৩০
সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি
তারায় তারায় খচিত,
স্বর্ণে রত্নে শোভন লোভন জানি
বর্ণে বর্ণে রচিত।
খড়্গ তোমার আরো মনোহর লাগে
বাঁকা বিদ্যুতে আঁকা সে,
গরুড়ের পাখা রক্তরবির রাগে
যেন গো অস্ত-আকাশে।
জীবন-শেষের শেষ জাগরণসম
ঝলসিছে মহাবেদনা―
নিমেষে দহিয়া যাহা-কিছু আছে মম
তীব্র ভীষণ চেতনা।
সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি
তারায় তারায় খচিত―
খড়্গ তোমার,হে দেব বজ্রপাণি,
চরম শোভায় রচিত।
The Heath
2 Holford Road
Hampstead
২৫ জুন ১৯১২
৩১
“কে নিবি গো কিনে আমায়, কে নিবি গো কিনে?”
পসরা মোর হেঁকে হেঁকে বেড়াই রাতে দিনে।
এমনি কবে হায়, আমার
দিন যে চলে যায়,
মায়ার’পরে বোঝা আমার বিষম হল দায়।
কেউ বা আসে, কেউ বা হাসে, কেউ বা কেঁদে চায়।
মধ্যদিনে বেড়াই রাজার পাষাণ-বাঁধা পথে,
মুকুট-মাথে অস্ত্র-হাতে রাজা এল রথে।
বললে হাতে ধরে, “তোমায়
কিনব আমি জোরে।”
জোর যা ছিল ফুরিয়ে গেল টানাটানি করে।
মুকুট-মাথে ফিরল রাজা সোনার রথে চড়ে।
রুদ্ধ্ব দ্বারের সমুখ দিয়ে ফিরতেছিলেম গলি।
দুয়ার খুলে বৃদ্ধ এল হাতে টাকার থলি।
করলে বিবেচনা, বললে,
“কিনব দিয়ে সোনা।”
উজাড় করে দিয়ে থলি করলে আনাগোনা।
বোঝা মাথায় নিয়ে কোথায় গেলেম অন্যমনা।
সন্ধ্যাবেলায় জ্যোৎস্না নামে মুকুল-ভরা গাছে।
সুন্দরী সে বেরিয়ে এল বকুলতলার কাছে।
বললে কাছে এসে, “তোমায়
কিনব আমি হেসে।”
হাসিখানি চোখের জলে মিলিয়ে এল শেষে;
ধীরে ধীরে ফিরে গেল বনছায়ার দেশে।
সাগরতীরে রোদ পড়েছে ঢেউ দিয়েছে জলে,
ঝিনুক নিয়ে খেলে শিশু বালুতটের তলে।
যেন আমায় চিনে বললে,
“অমনি নেব কিনে।”
বোঝা আমার খালাস হল তখনি সেইদিনে।
খেলার মুখে বিনামূল্যে নিল আমায় জিনে।
৩২
তোমারি নাম বলব নানা ছলে।
বলব একা বসে, আপন
মনের ছায়াতলে।
বলব বিনা ভাষায়,
বলব বিনা আশায়,
বলব মুখের হাসি দিয়ে,
বলব চোখের জলে।
বিনা-প্রয়োজনের ডাকে
ডাকব তোমার নাম,
সেই ডাকে মোর শুধু শুধুই
পুরবে মনস্কাম।
শিশু যেমন মাকে
নামের নেশায় ডাকে,
বলতে পারে এই সুখেতেই
মায়ের নাম সে বলে।
৩৩
অসীম ধন তো আছে তোমার
তাহে সাধ না মেটে।
নিতে চাও তা আমার হাতে
কণায় কণায় বেঁটে।
দিয়ে তোমার রতনমণি
আমায় করলে
ধনী,
এখন দ্বারে এসে ডাক,
রয়েছি দ্বার এঁটে।
আমায় তুমি করবে দাতা
আপনি ভিক্ষু হবে,
