গীতবিতান

  বিচিত্র
 

 

 

                                                                            ১

আমায়  ক্ষমো হে ক্ষমো, নমো হে নমো, তোমায় স্মরি, হে নিরুপম,

                নৃত্যরসে চিত্ত মম উছল হয়ে বাজে

   আমার সকল দেহের আকুল রবে  মন্ত্রহারা তোমার স্তবে

ডাইনে বামে ছন্দ নামে নবজনমের মাঝে।

বন্দনা মোর ভঙ্গিতে আজ সঙ্গীতে বিরাজে

 

একি পরম ব্যথায় পরান কাঁপায়,  কাঁপন বক্ষে লাগে।

       শান্তিসাগরে ঢেউ খেলে যায়, সুন্দর তায় জাগে।

              আমার সব চেতনা সব বেদনা রচিল এ যে কী আরাধনা—

                       তোমার পায়ে মোর সাধনা মরে না যেন লাজে।

 বন্দনা মোর ভঙ্গিতে আজ সঙ্গীতে বিরাজে

 

কাকন হতে তুলি নি ফুল, মেলে নি মোরে ফল।

কলস মম শূন্যসম, ভরি নি তীর্থজল।

আমার তনু তনুতে বাঁধনহারা   হৃদয় ঢালে অধরা ধারা—

তোমার চরণে হোক তা সারা পূজার পুণ্য কাজে।

বন্দনা মোর ভঙ্গিতে আজ সঙ্গীতে বিরাজে

 

               ২

নৃত্যের তালে তালে, নটরাজ,          ঘুচাও ঘুচাও ঘুচাও সকল বন্ধ হে।

সুপ্তি ভাঙাও, চিত্তে জাগাও   মুক্ত সুরের ছন্দ হে

তোমার চরণপবনপরশে   সরস্বতীর মানসসরসে

যুগে যুগে কালে কালে   সুরে সুরে তালে তালে

ঢেউ তুলে দাও, মাতিয়ে জাগাও অমলকমলগন্ধ হে

নমো নমো নমো—

তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম

নৃত্যে তোমার মুক্তির রূপ, নৃত্যে তোমার মায়া,

বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে কাঁপে নৃত্যের ছায়া।

তোমার বিশ্ব-নাচের দোলায় দোলায় বাঁধন পরায় বাঁধন খোলায়

যুগে যুগে কালে কালে সুরে সুরে তালে তালে,

অন্ত কে তার সন্ধান পায় ভাবিতে লাগায় ধন্দ হে

                                                  নমো নমো নমো—

তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম

 

নৃত্যের বশে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু,

পদযুগ ঘিরে জ্যোতিমঞ্জীরে বাজিল চন্দ্র ভানু।

তব নৃত্যের প্রাণবেদনায় বিবশ বিশ্ব জাগে চেতনায়

যুগে যুগে কালে কালে সুরে সুরে তালে তালে,

সুখে দুখে হয় তরঙ্গময় তোমার পরমানন্দ হে

                                                    নমো নমো নমো—

তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম

 

মোর সংসারে তাণ্ডব তব কম্পিত জটাজালে।

লোকে লোকে ঘুরে এসেছি তোমার নাচের ঘূর্ণিতালে।

ওগো সন্ন্যাসী, ওগো সুন্দর,  ওগো শঙ্কর, হে ভয়ঙ্কর,

যুগে যুগে কালে কালে সুরে সুরে তালে তালে,

জীবন-মরণ-নাচের ডমরু বাজাও জলদমন্দ্র হে

নমো নমো নমো—

তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম

 

নাই ভয়, নাই ভয়, নাই রে।

      থাক্ পড়ে থাক্ ভয় বাইরে

জাগো, মৃত্যুঞ্জয়, চিত্তে থৈ থৈ নর্তননৃত্যে।

ওরে মন, বন্ধনছিন্ন

দাও তালি তাই তাই তাই রে

 

 

    প্রলয়নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে,

হে নটরাজ, জটার বাঁধন পড়ল খুলে

                জাহ্নবী তাই মুক্ত ধারায়   উন্মাদিনী দিশা হারায়,

সঙ্গীতে তার তরঙ্গদল উঠল দুলে

    রবির আলো সাড়া দিল আকাশ-পারে,

শুনিয়ে দিল অভয়বাণী ঘর-ছাড়ারে।

আপন স্রোতে আপনি মাতে,   সাথি হল আপন-সাথে,

সব-হারা সে সব পেল তার কূলে কুলে

 

 

            দুই হাতে—

কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে ডাইনে বাঁয়ে দুই হাতে,

সুপ্তি ছুটে নৃত্য উঠে নিত্য নূতন সংঘাতে

      বাজে ফুলে, বাজে কাঁটায়, আলোছায়ার জোয়ার-ভাঁটায়,

প্রাণের মাঝে ওই-যে বাজে দুঃখে সুখে শঙ্কাতে

তালে তালে সাঁঝ-সকালে রূপ-সাগরে ঢেউ লাগে।

সাদা-কালোর দ্বন্দ্বে যে ওই  ছন্দে নানান রঙ জাগে।

        এই তালে তোর গান বেঁধে নে— কান্নাহাসির তান সেধে নে,

            ডাক দিল শোন্ মরণ বাঁচন নাচন-সভার ডঙ্কাতে

 

 

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ।

তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ

হাসি কান্না হীরাপান্না দোলে ভালে,

কাঁপে ছন্দে ভালো মন্দ তালে তালে।

নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু পাছে পাছে

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ।

কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ,

দিবারাত্রি নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ—

সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ

 

    

        আমার ঘুর লেগেছে— তাধিন্ তাধিন্।

তোমার   পিছন পিছন নেচে নেচে   ঘুর লেগেছে তাধিন্ তাধিন্।

তোমার   তালে আমার চরণ চলে,  শুনতে না পাই কে কী বলে—

তাধিন্ তাধিন্।

তোমার   গানে আমার প্রাণে যে কোন্  পাগল ছিল সেই জেগেছে—

তাধিন্ তাধিন্।

আমার   লাজের বাঁধন সাজের বাঁধন খ’সে গেল ভজন সাধন—

তাধিন্ তাধিন্।

বিষম    নাচের বেগে দোলা লেগে ভাবনা যত সব ভেগেছে—

তাধিন্ তাধিন্

 

  

কমলবনের মধুপরাজি  এসো হে কমলভবনে।

কী সুধাগন্ধ এসেছে আজি নববসন্তপবনে

অমল চরণে ঘেরিয়া পুলকে শত শতদল ফুটিল,

বারতা তাহারি দ্যুলোকে ভূলোকে ছুটিল ভুবনে ভুবনে

গ্রহে তারকায় কিরণে কিরণে বাজিয়া উঠিছে রাগিণী

গীতগুঞ্জন কূজনকাকলি আকুলি উঠিছে শ্রবণে।

সাগর গাহিছে কল্লোলগাথা, বায়ু বাজাইছে শঙ্খ—

সামগান উঠে বনপল্লবে, মঙ্গলগীত জীবনে

 

  

এসো গো নূতন জীবন।

এসো গো কঠোর নিঠুর নীরব,   এসো গো ভীষণ শোভন

       এসো অপ্রিয় বিরস তিক্ত,  এসো গো অশ্রুসলিলসিক্ত,

এসো গো ভূষণবিহীন রিক্ত,  এসো গো চিত্তপাবন

থাক্ বীণাবেণু, মালতীমালিকা পূর্ণিমানিশি, মায়াকুহেলিকা—

       এসো গো প্রখর হোমানলশিখা  হৃদয়শোণিতপ্রাশন।

এসো গো পরমদুঃখনিলয়, আশা-অঙ্কুর করহ বিলয়—

এসো সংগ্রাম, এসো মহাজয়,  এসো গো মরণসাধন

 

   ১০

         মধুর মধুর ধ্বনি বাজে

         হৃদয়কমলবনমাঝে

   নিভৃতবাসিনী বীণা পাণি অমৃতমুরতিমতী বাণী

   হিরণকিরণ ছবিখানি— পরানের কোথা সে বিরাজে

   মধুঋতু জাগে দিবানিশি  পিককুহরিত দিশি দিশি।

   মানসমধুপ পদতলে  মুরছি পড়িছে পরিমলে।

এসো দেবী, এসো এ আলোকে, একবার তোর হেরি চোখে—

  গোপনে থেকো না মনোলোকে  ছায়াময় মায়াময় সাজে

 

 ১১

ওঠো রে মলিনমুখ, চলো এইবার।

এসো রে তৃষিত-বুক, রাখো হাহাকার

হেরো ওই গেল বেলা, ভাঙিল ভাঙিল মেলা—

গেল সবে ছাড়ি খেলা ঘরে যে যাহার

হে ভিখারি, কারে তুমি শুনাইছ সুর—

রজনী আঁধার হল, পথ অতি দূর।

ক্ষুধিত তৃষিত প্রাণে আর কাজ নাহি গানে—

এখন বেসুর তানে বাজিছে সেতার

 

 

  ১২

           আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া।

যে হাওয়াতে চলত তরী অঙ্গেতে সেই লাগাই হাওয়া

    নেই যদি বা জমল পাড়ি  ঘাট আছে তো বসতে পারি।

আমার আশার তরী ডুবল যদি  দেখব তোদের তরী-বাওয়া

হাতের কাছে লোকের কাছে যা আছে সেই অনেক আছে।

আমার  সারা দিনের এই কি রে কাজ— ওপার-পানে কেঁদে চাওয়া।

    কম কিছু মোর থাকে হেথা পুরিয়ে নেব প্রাণ দিয়ে তা।

আমার  সেইখানেতেই কল্পলতা যেখানে মোর দাবি-দাওয়া

 

   ১৩

যখন  পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,

আমি  বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,

চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,

মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,

বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে—

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।

 

