গীতবিতান
    প্রেম (৩০১-৩৯৫)


                      ৩০১

হেলাফেলা সারা বেলা    একি খেলা আপন-সনে।

এই বাতাসে ফুলের বাসে    মুখখানি কার পড়ে মনে

    আঁখির কাছে বেড়ায় ভাসি কে জানে গো কাহার হাসি,

    দুটি ফোঁটা নয়নসলিল রেখে যায় এই নয়নকোণে

কোন্ ছায়াতে কোন্ উদাসী    দূরে বাজায় অলস বাঁশি,

মনে হয় কার মনের বেদন কেঁদে বেড়ায় বাঁশির গানে।

    সারা দিন গাঁথি গান কারে চাহে গাহে প্রাণ-

    তরুতলের ছায়ার মতন বসে আছি ফুলবনে

 

                              ৩০২

ওগো    এত প্রেম-আশা, প্রাণের তিয়াষা    কেমনে আছে সে পাশরি।

তবে     সেথা কি হাসে না চাঁদিনী যামিনী,  সেথা কি বাজে না বাঁশরি

   সখী,    হেথা সমীরণ লুটে ফুলবন,     সেথা কি পবন বহে না।

   সে যে তার কথা মোরে কহে অনুখন, মোর কথা তারে কহে না!

যদি     আমারে আজি সে ভুলিবে সজনী,    আমারে ভুলালে কেন সে।

ওগো    এ চিরজীবন করিব রোদন,    এই ছিল তার মানসে!

    যবে    কুসুমশয়নে নয়নে নয়নে    কেটেছিল সুখরাতি রে,

    তবে    কে জানিত তার বিরহ আমার    হবে জীবনের সাথি রে।

যদি    মনে নাহি রাখে, সুখে যদি থাকে,    তোরা একবার দেখে আয়-

এই    নয়নের তৃষা, পরানের আশা,    চরণের তলে রেখে আয়।

    আর নিয়ে যা রাধার বিরহের ভার,    কত আর ঢেকে রাখি বল্।

    আর পারিস যদি তো আনিস হরিয়ে    এক-ফোঁটা তার আঁখিজল।

না না, এত প্রেম, সখী, ভুলিতে যে পারে    তারে আর কেহ সেধো না।

আমি কথা নাহি কব, দুখ লয়ে রব    মনে মনে স'ব বেদনা।

    ওগো    মিছে মিছে, সখী, মিছে এই প্রেম, মিছে পরানের বাসনা।

    ওগো    সুখদিন হায় যবে চলে যায়    আর ফিরে আর আসে না

 

