বিসর্জন
চতুর্থ অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
বিচারসভা
গোবিন্দমাণিক্য রঘুপতি নক্ষত্ররায়
সভাসদ্‌গণ ও প্রহরীগণ
রঘুপতিকে

গোবিন্দমাণিক্য।    আর কিছু বলিবার আছে?
রঘুপতি।                                             কিছু নাই।
গোবিন্দমাণিক্য।    অপরাধ করিছ স্বীকার?
রঘুপতি।                                            অপরাধ?
                        অপরাধ করিয়াছি বটে। দেবীপূজা
                        করিতে পারি নি শেষ
মোহে মূঢ় হয়ে
                        বিলম্ব করেছি অকারণে। তার শাস্তি
                        দিতেছেন দেবী, তুমি উপলক্ষ শুধু।
গোবিন্দমাণিক্য।    শুন সর্বলোক, আমার নিয়ম এই

                        পবিত্র পূজার ছলে দেবতার কাছে
                        যে মোহান্ধ দিবে জীববলি, কিম্বা তারি
                        করিবে উদ্যোগ রাজ-আজ্ঞা তুচ্ছ করি,
                        নির্বাসনদণ্ড তার প্রতি। রঘুপতি,
                        অষ্ট বর্ষ নির্বাসনে করিবে যাপন;
                        তোমারে আসিবে রেখে সৈন্য চারিজন
                        রাজ্যের বাহিরে।
রঘুপতি।                                    দেবী ছাড়া এ জগতে
                        এ জানু হয় নি নত আর কারো কাছে।
                        আমি বিপ্র, তুমি শূদ্র, তবু জোড়করে
                        নতজানু আজ আমি প্রার্থনা করিব
                        তোমা কাছে
দুই দিন দাও অবসর
                        শ্রাবণের শেষ দুই দিন। তার পরে
                        শরতের প্রথম প্রত্যুষে
চলে যাব
                        তোমার এ অভিশপ্ত দগ্ধ রাজ্য ছেড়ে,
                        আর ফিরাব না মুখ।
গোবিন্দমাণিক্য।                                দুই দিন দিনু
                        অবসর।
রঘুপতি।                            মহারাজ রাজ-অধিরাজ!
                        মহিমাসাগর তুমি কৃপা-অবতার!
                        ধূলির অধম আমি, দীন, অভাজন!
                                                        [ প্রস্থান
গোবিন্দমাণিক্য।‌    নক্ষত্র, স্বীকার করো অপরাধ তব।
নক্ষত্ররায়।            মহারাজ, দোষী আমি। সাহস না হয়
                        মার্জনা করিতে ভিক্ষা।
                                                [ পদতলে পতন
গোবিন্দমাণিক্য।                                বলো তুমি কার
                        মন্ত্রণায় ভুলে এ কাজে দিয়েছ হাত?
                        স্বভাবকোমল তুমি, নিদারুণ বুদ্ধি
                        এ তোমার নহে।
নক্ষত্ররায়।                                আর কারে দিব দোষ!
                        লব না এ পাপমুখে আর কারো নাম।
                        আমি শুধু একা অপরাধী। আপনার
                        পাপমন্ত্রণায় আপনি ভুলেছি। শত
                        দোষ ক্ষমা করিয়াছ নির্বোধ ভ্রাতার,
                        আরবার ক্ষমা করো।
গোবিন্দমাণিক্য।                                নক্ষত্র, চরণ
                        ছেড়ে ওঠো, শোনো কথা। ক্ষমা কি আমার
                        কাজ? বিচারক আপন শাসনে বদ্ধ,
                        বন্দী হতে বেশি বন্দী। এক অপরাধে
                        দণ্ড পাবে এক জনে, মুক্তি পাবে আর,
                        এমন ক্ষমতা নাই বিধাতার
আমি
                        কোথা আছি!
সকলে।                                ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু!
                        নক্ষত্র তোমার ভাই।
গোবিন্দমাণিক্য।                                স্থির হও সবে।
                        ভাই বন্ধু কেহ নাহি মোর, এ আসনে
                        যতক্ষণ আছি। প্রমাণ হইয়া গেছে
                        অপরাধ। ছাড়ায়ে ত্রিপুররাজ্যসীমা
                        ব্রহ্মপুত্র নদীতীরে আছে রাজগৃহ
                        তীর্থস্নানতরে, সেথায় নক্ষত্ররায়
                        অষ্ট বর্ষ নির্বাসন করিবে যাপন।

