গীতাঞ্জলি
২১-৩০


                        ২১
জানি জানি কোন্‌ আদি কাল হতে
ভাসালে আমারে জীবনের স্রোতে,
সহসা হে প্রিয়, কত গৃহে পথে
          রেখে গেছ প্রাণে কত হরষন।
                কতবার তুমি মেঘের আড়ালে
                এমনি মধুর হাসিয়া দাঁড়ালে,
                অরুণ-কিরণে চরণ বাড়ালে,
                ললাটে রাখিলে শুভ পরশন।
সঞ্চিত হয়ে আছে এই চোখে
কত কালে কালে কত লোকে লোকে
কত নব নব আলোকে আলোকে
               অরূপের কত রূপদরশন।
                    কত যুগে যুগে কেহ নাহি জানে
                    ভরিয়া ভরিয়া উঠেছে পরানে
                    কত সুখে দুখে কত প্রেমে গানে
                               অমৃতের কত রসবরষন।
    বোলপুর
১০ ভাদ্র ১৩১৬

                   ২২
তুমি     কেমন করে গান কর যে গুণী,
          অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি।
                   সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে,
                   সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে,
                   পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে,
                             বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী।

মনে করি অমনি সুরে গাই,
কণ্ঠে আমার সুর খুঁজে না পাই।
          কইতে কী চাই, কইতে কথা বাধে;
          হার মেনে যে পরান আমার কাঁদে;
          আমায় তুমি ফেলেছ কোন্‌ ফাঁদে
                           চৌদিকে মোর সুরের জাল বুনি!

                   ২৩
অমন    আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
                 চলবে না।
এবার   হৃদয়-মাঝে লুকিয়ে বোসো,
             কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।

                       বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,
                       দেশ-বিদেশে কতই ঘুরি,
             এবার বলো, আমার মনের কোণে
                            দেবে ধরা, ছলবে না।
           আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
                          চলবে না।
            জানি আমার কঠিন হৃদয়
            চরণ রাখার যোগ্য সে নয়,
সখা,   তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়
              তবু কি প্রাণ গলবে না।
                    নাহয় আমার নাই সাধনা,
                    ঝরলে তোমার কৃপার কণা
         তখন    নিমেষে কি ফুটবে না ফুল,
                          চকিতে ফল ফলবে না।
         আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
                      চলবে না।
   বোলপুর
১১ ভাদ্র ১৩১৬। রাত্রি

                     ২৪
যদি   তোমার দেখা না পাই প্রভু,
                     এবার এ জীবনে
তবে  তোমায় আমি পাই নি যেন
                   সে কথা রয় মনে।
যেন  ভুলে না যাই, বেদনা পাই
                    শয়নে স্বপনে।

                 এ সংসারের হাটে
      আমার   যতই দিবস কাটে,
      আমার   যতই দু হাত ভরে ওঠে ধনে,
      তবু       কিছুই আমি পাই নি যেন
                       সে কথা রয় মনে।
      যেন     ভুলে না যাই, বেদনা পাই
                             শয়নে স্বপনে।

      যদি     আলসভরে
আমি   বসি পথের 'পরে,
যদি    ধূলায় শয়ন পাতি সযতনে,
যেন    সকল পথই বাকি আছে
                     সে কথা রয় মনে।
যেন    ভুলে না যাই, বেদনা পাই
                         শয়নে স্বপনে।
                      যতই উঠে হাসি,
         ঘরে     যতই বাজে বাঁশি,
        ওগো     যতই গৃহ সাজাই আয়োজনে,
        যেন      তোমায় ঘরে হয় নি আনা
                        সে কথা রয় মনে।
        যেন      ভুলে না যাই, বেদনা পাই
                         শয়নে স্বপনে।
১২ ভাদ্র ১৩১৬

               ২৫
হেরি অহরহ তোমারি বিরহ
              ভুবনে ভুবনে রাজে হে।
কত রূপ ধ'রে কাননে ভূধরে
              আকাশে সাগরে সাজে হে।
                    সারা নিশি ধরি তারায় তারায়
                    অনিমেষ চোখে নীরবে দাঁড়ায়,
                    পল্লবদলে শ্রাবণধারায়
                              তোমারি বিরহ বাজে হে।
ঘরে ঘরে আজি কত বেদনায়
তোমারি গভীর বিরহ ঘনায়,
কত প্রেমে হায় কত বাসনায়
            কত সুখে দুখে কাজে হে।
                    সকল জীবন উদাস করিয়া
                    কত গানে সুরে গলিয়া ঝরিয়া
                    তোমারি বিরহ উঠিছে ভরিয়া
                            আমার হিয়ার মাঝে হে।
১২ ভাদ্র ১৩১৬