                             ৩০৩

আমি    নিশি নিশি কত রচিব শয়ন    আকুলনয়ন রে।

কত    নিতি নিতি বনে করিব যতনে    কুসুমচয়ন রে।

    কত    শারদ যামিনী হইবে বিফল,    বসন্ত যাবে চলিয়া।

    কত    উদিবে তপন, আশার স্বপন    প্রভাতে যাইবে ছলিয়া

এই      যৌবন কত রাখিব বাঁধিয়া, মরিব কাঁদিয়া রে।

সেই      চরণ পাইলে মরণ মাগিব সাধিয়া সাধিয়া রে।

    আমি    কার পথ চাহি এ জনম বাহি,    কার দরশন যাচি রে।

    যেন    আসিবে বলিয়া কে গেছে চলিয়া,    তাই আমি বসে আছি রে।

তাই    মালাটি গাঁথিয়া পরেছি মাথায়,    নীলবাসে তনু ঢাকিয়া।

তাই    বিজন আলয়ে প্রদীপ জ্বালায়ে    একেলা রয়েছি জাগিয়া।

    ওগো তাই কত নিশি চাঁদ ওঠে হাসি, তাই কেঁদে যায় প্রভাতে।

    ওগো তাই ফুলবনে মধুসমীরণে ফুটে ফুল কত শোভাতে।

ওই    বাঁশিস্বর তার আসে বারবার, সেই শুধু কেন আসে না।

এই    হৃদয়-আসন শূন্য পড়ে থাকে,    কেঁদে মরে শুধু বাসনা।

    মিছে  পরশিয়া কায় বায়ু বহে যায়,    বহে যমুনার লহরী।

    কেন কুহু কুহু পিক কুহরিয়া উঠে,    যামিনী যে উঠে শিহরি।

ওগো, যদি নিশিশেষে আসে হেসে হেসে    মোর হাসি আর রবে কি।

এই    জাগরণে-ক্ষীণ বদনমলিন    আমারে হেরিয়া কবে কী।

    আমি    সারা রগনীর গাঁথা ফুলমালা    প্রভাতে চেণে ঝরিব-

ওগো,    আছে সুশীতল যমুনার জল,    দেখে তারে আমি মরিব

 

                     ৩০৪

কখন বসন্ত গেল, এবার হল না গান।

কখন বকুলমূল    ছেয়েছিল ঝরা ফুল,

কখন যে ফুল-ফোটা হয়ে গেল অবসান

এবার বসন্তে কি রে যুঁথিগুলি জাগে নি রে-

অলিকুল গুঞ্জরিয়া করে নি কি মধুপান।

এবার কি সমীরণ জাগায় নি ফুলবন-

সাড়া দিয়ে গেল না তো, চলে গেল ম্রিয়মাণ

বসন্তের শেষ রাতে  এসেছি যে শূন্য হাতে-

এবার গাঁথি নি মালা, কী তোমারে করি দান।

কাঁদিছে নীরব বাঁশি, অধরে মিলায় হাসি-

তোমার নয়নে ভাসে ছলোছলো অভিমান

 

                ৩০৫

বাঁশরি বাজাতে চাহি, বাঁশরি বাজিল কই।

বিহরিছে সমীরণ, কুহরিছে পিকগণ,

মথুরার উপবন    কুসুমে সাজিল ওই

বিকচ বকুলফুল    দেখে যে হতেছে ভুল,

কোথাকার অলিকুল    গুঞ্জরে কোথায়।

এ নহে কি বৃন্দাবন,    কোথা সেই চন্দ্রানন,

ওই কি নূপুরধ্বনি,    বনপথে শুনা যায়।

একা আছি বনে বসি,    পীত ধড়া পড়ে খসি,

সোঙরি সে মুখশশী    পরান মজিল সই

একবার রাধে রাধে    ডাক্ বাঁশি মনোসাধে-

আজি এ মধুর চাঁদে    মধুর যামিনী ভায়।

কোথা সে বিধুরা বালা-মলিনমালতীমালা,

হৃদয়ে বিরহজ্বালা,    এ নিশি পোহায় হায়।

কবি যে হল আকুল,    একি রে বিধির ভুল,

মথুরায় কেন ফুল ফুটেছে আজি লো সই

 

                   ৩০৬

পথিক পরান্ চল্ চল্ সে পথে তুই

যে পথ দিয়ে গেল রে তোর বিকেলবেলার জুঁই

    সে পথ বেয়ে গেছে যে তোর সন্ধ্যামেঘের সোনা,

প্রাণের ছায়াবীথির তলে গানের আনাগোনা-

                রইল না কিছুই

যে পথে তার পাপড়ি দিয়ে বিছিয়ে গেল ভুঁই,

পথিক পরান, চল্ চল্ সে পথে তুই।

    অন্ধকারে সন্ধ্যাযূথীর স্বপনময়ী ছায়া

উঠবে ফুটে তারার মতো কায়াবিহীন মায়া-

                ছুঁই তারে না ছুঁই

 

৩০৭

তুই      ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার।

তাই     জনম গেল, শান্তি পেলি না রে, মন, মন রে আমার

          যে পথ দিয়ে চলে এলি   সে পথ এখন ভুলে গেলি—

          কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে  মন, মন রে আমার

                      নদীর জলে থাকি রে কান পেতে,

                      কাঁপে রে প্রাণ পাতার মর্মরেতে

মনে হয় যে পাব খুঁজি         ফুলের ভাষা যদি বুঝি

যে পথ গেছে সন্ধ্যাতারার পারে  মন, মন রে আমার

 

