|  | ১ আমার    মাথা নত করে দাও হে তোমার
 চরণধুলার তলে।
 সকল অহংকার হে 
		আমার
 ডুবাও চোখের জলে।
 নিজেরে করিতে গৌরব দান
 নিজেরে কেবলি করি অপমান,
 আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া
 ঘুরে মরি পলে পলে।
 সকল অহংকার হে আমার
 ডুবাও চোখের জলে।
 আমারে না যেন করি প্রচার
 আমার আপন কাজে,
 তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ
 আমার জীবনমাঝে।
 
		যাচি হে 
		তোমার চরমশান্তি    পরানে তোমার পরমকান্তি,
 
		আমারে 
		আড়াল করিয়া দাঁড়াও হৃদয়পদ্মতলে।
 
		সকল 
		অহঙ্ককার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।
 ১৩১৩
 ২
 আমি    বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই,
 বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।
 এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর
 জীবন ভ'রে।
 না চাহিতে মোরে যা 
		করেছ দান—
 আকাশ আলোক তনু মন 
		প্রাণ,
 দিনে দিনে তুমি 
		নিতেছ আমায়
 সে মহাদানেরই যোগ্য করে
 অতি-ইচ্ছার সংকট হতে
 বাঁচায়ে মোরে।
 
 আমি     কখনো-বা ভুলি, কখনো-বা চলি
 তোমার পথের লক্ষ্য ধরে;
 তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ 
		হতে
 যাও সে সরে।
 এ যে তব দয়া জানি জানি হায়,
 নিতে চাও বলে ফিরাও আমায়,
 পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন
 তব মিলনেরই 
		যোগ্য করে
 আধা-ইচ্ছার 
		সংকট হতে
 বাঁচায়ে মোরে।
 ১৩১৩
 
 ৩
 কত অজানারে জানাইলে তুমি,
 কত ঘরে দিলে ঠাঁই—
 দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
 পরকে করিলে ভাই।
 পুরানো আবাস ছেড়ে যাই যবে
 মনে ভেবে মরি কী জানি কী হবে,
 নূতনের মাঝে তুমি পুরাতন
 সে কথা যে ভুলে যাই।
 দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
 পরকে করিলে ভাই।
 
 জীবনে মরণে নিখিল ভুবনে
 যখনি 
		যেখানে লবে,
 চিরজনমের পরিচিত ওহে,
 তুমিই 
		চিনাবে সবে।
 তোমারে জানিলে নাহি কেহ পর,
 নাহি কোনো মানা, নাহি কোনো ডর;
 সবারে মিলায়ে তুমি জাগিতেছ,
 দেখা যেন সদা পাই।
 দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
 পরকে করিলে ভাই।
 ১৩১৩
 
 ৪
 বিপদে মোরে রক্ষা করো
 এ নহে মোর প্রার্থনা,
 বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
 দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে
 নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
 দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।
 সহায় মোর না যদি জুটে
 নিজের বল না যেন টুটে,
 সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি
 লভিলে শুধু বঞ্চনা
 নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।
 
 আমারে তুমি করিবে ত্রাণ
 এ নহে মোর প্রার্থনা,
 তরিতে পারি 
		শকতি যেন র।
 আমার ভার লাঘব করি
 নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
 বহিতে পারি 
		এমনি যেন হয়।
 নম্রশিরে সুখের দিনে
 তোমারি মুখ লইব চিনে,
 দুখের রাতে নিখিল ধরা
 যেদিন করে বঞ্চনা
 তোমারে যেন না 
		করি সংশয়।
 ১৩১৩
 
 ৫
 অন্তর মম বিকশিত করো
 অন্তরতর হে।
 নির্মল করো উজ্জ্বল করো,
 সুন্দর করো হে।
 জাগ্রত করো, উদ্যত করো,
 নির্ভয় করো হে।
 মঙ্গল 
		করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে।
 অন্তর মম বিকশিত করো,
 অন্তরতর হে।
 
 যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,
 মুক্ত করো হে বন্ধ,
 সঞ্চার করো সকল কর্মে
 শান্ত তোমার ছন্দ।
 চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে,
 নন্দিত করো, নন্দিত করো,
 নন্দিত করো হে।
 অন্তর মম বিকশিত করো
 অন্তরতর হে।
 
