গীতবিতান

   প্রেম (১০১-২০০)


        

                   ১০১

দিনশেষের রাঙা মুকুল জাগল চিতে।

    সঙ্গোপনে ফুটবে প্রেমের মঞ্জরীতে

        মন্দবায়ে অন্ধকারে দুলবে তোমার পথের ধারে,

            গন্ধ তাহার লাগবে তোমার আগমনীতে-

                ফুটবে যখন মুকুল প্রেমের মঞ্জরীতে

রাত যেন না বৃথা কাটে প্রিয়তম হে-

    এসো এসো প্রাণে মম, গানে মম হে।

       এসো নিবিড় মিলনক্ষণে  রজনীগন্ধার কাননে,

            স্বপন হয়ে এসো আমার নিশীথিনীতে-

                ফুটবে যখন মুকুল প্রেমের মঞ্জরীতে

 

                      ১০২

আছ    আকাশ-পানে তুলে মাথা,

কোলে    আধেকখানি মালা গাঁথা

ফাল্গুনবেলায় বহে আনে   আলোর কথা ছায়ার কানে,

তোমার মনে তারি সনে    ভাবনা যত ফেরে যা-তা

    কাছে থেকে রইলে দূরে,

    কায়া মিলায় গানের সুরে।

হারিয়ে-যাওয়া হৃদয় তব     মূর্তি ধরে নব নব-

পিয়ালবনে উড়ালো চুল, বকুলবনে আঁচল পাতা

 

                     ১০৩

না, না, না,

    কোরো না ভাবনা-

যদি বা নিশি যায়    যাব না যাব না

যখনি চলে যাই    আসিব ব'লে যাই,

আলোছায়ার পথে   করি আনাগোনা

দোলাতে দোলে মন   মিলনে বিরহে।

বারে বারেই জানি     তুমি তো চির হে।

ক্ষণিক আড়ালে        বারেক দাঁড়ালে

মরি ভয়ে ভয়ে         পাব কি পাব না

 

                 ১০৪

চৈত্রপবনে মম চিত্তবনে    বাণীমঞ্জরী সঞ্চলিতা

        ওগো ললিতা।

যদি বিজনে দিন বহে যায়    খর তপনে ঝরে পড়ে হায়

        অনাদরে হবে ধূলিদলিতা

            ওগো ললিতা

 

                  ১০৫

নূপুর বেজে যায় রিনিরিনি।

       আমার মন কয়, চিনি চিনি

গন্ধ রেখে যায় মধুবায়ে   মাধবীবিতানের ছায়ে ছায়ে,

ধরণী শিহরায় পায়ে পায়ে,   কলসে কঙ্কণে কিনিকিনি

পারুল শুধাইল, কে তুমি গো,   অজানা কাননের মায়ামৃগ।

কামিনী ফুলকুল বরষিছে,  পবন এলোচুল পরশিছে,

আঁধারে তারাগুলি হরষিছে, ঝিল্লি ঝনকিছে ঝিনিঝিনি

 

                      ১০৬

আরো একটু বসো তুমি, আরো একটু বলো।

    পথিক, কেন অথির হেন-নয়ন ছলোছলো

আমার কী যে শুনতে এলে  তার কিছু কি আভাস পেলে-

    নীরব কথা বুকে আমার করে টলোমলো

        যখন থাক দূরে

আমার মনের গোপন বাণী বাজে গভীর সুরে।

কাছে এলে তোমার আঁখি  সকল কথা দেয় যে ঢাকি-

    সে যে মৌন প্রাণের রাতে তারা জ্বলোজ্বলো

 

                      ১০৭

বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে        এসেছি তোমারি এ দ্বারে,

পথিকেরে লহো ডাকি        তব মন্দিরের এক ধারে

বনপথ হতে, সুন্দরী,        এনেছি মল্লিকামঞ্জরী-

তুমি লবে নিজ বেণীবন্ধে     মনে রেখেছি এ দুরাশারে

কোনো কথা নাহি ব'লে     ধীরে ধীরে ফিরে যাব চলে।

ঝিল্লিঝঙ্কৃত নিশীথে      পথে যেতে বাঁশরিতে

শেষ গান পাঠাব তোমা-পানে শেষ উপহারে

 

                   ১০৮

      মেঘছায়ে সজল বায়ে মন আমার

উতলা করে সারাবেলা কার লুপ্ত হাসি, সুপ্ত বেদনা হায় রে

কোন্ বসন্তের নিশীথে যে বকুলমালাখানি পরালে

তার   দলগুলি গেছে ঝরে, শুধু গন্ধ ভাসে প্রাণে

জানি   ফিরিবে না আর ফিরিবে না, জানি তব পথ গেছে সুদূরে।

পারিলে না তবু পারিলে না চিরশূন্য করিতে ভূবন   মম-

তুমি   নিয়ে গেছ মোর বাঁশিখানি, দিয়ে গেছ তোমার গান

 

                      ১০৯

      গোধূলিলগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা।

     আমার যা কথা ছিল হয়ে গেল সারা

হয়তো সে তুমি শোন নাই, সহজে বিদায় দিলে তাই-

    আকাশ মুখর ছিল যে তখন, ঝরোঝরো বারিধারা

    চেয়েছিনু যবে মুখে তোলো নাই আঁখি,

    আঁধারে নীরব ব্যথা দিয়েছিল ঢাকি।

আর কি কখনো কবে  এমন সন্ধ্যা হবে-

    জনমের মতো হায় হয়ে গেল হারা

 

                    ১১০

আমার    প্রাণের মাঝে সুধা আছে, চাও কি-

           হায় বুঝি তার খবর পেলে না।

পারিজাতের মধুর গন্ধ পাও কি-

            হায় বুঝি তার নাগাল মেলে না

    প্রেমের বাদল নামল, তুমি জানো না হায় তাও কি।

    মেঘের ডাকে তোমার মনের ময়ূরকে নাচাও কি।

আমি    সেতারেতে তার বেঁধেছি, আমি  সুরলোকের সুর সেধেছি,

        তারি   তানে তানে মনে প্রাণে মিলিয়ে গলা গাও কি-

        হায় আসরেতে বুঝি এলে না।

        ডাক উঠেছে বারে বারে, তুমি সাড়া দাও কি!

আজ    ঝুলনদিনে দোলন লাগে, তোমার পরান হেলে না

 

                    ১১১

তোমার   মনের একটি কথা    আমায় বলো  বলো।

তোমার  নয়ন কেন এমন   ছলোছলো

    বনের 'পরে বৃষ্টি ঝরে ঝরোঝরো রবে।

সন্ধ্যা মুখরিত ঝিল্লিস্বরে  নীপকুঞ্জতলে।

শালের বীথিকায় বারি বহে যায় কলোকলো

    আজি দিগন্তসীমা

বৃষ্টি-আড়ালে হারালো নীলিমা  হারালো-

    ছায়া পড়ে তোমার মুখের 'পরে,

ছায়া ঘনায় তব মনে মনে  ক্ষণে ক্ষণে,

অশ্রুমন্থর বাতাসে বাতাসে তোমার হৃদয় টলোটলো

 

                     ১১২

উদাসিনী-বেশে বিদেশিনী কে সে নাইবা তাহারে জানি,

রঙে রঙে লিখা আঁখি মরীচিকা মনে মনে ছবিখানি

পুবের হাওয়ায় তরীখানি তার এই ভাঙা ঘাট কবে হল পার

    দূর নীলিমার বক্ষে তাহার উদ্ধত বেগ হানি

    মুগ্ধ আলসে গণি একা বসে পলাতকা যত ঢেউ।

    যারা চলে যায় ফেরে না তো হায় পিছু-পানে আর কেউ।

মনে জানি কারো নাগাল পাব না- তবু যদি মোর উদাসী ভাবনা

    কোনো বাসা পায় সেই দুরাশায় গাঁথি সাহানায় বাণী
 

১১৩

আমি   যাব না গো অমনি চলে। মালা তোমার দেব গলে

অনেক সুখে অনেক দুখে  তোমার বাণী নিলেম বুকে,

                       ফাগুনশেষে যাবার বেলা আমার বাণী যাব বলে

কিছু হল, অনেক বাকি।    ক্ষমা আমায় করবে না কি।

গান এসেছে সুর আসে নাই,    হল না যে শোনানো তাই—

                       সে সুর আমার রইল ঢাকা নয়নজলে

 

 

