বিসর্জন
পঞ্চম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
মন্দির। বাহিরে ঝড়

রঘুপতি  পুজোপকরণ লইয়া

রঘুপতি।     এতদিনে আজ বুঝি জাগিয়াছে দেবী!
                ওই রোষহুহুংকার! অভিশাপ হাঁকি
                নগরের 'পর দিয়া ধেয়ে চলিয়াছ
                তিমিররূপিণী! ওই বুঝি তোর
                প্রলয়-সঙ্গিণীগণ দারুণ ক্ষুধায়
                প্রাণপণে নাড়া দেয় বিশ্বমহাতরু!
                আজ মিটাইব তোর দীর্ঘ উপবাস।
                ভক্তেরে সংশয়ে ফেলি এতদিন ছিলি
                কোথা দেবী? তোর খড়্গ তুই না তুলিলে
                আমরা কি পারি? আজ কী আনন্দ, তোর
                চণ্ডীমূর্তি দেখে! সাহসে ভরেছে চিত্ত,
                সংশয় গিয়েছে; হতমান নতশির
                উঠেছে নূতন তেজে। ওই পদধ্বনি
                শুনা যায়, ওই আসে তোর পূজা। জয়
                মহাদেবী! 
                                    অপর্ণার প্রবেশ
                দূর হ, দূর হ মায়াবিনী,

                জয়সিংহে চাস তুই? আরে সর্বনাশী!
                মহাপাতকিনী!
                                    [ অপর্ণার প্রস্থান
                এ কী অকাল-ব্যাঘাত!
                জয়সিংহ যদি নাই আসে! কভু নহে।
                সত্যভঙ্গ কভু নাহি হবে তার।
জয়
                মহাকালী, সিদ্ধিদাত্রী, জয় ভয়ংকরী!

                যদি বাধা পায়
যদি ধরা পড়ে শেষে
                যদি প্রাণ যায় তার প্রহরীর হাতে!

                জয় মা অভয়া, জয় ভক্তের সহায়!
                জয় মা জাগ্রত দেবী, জয় সর্বজয়া!
                ভক্তবৎসলার যেন দুর্নাম না রটে
                এ সংসারে, শত্রুপক্ষ নাহি হাসে যেন
                নিঃশঙ্ক কৌতুকে। মাতৃ-অহংকার যদি
                চূর্ণ হয় সন্তানের, মা বলিয়া তবে
                কেহ ডাকিবে না তোরে। ওই পদধ্বনি!
                জয়সিংহ বটে! জয় নৃমুণ্ডমালিনী,
                পাষণ্ডদলনী মহাশক্তি!

                        জয়সিংহের দ্রুত প্রবেশ
                জয়সিংহ,  রাজরক্ত কই?
জয়সিংহ।            আছে আছে। ছাড়ো মোরে।
                নিজে আমি করি নিবেদন।

                রাজরক্ত
                চাই তোর, দয়াময়ী, জগৎপালিনী
                মাতা? নহিলে কিছুতে তোর মিটিবে না
                তৃষা? আমি রাজপুত, পূর্ব পিতামহ
                ছিল রাজা, এখনো রাজত্ব করে মোর
                মাতামহবংশ
রাজরক্ত আছে দেহে।
                এই রক্ত দিব। এই যেন শেষ রক্ত
                হয় মাতা, এই রক্তে মিটে যেন
                অনন্ত পিপাসা তোর! রক্ততৃষাতুরা।
                                        [বক্ষে ছুরি বিন্ধন
রঘুপতি।    জয়সিংহ! জয়সিংহ! নির্দয়! নিষ্ঠুর!
                এ কী সর্বনাশ করিলি রে? জয়সিংহ,
                অকৃতজ্ঞ, গুরুদ্রোহী, পিতৃমর্মঘাতী,
                স্বেচ্ছাচারী! জয়সিংহ, কুলিশকঠিন!
                ওরে জয়সিংহ, মোর একমাত্র প্রাণ,
                প্রাণাধিক, জীবন-মন্থন-করা ধন!
                জয়সিংহ, বৎস মোর, হে গুরুবৎসল!
                ফিরে আয়, ফিরে আয়, তোরে ছাড়া আর
                কিছু নাহি চাহি! অহংকার অভিমান
                দেবতা ব্রাহ্মণ সব যাক! তুই আয়!