             ৩০৮

যে দিন    সকল মুকুল গেল ঝরে

আমায়     ডাকল কেন গো,    এমন করে

            যেতে হবে যে পথ বেয়ে   শুকনো পাতা আছে ছেয়ে,

            হাতে আমার শূন্য ডালা কী ফুল দিয়ে দেবো ভরে

            গানহারা মোর হৃদয়তলে

তোমার    ব্যাকুল বাঁশি কী যে বলে।

            নেই আয়োজন, নেই মম ধন, নেই আভরণ, নেই আবরণ-

            রিক্ত বাহু এই তো আমার বাঁধবে তোমায় বাহুডোরে

  

                    ৩০৯

আমায়    থাকতে দে-না আপন-মনে।

সেই চরণের পরশখানি মনে পড়ে ক্ষণে ক্ষণে

    কথার পাকে কাজের ঘোরে ভুলিয়ে রাখে কে আর মোরে,

    তার স্মরণের বরণমালা গাঁথি বসে গোপন কোণে

এই-যে ব্যথার রতনখানি আমার বুকে দিল আনি

    এই নিয়ে আজ দিনের শেষে একা চলি তার উদ্দেশে।

     নয়নজল সামনে দাঁড়াই, তারে সাজাই তারি ধনে

 

                      ৩১০

হে বিরহী, হায় চঞ্চল হিয়া তব,

    নীরবে জাগ একাকী শূন্যমন্দিরে দীর্ঘ বিভাবরী-

        কোন্‌ সে নিরুদ্দেশ-লাগি আছ জাগিয়া

স্বপনরূপিণী অলোকসুন্দরী অলক্ষ্য অলকাপুরী-নিবাসিনী,

    তাহার মুরতি রচিলে বেদনায় হৃদয়মাঝারে

 

                  ৩১১

ওগো সখী, দেখি দেখি, মন কোথা আছে।

কত  কাতর হৃদয় ঘুরে ঘুরে হেরো কারে যাচে

কী মধু, কী সুধা, কী সৌরভ,  কী রূপ রেখেছ লুকায়ে-

কোন্ প্রভাতে ও কোন্ রবির আলোকে দিবে খুলিয়ে কাহার কাছে

সে যদি না আসে এ জীবনে,  এ কাননে পথ না পায়!

যারা এসেছে তারা বসন্ত ফুরালে  নিরাশপ্রাণে ফেরে পাছে

 
                          ৩১২

সখী,   বহে গেল বেলা, শুধু হাসিখেলা এ কি আর ভালো লাগে।

আকুল তিয়াষ, প্রেমের পিয়াস, প্রাণে কেন নাহি জাগে

    কবে আর হবে থাকিতে জীবন আঁখিতে আঁখিতে মদির মিলন-

    মধুর হুতাশে মধুর দহন  নিতি-নব অনুরাগে

    তরল কোমল নয়নের জল,  নয়নে উঠিবে ভাসি,

    সে বিষাদনীরে নিবে যাবে ধীরে  প্রখর চপল হাসি।

    উদাস নিশ্বাস আকুলি উঠিবে, আশানিরাশায় পরান টুটিবে-

    মরমের আলো কপোলে ফুটিবে শরম-অরুণরাগে

 

                          ৩১৩

ওলো    রেখে দে সখী, রেখে দে,    মিছে কথা ভালোবাসা।

         সুখের বেদনা, সোহাগযাতনা,    বুঝিতে পারি না ভাষা

         ফুলের বাঁধন, সাধের কাঁদন,    পরান সঁপিতে প্রাণের সাধন,

         লহো-লহো ব'লে পরে আরাধন- পরের চরণে আশা

         তিলেক দরশ পরশ মাগিয়া  বরষ বরষ কাতরে জাগিয়া

         পরের মুখের হাসির লাগিয়া  অশ্রুসাগরে ভাসা-

         জীবনের সুখ খুঁজিবারে গিয়া  জীবনের সুখ নাশা

 