                 ১১৪

খোলো খোলো দ্বার,   রাখিয়ো না আর

    বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে।

দাও সাড়া দাও, এই দিকে চাও,

    এসো দুই বাহু বাড়ায়ে

কাজ হয়ে গেছে সারা,  উঠেছে সন্ধ্যাতারা।

আলোকের খেয়া   হয়ে গেল দে'য়া

    অন্তসাগর পারায়ে

ভরি লয়ে ঝারি এনেছ কি বারি,

    সেজেছ কি শুচি দুকূলে।

বেঁধেছ কি চুল, তুলেছ কি ফুল,

    গেথেছ কি মালা মুকুলে।

ধেনু এল গোঠে ফিরে, পাখিরা এসেছে নীড়ে,

পথ ছিল যত জুড়িয়া জগত

    আঁধারে গিয়েছে হারায়ে
 

             ১১৫

বাজিবে, সখী, বাঁশি বাজিবে-

    হৃদয়রাজ হৃদে রাজিবে

বচন রাশি রাশি  কোথা যে যাবে ভাসি,

    অধরে লাজহাসি সাজিবে

নয়নে আঁখিজল  করিবে ছলছল,

    সুখবেদনা মনে বাজিবে।

মরমে মুরছিয়া   মিলাতে চাবে হিয়া

   সেই চরণযুগরাজীবে
 

                 ১১৬

কে বলেছে তোমায়, বঁধু, এত দুঃখ সইতে।

আপনি কেন এলে, বঁধু, আমার বোঝা বইতে

    প্রাণের বন্ধু, বুকের বন্ধু,

        সুখের বন্ধু, দুখের বন্ধু-

তোমায়   দেব না দুখ, পাব না দুখ,

    হেরব তোমার প্রসন্ন মুখ,

আমি    সুখে দুঃখে পারব, বন্ধু, চিরানন্দে রইতে-

তোমার সঙ্গে বিনা কথায় মনের কথা কইতে

    সেই চরণযুগরাজীবে
 

          ১১৭

সে আমার গোপন কথা শুনে যা ও সখী!

ভেবে না পাই বলব কী

প্রাণ যে আমার বাঁশি শোনে নীল গগনে,

গান হয়ে যায় নিজের মনে যাহাই বকি

সে যেন আসবে আমার মন বলেছে,

হাসির 'পরে তাই তো চোখের জল গলেছে।

দেখ্ লো তাই দেয় ইশারা তারায় তারা,

চাঁদ হেসে ওই হল সারা তাহাই লখি


             ১১৮

এ কী সুধারস আনে

    আজি মম মনে প্রাণে

সে যে চিরদিবসেরই, নূতন তাহারে হেরি-

বাতাস সে মুখ ঘেরি মাতে গুঞ্জনগানে

পুরাতন বীণাখানি  ফিরে পেল হারা বাণী।

নীলাকাশে শ্যামধরা  পরশে তাহারি ভরা-

ধরা দিল অগোচরা নব নব সুরে তানে


              ১১৯

ও যে মানে না মানা।

আঁখি ফিরাইলে বলে, 'না, না, না।'

যত বলি 'নাই রাতি-মলিন হয়েছে বাতি'

    মুখপানে চেয়ে বলে, 'না, না, না'

    বিধুর বিকল হয়ে খেপা পবনে

ফাগুন করিছে হা-হা ফুলের বনে।

আমি যত বলি 'তবে  এবার যে যেতে হবে'

    দুয়ারে দাঁড়ায়ে বলে, 'না, না, না।'
 

               ১২০

মান অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে আয়-

    তারে এগিয়ে নিয়ে আয়

চোখের জলে মিশিয়ে হাসি ঢেলে দে তার পায়-

    ওরে, ঢেলে দে তার পায়

আসছে পথে ছায়া পড়ে, আকাশ এল আঁধার করে,

    শুষ্ক কুসুম পড়ছে ঝরে, সময় বহে যায়-   

    ওরে সময় বহে য়ায়
 

                ১২১

তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,

এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা

যেথা আমি যাই নাকো  তুমি প্রকাশিত থাকো,

    আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা

তব মুখ সদা মনে     জাগিতেছে সংগোপনে,

    তিলেক অন্তর হলো না হেরি কূল-কিনারা।

কখনো বিপথে যদি      ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি

    অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা
 

                ১২২

যদি    বারণ কর তবে গাহিব না।

যদি    শরম লাগে মুখে চাহিব না

    যদি  বিরলে মালা গাঁথা

        সহসা পায় বাধা

    তোমার ফুলবনে যাইব না

     যদি থমকি থেমে যাও পথমাঝে

আমি  চমকি চলে যাব আন কাজে।

   যদি তোমার নদীকূলে

        ভুলিয়া ঢেউ তুলে,

    আমার তরীখানি বাহিব না
 

                ১২৩

কেন    বাজাও কাঁকন কনকন কত ছলভরে।

ওগো,  ঘরে ফিরে চলো কনককলসে জল ভরে

কেন    জলে ঢেউ তুলি ছলকি ছলকি কর খেলা।

কেন    চাহ খনে খনে চকিত নয়নে কার তরে    কত    ছলভরে

হেরো    যমুনা-বেলায় আলসে হেলায় গেল বেলা,

কত    হাসিভরা ঢেউ করে কানাকানি কলস্বরে    কত    ছলভরে।

হেরো   নদীপরপারে গগনকিনারে মেঘমেলা,

তারা    হাসিয়া হাসিয়া চাহিছে তোমারি মুখ' পরে     কত    ছলভরে
 

                     ১২৪

কেন    যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হল মরি লাজে।

    শরমে জড়িত চরণে কেমনে চলিব পথের মাঝে

আলোকপরশে মরমে মরিয়া হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া,

    কোনোমতে আছে পরান ধরিয়া কামিনী শিথিল সাজে

নিবিয়া বাঁচিল নিশার প্রদীপ উষার বাতাস লাগি,

রজনীর শশী গগনের কোণে লুকায় শরণ লাগি,

পাখি ডাকি বলে 'গেল বিভাবরী', বধূ চলে জলে লইয়া গাগরি।

আমি এ আকুল কবরী আবরি কেমনে যাইব কাজে
 

                   ১২৫

নিশি না পোহাতে জীবনপ্রদীপ জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া,

