গীতবিতান

   প্রেম ১-১০০
 

 

          ১

চিত্ত পিপাসিত রে

গীতসুধার তরে    

তাপিত শুষ্কলতা বর্ষণ যাচে যথা

কাতর অন্তর মোর লুণ্ঠিত ধুলি-'পরে

    গীত সুধার তরে

আজি বসন্তনিশা,  আজি অনন্ত তৃঁষা,

আজি এ জাগ্রত প্রাণ  তৃষিত চকোর-সমান

    গীতসুধার তরে।

চন্দ্র অতন্ত্র নভে   জাগিছে সুপ্ত ভবে,

অন্তর বাহির আজি  কাঁদে উদাস স্বরে

    গীতসুধার তরে
 

                                            ২

আমার    মনের মাঝে যে গান বাজে শুনতে কি পাও গো

আমার    চোখের 'পরে আভাস দিয়ে যখনি যাও গো

    রাবির কিরণ নেয় যে টানি ফুলের বুকের শিশিরখানি,

    আমার প্রাণের সে গান তুমি তেমনি কি নাও গো

    আমার  উদাস হৃদয় যখন আসে বাহির-পানে

    আপনাকে যে দেয় ধরা সে সকলখানে।

কচি পাতা প্রথম প্রাতে কী কথা কয় আলোর সাথে,

    আমার মনের আপন কথা বলে যে তাও গো    


                 ৩

কাহার গলার পরাবি গানের    রতনহার,

তাই কি বীণায় লাগালি যতনে   নূতন তার

    কানন পরেছে শ্যামল দুকুল, আমের শাখাতে নূতন মুকুল,

    নবীনের মায়া করিল আকুল হিয়া তোমার

যে কথা তোমার কোনো দিন আর  হয় নি বলা

নাহি জানি কারে তাই বলিবারে করে উতলা!

    দখিনপবনে বিহ্বলা ধরা   কাকলিকূজনে হয়েছে মুখরা,

    আজি নিখিলের বাণীমন্দিরে  খুলেছে দ্বার   

 

                      ৪

        যে ছায়ারে ধরব বলে করেছিলেম পণ

আজ সে মেনে নিল আমার গানেরই বন্ধন

আকাশে যার পরশ মিলায়  শরতমেঘের ক্ষণিক লীলায়

    আপন সুরে আজ শুনি তার নূপুরগুঞ্জন

অলস দিনের হাওয়ায়

গন্ধখানি মেলে যেত গোপন আসা-যাওয়ায়।

    আজ শরতের ছায়ানটে  মোর রাগিণীর মিলন ঘটে,

    সেই মিলনের তালে তালে বাজায় সে কঙ্কণ


                  ৫

তোমায়    গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ

        ওগো    ঘুম-ভাঙানিয়া।

বুকে    চমক দিয়ে তাই তো ডাক'

        ওগো  দুখজাগানিয়া

এল আঁধার ঘিরে,  পাখি   এল নীড়ে,

        তরী   এল তীরে-

শুধু    আমার হিয়া বিরাম পায় নাকো

        ওগো   দুখজাগানিয়া

    আমার    কাজের মাঝে মাঝে

কান্নাধারার দোলা তুমি থামতে দিলে না যে।

    আমায় পরশ ক'রে প্রাণ সুধায় ভ'রে

        তুমি যাও যে সরে-

বুঝি    আমার ব্যথার আড়ালেতে দাঁড়িয়ে থাক

        ওগো   দুখজাগানিয়া

 

                    ৬

গানের ডালি ভরে দে গো উষার কোলে-

আয় গো তোরা, আয় গো তোরা, আয় গো চলে

চাঁপার কলি চাঁপার গাছে  সুরের আশায় চেয়ে আছে,

    কান পেতেছে নতুন পাতা গাইবি ব'লে

            কমলবরন গগন-মাঝে

            কমলচরণ ওই বিরাজে।

ওইখানে তোর সুর ভেসে যাক, নবীন প্রাণের ওই দেশে যাক,

   ওই যেখানে সোনার আলোর দুয়ার খোলে


                           ৭

ওরে আমার হৃদয় আমার, কখন তোরে প্রভাতকালে

    দীপের মতো  গানের স্রোতে কে ভাসালে

যেন রে তুই হঠাৎ বেঁকে  শুকনো ডাঙায় যাস নে ঠেকে,

            জড়াস নে শৈবালের জালে

তীর যে হোথায় স্থির রয়েছে, ঘরের প্রদীপ সেই জ্বালালো-

            অচল রহে তাহার আলো।

গানের প্রদীপ তুই যে গানে চলবি ছুটে অকূল-পানে

              চপল ঢেউয়ের আকুল তালে


                      ৮

কাল    রাতের বেলা গান এল মোর মনে,

        তখন তুমি ছিলে না মোর সনে

যে কথাটি বলব তোমায় ব'লে    কাটল জীবন  নীরব চোখের জলে

সেই কথাটি সুরের হোমানলে  উঠল জ্বলে একটি আঁধার ক্ষণে-

    তখন তুমি ছিলে না মোর সনে॥     

    ভেবেছিলেম আজকে সকাল হলে

    সেই কথাটি তোমার যাব বলে।

ফুলের উদাস সুবাস বেড়ায় ঘুরে  পাখির গানে আকাশ গেল পূরে,

সেই কথাটি লাগল না সেই সুরে  যতই প্রয়াস করি পরানপণে-

    যখন তুমি আছ আমার সনে॥
 

                  ৯

আকাশে আজ কোন্‌ চরণের আসা-যাওয়া।

বাতাসে আজ কোন্‌ পরশের লাগে হাওয়া॥

অনেক দিনের বিদায় বেলার ব্যাকুল বাণী

আজ উদাসীর বাঁশির সুরে কে দেয় আনি-

বনের ছায়ায় তরুণ চোখের করুণ চাওয়া॥

কোন্‌ ফাগুনে যে ফুল ফোটা হল সারা

মৌমাছিদের পাখায় পাখায় কাঁদে তারা।

বকুলতলায় কাজ-ভোলা সেই কোন্‌ দুপুরে

যে-সব কথা ভাসিয়ে দিলেম গানের সুরে

ব্যথায় ভ'রে ফিরে আসে সে গান-গাওয়া॥
 

১০

মনে রবে কি না রবে আমারে   সে আমার মনে নাই।
ক্ষণে
 ক্ষণে আসি তব দুয়ারে,   অকারণে গান গাই॥
চলে
 যায় দিন, যতখন আছি   পথে যেতে যদি আসি কাছাকাছি
তোমার
 মুখের চকিত সুখের   হাসি দেখিতে যে চাই
          তাই   অকারণে গান গাই॥
ফাগুনের
 ফুল যায় ঝরিয়া   ফাগুনের অবসানে
ক্ষণিকের
 মুঠি দেয় ভরিয়া,   আর কিছু নাহি জানে।
ফুরাইবে
 দিন, আলো হবে ক্ষীণ,   গান সারা হবে, থেমে যাবে বীন,
যতখন
 থাকি ভরে দিবে নাকি    খেলারই ভেলাটাই
          তাই   অকারণে গান 
গাই॥
 

                     ১১

আকাশে আজ কোন্‌ চরণের আসা-যাওয়া।

বাতাসে আজ কোন্‌ পরশের লাগে হাওয়া॥

অনেক দিনের বিদায় বেলার ব্যাকুল বাণী

আজ উদাসীর বাঁশির সুরে কে দেয় আনি-

বনের ছায়ায় তরুণ চোখের করুণ চাওয়া॥

কোন্‌ ফাগুনে যে ফুল ফোটা হল সারা

মৌমাছিদের পাখায় পাখায় কাঁদে তারা।

বকুলতলায় কাজ-ভোলা সেই কোন্‌ দুপুরে

যে-সব কথা ভাসিয়ে দিলেম গানের সুরে

ব্যথায় ভ'রে ফিরে আসে সে গান-গাওয়া॥

 

                  ১৩

আমার    কণ্ঠ হতে গান কে নিল ভুলায়ে,

সে যে    বাসা বাঁধে নীরব মনের কুলায়ে॥

          মেঘের দিনে শ্রাবণ মাসে যূথীবনের দীর্ঘশ্বাসে

         আমার-প্রাণে সে দেয় পাখার ছায়া বুলায়ে॥

        যখন শরৎ কাঁপে শিউলিফুলের হরষে

        নয়ন ভরে যে সেই গোপন গানের পরশে।

        গভীর রাতে কী সুর লাগায় আধো-ঘুমে আধো-জাগায়,

        আমা  স্বপন-মাঝে দেয় কী দোল দুলায়ে॥

 