 শিলাইদহ
 ২৭ অগ্রহায়ণ ১৩১৪
 
 ৬
 প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে
 প্লাবিত করিয়া নিখিল দ্যুলোক-ভূলোকে
 তোমার অমল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া।
 দিকে দিকে আজি টুটিয়া সকল বন্ধ
 মুরতি ধরিয়া জাগিয়া ওঠে আনন্দ;
 জীবন উঠিল নিবিড় সুধায় ভরিয়া।
 
 চেতনা আমার কল্যাণ-রস-সরসে
 শতদল-সম ফুটিল পরম হরষে
 সব মধু তার চরণে তোমার ধরিয়া।
 নীরব আলোকে জাগিল হৃদয়প্রান্তে
 উদার উষার উদয়-অরুণ কান্তি,
 অলস আঁখির আবরণ গেল সরিয়া।
 অগ্রহায়ণ ১৩১৪
 
 ৭
 তুমি   নব নব রূপে এসো প্রাণে।
 এসো গন্ধে বরনে, এসো গানে।
 এসো   অঙ্গে পুলকময় পরশে,
 এসো   চিত্তে অমৃতময় হরষে,
 এসো   মুগ্ধ মুদিত দু নয়ানে।
 তুমি     নব নব রূপে এসো প্রাণে।
 এসো   নির্মল উজ্জ্বল কান্ত,
 এসো   সুন্দর স্নিগ্ধ প্রশান্ত,
 এসো   এসো হে বিচিত্র বিধানে।
 এসো    দুঃখে সুখে, এসো মর্মে,
 এসো    নিত্য নিত্য সব কর্মে;
 এসো    সকল-কর্ম-অবসানে।
 তুমি      নব নব রূপে এসো প্রাণে।
 অগ্রহায়ণ ১৩১৪?
                  
		৮আজ    ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায়
 লুকোচুরি খেলা।
 নীল আকাশে কে ভাসালে
 সাদা মেঘের ভেলা।
 আজ   ভ্রমর ভোলে মধু খেতে,
 উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে;
 আজ   কিসের তরে নদীর চরে
 চখাচখির মেলা।
 ওরে     যাব না আজ ঘরে রে ভাই,
 যাব না আজ ঘরে।
 ওরে আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ
 নেব রে লুঠ করে।
 যেন    জোয়ার-জলে ফেনার রাশি
 বাতাসে আজ ছুটছে হাসি।
 আজ    বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি
 কাটবে সকল বেলা।
 ১৩১৩
                     
		৯আনন্দেরই সাগর থেকে
 এসেছে আজ বান।
 দাঁড় ধরে আজ বোস্ রে সবাই,
 টান রে সবাই টান্।
 বোঝা যত বোঝাই করি
 করব রে পার দুখের তরী,
 ঢেউয়ের' পরে ধরব পাড়ি
 যায় যদি যাক প্রাণ।
 আনন্দেরই সাগর থেকে
 এসেছে আজ বান।
 
 কে ডাকে রে পিছন হতে,
 কে করে রে মানা,
 ভয়ের কথা কে বলে আজ—
 ভয় আছে সব জানা ।
 কোন্ শাপে কোন্ গ্রহের দোষে
 সুখের ডাঙায় থাকব বসে;
 পালের রশি ধরব কষি,
 চলব গেয়ে গান।
 আনন্দেরই সাগর থেকে
 এসেছে আজ বান।
 ১৩১৫
 
 ১০
 তোমার   সোনার থালায় সাজাব আজ
 দুখের অশ্রুধার।
 জননী গো, গাঁথব তোমার
 গলার মুক্তাহার।
 চন্দ্র সূর্য পায়ের কাছে
 মালা হয়ে জড়িয়ে আছে,
 তোমার     বুকে শোভা পাবে আমার
 দুখের অলংকার।
 
 ধন ধান্য তোমারি ধন,
 কী করবে তা কও।
 দিতে চাও তো দিয়ো আমায়,
 নিতে চাও তো লও।
 দুঃখ আমার ঘরের জিনিস,
 খাঁটি রতন তুই তো চিনিস—
 তোর    
		প্রসাদ দিয়ে তারে কিনিস,
 এ মোর অহংকার।
 ১৩১৫? |