গীতাঞ্জলি
১১১-১২০


                          ১১১
গর্ব করে নিই নে ও নাম, জান অন্তর্যামী,
        আমার মুখে তোমার নাম কি সাজে।
যখন সবাই উপহাসে তখন ভাবি আমি
        আমার কণ্ঠে তোমার নাম কি বাজে।
              তোমা হতে অনেক দূরে থাকি
              সে যেন মোর জানতে না রয় বাকি,
নামগানের এই ছদ্মবেশে দিই পরিচয় পাছে
       মনে মনে মরি যে সেই লাজে।

অহংকারের মিথ্যা হতে বাঁচাও দয়া করে
       রাখো আমায় যেথা আমার স্থান।
আর-সকলের দৃষ্টি হতে সরিয়ে দিয়ে মোরে
       করো তোমার নত নয়ন দান।
              আমার পূজা দয়া পাবার তরে,
              মান যেন সে না পায় করো ঘরে,
নিত্য তোমায় ডাকি আমি ধুলার 'পরে বসে
       নিত্যনূতন অপরাধের মাঝে।

রেলপথ। ই. বি. এস. আর.
       ২২ আষাঢ় ১৩১৭

                 ১১২
কে বলে সব ফেলে যাবি
            মরণ হাতে ধরবে যবে।
জীবনে তুই যা নিয়েছিস
            মরণে সব নিতে হবে।
     এই ভরা ভাণ্ডারে এসে
     শূন্য কি তুই যাবি শেষে।
     নেবার মতো যা আছে তোর
             ভালো করে নেই তুই তবে।

আবর্জনার অনেক বোঝা
          জমিয়েছিস যে নিরবধি,
বেঁচে যাবি যাবার বেলা
          ক্ষয় করে সব যাস রে যদি।
    এসেছি এই পৃথিবীতে,
    হেথায় হবে সেজে নিতে,
    রাজার বেশে চল্‌ রে হেসে
          মৃত্যুপারের সে উৎসবে।

  শিলাইদহ
২৫ আষাঢ় ১৩১৭
 
           ১১৩
নদীপারের এই আষাঢ়ের
            প্রভাতখানি
নে রে, ও মন, নে রে আপন
            প্রাণে টানি।
    সবুজ নীলে সোনায় মিলে
    যে সুধা এই ছড়িয়ে দিলে,
    জাগিয়ে দিলে আকাশতলে
           গভীর বাণী

    নে রে, ও মন, নে রে আপন
           প্রাণে টানি।

         এমনি করে চলতে পথে
                 ভবের কূলে
         দুই ধারে যা ফুল ফুটে সব
                নিস রে তুলে।
            সেগুলি তোর চেতনাতে
            গেঁথে তুলিস দিবস-রাতে,
            প্রতি দিনটি যতন করে
                  ভাগ্য মানি,
            নে রে, ও মন, নে রে আপন
                     প্রাণে টানি।
   শিলাইদহ
২৫ আষাঢ় ১৩১৭


                      ১১৪
মরণ যেদিন দিনের শেষে আসবে তোমার দুয়ারে
সেদিন তুমি কী ধন দিবে উহারে।
         ভরা আমার পরানখানি
         সম্মুখে তার দিব আনি,
              শূন্য বিদায় করব না তো উহারে —
              মরণ যেদিন আসবে আমার দুয়ারে।

                  কত শরৎ-বসন্ত-রাত,
                  কত সন্ধ্যা, কত প্রভাত
              জীবনপাত্রে কত যে রস বরষে;
                  কতই ফলে কতই ফুলে
                  হৃদয় আমার ভরি তুলে
              দুঃখসুখের আলোছায়ার পরশে।
                  যা-কিছু মোর সঞ্চিত ধন
                  এতদিনের সব আয়োজন
             চরমদিনে সাজিয়ে দিব উহারে —
             মরণ যেদিন আসবে আমার দুয়ারে।
   শিলাইদহ
২৫ আষাঢ় ১৩১৭
 
                    ১১৫
দয়া করে ইচ্ছা করে আপনি ছোটো হয়ে
        এসো তুমি এ ক্ষুদ্র আলয়ে।
             তাই তোমার মাধুর্যসুধা
             ঘুচায় আমার আঁখির ক্ষুধা,
             জলে স্থলে দাও যে ধরা
                     কত আকার লয়ে।

        বন্ধু হয়ে পিতা হয়ে জননী হয়ে
    আপনি তুমি ছোটো হয়ে এসো হৃদয়ে।
            আমিও কি আপন হাতে
            করব ছোটো বিশ্বনাথে।
        জানাব আর জানব তোমায়
                   ক্ষুদ্র পরিচয়ে?
  শিলাইদহ
২৫ আষাঢ় ১৩১৭

                    ১১৬
ওগো আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা,
মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা।
          সারা জনম তোমার লাগি
          প্রতিদিন যে আছি জাগি,
     তোমার তরে বহে বেড়াই
                    দুঃখসুখের ব্যথা।
     মরণ, আমার মরণ, তুমি
                   কও আমারে কথা।
     যা পেয়েছি, যা হয়েছি
                   যা-কিছু মোর আশা।
     না জেনে ধায় তোমার পানে
                   সকল ভালোবাসা।
          মিলন হবে তোমার সাথে,
          একটি শুভ দৃষ্টিপাতে,
    জীবনবধূ হবে তোমার
         নিত্য অনুগতা;
    মরণ, আমার মরণ, তুমি
         কও আমারে কথা।
    বরণমালা গাঁথা আছে,
         আমার চিত্তমাঝে,
    কবে নীরব হাস্যমুখে
         আসবে বরের সাজে।
    সেদিন আমার রবে না ঘর,
    কেই-বা আপন, কেই-বা অপর,
বিজন রাতে পতির সাথে
     মিলবে পতিব্রতা।
মরণ, আমার মরণ, তুমি
     কও আমারে কথা।

