বিসর্জন
 
    উৎসর্গ
শ্রীমান সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাণাধিকেষু
তোরি হাতে বাঁধা খাতা,         তারি 
শ-খানেক পাতা
                
অক্ষরেতে ফেলিয়াছি ঢেকে,
মস্তিষ্ককোটরবাসী                 
চিন্তাকীট রাশি রাশি
                
পদচিহ্ন গেছে যেন রেখে।
প্রবাসে প্রত্যহ তোরে             
হৃদয়ে স্মরণ করে
                
লিখিয়াছি নির্জন প্রভাতে,
মনে করি অবশেষে               
শেষ হলে ফিরে দেশে
                
জন্মদিনে দিব তোর হাতে।
বর্ণনাটা করি শোন্–             
একা আমি, গৃহকোণ,
                
কাগজ-পত্তর ছড়াছড়ি।
দশ দিকে বইগুলি               
সঞ্চয় করিছে ধূলি,
                
আলস্যে যেতেছে গড়াগড়ি।
শয্যাহীন খাটখানা               
এক পাশে দেয় থানা,
                
প্রকাশিয়া কাঠের পাঁজর।
তারি 'পরে অবিচারে             
যাহা-তাহা ভারে ভারে
                
স্তূপাকারে সহে অনাদর।
চেয়ে দেখি জানালায়             
খালখানা শুষ্কপ্রায়,
                
মাঝে মাঝে বেধে আছে জল,
এক ধারে রাশ রাশ              
অর্ধমগ্ন দীর্ঘ বাঁশ,
                
তারি 'পরে বালকের দল।
ধরে মাছ, মারে ঢেলা–          
সারাদিন করে খেলা
                
উভচর মানবশাবক।
মেয়েরা মাজিছে গাত্র          অথবা 
কাঁসার পাত্র
                
সোনার মতন ঝক্ ঝক্।
উত্তরে যেতেছে দেখা             
পড়েছে পথের রেখা
                
শুষ্ক সেই জলপথ-মাঝে–
বহু কষ্টে ডাক ছাড়ি             
চলেছে গোরুর গাড়ি,
                
ঝিনি ঝিনি ঘণ্টা তারি বাজে।
কেহ দ্রুত কেহ ধীরে           
কেহ যায় নতশিরে,
                
কেহ যায় বুক ফুলাইয়া,
কেহ জীর্ণ টাট্টু চড়ি             
চলিয়াছে তড়বড়ি
                
দুই ধারে দু-পা দুলাইয়া।
পরপারে গায়ে গায়             
অভ্রভেদী মহাকায়
                
স্তব্ধচ্ছায় বট-অশত্থেরা,
স্নিগ্ধ বন-অঙ্কে তারি             
সুপ্তপ্রায় সারি সারি
                
