধকারে বউ-কথা-কও চার পহর রাত কেবলই ডেকেছে – সে যেন অন্ধকারের কান্না!
সুরঙ্গমা। আহা কালকের রাতটা মনে হয়েছিল যেন কিছুতেই আর পোহাতে চায় না।
সুদর্শনা। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবি নে, তারই মধ্যে বার বার আমার মনে হচ্ছিল কোথায় যেন তার বীণা বাজছে। যে নিষ্ঠুর, তার কঠিন হাতে কি অমন মিনতির সুর বাজে? বাইরের লোক আমার অসম্মানটাই দেখে গেল – কিন্তু গোপন রাত্রের সেই সুরটা কেবল আমার হৃদয় ছাড়া আর তো কেউ শুনল না। সে বীণা তুই কি শুনেছিলি সুরঙ্গমা। না, সে আমার স্বপ্ন?
সুরঙ্গমা। সেই বীণা শুনব বলেই তো তোমার কাছে কাছে আছি। অভিমান-গলানো সুর বাজবে জেনেই কান পেতে পড়ে ছিলুম।
                                                                   [উভয়ের প্রস্থান

           গানের দলের প্রবেশ
                   গান
আমার      অভিমানের বদলে আজ
                   নেব তোমার মালা।
আজ       নিশিশেষে শেষ করে দিই
                   চোখের জলের পালা॥
আমার     কঠিন হৃদয়টারে
ফেলে     দিলেম পথের ধারে,
তোমার   চরণ দেবে তারে মধুর
                  পরশ পাষাণ-গালা॥
ছিল       আমার আঁধারখানি,
তারে      তুমিই নিলে টানি,
তোমার   প্রেম এল যে আগুন হয়ে
                 করল তারে আলা।
সেই যে  আমার কাছে আমি
ছিল       সবার চেয়ে দামি
তারে      উজাড় করে সাজিয়ে দিলেম
                তোমার বরণডালা॥
                                  [প্রস্থান

               সুদর্শনা ও সুরঙ্গমার পুনঃপ্রবেশ
সুদর্শনা। তার পণটাই রইল – পথে বের করলে তবে ছাড়লে! মিলন হলে এই কথাটাই তাকে বলব যে, আমিই এসেছি, তোমার আসার অপেক্ষা করি নি। বলব চোখের জল ফেলতে ফেলতে এসেছি – কঠিন পথ ভাঙতে ভাঙতে এসেছি। এ গর্ব আমি ছাড়ব না।
সুরঙ্গমা। কিন্তু সে গর্বও তোমার টিকবে না। সে যে তোমারও আগে এসেছিল নইলে তোমাকে বার করে কার সাধ্য।
সুদর্শনা। তা হয়তো এসেছিল – আভাস পেয়েছিলুম কিন্তু বিশ্বাস করতে পারি নি। যতক্ষণ অভিমান করে বসে ছিলুম ততক্ষণ মনে হয়েছিল সেও আমাকে ছেড়ে গিয়েছে – অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে যখনই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম তখনই মনে হল সেও বেরিয়ে এসেছে, রাস্তা থেকেই তাকে পাওয়া শুরু করেছি। এখন আমার মনে আর কোনো ভাবনা নেই। তার জন্যে এত যে দুঃখ এই দুঃখই আমাকে তার সঙ্গ দিচ্ছে। এত কষ্টের রাস্তা আমার পায়ের তলায় যেন সুরে সুরে বেজে উঠছে। এ যেন আমার বীণা, আমার দুঃখের বীণা; এরই বেদনার গানে তিনি এই কঠিন পাথরে এই শুকনো ধুলোয়, আপনি বেরিয়ে এসেছেন। আমার হাত ধরেছেন। সেই আমার অন্ধকারের মধ্যে যেমন করে হাত ধরতেন, হঠাৎ চমকে উঠে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত, এও সেইরকম। কে বললে, তিনি নেই, সুরঙ্গমা, তুই কি বুঝতে পারছিস নে তিনি লুকিয়ে এসেছেন?

             সুরঙ্গমার গান
আমার     আর হবে না দেরি,
আমি       শুনেছি ওই বাজে তোমার ভেরী॥
                 তুমি কি নাথ দাঁড়িয়ে আছ
                      আমার যাবার পথে,
                 মনে হয় যে ক্ষণে ক্ষণে
                      মোর বাতায়ন হতে
                      তোমায় যেন হেরি॥
আমার   স্বপন হল সারা
এখন    প্রাণে বীণা বাজায় ভোরের তারা।
                 দেবার মতো যা ছিল মোর
                      নাই কিছু আর হাতে,
                তোমার আশীর্বাদের মালা
                     নেব কেবল মাথে
                     আমার ললাট ঘেরি॥

