গীতাঞ্জলি
১-৯০


                     ৮১
তারা   তোমার নামে বাটের মাঝে
               মাসুল লয় যে ধরি।
         দেখি শেষে ঘাটে এসে
               নাইকো পারের কড়ি।
         তারা তোমার কাজের ভানে
         নাশ করে গো ধনে প্রাণে,
         সামান্য যা আছে আমার
                 লয় তা অপহরি।

                আজকে আমি চিনেছি সেই
                          ছদ্মবেশী-দলে।
                তারাও আমায় চিনেছে হায়
                          শক্তিবিহীন বলে।
                গোপন মূর্তি ছেড়েছে তাই,
                লজ্জা শরম আর কিছু নাই,
                দাঁড়িয়েছে আজ মাথা তুলে
                           পথ অবরোধ করি।
    বোলপুর
২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭

                     ৮২
     এই জ্যোৎস্নারাতে জাগে আমার প্রাণ;
               পাশে তোমার হবে কি আজ স্থান।
         দেখতে পাব অপূর্ব সেই মুখ,
         রইবে চেয়ে হৃদয় উৎসুক,
         বারে বারে চরণ ঘিরে ঘিরে
                ফিরবে আমার অশ্রুভরা গান ?
         সাহস করে তোমার পদমূলে
         আপনারে আজ ধরি নাই যে তুলে,
         পড়ে আছি মাটিতে মুখ রেখে,
               ফিরিয়ে পাছে দাও হে আমার দান।
আপনি যদি আমার হাতে ধরে
কাছে এসে উঠতে বল মোরে,
তবে প্রাণের অসীম দরিদ্রতা
        এই নিমেষেই হবে অবসান।

    বোলপুর
২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭

                    ৮৩
কথা ছিল এক-তরীতে কেবল তুমি আমি
     যাব    অকারণে ভেসে কেবল ভেসে,
ত্রিভুবনে জানবে না কেউ আমরা তীর্থগামী
     কোথায়   যেতেছি কোন্‌ দেশে সে কোন্‌ দেশে।
               কূলহারা সেই সমুদ্র-মাঝখানে
               শোনাব গান একলা তোমার কানে,
               ঢেউয়ের মতন ভাষা-বাঁধন-হারা
     আমার    সেই রাগিণী শুনবে নীরব হেসে।

আজো সময় হয় নি কি তার, কাজ কি আছে বাকি।
    ওগো   ওই-যে সন্ধ্যা নামে সাগরতীরে।
মলিন আলোয় পাখা মেলে সিন্ধুপারের পাখি
    আপন   কুলায়-মাঝে সবাই এল ফিরে।
               কখন তুমি আসবে ঘাটের 'পরে
              বাঁধনটুকু কেটে দেবার তরে।
              অস্তরবির শেষ আলোটির মতো
    তরী   নিশীথমাঝে যাবে নিরুদ্দেশে।

   বোলপুর
৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭

                  ৮৪
আমার    একলা ঘরের আড়াল ভেঙে
                    বিশাল ভবে
            প্রাণের রথে বাহির হতে
                    পারব কবে।
            প্রবল প্রেমে সবার মাঝে
            ফিরব ধেয়ে সকল কাজে,
            হাটের পথে তোমার সাথে
                    মিলন হবে,
            প্রাণের রথে বাহির হতে
                    পারব কবে।

                         নিখিল আশা-আকাঙ্ক্ষা-ময়
                                  দুঃখে সুখে,
                         ঝাঁপ দিয়ে তার তরঙ্গপাত
                                  ধরব বুকে।
                         মন্দ-ভালোর আঘাত-বেগে,
                         তোমার বুকে উঠব জেগে,
                         শুনব বাণী বিশ্বজনের
                                  কলরবে।
                         প্রাণের রথে বাহির হতে
                                  পারব কবে।
১ আষাঢ় ১৩১৭

                     ৮৫
একা আমি ফিরব না আর
       এমন করে —
নিজের মনে কোণে কোণে
       মোহের ঘোরে।
তোমায়   একলা বাহুর বাঁধন দিয়ে
            ছোটো করে ঘিরতে গিয়ে
            আপনাকে যে বাঁধি কেবল
                    আপন ডোরে।

                   যখন আমি পাব তোমায়
                         নিখিলমাঝে
                  সেইখনে হৃদয়ে পাব
                         হৃদয়রাজে।
এই    চিত্ত আমার বৃন্ত কেবল
           তারি 'পরে বিশ্বকমল;
           তারি 'পরে পূর্ণ প্রকাশ
                        দেখাও মোরে।
২ আষাঢ় ১৩১৭
 