যখন  জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,

কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়, আহা,

ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের,

শ্যওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায়—

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।

 

তখন  এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,

 কাটবে দিন কাটবে,

কাটবে গো দিন আজও যেমন দিন কাটে আহা,

ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী এমনি সে দিন উঠবে ভরি—

চরবে গোরু খেলবে রাখাল ওই মাঠে।

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।

 

তখন  কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।

সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি— আহা,

নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,

আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে

 

         ১৪

       গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ   আমার মন ভুলায় রে।

ওরে   কার পানে মন হাত বাড়িয়ে লুটিয়ে যায় ধুলায় রে

ও যে        আমার ঘরের বাহির করে, পায়ে-পায়ে পায়ে ধরে—

ও যে        কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে   যায় রে কোন্ চুলায় রে।

ও যে  কোন্ বাঁকে কী ধন দেখাবে, কোন্‌খানে কী দায় ঠেকাবে—

           কোথায় গিয়ে শেষ মেলে যে   ভেবেই না কুলায় রে

 

                                                   ১৫

এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়।

শালের বনে খ্যাপা হাওয়া, এই তো আমার মনকে মাতায়।

রাঙা মাটির রাস্তা বেয়ে হাটের পথিক চলে ধেয়ে,

ছোট মেয়ে ধুলায় বসে খেলার ডালি একলা সাজায়—

সামনে চেয়ে এই যা দেখি চোখে আমার বীণা বাজায়

 

আমার এ যে বাঁশের বাঁশি, মাঠের সুরে আমার সাধন।

আমার মনকে বেঁধেছি রে এই ধরণীর মাটির বাঁধন।

নীল আকাশের আলোর ধারা পান করেছে নতুন যারা

সেই ছেলেদের চোখের চাওয়া নিয়েছি মোর দু চোখ পূরে—

আমার বীণায় সুর বেঁধেছি ওদের কচি গলার সুরে

 

দূরে যাবার খেয়াল হলে সবাই মোরে ঘিরে থামায়—

গাঁয়ের আকাশ সজনে ফুলের হাতছানিতে ডাকে আমায়।

ফুরায় নি, ভাই, কাছের সুধা, পাই নি এদের কূলকিনারা।

তুচ্ছ দিনের গানের পালা আজও আমার হয় নি সারা

 

লাগল ভালো, মন ভোলালো, এই কথাটাই গেয়ে বেড়াই—

দিনে রাতে সময় কোথা, কাজের কথা তাই তো এড়াই।

মজেছে মন, মজল আঁখি- মিথ্যে আমায় ডাকাডাকি—

ওদের আছে অনেক আশা, ওরা করুক অনেক জড়ো—

আমি কেবল গেয়ে বেড়াই, চাই নে হতে আরো বড়ো

 

          ১৬

রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও   যাও গো এবার যাবার আগে—

তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে,

তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে,

অশ্রুজলের করুণ রাগে

রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে,

সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে

যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে,

রক্তে তোমার চরণ-দোলা লাগিয়ে দিয়ে।

আঁধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে.

পাষাণগুহার কক্ষে নিঝর-ধারা জাগে,

মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে,

বিশ্ব-নাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে,

তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে,

কাঁদন-বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে

 

  ১৭

আমার  অন্ধপ্রদীপ শূন্য-পানে চেয়ে আছে,

সে যে  লজ্জা জানায় ব্যর্থ রাতের তারার কাছে

ললাটে তার পড়ুক লিখা

তোমার লিখন ওগো শিখা—

বিজয়টিকা দাও গো এঁকে এই সে যাচে

হায়   কাহার পথে বাহির হলে বিরহিণী!

তোমার    আলোক-ঋণে করো তুমি আমায় ঋণী।

তোমার রাতে আমার রাতে

এক অলোকের সূত্রে গাঁথে

এমন ভাগ্য হায় গো আমার হারায় পাছে

 

           ১৮

কেন যে মন ভোলে আমার মন জানে।

তারে মানা করে কে, আমার মন মানে না

কেউ বোঝে না তারে, সে যে বোঝে না আপনারে।

সবাই লজ্জা দিয়ে যায়, সে তো কানে আনে না

তার খেয়া গেল পারে, সে যে রইল নদীর ধারে।

কাজ ক’রে সব সারা ওই এগিয়ে গেল কারা,

আন্‌মনা মন সে দিক-পানে দৃষ্টি হানে না

 

          ১৯

আমারে  ডাক দিল কে ভিতর পানে—

ওরা যে ডাকতে জানে

আশ্বিনে ওই শিউলিশাখে

মৌমাছিরে যেমন ডাকে

প্রভাতে সৌরভের গানে

ঘরছাড়া আজ ঘর পেল যে, আপন মনে রইল ম’জে।

হাওয়ায় হাওয়ায় কেমন ক’রে  খবর যে তার পৌছল রে

ঘর-ছাড়া ওই মেঘের কানে

 

        ২০

হাটের ধুলা সয় না যে আর, কাতর করে প্রাণ।

তোমার সুরসুরধুনীর ধারায় করাও আমার স্নান

জাগাক তারি মৃদঙ্গরোল, রক্তে তুলুক তরঙ্গদোল,

অঙ্গ হতে ফেলুক ধুয়ে সকল অসম্মান—

সব কোলাহল দিক্ ডুবায়ে তাহার কলতান

সুন্দর হে, তোমার ফুলে গেঁথেছিলেম মালা—

সেই কথা আজ মনে করাও, ভুলাও সকল জ্বালা।

তোমার গানের পদ্মবনে  আবার ডাকো নিমন্ত্রণে—

তারি গোপন সুধাকণা আবার কারও পান,

তারি রেণুর তিলকলেখা আমায় করো দান

 

২১

আমি    একলা চলেছি এ ভবে,

আমায়  পথের সন্ধান কে কবে।

             ভয় নেই, ভয় নেই—

             যাও আপন মনেই

যেমন  একলা মধুপ ধেয়ে যায়

কেবল ফুলের সৌরভে

 

                                                 ২২

স্বপন-পারের ডাক শুনেছি, জেগে তাই তো ভাবি

কেউ কখনো খুঁজে কি পায় স্বপ্নলোকের চাবি

নয় তো সেথায় যাবার তরে, নয় কিছু তো পাবার তরে,

নাই কিছু তার দাবি

       বিশ্ব হতে হারিয়ে গেছে স্বপ্নলোকের চাবি

চাওয়া-পাওয়ার বুকের ভিতর না-পাওয়া ফুল ফোটে,

       দিশাহারা গন্ধে তারি আকাশ ভরে উঠে।

খুঁজে যারে বেড়াই গানে, প্রাণের গভীর অতল-পানে

                              যে জন গেছে নাবি,

       সেই নিয়েছে চুরি করে স্বপ্নলোকের চাবি

 

                                                          ২৩

আপন মনে গোপন কোণে লেখাজোখার কারখানাতে

দুয়ার রুধে বচন কুঁদে খেলনা আমায় হয় বানাতে

       এই জগতের সকাল সাঁজে ছুটি আমার সকল কাজে,

       মিলে মিলে মিলিয়ে কথা রঙে রঙে হয় মানাতে

কে গো আছ ভুবন-মাঝে নিত্যশিশু আনন্দেতে,

ডাকে আমায় বিশ্বখেলায় খেলাঘরের জোগান দিতে।

      বনের হাওয়ায় সকাল-বেলা ভাসায় সে যে গানের ভেলা,

      সেই তো কাঁপায় সুরের কাঁপন মৌমাছিদের নীল ডানাতে

 

                                                          ২৪

সকালবেলার কুঁড়ি আমার বিকালে যায় টুটে,

মাঝখানে হায় হয় নি দেখা উঠল যখন ফুটে

ঝরা ফুলের পাপড়িগুলি   ধুলো থেকে আনিস তুলি,

শুকনো পাতার গাঁথব মালা হৃদয়পত্রপুটে।

যখন  সময় ছিল দিল ফাঁকি

এখন  আন্ কুড়ায়ে দিনের শেষে অসময়ের ছিন্ন বাকি।

কৃয্নরাতের চাঁদের কণা আঁধারকে দেয় যে সান্ত্বনা

তাই নিয়ে মোর মিটুক আশা স্বপন গেছে ছুটে

 

                                                 ২৫

পাগল যে তুই, কণ্ঠ ভরে

জানিয়ে দে তাই সাহস করে

         দেয় যদি তোর দুয়ার নাড়া

         থাকিস কোণে, দিস নে সাড়া

              বলুক সবাই ‘সৃষ্টিছাড়া’, বলুক সবাই ‘কী কাজ তোরে’

বল্ রে ‘আমি কেহই না গো,

কিছুই নহি, যে হই-নাগো।’

        শুনে বনে উঠবে হাসি,

        দিকে দিকে বাজবে বাঁশি—

বলবে বাতাস ‘ভালোবাসি’, বাঁধবে আকাশ অলখ ডোরে

 

                                                       ২৬

খেলাঘর  বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে।

কত রাত তাই তো জেগেছি বলব কী তোরে

প্রভাতে  পথিক ডেকে যায়, অবসর পাই নে আমি হায়—

           বাহিরের খেলায় ডাকে সে, যাব কী ক’রে

যা আমার সবার হেলাফেলা যাচ্ছে ছড়াছড়ি

পুরোনো  ভাঙা দিনের ঢেলা, তাই দিয়ে ঘর গড়ি।

যে আমার নতুন খেলার জন তারি এই খেলার সিংহাসন,

           ভাঙারে জোড়া দেবে সে কিসের মন্তরে

 