    শিলাইদহ
২৬ আষাঢ় ১৩১৭

            ১১৭
      যাত্রী আমি ওরে।
পারবে না কেউ রাখতে আমায় ধরে।
     দুঃখসুখের বাঁধন সবই মিছে,
     বাঁধা এ-ঘর রইবে কোথায় পিছে,
     বিষয়বোঝা টানে আমায় নীচে,
             ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে যাবে পড়ে।

       যাত্রী আমি ওরে।
চলতে পথে গান গাহি প্রাণ ভরে।
      দেহ-দুর্গে খুলবে সকল দ্বার,
      ছিন্ন হবে শিকল বাসনার,
      ভালোমন্দ কাটিয়ে হব পার
          চলতে রব লোকে লোকান্তরে।

       যাত্রী আমি ওরে।
যা-কিছু ভার যাবে সকাল সরে।
      আকাশ আমায় ডাকে দূরের পানে
      ভাষাবিহীন অজানিতের গানে,
      সকাল-সাঁঝে পরান মম টানে
             কাহার বাঁশি এমন গভীর স্বরে।

        যাত্রী আমি ওরে —
বাহির হলেম না জানি কোন্‌ ভোরে।
        তখন কোথাও গায় নি কোনো পাখি,
        কী জানি রাত কতই ছিল বাকি,
        নিমেষহারা শুধুই একটি আঁখি
            জেগেছিল অন্ধকারের 'পরে।

          যাত্রী আমি ওরে।
কোন্‌ দিনান্তে পৌঁছব কোন্‌ ঘরে।
          কোন্‌ তারকা দীপ জ্বালে সেইখানে,
          বাতাস কাঁদে কোন্‌ কুসুমের ঘ্রাণে,
          কে গো সেথায় স্নিগ্ধ দু-নয়ানে
                   অনাদিকাল চাহে আমার তরে।

    গোরাই নদী
২৬ আষাঢ় ১৩১৭

                  ১১৮
       উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে
       ওই যে তিনি, ও ই যে বাহির পথে।
আয় রে ছুটে, টানতে হবে রশি,
ঘরের কোণে রইলি কোথায় বসি।
ভিড়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে গিয়ে
       ঠাঁই করে তুই নে রে কোনোমতে।

কোথায় কী তোর আছে ঘরের কাজ,
সে-সব কথা ভুলতে হবে আজ।
টান্‌ রে দিয়ে সকল চিত্তকায়া,
টান্‌ রে ছেড়ে তুচ্ছ প্রাণের মায়া,
চল্‌ রে টেনে আলোর অন্ধকারে
       নগর গ্রামে অরণ্যে পর্বতে।

      ওই যে চাকা ঘুরছে ঝনঝনি,
      বুকের মাঝে শুনছ কি সেই ধ্বনি।
রক্তে তোমার দুলছে না কি প্রাণ।
গাইছে না মন মরণজয়ী গান?
আকাঙ্ক্ষা তোর বন্যাবেগের মতো
      ছুটছে নাকি বিপুল ভবিষ্যতে।

    গোরাই
২৬ আষাঢ় ১৩১৭

            ১১৯
ভজন পূজন সাধন আরাধনা
        সমস্ত থাক্‌ পড়ে।
রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে
        কেন আছিস ওরে।
অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে
কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে,
নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে
        দেবতা নাই ঘরে।

       তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে
              করছে চাষা চাষ

       পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,
             খাটছে বারো মাস।
       রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে,
       ধুলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে;
       তাঁরি মতন শুচি বসন ছাড়ি
              আয় রে ধুলার প'রে।

মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি,
       মুক্তি কোথায় আছে।
আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন 'পরে
      বাঁধা সবার কাছে।
রাখো রে ধ্যান থাক্‌ রে ফুলের ডালি,
ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুক ধুলাবালি,
কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে
       ঘর্ম পড়ুক ঝরে।

কয়া। গোরাই
২৭ আষাঢ় ১৩১৭

                ১২০
সীমার মাঝে, অসীম, তুমি
             বাজাও আপন সুর।
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ
             তাই এত মধুর।
কত বর্ণে কত গন্ধে,
কত গানে কত ছন্দে,
অরূপ, তোমার রূপের লীলায়
             জাগে হৃদয়পুর।
আমার মধ্যে তোমার শোভা
             এমন সুমধুর।

        তোমায় আমায় মিলন হলে
                   সকলি যায় খুলে

        বিশ্বসাগর ঢেউ খেলায়ে
                   উঠে তখন দুলে।
        তোমার আলোয় নাই তো ছায়া,
        আমার মাঝে পায় সে কায়া,
        হয় সে আমার অশ্রুজলে
                  সুন্দর বিধুর।
       আমার মধ্যে তোমার শোভা
                  এমন সুমধুর।  
জানিপুর। গোরাই
২৭ আষাঢ় ১৩১৭