                ১৪

যায় নিয়ে যায় আমায় আপন গানের টানে

    ঘর-ছাড়া কোন্‌ পথের পানে॥

    নিত্যকালের গোপন কথা বিশ্বপ্রাণের ব্যাকুলতা

    আমার বাঁশি দেয় এনে দেয় আমার কানে॥

মনে যে হয় আমার হৃদয় কুসুম হয়ে ফোটে,

    আমার হিয়া উচ্ছলিয়া সাগরে ঢেউ ওঠে।

    পরান আমার বাঁধন হারায় নিশীথরাতের তারায় তারায়,

    আকাশ আমায় কয় কী-যে কয় কেই বা জানে॥
 

                     ১৫

দিয়ে গেনু বসন্তের এই গানখানি-

বয়ষ ফুরায়ে যাবে, ভুলে যাবে জানি॥

    তবু তো ফাল্গুনরাতে  এ গানের বেদনাতে

    আঁখি তব ছলোছলো, এই বহু মানি॥

চাহি না রহিতে বসে ফুরাইলে বেলা,

তখনি চলিয়া যাব শেষ হলে খেলা।

    আসিবে ফাল্গুন পুন, তখন আবার শুনো

    নব পথিকেরই গানে নূতনের বাণী॥


            ১৬

গান আমার যায় ভেসে যায়-

চাস্‌ নে ফিরে,  দে তারে বিদায়॥

সে যে দখিনহাওয়ায় মুকুল ঝরা, ধুলার আঁচল হেলায় ভরা,

    সে যে শিশির-ফোঁটার মালা গাঁথা বনের আঙিনায়॥

    কাঁদন-হাসির আলোছায়া সারা অলস বেলা-

মেঘের গায়ে রঙের মায়া, খেলার পরে খেলা।

ভুলে-যাওয়ার বোঝাই ভরি    গেল চলে কতই তরী-

    উজান বায়ে ফেরে যদি কে রয় সে আশায়॥
 

             ১৭

সময় কারো যে নাই, ওরা চলে দলে দলে-

গান হায় ডুবে যায় কোন্‌ কোলাহলে॥

    পাষাণে রচিছে কত কীর্তি ওরা সবে   বিপুল গরবে,

    যায় আর বাঁশি-পানে চায় হাসিছলে॥

বিশ্বের কাজের মাঝে জানি আমি জানি

তুমি শোন মোর গানখানি।

আঁধার মথন করি যবে লও তুলি  গ্রহতারাগুলি

শোন যে নীরবে তব নীলাম্বরতলে॥
 

                ১৮

এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসিখেলায়

আমি যে গান গেয়েছিলেম  জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।

শুকনো ঘাসে শূন্য বনে  আপন-মনে

        অনাদরে অবহেলায়

আমি যে গান গেয়েছিলেম  জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়॥

দিনের পথিক মনে রেখো, আমি চলেছিলেম রাতে

        সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে।

যখন আমায় ওপার থেকে গেল ডেকে ভেসেছিলেম ভাঙা ভেলায়।

আমি যে গান গেয়েছিলেম   জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়॥

             

                 ১৯

আসা-যাওয়ার পথের ধারে গান গেয়ে মোর কেটেছে দিন।

যাবার বেলায় দেব কারে বুকের কাছে বাজল যে বীন॥

সুরগুলি তার নানা ভাগে  রেখে যাব পুষ্পরাগে,

মীড়গুলি তার মেঘের রেখায় স্বর্ণলেখায় করব বিলীন॥

কিছু বা সে মিলনমালার যুগলগলায় রইবে গাঁথা,

কিছু বা সে ভিজিয়ে দেবে দুই চাহনির চোখের পাতা।

কিছু বা কোন্‌ চৈত্রমাসে  বকুল-ঢাকা বনের ঘাসে

মনের কথার  টুকরো আমার কুড়িয়ে পাবে কোন্‌ উদাসীন।
 

                  ২০

গানের ভেলায়  বেলা অবেলায়  প্রাণের আশা

    ভোলা মনের স্রোতে ভাসা॥

কোথায় জানি ধায় সে বাণী, দিনের শেষে

    কোন্‌ ঘাটে যে ঠেকে এসে চিরকালের কাঁদা-হাসা॥

এমনি খেলার ঢেউয়ের দোলে

খেলার পারে যাবি চলে।

পালের হাওয়ার ভরসা তোমার-করিস নে ভয়

    পথের কড়ি না যদি রয়,  সঙ্গে আছে বাঁধন-নাশা॥

 

