|  | ৬১ সে যে     পাশে এসে বসেছিল
 তবু জাগি নি।
 কী ঘুম তোরে পেয়েছিল
 হতভাগিনী।
 এসেছিল নীরব রাতে
 বীণাখানি ছিল হাতে,
 স্বপনমাঝে বাজিয়ে গেল
 গভীর রাগিণী।
 জেগে দেখি দখিন-হাওয়া
 পাগল করিয়া
 গন্ধ তাহার ভেসে বেড়ায়
 আঁধার ভরিয়া।
 কেন আমার রজনী যায়—
 কাছে পেয়ে কাছে না পায়
 কেন গো তার মালার পরশ
 বুকে লাগে নি।
 বোলপুর
 ১২ বৈশাখ ১৩১৭
               
		৬২তোরা শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি,
 ওই যে আসে, আসে, 
		আসে।
 যুগে যুগে পলে পলে দিনরজনী
 সে যে আসে, আসে, 
		আসে।
 গেয়েছি গান যখন যত
 আপন-মনে খ্যাপার মতো
 সকল সুরে বেজেছে তার
 আগমনী —
 সে যে    আসে, আসে, আসে।
 
 কত কালের ফাগুন-দিনে বনের পথে
 সে যে আসে, 
		আসে, আসে।
 কত শ্রাবণ  অন্ধকারে মেঘের রথে
 সে যে আসে, 
		আসে, আসে।
 দুখের পরে পরম দুখে,
 তারি চরণ বাজে বুকে,
 সুখে কখন্ বুলিয়ে সে দেয়
 পরশমণি।
 সে যে আসে, আসে, 
		আসে।
 
 কলিকাতা
 ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭
 
 ৬৩
 মেনেছি, হার মেনেছি।
 ঠেলতে গেছি তোমায় যত
 আমায় তত হেনেছি।
 আমার চিত্তগগন থেকে
 তোমায় কেউ যে রাখবে ঢেকে
 কোনোমতেই সইবে না সে
 বারেবারেই জেনেছি।
 
 অতীত জীবন ছায়ার মতো
 চলছে পিছে পিছে,
 কত মায়ার বাঁশির সুরে
 ডাকছে আমায় মিছে।
 মিল ছুটেছে তাহার সাথে,
 ধরা দিলেম তোমার হাতে,
 যা আছে মোর এই জীবনে
 তোমার দ্বারে এনেছি।
 তিনধরিয়া
 ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭
                  
		৬৪একটি একটি করে তোমার
 পুরানো তার খোলো,
 সেতারখানি নূতন বেঁধে তোলো।
 ভেঙে গেছে দিনের মেলা,
 বসবে সভা সন্ধ্যাবেলা,
 শেষের সুর যে বাজাবে তার
 আসার সময় হল—
 সেতারখানি নূতন বেঁধে তোলো।
 
 দুয়ার তোমার খুলে দাও গো
 আঁধার 
		আকাশ-' পরে,
 সপ্তলোকের নীরবতা
 আসুক 
		তোমার ঘরে।
 এতদিন যে গেয়েছ গান
 আজকে তারি হোক অবসান,
 এ যন্ত্র যে তোমার যন্ত্র
 সেই কথাটাই ভোলো।
 সেতারখানি নূতন বেঁধে তোলো।
 তিনধরিয়া
 ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭
 
 ৬৫
 কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে —
 সে তো    আজকে নয় সে 
		আজকে নয়।
 ভুলে গেছি কবে থকে আসছি তোমায় চেয়ে
 সে তো    আজকে নয় সে 
		আজকে নয়।
 ঝরনা যেমন বাহিরে যায়,
 জানে না সে কাহারে চায়,
 তেমনি করে ধেয়ে এলেম
 জীবনধারা বেয়ে —
 সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।
 
 কতই নামে ডেকেছি যে,
 কতই ছবি এঁকেছি যে,
 কোন্ আনন্দে চলেছি, তার
 ঠিকানা না পেয়ে —
 সে তো    আজকে নয় সে আজকে নয়।
 
 পুষ্প যেমন আলোর লাগি
 না জেনে রাত কাটায় জাগি,
 তেমনি তোমার আশায় আমার
 হৃদয় আছে ছেয়ে —
 সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।
 
 তিনধরিয়া
 ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭
                    
		৬৬তোমার প্রেম যে বইতে পারি
 এমন সাধ্য নাই।
 এ সংসারে তোমার আমার
 মাঝখানেতে তাই
 কৃপা করে রেখেছ নাথ
 অনেক ব্যবধান —
 দুঃখসুখের অনেক বেড়া
 ধনজনমান।
 