                 ২৬
আর     নাই রে বেলা, নামল ছায়া
                 ধরণীতে,
এখন   চল্‌ রে ঘাটে কলসখানি
                 ভরে নিতে।
                        জলধারার কলস্বরে
                        সন্ধ্যাগগন আকুল করে,
      ওরে      ডাকে আমায় পথের 'পরে
                        সেই ধ্বনিতে।
                 চল্‌ রে ঘাটে কলসখানি
                        ভরে নিতে।

এখন      বিজন পথে করে না কেউ
                       আসা-যাওয়া,
ওরে       প্রেম-নদীতে উঠেছে ঢেউ,
                       উতল হাওয়া।
                             জানি নে আর ফিরব কিনা,
                             কার সাথে আজ হবে চিনা,
                 ঘাটে      সেই অজানা বাজায় বীণা
                                      তরণীতে।
                             চল্‌ রে ঘাটে কলসখানি
                                      ভরে নিতে।
১৩ ভাদ্র ১৩১৬

                      ২৭
আজ        বারি ঝরে ঝর ঝর
                    ভরা বাদরে।
             আকাশ-ভাঙা আকুল ধারা
                   কোথাও না ধরে।
                        শালের বনে থেকে থেকে
                        ঝড় দোলা দেয় হেঁকে হেঁকে,
                        জল ছুটে যায় এঁকেবেঁকে
                                 মাঠের 'পরে।
          আজ       মেঘের জটা উড়িয়ে দিয়ে
                                নৃত্য কে করে।

ওরে     বৃষ্টিতে মোর ছুটেছে মন,
                  লুটেছে ওই ঝড়ে,
          বুক ছাপিয়ে তরঙ্গ মোর
                  কাহার পায়ে পড়ে।
                       অন্তরে আজ কী কলরোল,
                       দ্বারে দ্বারে ভাঙল আগল,
                       হৃদয়-মাঝে জাগল পাগল
                                 আজি ভাদরে।
          আজ      এমন করে কে মেতেছে
                                বাহিরে ঘরে।
১৪ ভাদ্র ১৩১৬

                     ২৮
প্রভু     তোমা লাগি আঁখি জাগে;
                 দেখা নাই পাই,
                     পথ চাই,
          সেও মনে ভালো লাগে।

               ধুলাতে বসিয়া দ্বারে
               ভিখারি হৃদয় হা রে
                    তোমারি করুণা মাগে।
                        কৃপা নাই পাই,
                           শুধু চাই,
                  সেও মনে ভালো লাগে।

       আজি এ জগত-মাঝে
       কত সুখে কত কাজে
           চলে গেল সবে আগে।
               সাথি নাই পাই,
                   তোমায় চাই,
           সেও মনে ভালো লাগে।
                       চারি দিকে সুধাভরা
                       ব্যাকুল শ্যামল ধরা
                              কাঁদায় রে অনুরাগে।
                                 দেখা নাই নাই,
                                    ব্যথা পাই,
                             সেও মনে ভালো লাগে।
১৪ ভাদ্র ১৩১৬
      রাত্রি
                     ২৯
ধনে জনে আছি জড়ায়ে হায়,
তবু জান, মন তোমারে চায়।
            অন্তরে আছ হে অন্তর্যামী,
            আমা চেয়ে আমায় জানিছ স্বামী

            সব সুখে দুখে ভুলে থাকায়
                   জান, মম মন তোমারে চায়।
ছাড়িতে পারি নি অহংকারে,
ঘুরে মরি শিরে বহিয়া তারে,
ছাড়িতে পারিলে বাঁচি যে হায়

           তুমি জান, মন তোমারে চায়।
                  যা আছে আমার সকলি কবে
                  নিজ হাতে তুমি তুলিয়া লবে।
                  সব ছেড়ে সব পাব তোমায়,
                       মনে মনে মন তোমারে চায়।
১৫ ভাদ্র ১৩১৬

                   ৩০
এই তো তোমার প্রেম, ওগো
            হৃদয়হরণ।
এই-যে পাতায় আলো নাচে
            সোনার বরন।
                 এই-যে মধুর আলসভরে
                 মেঘ ভেসে যায় আকাশ- 'পরে,
                 এই-যে বাতাস দেহে করে
                           অমৃত ক্ষরণ।
                 এই তো তোমার প্রেম, ওগো
                           হৃদয়হরণ।

প্রভাত-আলোর ধারায় আমার
             নয়ন ভেসেছে।
এই তোমারি প্রেমের বাণী
             প্রাণে এসেছে।
                   তোমারি মুখ ওই নুয়েছে,
                   মুখে আমার চোখ থুয়েছে,
                   আমার হৃদয় আজ ছুঁয়েছে
                           তোমারি চরণ।
১৬ ভাদ্র ১৩১৬