                                                         ২৭

        গোপন প্রাণে একলা মানুষ যে

তারে  কাজের পাকে জড়িয়ে রাখিস নে

তার  একলা ঘরের ধেয়ান হতে উঠুক-না গান নানা স্রোতে,

       তার আপন সুরের ভুবন-মাঝে তারে থাকতে দে

তোর  প্রাণের মাঝে একলা মানুষ যে

তারে  দশের ভিড়ে ভিড়িয়ে রাখিস নে।

কোন্  আরেক একা ওরে খোঁজে, সেই তো ওরই দরদ বোঝে—

        যেন পথ খুঁজে পায়, কাজের ফাঁকে ফিরে না যায় সে

                                   

                                                                 ২৮

আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলায় বারে বারে

     ডাক দিয়ে যায় নতুন পাতার দ্বারে

         তাই তো আমার এই জীবনের বনচ্ছায়ে

         ফাগুন আসে ফিরে ফিরে দখিন-বায়ে,

              নতুন সুরে গান উড়ে যায় আকাশ-পারে,

              নতুন রঙে ফুল ফুটে তাই ভারে ভারে

         ওগো আমার নিত্য-নূতন, দাঁড়াও হেসে।

         চলব তোমার নিমন্ত্রণে নবীন বেশে।

             দিনের শেষে নিবল যখন পথের আলো,

                  সাগরতীরে যাত্রা আমার যেই ফুরালো,

                         তোমার বাঁশি বাজে সাঁঝের অন্ধকারে—

                         শূন্যে আমার উঠল তারা সারে সারে

 

                                                             ২৯

    এ শুধু অলস মায়া এ শুধু মেঘের খেলা,

    এ শুধু মনের সাধ বাতাসেতে বিসর্জন।

এ শুধু আপনমনে মালা গেঁথে ছিড়ে ফেলা,

নিমেষের হাসিকান্না গান গেয়ে সমাপন।

    শ্যামল পল্লবপাতে রবিকরে সারা বেলা

    আপনারই ছায়া লয়ে খেলা করে ফুলগুলি—

    এও সেই ছায়াখেলা বসন্তের সমীরণে।

কুহদের দেশে যেন সাধ ক’রে পথ ভুলি

হেথা হোথা ঘুরি ফিরি সারা দিন আনমনে।

কারে যেন দেব’ ব’লে কোথা যেন ফুল তুলি—

সন্ধ্যায় মলিন ফুল উড়ে যায় বনে বনে।

       এ খেলা খেলিবে, হায়, খেলার সাথি কে আছে।

       ভুলে ভুলে গান গাই— কে শোনে, কে নাই শোনে—

       যদি কিছু মনে পড়ে, যদি কেহ আসে কাছে

 

                                                               ৩০

যে আমি ওই ভেসে চলে    কালের ঢেউয়ে আকাশতলে

           ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে।

ধুলার সাথে, জলের সাথে, ফুলের সাথে, ফলের সাথে,

           সবার সথে চলছে ও যে ধেয়ে

ও যে সদাই বাইরে আছে,  দুঃখ সুখে নিত্য নাচে—

           ঢেউ দিয়ে যায়, দোলে যে ঢেউ খেয়ে।

একটু ক্ষয়ে ক্ষতি লাগে,   একটু ঘায়ে ক্ষত জাগে—

           ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে

যে আমি যায় কেঁদে হেসে   তাল দিতেছে মৃদঙ্গে সে,

           অন্য আমি উঠতেছি গান গেয়ে।

ও যে সচল ছবির মতো, আমি নীরব কবির মতো—

           ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে।

এই-যে আমি ওই আমি নই, আপন-মাঝে আপনি যে রই,

           যাই নে ভেসে মরণধারা বেয়ে—

মুক্ত আমি, তৃপ্ত আমি, শান্ত আমি, দৃপ্ত আমি,

           ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে

 

                                                         ৩১

দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না—

       সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।

              কান্নাহাসির বাঁধন তারা সইল না—

                     সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি

আমার প্রাণের গানের ভাষা

        শিখবে তারা ছিল আশা—

              উড়ে গেল, সকল কথা কইল না—

                    সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি

স্বপন দেখি, যেন তারা কার আশে

        ফেরে আমার ভাঙা খাঁচার চার পাশে—

              সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।

এত বেতন হয় কি ফঁকি।

       ওরা কি সব ছায়ার পাখি।

              আকাশ-পারে কিছুই কি গো বইল না—

                     সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি

 

৩২

তরীতে পা দিই নি আমি, পারের পানে যাই নি গো।

ঘাটেই বসে কাটাই বেলা, আর কিছু তো চাই নি গো

            তোরা যাবি রাজার পুরে   অনেক দূরে,

           তোদের রথের চাকার সুরে

                    আমার সাড়া পাই নি গো

            আমার এ যে গভীর জলে খেয়া বাওয়া,

            হয়তো কখন্ নিসুত রাতে উঠবে হাওয়া।

            আসবে মাঝি ও পার হতে উজান স্রোতে,

            সেই আশাতেই চেয়ে আছি— তরী আমার বাই নি গো

 

                                                                 ৩৩

আমি    ফিরব না রে, ফিরব না আর, ফিরব না রে—

এমন    হাওয়ার মুখে ভাসল তরী—

                কূলে ভিড়ব না আর, ভিড়ব না রে

ছড়িয়ে গেছে সুতো ছিড়ে, তাই খুঁটে আজ মরব কি রে—

এখন   ভাঙা ঘরের কুড়িয়ে খুঁটি

         বেড়া ঘিরব না আর, ঘিরব না রে

ঘাটের রশি গেছে কেটে, কাঁদব কি তাই বক্ষ ফেটে—

এখন পালের রশি ধরব কষি,

         এ রশি ছিঁড়ব না আর, ছিঁড়ব না রে

 

                                                             ৩৪

আয় আয় রে পাগল, ভুলবি রে চল্ আপনাকে,

             তোর একটুখানির আপনাকে।

তুই  ফিরিসনে আর এই চাকাটার ঘুরপাকে

          কোন্ হঠাৎ হাওয়ার ঢেউ উঠে

              তোর ঘরের আগল যায় টুটে,

                    ওরে সুযোগ ধরিস, বেরিয়ে পড়িস সেই ফাঁকে

                                তোর দুয়ার-ভাঙার সেই ফাঁকে

নানান গোলে তুফান তোলে চার দিকে

         তুই বুঝিস নে, মন, ফিরবি কখন কার দিকে।

             তোর আপন বুকের মাঝখানে

                    কী যে বাজায় কে যে সেই জানে—

ওরে পথের খবর মিলবে রে তোর সেই ডাকে

                      তোর আপন বুকের সেই ডাকে

 

                                                           ৩৫

কোন্ সুদূর হতে আমার মনোমাঝে

       বাণীর ধারা বহে— আমার প্রাণে প্রাণে।

আমি   কখন্ শুনি কখন শুনি না যে,

         কখন্ কী যে কহে— আমার কানে কানে

         আমার ঘুমে আমার কোলাহলে

         আঁখি-জলে  তাহারি সুর,

         তাহারি সুর জীবন-গুহাতলে

         গোপন গানে রহে— আমার কানে কানে

কোন্ ঘন গহন বিজন তীরে তীরে

তাহার ভাঙা গড়া— ছায়ার তলে তলে।

        আমি জানি না কোন্ দক্ষিণসমীরে

        তাহার ওঠা পড়া— ঢেউয়ের ছলোছলে।

এই ধরণীরে গগন-পারের ছাঁদে সে যে তারার সাথে বাঁধে,

        সুখের সাথে দুখ মিলায়ে কাঁদে

‘এ নহে এই নহে -নহে নহে, এ নহে এই নহে’—

                            কাঁদ কানে কানে

 

                                                            ৩৬

আকাশ হতে আকাশ-পথে হাজার স্রোতে

ঝরছে জগৎ ঝরনাধারার মতো

আমার শরীর মনের অধীর ধারা সাথে সাথে বইছে অবিরত।

দুই প্রবাহের ঘাতে ঘাতে উঠতেছে গান দিনে রাতে,

সেই গানে গানে আমার প্রাণে ঢেউ লেগেছে কত।

আমার হৃদয়তটে চূর্ণ সে গান ছড়ায় শত শত।

ওই আকাশ-ডোবা ধারার দোলায় দুলি অবিরত

এই নৃত্য-পাগল ব্যাকুলতা বিশ্বপরানে

নিত্য আমায় জাগিয়ে রাখে, শান্তি না মানে।

চিরদিনের কান্নাহাসি   উঠছে ভেসে রাশি—

এ-সব দেখতেছে কোন্ নিদ্রাহারা নয়ন অবনত।

ওগো, সেই নয়নে নয়ন আমার হোক-না নিমেষহত—

ওই আকাশ-ভরা দেখার সাথে দেখব অবিরত

 

                                                      ৩৭

আলোক-চোরা লুকিয়ে এল ওই—

তিমিরজয়ী বীর, তোরা আজ কই।

এই কুয়াশা-জয়ের দীক্ষা কাহার কাছে লই

মলিন হল শুভ্র বরন, অরুণ-সোনা করল হরণ,

লজ্জা পেয়ে নীরব হল উষা জ্যোতির্ময়ী

সুপ্তিসাগরতীর বেয়ে সে এসেছে মুখ ঢেকে,

অঙ্গে কালি মেখে।

রবির রশ্মি কই গো তোরা, কোথায় অঁধার-ছেদন ছোরা,

উদয়শৈলশৃঙ্গ হতে বল্ ‘মাভৈঃ মাভৈঃ’

 

                                                         ৩৮

জাগ’ জাগ’ আলসশয়নবিলগ্ন।

জাগ’ জাগ’ তামসগহননিমগ্ন

ধৌত করুণারুণবৃষ্টি সুপ্তিজড়িত যত আবিল দৃষ্টি,

জাগ’ জাগ’ দুঃখভারনত উদ্যমভগ্ন

জ্যোতিসম্পদ ভরি দিক চিত্ত ধনপ্রলোভননাশন বিত্ত,

জাগ’ জাগ’ পুণ্যবসন পর’ লজ্জিত নগ্ন

 

