গীতাঞ্জলি
৪১-৫০
৪১ এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে হবে গো এইবার— আমার এই মলিন অহংকার। দিনের কাজে ধুলা লাগি অনেক দাগে হল দাগি, এমনি তপ্ত হয়ে আছে সহ্য করা ভার। আমার এই মলিন অহংকার। এখন তো কাজ সাঙ্গ হল দিনের অবসানে, হল রে তাঁর আসার সময় আশা এল প্রাণে। স্নান করে আয় এখন তবে প্রেমের বসন পরতে হবে, সন্ধ্যাবনের কুসুম তুলে গাঁথতে হবে হার। ওরে আয় সময় নেই যে আর। ১৯ আশ্বিন ১৩১৬ ৪২ গায়ে আমার পুলক লাগে, চোখে ঘনায় ঘোর, হৃদয়ে মোর কে বেঁধেছে রাঙা রাখীর ডোর। আজিকে এই আকাশতলে জলে স্থলে ফুলে ফলে কেমন করে মনোহরণ ছড়ালে মন মোর। কেমন খেলা হল আমার আজি তোমার সনে। পেয়েছি কি খুঁজে বেড়াই ভেবে না পাই মনে। আনন্দ আজ কিসের ছলে কাঁদিতে চায় নয়নজলে, বিরহ আজ মধুর হয়ে করেছে প্রাণ ভোর। শিলাইদহ ২৫ আশ্বিন ১৩১৬ ৪৩ প্রভু, আজি তোমার দক্ষিণ হাত রেখো না ঢাকি। এসেছি তোমারে, হে নাথ, পরাতে রাখী। যদি বাঁধি তোমার হাতে পড়ব বাঁধা সবার সাথে, যেখানে যে আছে কেহই রবে না বাকি। আজি যেন ভেদ নাহি রয় আপনা পরে, তোমায় যেন এক দেখি হে বাহিরে ঘরে। তোমার সাথে যে বিচ্ছেদে ঘুরে বেড়াই কেঁদে কেঁদে, ক্ষণেক-তরে ঘুচাতে তাই তোমারে ডাকি। শিলাইদহ ২৭ আশ্বিন ১৩১৬ ৪৪ জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ। ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন। নয়ন আমার রূপের পুরে সাধ মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে, শ্রবণ আমার গভীর সুরে হয়েছে মগন। তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার বাজাই আমি বাঁশি। গানে গানে গেঁথে বেড়াই প্রাণের কান্নাহাসি। এখন সময় হয়েছে কি। সভায় গিয়ে তোমায় দেখি জয়ধ্বনি শুনিয়ে যাব এ মোর নিবেদন। শিলাইদহ ৩০ আশ্বিন ১৩১৬ ৪৫ আলোয় আলোকময় ক'রে হে এলে আলোর আলো। আমার নয়ন হতে আঁধার মিলালো মিলালো। সকল আকাশ সকল ধরা আনন্দে হাসিতে ভরা, যে দিক-পানে নয়ন মেলি ভালো সবই ভালো। তোমার আলো গাছের পাতায় নাচিয়ে তোলে প্রাণ। তোমার আলো পাখির বাসায় জাগিয়ে তোলে গান। তোমার আলো ভালোবেসে পড়েছে মোর গায়ে এসে, হৃদয়ে মোর নির্মল হাত বুলালো বুলালো। বোলপুর ২০ অগ্রহায়ণ ১৩১৬ ৪৬ আসনতলের মাটির 'পরে লুটিয়ে রব। তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব। কেন আমায় মান দিয়ে আর দূরে রাখ, চিরজনম এমন করে ভুলিয়ো নাকো, অসম্মানে আনো টেনে পায়ে তব। তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব। আমি তোমার যাত্রীদলের রব পিছে, স্থান দিয়ো হে আমায় তুমি সবার নীচে। প্রসাদ লাগি কত লোকে আসে ধেয়ে, আমি কিছুই চাইব না তো রইব চেয়ে; সবার শেষে বাকি যা রয় তাহাই লব। তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব। শান্তিনিকেতন ১০ পৌষ ১৩১৬ ৪৭ রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি; ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী। সময় যেন হয় রে এবার ঢেউ খাওয়া সব চুকিয়ে দেবার, সুধায় এবার তলিয়ে গিয়ে অমর হয়ে রব মরি। যে গান কানে যায় না শোনা সে গান সেথায় নিত্য বাজে, প্রাণের বীণা নিয়ে যাব সেই অতলের সভামাঝে। চিরদিনের সুরটি বেঁধে শেষ গানে তার কান্না কেঁদে, নীরব যিনি তাঁহার পায়ে নীরব বীণা দিব ধরি। শান্তিনিকেতন ১২ পৌষ ১৩১৬ ৪৮ আকাশতলে উঠল ফুটে আলোর শতদল। পাপড়িগুলি থরে থরে ছড়ালো দিক্-দিগন্তরে, ঢেকে গেল অন্ধকারের নিবিড় কালো জল। মাঝখানেতে সোনার কোষে আনন্দে ভাই আছি বসে, আমায় ঘিরে ছড়ায় ধীরে আলোর শতদল। আকাশেতে ঢেউ দিয়ে রে বাতাস বহে যায়। চার দিকে গান বেজে ওঠে, চার দিকে প্রাণ নাচে ছোটে, গগনভরা পরশখানি লাগে সকল গায়। ডুব দিয়ে এই প্রাণসাগরে নিতেছি প্রাণ বক্ষ ভরে, ফিরে ফিরে আমায় ঘিরে বাতাস বহে যায়। দশ দিকেতে আঁচল পেতে কোল দিয়েছে মাটি। রয়েছে জীব যে যেখানে সকলকে সে ডেকে আনে, সবার হাতে সবার পাতে অন্ন সে দেয় বাঁটি। ভরেছে মন গীতে গন্ধে, বসে আছি মহানন্দে, আমায় ঘিরে আঁচল পেতে কোল দিয়েছে মাটি। আলো, তোমায় নমি আমার মিলাক অপরাধ। ললাটেতে রাখো আমার পিতার আশীর্বাদ। বাতাস, তোমায় নমি, আমার ঘুচুক অবসাদ, সকল দেহে বুলায়ে দাও পিতার আশীর্বাদ। মাটি, তোমায় নমি, আমার মিটুক সর্ব সাধ। গৃহ ভরে ফলিয়ে তোলো পিতার আশীর্বাদ। পৌষ ১৩১৬ ৪৯ হেথায় তিনি কোল পেতেছেন আমাদের এই ঘরে। আসনটি তাঁর সাজিয়ে দে ভাই, মনের মতো করে। গান গেয়ে আনন্দমনে ঝাঁটিয়ে দে সব ধুলা। যত্ন করে দূর করে দে আবর্জনাগুলা। জল ছিটিয়ে ফুলগুলি রাখ সাজিখানি ভরে— আসনটি তাঁর সাজিয়ে দে ভাই, মনের মতো করে। দিনরজনী আছেন তিনি আমাদের এই ঘরে, সকালবেলায় তাঁরি হাসি আলোক ঢেলে পড়ে। যেমনি ভোরে জেগে উঠে নয়ন মেলে চাই, খুশি হয়ে আছেন চেয়ে দেখতে মোরা পাই। তাঁরি মুখের প্রসন্নতায় সমস্ত ঘর ভরে। সকালবেলায় তাঁরি হাসি আলোক ঢেলে পড়ে। একলা তিনি বসে থাকেন আমাদের এই ঘরে আমরা যখন অন্য কোথাও চলি কাজের তরে, দ্বারের কাছে তিনি মোদের এগিয়ে দিয়ে যান— মনের সুখে ধাই রে পথে, আনন্দে গাই গান। দিনের শেষে ফিরি যখন নানা কাজের পরে, দেখি তিনি একলা বসে আমাদের এই ঘরে। তিনি জেগে বসে থাকেন আমাদের এই ঘরে আমরা যখন অচেতনে ঘুমাই শয্যা- 'পরে। জগতে কেউ দেখতে না পায় লুকানো তাঁর বাতি, আঁচল দিয়ে আড়াল করে জ্বালান সারা রাতি। ঘুমের মধ্যে স্বপন কতই আনাগোনা করে, অন্ধকারে হাসেন তিনি আমাদের এই ঘরে। পৌষ ১৩১৬ ৫০ নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা, ভক্ত, সেথায় খোলো দ্বার, আজ লব তাঁর দেখা। সারাদিন শুধু বাহিরে ঘুরে ঘুরে কারে চাহি রে, সন্ধ্যাবেলার আরতি হয় নি আমার শেখা। তব জীবনের আলোতে জীবন-প্রদীপ জ্বালি হে পূজারি, আজ নিভৃতে সাজাব আমার থালি। যেথা নিখিলের সাধনা পূজালোক করে রচনা, সেথায় আমিও ধরিব একটি জ্যোতির রেখা। শান্তিনিকেতন ১৭ পৌষ ১৩১৬ |