বিশ্বভুবন মাতল যে তাই
হাসির কলরবে।
তুমি রইবে না ওই রথে,
নামবে ধুলাপথে,
যুগযুগান্ত আমার সাথে
চলবে হেঁটে হেঁটে।
Cheyne Walk
৮ ভাদ্র
১৩২০
৩৪
এ মণিহার আমায় নাহি সাজে।
পরতে গেলে লাগে,এরে
ছিঁড়তে গেলে বাজে।
কণ্ঠ যে রোধ করে,
সুর তো নাহি সরে,
ওই দিকে যে মন পড়ে রয়
মন লাগে না কাজে।
তাই তো বসে আছি,
এ হার তোমায় পরাই যদি
তবেই আমি বাঁচি।
ফুলমালার ডোরে
বরিয়া লও মোরে
তোমার কাছে দেখাই নে মুখ
মণিমালার লাজে।
৩৫
ভোরের বেলায় কখন এসে
পরশ করে গেছ হেসে।
আমার ঘুমের দুয়ার ঠেলে
কে সেই খবর দিল মেলে,
জেগে দেখি আমার আঁখি
আঁখির জলে গেছে ভেসে।
মনে হল আকাশ যেন
কইল কথা কানে কানে।
মনে হল সকল দেহ
পূর্ণ হল গানে গানে।
হৃদয় যেন শিশিরনত
ফুটল পূজার ফুলের মতো
জীবননদী কূল ছাপিয়ে
ছড়িয়ে গেল অসীম দেশে।
৩৬
প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে।
ভয়-ভাবনার বাধা টুটেছে
দুঃখকে আজ কঠিন বলে
জড়িয়ে ধরতে বুকের তলে
উধাও হয়ে হৃদয় ছুটেছে।
প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে।
হেথায় কারো ঠাঁই হবে না,
মনে ছিল এই ভাবনা
দুয়ার ভেঙে সবাই জুটেছে।
যতন করে আপনাকে যে
রেখেছিলেম ধুয়ে মেজে,
আনন্দে সে ধুলায় লুটেছে।
প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে।
৩৭
জীবন যখন ছিল ফুলের মতো
পাপড়ি তাহার ছিল শত শত।
বসন্তে সে হত যখন দাতা
ঝরিয়ে দিত দু-চারটে তার পাতা,
তবুও যে তার বাকি রইত কত।
আজ বুঝি তার ফল ধরেছে, তাই
হাতে তাহার অধিক কিছু নাই।
হেমন্তে তার সময় হল এবে
পূর্ণ করে আপনাকে সে দেবে,
রসের ভারে তাই সে অবনত।
৩৮
ভেলার মতো বুকে টানি
কলমখানি
মন যে ভেসে চলে।
ঢেউয়ে ঢেউয়ে বেড়ায় দুলে
কূলে কূলে
স্রোতের কলকলে।
ভবের স্রোতের কলকলে।
এবার কেড়ে লও এ ভেলা
ঘুচাও খেলা
জলের কোলাহলে।
অধীর জলের কোলাহলে।
এবার তুমি ডুবাও তারে
একেবারে
রসের রসাতলে।
গভীর রসের রসাতলে।
৩৯
বাজাও আমারে বাজাও।
বাজালে যে সুরে প্রভাত-আলোরে
সেই সুরে মোরে বাজাও।
যে সুর ভরিলে ভাষাভোলা-গীতে
শিশুর নবীন জীবন-বাঁশিতে
জননীর মুখ-তাকানো হাসিতে—
সেই সুরে মোরে বাজাও।
সাজাও আমারে সাজাও।
যে সাজে সাজালে ধরার ধূলিরে
সেই সাজে মোরে সাজাও।
সন্ধ্যামালতী সাজে যে ছন্দে
শুধু আপনারি গোপন গন্ধে,
যে সাজ নিজেরে ভোলে আনন্দে
সেই সাজে মোরে সাজাও।