ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


ি ও গান
 


 

          কে ?
আমার
    প্রাণের 'পরে চলে গেল কে
বসন্তের
   বাতাসটুকুর মতো!
সে যে
     ছুঁয়ে গেল নুয়ে গেল রে,
ফুল
       ফুটিয়ে গেল শত শত।

সে
   চলে গেল, বলে গেল না,
সে
   কোথায় গেল ফিরে এল না,
সে
   যেতে যেতে চেয়ে গেল,
           কী যেন গেয়ে গেল–
তাই
  আপন মনে বসে আছি
           কুসুম-বনেতে।

সে
    ঢেউয়ের মতো ভেসে গেছে,
      চাঁদের   আলোর দেশে গেছে,
     যেখান  দিয়ে হেসে গেছে
         হাসি তার   রেখে গেছে রে।
মনে হল আঁখির কোণে
       আমায় যেন ডেকে গেছে সে।
আমি
 কোথায় যাব কোথায় যাব,
      ভাবতেছি তাই একলা বসে।

সে
   চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল
          ঘুমের ঘোর।
সে
   প্রাণের কোথা দুলিয়ে গেল
           ফুলের ডোর।
সে
   কুসুম-বনের উপর দিয়ে
           কী কথা যে বলে গেল,
     ফুলের গন্ধ পাগল হয়ে
         সঙ্গে তারি চলে গেল।
হৃদয় আমার আকুল হল,
নয়ন আমার মুদে এল,
      কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে!


              সুখস্বপ্ন
ওই    জানালার কাছে বসে আছে
           করতলে রাখি মাথা।
তার   কোলে ফুল পড়ে রয়েছে,
সে যে ভুলে গেছে মালা গাঁথ।
শুধু    ঝুরু ঝুরু বায়ু বহে যায়,
তার   কানে কানে কী যে কহে যায়,
তাই   আধো শুয়ে আধো বসিয়ে
কত    ভাবিতেছে আনমনে।
       উড়ে উড়ে যায় চুল,
কোথা উড়ে উড়ে পড়ে ফুল,
    ঝুরু ঝুরু কাঁপে গাছপালা
             সমুখের উপবনে।
    অধরের কোণে হাসিটি
             আধখানি মুখ ঢাকিয়া,
    কাননের পানে চেয়ে আছে
             আধমুকুলিত আঁখিয়া।
    সুদূর স্বপন ভেসে ভেসে
            চোখে এসে যেন লাগিছে,
    ঘুমঘোরময় সুখের আবেশ
           প্রাণের কোথায় জাগিছে।
    চোখের উপরে মেঘ ভেসে যায়,
          উড়ে উড়ে যায় পাখি,
    সারাদিন ধরে বকুলের ফুল
          ঝরে পড়ে থাকি থাকি।
    মধুর আলস, মধুর আবেশ,
          মধুর মুখের হাসিটি,
    মধুর স্বপনে প্রাণের মাঝারে
          বাজিছে মধুর বাঁশিটি।

 


         জাগ্রত স্বপ্ন
আজ    একেলা বসিয়া, আকাশে চাহিয়া,
               কী সাধ যেতেছে, মন!
         বেলা চলে যায় — আছিস কোথায় ?
              কোন্‌ স্বপনেতে নিমগন ?
         বসন্তবাতাসে আঁখি মুদে আসে,
              মৃদু মৃদু বহে শ্বাস,
         গায়ে এসে যেন এলায়ে পড়িছে
              কুসুমের মৃদু বাস।
যেন   সুদূর নন্দনকাননবাসিনী
        সুখঘুমঘোরে মধুরহাসিনী,
        অজানা প্রিয়ার ললিত পরশ
             ভেসে ভেসে বহে যায়,
অতি     মৃদু মৃদু লাগে গায়।
    বিস্মরণমোহে আঁধারে আলোকে
            মনে পড়ে যেন তায়,
    স্মৃতি-আশা-মাখা মৃদু সুখে দুখে
           পুলকিয়া উঠে কায়।
     ভ্রমি আমি যেন সুদূর কাননে,
           সুদূর আকাশতলে,
     আনমনে যেন গাহিয়া বেড়াই
           সরযূর কলকলে।
     গহন বনের কোথা হতে শুনি
           বাঁশির স্বর-আভাস,
     বনের হৃদয় বাজাইছে যেন
           মরমের অভিলাষ।
     বিভোর হৃদয়ে বুঝিতে পারি নে
          কে গায় কিসের গান,
     অজানা ফুলের সুরভি মাখানো
         স্বরসুধা করি পান।

