গীতাঞ্জলি
৭১-৮০


               ৭১
ওগো মৌন, না যদি কও
        না-ই কহিলে কথা।
বক্ষ ভরি বইব আমি
       তোমার নীরবতা।
              স্তব্ধ হয়ে রইব পড়ে,
              রজনী রয় যেমন করে
              জ্বালিয়ে তারা নিমেষহারা
                      ধৈর্যে অবনতা।

হবে হবে প্রভাত হবে
    আঁধার যাবে কেটে।
তোমার বাণী সোনার ধারা
    পড়বে আকাশ ফেটে।
              তখন আমার পাখির বাসায়
              জাগবে কি গান তোমার ভাষায়।
             তোমার তানে ফোটাবে ফুল
                         আমার বনলতা ?
   তিনধরিয়া
১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭

               ৭২
যতবার আলো জ্বালাতে চাই
      নিবে যায় বারে বারে।
আমার জীবনে তোমার আসন
      গভীর অন্ধকারে।
              যে লতাটি আছে শুকায়েছে মূল
              কুঁড়ি ধরে শুধু, নাহি ফোটে ফুল,
              আমার জীবনে তব সেবা তাই
                       বেদনার উপহারে।

পূজাগৌরব পুণ্যবিভব
      কিছু নাহি, নাহি লেশ,
এ তব পূজারি পরিয়া এসেছে
      লজ্জার দীন বেশ।
              উৎসবে তার আসে নাই কেহ,
              বাজে নাই বাঁশি , সাজে নাই গেহ —
              কাঁদিয়া তোমায় এনেছে ডাকিয়া
                      ভাঙা মন্দির-দ্বারে।
   তিনধরিয়া
১ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭

                  ৭৩
সবা হতে রাখব তোমায়
           আড়াল ক'রে
হেন পূজার ঘর কোথা পাই
           আমার ঘরে।
                    যদি আমার দিনে রাতে,
                    যদি আমার সবার সাথে
                    দয়া ক'রে দাও ধরা, তো
                                  রাখব ধরে।
মান দিব যে তেমন মানী
      নই তো আমি,
পূজা করি সে আয়োজন
      নাই তো স্বামী।
                  যদি তোমায় ভালোবাসি,
                  আপনি বেজে উঠবে বাঁশি,
                  আপনি ফুটে উঠবে কুসুম,
                               কানন ভরে।
১ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭

               ৭৪
বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি,
        সে কি সহজ গান।
সেই সুরেতে জাগব আমি
        দাও মোরে সেই কান।
                 ভুলব না আর সহজেতে,
                 সেই প্রাণে মন উঠবে মেতে
                 মৃত্যুমাঝে ঢাকা আছে
                         যে অন্তহীন প্রাণ।

সে ঝড় যেন সই আনন্দে
           চিত্তবীণার তারে
সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত
           নাচাও যে ঝংকারে।
               আরাম হতে ছিন্ন ক'রে
               সেই গভীরে লও গো মোরে
               অশান্তির অন্তরে যেথায়
                          শান্তি সুমহান।

     তিনধরিয়া
১ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭

              ৭৫
দয়া দিয়ে হবে গো মোর
              জীবন ধুতে —
নইলে কি আর পারব তোমার
              চরণ ছুঁতে।
তোমায় দিতে পূজার ডালি
বেড়িয়ে পড়ে সকল কালি,
পরান আমার পারি নে তাই
              পায়ে থুতে।
                        এতদিন তো ছিল না মোর
                                  কোনো ব্যথা,
                        সর্ব অঙ্গে মাখা ছিল
                                  মলিনতা।
                        আজ ওই শুভ্র কোলের তরে
                        ব্যাকুল হৃদয় কেঁদে মরে