                            অপর্ণার প্রবেশ
অপর্ণা।    পাগল করিবে মোরে। জয়সিংহ, কোথা
             জয়সিংহ!
রঘুপতি।            আয় মা অমৃতময়ী! ডাক্‌
                তোর সুধাকণ্ঠে, ডাক্‌ ব্যগ্রস্বরে, ডাক্‌
                প্রাণপণে! ডাক্‌ জয়সিংহে! তুই তারে
                নিয়ে যা মা আপনার কাছে, আমি নাহি
                চাহি।
                                [ অপর্ণার মূর্ছা
                            প্রতিমার পদতলে মাথা রাখিয়া
                ফিরে দে, ফিরে দে, ফিরে দে, ফিরে দে!

দ্বিতীয় দৃশ্য
প্রাসাদ
গোবিন্দমাণিক্য ও নয়নরায়

গোবিন্দমাণিক্য।    এখনি আনন্দধ্বনি! এখনি পরেছে
                        দীপমালা নির্লজ্জ প্রাসাদ! উঠিয়াছে
                        রাজধানী-বহির্দ্বারে বিজয়তোরণ
                        পুলকিত নগরের আনন্দ-উৎক্ষিপ্ত
                        দুই বাহু-সম! এখনো প্রাসাদ হতে
                        বাহিরে আসি নি
ছাড়ি নাই সিংহাসন।
                        এতদিন রাজা ছিনু
কারো কি করি নি
                        উপকার? কোনো অবিচার করি নাই
                        দূর? কোনো অত্যাচার করি নাই শাসন?
                        ধিক্‌ ধিক্‌ নির্বাসিত রাজা! আপনারে
                        আপনি বিচার করি আপনার শোকে
                        আপনি ফেলিস অশ্রু!
                                                মর্তরাজ্য গেল,
                        আপনার রাজা তবু আমি। মহোৎসব
                        হোক আজি অন্তরের সিংহাসনতলে।

                                গুণবতীর প্রবেশ
গুণবতী।            প্রিয়তম, প্রাণেশ্বর, আর কেন নাথ?
                        এইবার শুনেছ তো দেবীর নিষেধ!
                        এস প্রভু, আজ রাত্রে শেষ পূজা করে
                        রামজানকীর মতো যাই নির্বাসনে।
গোবিন্দমাণিক্য।    অয়ি প্রিয়তমে, আজি শুভদিন মোর।
                        রাজ্য গেল, তোমারে পেলেম ফিরে। এস
                        প্রিয়ে, যাই দোঁহে দেবীর মন্দিরে, শুধু
                        প্রেম নিয়ে, শুধু পুষ্প নিয়ে, মিলনের
                        অশ্রু নিয়ে, বিদায়ের বিশুদ্ধ বিষাদ
                        নিয়ে, আজ রক্ত নয়, হিংসা নয়।
গুণবতী।                                                ভিক্ষা
                                রাখো নাথ!
গোবিন্দমাণিক্য।                            বলো দেবী!
গুণবতী।                                                হোয়ো না পাষাণ।
                        রাজগর্ব ছেড়ে দাও। দেবতার কাছে
                        পরাভব না মানিতে চাও যদি, তবু
                        আমার যন্ত্রণা দেখে গলুক হৃদয়।
                        তুমি তো নিষ্ঠুর কভু ছিলে নাকো প্রভু,
                        কে তোমারে করিল পাষাণ! কে তোমারে
                        আমার সৌভাগ্য হতে লইল কাড়িয়া!
                        করিল আমারে রাজাহীন রানী!
গোবিন্দমাণিক্য।                                            প্রিয়ে,
                        আমারে বিশ্বাস করো একবার শুধু,
                        না বুঝিয়া বোঝো মোর পানে চেয়ে। অশ্রু
                        দেখে বোঝো, আমারে যে ভালোবাস সেই
                        ভালোবাসা দিয়ে বোঝো
আর রক্তপাত
                        নহে। মুখ ফিরায়ো না দেবী, আর মোরে
                        ছাড়িয়ো না, নিরাশ কোরো না আশা দিয়ে।
                        যাবে যদি মার্জনা করিয়া যাও তবে।
                                                        [ গুণবতীর প্রস্থান
                        গেলে চলি! কী কঠিন নিষ্ঠুর সংসার।

