গীতাঞ্জলি
১৪১-১৫০


                 ১৪১
      মনকে, আমার কায়াকে,
আমি    একেবারে মিলিয়ে দিতে
      চাই এ কালো ছায়াকে।
           ওই আগুনে জ্বালিয়ে দিতে,
           ওই সাগরে তলিয়ে দিতে,
            ওই চরণে গলিয়ে দিতে,
                   দলিয়ে দিতে মায়াকে

                   মনকে, আমার কায়াকে।

যেখানে যাই সেথায় একে
আসন জুড়ে বসতে দেখে
লাজে মরি, লও গো হরি
      এই সুনিবিড় ছায়াকে।
      মনকে, আমার কায়াকে।

তুমি আমার অনুভাবে
কোথাও নাহি বাধা পাবে,
পূর্ণ একা দেবে দেখা
      সরিয়ে দিয়ে মায়াকে।
      মনকে, আমার কায়াকে।

১৯ শ্রাবণ ১৩১৭

             ১৪২
যাবার দিনে এই কথাটি
         বলে যেন যাই —
যা দেখেছি যা পেয়েছি
         তুলনা তার নাই।
         এই জ্যোতিঃসমুদ্র-মাঝে
         যে শতদল পদ্ম রাজে
         তারি মধু পান করেছি
                 ধন্য আমি তাই —
         যাবার দিনে এই কথাটি
                 জানিয়ে যেন যাই।

বিশ্বরূপের খেলাঘরে
        কতই গেলেম খেলে,
অপরূপকে দেখে গেলেম
       দুটি নয়ন মেলে।
           পরশ যাঁরে যায় না করা
           সকল দেহে দিলেন ধরা।
           এইখানে শেষ করেন যদি
                   শেষ করে দিন তাই —
            যাবার বেলা এই কথাটি
                    জানিয়ে যেন যাই।
২০ শ্রাবণ ১৩১৭

                ১৪৩
আমার    নামটা দিয়ে ঢেকে রাখি যারে
            মরছে সে এই নামের কারাগারে।
            সকল ভুলে যতই দিবারাতি
            নামটারে ওই আকাশপানে গাঁথি,
            ততই আমার নামের অন্ধকারে
            হারাই আমার সত্য আপনারে।

জড়ো করে ধূলির 'পরে ধূলি
নামটারে মোর উচ্চ করে তুলি।
           ছিদ্র পাছে হয় রে কোনোখানে
           চিত্ত মম বিরাম নাহি মানে,
           যতন করি যতই এ মিথ্যারে
           ততই আমি হারাই আপনারে।
২১ শ্রাবণ ১৩১৭

                ১৪৪
নামটা যেদিন ঘুচাবে, নাথ,
        বাঁচব সেদিন মুক্ত হয়ে —
আপনগড়া স্বপন হতে
        তোমার মধ্যে জনম লয়ে।
               ঢেকে তোমার হাতের লেখা
               কাটি নিজের নামের রেখা,
               কতদিন আর কাটবে জীবন
                      এমন ভীষণ আপদ বয়ে।

সবার সজ্জা হরণ করে
         আপনাকে সে সাজাতে চায়।
সকল সুরকে ছাপিয়ে দিয়ে
         আপনাকে সে বাজাতে চায়।
               আমার এ নাম যাক না চুকে,
               তোমারি নাম নেব মুখে,
               সবার সঙ্গে মিলব সেদিন
                          বিনা-নামের পরিচয়ে।
২১ শ্রাবণ ১৩১৭

                  ১৪৫
জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই,
       ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে।
মুক্তি চাহিবারে তোমার কাছে যাই
       চাহিতে গেলে মরি লাজে।
              জানি হে তুমি মম জীবনে শ্রেয়তম,
             এমন ধন আর নাহি যে তোমা-সম,
             তবু যা ভাঙাচোরা ঘরেতে আছে পোরা
                       ফেলিয়া দিতে পারি না যে।

তোমারে আবরিয়া ধুলাতে ঢাকে হিয়া
      মরণ আনে রাশি রাশি,
আমি যে প্রাণ ভরি তাদের ঘৃণা করি
      তবুও তাই ভালোবাসি।
           এতই আছে বাকি, জমেছে এত ফাঁকি,
           কত যে বিফলতা, কত যে ঢাকাঢাকি,
           আমার ভালো তাই চাহিতে যবে যাই
                          ভয় যে আসে মনোমাঝে।
২২ শ্রাবণ ১৩১৭

                  ১৪৬
তোমার দয়া যদি
         চাহিতে নাও জানি
তবুও দয়া করে
         চরণে নিয়ো টানি।
               আমি যা গড়ে তুলে
               আরামে থাকি ভুলে
                  সুখের উপাসনা
                        করি গো ফলে ফুলে —
               সে ধুলা-খেলাঘরে
               রেখো না ঘৃণাভরে,
                   জাগায়ো দয়া করে
                         বহ্নি-শেল হানি।