                       ৩১৪

তারে দেখাতে পারি নে কেন প্রাণ  খুলে গো।

    বুঝাতে পারি নে হৃদয়বেদনা

কেমনে সে হেসে চলে যায়,  কোন্ প্রাণে ফিরেও না চায়-

    এত সাধ এত প্রেম করে অপমান

এত ব্যাথাভরা ভালোবাসাকেহ দেখে না,  প্রাণে গোপনে রহিল।

    এ প্রেম কুসুম যদি হ'ত  প্রাণ হতে ছিঁড়ে লইতাম,

        তার চরণে করিতাম দান।

বুঝি সে তুলে নিত না, শুকাতো অনাদরে,  তবু তার সংশয় হ'ত অবসান

 

                        ৩১৫

এ তো    খেলা নয়, খেলা নয়-এ যে হৃদয়দহনজ্বালা সখী

এ যে    প্রাণভরা ব্যাকুলতা,  গোপন মর্মের ব্যথা,

        এ যে কাহার চরণোদ্দেশে জীবন মরন ঢালা

কে যেন সতত মোরে ডাকিয়ে আকুল করে-

যাই -যাই করে প্রাণ, যেতে পারি নে।

        যে কথা বলিতে চাহি  তা বুঝি বলিতে নাহি-

        কোথায় নামায়ে রাখি, সখী, এ প্রেমের ডালা।

        যতনে গাঁথিয়ে শেষে  পরাতে পারি নে মালা


                    ৩১৬

দিবস রজনী আমি যেন কার    আশায় আশায় থাকি।

তাই   চমকিত মন, চমকিত শ্রবণ,  তৃষিত আকুল আঁখি

    চঞ্চল হয়ে ঘুরিয়ে বেড়াই,  সদা মনে হয় যদি দেখা পাই-

    'কে আসিছে' বলে চমকিয়ে চাই  কাননে ডাকিলে পাখি

জাগরণে তারে না দেখিতে পাই,    থাকি স্বপনের আশে-

ঘুমের আড়ালে যদি ধরা দেয়  বাঁধিব স্বপনপাশে।

এত ভালোবাসি, এত যারে চাই, মনে হয় না তো সে যে কাছে নাই-

    যেন এ বাসনা ব্যাকুল আবেগে তাহারে আনিবে ডাকি

 

                        ৩১৭

অলি     বার বার ফিরে যায়,     অলি বার বার ফিরে আসে-

            তবে তো ফুল বিকাশে

কলি    ফুটিতে চাহে, ফোটে না,   মরে লাজে, মরে ত্রাসে

ভুলি    মান অপমান দাও মন প্রাণ, নিশিদিন রহো পাশে।

ওগো,    আশা ছেড়ে তবু আশা রেখে দাও    হৃদয়রতন-আশে

ফিরে এসো, ফিরে এসো-বন মোদিত ফুলবাসে।

আজি  বিরহরজনী, ফুল্ল কুসুম   শিশিরসলিলে ভাসে

 

                          ৩১৮

দূরের বন্ধু সুরের দূতীরে পাঠালো তোমার ঘরে।

মিলনবীণা যে হৃদয়ের মাঝে বাজে তব অগোচরে

মনের কথাটি গোপনে গোপনে   বাতাসে বাতাসে ভেসে আসে মনে,

বনে উপবনে,    বকুলশাখার চঞ্চলতায় মর্মরে মর্মরে

পুষ্পমালার পরশপুলক পেয়েছ বক্ষতলে,

রাখো তুমি তারে সিক্ত করিয়া সুখের অশ্রুজলে।

ধরো সাহানাতে মিলনের পালা, সাজাও যতনে বরণের ডালা-

মালতীর মালা, অঞ্চলে ঢেকে কনকপ্রদীপ  আনো  আনো তার পথ-'পরে

 

