|  | ৩১ আমি হেথায় থাকি শুধু
 গাইতে তোমার গান,
 দিয়ো তোমার জগৎসভায়
 এইটুকু মোর স্থান।
 আমি তোমার ভুবন-মাঝে
 লাগি নি নাথ, কোনো কাজে—
 শুধু কেবল সুরে বাজে
 অকাজের এই প্রাণ।
 নিশায় নীরব দেবালয়ে
 তোমার আরাধন,
 তখন মোরে আদেশ কোরো
 গাইতে হে রাজন্।
 ভোরে যখন আকাশ জুড়ে
 বাজবে বীণা সোনার সুরে
 আমি যেন না রই দূরে
 এই দিয়ো মোর মান।
 ১৬ ভাদ্র ১৩১৬
 
 ৩২
 দাও হে আমার ভয় ভেঙে দাও।
 আমার দিকে ও মুখ ফিরাও।
 পাশে থেকে চিনতে নারি,
 কোন্ দিকে যে কী নেহারি,
 তুমি আমার হৃদ্বিহারী
 হৃদয়পানে হাসিয়া চাও।
 
 বলো আমায় বলো কথা,
 গায়ে আমার পরশ করো।
 দক্ষিণ হাত বাড়িয়ে দিয়ে
 আমায় তুমি তুলে ধরো।
 যা বুঝি সব ভুল বুঝি হে,
 যা খুঁজি সব ভুল খুঁজি হে—
 হাসি মিছে, কান্না মিছে,
 সামনে এসে এ ভুল ঘুচাও।
 ১৬ ভাদ্র ১৩১৬
                  
		৩৩আবার এরা ঘিরেছে মোর মন।
 আবার চোখে নামে যে আবরণ।
 আবার এ যে নানা কথাই জমে,
 চিত্ত আমার নানা দিকেই ভ্রমে,
 দাহ আবার বেড়ে ওঠে ক্রমে,
 আবার এ যে হারাই শ্রীচরণ।
 
 তব নীরব বাণী হৃদয়তলে
 ডোবে না যেন লোকের কোলাহলে।
 সবার মাঝে আমার সাথে থাকো,
 আমায় সদা তোমার মাঝে ঢাকো,
 নিয়ত মোর চেতনা- 'পরে রাখো
 আলোকে-ভরা উদার ত্রিভুবন।
 ১৬ ভাদ্র ১৩১৬
 
 ৩৪
 আমার মিলন লাগি তুমি
 আসছ কবে থেকে।
 তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়
 রাখবে কোথায় ঢেকে।
 কত কালের সকাল-সাঁঝে
 তোমার চরণধনি বাজে,
 গোপনে দূত হৃদয়মাঝে
 গেছে আমায় ডেকে।
 
 ওগো পথিক, আজকে আমার
 সকল পরান ব্যেপে
 থেকে থেকে হরষ যেন
 উঠছে কেঁপে কেঁপে।
 যেন সময় এসেছে আজ,
 ফুরালো মোর যা ছিল কাজ—
 বাতাস আসে হে মহারাজ,
 তোমার গন্ধ মেখে।
 ১৬ ভাদ্র ১৩১৬
 
 ৩৫
 এসো হে এসো, সজল ঘন,
 বাদলবরিষনে—
 বিপুল তব শ্যামল স্নেহে
 এসো হে 
		এ জীবনে।
 এসো হে গিরিশিখর চুমি,
 ছায়ায় ঘিরি কাননভূমি—
 গগন ছেয়ে এসো হে তুমি
 গভীর গরজনে।
 
 ব্যথিয়ে উঠে নীপের বন
 পুলকভরা 
		ফুলে।
 উছলি উঠে কলরোদন
 নদীর 
		কূলে কূলে।
 এসো হে এসো হৃদয়ভরা,
 এসো হে এসো পিপাসা-হরা,
 এসো হে আঁখি-শীতল-করা
 ঘনায়ে এসো মনে।
 ১৭ ভাদ্র ১৩১৬
 
 ৩৬
 পারবি না কি যোগ দিতে এই ছন্দে রে,
 খসে যাবার ভেসে যাবার
 ভাঙবারই 
		আনন্দে রে।
 পাতিয়া কান শুনিস না যে
 দিকে দিকে গগনমাঝে
 মরণবীণায় কী সুর বাজে
 তপন-তারা-চন্দ্রে রে
 জ্বালিয়ে আগুন ধেয়ে ধেয়ে
 জ্বলবারই আনন্দে রে।
 
