|  | ৫১ কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ
 জ্বালিয়ে তুমি ধরায় 
		আস।
 সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো,
 পাগল ওগো, ধরায় আস।
 
 এই    অকুল সংসারে
 দুঃখ-আঘাত তোমার প্রাণে বীণা ঝংকারে।
 ঘোর   বিপদ-মাঝে
 কোন্ জননীর মুখের হাসি দেখিয়া হাস।
 
 তুমি    কাহার সন্ধানে
 সকল সুখে আগুন জ্বেলে বেড়াও কে জানে।
 এমন ব্যাকুল করে
 কে তোমারে কাঁদায় যারে ভালোবাস।
 
 তোমার ভাবনা কিছু নাই—
 কে যে তোমার সাথের সাথি ভাবি মনে তাই।
 তুমি   মরণ ভুলে
 কোন্ অনন্ত প্রাণসাগরে আনন্দে ভাস।
 
		পৌষ ১৩১৬
 ৫২
 তুমি আমার আপন, তুমি আছ আমার কাছে,
 এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও।
 তোমার মাঝে মোর জীবনের সব আনন্দ আছে,
 এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও।
 
 আমায়     দাও সুধাময় সুর,
 আমার     বাণী করো সুমধুর;
 আমার     প্রিয়তম তুমি, এই কথাটি
 বলতে দাও হে বলতে দাও।
 
 এই      
		নিখিল আকাশ ধরা
 এ যে    
		তোমায় দিয়ে ভরা,
 আমার   
		হৃদয় হতে এই কথাটি
 বলতে দাও হে বলতে দাও।
 
 দুখি     জেনেই 
		কাছে আস,
 ছোটো   বলেই ভালোবাস,
 আমার  ছোটো মুখে এই কথাটি
 বলতে দাও হে বলতে দাও।
 মাঘ ১৩১৬
                    
		৫৩নামাও নামাও আমায় তোমার
 চরণতলে,
 গলাও হে মন, ভাসাও জীবন
 নয়নজলে।
 একা আমি 
		অহংকারের
 উচ্চ অচলে,
 পাষাণ-আসন 
		ধুলায় লুটাও,
 ভাঙো সবলে।
 
 নামাও নামাও আমায় তোমার
 চরণতলে।
 
 কী লয়ে বা গর্ব করি
 ব্যর্থ জীবনে।
 ভরা গৃহে শূন্য আমি
 তোমা বিহনে।
 
 দিনের কর্ম ডুবেছে মোর
 আপন অতলে
 সন্ধ্যাবেলার পূজা যেন
 যায় না বিফলে।
 নামাও নামাও আমায় তোমার
 চরণতলে।
 মাঘ ১৩১৬
 
 ৫৪
 আজি    গন্ধবিধুর সমীরণে
 কার      সন্ধানে ফিরি বনে বনে।
 আজি     
		ক্ষুব্ধ নীলাম্বর-মাঝে
 এ কী     
		চঞ্চল ক্রন্দন বাজে ।
 সুদূর দিগন্তের 
		সকরুণ সংগীত
 লাগে মোর চিন্তায় কাজে —
 আমি   
		খুঁজি কারে অন্তরে মনে
 গন্ধবিধুর সমীরণে ।
 
 ওগো     জানি না কী নন্দনরাগে
 সুখে      উৎসুক যৌবন জাগে।
 আজি   
		আম্রমুকুলসৌগন্ধ্যে,
 নব-    
		পল্লব-মর্মর ছন্দে,
 চন্দ্র-কিরণ-সুধা-সিঞ্চিত অম্বরে
 অশ্রু-সরস মহানন্দে
 আমি পুলকিত কার 
		পরশনে
 গন্ধবিধুর সমীরণে।
 বোলপুর
 ফাল্গুন ১৩১৩
               
		৫৫আজি   বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
 তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে
 কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
 আজি   
		খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,
 আজি   
		ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,
 এই      
		সংগীত-মুখরিত গগনে
 তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো ।
 এই      
		বাহির ভুবনে দিশা হারায়ে
 দিয়ো    
		ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে ।
 
 অতি     নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে
 আজি    পল্লবে পল্লবে বাজে রে —
 দূরে      গগনে কাহার পথ চাহিয়া
 আজি    ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে রে ।
 মোর    পরানে দখিন বায়ু লাগিছে,
 কারে    দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে,
 এই     সৌরভবিহ্বল রজনী
 কার     চরণে ধরণীতলে জাগিছে ।
 ওগো   সুন্দর, বল্লভ, কান্ত,
 তব গম্ভীর আহ্বান কারে।
     বোলপুর২৬ চৈত্র ১৩১৬
              