                 ২১

অনেক দিনের আমার যে গান আমার কাছে ফিরে আসে

তারে আমি শুধাই, তুমি ঘুরে বেড়াও কোন্‌ বাতাসে॥

যে ফুল গেছে সকল ফেলে গন্ধ তাহার কোথায় পেলে,

যার আশা আজ শূন্য হল কী সুর জাগাও তাহার আশে॥

সকল গৃহ হারালো যার তোমার তানে তারি বাসা,

যার বিরহের নাই অবসান তার মিলনের আনে ভাষা।

শুকালো যেই নয়নবারি  তোমার সুরে কাঁদন তারি,

ভোলা দিনের বাহন তুমি স্বপন ভাসাও দূর আকাশে।
 

                  ২২

পাখি আমার নীড়ের পাখি অধীর হল কেন জানি-

আকাশ-কোণে যায় শোনা কি ভোরের আলোর কানাকানি॥

    ডাক উঠেছে মেঘে মেঘে, অলস পাখা উঠল জেগে-

    লাগল তারে উদাসী ওই নীল গগনের পরশখানি॥

আমার নীড়ের পাখি এবার উধাও হল আকাশ-মাঝে

যায় নি কারো সন্ধানে সে, যায় নি যে সে কোন কাজে।

    গানের ভরা উঠল ভরে,  চায় দিতে তাই উজাড় করে-

     নীরব গানের সাগর-মাঝে আপন প্রাণের সকল বাণী॥
 

                ২৩

ছুটির বাঁশি বাজল যে ওই নীল গগনে,

আমি কেন একলা বসে এই বিজনে॥

    বাঁধন টুটে উঠবে ফুটে শিউলিগুলি

    তাই তো কুঁড়ি কানন জুড়ি উঠছে দুলি,

    শিশির-ধোওয়া হাওয়ার ছোঁওয়া লাগল বনে-

    সুর খুঁজে তাই শূন্যে তাকাই আপন-মনে॥

বনের পথে কী মায়াজাল হয় যে বোনা,

সেইখানেতে আলোছায়ার চেনাশোনা।

    ঝরে-পড়া মালতী তার গন্ধশ্বাসে

    কান্না-আভাস দেয় মেলে ওই ঘাসে ঘাসে,

    আকাশ হাসে শুভ্র কাশের আন্দোলনে-

    সুর খুঁজে তাই শূন্যে তাকাই আপন-মনে॥
 

                 ২৪

বাঁশি আমি বাজাই নি কি পথের ধারে ধারে।

    গান গাওয়া কি হয় নি সারা তোমার বাহির-দ্বারে॥

    ওই-যে দ্বারের যবনিকা  নানা বর্ণে চিত্রে লিখা

        নানা সুরের অর্ঘ্য শুনি জলে স্থলে-

    'পথের বাঁধন ঘুচিয়ে ফেলো' এই কথা সে'ই বলে।

    মিলন-ছোঁওয়া বিচ্ছেদেরই অন্তবিহীন ফেরাফেরি

   যেও গো নিয়ে আনাগোনার পারে॥
 

                  ২৫

তোমার    শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে   চলে এসেছি।

            কেউ কি তা জানে॥

        তোমার আছে গানে গানে গাওয়া,

        আমার কেবল চোখে চোখে চাওয়া-

মনে মনে মনের কথাখানি  বলে এসেছি  কেউ কি তা জানে॥

        ওদের নেশা তখন ধরে নাই,

            রঙিন রসে প্যালা ভরে নাই।

    তখনো তো কতই আনাগোনা,

    নতুন লোকের নতুন চেনাশোনা-

ফিরে ফিরে ফিরে-আসার আশা দ'লে এসেছি কেউ কি তা জানে॥
 

                   ২৬

আমার    শেষ রাগিণীর প্রথম ধুয়ো ধরলি রে  কে তুই।

আমার    শেষ পেয়ালা চোখের জলে ভরলি রে  কে তুই॥

দূরে    পশ্চিমে ওই দিনের পারে  অস্তরবির পথের ধারে

    রক্তরাগের ঘোমটা মাথায় পরলি রে কে তুই॥

    সন্ধ্যাতারায় শেষ চাওয়া তোর রইল কি ওই-যে।

    সন্ধ্যা-হাওয়ায় শেষ বেদনা বইল কি ওই-যে।

তোর    হঠাৎ-খসা প্রাণের মালা ভরল আমার শূন্য ডালা-

    মরণপথের সাথি আমায় করলি রে  কে তুই॥ 


                     ২৭

পাছে    সুর ভুলি এই ভয় হয়-

পাছে    ছিন্ন তারের জয় হয়॥

পাছে উৎসবক্ষণ তন্দ্রালসে হয় নিমগন, পুণ্য লগন

    হেলায় খেলায় ক্ষয় হয়-

পাছে    বিনা গানের মিলনবেলা ক্ষয় হয়॥

    যখন তাণ্ডবে মোর ডাক পড়ে

পাছে    তার তালে মোর তাল না-মেলে সেই ঝড়ে।

যখন    মরণ এসে ডাকবে শেষে বরণ-গানে, পাছে প্রাণে

        মোর বাণী সব লয় হয়-

    পাছে    বিনা গানেই বিদায়বেলা লয় হয়॥
 

                   ২৮

বিরস দিন বিরল কাজ, প্রবল বিদ্রোহে

এসেছ প্রেম, এসেছ আজ কী মহা সমারোহে॥

    একেলা রই অলসমন, নীরব এই ভবনকোণ,

    ভাঙিলে দ্বার কোন্‌ সে ক্ষণ  অপরাজিত ওহে॥

কানন-'পর ছায়া বুলায়, ঘনায় ঘনঘটা।

গঙ্গা যেন হেসে দুলায় ধূর্জটির জটা।

    যেথা যে রয় ছাড়িল পথ, ছুটালে ওই বিজয়রথ

আঁখি তোমার তড়িতবৎ  ঘনঘুমের মোহে॥
 

                 ২৯

বাজিল কাহার বীণা মধুর স্বরে

    আমার নিভৃত নব জীবন 'পরে।

প্রভাতকমলসম ফুটিল হৃদয় মম

    কার দুটি নিরুপম  চরণ-তলে॥

জেগে উঠে সব শোভা, সব মাধুরী,

পলকে পলকে হিয়া পুলকে পূরি।

    কোথা হতে সমীরণ  আনে নব জাগরণ,

    পরানের আবরণ মোচন করে॥

    লাগে বুকে সুখে দুখে কত যে ব্যথা,

কেমনে বুঝায়ে কব না জানি কথা।

আমার বাসনা আজি  ত্রিভুবনে উঠে বাজি,

    কাঁপে নদী বনরাজি  বেদনাভরে॥
 

                   ৩০

সবার সাথে চলতেছিল অজানা এই পথের অন্ধকারে,

কোন্‌ সকালের হঠাৎ আলোয় পাশে আমার দেখতে পেলেম তারে॥

এক নিমেষেই রাত্রি হল ভোর, চিরদিনের ধন যেন সে মোর,

পরিচয়ের অন্ত যেন কোনোখানে নাইকো একেবারে-

চেনা কুসুম ফুটে আছে না-চেনা এই গহন বনের ধারে

    অজানা এই পথের অন্ধকারে॥

জানি আমি দিনের শেষে সন্ধ্যাতিমির নামবে পথের মাঝে-

আবার কখন পড়বে আড়াল, দেখাশোনার বাঁধন রবে না যে।

    তখন আমি পাব মনে মনে পরিচয়ের পরশ ক্ষণে ক্ষণে;