        প্রহরীগণ নক্ষত্রকে লইয়া যাইতে উদ্যত। রাজার সিংহাসন হইতে অবরোহণ

                        দিয়ে যাও বিদায়ের আলিঙ্গন। ভাই,
                        এ দণ্ড তোমার শুধু একেলার নহে,
                        এ দণ্ড আমার। আজ হতে রাজগৃহ
                        সূচিকণ্টকিত হয়ে বিঁধিবে আমায়।
                        রহিল তোমার সাথে আশীর্বাদ মোর;
                        যত দিন দূরে র'বি রাখিবেন তোরে
                        দেবগণ।
                                            [ নক্ষত্রের প্রস্থান
                                    সভাসদ্‌গণের প্রতি
                                        সভাগৃহ ছেড়ে যাও সবে,
                        ক্ষণেক একেলা রব আমি।
                                                    [ সকলের প্রস্থান
                            দ্রুত নয়নরায়ের প্রবেশ
নয়নরায়।                                            মহারাজ,
                        সমূহ বিপদ!
গোবিন্দমাণিক্য।                    রাজা কি মানুষ নহে?
                        হায় বিধি, হৃদয় তাহার গড় নি কি
                        অতি দীনদরিদ্রের সমান করিয়া?
                        দুঃখ দিবে সবার মতন, অশ্রুজল
                        ফেলিবারে অবসর দিবে না কি শুধু?
                        কিসের বিপদ, ব'লে যাও শীঘ্র করি।
নয়নরায়।            মোগলের সৈন্য সাথে আসে চাঁদপাল,
                        নাশিতে ত্রিপুরা।
গোবিন্দমাণিক্য।                            এ নহে নয়নরায়।
                        তোমার উচিত। শত্রু বটে চাঁদপাল,
                        তাই বলে তার নামে হেন অপবাদ!
নয়নরায়।            অনেক দিয়েছ দণ্ড হীন অধীনেরে,
                        আজ এই অবিশ্বাস সব চেয়ে বেশি।
                        শ্রীচরণচ্যুত হয়ে আছি, তাই বলে
                        গিয়েছি কি এত অধঃপাতে!
গোবিন্দমাণিক্য।‌                                    ভালো করে
                        বলো আরবার, বুঝে দেখি সব।
নয়নরায়।                                            যোগ
                        দিয়ে মোগলের সাথে চাহে চাঁদপাল
                        তোমারে করিতে রাজ্যচ্যুত।
গোবিন্দমাণিক্য।                                        তুমি কোথা
                        পেলে এ সংবাদ?
নয়নরায়।                                    যেদিন আমারে প্রভু
                        নিরস্ত্র করিলে, অস্ত্রহীন লাজে চলে
                        গেনু দেশান্তরে; শুনিলাম আসামের
                        সাথে মোগলের বাধিছে বিবাদ; তাই
                        চলেছিনু সেথাকার রাজসন্নিধানে
                        মাগিতে সৈনিকপদ। পথে দেখিলাম
                        আসিছে মোগল সৈন্য ত্রিপুরার পানে
                        সঙ্গে চাঁদপাল। সন্ধানে জেনেছি তার
                        অভিসন্ধি। ছুটিয়া এসেছি রাজপদে।
গোবিন্দমাণিক্য।    সহসা এ কী হল সংসারে হে বিধাতঃ!
                        শুধু দুই-চারিদিন হল, ধরণীর
                        কোন্‌খানে ছিদ্রপথ হয়েছে বাহির,
                        সমুদয় নাগবংশ রসাতল হতে
                        উঠিতেছে চারি দিকে পৃথিবীর 'পরে

                        পদে পদে তুলিতেছে ফণা। এসেছে কি
                        প্রলয়ের কাল!
এখন সময় নহে
                        বিস্ময়ের। সেনাপতি, লহ সৈন্যভার।