                                                           ৩৯

তোমার আসন শূন্য আজি হে বীর পূর্ণ করো—

ওই-যে দেখি বসুন্ধরা কাঁপল থরোথরে

বাজল তূর্য আকাশপথে— সূর্য আসেন অগ্নিরথে আকাশপথে,

        এই প্রভাতে দখিন হাতে বিজয়খড়গ ধরো

ধর্ম তোমার সহায়, তোমার সহায় বিশ্ববাণী।

অমর বীর্য সহায় তোমার, সহায় বজ্রপাণি।

দুর্গম পথ সগৌরবে তোমার চরণচিহ্ন লবে সগৌরবে—

চিত্তে অভয় বর্ম, তোমার বক্ষে তাহাই পরো

 

৪০

মোরা    সত্যের ’পরে মন   আজি করিব সমর্পণ।

জয় জয় সত্যের জয়।

মোরা    বুঝিব সত্য, পূজিব সত্য, খুঁজিব সত্যধন।

জয় জয় সত্যের জয়।

যদি      দুঃখে দহিতে হয় তবু মিথ্যাচিন্তা নয়।

যদি      দৈন্য বহিতে হয় তবু মিথ্যাকর্ম নয়।

যদি      দণ্ড সহিতে হয়  তবু  মিথ্যাবাক্য নয়।

জয় জয় সত্যের জয়

 

মোরা    মঙ্গলকাজে প্রাণ আজি করিব সকলে দান।

জয় জয় মঙ্গলময়।

মোরা    লভিব পুণ্য, শোভিব পুণ্যে, গাহিব পুণ্যগান।

জয় জয় মঙ্গলময়।

যদি      দুঃখে দহিতে হয় তবু অশুভচিন্তা নয়।

যদি      দৈন্য বহিতে হয় তবু অশুভকর্ম নয়।

যদি      দণ্ড সহিতে হয় তবু অশুভবাক্য নয়।

জয় জয় মঙ্গলময়

 

সেই     অভয় ব্রহ্মনাম আজি মোরা সবে লইলাম

যিনি সকল ভয়ের ভয়।

মোরা    করিব না শোক যা হবার হোক, চলিব ব্রহ্মধাম।

জয় জয় ব্রহ্মের জয়।

যদি      দুঃখে দহিতে হয় তবু নাহি ভয়, নাহি ভয়।

যদি      দৈন্য বহিতে হয় তবু নাহি ভয়, নাহি ভয়।

যদি      মৃত্যু নিকট হয় তবু নাহি ভয়, নাহি ভয়।

জয় জয় ব্রহ্মের জয়

 

মোরা    আনন্দ-মাঝে মন আজি করিব বিসর্জন।

জয় জয় আনন্দময়।

সকল দৃশ্যে সকল বিশ্বে আনন্দনিকেতন।

জয় জয় আনন্দময়।

আনন্দ চিত্ত-মাঝে আনন্দ সর্বকাজে,

আনন্দ সর্বকালে দুঃখে বিপদজালে,

আনন্দ সর্বলোকে মৃত্যুবিরহে শোকে—

জয় জয় আনন্দময়

 

 

৪১

আমাদের শান্তিনিকেতন আমাদের সব হতে আপন।

তার আকাশ-ভরা কোলে মোদের দোলে হৃদয় দোলে,

মোরা বারে বারে দেখি তারে নিত্যই নূতন

মোদের তরুমূলের মেলা, মোদের খোলা মাঠের খেলা,

মোদের নীল গগনের সোহাগ-মাখা সকাল-সন্ধ্যাবেলা।

মোদের শালের ছায়াবীথি বাজায় বনের কলগীতি,

সদাই পাতার নাচে মেতে আছে আম্‌লকি-কানন

আমরা যেথায় মরি ঘুরে সে যে যায় না কভু দূরে,

মোদের মনের মাঝে প্রেমের সেতার বাঁধা যে তার সুরে।

মোদের প্রাণের সঙ্গে প্রাণে সে যে মিলিয়েছে এক তানে,

মোদের ভাইয়ের সঙ্গে ভাইকে যে সে করেছে এক-মন।

 

                                                               ৪২

       না গো, এই যে ধুলা আমার না এ।

তোমার ধুলার ধারার ’পরে উড়িয়ে যাব সন্ধ্যাবায়ে

         দিয়ে মাটি আগুন জ্বালি রচলে দেহ পূজার থালি—

শেষ আরতি সারা ক’রে ভেঙে যাব তোমার পায়ে

ফুল যা ছিল পূজার তরে

যেতে পথে ডালি হতে অনেক যে তার গেছে পড়ে।

কত প্রদীপ এই থালাতে সাজিয়েছিল আপন হাতে—

কত যে তার নিবল হাওয়ায়, পৌঁছল না চরণছায়ে

 

৪৩

জীবন আমার চলছে যেমন তেমনি ভাবে

সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দে চলে যাবে

চলার পথে দিনে রাতে দেখা হবে সবার সাথে—

তাদের আমি চাব, তারা আমায় চাবে

জীবন আমার পলে পলে এমনি ভাবে

দুঃখসুখের রঙে রঙে রাঙিয়ে যাবে

রঙের খেলার সে সভাতে খেলে যে জন সবার সাথে

তারে আমি চাব, সেও আমায় চাবে

 

৪৪

কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি।

আজ হৃদয়ের ছায়াতে আলোতে বাঁশরি উঠেছে বাজি

ভালোবেসেছিনু এই ধরণীরে সেই স্মৃতি মনে আসে ফিরে ফিরে,

কত বসন্তে দখিনসমীরে ভরেছে আমারি সাজি

নয়নের জল গভীর গহনে আছে হৃদয়ের স্তরে,

বেদনার রসে গোপনে গোপনে সাধনা সফল করে।

                                      মাঝে মাঝে বটে ছিঁড়েছিল তার, তাই নিয়ে কেবা করে হাহাকার—

সুর তবু লেগেছিল বারে-বার মনে পড়ে তাই আজি

 

৪৫

আমি যে সব নিতে চাই,     সব নিতে ধাই রে।

আমি আপনাকে, ভাই,       মেলব যে বাইরে

পালে আমার লাগলো হাওয়া, হবে আমার সাগর-যাওয়া,

ঘাটে তরী নাই বাঁধা নাই রে

সুখে দুঃখে বুকের মাঝে     পথের বাঁশি কেবল বাজে,

সকল কাজে শুনি যে তাই রে।

পাগ্‌লামি আজ লাগল পাখায়,           পাখি কি আর থাকবে শাখায়।

দিকে দিকে সাড়া যে পাই রে

 

৪৬

আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা,

আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা

নাচে আলো নাচে, ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে—

বাজে আলো বাজে, ও ভাই, হৃদয়বীণার মাঝে—

জাগে আকাশ, ছোট বাতাস, হাসে সকল ধরা

আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি।

আলোর ঢেউয়ে উঠল নেচে মল্লিকা মালতি।

মেঘে মেঘে সোনা, ও ভাই, যায় না মানিক গোনা—

পাতায় পাতায় হাসি, ও ভাই, পুলক রাশি রাশি—

সুরনদীর কূল ডুবেছে সুধা-নিঝর-ঝরা

 

                                                           ৪৭

ওরে ওরে    ওরে, আমার মন মেতেছে,

         তারে আজ থামায় কে রে।

সে যে   আকাশ-পানে হাত পেতেছে,

              তারে আজ নামায় কে রে।

ওরে ওরে ওরে, আমার মন মেতেছে, আমারে থামায় কে রে

ওরে ভাই, নাচ্ রে ও ভাই, নাচ্ রে—

      আজ ছাড়া পেয়ে বাঁচ রে—

লাজ ভয় ঘুচিয়ে দে রে।

তোরে আজ থামায় কে রে

 

              ৪৮

হারে রে রে রে রে, আমায় ছেড়ে দে রে, দে রে—

যেমন ছাড়া বনের পাখি মনের আনন্দে রে

ঘনশ্রাবণধারা   যেমন বাঁধনহারা,

বাদল-বাতাস যেমন ডাকত আকাশ লুটে ফেরে

হারে রে রে রে রে, আমায় রাখবে ধ’রে কে রে—

দাবানলের নাচন যেমন সকল কানন ঘেরে,

বজ্র যেমন বেগে গর্জে ঝড়ের মেঘে,

অট্টহাস্যে সকল বিঘ্ন-বাধার বক্ষ চেরে

 

৪৯

আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান।

দাঁড় ধ’রে আজ বোস্ রে সবাই, টান রে সবাই টান

বোঝা যত বোঝাই করি করব রে পার দুখের তরী,

ঢেউয়ের ’পরে ধরব পাড়ি— যায় যদি যাক প্রাণ

কে ডাকে রে পিছন হতে, কে করে রে মানা,

ভয়ের কথা কে বলে আজ— ভয় আছে সব জানা।

কোন্ শাপে কোন্ গ্রহের দোষে   সুখের ডাঙায় থাকব বসে।

পালের রাশি ধরব কষি, চলব গেয়ে গান

 

৫০

খরবায়ু বয় বেগে,            চারি দিক ছায় মেঘ,

ওগো নেয়ে, নাওখানি বাইয়ো।

তুমি কষে ধরো হাল,         আমি তুলে বাঁধি পাল—

হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো

শৃঙ্খলে বারবার ঝন্‌ঝন্ ঝঙ্কার   নয় এ তো তরণীর ক্রন্দন শঙ্কার—

বন্ধন দুর্বার সহ্য না হয় আর,  টলোমলো করে আজ তাই ও।

হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো

 

গণি গণি দিন খন   চঞ্চল করি মন

বোলো না ‘যাই কি নাই যাই রে’।

সংশয়পারাবার   অন্তরে হবে পার,

উদ্‌বেগে তাকায়ো না বাইরে।

যদি মাতে মহাকাল, উদ্দাম জটাজাল ঝড়ে হয় লুণ্ঠিত, ঢেউ উঠে উত্তাল,

হয়ো নাকো কুণ্ঠিত, তালে তার দিয়ো তাল— জয়-জয় জয়গান গাইয়ো।

হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো

 