                        ওরে কে আছিস?
কেহ নাই? চলিলাম।
                        বিদায় হে সিংহাসন! হে পুণ্য প্রাসাদ,
                        আমার পৈতৃক ক্রোড়, নির্বাসিত পুত্র
                        তোমারে প্রণাম ক'রে লইল বিদায়।

তৃতীয় দৃশ্য
অন্তঃপুরকক্ষ

গুণবতী

গুণবতী।    বাজা বাদ্য বাজা, আজ রাত্রে পূজা হবে,
                আজ মোর প্রতিজ্ঞা পুরিবে। আন্‌ বলি
                আন্‌ জবাফুল। রহিলি দাঁড়ায়ে? আজ্ঞা
                শুনিবি নে? আমি কেহ নই? রাজ্য গেছে,
                তাই ব'লে এতটুকু রানী বাকি নেই
                আদেশ শুনিবে যার কিংকর-কিংকরী?
                এই নে কঙ্কণ, এই নে হীরার কণ্ঠী

                এই নে যতেক আভরণ। ত্বরা ক'রে
                কর্‌ গিয়ে আয়োজন দেবীর পূজার।
                মহামায়া এ দাসীরে রাখিয়ো চরণে।

চতুর্থ দৃশ্য
মন্দির
রঘুপতি

রঘুপতি।    দেখো, দেখো, কী করে দাঁড়ায়ে আছে, জড়
                পাষাণের স্তূপ, মূঢ় নির্বোধের মতো।
                মূক, পঙ্গু, অন্ধ ও বধির! তোরি কাছে
                সমস্ত ব্যথিত বিশ্ব কাঁদিয়া মরিছে!
                পাষাণ চরণে তোর, মহৎ হৃদয়
                আপনারে ভাঙিছে আছাড়ি। হা হা হা হা!
                কোন্‌ দানবের এই ক্রূর পরিহাস
                জগতের মাঝখানে রয়েছে বসিয়া।
                মা বলিয়া ডাকে যত জীব, হাসে তত
                ঘোরতর অট্টহাস্যে নির্দয় বিদ্রূপ।
                দে ফিরায়ে জয়সিংহে মোর! দে ফিরায়ে!
                দে ফিরায়ে রাক্ষসী পিশাচী!

                                নাড়া দিয়া
                                                    শুনিতে কি
                পাস? আছে কর্ণ? জানিস কী করেছিস?
                কার রক্ত করেছিস পান? কোন্‌ পুণ্য
                জীবনের? কোন্‌ স্নেহদয়াপ্রীতি-ভরা
                মহা হৃদয়ের?
                                        থাক্‌ তুই চিরকাল
                এইমতো
এই মন্দিরের সিংহাসনে,
                সরল ভক্তির প্রতি গুপ্ত উপহাস!
                দিব তোর পূজা প্রতিদিন, পদতলে
                করিব প্রণাম, দয়াময়ী মা বলিয়া
                ডাকিব তোমারে। তোর পরিচয় কারো
                কাছে নাহি প্রকাশিব, শুধু ফিরায়ে দে
                মোর জয়সিংহে! কার কাছে কাঁদিতেছি!
                তবে দূর, দূর, দূর, দূর করে দাও
                হৃদয়দলনী পাষাণীরে। লঘু হোক
                জগতের বক্ষ।