    তোমার অনল দিয়া

কবে যাবে তুমি সমুখের পথে দীপ্ত শিখাটি বাহি

    আছি তাই পথ চাহি।

পুড়িবে বলিয়া রয়েছে আশায় আমার নীরব হিয়া

    আপন আঁধার নিয়া
 

                  ১২৬

অলকে কুসুম না দিয়ো,     শুধু  শিথিল কবরী বাঁধিয়ো।

কাজলবিহীন সজল নয়নে হৃদয়দুয়ারে ঘা দিয়ো

আকুল আঁচলে পথিকচরণে মরণের ফাঁদ ফাঁদিয়ো-

না করিয়া বাদ মনে যাহা সাধ, নিদয়া, নীরবে সাধিয়ো

এসো এসো বিনা ভূষণেই, দোষ নেই তাহে দোষ নেই।

যে আসে আসুক ওই তব রূপ অযতন-ছাঁদে ছাঁদিয়ো।

শুধু হাসিখানি আঁখিকোণে হানি উতলা হৃদয় ধাঁদিয়ো


                   ১২৭

নিশীথে কী কয়ে গেল মনে  কী জানি, কী জানি।

সে কি ঘুমে, সে কি জাগরণে  কী জানি, কী জানি

নানা কাজে নানা মতে  ফিরি ঘরে, ফিরি পথে-

সে কথা কি অগোচরে বাজে ক্ষণে ক্ষণে। কী জানি, কী জানি

সে কথা কি অকারণে ব্যথিছে হৃদয়, একি ভয়, একি জয়।

সে কথা কি কানে কানে বারে বারে কয়  'আর নয়' 'আর নয়'।

সে কথা কি নানা সুরে   বলে মোরে 'চলো দূরে'-

সে কি বাজে বুকে মম, বাজে কি গগনে। কী জানি, কী জানি


                     ১২৮

    মোর  স্বপন-তরীর কে তুই নেয়ে।

     লাগল পালে নেশার হাওয়া, পাগল পরান চলে গেয়ে

আমায়   ভুলিয়ে দিয়ে যা   তোর   দুলিয়ে দিয়ে না,

            তোর  সুদূর ঘাটে চল্‌ রে বেয়ে

আমার     ভাবনা তো সব মিছে,  আমার   সব পড়ে থাক্‌ পিছে।

তোমার    ঘোমটা খুলে দাও,     তোমার    নয়ন তুলে চাও,

                দাও   হাসিতে মোর পরান ছেয়ে
 

                  ১২৯

    ভালোবাসি, ভালোবাসি-

এই সুরে    কাছে দূরে    জলে স্থলে বাজায় বাঁশি

    আকাশে কার বুকের মাঝে  ব্যথা বাজে,

দিগন্তে কার কালো আঁখি    আঁখির জলে যায় গো ভাসি

    সেই সুরে সাগরকূলে   বাঁধন খুলে

        অতল রোদন উঠে দুলে।

    সেই সুরে বাজে মনে     অকারণে

ভুলে-যাওয়া গানের বাণী, ভোলা দিনের কাঁদন-হাসি
 

                   ১৩০

এবার মিলন-হাওয়ায়-হাওয়ায় হেলতে হবে।

    ধরা দেবার খেলা এবার খেলতে হবে

ওগো পথিক, পথের টানে  চলেছিলো মরণ-পানে,

    আঙিনাতে আসন এবার মেলতে হবে

মাধবিকার কুঁড়িগুলি আনো তুলে-মালতিকার মালা গাঁথো নবীন ফুলে।

    স্বপ্নস্রোতে ভিড়বি পারে, বাঁধবি দুজন দুইজনারে,

        সেই মায়াজাল হৃদয় ঘিরে ফেলতে হবে
 

                     ১৩১

তোমার রঙিন পাতায় লিখব প্রাণের কোন্ বারতা।

    রঙের তুলি পাব কোথা

সে রঙ তো নেই চোখের জলে,  আছে কেবল হৃদয়তলে,

    প্রকাশ করি কিসের ছলে  মনের কথা।

        কইতে গেলে রইবে কি তার সরলতা

বন্ধু, তুমি বুঝবে কি মোর সহজ বলা- নাই যে আমার ছলা-কলা।

    সুর যা ছিল বাহির ত্যেজে   অন্তরেতে উঠল বেজে

        একলা কেবল জানে সে যে  মোর দেবতা।  

           কেমন করে করব বাহির মনের কথা
 

                      ১৩২

আজ    সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে।

    ওগো আমার প্রিয়, তোমার রঙিন উত্তরীয়

        পরো পরো পরো তবে

মেঘ    রঙে রঙে বোনা,  আজ রবির রঙে সোনা,

আজ আলোর রঙ যে বাজল পাখির রবে

    আজ    রঙ-সাগরে তুফান ওঠে মেতে।

যখন     তারি হাওয়া লাগে    তখন    রঙের মাতন জাগে

            কাঁচা    সবুজ ধানের ক্ষেতে।

সেই    রাতের-স্বপন-ভাঙা  আমার হৃদয় হোক-না রাঙা

            তোমার রঙেরই গৌরবে
 

                      ১৩৩

এই বুঝি মোর ভোরের তারা এল সাঁঝের তারার বেশে।

অবাক-চোখে ওই চেয়ে রয় চিরদিনের হাসি হেসে

    সকল বেলা পাই নি দেখা,  পাড়ি দিল কখন একা,

        নামল আলোক-সাগর-পারে অন্ধকারের ঘাটে এসে

সকাল বেলা আমার হৃদয় ভরিয়েছিল পথের গানে,

সন্ধ্যাবেলা বাজায় বীণা কোন্ সুরে যে কেই বা জানে।

    পরিচয়ের রসের ধারা কিছুতে আর হয় না হারা,

        বারে বারে নতুন করে চিত্ত আমার ভুলাবে সে


                 ১৩৪
আমার    দোসর যে জন ওগো তারে    কে জানে।

    একতারা তার দেয় কি সাড়া আমার গানে  কে জানে

আমার  নদীর যে ঢেউ  ওগো  জানে কি কেউ

    যায় বহে যায় কাহার পানে। কে জানে

        যখন    বকুল ঝ'রে

    আমার     কাননতল যায় গো ভ'রে

তখন কে আসে-যায়   সেই    বনছায়ায়,

        কে সাজি তার ভরে আনে। কে জানে
 

                    ১৩৫

আমার লতার প্রথম মুকুল চেয়ে আছে মোর পানে,

    শুধায় আমারে 'এসেছি এ কোন্‌খানে'

        এসেছ আমার জীবনলীলার রঙ্গে,

            এসেছ আমার তরল ভাবের ভঙ্গে,

        এসেছ আমার স্বরতরঙ্গ-গানে

আমার লতার প্রথম মুকুল প্রভাত-আলোক-মাঝে

        শুধায় আমারে 'এসেছি এ কোন্‌ কাজে'।

    টুটিতে গ্রন্থি কাজের জটিল বন্ধে,

        বিবশ চিত্ত ভরিতে অলস গন্ধে,

            বাজাতে বাঁশরি প্রেমাতুর দুনয়ানে


                ১৩৬

    দুঃখ দিয়ে মেটাব দুঃখ তোমার,

স্নান করাব অতল জলে বিপুল বেদনার

মোর সংসার দিব যে জ্বালি,    শোধন হবে এ মোহের কালি,

    মরণব্যথা দিব তোমার চরণে উপহার
 

             ১৩৭

একদিন চিনে নেবে তারে,

    তারে  চিনে নেবে

অনাদরে যে রয়েছে কুণ্ঠিতা

সরে যাবে নবারুণ-আলোকে  এই কালো অবগুণ্ঠন-

ঢেকে রবে না রবে না মায়াকুহেলীর  মলিন আবরণ

                    তারে  চিনে নেবে

আজ গাঁথুক মালা সে গাঁথুক মালা,

        তার  দুখরজনীর অশ্রুমালা।

    কখন দুয়ারে অতিথি আসিবে,

    লবে তুলি মালাখানি ললাটে।

আজি জ্বালুক প্রদীপ চির-অপরিচিতা

    পূর্ণপ্রকাশের লগন-লাগি-

        তারে  চিনে নেবে
 

                  ১৩৮

মম    যৌবননিকুঞ্জে গাহে পাখি-

    সখি, জাগ' জাগ'

    মেলি রাগ-অলস আঁখি-

অনু    রাগ-অলস আঁখি সখি, জাগ' জাগ'

        আজি চঞ্চল এ নিশীথে

        জাগ'    ফাল্গুনগুণগীতে

        অয়ি    প্রথমপ্রণয়ভীতে,

        মম  নন্দন-অটবীতে

পিক মুহু মুহু উঠে ডাকি-সখি, জাগ' জাগ

    জাগ' নবীন গৌরবে,

    নব    বকুলসৌরভে,

    মৃদু  মলয়বীজনে

    জাগ' নিভৃত নির্জনে।

    আজি আকুল ফুলসাজে

    জাগ'  মৃদুকম্পিত লাজে,

    মম  হৃদয়শয়নমাঝে,

    শুন মধুর মুরলী বাজে

মম    অন্তরে থাকি থাকি-সখি, জাগ' জাগ'  


                    ১৩৯

      আহা,    জাগি পোহালো বিভাবরী।

                ক্লান্ত নয়ন তব সুন্দরী

ম্লান প্রদীপ উষানিলচঞ্চল, পাণ্ডুর শশধর গত-অস্তাচল,

মুছ আঁখিজল, চল' সখি চল' অঙ্গে নীলাঞ্চল সম্বরি

শরতপ্রভাত নিরাময় নির্মল, শান্ত সমীরে কোমল পরিমল,

নির্জন বনতল শিশিরসুশীতল, পুলকাকুল তরুবল্লরী।

বিরহশয়নে ফেলি মলিন মালিকা  এস নবভুবনে এস গো বালিকা,

গাঁথি লহ অঞ্চলে নব শেফালিকা  অলকে নবীন ফুলমঞ্জরী
 

                 ১৪০

       সে আসে ধীরে,

      যায় লাজে ফিরে।

রিনিকি রিনিকি রিনিঝিনি মঞ্জু মঞ্জু মঞ্জীরে

        রিনিঝিনি-ঝিন্নীরে

বিকচ নীপকুঞ্জে    নিবিড়তিমিরপুঞ্জে

কুন্তলফুলগন্ধ  আসে অন্তরমন্দিরে

        উন্মাদ সমীরে

শঙ্কিত চিত কম্পিত অতি, অঞ্চল উড়ে চঞ্চল।

পুষ্পিত তৃণবীথি, ঝঙ্কৃত বনগীতি-

কোমলপদপল্লবতলচুম্বিত ধরণীরে

         নিকুঞ্জকুটীরে
 

                   ১৪১

    পুষ্পবনে পুষ্প নাহি, আছে অন্তরে।

    পরানে বসন্ত এল কার মন্তরে

মুঞ্জরিল শুষ্ক শাখী,  কুহরিল মৌন পাখি,

    বহিল আনন্দধারা মরুপ্রান্তরে

দুখেরে করি না ডর, বিরহে বেঁধেছি ঘর,

    মনোকুঞ্জে মধুকর তবু গুঞ্জরে।

হৃদয়ে সুখের বাসা, মরমে অমর আশা,

    চিরবন্দী ভালোবাসা প্রাণপিঞ্জরে


                      ১৪২

আমার    পরান যাহা চায় তুমি    তাই, তুমি তাই গো।

তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো

তুমি    সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও-

আমি    তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে, আর কিছু নাহি চাই গো