    যেন রে কোথায় তরুর ছায়ায়
         বসিয়া রূপসী বালা,
     কুসুমশয়নে আধেক মগনা
     বাকলবসনে আধেক নগনা,
     সুখদুখগান গা ই ছে শুইয়া
            গাঁথিতে গাঁথিতে মালা।
     ছায়ায় আলোকে, নিঝরের ধারে,
    কোথা কোন্‌ গুপ্ত গুহার মাঝারে,
    যেন হেথা হোথা কে কোথায় আছে
            এখনি দেখিতে পাব —
   যেন রে তাদের চরণের কাছে
           বীণা লয়ে গান গাব।
   শুনে শুনে তারা আনত নয়নে
          হাসিবে মুচুকি হাসি,
    শরমের আভা অধরে কপোলে
         বেড়াইবে ভাসি ভাসি।
    মাথায় বাঁধিয়া ফুলের মালা
         বেড়াইব বনে বনে।
    উড়িতেছে কেশ, উড়িতেছে বেশ,
    উদাস পরান কোথা নিরুদ্দেশ,
    হাতে লয়ে বাঁশি মুখে লয়ে হাসি,
         ভ্রমিতেছি আনমনে।
    চারি দিকে মোর বসন্ত হসিত,
    যৌবনকুসুম প্রাণে বিকশিত,
    কুসুমের'পরে ফেলিব চরণ
         যৌবনমাধুরীভরে।
    চারি দিকে মোর মাধবী মালতী
         সৌরভে আকুল করে।
 

     কেহ কি আমারে চাহিবে না ?
     কাছে এসে গান গাহিবে না ?
     পিপাসিত প্রাণে চাহি মুখপানে
              কবে না প্রাণের আশা ?
     চাঁদের আলোতে দখিন বাতাসে
     কুসুমকাননে বাঁধি বাহুপাশে
     শরমে সোহাগে মৃদুমধুহাসে
             জানাবে না ভালোবাসা ?
     আমার যৌবনকুসুমকাননে
            ললিত চরণে বেড়াবে না ?
     আমার প্রাণের লতিকা-বাঁধন
           চরণে তাহার জড়াবে না ?
     আমার প্রাণের কুসুম গাঁথিয়া
          কেহ পরিবে না গলে ?
     তাই ভাবিতেছি আপনার মনে
          বসিয়া তরুর তলে ।


           দোলা
        ঝিকিমিকি বেলা;
    গাছের ছায়া কাঁপে জলে,
    সোনার কিরণ করে খেলা।
    দুটিতে দোলার'পরে দোলে রে,
দেখে
   রবির আঁখি ভোলে রে।

গাছের ছায়া চারি দিকে আঁধার করে রেখেছে,
      লতাগুলি আঁচল দিয়ে ঢেকেছে।
ফুল
   ধীরে ধীরে মাথায় পড়ে,
     পায়ে পড়ে, গায়ে পড়ে,
থেকে থেকে বাতাসেতে ঝুরু ঝুরু পাতা নড়ে।
       নিরালা সকল ঠাঁই,
       কোথাও সাড়া নাই,
শুধু নদীটি বহে যায় বনের ছায়া দিয়ে,
      বাতাস ছুঁয়ে যায় লতারে শিহরিয়ে।
      দুটিতে বসে বসে দোলে,
বেলা কোথায় গেল চলে।
         হেরো, সুধামুখী মেয়ে
         কী চাওয়া আছে চেয়ে
     মুখানি থুয়ে তার বুকে।
     কী মায়া মাখা চাঁদমুখে।
হাতে তার কাঁকন দুগাছি,
     কানেতে দুলিছে তার দুল,
হাসি-হাসি মুখখানি তার
     ফুটেছে সাঁঝের জুঁই ফুল।
     গলেতে বাহু বেঁধে
         দুজনে কাছাকাছি —
     দুলিছে এলো চুল,
         দুলিছে মালাগাছি।
    আঁধার ঘনাইল,
    পাখিরা ঘুমাইল,
সোনার রবি-আলো আকাশে মিলাইল।
      মেঘেরা কোথা গেল চলে,
      দুজনে বসে বসে দোলে।
         ঘেঁষে আসে বুকে বুকে,
         মিলায়ে মুখে মুখে
     বাহুতে বাঁধি বাহুপাশ,
     সুধীর বহিতেছে শ্বাস।
            মাঝে মাঝে থেকে থেকে
            আকাশেতে চেয়ে দেখে,
গাছের আড়ালে দুটি তারা।
     প্রাণ কোথা উড়ে যায়,
     সেই তারা পানে ধায়,
আকাশের মাঝে হয় হারা।
      পৃথিবী ছাড়িয়া যেন তারা
       দুটিতে হয়েছে দুটি তারা।