|  | ১২১ তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর
 তুমি তাই এসেছ নীচে।
 আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর,
 তোমার   প্রেম হত যে মিছে।
 আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,
 আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,
 মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে
 তোমার    ইচ্ছা তরঙ্গিছে।
 
 তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে
 তবু   আমার হৃদয় লাগি
 ফিরছ কত মনোহরণ-বেশে
 প্রভু   নিত্য আছ 
		জাগি।
 তাই তো, প্রভু, হেথায় এল নেমে,
 তোমারি প্রেম ভক্ত প্রাণের প্রেমে,
 মূর্তি তোমার যুগল-সম্মিলনে
 সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে।
 জানিপুর। গোরাই
 ২৮ আষাঢ় ১৩১৭
 
 ১২২
 মানের আসন, আরামশয়ন
 নয় তো তোমার তরে।
 সব ছেড়ে আজ খুশি হয়ে
 চলো পথের 'পরে।
 এসো বন্ধু তোমরা সবে
 একসাথে সব বাহির হবে,
 আজকে যাত্রা করব মোরা
 অমানিতের ঘরে।
 
 নিন্দা পরব ভূষণ করে
 কাঁটার কণ্ঠহার,
 মাথায় করে তুলে লব
 অপমানের ভার।
 দুঃখীর শেষ আলয় যেথা
 সেই ধুলাতে লুটাই মাথা,
 ত্যাগের শূন্যপাত্রটি নিই
 আনন্দরস ভরে।
 গোরাই
 ২৯ আষাঢ় ১৩১৭
 
 ১২৩
 প্রভুগৃহ হতে আসিলে যেদিন
 বীরের দল
 সেদিন কোথায় ছিল যে লুকানো
 বিপুল বল।
 কোথায় বর্ম, অস্ত্র কোথায়,
 ক্ষীণ দরিদ্র অতি অসহায়,
 চারি দিক হতে এসেছে আঘাত
 অনর্গল,
 প্রভুগৃহ হতে আসিলে যেদিন
 বীরের দল।
 প্রভুগৃহমাঝে ফিরিলে যেদিন
 বীরের দল
 সেদিন কোথায় লুকাল আবার
 বিপুল বল।
 ধনুশর অসি কোথা গেল খসি,
 শান্তির হাসি উঠিল বিকশি;
 চলে গেলে রাখি সারা জীবনের
 সকল ফল,
 প্রভুগৃহমাঝে ফিরিলে যেদিন
 বীরের দল।
 
 কলিকাতা। ঠিকাগাড়িতে
 ৩১ আষাঢ় ১৩১৭
 
 ১২৪
 ভেবেছিনু মনে যা হবার তারি শেষে
 যাত্রা আমার বুঝি থেমে গেছে এসে।
 নাই বুঝি পথ, নাই বুঝি আর কাজ,
 পাথেয় যা ছিল ফুরায়েছে বুঝি আজ,
 যেতে হবে সরে নীরব অন্তরালে
 জীর্ণ জীবনে ছিন্ন মলিন বেশে।
 
 কী নিরখি আজি, এ কী অফুরান লীলা,
 এ কী নবীনতা বহে অন্তঃশীলা।
 পুরাতন ভাষা মরে এল যবে মুখে,
 নবগান হয়ে গুমরি উঠিল বুকে,
 পুরাতন পথ শেষ হয়ে গেল যেথা
 সেথায় আমারে আনিলে নূতন দেশে।
 কলিকাতা। ঠিকাগাড়িতে
 ৩১ আষাঢ় ১৩১৭
               
		১২৫আমার এ গান ছেড়েছে তার
 সকল অলংকার,
 তোমার কাছে রাখে নি আর
 সাজের অহংকার।
 অলংকার যে মাঝে প'ড়ে
 মিলনেতে আড়াল করে,
 তোমার কথা ঢাকে যে তার
 মুখর ঝংকার।
 
 তোমার কাছে খাটে না মোর
 কবির গরব করা,
 মহাকবি, তোমার পায়ে
 দিতে চাই যে ধরা।
 জীবন লয়ে যতন করি'
 যদি সকল বাঁশি গড়ি,
 আপন সুরে দিবে ভরি
 সকল ছিদ্র তার।
 কলিকাতা
 ১ শ্রাবণ ১৩১৭
 