আমি    তোমার বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস

         দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী,    দীর্ঘ বরষ-মাস।

যদি    আর-কারে ভালোবাস,    যদি আর ফিরে নাহি আস,

তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো
 

                  ১৪৩

আমি    নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি,

       তুমি    অবসরমত বাসিয়ো।

            আমি  নিশিদিন হেথায় বসে আছি,

তোমার যখন মনে পড়ে আসিয়ো

       আমি  সারানিশি তোমা-লাগিয়া

            রব  বিরহশয়নে জাগিয়া-

তুমি    নিমেষের তরে প্রভাতে

        এসে  মুখপানে চেয়ে হাসিয়ো

তুমি  চিরদিন মধুপবনে

    চির-বিকশিত বনভবনে

যেয়ো  মনোমত পথ ধরিয়া

    তুমি নিজ সুখস্রোতে ভাসিয়ো।

        যদি   তার মাঝে পড়ি আসিয়া

তবে    আমিও চলিব ভাসিয়া,

        যদি  দূরে পড়ি তাহে ক্ষতি কী-

        মোর স্মৃতি মন হতে নাশিয়ো
 

                      ১৪৪

সখী,      ওই বুঝি বাঁশি বাজে    বনমাঝে কি মনোমাঝে

                বসন্তবায়    বহিছে কোথায়,

                    কোথায় ফুটেছে ফুল,

            বলো গো সজনি, এ সুখরজনী

কোন্‌খানে উদিয়াছে- বনমাঝে কি মনোমাঝে

    যাব কি যাব না   মিছে এ ভাবনা,

        মিছে মরি লোকলাজে।

কে জানে কোথা সে  বিরহহুতাশে

        ফিরে অভিসারসাজে-

            বনমাঝে কি মনোমাঝে
 

                      ১৪৫

ওরে,     কী শুনেছিস ঘুমের ঘোরে, তোর  নয়ন এল জলে ভরে

            এত দিনে তোমায় বুঝি  আঁধার ঘরে পেল খুঁজি-

            পথের বঁধু দুয়ার ভেঙে পথের পথিক করবে তোরে

তোর       দুখের শিখায় জ্বাল্ রে প্রদীপ জ্বাল রে।

তোর       সকল দিয়ে ভরিস পূজার থাল রে।

যেন        জীবন মরণ একটি ধারায়   তার চরণে আপনা হারায়,

              সেই পরশে মোহের বাঁধন রূপ যেন পায় প্রেমের ডোরে
 

                       ১৪৬

কার       চোখের চাওয়ার হাওয়ায় দোলায় মন,

তাই       কেমন হয়ে আছিস সারাক্ষণ

                হাসি যে তাই অশ্রুভারে নোওয়া,

                ভাবনা যে তাই মৌন দিয়ে ছোঁওয়া,

                    ভাষায় যে তোর সুরের আবরণ

তোর      পরানে কোন্ পরশমণির খেলা,

তাই       হৃদ্‌গগনে সোনার মেঘের মেলা।

                দিনের স্রোতে তাই তো পলকগুলি

                ঢেউ খেলে যায় সোনার ঝলক তুলি,

                    কালোয় আলোয় কাঁপে আঁখির কোণ


                    ১৪৭

অনেক কথা যাও যে ব'লে কোনো কথা না বলি।

তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি

যে আছে মম গভীর প্রাণে  ভেদিবে তারে হাসির বাণে,

    চকিতে চাহ মুখের পানে তুমি যে কুতুহলী।

    তোমারে তাই এড়াতে চাই, ফিরিয়া যাই চলি

আমার চোখে যে চাওয়াখানি ধোওয়া সে আঁখিলোরে-

তোমারে আমি দেখিতে পাই, তুমি না পাও মোরে।

তোমার মনে কুয়াশা আছে,  আপনি ঢাকা আপন-কাছে-

    নিজের অগোচরেই পাছে আমারে যাও ছলি

    তোমারে তাই এড়াতে চাই, ফিরিয়া যাই চলি


                  ১৪৮

না বলে যায় পাছে সে  আঁখি মোর ঘুম না জানে।

কাছে তার রই, তবুও ব্যথা যে রয় পরানে

    যে পথিক পথের ভুলে এল মোর প্রাণের কূলে

পাছে তার ভুল ভেঙে যায়, চলে যায় কোন্‌ উজানে

    এল যেই এল আমার আগল টুটে,

    খোলা দ্বার দিয়ে আবার যাবে ছুটে।

খেয়ালের হাওয়া লেগে  যে খ্যাপা ওঠে জেগে

    সে কি আর সেই অবেলায় মিনতির বাধা মানে


                     ১৪৯

     তবে    শেষ করে দাও শেষ গান, তার পরে যাই চলে।

তুমি ভুলে যেয়ো এ রজনী, আজ রজনী ভোর হলে

    বাহুডোরে বাঁধি কারে, স্বপ্ন কভু বাঁধা পড়ে?

    বক্ষে শুধু বাজে ব্যথা, আঁখি ভাসে জলে
 

                 ১৫০

সখী    আমারি দুয়ারে কেন আসিল

        নিশিডোরে যোগী ভিখারি।

  কেন    করুণস্বরে বীণা বাজিল

আমি      আসি যাই যতবার  চোখে পড়ে মুখ তার,

         তারে ডাকিব কি ফিরাইব তাই ভাবি লো

শ্রাবণে আঁধার দিশি   শরতে বিমল নিশি,

বসন্তে দখিন বায়ু, বিকশিত উপবন-

কত ভাবে কত গীতি   গাহিতেছে নিতি নিতি

    মন নাহি লাগে কাজে, আঁখিজলে ভাসি লো
 

                 ১৫১

    তবু    মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।

যদি        পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।

            যদি থাকি কাছাকাছি,

দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি-

                তবু     মনে রেখো

যদি           জল আসে আঁখিপাতে,

এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,

এক দিন যদি বাধা পড়ে কাজে শারদ প্রাতে-

                    তবু মনে রেখো

            যদি    পড়িয়া মনে

ছলোছলো জল নাই দেখা দেয় নয়নকোণে-

                    তবু মনে রেখো
 

             ১৫২

     তুমি    যেয়ো না এখনি।

    এখনো আছে রজনী

    পথ বিজন  তিমিরসঘন,

কানন মণ্টকতরুগহন-আঁধারা ধরণী

বড়ো সাধে জ্বালিনু দীপ, গাঁথিনু মালা-

চিরদিনে, বঁধু, পাইনু হে তব দরশন।

  আজি যাব অকূলের পারে,

ভাসাব প্রেমপারাবারে  জীবনতরণী
 

                 ১৫৩

আকুল কেশে আসে, চায় ম্লাননয়নে, কে গো চিরবিরহিণী-

    নিশিভোর আঁখি জড়িত ঘুমঘোরে,

        বিজন ভবনে  কুসুমসুরভি মৃদু পবনে,

     সুখশয়নে, মম প্রভাতস্বপনে

        শিহরি চমকি জাগি  তারি লাগি।

        চকিতে মিলায় ছায়াপ্রায়, শুধু রেখে যায়

             ব্যাকুল বাসনা কুসুমকানন।
 

                    ১৫৪

        কে দিল আবার আঘাত আমার দুয়ারে।

এ নিশীথকালে কে আসি দাঁড়ালে, খুঁজিতে আসিলে কাহারে

বহুকাল হল বসন্তদিন এসেছিল এক অতিথি নবীন,

    আকুল জীবন করিল মগন  আকূল পুলকপাথারে

আজি এ বরষা নিবিড়তিমির, ঝরোঝরো জল, জীর্ণ কুটীর-

        বাদলের বায়ে প্রদীপ নিবায়ে জেগে বসে আছি একা রে।

অতিথী অজানা, তব গীতসুর  গাগিতেছে কানে ভীষণমধুর-

        ভাবিতেছি মনে যাব তব সনে   অচেনা অসীম আঁধারে
 

                  ১৫৫

না না) নাই বা এলে যদি সময় নাই,

ক্ষণেক এসে বোলো না গো 'যাই যাই যাই'

