গীতাঞ্জলি
১-১০০


                    ৯১
এই করেছ ভালো, নিঠুর,
            এই করেছ ভালো।
এমনি করে হৃদয়ে মোর
            তীব্র দহন জ্বালো।
                   আমার এ ধূপ না পোড়ালে
                   গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে,
                   আমার এ দীপ না জ্বালালে
                            দেয় না কিছুই আলো।

যখন থাকে অচেতনে
        এ চিত্ত আমার
আঘাত সে যে পরশ তব
        সেই তো পুরস্কার।
                  অন্ধকারে মোহে লাজে
                  চোখে তোমায় দেখি না যে,
                  বজ্রে তোলো আগুন করে
                            আমার যত কালো।
৪ আষাঢ় ১৩১৭
 
                    ৯২
দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে,
          আপন জেনে আদর করি নে।
পিতা বলে প্রণাম করি পায়ে,
          বন্ধু বলে দু-হাত ধরি নে।
                   আপনি তুমি অতি সহজ প্রেমে
                   আমার হয়ে এলে যেথায় নেমে
                   সেথায় সুখে বুকের মধ্যে ধরে
                         সঙ্গী বলে তোমায় বরি নে।

ভাই তুমি যে ভায়ের মাঝে প্রভু,
তাদের পানে তাকাই না যে তবু,
ভাইয়ের সাথে ভাগ করে মোর ধন
           তোমার মুঠা কেন ভরি নে।
                   ছুটে এসে সবার সুখে দুখে
                   দাঁড়াই নে তো তোমারি সম্মুখে,
                   সঁপিয়ে প্রাণ ক্লান্তিবিহীন কাজে
                              প্রাণসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ি নে।
৫ আষাঢ় ১৩১৭

                       ৯৩
তুমি যে কাজ করছ, আমায়
             সেই কাজে কি লাগাবে না।
কাজের দিনে আমায় তুমি
             আপন হাতে জাগাবে না ?
                      ভালোমন্দ ওঠাপড়ায়
                      বিশ্বশালার ভাঙাগড়ায়
                      তোমার পাশে দাঁড়িয়ে যেন
                             তোমার সাথে হয় গো চেনা।

ভেবেছিলেম বিজন ছায়ায়
         নাই যেখানে আনাগোনা,
সন্ধ্যাবেলায় তোমায় আমায়
         সেথায় হবে জানাশোনা।
                  অন্ধকারে একা একা
                  সে দেখা যে স্বপ্ন দেখা,
                  ডাকো তোমার হাটের মাঝে
                       চলছে যেথায় বেচাকেনা।
৬ আষাঢ় ১৩১৭

                 ৯৪
বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো ।
          নয়কো বনে, নয় বিজনে,
          নয়কো আমার আপন মনে,
সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়,
         সেথায় আপন আমারো।

        সবার পানে যেথায় বাহু পসারো,
       সেইখানেতেই প্রেম জাগিবে আমারো।
                  গোপনে প্রেম রয় না ঘরে,
                  আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে,
        সবার তুমি আনন্দধন, হে প্রিয়,
                 আনন্দ সেই আমারো।
৭ আষাঢ় ১৩১৭
 
                  ৯৫
ডাকো ডাকো ডাকো আমারে,
তোমার স্নিগ্ধ শীতল গভীর
          পবিত্র আঁধারে।
                তুচ্ছ দিনের ক্লান্তি গ্লানি
                দিতেছে জীবন ধুলাতে টানি,
                সারাক্ষণের বাক্যমনের
                         সহস্র বিকারে।

মুক্ত করো হে মুক্ত করো আমারে,
তোমার নিবিড় নীরব উদার
              অনন্ত আঁধারে।
                   নীরব রাত্রে হারাইয়া বাক্‌
                   বাহির আমার বাহিরে মিশাক,
                   দেখা দিক মম অন্তরতম
                          অখণ্ড আকারে।
৭ আষাঢ় ১৩১৭

