গীতাঞ্জলি
১১-২০


                     ১১
আমরা    বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা
                       গেঁথেছি শেফালিমালা।
            নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে
                       সাজিয়ে এনেছি ডালা।
            এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার
                       শুভ্র মেঘের রথে,
            এসো     নির্মল নীল পথে,
            এসো     ধৌত শ্যামল
                       আলো-ঝলমল
                       বনগিরিপর্বতে।
            এসো     মুকুটে পরিয়া শ্বেত শতদল
                     শীতল-শিশির-ঢালা।

         ঝরা মালতীর ফুলে
আসন বিছানো নিভৃত কুঞ্জে
         ভরা গঙ্গার কূলে
ফিরিছে মরাল ডানা পাতিবারে
               তোমার চরণমূলে।
       গুঞ্জরতান তুলিয়ো তোমার
            সোনার বীণার তারে
            মৃদু মধু ঝংকারে,
      হাসিঢালা সুর গলিয়া পড়িবে
            ক্ষণিক অশ্রুধারে।
                 রহিয়া রহিয়া যে পরশমণি
                      ঝলকে অলককোণে,
                পলকের তরে সকরুণ করে
                      বুলায়ো বুলায়ো মনে

                সোনা হয়ে যাবে সকল ভাবনা,
                      আঁধার হইবে আলা।
১৩১৫?

                  ১২
লেগেছে অমল ধবল পালে
             মন্দ মধুর হাওয়া।
দেখি নাই কভু দেখি নাই
             এমন তরণী বাওয়া।
                   কোন্‌ সাগরের পার হতে আনে
                        কোন্‌ সুদূরের ধন!
                        ভেসে যেতে চায় মন,
                   ফেলে যেতে চায় এই কিনারায়
                         সব চাওয়া সব পাওয়া।

পিছনে ঝরিছে ঝর ঝর জল,
         গুরু গুরু দেয়া ডাকে

মুখে এসে পড়ে অরুণকিরণ
         ছিন্ন মেঘের ফাঁকে।
ওগো কাণ্ডারী, কে গো তুমি , কার
         হাসিকান্নার ধন।
         ভেবে মরে মোর মন

কোন্‌ সুরে আজ বাঁধিবে যন্ত্র,
         কী মন্ত্র হবে গাওয়া।
শান্তিনিকেতন
৩ ভাদ্র ১৩১৫

               ১৩
আমার    নয়ন-ভুলানো এলে।
আমি     কী হেরিলাম হৃদয় মেলে।
           শিউলিতলার পাশে পাশে
           ঝরা ফুলের রাশে রাশে
           শিশির-ভেজা ঘাসে ঘাসে
                  অরুণ-রাঙা-চরণ ফেলে
                  নয়ন-ভুলানো এলে।

আলোছায়ার আঁচলখানি
           লুটিয়ে পড়ে বনে বনে,
ফুলগুলি ওই মুখে চেয়ে
           কী কথা কয় মনে মনে।
                 তোমায় মোরা করব বরণ,
                 মুখের ঢাকা করো হরণ,
                 ওইটুকু ওই মেঘাবরণ
                        দু হাত দিয়ে ফেলো ঠেলে।
                        নয়ন-ভুলানো এলে।

বনদেবীর দ্বারে দ্বারে
        শুনি গভীর শঙ্খধনি,
আকাশবীণার তারে তারে
        জাগে তোমার আগমনী।
                 কোথায় সোনার নূপুর বাজে,
                 বুঝি আমার হিয়ার মাঝে,
                 সকল ভাবে সকল কাজে
                        পাষাণ-গালা সুধা ঢেলে

                        নয়ন-ভুলানো এলে।
শান্তিনিকেতন
৩ ভাদ্র ১৩১৫
 
                 ১৪
জননী, তোমার করুণ চরণখানি
হেরিনু আজি এ অরুণকিরণ রূপে।
জননী, তোমার মরণহরণ বাণী
নীরব গগনে ভরি উঠে চুপে চুপে।

           তোমারে নমি হে সকল ভুবন-মাঝে,
           তোমারে নমি হে সকল জীবন-কাজে;
           তনু মন ধন করি নিবেদন আজি
           ভক্তিপাবন তোমার পূজার ধূপে।
           জননী, তোমার করুণ চরণখানি
           হেরিনু আজি এ অরুণকিরণ রূপে।
১৩১৫