    আমার প্রাণে আছে জানি     সীমাবিহীন গভীর বাণী,

তোমায়    চিরদিনের কথাখানি বলব-

    যখন    দখিনহাওয়া কানন ঘিরে

                  এক কথা কয় ফিরে ফিরে,

     পূর্ণমাচাঁদ কারে চেয়ে   এক তানে দেয় আকাশ ছেয়ে,

যেন      সময়হারা সেই সময়ে একটি সে গান গাই
 

                   ১৫৬

জয় ক'রে তবু ভয় কেন তোর   যায় না,

    হায় ভীরু প্রেম,   হায় রে।

আশার আলোয় তবুও ভরসা পায় না,

    মুখে হাসি তবু চোখে জল না শুকায় রে

        বিরহের দাহ আজি হল যদি সারা,

        ঝরিল মিলনরসের শ্রাবণধারা,

        তবুও এমন গোপন বেদনতাপে

            অকারণ দুখে পরান কেন দুখায় রে

যদিবা ভেঙেছে ক্ষণিক মোহের ভুল,

    এখনো প্রাণে কি যাবে না মানের মূল।

        যাহা খুঁজিবার সাঙ্গ হল তো খোঁজা,

        যাহা বুঝিবার শেষ হয়ে গেল বোঝা,

        তবু কেন হেন সংশয়ঘনছায়ে

            মনের কথাটি নীরব মনে লুকায় রে
 

                   ১৫৭

কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে-

    নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে

        তোমার অভিসারে    যাব অগম-পারে

            চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে

পরানে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা-

    দুখের মাধুরীতে করিল দিশাহারা।

        সকলই নিবে কেড়ে, দিবে না তবু ছেড়ে-

            মন সরে না যেতে, ফেলিলে একি দায়ে
 

                  ১৫৮

আমার    মনের কোণের বাইরে

    জানলা খুলে ক্ষণে ক্ষণে চাই রে

    কোন্   অনেক দূরে    উদাস সুরে

        আভাস যে কার পাই রে-

            আছে-আছে নাই রে

আমার   দুই হল হারা,

কোন্ গগনে খোঁজে কোন্ সন্ধ্যাতারা।

        কার   ছায়া আমায়   ছুঁয়ে যে যায়,

          কাঁপে হৃদয় তাই রে-

            গুন্‌গুনিয়ে গাই রে
 

                 ১৫৯

মুখপানে চেয়ে দেখি, ভয় হয় মনে-

ফিরেছ কি ফের নাই বুঝিব কেমনে

    আসন দিয়েছি পাতি,   মালিকা রেখেছি গাঁথি,

        বিফল হল কি তাহা ভাবি খনে খনে

গোধুলিলগনে পাখি ফিরে আসে নীড়ে,

ধানে ভরা তরীখানি ঘাটে এসে ভিড়ে

    আজো কি খোঁজার শেষে   ফের নি আপন দেশে।

            বিরামবিহীন তৃষা জ্বলে কি নয়নে
 

                    ১৬০

স্বপনে দোঁহে ছিনু কী মোহে, জাগার বেলা হল-

    যাবার আগে শেষ কথাটি বোলো

        ফিরিয়া চেয়ে এমন কিছু দিয়ো

        বেদনা হবে পরমরমণীয়-

        আমার মনে রহিবে নিরবধি

    বিদায়খনে খনেক-তরে যদি সজল আঁখি তোলো

নিমেষহারা এ শুকতারা এমনি উষাকালে

     উঠিবে দূরে বিরহাকাশভালে।

        রজনীশেষে এই-যে শেষ কাঁদা

        বীণার তারে পড়িল তাহা বাঁধা,

        হারানো মণি স্বপনে গাঁথা রবে-

    হে বিরহিণী, আপন হাতে তবে   বিদায়দ্বার খোলো
 

                 ১৬১

মিলনরাতি পোহালো, বাতি নেভার বেলা এল-

    ফুলের পালা ফুরালে ডালা উজাড় করে ফেলো

        স্মৃতির ছবি মিলাবে যবে   ব্যথার তাপ কিছু তো রবে,

            তা নিয়ে মনে বিজন খনে বিরহদীপ জ্বেলো

ফাল্গুনের মাধবীলীলা কুঞ্জ ছিল ঘিরে,

    চৈত্রবনে বেদনা তারি মর্মরিয়া ফিরে।

        হয়েছে শেষ, তবুও বাকি   কিছু তো গান গিয়েছি রাখি-

            সেটুকু নিয়ে গুন্‌গুনিয়ে সুরের খেলা খেলো
 

            ১৬২

হে ক্ষণিকের অতিথি,

    এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া

        ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া

কোন্‌ অমরার বিরহিণীরে   চাহ নি ফিরে,

    কার বিষাদের শিশিরনীরে  এলে নাহিয়া

        ওগো অকরুণ, কী মায়া জানো,

            মিলনছলে বিরহ আনো।

চলেছ পথিক আলোকযানে  আঁধার-পানে

    মনভুলানো মোহনতানে  গান গাহিয়া

                    ১৬৩

হায় অতিথি, এখনি কি হল তোমার যাবার বেলা।

দেখো আমার হৃদয়তলে সারা রাতের আসন মেলা

        এসেছিলে দ্বিধাভরে

            কিছু বুঝি চাবার তরে,

    নীরব চোখে সন্ধ্যালোকে খেয়াল নিয়ে করলে খেলা

জানালে না গানের ভাষায় এনেছিলে যে প্রত্যাশা।

শাখার আগায় বসল পাখি, ভুলে গেল বাঁধতে বাসা।

        দেখা হল, হয় নি চেনা-

            প্রশ্ন ছিল, শুধালে না-

আপন মনের আকাঙ্ক্ষারে আপনি কেন করলে হেলা
 

                  ১৬৪

মুখখানি কর মলিন বিধুর যাবার বেলা-

জানি আমি জানি, সে তব মধুর ছলের খেলা

    গোপন চিহ্ন এঁকে যাবে তব রথে-

    জানি তুমি তারে ভুলিবে না কোনোমতে

    যার সাথে তব হল এক দিন মিলনমেলা

জানি আমি যবে আঁখিজল ভরে রসের স্নানে

মিলনের বীজ অঙ্কুর ধরে নবীন প্রাণে।

    খনে খনে এই চিরবিরহের ভান,

    খনে খনে এই ভয়রোমাঞ্চদান-

তোমার প্রণয়ে সত্য সোহাগে মিথ্যা হেলা
 

                    ১৬৫

     ওকে    বাঁধিবি কে রে,   হবে যে ছেড়ে দিতে।

                ওর  পথ খোলে রে  বিদায়রজনীতে

গগনে তার মেঘদুয়ার ঝেঁপে  বুকেরই ধন বুকেতে ছিল চেপে,

        প্রভাতবায়ে গেল সে দ্বার কেঁপে-

            এল যে ডাক ভোরের রাগিণীতে

        শীতল হোক বিমল হোক প্রাণ,

            হৃদয়ে শোক রাখুক তার দান।

যা ছিল ঘিরে শূন্যে সে মিলালো, সে ফাঁক দিয়ে আসুক তবে আলো-

            বিজনে বসি পূজাঞ্জলি ঢালো

                শিশিরে-ভরা সেঁউতি-ঝরা গীতে
 

                      ১৬৬

সকালবেলার আলোয় বাজে বিদায়ব্যথার ভৈরবী-

    আন্‌ বাঁশি তোর, আয় কবি

শিশিরশিহর শরতপ্রাতে   শিউলিফুলের গন্ধসাথে

    গান রেখে যাস আকুল হাওয়ায়, নাই যদি রোস নাই র'বি

        এমন উষা আসবে আবার সোনার রঙিন দিগন্তে,

            কুন্দের দুল সীমন্তে।

কপোতকূজনকরুণ ছায়ায়  শ্যামল কোমল মধুর মায়ায়

            তোমার গানের-নূপুরমুখর

                জাগবে আবার এই ছবি 
 

                   ১৬৭