                    দূরে গোমতীর জলে প্রতিমা-নিক্ষেপ
                    মশাল লইয়া বাদ্য বাজাইয়া

                        গুণবতীর প্রবেশ
গুণবতী।    জয় জয় মহাদেবী।
                    দেবী কই?
রঘুপতি।                    দেবী নাই।
গুণবতী।                                ফিরাও দেবীরে
                গুরুদেব, এনে দাও তাঁরে, রোষ শান্তি
                করিব তাঁহার। আনিয়াছি মার পূজা।
                রাজ্য পতি সব ছেড়ে পালিয়াছি শুধু
                প্রতিজ্ঞা আমার। দয়া করো, দয়া করে
                দেবীরে ফিরায়ে আনো শুধু, আজি এই
                এক রাত্রি তরে। কোথা দেবী?
রঘুপতি।    কোথাও সে
                নাই। ঊর্ধ্বে নাই, নিম্নে নাই, কোথাও সে
                নাই, কোথাও সে ছিল না কখনো।
গুণবতী।                                            প্রভু,
                এইখানে ছিল না কি দেবী?
রঘুপতি।                                        দেবী বল
                তারে? এ সংসারে কোথাও থাকিত দেবী,
                তবে সেই পিশাচীরে দেবী বলা কভু
                সহ্য কি করিত দেবী? মহত্ত্ব কি তবে
                ফেলিত নিষ্ফল রক্ত হৃদয় বিদারি
                মূঢ় পাষাণের পদে? দেবী বল তারে?
                পুণ্যরক্ত পান ক'রে সে মহারাক্ষসী
                ফেটে মরে গেছে।
গুণবতী।                            গুরুদেব, বধিয়ো না
                মোরে। সত্য করে বলো আরবার। দেবী
                নাই?
রঘুপতি।    নাই।
গুণবতী।            দেবী নাই?
রঘুপতি।                            নাই।
গুণবতী।                                        দেবী নাই?
                তবে কে রয়েছে?
রঘুপতি।                            কেহ নাই। কিছু নাই।
গুণবতী।    নিয়ে যা, নিয়ে যা পূজা! ফিরে যা, ফিরে যা!
                বল্‌ শীঘ্র কোন্‌ পথে গেছে মহারাজ।

                        অপর্ণার প্রবেশ
অপর্ণা।      পিতা!
রঘুপতি।    জননী, জননী, জননী আমার!
                পিতা! এ তো নহে ভৎর্সনার নাম। পিতা!
                মা জননী, এ পুত্রঘাতীরে পিতা ব'লে
                যে জন ডাকিত, সেই রেখে গেছে ওই
                সুধামাখা নাম তোর কণ্ঠে, এইটুকু
                দয়া করে গেছে। আহা, ডাক আরবার!
অপর্ণা।       পিতা, এস এ মন্দির ছেড়ে যাই মোরা।

                            পুষ্প-অর্ঘ্য লইয়া
                        গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ

গোবিন্দমাণিক্য।    দেবী কই?
রঘুপতি।                            দেবী নাই।
গোবিন্দমাণিক্য।                                    একি রক্তধারা!
রঘুপতি।            এই শেষ পুণ্যরক্ত এ পাপ-মন্দিরে।
                        জয়সিংহ নিবায়েছে নিজ রক্ত দিয়ে
                        হিংসারক্তশিখা।
গোবিন্দমাণিক্য।                        ধন্য ধন্য জয়সিংহ,
                        এ পূজার পুষ্পাঞ্জলি সঁপিনু তোমারে।
গুণবতী।            মহারাজ!
গোবিন্দমাণিক্য।‌                    প্রিয়তমে!
গুণবতী।                                            আজ দেবী নাই

                        তুমি মোর একমাত্র রয়েছ দেবতা।
                                                [ প্রণাম
গোবিন্দমাণিক্য।    গেছে পাপ। দেবী আজ এসেছে ফিরিয়া
                        আমার দেবীর মাঝে।
অপর্ণা।                                        পিতা চলে এসো!
রঘুপতি।             পাষাণ ভাঙিয়া গেল
জননী আমার
                        এবারে দিয়েছে দেখা প্রত্যক্ষ প্রতিমা!
                        জননী অমৃতময়ী!
অপর্ণা।                                    পিতা, চলে এসো!