|
১৩১
দুঃস্বপন কোথা হতে এসে
জীবনে বাধায়
গণ্ডগোল।
কেঁদে উঠে জেগে দেখি শেষে
কিছু নাই আছে মার
কোল।
ভেবেছিনু আর-কেহ বুঝি,
ভয়ে তাই প্রাণপণে যুঝি,
তব হাসি দেখে আজ বুঝি
তুমিই দিয়েছ মোরে দোল।
এ জীবন সদা দেয় নাড়া
লয়ে তার সুখ দুখ ভয়;
কিছু যেন নাই গো সে ছাড়া,
সেই যেন মোর সমুদয়।
এ ঘোর
কাটিয়া যাবে চোখে
নিমেষেই
প্রভাত-আলোকে,
পরিপূর্ণ তোমার সম্মুখে
থেমে যাবে সকল কল্লোল।
৮ শ্রাবণ ১৩১৭
১৩২
গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি
বাহির মনে
চিরদিবস মোর জীবনে।
নিয়ে গেছে গান আমারে
ঘরে ঘরে দ্বারে
দ্বারে,
গান দিয়ে হাত বুলিয়ে বেড়াই
এই ভুবনে।
কত শেখা সেই শেখালো,
কত গোপন পথ দেখালো,
চিনিয়ে দিল কত তারা
হৃদ্গগনে।
বিচিত্র সুখদুখের দেশে
রহস্যলোক ঘুরিয়ে শেষে
সন্ধ্যাবেলায় নিয়ে এল
কোন্ ভবনে। ৯ শ্রাবণ
১৩১৭
১৩৩
তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর,
যবে আমার জনম হবে ভোর।
চলে যাব নবজীবন-লোকে,
নূতন দেখা জাগবে আমার চোখে,
নবীন হয়ে নূতন সে আলোকে
পরব তব নবমিলন-ডোর।
তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর।
তোমার অন্ত নাই গো অন্ত নাই,
বারে বারে নূতন লীলা তাই।
আবার তুমি জানি নে কোন্ বেশে
পথের মাঝে দাঁড়াবে, নাথ, হেসে,
আমার এ হাত ধরবে কাছে এসে,
লাগবে প্রাণে নূতন ভাবের ঘোর।
তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর।
১০ শ্রাবণ ১৩১৭
১৩৪
যেন শেষ গানে মোর সব রাগিণী পূরে—
আমার সব আনন্দ মেলে তাহার সুরে।
যে আনন্দে মাটির ধরা হাসে
অধীর হয়ে তরুলতায় ঘাসে,
যে আনন্দে দুই পাগলের মতো
জীবন-মরণ বেড়ায় ভুবন ঘুরে—
সেই আনন্দ মেলে তাহার সুরে।
যে আনন্দ আসে ঝড়ের বেশে,
ঘুমন্ত প্রাণ জাগায় অট্ট হেসে।
যে আনন্দ দাঁড়ায় আঁখিজলে
দুঃখ-ব্যথার রক্তশতদলে,
যা আছে সব ধুলায় ফেলে দিয়ে
যে আনন্দে বচন
নাহি ফুরে
সেই আনন্দ
মেলে তাহার সুরে।
১১ শ্রাবণ ১৩১৭
১৩৫
যখন আমায় বাঁধ আগে পিছে,
মনে করি আর পাব না ছাড়া।
যখন আমায় ফেল তুমি নীচে,
মনে করি আর হব না খাড়া।
আবার
তুমি দাও যে বাঁধন খুলে,
আবার
তুমি নাও আমারে তুলে,
চিরজীবন
বাহু-দোলায় তব
এমনি করে কেবলি দাও নাড়া।
ভয় লাগায়ে তন্দ্রা কর ক্ষয়,
ঘুম ভাঙায়ে তখন ভাঙ' ভয়।
দেখা দিয়ে ডাক দিয়ে যাও প্রাণে,
তাহার পরে লুকাও যে কোন্খানে,
মনে করি এই হারালেম বুঝি,
কোথা হতে আবার
যে দাও সাড়া।
১১ শ্রাবণ ১৩১৭
১৩৬