      শেষ বেলাকার শেষের গানে

            ভোরের বেলার বেদন আনে

তরুণ মুখের করুণ হাসি   গোধূলি-আলোয় উঠেছে ভাসি,

            প্রথম ব্যথার প্রথম বাঁশি

    বাজে দিগন্তে কী সন্ধানে   শেষের গানে

    আজি দিনান্তে মেঘের মায়া

        সে আঁখিপাতার ফেলেছে ছায়া

    খেলায় খেলায় যে কথাখানি

       চোখে চোখে যেত বিজলি হানি

            সেই প্রভাতের নবীন বাণী

    চলেছে রাতের স্বপন-পানে  শেষের গানে
 

                   ১৬৮

কাঁদার সময় অল্প ওরে, ভোলার সময় বড়ো।

যাবার দিনে শুকনো বকুল মিথ্যে করিস জড়ো

        আগমনীর নাচের তালে  নতুন মুকুল নামল ডালে,

        নিঠুর হাওয়ায় পুরানো ফুল ওই-যে পড়ো-পড়ো

ছিন্নবাঁধন পান্থরা যায় ছায়ার পানে চলে,

কান্না তাদের রইল পড়ে শীর্ণ তৃণের কোলে।

            জীর্ণ পাতা উড়িয়ে ফেলা খেল্‌, কবি, সেই শিশুর খেলা-

            নতুন গানে কাঁচা সুরের প্রাণের বেদী গড়ো
 

                   ১৬৯

      কেন রে এতই যাবার ত্বরা-

বসন্ত, তোর হয়েছে কি ভোর  গানের ভরা

        এখনি মাধবী  ফুরালো কি সবই,

        বনছায়া গায় শেষ ভৈরবী-

    নিল কি বিদায় শিথিল করবী বৃন্তঝরা

এখনি তোমার পীত উত্তরী  দিবে কি ফেলে

    তপ্ত দিনের শুষ্ক তৃণের আসন মেলে।

        বিদায়ের পথে হতাশ বকুল

        কপোতকূজনে হল যে আকুল,

    চরণপূজনে ঝরাইছে ফুল  বসুন্ধরা
 

                    ১৭০

জানি,    জানি হল যাবার আয়োজন-

           তবু, পথিক, থামো থামো কিছুক্ষণ

           শ্রাবণগগন বারি-ঝরা,

           কাননবীথি ছায়ায় ভরা,

           শুনি জলের ঝরোঝরে যূথীবনের ফুল-ঝরা ক্রন্দন

যেয়ো-     যখন বাদলশেষের পাখি

             পথে পথে উঠবে ডাকি ডাকি।

              শিউলিবনের মধুর স্তবে

              জাগবে শরৎলক্ষ্মী যবে,

              শুভ্র আলোর শঙ্খরবে   পরবে ভালে মঙ্গলচন্দন
 

                ১৭১

আমার    যাবার বেলায় পিছু ডাকে

ভোরের আলো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে

           বাদলপ্রাতের উদাস পাখি    ওঠে ডাকি

           বনের গোপন শাখে শাখে, পিছু ডাকে

ভরা নদী ছায়ার তলে   ছুটে চলে-

            আমার প্রাণের ভিতর সে কে  থেকে থেকে

            বিদায়প্রাতের উতলাকে   পিছু ডাকে
 

                     ১৭২

কে বলে 'যাও যাও'-        আমার   যাওয়া তো নয় যাওয়া।

    টুটবে আগল বারে বারে তোমার দ্বারে,

লাগবে আমায় ফিরে ফিরে   ফিরে-আসার হাওয়া

    ভাসাও আমার ভাঁটার টানে   অকূল-পানে,

আবার    জোয়ার-জলে তীরের তলে   ফিরে তরী বাওয়া

                        পথিক আমি, পথেই বাসা-

                    আমার   যেমন যাওয়া তেমনি আসা।

                        ভোরের আলোয় আমার তারা

                            হোক-না হারা,

আবার   জ্বলবে সাঁজে আঁধার-মাঝে তারি নীরব চাওয়া
 

                        ১৭৩

কেন আমায় পাগল করে যাস    ওরে  চলে-যাওয়ার দল।

            আকাশে বয় বাতাস উদাস, পরান টলোমল

        প্রভাততারা দিশাহারা, শরতমেঘের ক্ষণিক ধারা-

    সভা ভাঙার শেষ বাণীতে তান লাগে চঞ্চল

নাগকেশরের ঝরা কেশর ধুলার সাথে মিতা।

    গোধূলি সে রক্ত-আলোয় জ্বালে আপন চিতা।

শীতের হাওয়ায় ঝরায় পাতা,   আম্‌লকী-বন মরণ-মাতা,

        বিদায়বাঁশির সুরে বিধুর সাঁঝের দিগঞ্চল
 

                   ১৭৪

          যদি হল যাবার ক্ষণ

    তবে     যাও দিয়ে যাও শেষের পরশন

বারে বারে যেথায় আপন গানে    স্বপন ভাসাই দূরের পানে

    মাঝে মাঝে দেখে যেয়ো শূন্য বাতায়ন-

            সে মোর    শূন্য বাতায়ন    

                বনের প্রান্তে ওই মালতীলতা

            করুণ গন্ধে কয় কী গোপন কথা।

ওরই ডালে আর শ্রাবণের পাখি  স্মরণখানি আনবে না কি,

    আজ-শ্রাবণের সজল ছায়ায় বিরহ মিলন-

            আমাদের বিরহ মিলন
 

                ১৭৫।

ক্লান্ত বাঁশির শেষ রাগিণী বাজে শেষের রাতে।

শুকনো ফুলের মালা এখন দাও তুলে মোর হাতে

    সুরখানি ওই নিয়ে কানে   পাল তুলে দিই পারের পানে,

        চৈত্ররাতের মলিন মালা রইবে আমার সাথে

পথিক আমি এসেছিলেম তোমার বকুলতলে-

পথ আমারে ডাক দিয়েছে, এখন যাব চলে।

ঝরা যূথীর পাতায় ঢেকে  আমার বেদন গেলেম রেখে,

    কোন্ ফাল্গুনে মিলবে সে-যে তোমার বেদনাতে
 

                ১৭৬

কখন দিলে পরায়ে   স্বপন বরণমালা,

            ব্যথার  মালা

প্রভাতে দেখি জেগে    অরুণ মেঘে

    বিদায়বাঁশরি বাজে অশ্রু-গালা

গোপনে এসে গেলে,   দেখি নাই আঁখি মেলে।

আঁধারে দুঃখডোরে    বাঁধিলে মোরে,

        ভূষণ পরালে বিরহবেদন-ঢালা
 

               ১৭৭

যাবার বেলা শেষ কথাটি যাও বলে,

কোন্‌খানে যে মন লুকানো দাও বলে

    চপল লীলা ছলনাভরে    বেদনখানি আড়াল করে,

        যে বাণী তব হয় নি বলা নাও বলে

হাসির বাণে হেনেছ কত শ্লেষকথা,

নয়নজলে ভরো গো আজি শেষ কথা।

    হায় রে অভিমানিনী নারী,   বিরহ হল দ্বিগুণ ভারী

    দানের ডালি ফিরায়ে নিতে চাও ব'লে
 

               ১৭৮

   জানি তুমি ফিরে আসিবে আবার, জানি।

তবু মনে মনে প্রবোধ নাহি যে মানি

বিদায়লগনে ধরিয়া দুয়ার   তাই তো তোমায় বলি বারবার

    'ফিরে এসো এসো বন্ধু আমার,' বাষ্পবিভল বাণী

    যাবার বেলায় কিছু মোরে দিয়ো দিয়ো

        গানের সুরেতে তব আশ্বাস প্রিয়।

বনপথে যবে যাবে সে ক্ষণের  হয়তো বা কিছু রবে স্মরণের,

    তুমি লব সেই তব চরণের  দলিত কুসুমখানি                 

 

১৭৯

না রে, না রে, ভয় করব না বিদায়বেদনারে

আপন সুধা দিয়ে ভরে দেব তারে

চোখের জলে সে যে নবীন রবে, ধ্যানের মণিমালায় গাঁথা হবে,

          পরব বুকের হারে

নয়ন হতে তুমি আসবে প্রাণে, মিলবে তোমার বাণী আমার গানে গানে

বিরহব্যথায় বিধুর দিনে দুখের আলোয় তোমায় নেব চিনে,

এ মোর সাধনা রে

 