                   ১৫
জগৎ জুড়ে উদার সুরে
                  আনন্দগান বাজে,
সে গান কবে গভীর রবে
                  বাজিবে হিয়া-মাঝে।
                       বাতাস জল আকাশ আলো
                       সবারে কবে বাসিব ভালো,
                       হৃদয়সভা জুড়িয়া তারা
                                   বসিবে নানা সাজে।
নয়নদুটি মেলিলে কবে
               পরান হবে খুশি,
যে পথ দিয়া চলিয়া যাব
               সবারে যাব তুষি।
                       রয়েছ তুমি, এ কথা কবে
                       জীবন-মাঝে সহজ হবে,
                       আপনি কবে তোমারি নাম
                                    ধ্বনিবে সব কাজে।
   বোলপুর
আষাঢ় ১৩১৬

                        ১৬
মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে,
              আঁধার করে আসে,
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
             একা দ্বারের পাশে।
                   কাজের দিনে নানা কাজে
                   থাকি নানা লোকের মাঝে,
                   আজ আমি যে বসে আছি
                         তোমারি আশ্বাসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
            একা দ্বারের পাশে।

তুমি যদি না দেখা দাও,
            কর আমায় হেলা,
কেমন করে কাটে আমার
            এমন বাদল-বেলা।
                 দূরের পানে মেলে আঁখি
                 কেবল আমি চেয়ে থাকি,
                 পরান আমার কেঁদে বেড়ায়
                         দুরন্ত বাতাসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
                 একা দ্বারের পাশে।
  বোলপুর
আষাঢ় ১৩১৬

                  ১৭
কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো।
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
         রয়েছে দীপ না আছে শিখা,
        এই কি ভালে ছিল রে লিখা

ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।
বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো।

বেদনাদূতী গাহিছে, 'ওরে প্রাণ,
তোমার লাগি জাগেন ভগবান।
        নিশীথে ঘন অন্ধকারে
        ডাকেন তোরে প্রেমাভিসারে,
দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান।
তোমার লাগি জাগেন ভগবান।'

গগনতল গিয়েছে মেঘে ভরি,
বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি।
       এ ঘোর রাতে কিসের লাগি
       পরান মম সহসা জাগি
এমন কেন করিছে মরি মরি।
বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি।

বিজুলি শুধু ক্ষণিক আভা হানে,
নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।
      জানি না কোথা অনেক দূরে
      বাজিল প্রাণ গভীর সুরে,
সকল গান টানিছে পথপানে।
নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।

কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো।
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
      ডাকিছে মেঘ, হাঁকিছে হাওয়া,
      সময় গেলে হবে না যাওয়া,
নিবিড় নিশা নিকষঘন কালো।
পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো।

    বোলপুর
আষাঢ় ১৩১৬

                  ১৮
আজি    শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহে
                 গোপন তব চরণ ফেলে
           নিশার মতো নীরব ওহে
                 সবার দিঠি এড়ায়ে এলে।
                         প্রভাত আজি মুদেছে আঁখি,
                         বাতাস বৃথা যেতেছে ডাকি,
                         নিলাজ নীল আকাশ ঢাকি
                                নিবিড় মেঘ কে দিল মেলে।

কূজনহীন কাননভূমি,
           দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে,
একেলা কোন্‌ পথিক তুমি
          পথিকহীন পথের 'পরে।
                 হে একা সখা, হে প্রিয়তম,
                 রয়েছে খোলা এ ঘর মম,
                 সমুখ দিয়ে স্বপনসম
                      যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে।
   বোলপুর
আষাঢ় ১৩১৬

                   ১৯
আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল,
        গেল রে দিন বয়ে।
বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা
        ঝরছে রয়ে রয়ে।
             একলা বসে ঘরের কোণে
             কী ভাবি যে আপন-মনে,
             সজল হাওয়া যূথীর বনে
                     কী কথা যায় কয়ে।
             বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা
                    ঝরছে রয়ে রয়ে।

হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে,
         খুঁজে না পাই কূল;
সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তুলে
         ভিজে বনের ফুল।
               আঁধার রাতে প্রহরগুলি
               কোন্‌ সুরে আজ ভরিয়ে তুলি,
               কোন্‌ ভুলে আজ সকল ভুলি
                          আছি আকুল হয়ে।
               বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা
                           ঝরছে রয়ে রয়ে।
    শিলাইদহ
আষাঢ় ১৩১৬

                      ২০
আজি     ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার,
            পরানসখা বন্ধু হে আমার।
                    আকাশ কাঁদে হতাশ-সম,
                    নাই যে ঘুম নয়নে মম,
                    দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম,
                            চাই যে বারে বার।
                    পরানসখা বন্ধু হে আমার।
বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,
তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
            সুদূর কোন্‌ নদীর পারে,
            গহন কোন্‌ বনের ধারে
            গভীর কোন্ অন্ধকারে
                    হতেছ তুমি পার।
            পরানসখা বন্ধু হে আমার।