                  ৮৬
আমারে যদি জাগালে আজি নাথ,
    ফিরো না তবে ফিরো না, করো
               করুণ আঁখিপাত।
                   নিবিড় বন-শাখার 'পরে
                   আষাঢ়-মেঘে বৃষ্টি ঝরে,
                   বাদলভরা আলসভরে
                          ঘুমায়ে আছে রাত।
                  ফিরো না তুমি ফিরো না, করো
                          করুণ আঁখিপাত।

বিরামহীন বিজুলিঘাতে
       নিদ্রাহারা প্রাণ
বরষা-জলধারার সাথে
      গাহিতে চাহে গান।
                হৃদয় মোর চোখের জলে
                বাহির হল তিমিরতলে,
                আকাশ খোঁজে ব্যাকুল বলে
                        বাড়ায়ে দুই হাত।
                ফিরো না তুমি ফিরো না, করো
                        করুণ আঁখিপাত।

৩ আষাঢ় ১৩১৭

                ৮৭
ছিন্ন করে লও হে মোরে
             আর বিলম্ব নয়
ধুলায় পাছে ঝরে পড়ি
             এই জাগে মোর ভয়।
এ ফুল তোমার মালার মাঝে
ঠাঁই পাবে কি , জানি না যে,
তবু তোমার আঘাতটি তার
              ভাগ্যে যেন রয়।
ছিন্ন করো ছিন্ন করো
              আর বিলম্ব নয়।

               কখন্ যে দিন ফুরিয়ে যাবে,
                        আসবে আঁধার করে,
               কখন তোমার পূজার বেলা
                        কাটবে অগোচরে।
               যেটুকু এর রঙ ধরেছে,
               গন্ধে সুধায় বুক ভরেছে,
               তোমার সেবায় লও সেটুকু
                        থাকতে সুসময়।
               ছিন্ন করো ছিন্ন করো
                        আর বিলম্ব নয়।

৩ আষাঢ় ১৩১৭
 
                 ৮৮
চাই গো আমি তোমারে চাই
        তোমায় আমি চাই —
এই কথাটি সদাই মনে
        বলতে যেন পাই।
আর যা-কিছু বাসনাতে
        ঘুরে বেড়াই দিনে রাতে
মিথ্যা সে-সব মিথ্যা ওগো
        তোমায় আমি চাই।
                    রাত্রি যেমন লুকিয়ে রাখে
                           আলোর প্রার্থনাই —
                    তেমনি গভীর মোহের মাঝে
                          তোমায় আমি চাই।
                    শান্তিরে ঝড় যখন হানে
                    শান্তি তবু চায় সে প্রাণে,
                    তেমনি তোমায় আঘাত করি
                            তবু তোমায় চাই।
৩ আষাঢ় ১৩১৭

               ৮৯
আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু,
           নয় তো হীনবল,
শুধু কি এ ব্যাকুল হয়ে
          ফেলবে অশ্রুজল।
মন্দমধুর সুখে শোভায়
প্রেমকে কেন ঘুমে ডোবায়।
তোমার সাথে জাগতে সে চায়
          আনন্দে পাগল।

নাচো যখন ভীষণ সাজে
তীব্র তালের আঘাত বাজে,
পালায় ত্রাসে পালায় লাজে
          সন্দেহ-বিহ্বল।
সেই প্রচণ্ড মনোহরে
প্রেম যেন মোর বরণ করে,
ক্ষুদ্র আশার স্বর্গ তাহার
          দিক সে রসাতল।

৪ আষাঢ় ১৩১৭

                    ৯০
আরো আঘাত সইবে আমার
              সইবে আমারো,
আরো কঠিন সুরে জীবনতারে ঝংকারো।
             যে রাগ জাগাও আমার প্রাণে
             বাজে নি তা চরমতানে,
             নিঠুর মূর্ছনায় সে গানে
                       মূর্তি সঞ্চারো।

লাগে না গো কেবল যেন
            কোমল করুণা,
মৃদু সুরের খেলায় এ প্রাণ
            ব্যর্থ কোরো না।
                 জ্বলে উঠুক সকল হুতাশ,
                 গর্জি উঠুক সকল বাতাস,
                 জাগিয়ে দিয়ে সকল আকাশ
                         পূর্ণতা বিস্তারো।
৪ আষাঢ় ১৩১৭