জানব চিরদিনের পথে আঁধার আলোয় চলছি সারে সারে-

হৃদয়-মাঝে দেখব খুঁজে একটি মিলন সব-হারানোর পারে

        অজানা এই পথের অন্ধকারে ॥
 

                 ৩১

আমার পরান লয়ে কী খেলা খেলাবে ওগো

        পরানপ্রিয়।

কোথা হতে ভেসে কূলে লেগেছে চরণমূলে

        তুলে দেখিয়ো

এ নহে গো তৃণদল, ভেসে-আসা ফুলফল-

    এ যে ব্যথাভরা মন  মনে রাখিয়ো॥

কেন আসে কেন যায়  কেহ না জানে।

    কে আসে কাহার পাশে কিসের টানে।

রাখ যদি ভালোবেসে চিরপ্রাণ পাইবে সে,

ফেলে যদি যাও তবে বাঁচিবে কি ও॥
 

                  ৩২

সুন্দর হৃদিরঞ্জন তুমি নন্দনফুলহার

তুমি অনন্ত নববসন্ত অন্তরে আমার

নীল অম্বর চুম্বননত, চরণে ধরণী মুগ্ধ নিয়ত,

    অঞ্চল ঘেরি সঙ্গীত যত গুঞ্জরে শতবার॥

ঝলকিছে কত ইন্দুকিরণ, পুলকিছে ফুলগন্ধ-

    চরণভঙ্গে লালিত অঙ্গে চমকে চকিত ছন্দ।

ছিঁড়ি মর্মের শত বন্ধন তোমা-পানে ধায় যত ক্রন্দন-

    লহো হৃদয়ের ফুলচন্দন বন্দন-উপহার॥
 

                    ৩৩

আমারে করো তোমার বীণা, লহো গো লহো তুলে।

উঠিবে বাজি তন্ত্রীরাজি  মোহন অঙ্গুলে॥

কোমল তব কমলকরে, পরশ করো পরান 'পরে,

    উঠবে হিয়া গুঞ্জরিয়া তব শ্রবণমূলে॥

কখনো সুখে কখনো দুখে কাঁদিবে চাহি তোমার মুখে,

    চরণে পড়ি রবে নীরবে রহিবে যবে ভুলে।

কেহ না জানে কী নব তানে উঠিবে গীত শূন্য-পানে,

    আনন্দের বারতা যাবে অনন্তের কূলে।
 

                 ৩৪

ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে

    আমার নামটি লিখো-তোমার

    মনের মন্দিরে।

আমার পরানে যে গান বাজিছে

    তাহারি তালটি শিখো-তোমার

    চরণমঞ্জীরে॥

ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে

    আমার মুখর পাখি-তোমার

    প্রাসাদপ্রাঙ্গণে।

মনে ক'রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো

আমার হাতের রাখী-তোমার

কনককঙ্কণে॥

আমার লতার একটি মুকুল

ভুলিয়া তুলিয়া রেখো-তোমার

অলকবন্ধনে।

আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে

    একটি বিন্দু এঁকো-তোমার

    ললাটচন্দনে।

আমার মনের মোহের মাধুরী

    মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো-তোমার   

    অঙ্গসৌরভে।

আমার আকুল জীবনমরণ

    টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো-তোমার

অতুল গৌরবে॥

                        
                     ৩৫

ওগো    কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ, আরো কী তোমার চাই।

ওগো    ভিখারি আমার ভিখারি, চলেছ কী কাতর গান গাই॥

    প্রতিদিন প্রাতে নব নব ধনে তুষিব তোমারে সাধ ছিল মনে-

            ভিখারি আমার ভিখারি,

হায়    পলকে সকলই সঁপেছি চরণে, আর তো কিছুই নাই॥

আমি    আমার বুকের আঁচল ঘেরিয়া তোমারে পরানু বাস।

আমি    আমার ভুবন শূন্য করেছি তোমার পুরাতে আশ।

হেরো    মম প্রাণ মন যৌবন নব  করপুটতলে পড়ে আছে তব-

        ভিখারি আমার ভিখারি,

হায়    আরো যদি চাও মোরে কিছু দাও, ফিরে আমি দিব তাই॥
 

                      ৩৬

তুমি    সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা,

        মম শূন্যগগনবিহারী।

আমি      আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা-

            তুমি আমারি, তুমি আমারি,

            মম অসীমগগনবিহারী॥

মম হৃদয়রক্তরাগে তব চরণ দিয়েছি রাঙিয়া,

অয়ি  সন্ধ্যাস্বপনবিহারী।

তব অধর এঁকেছি সুধাবিষে মিশে মম সুখদুখ ভাঙিয়া-

    তুমি    আমারি, তুমি আমারি,

    মম    বিজনজীবনবিহারি॥

মম    মোহের স্বপন-অঞ্জন তব নয়নে দিয়েছি পরায়ে,

    অয়ি মুগ্ধনয়নবিহারি।

মম    সঙ্গীত তব অঙ্গে অঙ্গে দিয়েছি জড়ায়ে জড়ায়ে-

    তুমি    আমারি, তুমি আমারি,

    মম জীবনমরণবিহারি॥
 

              ৩৭

কত কথা তারে ছিল বলিতে ।

চোখে চোখে দেখা হল পথ চলিতে॥

বসে বসে দিবারাতি  বিজনে সে কথা গাঁথি

    কত যে পূরবীরাগে কত ললিতে॥

সে কথা ফুটিয়া উঠে কুসুমবনে,

সে কথা ব্যাপিয়া যায় নীল গগনে

সে কথা লইয়া খেলি হৃদয়ে বাহিরে মেলি,

মনে মনে গাহি কার মন ছলিতে॥ 
 

                 ৩৮

সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে

দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে॥

    এ কথা কভু আর পারে না ঘুচিতে,

আছে সে নিখিলের মাধুরীরুচিতে।

    এ কথা শিখানু যে আমার বীণারে,

গানেতে চিনালেম সে চির-চিনারে॥

সে কথা সুরে সুরে ছড়াব পিছনে

স্বপনফসলের বিছনে বিছনে।

মধুপগুঞ্জে সে লহরী তুলিবে,

কুসুমকুঞ্জে সে পবনে দুলিবে,

ঝরিবে শ্রাবণের বাদলসিচনে।

শরতে ক্ষীণ মেঘে ভাসিবে আকাশে

স্মরণবেদনার বরনে আঁকা সে।

চকিতে ক্ষণে ক্ষণে পাব যে তাহারে

ইমনে কেদারায় বেহাগে বাহারে॥
 

                  ৩৯

 হে নিরুপমা,

গানে যদি লাগে বিহ্বল তান     করিয়ো ক্ষমা

ঝরোঝরো ধারা আজি উতরোল,  নদীকূলে-কূলে উঠে কল্লোল,

বনে বনে গাহে মর্মরস্বরে   নবীন পাতা।

সজল পবন দিশে দিশে তোলে বাদলগাথা॥

হে নিরুপমা,

চপলতা আজি যদি ঘটে তবে করিয়ো ক্ষমা।

তোমার দুখানি কালো আঁখি-'পরে  বরষার কালো ছায়াখানি পড়ে,

ঘন কালো তব কুঞ্চিত কেশে যূথীর মালা।

তোমারি চরণে নববরষার বরণডালা॥

হে নিরুপমা,

চপলতা আজি যদি ঘটে তবে  করিয়ো ক্ষমা।

এল বরষার সঘন দিবস, বনরাজি আজি ব্যাকুল বিবশ,

বকুলবীথিকা মুকুলে মত্ত  কানন-'পরে।

নবকদম্ব মদির গন্ধে  আকুল করে॥

হে নিরুপমা,

আঁখি যদি আজ করে অপরাধ, করিয়ো ক্ষমা।

হেরো আকাশের দূর কোণে কোণে  বিজুলি চমকি ওঠে খনে খনে,

দ্রুত কৌতুকে তব বাতায়নে  কী দেখে চেয়ে।

অধীর পবন কিসের লাগিয়া আসিছে ধেয়ে॥


      
                

      অজানা খনির নূতন মণির  গেঁথেছি হার,
      ক্লান্তিবিহীনা নবীনা বীণায়   বেঁধেছি তার

যেমন নূতন বনের দুকূল,    যেমন নূতন আমের মুকুল,
     মাঘের অরুণে খোলে স্বর্গের নূতন দ্বার,
তেমনি আমার নবীন রাগের   নব যৌবনে নব সোহাগের
     রাগিণী রচিয়া উঠিল নাচিয়া বীণার তার
     যে
বাণী আমার কখনো কারেও হয় নি বলা
     তাই দিয়ে গানে রচিব নূতন নৃত্যকলা।

আজি কারণ বাতাসে বাতাসে যুগান্তরের সুর ভেসে আসে,
    মর্মরস্বরে বনের ঘুচিল মনের ভার।
যেমনি ভাঙিল বাণীর বন্ধ উচ্ছ্বসি উঠে নূতন ছন্দ,
    সুরের সাহসে আপনি চকিত বীণার তার।।
   


                  ৪১

আজি এ নিরালা কুঞ্জে আমার অঙ্গ-মাঝে

বরণের ডালা সেজেছে আলোকমালার সাজে॥

    নব বসন্তে লতায় পাতায় ফুলে

    বাণীহিল্লোল উঠে প্রভাতের স্বর্ণকূলে,

    আমার দেহের বাণীতে সে গান উঠিছে দুলে-
    এ বরণগান নাহি পেলে মান মরিব লাজে।
    ওহে প্রিয়তম, দেহে মনে মম ছন্দ বাজে॥

    অর্ঘ্য তোমার আনি নি ভরিয়া বাহির হতে,

ভেসে আসে পূজা পূর্ণ প্রাণের আপন স্রোতে।

মোর তনুময় উছলে হৃদয় বাঁধনহারা,

অধীরতা তারি মিলনে তোমারি হোক-না সারা।

ঘন যামিনীর আঁধারে যেমন জ্বলিছে তারা,

দেহ ঘেরি মম প্রাণের চমক তেমনি রাজে-

সচকিত আলো নেচে ওঠে মোর সকল কাজে।
 

                    ৪২

ফিরে যাও কেন ফিরে যাও   বহিয়া বিফল বাসনা॥

চিরদিন আছ দূরে  অজানার মতো নিভূত অচেনা পুরে,

    কাছে আস তবু আস না

    বহিয়া বিফল বাসনা॥

পারি না তোমায় বুঝিতে-

ভিতরে কারে কি পেয়েছ,   বাহিরে চাহ না খুঁজিতে।

    না-বলা তোমার বেদনা যত

বিরহপ্রদীপে শিখারই মতো

নয়নে তোমার উঠিছে জ্বলিয়া

    নীরব কী সম্‌ভাষণা॥

       

                 ৪৩

আমার    জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান-

    তুমি    জান নাই, তুমি জান নাই,

    তুমি    জান নাই তার মূল্যের পরিমাণ॥

        রজনীগন্ধা অগোচরে

    যেমন রজনী স্বপনে ভরে   সৌরভে,

        তুমি  জান নাই, তুমি জান নাই,

তুমি    জান নাই, মরমে আমার ঢেলেছ তোমার গান॥

        বিদায় নেবার সময় এবার হল-

    প্রসন্ন মুখ তোলো, মুখ তোলো, মুখ তোলো-

    মধুর মরণে পূর্ণ করিয়া সঁপিয়া যাব প্রাণ  চরণে।

যারে    জান নাই, যারে জান নাই, যারে জান নাই,

তার    গোপন ব্যথার নীরব রাত্রি হোক আজি অবসান॥

              

                   ৪৪

জানি জানি তুমি এসেছ এ পথে মনের ভুলে।

তাই হোক তবে তাই হোক, দ্বার দিলেম খুলে॥

এসেছ তুমি তো বিনা আভরণে, মুখর নূপুর বাজে না চরণে,

তাই হোক তবে তাই হোক, এসো সহজ মনে।

ওই তো মালতী ঝরে পড়ে যায় মোর আঙিনায়,

শিথিল কবরী সাজাতে তোমার লও-না তুলে॥

কোনো আয়োজন নাই একেবারে, সুর বাঁধা নাই এ বীণার তারে,

তাই হোক তবে, এসো হৃদয়ের মৌনপারে।

ঝরোঝরো বারি ঝরে বনমাঝে, আমারি মনের সুর ওই বাজে,

উতলা হাওয়ার তালে তালে মন উঠিছে দুলে॥
 

                  ৪৫

হে সখা, বারতা পেয়েছি মনে মনে তব নিশ্বাসপরশনে,

        এসেছ অদেখা বন্ধু  দক্ষিণসমীরণে॥

কেন বঞ্চনা কর মোরে, কেন বাঁধ অদৃশ্য ডোরে-

দেখা দাও, দেখা দাও দেহ মন ভ'রে মম নিকুঞ্জবনে॥

দেখা দাও চম্পকে রঙ্গনে, দেখা দাও কিংশুকে কাঞ্চনে।

কেন শুধু বাঁশরির সুরে  ভুলায়ে লয়ে যাও দূরে,

    যৌবন-উৎসবে ধরা দাও দৃষ্টির বন্ধনে॥
 

                       ৪৬

যদি    জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম।

    কে যে আমায় কাঁদায় আমি কী জানি তার নাম॥

কোথায় যে হাত বাড়াই মিছে, ফিরি আমি কাহার পিছে-

    সব যেন মোর বিকিয়েছে, পাই নি তাহার দাম॥

এই বেদনার ধন সে কোথায় ভাবি জনম ধ'রে।

ভুবন ভরে আছে যেন, পাই নে জীবন ভরে।

সুখ যারে কয় সকল জনে  বাজাই তারে ক্ষণে ক্ষণে-

    গভীর সুরে 'চাই নে' 'চাই নে' বাজে অবিশ্রাম॥


                  ৪৭

আমি যে আর সইতে পারি নে।

সুরে বাজে মনের মাঝে গো, কথা দিয়ে কইতে পারি নে॥

    আমি সে আর বইতে পারি নে॥

    আজ আমার নিবিড় অন্তরে

কী হাওয়াতে কাঁপিয়ে দিল গো পুলক-লাগা আকুল মর্মরে।

কোন্‌ গুণী আজ উদাস প্রাতে  মীড় দিয়েছে কোন্‌ বীণাতে গো-

    ঘরে যে আর রইতে পারি না॥
 

                ৪৮।

আমার নয়ন তব নয়নের নিবিড় ছায়ায়

    মনের কথার কুসুমকোরক খোঁজে।

সেথায় কখন অগম গোপন গহন মায়ায়

    পথ হারাইল ও যে॥

আতুর দিঠিতে শুধায় সে নীরবেরে-

নিভৃত বাণীর সন্ধান নাই যে রে;

অজানার মাঝে অবুঝের মতো ফেরে

    অশ্রুধারায় মজে॥

আমার হৃদয়ে যে কথা লুকানো তার আভাষণ

ফেলে কভু ছায়া তোমার হৃদয়তলে?

দুয়ারে এঁকেছি রক্ত রেখায় পদ্ম-আসন,

সে তোমারে কিছু বলে?