                        দিয়ো না গো, দিয়ো না আর
                                 ধুলায় শুতে।

     কলিকাতা
২৪
জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭

              ৭৬
সভা যখন ভাঙবে তখন
          শেষের গান কি যাব গেয়ে।
হয়তো তখন কণ্ঠহারা
          মুখের পানে রব চেয়ে।
এখনো যে সুর লাগে নি
বাজবে কি আর সেই রাগিণী,
প্রেমের ব্যথা সোনার তানে
         সন্ধ্যাগগন ফেলবে ছেয়ে?
এতদিন যে সেধেছি সুর
         দিনেরাতে আপন-মনে
ভাগ্যে যদি সেই সাধনা
         সমাপ্ত হয় এই জীবনে—
এ জনমের পূর্ণ বাণী
মানস-বনের পদ্মখানি
ভাসাব শেষ সাগরপানে
        বিশ্বগানের ধারা বেয়ে।

    কলিকাতা
২৪
জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭

              ৭৭
        চিরজনমের বেদনা,
ওহে   চিরজীবনের সাধনা।
            তোমার আগুন উঠুক হে জ্বলে,
            কৃপা করিয়ো না দুর্বল বলে,
            যত তাপ পাই সহিবারে চাই,
                      পুড়ে হোক ছাই বাসনা।

অমোঘ যে ডাক সেই ডাক দাও
            আর দেরি কেন মিছে।
যা আছে বাঁধন বক্ষ জড়ায়ে
            ছিঁড়ে প'ড়ে যাক পিছে।
গরজি গরজি শঙ্খ তোমার
বাজিয়া বাজিয়া উঠুক এবার,
গর্ব টুটিয়া নিদ্রা ছুটিয়া
            জাগুক তীব্র চেতনা।

   কলিকাতা
২৬
জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭

               ৭৮
তুমি যখন গান গাহিতে বল
          গর্ব আমার ভ'রে ওঠে বুকে;
দুই আঁখি মোর করে ছল ছল
          নিমেষহারা চেয়ে তোমার মুখে।
কঠিন কটু যা আছে মোর প্রাণে
গলিতে চায় অমৃতময় গানে,
সব সাধনা আরাধনা মম
         উড়িতে চায় পাখির মতো সুখে।

         তৃপ্ত তুমি আমার গীতরাগে,
         ভালো লাগে তোমার ভালো লাগে,
         জানি আমি এই গানের ই বলে
                  বসি গিয়ে তোমারি সম্মুখে।
         মন দিয়ে যার নাগাল নাহি পাই,
         গান দিয়ে সেই চরণ ছুঁয়ে যাই,
         সুরের ঘোরে আপনাকে যাই ভুলে,
                  বন্ধু ব'লে ডাকি মোর প্রভুকে।

২৭
জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭

                     ৭৯
         ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা
প্রভু,   তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে।
         যায় যেন মোর সকল গভীর আশা
প্রভু,   তোমার কানে, তোমার কানে, তোমার কানে।

         চিত্ত মম যখন যেথায় থাকে,
সাড়া   যেন দেয় সে তোমার ডাকে,
         যত বাধা সব টুটে যায় যেন
প্রভু,   তোমার টানে, তোমার টানে, তোমার টানে।

         বাহিরের এই ভিক্ষাভরা থালি
         এবার যেন নিঃশেষে হয় খালি,
         অন্তর মোর গোপনে যায় ভরে
প্রভু,   তোমার দানে, তোমার দানে, তোমার দানে।

         হে বন্ধু মোর, হে অন্তরতর,
         এ জীবনে যা-কিছু সুন্দর
         সকলি আজ বেজে উঠুক সুরে
প্রভু,   তোমার গানে, তোমার গানে, তোমার গানে।

        কলিকাতা
২৮
জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭
 
                ৮০
তারা    দিনের বেলা এসেছিল
                 আমার ঘরে,
          বলেছিল, একটি পাশে
                রইব প'ড়ে।
          বলেছিল, দেবতা সেবায়
          আমরা হব তোমার সহায় —
          যা কিছু পাই প্রসাদ লব
              পূজার পরে।
 

              এমনি করে দরিদ্র ক্ষীণ
                   মলিন বেশে
              সংকোচেতে একটি কোণে
                   রইল এসে।
              রাতে দেখি প্রবল হয়ে
              পশে আমার দেবালয়ে,
              মলিন হাতে পূজার বলি
                    হরণ করে।

     বোলপুর
২৮
জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