গীতাঞ্জলি
১০০-১১০


                 ১০১
হে মোর দেবতা , ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।
        আমার নয়নে তোমার বিশ্বছবি
        দেখিয়া লইতে সাধ যায় তব কবি,
        আমার মুগ্ধ শ্রবণে নীরব রহি
             শুনিয়া লইতে চাহ আপনার গান।
হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।

     আমার চিত্তে তোমার সৃষ্টিখানি
     রচিয়া তুলিছে বিচিত্র এক বাণী।
         তারি সাথে প্রভু মিলিয়া তোমার প্রীতি
         জাগায়ে তুলিছে আমার সকল গীতি,
         আপনারে তুমি দেখিছ মধুর রসে
                 আমার মাঝারে নিজেরে করিয়া দান।
        হে মোর দেবতা , ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
        কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।
১৩ আষাঢ় ১৩১৭
 
            ১০২
এই মোর সাধ যেন এ জীবনমাঝে
তব আনন্দ মহাসংগীতে বাজে।
     তোমার আকাশ, উদার আলোকধারা,
     দ্বার ছোটো দেখে ফেরে না যেন গো তারা,
     ছয় ঋতু যেন সহজ নৃত্যে আসে
          অন্তরে মোর নিত্য নূতন সাজে।

     তব আনন্দ আমার অঙ্গে মনে
     বাধা যেন নাহি পায় কোনো আবরণে।
তব আনন্দ পরম দুঃখে মম
জ্বলে উঠে যেন পুণ্য আলোকসম,
তব আনন্দ দীনতা চূর্ণ করি'
      ফুটে উঠে ফেটে আমার সকল কাজে।
১৩ আষাঢ় ১৩১৭

           ১০৩
একলা আমি বাহির হলেম
         তোমার অভিসারে,
সাথে সাথে কে চলে মোর
          নীরব অন্ধকারে।
ছাড়াতে চাই অনেক করে
ঘুরে চলি, যাই যে সরে,
মনে করি আপদ গেছে,
         আবার দেখি তারে।

               ধরণী সে কাঁপিয়ে চলে —
                      বিষম চঞ্চলতা।
               সকল কথার মধ্যে সে চায়
                      কইতে আপন কথা।
               সে যে আমার আমি, প্রভু,
               লজ্জা তাহার নাই যে কভু,
               তারে নিয়ে কোন্‌ লাজে বা
                      যাব তোমার দ্বারে।
১৪ আষাঢ় ১৩১৭

                   ১০৪
আমি চেয়ে আছি তোমাদের সবাপানে।
স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে।
    নীচে সব নীচে এ ধূলির ধরণীতে
    যেথা আসনের মূল্য না হয় দিতে,
    যেথা রেখা দিয়ে ভাগ করা নেই কিছু
           যেথা ভেদ নাই মানে আর অপমানে,
           স্থান দাও সেথা সকলের মাঝখানে।

যেথা বাহিরের আবরণ নাহি রয়,
যেথা আপনার উলঙ্গ পরিচয়।
     আমার বলিয়া কিছু নাই একেবারে,
     এ সত্য যেথা নাহি ঢাকে আপনারে,
     সেথায় দাঁড়ায়ে নিলাজ দৈন্য মম
           ভরিয়া লইব তাঁহার পরম দানে।
           স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে।
১৫ আষাঢ় ১৩১৭

            ১০৫
আর আমায় আমি নিজের শিরে
                          বইব না।
আর নিজের দ্বারে কাঙাল হয়ে
                         রইব না।
এই বোঝা তোমার পায়ে ফেলে
        বেড়িয়ে পড়ব অবহেলে —
        কোনো খবর রাখব না ওর,
               কোনো কথাই কইব না।
        আমায় আমি নিজের শিরে
                         বইব না।

        বাসনা মোর যারেই পরশ
                            করে সে,
        আলোটি তার নিবিয়ে ফেলে
                            নিমেষে।
ওরে   সেই অশুচি, দুই হাতে তার
         যা এনেছে চাই নে সে আর,
         তোমার প্রেমে বাজবে না যা
                সে আর আমি সইব না।
         আমায় আমি নিজের শিরে
                            বইব না।
 ১৫ আষাঢ় ১৩১৭

                  ১০৬
হে মোর চিত্ত, পূণ্য তীর্থে
         জাগো রে ধীরে —
এই ভারতের মহামানবের
         সাগরতীরে।

           হেথায় দাঁড়ায়ে দু-বাহু বাড়ায়ে,
                         নমি নর-দেবতারে,
           উদার ছন্দে পরমানন্দে
                        বন্দন করি তাঁরে।
     ধ্যান-গম্ভীর এই যে ভূধর,
     নদীজপমালাধৃত প্রান্তর,
     হেথায় নিত্য হেরো পবিত্র
               ধরিত্রীরে
     এই ভারতের মহামানবের
               সাগরতীরে।

কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে
         কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে
        সমুদ্রে হল হারা।
                হেথায় আর্য, হেথা অনার্য
                     হেথায় দ্রাবিড়, চীন —
                শক-হুন-দল পাঠান মোগল
                     এক দেহে হল লীন।
     পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার,
     সেথা হতে সবে আনে উপহার,
     দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে
                      যাবে না ফিরে,
     এই ভারতের মহামানবের
                      সাগরতীরে।

রণধারা বাহি জয়গান গাহি
           উন্মাদ কলরবে
ভেদি মরুপথ গিরিপর্বত
           যারা এসেছিল সবে,
                তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে
                          কেহ নহে নহে দূর,
                আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতে
                         তারি বিচিত্র সুর।
        হে রুদ্রবীণা, বাজো, বাজো, বাজো,
        ঘৃণা করি দূরে আছে যারা আজো,
        বন্ধ নাশিবে, তারাও আসিবে
                   দাঁড়াবে ঘিরে