তব কুঞ্জের পথ দিয়ে যেতে যেতে

বাতাসে বাতাসে ব্যথা দিই মোর পেতে-

বাঁশি কী আশায় ভাষা দেয় আকাশেতে

সে কি কেহ নাহি বোঝে॥

                 

              ৪৯

আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরণীতে

মুগ্ধ ললিত অশ্রুগলিত গীতে॥

পঞ্চশরের বেদনামাধুরী দিয়ে

বাসররাত্রি রচিব না মোরা প্রিয়ে-

ভাগ্যের পায়ে দুর্বল প্রাণে ভিক্ষা না যেন যাচি।

কিছু নাই ভয়, জানি নিশ্চয় তুমি আছ আমি আছি॥

উড়াব ঊর্ধ্বে প্রেমের নিশান দুর্গমপথমাঝে

দুর্দম বেগে দুঃসহতম কাজে।

রুক্ষ দিনের দুঃখ পাই তো পাব-

চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাব।

পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,

মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি॥

দুজনের চোখে দেখেছি জগৎ দোঁহারে দেখেছি দোঁহে-

মরুপথতাপ দুজনে নিয়েছি সহে।

ছুটি নি মোহন মরীচিকা-পিছে-পিছে,

ভুলাই নি মন সত্যেরে করি মিছে-

এই গৌরবে চলিব এ ভবে যত দিন দোঁহে বাঁচি।

এ বাণী, প্রেয়সী, হোক মহীয়সী 'তুমি আছ আমি আছি'॥

               

              ৫০

আরো কিছুখন নাহয় বসিয়ো পাশে,

    আরো যদি কিছু কথা থাকে তাই বলো।

শরত-আকাশ হেরো ম্লান হয়ে আসে,

    বাষ্প-আভাসে দিগন্ত ছলোছলো॥

জানি তুমি কিছু চেয়েছিলে দেখিবারে,

তাই তো প্রভাতে এসেছিলে মোর দ্বারে,

দিন না ফুরাতে দেখিতে পেলে কি তারে

    হে পথিক বলো বলো-

সে মোর অগম অন্তরপারাবারে

    রক্তকমল তরঙ্গে টলোমলো॥

দ্বিধাভরে আজও প্রবেশ কর নি ঘরে,

    বাহির আঙনে করিলে সুরের খেলা।

জানি না কী নিয়ে যাবে যে দেশান্তরে,

    হে অতিথি, আজি শেষ বিদায়ের বেলা।

প্রথম প্রভাতে সব কাজ তব ফেলে

যে গভীর বাণী শুনিবারে কাছে এলে

কোনোখানে কিছু ইশারা কি তার পেলে,

    হে পথিক, বলো বলো-

সে বাণী আপন গোপন প্রদীপ জ্বেলে

    রক্ত আগুনে প্রাণে মোর জ্বলোজ্বলো॥

 

                  ৫১

এখনো কেন সময় নাহি হল, নাম-না-জানা অতিথি-

আঘাত হানিলে না দুয়ারে,  কহিলে না 'দ্বার খোলো'॥

    হাজার লোকের মাঝে  রয়েছি একেলা যে-

    এসো আমার হঠাৎ-আলো,  পরান চমকি তোলো॥

আঁধার বাধা আমার ঘরে, জানি না কাঁদি কাহার তরে।

    চরণসেবার সাধনা আনো, সকল দেবার বেদনা আনো-

নবীন প্রাণের জাগরমন্ত্র  কানে কানে বোলো॥

                 