 আড়াল থেকে ক্ষণে ক্ষণে
 আভাসে দাও দেখা —
 কালো 
		মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
 রবির মৃদু রেখা।
 শক্তি 
		যারে দাও বহিতে
 অসীম প্রেমের ভার
 একেবারে 
		সকল পর্দা
 ঘুচায়ে দাও তার।
 
 না রাখ তার ঘরের আড়াল
 না রাখ তার ধন,
 পথে এনে নিঃশেষে তায়
 কর অকিঞ্চন।
 
 না থাকে তার মান অপমান,
 লজ্জা শরম ভয়,
 একলা তুমি সমস্ত তার
 বিশ্বভুবনময়।
 
 এমন করে মুখোমুখি
 সামনে তোমার থাকা,
 কেবলমাত্র তোমাতে প্রাণ
 পূর্ণ করে রাখা,
 এ দয়া যে পেয়েছে তার
 লোভের সীমা নাই —
 সকল লোভ সে সরিয়ে ফেলে
 তোমায় দিতে ঠাঁই।
 তিনধরিয়া
 ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭
                     
		৬৭সুন্দর, তুমি এসেছিলে আজ 
		প্রাতে
 অরুণ-বরণ পারিজাত লয়ে 
		হাতে।
 নিদ্রিত পুরী, পথিক ছিল না পথে,
 একা চলি গেলে তোমার সোনার রথে,
 বারেক থামিয়া মোর বাতায়নপানে
 চেয়েছিলে তব করুণ নয়নপাতে।
 সুন্দর, তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে।
 
 স্বপন আমার ভরেছিল কোন্ গন্ধে
 ঘরের আঁধার কেঁপেছিল কী আনন্দে,
 ধুলায় লুটানো নীরব আমার বীণা
 বেজে উঠেছিল অনাহত কী আঘাতে।
 
 কতবার আমি ভেবেছিনু উঠি-উঠি
 আলস ত্যজিয়া পথে বাহিরাই ছুটি,
 উঠিনু যখন তখন গিয়েছ চলে —
 দেখা 
		বুঝি আর হল না তোমার সাথে।
 সুন্দর, 
		তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে।
 
 তিনধরিয়া
 ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭
                
		৬৮আমার    খেলা যখন ছিল তোমার সনে
 তখন   
		কে তুমি তা কে জানত।
 তখন     ছিল না ভয় ছিল না লাজ মনে
 জীবন   
		বহে যেত অশান্ত।
 তুমি     ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত
 যেন আমার আপন সখার মতো,
 হেসে   তোমার সাথে ফিরেছিলেম ছুটে
 সেদিন কত না বন-বনান্ত।
 
 ওগো      সেদিন তুমি গাইতে যে-সব গান
 কোনো অর্থ তাহার কে জানত।
 শুধু        সঙ্গে তারি গাইত আমার 
		প্রাণ ,
 সদা     
		নাচত হৃদয় অশান্ত।
 হঠাৎ    খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি,
 স্তব্ধ আকাশ, নীরব শশী রবি,
 তোমার চরণপানে নয়ন করি' নত
 ভুবন দাঁড়িয়ে আছে একান্ত।
 ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭
                  
		৬৯ওই যে তরী দিল খুলে।
 তোর বোঝা কে নেবে তুলে।
 সামনে যখন যাবি ওরে
 থাক্ না পিছন পিছে পড়ে,
 পিঠে তারে বইতে গেলি,
 একলা পড়ে রইলি কূলে।
 
 ঘরের বোঝা টেনে টেনে।
 পারের ঘাটে রাখলি এনে,
 তাই যে তোরে বারে বারে
 ফিরতে হল গেলি ভুলে।
 ডাক রে 
		আবার মাঝিরে ডাক,
 বোঝা 
		তোমার যাক ভেসে যাক,
 জীবনখানি উজাড় করে
 সঁপে দে তার চরণমূলে।
 
 তিনধরিয়া
 ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭
              
		৭০চিত্ত আমার হারাল আজ
 মেঘের মাঝখানে,
 কোথায় ছুটে চলেছে সে
 কোথায় কে জানে।
 বিজুলি তা'র বীণার তারে
 আঘাত করে বারে বারে,
 বুকের মাঝে বজ্র বাজে
 কী মহাতানে।
 পুঞ্জ পুঞ্জ ভারে ভারে
 নিবিড় নীল অন্ধকারে
 জড়াল রে অঙ্গ আমার,
 ছড়াল প্রাণে।
 পাগল হাওয়া নৃত্যে মাতি
 হল আমার সাথের সাথি,
 অট্টহাসে ধায় কোথা সে—
 বারণ না মানে।
 তিনধরিয়া
 ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭
 |