৫১

যুদ্ধ যখন বাধিল অচলে চঞ্চলে

ঝঙ্কারধ্বনি রণিল কঠিন শৃঙ্খলে,

বন্ধমোচন ছন্দে তখন নেমে এলে নির্ঝরিণী—

তোমারে চিনি, তোমারে চিনি

সিন্ধুমিলনসঙ্গীতে

মাতিয়া উঠেছ পাষাণশাসন লঙ্ঘিতে

অধীর ছন্দে ওগো মহাবিদ্রোহিণী—

তোমারে চিনি, তোমারে চিনি

হে নিঃশঙ্কিতা,

আত্ন-হারানো রুদ্রতালের নূপুরঝঙ্কৃতা,

মৃত্যুতোরণতরণ-চরণ-চারিণী

চিরদিন অভিসারিণী,

তোমারে চিনি

 

৫২

গগনে গগনে ধায় হাঁকি

বিদ্যুতবাণী বজ্রবাহিনী বৈশাখী,

স্পর্ধাবেগের ছন্দ জাগায় বনস্পতির শাখাতে

শূন্যমদের নেশায় মাতাল ধায় পাখি,

অলখ পথের ছন্দ উড়ায় মুক্তবেগের পাখাতে

অন্তরতল মনন করে ছন্দে

সাদা কালোর দ্বন্দ্বে,

কভু ভালো কভু মন্দে,

কভু সোজা কভু বাঁকাতে

ছন্দ নাচিল হোমবহ্নির তরঙ্গে,

মুক্তিরণের যোদ্ধৃবীরের ভ্রূভঙ্গে,

ছন্দ ছুটিল প্রলয়পথের রুদ্ররথের চাকাতে

 

৫৩

                    ভাঙো  বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও।

বন্দী প্রাণ মন হোক উধাও

শুকনো গাঙে আসুক

জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক—

ভাঙনের জয়গান গাও।

জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক,

যাক ভেসে যাক, যাক ভেসে যাক।

আমরা শুনেছি ওই মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ

কোন্ নূতনেরই ডাক।

ভয় করি না অজানারে,

রুদ্ধ তাহারি দ্বারে দুর্দাড় বেগে ধাও

 

৫৪

ওই সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে বাজল ভেরী, বাজল ভেরী।

কখন্ আমার খুলবে দুয়ার— নাইকো দেরি, নাইকো দেরি

তোমার তো নয় ঘরের মেলা, কোণের খেলা গো—

তোমার সঙ্গে বিষম রঙ্গে জগৎ জুড়ে ফেরাফেরি

মরণ তোমার পারের তরী, কাঁদন তোমার পালের হাওয়া—

তোমার বীণা বাজায় প্রাণে বেরিয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া।

ভাঙল যাহা পড়ল ধুলায় যাক্-না-চুলায় গো—

ভরল যা তাই দেখ্-না, রে ভাই, বাতাস ঘেরি, আকাশ ঘেরি

 

৫৫

দুয়ার মোর পথপাশে,    সদাই তারে খুলে রাখি।

কখন্ তার রথ আসে     ব্যাকুল হয়ে জাগে আঁখি

শ্রাবণে শুনি দূর মেঘে  লাগায় গুরু গরো-গরো,

ফাগুনে শুনি বায়ুবেগে  জাগায় মৃদু মরো-মরো—

আমার বুকে উঠে জেগে  চমক তারি থাকি থাকি

সবাই দেখি যায় চলে  পিছন-পানে নাহি চেয়ে

উতল রোলে কল্লোলে  পথের গান গেয়ে গেয়ে।

শরৎ-মেঘ যায় ভেসে  উধাও হয়ে কত দূরে

যেথায় সব পথ মেশে  গোপনে কোন্ সুরপুরে।

স্বপনে ওড়ে কোন্ দেশে উদাস মোর মনোপাখি

 

৫৬

        নাহয় তোমার যা হয়েছে তাই হল।

        আরো কিছু নাই হল, নাই হল, নাই হল

কেউ যা কভু দেয় না ফাঁকি   সেইটুকু তোর থাক্-না বাকি,

পথেই নাহয় ঠাঁই হল

চল্ রে সোজা বীণার তারে ঘা দিয়ে।

ডাইনে বাঁয়ে দৃষ্টি তোমার না দিয়ে।

হারিয়ে চলিস পিছনেরে,  সামনে যা পাস কুড়িয়ে নে রে—

খেদ কী রে তোর যাই হল

 

৫৭

সে কোন্   বনের হরিণ ছিল আমার মনে।

কে তারে বাঁধল অকারণে

গতিরাগের সে ছিল গান,  আলোছায়ার সে ছিল প্রাণ,

আকাশকে সে চমকে দিত বনে

মেঘলা দিনের আকুলতা বাজিয়ে যেত পায়ে

তমাল ছায়ে-ছায়ে।

ফাল্গুনে সে পিয়ালতলায়   কে জানিত কোথায় পলায়

দখিন-হাওয়ার চঞ্চলতার সনে

 

     ৫৮

তোমার হল শুরু,   আমার হল সারা—

তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা

তোমার জ্বলে বাতি তোমার ঘরে সাথি—

আমার তরে রাতি, আমার তরে তারা

তোমার আছে ডাঙা, আমার আছে জল—

তোমার বসে থাকা, আমার চলাচল।

তোমার হাতে রয়, আমার হাতে ক্ষয়—

তোমার মনে ভয়, আমার ভয় হারা

 

৫৯

      এমনি ক’রেই যায় যদি দিন যাক না।

মন উড়েছে উড়ুক-না রে মেলে দিয়ে গানের পাখ্‌না

আজকে আমার প্রাণ ফোয়ারার সুর ছুটছে,

দেহের বাঁধ টুটেছে—

মাথার ’পরে খুলে গেছে আকাশের ওই সুনীল ঢাক্‌না

ধরণী আজ মেলেছে তার হৃদয়খানি,

সে যেন রে কাহার বাণী।

কঠিন মাটি মনকে আজি দেয় না বাধা।

সে কোন্ সুরে সাধা-

বিশ্ব বলে মনের কথা, কাজ পড়ে আজ থাকে থাক্-না

 

    ৬০

আমারে             বাঁধবি তোরা সেই বাঁধন কি তোদের আছে।

আমি যে            বন্দী হতে সন্ধি করি সবার কাছে

সন্ধ্যা-আকাশ      বিনা ডোরে বাঁধল মোরে গো,

নিশিদিন বন্ধহারা নদীর ধারা আমায় যাচে।

যে কুসুম           আপনি ফোটে, আপনি ঝরে, রয় না ঘরে গো—

তারা যে            সঙ্গী আমার, বন্ধু আমার, চায় না পাছে

আমারে             ধরবি ব’লে মিথ্যে সাধা।

আমি যে            নিজের কাছে নিজের গানের সুরে বাঁধা।

আপনি যাহার প্রাণ দুলিল, মন ভুলিল গো—

সে মানুষ           আগুন-ভরা, পড়লে ধরা সে কি বাঁচে।

সে যে ভাই,        হাওয়ার সখা, ঢেউয়ের সাথি, দিবারাতি গো

কেবলই            এড়িয়ে চলার ছন্দে তাহার রক্ত নাচে

 

৬১

ফিরে ফিরে আমায় মিছে ডাকো স্বামী,—

সময় হল বিদায় নেব আমি

অপমানে যার সাজায় চিতা

সে যে বাহির হয়ে এল অগ্নিজিতা।

রাজাসনের কঠিন অসম্মানে

ধরা দিবে না সে যে মুক্তিকামী

আমায় মাটি নেবে আঁচল পেতে

বিশ্বজনের চোখের আড়ালেতে,

তুমি থাকো সোনার সীতার অনুগামী

 

৬২

ফুরালো ফুরালো এবার    পরীক্ষার এই পালা—

পার হয়েছি আমি অগ্নিদহন-জ্বালা

মা গো মা, মা গো মা, এবার তুমি জাগো মা—

                                    তোমার কোলে উজাড় করে দেব অপমানের ডালা    

                               তোমার শ্যামল আঁচলখানি   আমার অঙ্গে দাও, মা, আনি—

আমার বুকের থেকে লও খসিয়ে নিঠুর কাঁটার মালা

 

                ৬৩

ওরে     শিকল, তোমায় কোলে ক’রে দিয়েছি ঝঙ্কার।

তুমি     আনন্দে, ভাই, রেখেছিলে ভেঙে অহঙ্কার

তোমায় নিয়ে ক’রে খেলা   সুখে দুঃখে কাটল বেলা—

অঙ্গ বেড়ি দিলে বেড়ী বিনা দামের অলঙ্কার

তোমার ‘পরে করি নে রোষ, দোষ থাকে তো আমারি দোষ—

ভয় যদি রয় আপন মনে তোমায় দেখি ভয়ঙ্কর।

অন্ধকারে সারা রাতি ছিলে আমার সাথের সাথি,

সেই দায়টি স্মরি তোমায় করি নমস্কার

 

৬৪

আমাকে যে বাঁধবে ধরে, এই হবে যার সাধন,

সে কি অমনি হবে।

আপনাকে সে বাঁধা দিয়ে আমায় দেবে বাঁধন,

সে কি অমনি হবে

আমাকে যে দুঃখ দিয়ে আনবে আপন বশে,

সে কি অমনি হবে।

তার আগে তার পাষাণ-হিয়া গলবে করুণ রসে,

সে কি অমনি হবে।

আমাকে যে কাঁদাবে তার ভাগ্যে আছে কাঁদন,

সে কি অমনি হবে

 

৬৫

আমি চঞ্চল হে,

          আমি সুদূরের পিয়াসি।

দিন চলে যায়, আমি আনমনে  তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে—