                 ৫২

আজি    গোধুলিলগনে এই বাদলগগনে

    তার  চরণধ্বনি আমি হৃদয়ে গণি-

'সে আসিবে' আমার মন বলে সারাবেলা,

    অকরণ পুলকে আঁখি ভাসে জলে॥

অধীর পবনে তার উত্তরীয়  দূরের পরশন দিল কি ও-

রজনীগন্ধার পরিমলে  'সে আসিবে' আমার মন বলে।

উতলা হয়েছে মালতীর লতা, ফুরালো না তাহার মনের কথা।

    বনে বনে আজি একি কানাকানি,

    কিসের বারতা ওরা পেয়েছে না জানি,

    কাঁপন লাগে দিগঙ্গনার বুকের আঁচলে-

    'সে আসিবে' আমার মন বলে॥


                 ৫৩

আমি    চাহিতে এসেছি শুধু একখানি মালা

তব    নব প্রভাতের নবীন-শিশির ঢালা॥

হেরো,    শরমে-জড়িত কত-না গোলাপ কত-না গরবি করবী,

ওগো,    কত-না কুসুম ফুটেছে তোমার মালঞ্চ করি আলা॥

ওগো,    অমল শরত-শীতল-সমীর বহিছে তোমারি কেশে,

ওগো,    কিশোর-অরুণ-কিরণ তোমার অধরে পড়েছে এসে।

তব    অঞ্চল হতে বনপথে ফুল যেতেছে পড়িয়া এসে।

তব    অঞ্চল হতে বনপথে ফুল যেতেছে পড়িয়া ঝরিয়া-

ওগো,    অনেক কুন্দ অনেক শেফালি ভরেছে তোমার ডালা॥
 

               ৫৪

ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশের পাখি,

নয়নে দেখেছি তব নূতন আকাশ॥

দুখানি আঁখির পাতে কী রেখেছ ঢাকি,

হাসিলে ফুটিয়া পড়ে উষার আভাস॥

হৃদয় উড়িতে চাষ হোথায় একাকী-

আঁখিতারকার দেশে করিবারে বাস।

ওই গগনেতে চেয়ে উঠিয়াছে ডাকি-

কোথায় হারাতে চায় এ গীত-উচ্ছ্বাস॥
 

                ৫৫

কী রাগিণী বাজালে হৃদয়ে, মোহন, মনোমোহন,

    তাহা তুমি জান হে, তুমি জান॥

চাহিলে মুখপানে, কী গাহিলে নীরবে

    কিসে মোহিলে মন প্রাণ,

তাহা তুমি জান হে, তুমি জান॥

আমি শুনি দিবারজনী

    তারি ধ্বনি, তারি প্রতিধ্বনি।

তুমি কেমনে মরম পরশিলে মম,

    কোথা হতে প্রাণ কেড়ে আন,

তাহা তুমি জান হে, তুমি জান॥
 

                  ৫৬

ওগো    শোনো কে বাজায়।

বনফুলের মালার গন্ধ বাঁশির তানে মিশে যায়॥

    অধর ছুঁয়ে বাঁশিখানি  চুরি করে হাসিখানি-

    বঁধুর হাসি মধুর গানে প্রাণের পানে ভেসে যায়॥

কুঞ্জবনের ভ্রমর বুঝি বাঁশির মাঝে গুঞ্জরে,

বকুলগুলি আকুল হয়ে বাঁশির গানে মুঞ্জরে।

যমুনারই কলতান কানে আসে, কাঁদে প্রাণ-

    আকাশে ওই মধুর বিধু কাহার পানে হেসে চায়॥ 
 

                   ৫৭

বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে আমার প্রাণে,

মন যে কেমন করে মনে মনে তাহা মনই জানে॥

    তোমারে হৃদয়ে ক'রে আছি নিশিদিন ধ'রে,

    চেয়ে থাকি আঁখি ভ'রে মুখের পানে॥

বড়ো আশা, বড়ো তৃষা, বড়ো আকিঞ্চন তোমারি লাগি

বড়ো সুখে, বড়ো দুখে, বড়ো অনুরাগে রয়েছি জাগি।

এ জন্মের মতো আর হয়ে গেছে যা হবার,

ভেসে গেছে মন প্রাণ মরণ টানে॥
 

                   ৫৮

     আমার মন মানে না-দিনরজনী।

আমি    কী কথা স্মরিয়া এ তনু ভরিয়া পুলক রাখিতে নারি।

ওগো,    কী ভাবিয়া মনে এ দুটি নয়নে উথলে নয়নবারি-

        ওগো সজনি॥

    সে সুধাবচন, সে সুখপরশ, অঙ্গে বাজিছে বাঁশি।

তাই    শুনিয়া শুনিয়া আপনার মনে হৃদয় হয় উদাসী-

        কেন না জানি॥

ওগো,    বাতাসে কী কথা ভেসে চলে আসে, আকাশে কী মুখ জাগে।

ওগো,    বনমর্মরে নদীনির্ঝরে কী মধুর সুর লাগে।

    ফুলের গন্ধ বন্ধুর মতো জড়ায়ে ধরিছে গলে-

আমি    এ কথা, এ ব্যথা, সুখব্যাকুলতা কাহার চরণতলে

            দিব নিছনি॥ 


                  ৫৯

মরি লো মরি,    আমায়   বাঁশিতে ডেকেছে কে॥

    ভেবেছিলেম ঘরে রব, কোথাও যাব না-

ওই-যে    বাহিরে বাজিল বাঁশি, বলো কী করি।

    শুনেছি কোন্‌ কুঞ্চবনে যমুনাতীরে

সাঁঝের বেলায় বাজে বাঁশি ধীরে সমীরে-

ওগো, তোরা জানিস যদি   আমায়   পথ বলে দে॥

    দেখি গে তার মুখের হাসি,

তারে  ফুলের মালা পরিয়ে আসি,

তারে  বলে আসি 'তোমার বাঁশি

    আমার    প্রাণে বেজেছে'॥


                     ৬০

এবার    উজাড় করে লও হে আমার যা-কিছু সম্বল।

    ফিরে চাও, ফিরে চাও,  ফিরে চাও ওগো চঞ্চল॥

চৈত্ররাতের বেলায় নাহয় এক প্রহরের খেলায়

    আমার   স্বপনস্বরূপিণী প্রাণে দাও পেতে অঞ্চল॥

    যদি এই ছিল গো মনে,

যদি পরম দিনের স্মরণ ঘুচাও চরম অযতনে,

তবে ভাঙা খেলার ঘরে নাহয় দাঁড়াও ক্ষণেক-তরে-

সেথা    ধুলায় ধুলায় ছড়াও হেলায় ছিন্ন ফুলের দল॥
 

                   ৬১

সখী,    প্রতিদিন হায় এসে ফিরে যায় কে।

তারে    আমার মাথার একটি কুসুম দে॥

যদি    শুধায় কে দিল কোন্‌ ফুলকাননে,

মোর    শপথ, আমার নামটি বলিস নে॥

সখী,    সে আসি ধুলায় বসে যে তরুর তলে

সেখা    আসন বিছায়ে রাখিস বকুলদলে।

সে যে    করুণা জাগায় সকরুণ নয়নে-

যেন    কী বলিতে চায়, না বলিয়া যায় সে॥
 

                 ৬২

তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম

নিবিড় নিভৃত পূর্ণমানিশীথিনী-সম॥

    মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন

তুমি    ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম॥

জাগিবে একাকী  তব করুণ আঁখি,

তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।

    মম দুঃখবেদন মম  সফল স্বপন

তুমি    ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম॥
 

                 ৬৩

তোমার গোপন কথাটি; সখী    রেখো না মনে।

শুধু আমায়,    বোলো    আমায় গোপনে॥

ওগো    ধীরমধুরহাসিনী,    বোলো ধীরমধুর ভাষে-

আমি    কানে না শুনিব গো, শুনিব প্রাণের শ্রবণে॥

যবে     গভীর যামিনী, যবে    নীরব মেদিনী,

যবে    সুপ্তিমগন বিহগনীড়    কুসুমকাননে,

বোলো    অশ্রুজড়িত কণ্ঠে, বোলো কম্পিত স্মিত হাসে-

বোলো    মধুরবেদনবিধুর হৃদয়ে    শরমনমিত নয়নে॥

 

                ৬৪

      এসো আমার ঘরে।

বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে॥

স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে

    মুগ্ধ এ চোখে।

ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে   এসো আমার ঘরে॥

    দুঃখসুখের দোলে এসো, প্রাণের হিল্লোলে এসো।

    ছিলে আশার অরূপ বাণী ফাল্গুনবাতাসে

    বনের  আকুল নিশ্বাসে-

এবার ফুলের প্রফুল্ল রূপ এসো বুকের 'পরে॥


               ৬৫

ঘুমের ঘন গহন হতে যেমন আসে স্বপ্ন

    তেমনি উঠে এসো এসো।

শমীশাখার বক্ষ হতে যেমন জ্বলে অগ্নি

    তেমনি তুমি এসো এসো॥

ঈশানকোণে কালো মেঘের নিষেধ বিদারি

    যেমন আসে সহসা বিদ্যুৎ

তেমনি তুমি চমক হানি এসো হৃদয়তলে-

    এসো তুমি, এসো তুমি, এসো এসো॥

আঁধার যবে পাঠায় ডাক মৌন ইশারায়

যেমন আসে কালপুরুষ সন্ধ্যাকাশে

    তেমনি তুমি এসো, তুমি এসো এসো।

সুদূর হিমগিরির শিখরে

মন্ত্র যবে প্রেরণ করে তাপস বৈশাখ

প্রখর তাপে কঠিন ঘন তুষার গলায়ে,

বন্যাধারা যেমন নেমে আসে,

তেমনি তুমি এসো, তুমি এসো এসো॥ 

                   

                   ৬৬

মম    রুদ্ধমুকুলদলে এসো সৌরভ-অমৃতে,

মম    অখ্যাততিমিরতলে এসো গৌরবনিশীথে॥

এই    মূল্যহারা মম শুক্তি,  এসো মুক্তাকণায় তুমি মুক্তি-

মম    মৌনী বীণার তারে এসো সঙ্গীতে॥

    নব অরুণের এসো আহ্বান,

     চিররজনীর হোক অবসান-এসো।

এসো    শুভস্মিত শুকতারায়, এসো   শিশির-অশ্রুধারায়

    সিন্দূর পরাও উষারে তব রশ্মিতে॥
 

                 ৬৭

এসো    এসো পুরুষোত্তম, এসো এসো বীর মম।

তোমার    পথ চেয়ে আছে প্রদীপ জ্বালা

আজি    পরিবে বীরাঙ্গনার হাতে দৃপ্ত ললাটে, সখা,

            বীরের বরণমালা

ছিন্ন ক'রে দিবে সে তার     শক্তির    অভিমান,

তোমার চরণে করিবে দান    আত্মনিবেদনের ডালা-

            চরণে করিবে দান।

আজ    পরাবে বীরাঙ্গনা তোমার  দৃপ্ত ললাটে, সখা,    

            বীরের বরণমালা


                     ৬৮

আমার    নিশীথরাতের বাদলধারা, এসো হে গোপনে

আমার    স্বপনলোকে দিশাহারা

ওগো    অন্ধকারের অন্তরধন, দাও ঢেকে মোর পরান মন-

আমি    চাই নে তপন, চাই নে তারা

যখন    সবাই মগন ঘুমের ঘোরে  নিয়ো গো নিয়ো গো,

আমার    ঘুম নিয়ো গো হরণ করে।

           একলা ঘরে চুপে চুপে এসো কেবল সুরের রূপে-

            দিয়ো গো, দিয়ো গো,

আমার    চোখের জলের দিয়ো সাড়া
 

                       ৬৯

একলা ব'সে হেরো তোমার ছবি   এঁকেছি আজ বসন্তী রঙ দিয়া।

খোঁপার ফুলে একটি মধুলোভী   মৌমাছি ওই গুঞ্জরে বন্দিয়া

সমুখ-পানে বালুতটের তলে  শীর্ণ নদী শ্রান্তধারায় চলে,

বেণুচ্ছায়া তোমার চেলাঞ্চলে উঠিছে স্পন্দিয়া

মগ্ন তোমার স্নিগ্ধ নয়ন দুটি  ছায়ায় ছন্ন অরণ্য-অঙ্গনে,

প্রজাপতির দল যেখানে জুটি  রঙ ছড়ালো প্রফুল্ল রঙ্গনে।

তপ্ত হাওয়ায় শিথিলমঞ্জরী গোলকচাঁপা একটি দুটি করি

পায়ের কাছে পড়ছে ঝরি ঝরি  তোমারে নন্দিয়া

ঘাটের ধারে কম্পিত ঝাউশাখে  দোয়েল দোলে সঙ্গীতে চঞ্চলি,

আকাশ ঢালে পাতার ফাঁকে ফাঁকে তোমার কোলে সুবর্ণ-অঞ্জলি।

বনের পথে কে যায় চলি দূরে-বাঁশির ব্যথা পিছন-ফেরা সুরে

তোমায় ঘিরে হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে  ফিরিছে ক্রন্দিয়া
 

                        ৭০

কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুমচয়নে।

সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে

দেখিতে দেখিতে নূতন আলোকে  কে দিল রচিয়া ধ্যানের পুলকে

নূতন ভূবন নূতন দ্যুলোকে মোদের মিলিত নয়নে

    বাহির-আকাশে মেঘ ঘিরে আসে, এল সব তারা ঢাকিতে।

    হারানো সে আলো আসন বিছালো শুধু দুজনের আঁখিতে।

ভাষাহারা মম বিজন রোদনা  প্রকাশের লাগি করেছে সাধনা,

    চিরজীবনেরই বাণীর বেদনা মিটিল দোঁহার নয়নে

 

                               ৭১

         দে পড়ে দে আমায় তোরা কী কথা আজ লিখেছে সে।

তার    দূরের বাণীর পরশমানিক লাগুক আমার প্রাণে এসে

শস্যখেতের গন্ধখানি একলা ঘরে দিক সে আনি,

ক্লান্তগমন পান্থহাওয়া লাগুক আমার মুক্ত কেশে

নীল আকাশের সুরটি নিয়ে বাজাক আমার বিজন মনে,

ধূসর পথের উদাস বরন মেলুক আমার বাতায়নে।

সূর্য ডোবার রাঙা বেলায় ছড়াব প্রাণ রঙের খেলায়,

আপন-মনে চোখের কোণে অশ্রু-আভাস উঠবে ভেসে

 