                   ১৮০

    তোর    প্রাণের রস তো শুকিয়ে গেল ওরে।

    তবে     মরণরসে নে পেয়ালা ভরে

সে যে       চিতার আগুন লাগিয়ে ঢালা, সব জ্বলনের মেটায় জ্বালা-

              সব   শূন্যকে সে অট্টহেসে দেয় যে রঙিন করে॥

   তোর     সূর্য ছিল গহন মেঘের মাঝে,

   তোর     দিন মরেছে অকাজেরই কাজে।

তবে  আসুক-না সেই তিমিররাতি   লুপ্তিনেশার চরম সাথি-

     তোর    ক্লান্ত আঁখি দিক সে ঢাকি দিক্-ভোলাবার ঘোরে

 

১৮১

মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান। 
মেঘবরণ
 তুঝ, মেঘজটাজূট,
রক্তকমলকর,
 রক্ত-অধরপুট,
তাপবিমোচন
 করুণ কোর তব
         মৃত্যু-অমৃত করে দান॥
              আকুল রাধা-রিঝ অতি জরজর,
              ঝরই নয়নদউ অনুখন ঝরঝর
              তুঁহুঁ মম মাধব, তুঁহুঁ মম দোসর,
                  তুঁহুঁ মম তাপ ঘুচাও।
                  মরণ, তু আও রে আও।

  ভুজপাশে তব লহ সম্বোধয়ি,
  আঁখিপাত মঝু দেহ তু রোধয়ি,
  কোর-উপর তুঝ রোদয়ি রোদয়ি
        নীদ ভরব সব 
দেহ।


           তুঁহুঁ নহি বিসরবি, তুঁহুঁ নহি ছোড়বি,
           রাধাহৃদয় তু কবহুঁ  তোড়বি,
           হিয়-হিয় রাখবি অনুদিন অনুখন
                অতুলন তোঁহার লেহ।

গগন
 সঘন অব, তিমিরমগন ভব,
তড়িতচকিত
 অতি, ঘোর মেঘরব,
শালতালতরু
 সভয়-তবধ সব
    পন্থ বিজন অতি ঘোর।

           একলি যাওব তুঝ অভিসারে,
           তুঁহুঁ মম প্রিয়তম, কি ফল বিচারে
           ভয়বাধা সব অভয় মুরতি ধরি
                     পন্থ দেখায়ব মোর।

      ভানু ভণে, অয়ি, রাধা, ছিয়ে ছিয়ে
           চঞ্চল চিত্ত তোহারি।
      জীবনবল্লভ মরণ-অধিক সো,
           অব তুঁহুঁ দেখ বিচারি।

 

                    ১৮২

উতল হাওয়া লাগল আমার গানের তরণীতে।

    দোলা লাগে দোলা লাগে

  তোমার    চঞ্চল ওই নাচের লহরীতে

যদি কাটে রশি, যদি   হাল পড়ে খসি,

    যদি   ঢেউ ওঠে উচ্ছ্বসি,

  সম্মুখেতে মরণ যদি জাগে,

করি নে ভয়-নেবই তারে, নেবই তারে জিতে
 

                        ১৮৩

না না না) ডাকব না, ডাকব না    অমন করে বাইরে থেকে।

পারি যদি অন্তরে তার ডাক পাঠাব, আনব ডেকে

    দেবার ব্যথা বাজে আমার বুকের তলে,

     নেবার মানুষ জানি নে তো কোথাচলে-

        এই দেওয়া-নেওয়ার মিলন আমার ঘটাবে কে

মিলবে না কি মোর বেদনা তার বেদনাতে-

গঙ্গাধারা মিশবে নাকি কালো যমুনাতে।

        আপনি কী সুর উঠল বেজে

            আপনা হতে এসেছে যে-

              গেল যখন আশার বচন গেছে রেখে
 

                     ১৮৪

তোরা    যে যা বলিস ভাই,    আমার    সোনার হরিণ চাই।

       ও সেই মনোহরণ চপলচরণ সোনার হরিণ চাই

সে-যে    চমকে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা।

সে-যে    নাগাল পেলে পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁদা।

আমি      ছুটব পিছে মিছে মিছে পাই বা নাহি পাই-

আমি      আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই

তোরা     পাবার জিনিস হাটে কিনিস, রাখিস ঘরে ভরে-

যারে      যায় না পাওয়া তারি হাওয়া লাগল কেন মোরে।

আমার    যা ছিল তা গেল ঘুচে যা নেই তার ঝোঁকে-

আমার    ফুরোয় পুঁজি, ভাবিস বুঝি মরি তারি শোকে?

আমি      আছি সুখে হাস্যমুখে, দুঃখ আমার নাই।

আমি      আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে ধাই
 

                      ১৮৫

            ও আমার ধ্যানেরই ধন,

      তোমায়    হৃদয়ে দোলায় যে হাসি রোদন

আসে বসন্ত, ফোটে বকুল,       কুঞ্জে পূর্ণিমাচাঁদ হেসে আকুল-

            তারা    তোমায় খুঁজে না পায়,

            প্রাণের মাঝে আছ গোপন স্বপন

     আঁখিরে ফাঁকি দাও, একি ধারা!

            অশ্রুজলে তারে কর সারা।

গন্ধ আসে, কেন দেখি নে মালা। পায়ের ধ্বনি শুনি, পথ নিরালা।

            বেলা যে যায়, ফুল যে শুকায়-

                অনাথ হয়ে আছে আমার ভুবন
 

                 ১৮৬

হায় রে,        ওরে যায় না কি জানা।

      নয়ন ওরে খুঁজে বেড়ায়,    পায় না ঠিকানা

            অলখ পথেই যাওয়া আসা,   শুনি চরণধ্বনির ভাষা-

                গন্ধে শুধু হাওয়ায় হাওয়ায় রইল নিশানা

কেমন করে জানাই তারে

      বসে আছি পথের ধারে।

            প্রাণে এল সন্ধ্যাবেলা     আলোয় ছায়ায় রঙিন খেলা-

                ঝরে-পড়া বকুলদলে বিছায় বিছানা
 

                  ১৮৭

ওহে    সুন্দর, মম গৃহে আজি পরমোৎসব-রাতি।

        রেখেছি কনকমন্দিরে কমলাসন পাতি

           তুমি   এসো হৃদে এসো, হৃদিবল্লভ হৃদয়েশ,

           তুমি   অশ্রুনেত্রে কর' বরিষন করুণ হাস্যভাতি

তব      কণ্ঠে দিব মালা,  দিব   চরণে ফুলডালা-

        আমি     সকল কুঞ্জকানন ফিরি এনেছি যূথি জাতি।

        তব পদতললীনা আমি বাজাব স্বর্ণবীণা-

        বরণ করিয়া লব তোমারে মম মানসসাথি
 

                     ১৮৮

    কে আমারে যেন এনেছে ডাকিয়া,  এসেছি ভুলে।

    তবু একবার চাও মুখপানে  নয়ন তুলে।

দেখি ও নয়নে নিমেষের তরে   সে দিনের ছায়া পড়ে কি না পড়ে,

        সজল আবেগে আঁখিপাতা-দুটি   পড়ে কি ঢুলে।

        ক্ষণেকের তরে ভুল ভাঙায়ো না,  এসেছি ভুলে

    ব্যথা দিয়ে কবে কথা কয়েছিলে   পড়ে না মনে,

    দূরে থেকে কবে ফিরে গিয়েছিলে  নাই স্মরণে।

শুধু মনে পড়ে হাসিমুখখানি, লাজে বাধো-বাধো সোহাগের বাণী,

        মনে পড়ে সেই হৃদয়-উছাস নয়নকূলে।

        তুমি যে ভুলেছ ভুলে গেছি, তাই এসেছি ভুলে

     কাননের ফুল এরা তো ভোলে নি,  আমরা ভুলি।

     এই তো ফুটেছে পাতায় পাতায়   কামিনীগুলি।

      চাঁপা কোথা হতে এসেছে ধরিয়া   অরুণকিরণ কোমল করিয়া,

            বকুল ঝরিয়া মরিবারে চায়   কাহার চুলে।

            কেহ ভোলে কেউ ভোলে না যে, তাই  এসেছি ভুলে

        এমন করিয়া কেমনে কাটিবে  মাধবীরাতি।

        দখিনবাতাসে কেহ নাহি পাশে    সাথের সাথি।

চারি দিক হতে বাঁশি শোনা যায়, সুখে আছে যারা তারা গান গায়-

        আকুল বাতাসে, মন্দির সুবাসে,  বিকচ ফুলে,

        এখনো কি কেঁদে চাহিবে না কেউ   আসিলে ভুলে
 

                       ১৮৯

    সে দিন দুজনে দুলেছিনু বনে,  ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা।