দ্বিতীয় দৃশ্য
মন্দিরপ্রাঙ্গণ
জয়সিংহ ও রঘুপতি

রঘুপতি।     গেছে গর্ব, গেছে তেজ, গেছে ব্রাহ্মণত্ব।
                ওরে বৎস, আমি তোর গুরু নহি আর।
                কাল আমি অসংশয়ে করেছি আদেশ
                গুরুর গৌরবে, আজ শুধু সানুনয়ে
                ভিক্ষা মাগিবার মোর আছে অধিকার।
                অন্তরেতে সে দীপ্তি নিবেছে, যার বলে
                তুচ্ছ করিতাম আমি ঐশ্বর্যের জ্যোতি,
                রাজার প্রতাপ। নক্ষত্র পড়িলে খসি
                তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর মাটির প্রদীপ।
                তাহারে খুঁজিয়া ফিরে পরিহাসভরে
                খদ্যোত ধূলির মাঝে, খুঁজিয়া না পায়।
                দীপ প্রতিদিন নেবে, প্রতিদিন জ্বলে,
                বারেক নিবিলে তারা চির-অন্ধকার!
                আমি সেই চিরদীপ্তিহীন; সামান্য এ
                পরমায়ু, দেবতার অতি ক্ষুদ্র দান,
                ভিক্ষা মেগে লইয়াছি তারি দুটো দিন
                রাজদ্বারে নতজানু হয়ে। জয়সিংহ,
                সেই দুই দিন যেন ব্যর্থ নাহি হয়।
                সেই দুই দিন যেন আপন কলঙ্ক
                ঘুচায়ে মরিয়া যায়। কালামুখ তার
                রাজরক্তে রাঙা করে তবে যায় যেন।
                বৎস, কেন নিরুত্তর? গুরুর আদেশ
                নাহি আর; তবু তোরে করেছি পালন
                আশৈশব, কিছু নহে তার অনুরোধ?
                নহি কি রে আমি তোর পিতার অধিক
                পিতৃবিহীনের পিতা বলে? এই দুঃখ
                এত করে স্মরণ করাতে হল! কৃপা
                ভিক্ষা সহ্য হয়, ভালোবাসা ভিক্ষা করে
                যে অভাগ্য, ভিক্ষুকের অধম ভিক্ষুক
                সে যে। বৎস, তবু নিরুত্তর? জানু তবে
                আরবার নত হোক। কোলে এসেছিল
                যবে, ছিল এতটুকু, এ জানুর চেয়ে
                ছোটো
তার কাছে নত হোক জানু। পুত্র,
                ভিক্ষা চাই আমি।
জয়সিংহ।                            পিতা, এ বিদীর্ণ বুকে
                আর হানিয়ো না বজ্র। রাজরক্ত চাহে
                দেবী, তাই তারে এনে দিব। যাহা চাহে
                সব দিব। সব ঋণ শোধ করে দিয়ে
                যাব। তাই হবে। তাই হবে।
                                                    [ প্রস্থান
রঘুপতি।                                            তবে তাই
                হোক। দেবী চাহে, তাই বলে দিস। আমি
                কেহ নই। হায় অকৃতজ্ঞ, দেবী তোর
                কী করেছে? শিশুকাল হতে দেবী তোরে
                প্রতিদিন করেছে পালন? রোগ হলে
                করিয়াছে সেবা? ক্ষুধায় দিয়েছে অন্ন?
                মিটায়েছে জ্ঞানের পিপাসা? অবশেষে
                এই অকৃতজ্ঞতার ব্যথা নিয়েছে কি
                দেবী বুক পেতে? হায়, কলিকাল! থাক্‌!