                       ৭২

রাতে রাতে আলোর শিখা রাখি জ্বেলে

    ঘরের কোণে আসন মেলে

বুঝি সময় হল এবার    আমার প্রদীপ নিবিয়ে দেবার-

    পূর্ণিমাচাঁদ, তুমি এলে

এত দিন সে ছিল তোমার পথের পাশে

    তোমার দরশনের আশে।

আজ তারে যেই পরশিবে যাক সে নিবে, যাক সে নিবে-

    যা আছে সব দিক সে ঢেলে

 

                  ৭৩

অনেক কথা বলেছিলেম কবে তোমার কানে কানে

কত নিশীথ-অন্ধকারে, কত গোপন গানে গানে

সে কি তোমার মনে আছে  তাই শুধাতে এলেম কাছে-

রাতের বুকের মাঝে তারা মিলিয়ে আছে সকল খানে

ঘুম ভেঙে তাই শুনি যবে দীপ-নেভা মোর বাতায়নে

স্বপ্নে-পাওয়া বাদল-হাওয়া ছুটে আসে ক্ষণে ক্ষণে-

বৃষ্টিধারার ঝরোঝরে ঝাউবাগানের মরোমরে

ভিজে মাটির গন্ধে হঠাৎ সেই কথা সব মনে আনে

 

                         ৭৪

জানি    তোমার অজানা নাহি গো    কী আছে আমার মনে।

আমি    গোপন করিতে চাহি গো, ধরা পড়ে দুনয়নে

            কী বলিতে পাছে কী বলি

        তাই  দূরে চলে যাই কেবলই,

            পথপাশে দিন বাহি গো-

তুমি    দেখে যাও আঁখিকোণে  কী আছে আমার মনে

চির    নিশীথতিমিরগহনে    আছে মোর পূজাবেদী-

       চকিত হাসির দহনে   সে তিমির দাও ভেদি।

       বিজন দিবস-রাতিয়া

কাটে ধেয়ানের মালা গাঁথিয়া,

        আনমনে গান গাহি গো-

তুমি    শুনে যাও খনে খনে  কী আছে আমার মনে

 

                         ৭৫

পুরানো জানিয়া চেয়ো না আমারে আধেক আঁখির কোণে অলস অন্যমনে।

আপনারে আমি দিতে আসি যেই  জেনো জেনো সেই শুভ নিমেষেই

    জীর্ণ কিছুই নেই কিছু নেই, ফেলে দিই পুরাতনে

    আপনারে দেয় ঝরনা আপন ত্যাগরসে উচ্ছলি-

    লহরে লহরে নূতন নূতন অর্ঘ্যের অঞ্জলি।

মাধবীকুঞ্জ বার বার করি    বনলক্ষ্মীর ডালা দেয় ভরি-

    বারবার তার দানমঞ্জরী নব নব ক্ষণে ক্ষণে

    তোমার প্রেমে যে লেগেছে আমায় চির নূতনের সুর।

    সব কাজে মোর সব ভাবনায় জাগে চিরসুমধুর।

মোর দানে নেই দীনতার লেশ, যত নেবে তুমি না পাবে শেষ-

    আমার দিনের সকল নিমেষ  ভরা অশেষের ধনে

 

                         ৭৬

আমার    যদি বেলা যায় গো বয়ে   জেনো জেনো

    আমার  মন রয়েছে তোমায় লয়ে

পথের ধারে আসন পাতি    তোমায় দেবার মালা গাঁথি-

    জেনো জেনো তাইতে আছি মগন হয়ে

    চলে গেল যাত্রী সবে

    নানান পথে কলরবে।

আমার চলা এমনি ক'রে আপন হাতে সাজি ভ'রে-

    জেনো জেনো আপন মনে গোপন রয়ে

 

                  ৭৭

চপল তব নবীন আঁখি দুটি

সহসা যত বাঁধন হতে আমারে দিল ছুটি

    হৃদয় মম আকাশে গেল খুলি,

সুদূরবনগন্ধ আসি করিল কোলাকুলি।

    ঘাসের ছোঁওয়া নিভৃত তরুছায়ে

চুপিচুপি কী করুণ কথা কহিল সারা গায়ে।

আমের বোল, ঝাউয়ের দোল, ঢেউয়ের লুটোপুটি-

বুকের কাছে সবাই এল জুটি

 

                  ৭৮

জয়যাত্রায় যাও গো, ওঠো জয়রথে তব।

মোরা জয়মালা গেঁথে আশা চেয়ে বসে রব

মোরা    আঁচল বিছায়ে রাখি পথধুলা দিব ঢাকি,

ফিরে এলে হে বিজয়ী,

তোমায় হৃদয়ে বলিয়া লব

আঁকিয়ো হাসির রেখা সজল আঁখির কোণে,

নব বসন্তশোভা এনো এ কুঞ্জবনে।

তোমার সোনার প্রদীপ জ্বালো

আঁধার ঘরের আলো,

পরাও রাতের ভালে চাঁদের তিলক নব

 

                ৭৯

বিজয়মালা এনো আমার লাগি।

দীর্ঘরাত্রি রইব আমি জাগি

চরণ যখন পড়বে তোমার মরণকূলে

বুকের মধ্যে উঠবে আমার পরান দুলে,

সব যদি যায় হব তোমার সর্বনাশের ভাগী

 

                 ৮০

         আন্‌মনা, আন্‌মনা

তোমার কাছে আমার বাণীর মাল্যখানি আনব না।

বার্তা আমার ব্যর্থ হবেসত্য আমার বুঝবে কবে,

    তোমারো মন জানব না, আন্‌মনা, আন্‌মনা

লগ্ন যদি হয় অনুকূল মৌনমধুর সাঁঝে,

নয়ন তোমার মগ্ন যখন ম্লান আলোর মাঝে,

    দেব তোমায় শান্ত সুরের সান্ত্বনা

ছন্দে গাঁথা বাণী তখন পড়ব তোমার কানে

    মন্দ মৃদুল তানে,

ঝিল্লি যেমন শালের বনে নিদ্রানীরব রাতে

অন্ধকারের জপের মালায় একটানা সুর গাঁথে,

    একলা তোমার বিজন প্রাণের প্রাঙ্গণে

    প্রান্তে বসে একমনে

এঁকে যাব আমার গানের আল্‌পনা,

আন্‌মনা, আন্‌মনা

 

            ৮১

ওলো সই, ওলো সই,

আমার     ইচ্ছা করে তোদের মতন মনের কথা কই।

ছড়িয়ে দিয়ে পা দুখানি কোণে বসে কানাকানি,

    কভু হেসে কভু কেঁদে চেয়ে বসে রই

         ওলো সই, ওলো সই,

তোদের আছে মনের কথা, আমার আছে কই।

আমি    কী বলিব, কার কথা, কোন্ সুখ, কোন্ ব্যথা-

    নাই কথা, তবু সাধ শত কথা কই

    ওলো সই, ওলো সই,

তোদের    এত কী বলিবার আছে ভেবে অবাক হই।

আমি    একা বসি সন্ধ্যা হলে  আপনি ভাসি নয়নজলে,

    কারণ কেহ শুধাইলে নীরব হয়ে রই

 

                   ৮২

হৃদয়ের এ কূল, ও কূল, দু কূল ভেসে যায়, হায় সজনি,

    উথলে নয়নবারি।

    যে দিকে চেয়ে দেখি ওগো সখী,

        কিছু আর চিনিতে না পারি

পরানে পড়িয়াছে টান,

    ভরা নদীতে আসে বান,

            আজিকে কী ঘোর তুফান  সজনি গো,

                    বাঁধ আর বাঁধিতে নারি

কেন এমন হল গো, আমার এই নবযৌবনে।

    সহসা কী বহিল কোথাকার কোন্ পবনে।

    হৃদয় আপনি উদাস, মরমে কিসের হুতাশ-

    জানি না কী বাসনা, কী বেদনা গো-

কেমনে আপনা নিবারি

 

                  ৮৩

না বলে যেয়ো না চলে মিনতি করি

গোপনে জীবন মন লইয়া হরি

সারা নিশি জেগে থাকি, ঘুমে ঢুলে পড়ে আঁখি-

ঘুমালে হারাই পাছে সে ভয়ে মরি

চকিতে চমকি, বঁধু, তোমায় খুঁজি-

থেকে থেকে মনে হয় স্বপন বুঝি।

নিশিদিন চাহে হিয়া  পরান পসারি দিয়া

অধীর চরণ তব বাঁধিয়া ধরি

 

                  ৮৪

আর    নাই রে বেলা, নামল ছায়া ধরণীতে।

এখন    চল্ রে ঘাটে কলসখানি ভরে নিতে

    জলধারার কলস্বরে   সন্ধ্যাগগন আকুল করে,

ওরে    ডাকে আমার পথের 'পরে সেই ধ্বনিতে

এখন বিজন পথে করে না কেউ আসা যাওয়া।

ওরেপ্রেমনদীতে উঠেছে ঢেউ, উতল হাওয়া।

    জানি নে আর ফিরব কিনা, কার সাথে আজ হবে চিনা-

ঘাটে    সেই অজানা বাজায় বীণা তরণীতে

 