সত্য মুদে আছে
      দ্বিধার মাঝখানে,
তাহারে তুমি ছাড়া
      ফুটাতে কে বা জানে।
               মৃত্যু ভেদ করি'
               অমৃত পড়ে ঝরি',
                  অতল দীনতার
                      শূন্য উঠে ভরি' ।
               পতন-ব্যথা মাঝে
               চেতনা আসি বাজে,
                   বিরোধ কোলাহলে
                       গভীর তব বাণী।
২২ শ্রাবণ ১৩১৭

                ১৪৭
জীবনে যত পূজা
          হল না সারা,
জানি হে জানি তাও
          হয় নি হারা।

যে ফুল না ফুটিতে
ঝরেছে ধরণীতে,
যে নদী মরুপথে
          হারালো ধারা,
জানি হে জানি তাও
          হয় নি হারা।

                 জীবনে আজো যাহা
                           রয়েছে পিছে,
                 জানি হে জানি তাও
                           হয় নি মিছে।
                 আমার অনাগত
                 আমার অনাহত
                 তোমার বীণা-তারে
                           বাজিছে তারা —
                 জানি হে জানি তাও
                           হয় নি হারা।

২৩ শ্রাবণ ১৩১৭

                   ১৪৮
একটি নমস্কারে, প্রভু,
           একটি নমস্কারে
সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক
           তোমার এ সংসারে।

          ঘন শ্রাবণ-মেঘের মতো
          রসের ভারে নম্র নত
                একটি নমস্কারে, প্রভু,
                        একটি নমস্কারে
                সমস্ত মন পড়িয়া থাক্‌
                        তব ভবন-দ্বারে।

নানা সুরের আকুল ধারা
মিলিয়ে দিয়ে আত্মহারা
       একটি নমস্কারে, প্রভু,
              একটি নমস্কারে
       সমস্ত গান সমাপ্ত হোক
              নীরব পারাবারে।

          হংস যেমন মানসযাত্রী,
          তেমনি সারা দিবসরাত্রি
              একটি নমস্কারে, প্রভু,
                   একটি নমস্কারে
              সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক
                    মহামরণ-পারে।
২৩ শ্রাবণ ১৩১৭

             ১৪৯
      জীবনে যা চিরদিন
             রয়ে গেছে আভাসে
      প্রভাতের আলোকে যা
            ফোটে নাই প্রকাশে,

জীবনের শেষ দানে
জীবনের শেষ গানে,
      হে দেবতা, তাই আজি
            দিব তব সকাশে,
      প্রভাতের আলোকে যা
            ফোটে নাই প্রকাশে।

কথা তারে শেষ করে
           পারে নাই বাঁধিতে,
গান তারে সুর দিয়ে
           পারে নাই সাধিতে।
                কী নিভৃতে চুপে চুপে
                মোহন নবীনরূপে
                     নিখিল নয়ন হতে
                         ঢাকা ছিল, সখা, সে।
                     প্রভাতের আলোকে তো
                         ফোটে নাই প্রকাশে।

          ভ্রমেছি তাহারে লয়ে
                দেশে দেশে ফিরিয়া,
         জীবনে যা ভাঙাগড়া
                সবি তারে ঘিরিয়া।

সব ভাবে সব কাজে
আমার সবার মাঝে
       শয়নে স্বপনে থেকে
              তবু ছিল একা সে।
       প্রভাতের আলোকে তো
             ফোটে নাই প্রকাশে।

                    কত দিন কত লোকে
                            চেয়েছিল উহারে,
                    বৃথা ফিরে গেছে তারা
                           বাহিরের দুয়ারে

আর কেহ বুঝিবে না,
তোমা-সাথে হবে চেনা
      সেই আশা লয়ে ছিল
             আপনারি আকাশে,
      প্রভাতের আলোকে তো
             ফোটে নাই প্রকাশে।
২৪ শ্রাবণ ১৩১৭

             ১৫০
তোমার সাথে নিত্য বিরোধ
         আর সহে না —
দিনে দিনে উঠছে জমে
        কতই দেনা ।
            সবাই তোমায় সভার বেশে
            প্রণাম করে গেল এসে,
            মলিন বাসে লুকিয়ে বেড়াই
                      মান রহে না।

কী জানাব চিত্তবেদন,
বোবা হয়ে গেছে যে মন,
তোমার কাছে কোনো কথাই
                    আর কহে না।

           ফিরায়ো না এবার তারে
           লও গো অপমানের পারে,
           করো তোমার চরণতলে
                         চির-কেনা।
বোলপুর
২৫ শ্রাবণ ১৩১৭