তৃতীয় দৃশ্য
প্রাসাদকক্ষ
গোবিন্দমাণিক্য
নয়নরায়ের প্রবেশ

নয়নরায়।    বিদ্রোহী সৈনিকদের এনেছি ফিরায়ে,
                যুদ্ধসজ্জা হয়েছে প্রস্তুত। আজ্ঞা দাও
                মহারাজ, অগ্রসর হই
আশীর্বাদ
                করো

গোবিন্দমাণিক্য।    চলো সেনাপতি, নিজে আমি যাব
                রণক্ষেত্রে।
নয়নরায়।                        যতক্ষণ এ দাসের দেহে
                প্রাণ আছে, ততক্ষণ মহারাজ, ক্ষান্ত
                থাকো, বিপদের মুখে গিয়ে

গোবিন্দমাণিক্য।                                সেনাপতি,
                সবার বিপদ-অংশ হতে, মোর অংশ
                নিতে চাই আমি। মোর রাজ-অংশ, সব
                চেয়ে বেশি। এস সৈন্যগণ, লহ মোরে
                তোমাদের মাঝে। তোমাদের নৃপতিরে
                দূর সিংহাসনচূড়ে নির্বাসিত করে
                সমরগৌরব হতে বঞ্চিত কোরো না।

                                চরের প্রবেশ
চর।            নির্বাসনপথ হতে লয়েছে কাড়িয়া
                কুমার নক্ষত্ররায়ে মোগলের সেনা;
                রাজপদে বরিয়াছে তাঁরে। আসিছেন
                সৈন্য লয়ে রাজধানী পানে।
গোবিন্দমাণিক্য।                            চুকে গেল।
                আর ভয় নাই। যুদ্ধ তবে গেল মিটে।

                            প্রহরীর প্রবেশ
প্রহরী।        বিপক্ষশিবির হতে পত্র আসিয়াছে।
গোবিন্দমাণিক্য।    নক্ষত্রের হস্তলিপি। শান্তির সংবাদ
                হবে বুঝি।
এই কি স্নেহের সম্ভাষণ!
                এ তো নহে নক্ষত্রের ভাষা! চাহে মোর
                নির্বাসন, নতুবা ভাসাবে রক্তস্রোতে
                সোনার ত্রিপুরা
দগ্ধ করে দিবে দেশ,
                বন্দী হবে মোগলের অন্তঃপুরতরে
                ত্রিপুররমণী?
দেখি, দেখি, এই বটে
                তারি লিপি। "মহারাজ নক্ষত্রমাণিক্য!'
                মহারাজ! দেখো সেনাপতি
এই দেখো
                রাজদণ্ডে-নির্বাসিত দিয়েছে রাজারে
                নির্বাসন দণ্ড। এমনি বিধির খেলা!
নয়নরায়।    নির্বাসন! এ কী স্পর্ধা! এখনো তো যুদ্ধ
                শেষ হয় নাই।
গোবিন্দমাণিক্য।                    এ তো নহে মোগলের
                দল। ত্রিপুরার রাজপুত্র রাজা হতে
                করিয়াছে সাধ, তার তরে যুদ্ধ কেন?
নয়নরায়।    রাজ্যের মঙ্গল

গোবিন্দমাণিক্য।                    রাজ্যের মঙ্গল হবে?
                দাঁড়াইয়া মুখোমুখি দুই ভাই হানে
                ভ্রাতৃবক্ষ লক্ষ্য করে মৃত্যুমুখী ছুরি

                রাজ্যের মঙ্গল হবে তাহে? রাজ্যে শুধু
                সিংহাসন আছে
গৃহস্থের ঘর নেই,
                ভাই নেই, ভ্রাতৃত্ববন্ধন নেই হেথা?
                দেখি দেখি আরবার
এ কি তার লিপি?
                নক্ষত্রের নিজের রচনা নহে। আমি
                দস্যু, আমি দেবদ্বেষী, আমি অবিচারী,
                এ রাজ্যের অকল্যাণ আমি! নহে, নহে,
                এ তার রচনা নহে।
রচনা যাহারই
                হোক, অক্ষর তো তারি বটে। নিজ হস্তে
                লিখেছে তো সেই। যে সর্পেরই বিষ হোক,
                নিজের অক্ষরমুখে মাখায়ে দিয়েছে,
                হেনেছে আমার বুকে।
বিধি, এ তোমার
                শাস্তি, তার নহে। নির্বাসন! তাই হোক।
                তার নির্বাসনদণ্ড তার হয়ে আমি
                নীরবে বিনম্র শিরে করিব বহন।