সুদর্শনা। ও কে ও! চেয়ে দেখ্‌ সুরঙ্গমা, এত রাত্রে এই আঁধারে পথে আরও একজন পথিক বেরিয়েছে যে।
সুরঙ্গমা। মা, এ যে বিক্রম রাজা দেখছি!
সুদর্শনা। বিক্রম রাজা?
সুরঙ্গমা। ভয় করো না।
সুদর্শনা। ভয়! ভয় কেন করব। ভয়ের দিন আমার আর নেই।
                      রাজা বিক্রমবাহুর প্রবেশ
বিক্রম। তুমিও চলেছ বুঝি। আমিও এই এক পথেরই পথিক। আমাকে কিছুমাত্র ভয় কোরো না।
সুদর্শনা। ভালোই হয়েছে বিক্রমরাজ – আমরা দুজনে তাঁর কাছে পাশাপাশি চলেছি এ ঠিক হয়েছে। ঘর ছেড়ে বেরোবার মুখেই তোমার সঙ্গে আমার যোগ হয়েছিল— আজ ঘরে ফেরবার পথে সেই যোগই যে এমন শুভযোগ হয়ে উঠবে তা আগে কে মনে করতে পারত!
বিক্রম। কিন্তু তুমি যে হেঁটে চলেছ এ তো তোমাকে শোভা পায় না। যদি অনুমতি কর তাহলে এখনই রথ আনিয়ে দিতে পারি।
সুদর্শনা। না না, অমন কথা বলো না – যে-পথ দিয়ে তাঁর কাছ থেকে দূরে এসেছি, সেই পথের সমস্ত ধুলোটা পা দিয়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে ফিরব তবেই আমার বেরিয়ে আসা সার্থক হবে। রথে করে নিয়ে গেলে আমাকে ফাঁকি দেওয়া হবে।
সুরঙ্গমা। মহারাজ, তুমিও তো আজ ধুলোয়। এ পথে তো হাতি ঘোড়া রথ কারও দেখি নি।
সুদর্শনা। যখন প্রাসাদে ছিলুম তখন কেবল সোনারুপোর মধ্যেই পা ফেলেছি – আজ তাঁর ধুলোর মধ্যে চলে আমার সেই ভাগ্যদোষ খণ্ডিয়ে নেব। আজ আমার সেই ধুলোমাটির রাজার সঙ্গে পদে পদে এই ধুলোমাটিতে মিলন হচ্ছে, এ সুখের খবর কে জানত।
সুরঙ্গমা। ঐ দেখো, পূর্বদিকে চেয়ে দেখো ভোর হয়ে আসছে। আর দেরি নেই – তাঁর প্রাসাদের সোনার চূড়ার শিখর দেখা যাচ্ছে।
                         ঠাকুরদার প্রবেশ
ঠাকুরদা। ভোর হল, দিদি ভোর হল।
সুদর্শনা। তোমাদের আশীর্বাদে পৌঁছেছি।
ঠাকুরদা। কিন্তু আমাদের রাজার রকম দেখেছ? রথ নেই, বাদ্য নেই, সমারোহ নেই।
সুদর্শনা। বল কী, সমারোহ নেই? ওই যে আকাশ একেবারে রাঙা, ফুলগন্ধের অভ্যর্থনায় বাতাস একেবারে পরিপূর্ণ।
ঠাকুরদা। তা হোক, আমাদের রাজা যত নিষ্ঠুর হোক আমরা তো তেমন কঠিন হতে পারি নে — আমাদের যে ব্যথা লাগে। এই দীনবেশে তুমি রাজভবনে যাচ্ছ, এ কি আমরা সহ্য করতে পারি? একটু দাঁড়াও, আমি ছুটে গিয়ে তোমার জন্যে রানীর বেশ নিয়ে আসি।
সুদর্শনা। না না না। সে বেশ তিনি আমাকে চিরদিনের মতো ছাড়িয়েছেন – সবার সামনে আমাকে দাসীর বেশ পরিয়েছেন– বেঁচেছি বেঁচেছি – আমি আজ তাঁর দাসী – যে-কেউ তাঁর আছে, আমি আজ সকলের নীচে।
ঠাকুরদা। শত্রুপক্ষ তোমার এ দশা দেখে পরিহাস করবে, সেইটে আমাদের অসহ্য হয়।
সুদর্শনা। শত্রুপক্ষের পরিহাস অক্ষয় হোক – তারা আমার গায়ে ধুলো দিক! আজকের দিনের অভিসারে সেই ধুলোই আমার
অঙ্গরাগ।
ঠাকুরদা। এর উপরে আর কথা নেই। এখন আমাদের বসন্ত-উৎসবের শেষ খেলাটাই চলুক — ফুলের রেণু এখন থাক্, দক্ষিনে হাওয়ায় এবার ধুলো উড়িয়ে দিক। সকলে মিলে আজ ধূসর হয়ে প্রভুর কাছে যাব। গিয়ে দেখব তাঁর গায়েও ধুলো মাখা। তাঁকে বুঝি কেউ ছাড়ে, মনে করছ? যে পায় তাঁর গায়ে মুঠো মুঠো ধুলো দেয় যে।
বিক্রম। ঠাকুরদা, তোমাদের এই ধুলোর খেলায় আমাকেও ভুলো না। আমার এই রাজবেশটাকে এমনি মাটি করে নিয়ে যেতে হবে যাতে একে আর চেনা না যায়।
ঠাকুরদা। সে আর দেরি হবে না ভাই। যেখানে নেবে এসেছ এখানে যত তোমার মিথ্যে মান সব ঘুচে গেছে — এখন দেখতে দেখতে রং ফিরে যাবে। আর এই আমাদের রানীকে দেখো, ও নিজের উপর ভারি রাগ করেছিল —মনে করেছিল গয়না ফেলে দিয়ে নিজের ভুবনমোহন রূপকে লাঞ্ছনা দেবে, কিন্তু সে রূপ অপমানের আঘাতে আরও ফুটে পড়েছে — সে যেন কোথাও আর কিছু ঢাকা নেই। আমাদের রাজাটির নিজের নাকি রূপের সম্পর্ক নেই তাই তো বিচিত্র রূপ সে এত ভালোবাসে, এই রূপই তো তার বক্ষের অলংকার। সেই রূপ আপন গর্বের আবরণ ঘুচিয়ে দিয়েছে — আর আমার রাজার ঘরে কী সুরে যে এতক্ষণে বীণা বেজে উঠেছে, তাই শোনবার জন্যে প্রাণটা ছটফট করছে।
সুরঙ্গমা। ঐ যে সূর্য উঠল।
                                    [সকলের প্রস্থান