                  ৮৫

বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা, নিয়ো হে নিয়ো।

হৃদয় বিদারি হয়ে গেল ঢালা, পিয়ো হে পিয়ো

ভরা সে পাত্র, তারে বুকে ক'রে   বেড়ানু বহিয়া সারা রাতি ধরে,

    লও তুলে লও আজি নিশিভোরে প্রিয় হে প্রিয়

    বাসনার রঙে লহরে লহরে রঙিন হল।

    করুণ তোমার অরুণ অধরে তোলে হে তোলো।

এ রসে মিশাক তব নিশ্বাস   নবীন উষার পুষ্পসুবাস-

    এরই 'পরে তব আঁখির আভাস দিয়ো হে দিয়ো।

 

                         ৮৬

আমি     চিনি গো চিনি    তোমারে    ওগো বিদেশিনী।

তুমি    থাক সিন্ধুপারে    ওগো বিদেশিনী

তোমায়    দেখেছি শারদপ্রাতে,    তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,

তোমায়     দেখেছি হৃদি-মাঝারে    ওগো বিদেশিনী।

আমি    আকাশে পাতিয়া কান    শুনেছি    শুনেছি তোমারি গান,

আমি    তোমারে সঁপেছি প্রাণ    ওগো বিদেশিনী।

         ভুবন ভ্রমিয়া শেষে       আমি    এসেছি নূতন দেশে,

আমি     অতিথি তোমারি দ্বারে    ওগো বিদেশিনী

 

                         ৮৭

যা ছিল কালো-ধলো    তোমার     রঙে রঙে রাঙা হল।

যেমন    রাঙাবরন তোমার চরণ    তার সনে আর ভেদ না র'

রাঙা হল বসন-ভূষণ,    রাঙা হল শয়ন-স্বপন-

মন    হল কেমন দেখ্ রে, যেমন    রাঙা কমল টলোমলো

 

                         ৮৮

আহা    তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার, ওগো প্রিয়-

বড়ো    উতলা আজ পরান আমার, খেলাতে হার মানবে কি ও

কেবল    তুমিই কি গো এমনি ভাবে  রাঙিয়ে মোরে পালিয়ে যাবে।

তুমি    সাধ ক'রে, নাথ, ধরা দিয়ে আমারও রঙ বক্ষে নিয়ো-

এই    হৃৎকমলের রাঙা রেণু রাঙাবে ওই উত্তরীয়

 

                       ৮৯

আমার    সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।

আমি    তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়

যে জন দেয় না দেখা, যায় যে দেখে-ভালোবাসে আড়াল থেকে-

আমার    মন মজেছে সেই গভীরের গোপন ভালোবাসায়

 

                      ৯০

আমি    রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব।

আমি    হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাব

    ভরাব না ভূষণভারে, সাজাব না ফুলের হারে-

    প্রেমকে আমার মালা ক'রে গলায় তোমার দোলাব

    জানবে না কেউ কোন্ তুফানে  তরঙ্গদল নাচবে প্রাণে,

    চাঁদের মতন অলখ টানে জোয়ারে ঢেউ তোলাব

 

                   ৯১

আমি    তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী।

আমি    সকল দাগে হব দাগি॥

তোমার    পথের কাঁটা করব চয়ন, যেথা তোমার ধুলার শয়ন

            সেথা আঁচল পাতব আমার-তোমার রাগে অনুরাগী

আমি        শুচি-আসন টেনে টেনে    বেড়াব না বিধান মেনে,

              যে পঙ্কে ওই চরণ পড়ে তাহারি ছাপ বক্ষে মাগি   

 

                        ৯২

আমার    নয়ন তোমার নয়নতলে মনের কথা খোঁজে,

সেথায়    কালো ছায়ার মায়ার ঘোরে পথ হারালো ও যে    

    নীরব দিঠে শুধায় যত    পায় না সাড়া মনের মতো,

    অবুঝ হয়ে রয় সে চেয়ে অশ্রুধারায় ম'জে   

তুমি    আমার কথার আভাখানি পেয়েছ কি মনে।

    এই-যে আমি মালা আনি, তার বাণী কেউ শোনে?

    পথ দিয়ে যাই যেতে যেতে   হাওয়ায় ব্যথা দিই যে পেতে-

    বাঁশি বিছায় বিষাদ-ছায়া তার ভাষা কেউ বোঝে   

 

                  ৯৩

ফুল তুলিতে ভুল করেছি প্রেমের সাধনে।

বঁধু, তোমায় বাঁধন কিসে মধুর বাঁধনে   

    ভোলাব না মায়ার ছলে, রইব তোমার চরণতলে,

মোহের ছায়া ফেলব না মোর হাসি-কাঁদনে   

রইল শুধু বেদন-ভরা আশা, রইল শুধু প্রাণের নীরব ভাষা।

নিরাভরণ যদি থাকি  চোখের কোণে চাইবে না কি-

যদি আঁখি নাই-বা ভোলাই রঙের ধাঁদনে   

 

               ৯৪

চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো।

ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো   

পাগল হাওয়া বুঝতে নারে  ডাক পড়েছে কোথায় তারে-

ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো   

নীল গগনের ললাটখানি চন্দনে আজ মাখা,

বাণীবনের হংসমিথুন মেলেছে আজ পাখা।

    পারিজাতের কেশর নিয়ে ধরায়, শশী ছড়াও কী এ।

ইন্দ্রপুরীর কোন্ রমনী বাসরপ্রদীপ জ্বালো   

 

                ৯৫

তুমি    একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে

         আমায়   শুধু ক্ষণেক-তরে।

আমি    হাতে আমার সাঙ্গ করব পরে   

    না চাহিলে তোমার মুখপানে

    হৃদয় আমার বিরাম নাহি জানে,

    কাজের মাঝে ঘুরে বেড়াই যত

        ফিরি কূলহারা সাগরে   

বসন্ত আজ উচ্ছ্বাসে নিশ্বাসে

    এল     আমার বাতায়নে।

অলস ভ্রমর গুঞ্জরিয়া আসে,

    ফেরে  কুঞ্জের প্রাঙ্গণে।

    আজকে শুধু একান্তে আসীন

চোখে চোখে চেয়ে থাকার দিন,

আজকে জীবন-সমর্পণের গান

    গাব নীরব অবসরে

 

                ৯৬

ওগো, তোমার চক্ষু দিয়ে মেলে সত্য দৃষ্টি

    আমার   সত্যরূপ প্রথম করেছ সৃষ্টি

তোমায় প্রণাম, তোমায় প্রণাম,

    তোমায় প্রণাম শতবার

    আমি     তরুণ অরুণলেখা,

    আমি    বিমল জ্যোতির রেখা,

    আমি    নবীন শ্যামল মেঘে

                প্রথম প্রসাদবৃষ্টি।

তোমায় প্রণাম, তোমায় প্রণাম,

    তোমায় প্রণাম শতবার

 

          ৯৭

       হে নবীনা,

প্রতিদিনের পথের ধুলায় যায় না চিনা

    শুনি বাণী ভাসে বসন্তবাতাসে,

প্রথম জাগরণে দেখি সোনার মেঘে লীনা

স্বপন দাও ধরা   কী কৌতুকে ভরা।

    কোন্ অলকার ফুলে মালা সাজাও চুলে,

কোন্ অজানা সুরে বিজনে বাজাও বীণা

৯৮।

ওগো    শান্ত পাষাণমুরতি সুন্দরী,

           চঞ্চলেরে হৃদয়তলে লও বরি

কুঞ্জবনে এসো একা নয়নে অশ্রু দিক্‌ দেখা-

অরুণ রাগে হোক রঞ্জিত বিকশিত বেদনার মঞ্জরী

 

                    ৯৯

তোমার পায়ের তলায় যেন গো রঙ লাগে-

আমার    মনের বনের ফুলের রাঙা রাগে

    যেন  আমার গানের তানে

        তোমায়   ভূষণ পরাই কানে,

যেন    রক্তমণির হার গেঁথে দিই প্রাণের অনুরাগে

 

                    ১০০

অনেক পাওয়ার মাঝে মাঝে কবে  কখন একটুখানি পাওয়া,

    সেইটুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া

দিনের পরে দিন চলে যায় যেন তারা পথের স্রোতেই ভাসা,

    বাহির হতেই তাদের যাওয়া আসা।

কখন আসে একটি সকাল সে যেন মোর ঘরেই বাঁধে বাসা,

    সে যেন মোর চিরদিনের চাওয়া

হারিয়ে-যাওয়া আলোর মাঝে কণা কুড়িয়ে পেলেম যারে

    রইল গাঁথা মোর জীবনের হারে।

সেই-যে আমার জোড়া-দেওয়া ছিন্ন দিনের খণ্ড আলোর মালা

    সেই নিয়ে আজ সাজাই আমার থালা-

এক পলকের পুলক যত, এক নিমেষের প্রদীপখানি জ্বালা,

    একতারাতে আধখানা গান গাওয়া