    এই স্মৃতিটুকু কভু খনে খনে    যেন জাগে মনে, ভুলো না।

সে দিন বাতাসে ছিল তুমি জানো-আমারি মনের প্রলাপ জড়ানো,

     আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসির তুলনা

     যেতে যেতে পথে পূর্ণিমারাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে।

     দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে কী জানি কী মহা লগনে।

এখন আমার বেলা নাহি আর,   বহিব একাকী বিরহের ভার-

      বাঁধিনু যে রাখী পরানে তোমার সে রাখী খুলো না, খুলো না
 

                      ১৯০

   সেই ভালো সেই ভালো,   আমারে না হয় না জানো।

   দূরে গিয়ে নয় দুঃখ দেবে,  কাছে কেন লাজে লাজানো

মোর বসন্তে লেগেছে তো সুর,   বেণুবনছায়া হয়েছে মধুর-

      থাক-না এমনি গন্ধে-বিধুর মিলনকুঞ্জে সাজানো

  গোপনে দেখেছি তোমার ব্যাকুল  নয়নে ভাবের খেলা।

  উতল আঁচল, এলোথেলো চুল,  দেখেছি ঝড়ের বেলা।

তোমাতে আমাতে হয় নি যে কথা  মর্মে আমার আছে সে বারতা-

      না বলা বাণীর নিয়ে আকুলতা   আমার বাঁশিটি বাজানো
 

                  ১৯১

কাছে যবে ছিল পাশে হল না যাওয়া,

        চলে যবে গেল তারি লাগিল হাওয়া

            যবে ঘাটে ছিল নেয়ে   তারে দেখি নাই চেয়ে,

                দূর হতে শুনি স্রোতে তরণী-বাওয়া

যেখানে হল না খেলা সে খেলাঘরে

        আজি নিশিদিন মন কেমন করে।

                হারানো দিনের ভাষা   স্বপ্নে আজি বাঁধে বাসা,

                    আজ শুধু আঁখিজলে পিছনে চাওয়া
 

                    ১৯২

আমার    প্রাণের 'পরে চলে গেল কে

বসন্তের    বাতাসটুকুর মতো।

সে যে    ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে-

ফুল     ফুটিয়ে গেল শত শত।

সে       চলে গেল, বলে গেল না-সে কোথায় গেল ফিরে এল না।

সে       যেতে যেতে চেয়ে গেল  কী যেন গেয়ে গেল-

তাই     আপন-মনে বসে আছি কুসুমবনেতে

সে       ঢেউয়ের মতো ভেসে গেছে, চাঁদের আলোর দেশে গেছে,

          যেখান দিয়ে হেসে গেছে, হাসি তার রেখে গেছে রে-

          মনে হল আঁখির কোণে  আমায় যেন ডেকে গেছে সে।

আমি     কোথায় যাব, কোথায় যাব, ভাবতেছি তাই একলা বসে।

সে       চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল ঘুমের ঘোর।

সে       প্রাণের কোথায় দুলিয়ে গেল ফুলের ডোর।

          কুসুমবনের উপর দিয়ে কী কথা সে বলে গেল,

          ফুলের গন্ধ পাগল হয়ে সঙ্গে তারি চলে গেল।

          হৃদয় আমার আকুল হল, নয়ন আমার মুদে এল রে-

          কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে
 

                 ১৯৩

        মনে রয়ে গেল মনের কথা-

        শুধু চোখের জল, প্রাণের ব্যথা

মনে করি দুটি কথা ব'লে যাই, কেন মুখের পানে চেয়ে চলে যাই।

সে যদি চাহে মরি যে তাহে, কেন মুদে আসে আঁখির পাতা

ম্লানমুখে, সখী, সে যে চলে যায়- ও তার ফিরায়ে ডেক নিয়ে আয়।

বুঝিল না সে যে কেঁদে গেল-ধুলায় লুটাইল হৃদয়লতা
 

                 ১৯৪

ওগো আমার চির-অচেনা পরদেশী,

ক্ষণতরে এসেছিলে নির্জন নিকুঞ্জ হতে কিসের আহ্বানে

    যে কথা বলেছিলে ভাষা বুঝি নাই তার,

    আভাস তারি হৃদয়ে বাজিছে সদা

    যেন কাহার বাঁশির মনোমোহন সুরে

প্রভাতে একা বসে গাঁথেছিনু মালা,

ছিল পড়ে তৃণতলে অশোকবনে।

    দিনশেষে ফিরে এসে পাই নি তারে,

    তুমিও কোথা গেছ চলে-

বেলা গেল, হল না আর দেখা
 

               ১৯৫

কোথা হতে শুনতে যেন পাই-

    আকাশে আকাশে বলে 'যাই'

        পাতায় পাতায় ঘাসে ঘাসে জেগে ওঠে দীর্ঘশ্বাসে

            'হায়' তারা নাই, তারা নাই'

কত দিনের কত ব্যথা   হাওয়ায় ছড়ায় ব্যাকুলতা।

            চলে যাওয়ার পথ যে দিকে  সে দিক-পানে অনিমিখে

                আজ ফিরে চাই, ফিরে চাই
 

                  ১৯৬

পান্থপাখির রিক্ত কুলায় বনের গোপন ডালে

কান পেতে ওই তাকিয়ে আছে পাতার অন্তরালেভ

    বাসায়-ফেরা ডানার শব্দ নিঃশেষে সব হল স্তব্ধ,

    সন্ধ্যাতারার জাগল মন্ত্র দিনের বিদায়-কালে

চন্দ্র দিল রোমাঞ্চিয়া তরঙ্গ সিন্ধুর,

বনচ্ছায়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে লাগল আলোর সুর।

    সুপ্তিবিহীন শূন্যতা যে সারা প্রহর বক্ষে বাজে

    রাতের হাওয়ায় মর্মরিত বেণুশাখার ডালে
 

               ১৯৭

বাজে করুণ সুরে    হায় দূরে

    তব চরণতলচুম্বিত পন্থবীণা।

     এ মম পান্থচিত চঞ্চল

        জানি না কী উদ্দেশে

   যূথীগন্ধ অশান্ত সমীরে

        ধায় উতলা উচ্ছ্বাসে,

তেমনি চিত্ত উদাসী রে

        নিদারুণ বিচ্ছেদের নিশীথে
 

              ১৯৮

জীবনে পরম লগন     কোরোনা হেলা

        কোরো না হেলা হে গরবিনি।

বৃথাই কাটিবে বেলা, সাঙ্গ হবে  যে খেলা,

সুধার হাটে ফুরাবে বিকিকিনি    হে গরবিনি

        মনের মানুষ লুকিয়ে আসে,  দাঁড়ায় পাশে, হায়

        হেসে চলে যায় জোয়ার-জলে   ভাসিয়ে ভেলা-

দুর্লভ ধনে দুঃখের পণে লও গো জিনি হে গরবিনি

        ফাগুন যখন যাবে গো নিয়ে ফুলের ডালা

কী দিয়ে তখন গাঁথিবে তোমার  বরণমালা

                            হে বিরহিণী।

        বাজবে বাঁশি দূরের হাওয়ায়,

     চোখের জলে শূন্যে চাওয়ায়  কাটবে প্রহর-

বাজবে বুকে বিদায়পথের চরণ ফেলা  দিনযামিনী

                            হে গরবিনি
 

              ১৯৯

সখী, তোরা দেখে যা এবার এল সময়

        আর বিলম্ব নয়, নয়, নয়

            কাছে এল বেলা,  মরণ-বাঁচনেরই খেলা,

                ঘুচিল সংশয়

              আর বিলম্ব নয়

    বাঁধন ছিঁড়ল তরী,

হঠাৎ দখিন-হাওয়ায়-হাওয়ায় পাল উঠিল ভরি।

    ঢেউ  ওঠে ওই খেপে ও তোর  হাল গেল যে কেঁপে,

                ঘূর্ণিজলে ডুবে গেল সকল লজ্জা ভয়
 

                  ২০০

    আমি আশায় আশায় থাকি।

আমার  তৃষিত-আকুল আঁখি

        ঘুমে-জাগরণে-মেশা প্রাণে স্বপনের নেশা-

            দূর দিগন্তে চেয়ে কাহারে ডাকি

বনে বনে করে কানাকানি অশ্রুত বাণী,

        কী গাহে পাখি।

কী কব না পাই ভাষা, মোর  জীবন রঙিন কুয়াশা

                ফেলেছে ঢাকি