ওগো, প্রাণে মনে আমি যে তাহার পরশ পাবার প্রয়াসী

ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে  বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি—

মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই  সে কথা যে যাই পাশরি

আমি উন্মানা হে,

     সে সুদূর, আমি উদাসী

রৌদ্র-মাখানো অলস বেলায় তরুমর্মরে ছায়ার খেলায়

কী মুরতি তব নীল আকাশে নয়নে উঠে গো আভাসি।

         সে সুদূর, আমি উদাসী।

ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি—

কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার সে কথা যে যাই পাশরি

 

৬৬

ওরে সাবধানী পথিক, বারেক  পথ ভুলে মরো ফিরে।

খোলা আঁখি-দুটো অন্ধ করে দে আকুল আঁখির নীরে

সে ভোলা পথের প্রান্তে রয়েছে হারানো হিয়ার কুঞ্জ,

ঝ’রে প’ড়ে আছে কাঁটা-তরুতলে রক্তকুসুমপুঞ্জ—

সেথা দুই বেলা ভাঙা-গড়া-খেলা অকূলসিন্ধুতীরে

অনেক দিনের সঞ্চয় তোর আগুলি আছিস বসে,

ঝড়ের রাতের ফুলের মতন ঝরুক পড়ুক খসে।

আয় রে এবার সব-হারাবার জয়মালা পরো শিরে

 

৬৭

তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়

কোন্‌খানে রে কোন্ পাষাণের ঘায়

নবীন তরী নতুন চলে, দিই নি পাড়ি অগাধ জলে—

বাহি তারে খেলার ছলে কিনার-কিনারায়

ভেসেছিলেম স্রোতের ভরে, একা ছিলেম কর্ণ ধ’রে—

লেগেছিল পালের ’পরে মধুর মৃদু বায়।

সুখে ছিলেম আপন-মনে, মেঘ ছিল না গগনকোণে—

লাগবে তরী কুসুমবনে ছিলেম সেই আশায়

 

৬৮

আমি    কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে—

তাই     আকাশকুসুম করিনু চয়ন হতাশে

ছায়ার মতন মিলায় ধরণী, কূল নাহি পায় আশার তরণী,

মানসপ্রতিমা ভাসিয়া বেড়ায় আকাশে

কিছু     বাঁধা পড়িল বা কেবলই বাসনা-বাঁধনে।

কেহ     নাহি দিল ধরা শুধু এ সুদুর-সাধনে।

আপনার মনে বসিয়া একেলা অনলশিখায় কী করিনু খেলা,

দিনশেষে দেখি ছাই হল সব হুতাশে

 

৬৯

শুধু      যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা,

শুধু      আলো-আঁধারে কাঁদা-হাসা

শুধু      দেখা পাওয়া, শুধু ছুঁয়ে যাওয়া,

শুধু      দূরে যেতে যেতে কেঁদে চাওয়া,

শুধু      নব দুরাশায় আগে চলে যায়—

পিছে ফেলে যায় মিছে আশা

অশেষ বাসনা লয়ে ভাঙা বল,

প্রাণপণ কাজে পায় ভাঙা ফল,

ভাঙা তরী ধ’রে ভাসে পারাবারে

ভাব কেঁদে মরে— ভাঙা ভাষা।

হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয়,

আধখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয়,

লাজে ভয়ে ত্রাসে আধো-বিশ্বাসে

শুধু আধখানি ভালোবাসা

 

৭০

ওগো, তোরা কে যাবি পারে।

আমি    তরী নিয়ে বসে আছি নদীকিনারে

ও পারেতে উপবনে

কত খেলা কত জনে,

এ পারেতে ধু ধু মরু বারি বিনা রে

এই বেলা বেলা আছে, আয় কে যাবি।

মিছে কেন কাটে কাল কত কী ভাবি।

সূর্য পাটে যাবে নেমে,

সুবাতাস যাবে থেমে,

খেয়া বন্ধ হয়ে যাবে সন্ধ্যা-আধারে

 

৭১

তোমাদের দান যশের ডালার সব-শেষ সঞ্চয় আমার—

নিতে মনে লাগে ভয়

এই রূপলোকে কবে এসেছিনু রাতে,

গেঁথেছিনু মালা ঝ’রে-পড়া পারিজাতে,

আঁধারে অন্ধ— এ যে গাঁথা তারি হাতে—

কী দিল এ পরিচয়

এরে পরাবে ওক কলালক্ষ্মীর গলে

সাতনরী হারে যেথায় মানিক জ্বলে।

একদা কখন অমরার উত্সবে

ম্লান ফুলদল খসিয়া পড়িবে কবে,

এ আদর যদি লজ্জার পরাভবে

সে দিন মলিন হয়

 

৭২

দূর রজনীর স্বপন লাগে আজ নূতনের হাসিতে,

দূর ফাগুনের বেদন জাগে আজ ফাগুনের বাঁশিতে

হায় রে সে কাল হায় রে  কখন চলে যায় রে

আজ এ কালের মরীচিকায়  নতুন মায়ায় ভাসিতে

যে মহাকাল দিন ফুরালে  আমার কুসুম ঝরালো

সেই তোমারি তরুণ ভালে ফুলের মালা পরালো।

শুনিয়ে শেষের কথা সে  কাঁদিয়ে ছিল হতাশে,

তোমার মাঝে নতুন সাজে শূন্য আবার ভরালো।

আমার খেলা খেলেছিলেম,   আমরাও গান গেয়েছি।

আমরাও পাল মেলেছিলেম,  আমরা তরী বেয়েছি।

হারায় নি তা হারায় নি   বৈতরণী পারায় নি-

নবীন চোখের চপল আলোয় সে কাল ফিরে পেয়েছি

 

৭৩

ওরে মাঝি, ওরে আমার মানবজন্মতরীর মাঝি,

শুনতে কি পাস দূরের থেকে পারের বাঁশি উঠছে বাজি

তরী কি তোর দিনের শেষে ঠেকবে এবার ঘাটে এসে।

সেথায় সন্ধ্যা-অন্ধকারে দেয় কি দেখা প্রদীপরাজি

যেন আমার লাগে মনে       মন্দ-মধুর এই পবনে

সিন্ধুপারের হাসিটি কার আঁধার বেয়ে আসছে আজি।

আসার তার কুসুমগুলি         কিছু এনেছিলেম তুলি,

যেগুলি তার নবীন আছে এই বেলা নে সাজিয়ে সাজি

 

৭৪

চোখ যে ওদের ছুটে চলে গো—

ধনের বাটে, মানের বাটে, রূপের হাটে, দলে দলে গো

দেখবে ব’লে করেছে পণ,  দেখবে কারে জানে না মন—

প্রেমের দেখা দেখে যখন  চোখ ভেসে যায় চোখের জলে গো

আমায় তোরা ডাকিস না রে—

আমি যাব খেয়ার ঘাটে অরূপ-রসের পারাবারে।

উদাস হাওয়া লাগে পালে, পারের পানে যাবার কালে

চোখদুটোরে ডুবিয়ে যাব অকূল সুধা-সাগর-তলে গো

 

       ৭৫

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,  কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলা
দিনে দেখেছিলেম মাঠে  কালো মেয়ের কালো 
হরিণ-চোখ।

ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে,  মুক্তবেণী পিঠেরপরে লোটে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক,  দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

ঘন
 মেঘে আঁধার হল দেখে  ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা
 মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে  কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে
 হানি যুগল ভুরু  শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো?
 তা সে যতই কালো হোক,  দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

বে বাতাস এল হঠা ধেয়ে, ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের
 ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা, মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার
 পানে দেখলে কিনা চেয়ে  আমি জানি আর জানে সেই 
মেয়ে।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

এমনি
 করে কাজল কালো মেঘ  জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান 
কোণে।

এমনি করে কালো কোমল ছায়া আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।

এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে হঠা খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
কালো?
 তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

কৃষ্ণকলি
 আমি তারেই বলি,  আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম
 ময়নাপাড়ার মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
মাথার
 পরে দেয় নি তুলে বাস, লজ্জা পাবার পায় নি 
অবকাশ।

কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ। 

 

৭৬

তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা।

ওই-যে সুদূর নীহারিকা

যারা করে আছে ভিড়          আকাশের নীড়,

ওই যারা দিনরাত্রি

আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী   গ্রহ তারা রবি,

তুমি কি তাদের মতো সত্য নও।

হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি

নয়নসমুখে তুমি নাই,

নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই— আজি তাই

শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।

আমার নিখিল   তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল।

নাহি জানি, কেহ নাহি জানে—

তব সুর বাজে মোর গানে,

কবির অন্তরে তুমি কবি—

নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি

 

৭৭

আজ     তারায় তারায় দীপ্ত শিখার অগ্নি জ্বলে

নিদ্রাবিহীন গগনতলে

ওই      আলোক-মাতাল স্বর্গসভার মহাঙ্গন

হেথায় ছিল কোন্ যুগে মোর নিমন্ত্রণ—

আমার‌  লাগল না মন লাগল না,

তাই     কালের সাগর পাড়ি দিয়ে এলেম চ’লে

নিদ্রাবিহীন গগনতলে

হেথা     মন্দমধুর কানাকানি জলে স্থলে

শ্যামল মাটির ধরাতলে।

হেথা     ঘাসে ঘাসে রঙিন ফুলের আলিস্পন,

বনের পথে আঁধার-আলোয় আলিঙ্গন—

আমার লাগল রে মন লাগল রে,

তাই     এইখানেতেই দিন কাটে এই খেলার ছলে

শ্যামল মাটির ধরাতলে

 

৭৮

ওরে     প্রজাপতি, মায়া দিয়ে           কে যে পরশ করল তোরে

অস্তরবির তুলিখানি চুরি ক’রে

হাওয়ার বুকে যে চঞ্চলের গোপন বাসা

বনে বনে বয়ে বেড়াস তারি ভাষা,

অপ্সরীদের দোলের খেলার ফুলের রেণু

পাঠায় কে তোর পাখায় ভ’রে

যে গুণী তার কীর্তিনাশার বিপুল নেশায়

চিকন রেখার লিখন মেলে শূন্যে মেশায়,

সুর বাঁধে আর সুর যে হারায় পলে পলে—

গান গেয়ে যে চলে তারা দলে দলে—

তার হারা সুর নাচের নেশায়

ডানাতে তোর পড়ল ঝরে

 

৭৯

নমো    যন্ত্র, নমো— যন্ত্র, নমো— যন্ত্র, নমো— যন্ত্র!