কুঁড়েগুলি বেড়া দিয়ে ঘেরা–
বিহঙ্গে মানবে মিলি             
আছে হোথা নিরিবিলি,
                
ঘনশ্যাম পল্লবের ঘর–
সন্ধ্যাবেলা হোথা হতে         ভেসে আসে 
বায়ুস্রোতে
                
গ্রামের বিচিত্র গীতস্বর।
পূর্বপ্রান্তে বনশিরে             
সূর্যোদয় ধীরে ধীরে,
                
চারি দিকে পাখির কূজন।
শঙ্খঘণ্টা ক্ষণপরে             
দূর মন্দিরের ঘরে
                
প্রচারিছে শিবের পূজন।
যে প্রত্যুষে মধুমাছি             
বাহিরায় মধু যাচি
                
কুসুমকুঞ্জের দ্বারে দ্বারে
সেই ভোরবেলা আমি         মানসকুহরে নামি
                
আয়োজন অরি লিখিবারে।
লিখিতে লিখিতে মাঝে         পাখি-গান কানে 
বাজে,
                
মনে আনে কাল পুরাতন–
ওই গান, ওই ছবি,             
তরুশিরে রাঙা রবি
                
ওরা প্রকৃতির নিত্যধন।
আদিকবি বাল্মীকিরে             
এই সমীরণ ধীরে
                
ভক্তিভরে করেছে বীজন,
ওই মায়াচিত্রবৎ                 
তরুলতা ছায়াপথ
                
ছিল তাঁর পুণ্য তপোবন।
রাজধানী কলিকাতা             
তুলেছে স্পর্ধিত মাথা,
                
পুরাতন নাহি ঘেঁষে কাছে।
কাষ্ঠ লোষ্ট্র চারি দিক,          
বর্তমান-আধুনিক
                
আড়ষ্ট হইয়া যেন আছে।
"আজ' "কাল' দুটি ভাই         মরিতেছে 
জন্মিয়াই,
                
কলরব করিতেছে অত।
নিশিদিন ধূলি প'ড়ে             
দিতেছে আচ্ছন্ন করে
                
চিরসত্য আছে যেথা যত।
জীবনের হানাহানি             
প্রাণ নিয়ে টানাটানি,
                
মত নিয়ে বাক্য-বরিষন,
বিদ্যা নিয়ে রাতারাতি         পুঁথির 
প্রাচীর গাঁথি
                
প্রকৃতির গণ্ডি-বিরচন,
কেবলি নূতনে আশ,         সৌন্দর্যেতে 
অবিশ্বাস,
                
উন্মাদনা চাহি দিনরাত–
সে-সকল ভুলে গিয়ে         কোণে বসে খাতা 
নিয়ে
                
মহানন্দে কাটিছে প্রভাত।
দক্ষিণের বারান্দায়           
বেড়াই মুগ্ধের প্রায়,
                
অপরাহ্নে পড়ে তরুচ্ছায়া–
কল্পনার ধনগুলি             
হৃদয়দোলায় দুলি
                
প্রতিক্ষণে লভিতেছে কায়া।
সেবি বাহিরের বায়ু         বাড়ে তাহাদের 
আয়ু,
                
ভোগ করে চাঁদের অমিয়–
ভেদ করি মোর প্রাণ       জীবন করিয়া পান
                
হইতেছে জীবনের প্রিয়।
এত তারা জেগে আছে     নিশিদিন কাছে কাছে,
            এত কথা কয় শত 
স্বরে,
তাহাদের তুলনায়           
আর-সবে ছায়াপ্রায়
            আসে যায় নয়নের 
'পরে।
আজ সব হল সারা,         বিদায় লয়েছে তারা,
            নূতন বেঁধেছে 
ঘরবাড়ি–
এখন স্বাধীন বলে           
বাহিরে এসেছে চলে
            অন্তরের 
পিতৃগৃহ ছাড়ি।
তাই এতদিন পরে          আজি 
নিজমূর্তি ধরে
            প্রবাসের 
বিরহবেদনা,
তোদের কাছেতে যেতে     তোদিকে নিকটে পেতে
            জাগিতেছে 
একান্ত বাসনা।
সম্মুখে দাঁড়াব যবে           
"কী এনেছ' বলি সবে
            যদ্যপি শুধাস 
হাসিমুখ,
খাতাখানি বের করে         বলিব "এ পাতা 
ভরে
            আনিয়াছি 
প্রবাসের সুখ'।
সেই ছবি মনে আসে         
টেবিলের চারি পাশে
            গুটিকত চৌকি 
টেনে আনি,
শুধু জন দুই-তিন             
ঊর্ধ্বে জ্বলে কেরোসিন,
            কেদারায় বসি 
ঠাকুরানী।
দক্ষিণের দ্বার দিয়ে           
বায়ু আসে গান নিয়ে,
            কেঁপে কেঁপে 
উঠে দীপশিখা।
খাতা হাতে সুর ক'রে         অবাধে যেতেছি 
প'ড়ে,
            কেহ নাই 
করিবারে টীকা।
ঘণ্টা বাজে, বাড়ে রাত,      ফুরায় ব'য়ের পাত,
            বাহিরে 
নিস্তব্ধ চারি ধার–
তোদের নয়নে জল           করে 
আসে ছলছল্
            শুনিয়া কাহিনী 
করুণার।
তাই দেখে শুতে যাই,         আনন্দের শেষ 
নাই,
            কাটে রাত্রি 
স্বপ্ন-রচনায়–
মনে মনে প্রাণ ভরি           
অমরতা লাভ করি
            নীরব সে 
সমালোচনায়।
তার পরে দিনকত             
কেটে যায় এইমতো,
            তার পরে 
ছাপাবার পালা।
মুদ্রাযন্ত্র হতে শেষে             
বাহিরায় ভদ্রবেশে,
            তার পরে মহা 
ঝালাপালা।
রক্তমাংস-গন্ধ পেয়ে            
ক্রিটিকেরা আসে ধেয়ে,
            চারি দিকে করে 
কাড়াকাড়ি।
কেহ বলে, "ড্রামাটিক          বলা 
নাহি যায় ঠিক,
            লিরিকের বড়ো 
বাড়াবাড়ি।"
শির নাড়ি কেহ কহে,          
"সব-সুদ্ধ মন্দ নহে,
            ভালো হ'ত আরো 
ভালো হলে।"
কেহ বলে, "আয়ুহীন          বাঁচিবে 
দু-চারি দিন,
            চিরদিন রবে না 
তা ব'লে।"
কেহ বলে "এ বহিটা         লাগিতে পারিত 
মিঠা
            হ'ত যদি অন্য 
কোনোরূপ।"
যার মনে যাহা লয়           
সকলেই কথা কয়,
            আমি শুধু বসে 
আছি চুপ।
ল'য়ে নাম, ল'য়ে জাতি     বিদ্বানের মাতামাতি,
            ও-সকল আনিস নে 
কানে।
আইনের লৌহ-ছাঁচে         কবিতা কভু না 
বাঁচে,
            প্রাণ শুধু 
পায় তাহা প্রাণে।
হাসিমুখে স্নেহভরে          সঁপিলাম 
তোর করে,
            বুঝিয়া পড়িবি 
অনুরাগে।
কে বোঝে কে নাই বোঝে     ভাবুক তা নাহি খোঁজে,
            ভালো যার লাগে 
তার লাগে।
                       
– 
রবিকাকা