                 ৯৬
যেথায় তোমার লুট হতেছে ভুবনে
সেইখানে মোর চিত্ত যাবে কেমনে।
          সোনার ঘটে সূর্য তারা
          নিচ্ছে তুলে আলোর ধারা,
অনন্ত প্রাণ ছড়িয়ে পড়ে গগনে।
সেইখানে মোর চিত্ত যাবে কেমনে।

          যেথায় তুমি বস' দানের আসনে,
          চিত্ত আমার সেথায় যাবে কেমনে।
               নিত্য নূতন রসে ঢেলে
               আপনাকে যে দিচ্ছ মেলে,
         সেথা কি ডাক পড়বে না গো জীবনে।
         সেইখানে মোর চিত্ত যাবে কেমনে।

১৮ আষাঢ় ১৩১৭

                       ৯৭
          ফুলের মতন আপনি ফুটাও গান,
          হে আমার নাথ, এই তো তোমার দান।
ওগো   সে ফুল দেখিয়া আনন্দে আমি ভাসি,
          আমার বলিয়া উপহার দিতে আসি,
তুমি     নিজ হাতে তারে তুলে লও স্নেহে হাসি,
          দয়া করে প্রভু রাখো মোর অভিমান।

         তার পরে যদি পূজার বেলার শেষে
         এ গান ঝরিয়া ধরার ধুলায় মেশে,
তবে    ক্ষতি কিছু নাই
তব করতলপুটে
         অজস্র ধন কত লুটে কত টুটে,
তারা   আমার জীবনে ক্ষণকালতরে ফুটে,
         চিরকালতরে সার্থক করে প্রাণ।
৯ আষাঢ় ১৩১৭

                      ৯৮
        মুখ ফিরায়ে রব তোমার পানে।
        এই ইচ্ছাটি সফল করো প্রাণে।
কেবল থাকা, কেবল চেয়ে থাকা,
কেবল আমার মনটি তুলে রাখা,
সকল ব্যথা সকল আকাঙ্ক্ষায়
       সকল দিনের কাজেরি মাঝখানে।
             নানা ইচ্ছা ধায় নানা দিক-পানে,
             একটি ইচ্ছা সফল করো প্রাণে।
         সেই ইচ্ছাটি রাতের পরে রাতে
         জাগে যেন একের বেদনাতে,
         দিনের পরে দিনকে যেন গাঁথে
              একের সূত্রে এক আনন্দগানে।
১০ আষাঢ় ১৩১৭

                   ৯৯
আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে —
আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে ।
       এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি
       পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি
              নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে
              আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।
              রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের 'পরে
              নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে।
এসেছে এসেছে এই কথা বলে প্রাণ,
এসেছে এসেছে উঠিতেছে এই গান,
             নয়নে এসেছে , হৃদয়ে এসেছে ধেয়ে।
             আবার আষাঢ় এসেছে আকাশ ছেয়ে।

১০ আষাঢ় ১৩১৭

                 ১০০
আজ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে;
       চলেছে গরজি, চলেছে নিবিড় সাজে।
হৃদয়ে তাহার নাচিয়া উঠিছে ভীমা,
ধাইতে ধাইতে লোপ ক'রে চলে সীমা,
কোন্‌ তাড়নায় মেঘের সহিত মেঘে,
       বক্ষে বক্ষে মিলিয়া বজ্র বাজে।
       বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে।

       পুঞ্জে পুঞ্জে দূর সুদূরের পানে
       দলে দলে চলে, কেন চলে নাহি জানে।
জানে না কিছুই কোন্‌ মহাদ্রিতলে
গভীর শ্রাবণে গলিয়া পড়িবে জলে,
নাহি জানে তার ঘনঘোর সমারোহে
       কোন্‌ সে ভীষণ জীবন-মরণ রাজে।
       বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে।

           ঈশান কোণেতে ওই যে ঝড়ের বাণী
           গুরু গুরু রবে কী করিছে কানাকানি ।
দিগন্তরালে কোন্‌ ভবিতব্যতা
স্তব্ধ তিমিরে বহে ভাষাহীন ব্যথা,
কালো কল্পনা নিবিড় ছায়ার তলে
ঘনায়ে উঠিছে কোন্‌ আসন্ন কাজে।
বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে।

১২ আষাঢ় ১৩১৭