       এই ভারতের মহামানবের
                   সাগরতীরে।

হেথা একদিন বিরামবিহীন
          মহা ওংকারধ্বনি,
হৃদয়তন্ত্রে একের মন্ত্রে
          উঠেছিল রনরনি।
                 তপস্যাবলে একের অনলে
                         বহুরে আহুতি দিয়া
                 বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল
                         একটি বিরাট হিয়া।
          সেই সাধনার সে আরাধনার
          যজ্ঞশালায় খোলা আজি দ্বার,
          হেথায় সবারে হবে মিলিবারে
                            আনতশিরে —
          এই ভারতের মহামানবের
                            সাগরতীরে।

সেই হোমানলে হেরো আজি জ্বলে
         দুখের রক্ত শিখা,
হবে তা সহিতে মর্মে দহিতে
         আছে সে ভাগ্যে লিখা।
                    এ দুখ বহন করো মোর মন,
                           শোনো রে একের ডাক।
                    যত লাজ ভয় করো করো জয়
                           অপমান দূরে থাক।
         দুঃসহ ব্যথা হয়ে অবসান
                   জন্ম লভিবে কী বিশাল প্রাণ।
         পোহায় রজনী, জাগিছে জননী
                  বিপুল নীড়ে,
         এই ভারতের মহামানবের
                  সাগরতীরে।

এসো হে আর্য, এসো অনার্য,
        হিন্দু মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,
        এসো এসো খৃস্টান।
            এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন
                       ধরো হাত সবাকার,
            এসো হে পতিত করো অপনীত
                       সব অপমানভার।
            মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা
            মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা,
            সবারে-পরশে-পবিত্র-করা
                      তীর্থনীরে।
            আজি ভারতের মহামানবের
                     সাগরতীরে।
 ১৮ আষাঢ় ১৩১৭

                    ১০৭
যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
     সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে
          সবার পিছে, সবার নীচে,
                   সব-হারাদের মাঝে।
     যখন তোমায় প্রণাম করি আমি,
     প্রণাম আমার কোন্‌খানে যায় থামি,
তোমার চরণ যেথায় নামে অপমানের তলে
     সেথায় আমার প্রণাম নামে না যে
          সবার পিছে, সবার নীচে,
              সব-হারাদের মাঝে।

অহংকার তো পায় না নাগাল যেথায় তুমি ফের,
      রিক্তভূষণ দীনদরিদ্র সাজে —
          সবার পিছে, সবার নীচে,
                সব-হারাদের মাঝে।
      ধনে মানে যেথায় আছে ভরি
      সেথায় তোমার সঙ্গ আশা করি —
সঙ্গী হয়ে আছ যেথায় সঙ্গিহীনের ঘরে
      সেথায় আমার হৃদয় নামে না যে
          সবার পিছে, সবার নীচে,
                 সব-হারাদের মাঝে।
১৯ আষাঢ় ১৩১৭

                     ১০৮
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!
           মানুষের অধিকারে
           বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
          বিধাতার রুদ্ররোষে
          দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে
সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে।
          চরণে দলিত হয়ে
          ধুলায় সে যায় বয়ে
সে নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ।
অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান।

যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
          অজ্ঞানের অন্ধকারে
          আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার,
মানুষের নারায়ণে তবুও কর না নমস্কার।
          তবু নত করি আঁখি
          দেখিবারে পাও না কি
নেমেছে ধুলার তলে হীন পতিতের ভগবান,
অপমানে হতে হবে সেথা তোরে সবার সমান।

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে,
অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।
          সবারে না যদি ডাক',
          এখনো সরিয়া থাক',
আপনারে বেঁধে রাখ' চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান

মৃত্যুমাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান।

২০ আষাঢ় ১৩১৭

               ১০৯
ছাড়িস নে ধরে থাক এঁটে,
                ওরে হবে তোর জয়।
অন্ধকার যায় বুঝি কেটে,
                 ওরে আর নেই ভয়।
ওই দেখ্‌ পূর্বাশার ভালে
নিবিড় বনের অন্তরালে
        শুকতারা হয়েছে উদয়।
        ওরে   আর নেই ভয়।
এরা যে কেবল নিশাচর

অবিশ্বাস আপনার 'পর,
        নিরাশ্বাস, আলস্য সংশয়,
        এরা প্রভাতের নয়।
ছুটে আয়, আয় রে বাহিরে,
চেয়ে দেখ্‌, দেখ্‌ ঊর্ধ্বশিরে,
        আকাশ হতেছে জ্যোতির্ময়।
        ওরে আর নেই ভয়।
২১ আষাঢ় ১৩১৭

              ১১০
আছ আমার হৃদয় আছ ভরে
          এখন তুমি যা-খুশি তাই করো।
এমনি যদি বিরাজ অন্তরে
         বাহির হতে সকলই মোর হরো।
              সব পিপাসার যেথায় অবসান
              সেথায় যদি পূর্ণ কর প্রাণ
              তাহার পরে মরুপথের মাঝে
                    উঠে রৌদ্র উঠুক খরতর ।

এই যে খেলা খেলছ কত ছলে
         এই খেলা তো আমি ভালোবাসি।
এক দিকেতে ভাসাও আঁখিজলে
         আরেক দিকে জাগিয়ে তোল হাসি।
              যখন ভাবি সব খোয়ালেম বুঝি,
              গভীর করে পাই তাহারে খুঁজি,
             কোলের থেকে যখন ফেল দূরে
                    বুকের মাঝে আবার তুলে ধর।
রেলপথে। ই. আর. আর,
    ২১ আষাঢ় ১৩১৭