যতকাল তুই শিশুর মতো
রইবি বলহীন,
অন্তরেরি অন্তঃপুরে
থাক্ রে ততদিন।
অল্প ঘায়ে পড়বি ঘুরে,
অল্প দাহে মরবি পুড়ে,
অল্প গায়ে লাগলে ধুলা
করবে যে মলিন—
অন্তরেরি অন্তঃপুরে
থাক্ রে ততদিন।
যখন তোমার শক্তি হবে
উঠবে ভরে প্রাণ
আগুন-ভরা সুধা তাঁহার
করবি যখন পান—
বাইরে তখন যাস রে ছুটে,
থাকবি শুচি ধুলায় লুটে,
সকল বাঁধন অঙ্গে নিয়ে
বেড়াবি স্বাধীন—
অন্তরেরি অন্তঃপুরে
থাক্ রে ততদিন।
১৪ শ্রাবণ ১৩১৭
১৩৭
আমার চিত্ত তোমায় নিত্য হবে
সত্য হবে—
ওগো সত্য, আমার এমন সুদিন
ঘটবে কবে।
সত্য সত্য সত্য জপি,
সকল বুদ্ধি সত্যে সঁপি,
সীমার বাঁধন পেরিয়ে যাব
নিখিল ভবে,
সত্য, তোমার পূর্ণ প্রকাশ
দেখব কবে।
তোমায় দূরে সরিয়ে, মরি
আপন অসত্যে।
কী যে কাণ্ড করি গো সেই
ভূতের রাজত্বে।
আমার আমি ধুয়ে মুছে
তোমার মধ্যে যাবে ঘুচে,
সত্য, তোমায় সত্য হব
বাঁচব তবে,
তোমার মধ্যে মরণ আমার
মরবে কবে।
১৫ শ্রাবণ ১৩১৭
১৩৮
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি
আমার আমি সেইটুকু থাক্ বাকি।
তোমায় আমি হেরি সকল দিশি,
সকল দিয়ে তোমার মাঝে মিশি,
তোমারে প্রেম জোগাই দিবানিশি,
ইচ্ছা
আমার সেইটুকু থাক্ বাকি—
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি।
তোমায় আমি কোথাও নাহি ঢাকি
কেবল আমার সেইটুকু থাক্ বাকি।
তোমার লীলা হবে এ প্রাণ ভরে
এ সংসারে রেখেছ তাই ধরে,
রইব বাঁধা তোমার বাহুডোরে
বাঁধন আমার সেইটুকু থাক্ বাকি—
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি।
১৫ শ্রাবণ ১৩১৭
১৩৯
যা দিয়েছ আমার এ প্রাণ ভরি
খেদ রবে না এখন যদি মরি।
রজনীদিন কত দুঃখে সুখে
কত যে সুর বেজেছে এই বুকে,
কত বেশে আমার ঘরে ঢুকে
কত রূপে নিয়েছ মন হরি,
খেদ রবে না এখন যদি মরি।
জানি তোমায় নিই নি প্রাণে বরি,
পাই নি আমার সকল পূর্ণ ক রি।
যা পেয়েছি ভাগ্য বলে মানি,
দিয়েছ তো তব পরশখানি,
আছ তুমি এই জানা তো জানি—
যাব ধরি সেই ভরসার তরী।
খেদ রবে না এখন যদি মরি।
১৫ শ্রাবণ ১৩১৭
১৪০
ওরে মাঝি, ওরে আমার
মানবজন্মতরীর মাঝি,
শুনতে কি পাস দূরের থেকে
পারের বাঁশি উঠছে বাজি।
তরী কি তোর দিনের শেষে
ঠেকবে এবার ঘাটে এসে।
সেথায় সন্ধ্যা-অন্ধকারে
দেয় কি দেখা প্রদীপরাজি।
যেন আমার লাগছে মনে,
মন্দমধুর এই পবনে
সিন্ধুপারের হাসিটি কার
আঁধার বেয়ে আসছে আজি।
আসার বেলায় কুসুমগুলি
কিছু এনেছিলেম তুলি,
যেগুলি তার নবীন আছে
এইবেলা নে সাজিয়ে সাজি।
১৮ শ্রাবণ ১৩১৭ |