 ১২৬
 নিন্দা দুঃখে অপমানে
 যত আঘাত খাই
 তবু জানি কিছুই সেথা
 হারাবার তো নাই।
 থাকি যখন ধুলার 'পরে
 ভাবতে না হয় আসনতরে,
 দৈন্যমাঝে অসংকোচে
 প্রসাদ তব চাই।
 
 লোকে যখন ভালো বলে,
 যখন সুখে থাকি,
 জানি মনে তাহার মাঝে
 অনেক আছে ফাঁকি।
 সেই ফাঁকিরে সাজিয়ে লয়ে
 ঘুরে বেড়াই মাথায় বয়ে,
 তোমার কাছে যাব এমন
 সময় নাহি পাই।
 বোলপুর
 ২ শ্রাবণ ১৩১৭
 
 ১২৭
 রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে
 পরাও যারে মণিরতন-হার —
 খেলাধুলা আনন্দ তার সকলি যায় ঘুরে,
 বসন-ভুষণ হয় যে বিষম ভার।
 ছেঁড়ে পাছে আঘাত লাগি,
 পাছে ধুলায় হয় সে দাগি,
 আপনাকে তাই সরিয়ে রাখে সবার হতে দূরে,
 চলতে গেলে ভাবনা ধরে তার —
 রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে,
 পরাও যারে মণিরতন-হার।
 
 কী হবে মা অমনতরো রাজার মতো সাজে,
 কী হবে ওই মণিরতন-হারে।
 দুয়ার খুলে দাও যদি তো ছুটি পথের মাঝে
 রৌদ্রবায়ু-ধুলাকাদার পাড়ে।
 যেথায় বিশ্বজনের মেলা
 সমস্ত দিন নানান খেলা,
 চারি দিকে বিরাট গাথা বাজে হাজার সুরে,
 সেথায় সে যে পায় না অধিকার,
 রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে,
 পরাও যারে মণিরতন-হার।
   বোলপুর২ শ্রাবণ ১৩১৭
 
 ১২৮
 জড়িয়ে গেছে সরু মোটা
 দুটো তারে
 জীবনবীণা ঠিক সুরে তাই
 বাজে না রে।
 এই বেসুরো জটিলতায়
 পরান আমার মরে ব্যথায়,
 হঠাৎ আমার গান থেমে যায়
 বারে বারে।
 জীবনবীণা ঠিক সুরে আর
 বাজে না রে।
 
 এই বেদনা বইতে আমি
 পারি না যে,
 তোমার সভার পথে এসে
 মরি লাজে।
 তোমার যারা গুণী আছে
 বসতে নারি তাদের কাছে,
 দাঁড়িয়ে থাকি সবার পাছে
 বাহির-দ্বারে।
 জীবনবীণা ঠিক সুরে আর
 বাজে না রে।
 বোলপুর
 ৩ শ্রাবণ ১৩১৭
 
 ১২৯
 গাবার মতো হয় নি কোনো গান,
 দেবার মতো হয় নি কিছু দান।
 মনে যে হয় সবি রইল বাকি
 তোমায় শুধু দিয়ে এলেম 
		ফাঁকি,
 কবে হবে জীবন পূর্ণ করে
 এই জীবনের পূজা অবসান।
 
 আর-সকলের সেবা করি যত
 প্রাণপণে দিই অর্ঘ্য ভরি ভরি।
 সত্য মিথ্যা সাজিয়ে দিই যে কত
 দীন বলিয়া পাছে ধরা পড়ি।
 তোমার কাছে গোপন কিছু নাই,
 তোমার পূজায় সাহস এত তাই,
 যা আছে তাই পায়ের কাছে আনি
 অনাবৃত দরিদ্র এই প্রাণ।
 ৭ শ্রাবণ ১৩১৭
 
 ১৩০
 আমার মাঝে তোমার লীলা হবে,
 তাই তো আমি এসেছি এই ভবে।
 এই ঘরে সব খুলে যাবে দ্বার,
 ঘুচে যাবে সকল 
		অহংকার,
 আনন্দময় তোমার এ 
		সংসারে
 আমার কিছু আর বাকি না রবে।
 
 মরে গিয়ে বাঁচব আমি, তবে
 আমার মাঝে তোমার লীলা হবে।
 সব বাসনা যাবে আমার থেমে
 মিলে গিয়ে তোমারি এক প্রেমে,
 দুঃখসুখের বিচিত্র জীবনে
 তুমি ছাড়া আর কিছু না রবে।
 ৭ শ্রাবণ ১৩১৭
 |