 পাগল-করা গানের তানে
 ধায় যে কোথা কেই-বা জানে,
 চায় না ফিরে পিছন-পানে
 রয় না বাঁধা বন্ধে রে
 লুটে যাবার ছুটে যাবার
 চলবারই আনন্দে রে।
 সেই আনন্দ-চরণপাতে
 ছয় ঋতু যে নৃত্যে মাতে,
 প্লাবন বহে যায় ধরাতে
 বরন গীতে গন্ধে রে
 ফেলে দেবার ছেড়ে দেবার
 মরবারই আনন্দে রে।
 বোলপুর
 ১৮ ভাদ্র ১৩১৬
 
 ৩৭
 নিশার স্বপন ছুটল রে, এই
 ছুটল রে।
 টুটল বাঁধন টুটল রে।
 রইল না আর 
		আড়াল প্রাণে,
 বেরিয়ে এলেম 
		জগৎ-পানে,
 হৃদয়শতদলের 
		সকল
 দলগুলি এই ফুটল রে, এই
 ফুটল রে।
 
 দুয়ার আমার ভেঙে শেষে
 দাঁড়ালে এই আপনি এসে
 নয়নজলে ভেসে হৃদয়
 চরণতলে লুটল রে।
 আকাশ হতে প্রভাত-আলো
 আমার পানে হাত বাড়ালো,
 ভাঙা কারার দ্বারে আমার
 জয়ধ্বনি উঠল রে, এই
 উঠল রে।
 ১৮ ভাদ্র ১৩১৬
 
 ৩৮
 শরতে আজ কোন্ অতিথি
 এল প্রাণের দ্বারে।
 আনন্দগান গা রে হৃদয়,
 আনন্দগান গা রে।
 নীল আকাশের নীরব কথা
 শিশির-ভেজা ব্যাকুলতা
 বেজে উঠুক আজি তোমার
 বীণার তারে তারে।
 
 শস্যখেতের সোনার গানে
 যোগ দে রে আজ সমান তানে,
 ভাসিয়ে দে সুর ভরা নদীর
 অমল জলধারে।
 যে এসেছে তাহার মুখে
 দেখ্ রে চেয়ে গভীর সুখে,
 দুয়ার খুলে তাহার সাথে
 বাহির হয়ে যা রে।
 শান্তিনিকেতন
 ১৮ ভাদ্র ১৩১৬
 
 ৩৯
 হেথা     যে গান গাইতে আসা আমার
 হয় নি সে গান গাওয়া—
 আজো   কেবলি সুর সাধা , আমার
 কেবল গাইতে চাওয়া।
 আমার    লাগে নাই সে সুর, আমার
 বাঁধে নাই সে কথা,
 শুধু    প্রাণেরই মাঝখানে আছে
 গানের ব্যাকুলতা।
 আজো  ফোটে নাই সে ফুল, শুধু
 বহেছে এক হাওয়া।
 
 আমি    দেখি নাই তার মুখ, আমি
 শুনি নাই তার বাণী,
 কেবল   শুনি ক্ষণে ক্ষণে তাহার
 পায়ের ধ্বনিখানি।
 আমার    দ্বারের সমুখ দিয়ে সে জন
 করে আসা-যাওয়া।
 শুধু    আসন পাতা হল আমার
 সারাটি দিন ধ'রে—
 ঘরে   হয় নি প্রদীপ জ্বালা, তারে
 ডাকব কেমন ক'রে।
 আছি  পাবার আশা নিয়ে, তারে
 হয় নি আমারা পাওয়া।
 কলিকাতা
 ২৭ ভাদ্র ১৩১৬
                     
		৪০যা     হারিয়ে যায় তা আগলে বসে
 রইব কত আর।
 আর   পারি নে রাত জাগতে হে নাথ,
 ভাবতে অনিবার।
 আছি রাত্রিদিবস ধরে
 দুয়ার আমার বন্ধ করে,
 আসতে যে চায় সন্দেহে তায়
 তাড়াই বারে বার।
 
 তাই তো কারো হয় না আসা
 আমার একা ঘরে।
 আনন্দময় ভুবন তোমার
 বাইরে খেলা করে।
 তুমিও বুঝি পথ নাহি পাও,
 এসে এসে ফিরিয়া যাও,
 রাখতে যা চাই রয় না তাও
 ধুলায় একাকার।
 কলিকাতা
 ১ আশ্বিন ১৩১৬
 |