তুমি     চক্রমুখরমন্দ্রিত,     তুমি বজ্রবহ্নিবন্দিত,

তব      বস্তুবিশ্ববক্ষোদংশ ধংসবিকট দন্ত

তব      দীপ্ত-অগ্নি-শত-শতঘ্নী-বিঘ্নবিজিয় পন্থ।

তব      লৌহগলন শৈলদলন অচলচলন মন্ত্র

কভু      কাষ্ঠলোষ্ট্র-ইষ্টক-দৃঢ় ঘনপিনদ্ধ কায়া,

কভু      ভূতল-জল-অন্তরীক্ষ-লঙ্ঘন লঘু মায়া।

তব      খানি-খনিত্র-নখ-বিদীর্ণ ক্ষিতি বিকীর্ণ-অন্ত্র।

তব      পঞ্চভূতবন্ধনকর ইন্দ্রজালতন্ত্র

 

 

৮০

ওগো নদী, আপন বেগে পাগল-পারা,

আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু        গন্ধভরে তন্দ্রাহারা

আমি সদা অচল থাকি,       গভীর চলা গোপন রাখি,

আমার চলা নবীন পাতায়, আমার চলা ফুলের ধারা

ওগো নদী, চলার বেগে পাগল-পারা,

পথে পথে বাহির হয়ে আপন-হারা—

আমার চলা যায় না বলা—  আলোর পানে প্রাণের চলা—

আকাশ বোঝে আনন্দ তারা, বোঝে নিশার বীরব তারা

 

৮১

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষশাখায় ফাগুন মাসে

কী উচ্ছ্বাসে

ক্লান্তিবিহীন ফুল ফোটানোর খেলা।

ক্ষান্তকূজন শান্তবিজন সন্ধ্যাবেলা

প্রত্যহ সেই ফুল্ল শিরীষ প্রশ্ন শুধায় আমায় দেখি

‘এসেছে কি— এসেছে কি।’

 

আর বছরেই এমনি দিনেই ফাগুন-মাসে

কী উচ্ছ্বাসে

নাচের মাতন লাগল শিরীষ-ডালে

স্বর্গপুরের কোন্ নূপুরের তালে।

প্রত্যহ সেই চঞ্চল প্রাণ শুধিয়েছিল, ‘শুনাও দেখি

আসে নি কি— আসে নি কি।’

আবার কখন এমনি দিনেই ফাগুন মাসে

কী আশ্বাসে

ডালগুলি তার রইবে শ্রবণ পেতে

অলখ জনের চরণ-শব্দে মেতে।

প্রত্যহ তার মর্মরস্বর বলবে আমায় কী বিশ্বাসে,

‘সে কি আসে— সে কি আসে।’

 

প্রশ্ন জানাই পুষ্পবিভোর ফাগুন মাসে

কী আশ্বাসে,

‘হায় গো, আমার ভাগ্য-রাতের তারা,

নিমেষ-গণন হয় নি মোর সারা।’

প্রত্যহ বয় প্রাঙ্গণময় বনের বাতাস এলোমেলো—

‘সে কি এল— সে কি এল।’

 

৮২

হে       আকাশবিহারী-নীরদবাহন জল,

আছিল শৈলশিখরে-শিখরে তোমার লীলাস্থল

তুমি     বরনে বরনে কিরণে কিরণে প্রাতে সন্ধ্যায় অরুণে হিরণে

দিয়েছ ভাসায়ে পবনে পবনে স্বপনতরণীদল

শেষে    শ্যামল মাটির প্রেমে  তুমি ভুলে এসেছিলে নেমে,

কবে     বাঁধা পড়ে গেল যেখানে ধারার গভীর তিমিরতল।

আজ     পাষাণদুয়ার দিয়েছি টুটিয়া, কত যুগ পরে এসেছ ছুটিয়া

নীল গগনের হারানো স্মরণ

গানেতে সমুচ্ছল

 

৮৩

যে কেবল          পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে,

সে কি আজ        দিল ধরা গন্ধে-ভরা বসন্তের এই সঙ্গীতে

ও কি তার          উত্তরীর অশোকশাখায় উঠল দুলি।

আজি কি            পলাশবনে ওই সে বুলায় রঙের তুলি।

ও কি তার          চরণ পড়ে তালে তালে মল্লিকার ওই ভঙ্গীতে

                                      না গো না,          দেয় নি ধরা,   হাসির ভরা দীর্ঘশ্বাসে যায় ভেসে।

                                    মিশে এই হেলা-দোলায়  মনকে ভোলায়, ঢেউ দিয়ে যায় স্বপ্নে সে।

সে বুঝি             লুকিয়ে আসে বিচ্ছেদেরই রিক্ত রাতে,

নয়নের             আড়ালে তার  নিত্য-জাগার আসন পাতে—

ধেয়ানের           বর্ণছটায় ব্যথার রঙে মনকে সে রয় রঙ্গীতে

 

৮৪

ও কি এল, ও কি এল না,  বোঝা গেল না—

ও কি মায়া কি স্বপনছায়া, ও কি ছলনা

        ধরা কি পড়ে ও রূপেরই ডোরে,

    গানেরই তানে কি বাঁধিবে ওরে—

ও যে চিরবিরহেরই সাধনা

ওর  বাঁশিতে করুণ কী সুর লাগে

      বিরহমিলনমিলিত রাগে।

সুখে কি দুখে ও পাওয়া না-পাওয়া,

হৃদয়বনে ও উদাসী হাওয়া,

বুঝি শুধু ও পরমকামনা

 

৮৫

দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে

আমার বাটে বটের ছায়ায় সারা বেলা গেল খেলে

গাইল কী গান সেই তা জানে, সুর বাজে তার আমার প্রাণে—

বলো দেখি তোমরা কি তার কথার কিছু আভাস পেলে

আমি তারে শুধাই যবে ‘কী তোমারে দিব আনি’—

সে শুধু কয়, ‘আর কিছু নয়, তোমার গলার মালাখানি।’

দিই যদি তো কী দাম দেবে  যায় বেলা সেই ভাব্‌না ভেবে—

ফিরে এসে দেখি ধুলায় বাঁশিটি তার গেছে ফেলে

 

৮৬

    বাজে গুরুগুরু শঙ্কার ডঙ্কা,

ঝঞ্ঝা ঘনায় দূরে ভীষণ নীরবে।

   কত রব সুখস্বপ্নের ঘোরে আপনা ভুলে—

সহসা জাগিতে হবে

 

 

 

৮৭

ও জোনাকি,    কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ।

এই   আঁধারে সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ

  তুমি   নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র, তাই ব’লে কি কম আনন্দ।

     তুমি   আপন জীবন পূর্ণ ক’রে আপন আলো জ্বেলেছ

তোমার যা আছে তা তোমার আছে, তুমি নও গো ঋণী কারো কাছে,

     তোমার অন্তরে যে শক্তি আছে তারি আদেশ পেলেছ।

তুমি   আঁধার-বাঁধন ছাড়িয়ে ওঠ,   তুমি  ছোটো হয়ে নও গো ছোটো,

     জগতে যেথায় যত আলো সবায় আপন ক’রে ফেলেছ

 

৮৮

হ্যাদে গো নন্দরানী, আমাদের   শ্যামকে ছেড়ে দাও।

                                     আমরা রাখল-বালক দাঁড়িয়ে দ্বারে।  আমাদের  শ্যামকে দিয়ে যাও

হেরে গো   প্রভাত হল, সুয্যি ওঠে, ফুল ফুটেছে বনে।

আমরা   শ্যামকে নিয়ে গোষ্ঠে যাব আজ করেছি মনে।

ওগো,  পীত ধড়া পরিয়ে তারে কোলে নিয়ে আয়।

তার   হাতে দিয়ো মোহন রেণু, নূপুর দিয়ো পায়

রোদের বেলায় গাছের তলায় নাচব মোরা সবাই মিলে।

বাজবে নূপুর রুনুঝুনু, বাজবে বাঁশি মধুর বোলে।

বনফুলে গাঁথব মালা, পরিয়ে দেব’ শ্যামের গলে

 

৮৯

আঁধারের লীলা আকাশে আলোকলেখায়-লেখায়,

ছন্দের লীলা অচলকঠিনমৃদঙ্গে।

অরূপের লীলা অগোনা রূপের রেখায় রেখায়,

স্তব্ধ অতল খেলায় তরলতরঙ্গে

     আপনারে পাওয়া আপনা-ত্যাগের গভীর লীলায়,

     মূর্তির লীলা মূর্তিবিহীন কঠোর শিলায়,

শান্ত শিবের লীলা যে প্রলয়ভ্রূভঙ্গে।

শৈলের লীলা নির্ঝরকলকলিত রোলে,

          শুভ্রের লীলা কত-না রঙ্গে বিরঙ্গে।

মাটির লীলা যে শস্যের বায়ুহেলিত দোলে,

আকাশের লীলা উধাও ভাষার বিহঙ্গে।

স্বর্গের খেলা মর্তের ম্লান ধুলায় হেলায়,

দুঃখেরে লয়ে আনন্দ খেলে দোলন-খেলায়,

শৌর্যের খেলা ভীরু মাধুরীর আসঙ্গে

 