                   গান
ভোর হল বিভাবরী, পথ হল অবসান।
শুন ওই লোকে লোকে উঠে আলোকেরই গান॥
           ধন্য হলি ওরে পান্থ
           রজনীজাগরক্লান্ত,
ধন্য হল মরি মরি ধুলায় ধূসর প্রাণ॥
           বনের কোলের কাছে
           সমীরণ জাগিয়াছে;
           মধুভিক্ষু সারে সারে
                 আগত কুঞ্জের দ্বারে।
হল তব যাত্রা সারা,
মোছো মোছো অশ্রুধারা,
লজ্জা ভয় গেল ঝরি,
                ঘুচিল রে অভিমান॥

                                                    অন্ধকার ঘর
সুদর্শনা। প্রভু, যে আদর কেড়ে নিয়েছ সে আদর আর ফিরিয়ে দিয়ো না। আমি তোমার চরণের দাসী, আমাকে সেবার অধিকার দাও।
রাজা। আমাকে সইতে পারবে?
সুদর্শনা। পারব রাজা, পারব। আমার প্রমোদবনে আমার রানীর ঘরে তোমাকে দেখতে চেয়েছিলুম – সেখানে তোমার দাসের অধম দাসকেও তোমার চেয়ে চোখে সুন্দর ঠেকে। তোমাকে তেমন করে দেখবার তৃষ্ণা আমার একেবারে ঘুচে গেছে – তুমি সুন্দর নও, প্রভু সুন্দর নও, তুমি অনুপম।
রাজা। তোমারই মধ্যে আমার উপমা আছে।
সুদর্শনা। যদি থাকে তো সেও অনুপম।
রাজা। আজ এই অন্ধকার ঘরের দ্বার একেবারে খুলে দিলুম – এখানকার লীলা শেষ হল। এসো, এবার আমার সঙ্গে এসো, বাইরে চলে এসো— আলোয়।
সুদর্শনা। যাবার আগে আমার অন্ধকারের প্রভুকে আমার নিষ্ঠুরকে আমার ভয়ানককে প্রণাম করে নিই।
                                                     [প্রস্থান

                   গান
অরূপবীণা রূপের আড়ালে লুকিয়ে বাজে,
সে বীণা আজি উঠিল বাজি হৃদয়-মাঝে॥
        ভুবন আমার ভরিল সুরে,
        ভেদ ঘুচে যায় নিকটে দূরে,
সেই রাগিণী লেগেছে আমার সকল কাজে॥
হাতে পাওয়ার চোখে চাওয়ার সকল বাঁধন,
গেল কেটে আজ সফল হল সকল কাঁদন।
        সুরের রসে হারিয়ে যাওয়া
       সেই তো দেখা সেই তো পাওয়া,
বিরহ মিলন মিলে গেল আজ সমান সাজে॥