		৫৬তব     সিংহাসনের আসন হতে
 এলে তুমি নেমে,
 মোর  বিজন ঘরের দ্বারের কাছে
 দাঁড়ালে নাথ থেমে।
 একলা বসে আপন-মনে
 গাইতেছিলেম গান,
 তোমার কানে গেল সে সুর
 এলে তুমি নেমে,
 মোর   বিজন ঘরের দ্বারের কাছে
 দাঁড়ালে নাথ থেমে।
 
 তোমার সভায় কত-না গান
 কতই আছেন গুণী;
 গুণহীনের গানখানি আজ
 বাজল তোমার প্রেমে।
 লাগল বিশ্বতানের মাঝে
 একটি করুণ সুর,
 হাতে লয়ে বরণমালা
 এলে তুমি নেমে,
 মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে
 দাঁড়ালে নাথ থেমে।
 ২৭ চৈত্র ১৩১৬
 
 ৫৭
 তুমি  এবার আমায় লহো হে নাথ, লহো।
 এবার তুমি ফিরো না হে —
 হৃদয়   কেড়ে নিয়ে রহো।
 যে দিন গেছে তোমা বিনা
 তারে আর ফিরে চাহি না,
 যাক সে ধুলাতে।
 
 এখন    তোমার আলোয় জীবন মেলে
 যেন   জাগি অহরহ।
 কী আবেশে কিসের কথায়
 ফিরেছি হে যথায় তথায়
 পথে প্রান্তরে,
 এবার বুকের কাছে ও মুখ রেখে
 তোমার   আপন বাণী কহো
 কত কলুষ কত ফাঁকি
 এখনো যে আছে বাকি
 মনের গোপনে,
 আমায়    তার লাগি আর ফিরায়ো না,
 তারে আগুন দিয়ে দহো।
 ২৯ চৈত্র ১৩১৬
               
		৫৮জীবন যখন শুকায়ে যায়
 করুণাধারায় এসো।
 সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,
 গীতসুধারসে এসো।
 
 কর্ম যখন প্রবল-আকার
 গরজি উঠিয়া ঢাকে 
		চারি ধার,
 হৃদয়প্রান্তে হে 
		নীরব নাথ,
 শান্তচরণে এসো।
 
 আপনারে যবে করিয়া কৃপণ
 কোণে পড়ে থাকে দীনহীন মন,
 দুয়ার খুলিয়া হে উদার নাথ,
 রাজ-সমারোহে এসো।
 
 বাসনা যখন 
		বিপুল ধুলায়
 অন্ধ করিয়া 
		অবোধে ভুলায়
 ওহে পবিত্র, 
		ওহে অনিদ্র,
 রুদ্র আলোকে এসো।
 ২৮ চৈত্র ১৩১৬
                  
		৫৯এবার   নীরব করে দাও হে তোমার
 মুখর কবিরে।
 তার    হৃদয়-বাঁশি আপনি কেড়ে
 বাজাও গভীরে।
 নিশীথরাতের নিবিড় সুরে
 বাঁশিতে তান দাও হে পুরে,
 যে তান দিয়ে অবাক কর'
 গ্রহশশীরে।
 
 যা-কিছু মোর ছড়িয়ে আছে
 জীবন-মরণে,
 গানের টানে মিলুক এসে
 তোমার চরণে।
 বহুদিনের বাক্যরাশি
 এক নিমেষে যাবে ভাসি,
 একলা বসে শুনব বাঁশি
 অকূল তিমিরে।
 ৩০ চৈত্র ১৩১৬
                  
		৬০বিশ্ব যখন নিদ্রামগন,
 গগন অন্ধকার;
 কে দেয় আমার বীণার তারে
 এমন ঝংকার।
 নয়নে ঘুম নিল কেড়ে,
 উঠে বসি শয়ন ছেড়ে,
 মেলে আঁখি চেয়ে থাকি
 পাই নে দেখা তার।
 গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া
 প্রাণ উঠিল পুরে,
 জানি নে কোন্ বিপুল বাণী
 বাজে ব্যাকুল সুরে।
 কোন্ বেদনায় বুঝি না রে
 হৃদয় ভরা অশ্রুভারে,
 পরিয়ে দিতে চাই কাহারে
 আপন কণ্ঠহার ।
 ৪ বৈশাখ ১৩১৭
 |