৯০

দেখা না-দেখায় মেশা  হে বিদ্যুৎলতা,

কাঁপাও ঝড়ের বুকে  একি ব্যাকুলতা

গগনে সে ঘুরে ঘুরে খোঁজে কাছে, খোঁজে দূরে—

সহসা কী হাসি হাস’, নাহি কহ কথা

আঁধার ঘনায় শূন্যে,   নাহি জানে নাম,

কী রুদ্র সন্ধানে সিন্ধু  দুলিছে দুর্দাম।

অরণ্য হতাশপ্রাণে  আকাশে ললাট হানে,

দিকে দিকে কেঁদে ফেরে   কী দুঃসহ ব্যাথা

 

৯১

তুমি উষার সোনার বিন্দু প্রাণের সিন্ধুকূলে,

শরৎ-প্রাতের শিশির প্রথম শিউলিফুলে

আকাশপারের ইন্দ্রধনু ধারার পারে নোওয়া,

নন্দনেরই নন্দিনী গো চন্দ্রলেখায় ছোঁওয়া,

প্রতিপদে চাঁদের স্বপন শুভ্র মেঘে ছোঁওয়া—

স্বর্গলোকের গোপন কথা মর্তে এলে ভুলে

                                      তুমি কবির ধেয়ান-ছবি পূর্বজনম-স্মৃতি,

                                      তুমি আমার কুড়িয়ে-পাওয়া হারিয়ে-যাওয়া গীতি।

যে কথাটি যায় না বলা কইলে চুপে চুপে,

তুমি আমার মুক্তি হয়ে এলে বাঁধনরূপে—

অমল আলোর কমলবনে ডাকলে দুয়ার খুলে।

 

৯২

আকাশ, তোমার কোন্ রূপে মন চিনতে পারে

তাই ভাবি যে বারে বারে

গহন রাতের চন্দ্র তোমার মোহন ফাঁদে

স্বপন দিয়ে মনকে বাঁধে,

প্রভাতসূর্য শুভ জ্যোতির তরবারে

ছিন্ন করি ফেলে তারে

বসন্তবায় পরান ভুলায় চুপে চুপে,

বৈশাখী ঝড় গর্জি উঠে রুদ্ররূপে।

শ্রাবণমেঘের নিবিড় সজল কাজল ছায়া

দিগ্‌দিগন্তে ঘনায় মায়া-

আশ্বিনে এই অমল আলোর কিরণধারে

যায় নিয়ে কোন্ মুক্তিপারে

 

৯৩

আধেক ঘুমে   নয়ন চুমে   স্বপন দিয়ে যায়।

শ্রান্ত ভালে  যূথীর মালে  পরশে মৃদু বায়

বনের ছায়া মনের সাথি, বাসনা নাহি কিছু-

পথের ধারে আসন পাতি,  না চাহি ফিরে পিছু—

বেণুর পাতা  মিশায় গাথা  নীরব ভাবনায়

মেঘের খেলা গগনতটে  অলস লিপি-লিখা,

সুদূর কোন্ স্মরণপটে  জাগিল মরীচিকা।

চৈত্রদিনে তপ্ত বেলা তৃণ-আঁচল পেতে

শূন্যতলে গন্ধ-ভেলা  ভাষায় বাতাসেতে—

কপোত ডাকে  মধুকশাখে  বিজন বেদনায়

 

৯৪

পাখি বলে, ‘চাঁপা, আমারে কও,

কেন তুমি হেন নীরবে রও।

প্রাণ ভরে আমি গাহি যে গান

সারা প্রভাতেরই সুরের দান,

সে কি তুমি তব হৃদয়ে লও।

কেন তুমি তবে নীরবে রও।’

চাঁপা শুনে বলে, ‘হায় গো হায়,

যে আমারই গাওয়া শুনিতে পায়

নহ নহ পাখি, সে তুমি নহ।’

 

পাখি বলে, ‘চাঁপা আমারে কও,

কেন তুমি হেন গোপনে রও।

ফাগুনের প্রাতে উতলা বায়

উড়ে যেতে সে যে ডাকিয়া যায়,

সে কি তুমি তব হৃদয়ে লও।

কেন তুমি তবে গোপনে রও।’

চাঁপা শুনে বলে, ‘হায় গো হায়,

যে আমারই ওড়া দেখিতে পায়

নহ নহ পাখি, সে তুমি নও।’

 

৯৫

মাটির   বুকের মাঝে বন্দী যে জল মিলিয়ে থাকে

মাটি     পায় না, পায় না, মাটি পায় না তাকে

কবে     কাটিয়ে বাঁধন পালিয়ে যখন যায় সে দূরে

আকাশপুরে গো,

তখন    কাজল মেঘের সজল ছায়া শূব্যে আঁকে,

সুদূর শূন্যে আঁকে-

মাটি     পায় না, পায় না, মাটি পায় না তাকে

শেষে    বজ্র তারে বাজায় ব্যথা বহ্নিজ্বালায়,

ঝঞ্ঝা তারে দিগ্‌বিদিকে কাঁদিয়ে চালায়।

তখন    কাছের ধন যে দূরের থেকে কাছে আসে

বুকের পাশে গো,

তখন    চোখের জলে নামে সে যে চোখের জলের ডাকে,

আকুল চোখের জলের ডাকে—

মাটি     পায় রে, পায় রে, মাটি পায় রে তাকে

 

৯৬

আমি সন্ধ্যাদীপের শিখা,

    অন্ধকারের ললাট-মাঝে পরানু রাজটিকা

তার     স্বপনে মোরে আলোর পরশ   জাগিয়ে দিল গোপন হরষ,

অন্তরে তার রইল আমার প্রথম প্রেমের লিখা

আমার নির্জন উত্সবে

          অম্বরতল হয় নি উতল পাখির কলরবে।

যখন    তরুণ রবির চরণ লেগে   নিখিল ভুবন উঠবে জেগে

  তখন আমি মিলিয়ে যাব ক্ষণিক মরীচিকা

 

৯৭

মাটির প্রদীপখানি আছে মাটির ঘরের কোলে,

সন্ধ্যাতারা তাকায় তারি আলো দেখবে ব’লে

সেই আলোটি নিমেষহত  প্রিয়ার ব্যাকুল চাওয়ার মতো,

সেই আলোটি মায়ের প্রাণের ভয়ের মতো দোলে

সেই আলোটি নেবে জ্বলে শ্যামল ধারার হৃদয়তলে,

সেই আলেটি চপল হাওয়ায় ব্যাথায় কাঁপে পলে পলে।

নামল সন্ধ্যাতারার বাণী  আকাশ হতে আশিস আনি,

অমরশিখা আকুল হল মর্তশিখায় উঠতে জ্ব’লে

 

৯৮

আমি    তোমারি মাটির কন্যা,  জননী বসুন্ধরা—

তবে     আমার মানবজন্ম  কেন বঞ্চিত করা

পবিত্র জানি যে তুমি  পবিত্র জন্মভূমি,

মানবকন্যা আমি যে ধন্যা  প্রাণের পুণ্যে ভরা

কোন্ স্বর্গের তরে  ওরা  তোমায় তুচ্ছ করে

          রহি  তোমার বক্ষোপরে।

আমি যে তোমারি আছি  নিতান্ত কাছাকাছি,

তোমার  মোহিনীশক্তি দাও আমারে হৃদয়প্রাণহরা

 

৯৯

যাবই আমি যাবই ওগো, বাণিজ্যেতে যাবই।

লক্ষ্মীরে হারাই যদি, অলক্ষ্মীরে পাবই।

সাজিয়ে নিয়ে জাহাজখানি বসিয়ে হাজার দাঁড়ি

কোন্ পূরীতে যাব দিয়ে কোন্ সাগরে পাড়ি।

 

কোন্ তারকা লক্ষ্য করি   কূলকিনারা পরিহরি

কোন্ দিকে যে বাইব তরী  বিরাট কালো নীরে—

মরব বা আর ব্যর্থ আশায় সোনার বালুর তীরে

 

নীলের কোলে শ্যামল সে দ্বীপ প্রবাল দিয়ে ঘেরা।

শৈলচূড়ায় নীড় বেঁধেছি সাগর-বিহঙ্গেরা।

নারিকেলের শাখে শাখে ঝোড়ো বাতাস কেবল ডাকে,

ঘব বনের ফাঁকে ফাঁকে বইছে নগনদী।

সাত-রাজার ধন মানিক পাব সেথায় নামি যদি

 

হেরো সাগর ওঠে তরঙ্গিয়া, বাতাস বহে বেগে।

সূর্য যেথায় অস্তে নামে ঝিলিক মারে মেঘে।

দক্ষিণে চাই, উত্তরে চাই— ফেনায় ফেনা, আর কিছু নাই—

যদি কোথাও কূল নাহি পাই তল পাব তো তবু—

ভিটার কোণে হতাশমনে রইবে না আর কভু

 

আকূল-মাঝে ভাসিয়ে তরী যাচ্ছি অজানায়

আমি শুধু একলা নেয়ে আমার শূন্য নায়।

নব নব পবন-ভরে  যাব দ্বীপে দ্বীপান্তরে,

নেব তরী পূর্ণ করে  অপূর্ব ধন যত।

ভিখারি মন ফিরবে যখন ফিরবে রাজার মতো

 

১০০

আমার নূতন যৌবনেরই দূত।

আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত।

আমরা বেড়া ভাঙি

আমরা  অশোকবনের রাঙা নেশায় রাঙি।

ঝঞ্ঝার বন্ধন ছিন্ন করে দিই— আমরা বিদ্যুৎ

আমরা করি ভুল—

অগাধ জলে ঝাঁপ দিয়ে যুঝিয়ে পাই কূল।

                                     যেখানে ডাক পড়ে  জীবন-মরণ-ঝড়ে  আমরা প্রস্তুত