                          ৩১৯

আমার    মন চেয়ে রয় মনে মনে    হেরে মাধুরী।

           নয়ন আমার কাঙাল হয়ে মরে না ঘুরি

           চেয়ে চেয়ে বুকের মাঝে  গুঞ্জরিল একতারা যে-

           মনোরথের পথে পথে বাজল বাঁশুরি।

           রূপের কোলে ওই-যে দোলে অরূপ মাধুরী

কূলহারা    কোন্ রসের সরোবরে    মূলহারা ফুল ভাসে জলের 'পরে।

             হতের ধরা ধরতে গেলে    ঢেউ দিয়ে তায় দিই যে ঠেলে-

             আপন-মনে স্থির হয়ে রই, করি নে চুরি।

             ধরা দেওয়ার ধন সে তো নয়, অরূপ মাধুরী

  

                  ৩২০

বিনা সাজে সাজি    দেখা দিয়েছিলে কবে,

আভরণে আজি  আবরণ কেন তবে

    ভালোবাসা যদি মেশে আধা-আধি মোহে

    আলোতে আঁধারে  দোঁহারে হারাব দোঁহে।

    ধেয়ে আসে হিয়া  তোমার সহজ রবে,

    আভরণ দিয়া  আবরণ কেন তবে

ভাবের রসেতে  যাহার নয়ন ডোবা

ভূষণে তাহারে  দেখাও কিসের শোভা।

    কাছে এসে তবু  কেন রয়ে গেলে দূরে-

    বাহির-বাঁধনে বাঁধিবে কি বন্ধুরে,

    নিজের ধনে কি নিজে চুরি করে লবে।

    আভরণে আজি  আবরণ কেন তবে

  

                   ৩২১

বাহির পথে বিবাগি হিয়া    কিসের খোঁজে গেলি,

        আয় রে ফিরে আয়।

পুরানো ঘরে দুয়ার দিয়া ছেঁড়া আসন মেলি

        বসিবি নিরালায়

সারাটা বেলা সাগরধারে  কুড়ালি যত নুড়ি,

নানা রঙের শামুক-ভারে  বোঝাই হল ঝুড়ি,

        কহিল বাণী কী জানি কী ভাষায়

বিরাম হল আরামহীন যদি রে তোর ঘরে,  না যদি রয় সাথি,

সন্ধ্যা যদি তন্দ্রালীন মৌন অনাদরে,  না যদি জ্বালে বাতি,

তবু তো আছে আঁধার কোণে  ধ্যানের ধনগুলি-

একেলা বসি আপন-মনে   মুছিবি তার ধূলি,

গাঁথিবি তারে রতনহারে  বুকেতে নিবি তুলি মধুর বেদনায়।

    কাননবীথি ফুলের রীতি  নাহয় গেছে ভুলি,

        তারকা আছে গগনকিনারায়

 

                        ৩২২

       এলেম নতুন দেশে-

    তলায় গেল ভগ্ন তরী, কূলে এলেম ভেসে

অচিন মনের ভাষা  শোনাবে অপূর্ব কোন্ আশা,

        বোনাবে  রঙিন সুতোয় সুঃখসুখের জাল,

            বাজবে প্রাণে নতুন গানের তাল-

                নতুন বেদনায়  ফিরব কেঁদে হেসে

        নাম-না জানা প্রিয়া

    নাম-না-জানা ফুলের মালা নিয়া   হিয়ায় দেবে হিয়া।

যৌবনেরই নবোচ্ছ্বাসে ফাল্গুন মাসে

        বাজবে নূপুর বনের ঘাসে।

            মাতবে দখিনবায়  মঞ্জরিত লবঙ্গলতায়,

                    চঞ্চলিত এলো কেশে

 

                           ৩২৩

ঝড়ে    যায় উড়ে যায় গো    আমার    মুখের আঁচলখানি।

ঢাকা    থাকে না হায় গো,    তারে রাখতে নারি টানি

    আমার রইল না লাজলজ্জা,    আমার ঘুচল গো সাজসজ্জা-

    তুমি দেখলে আমারে  এমন    প্রলয়-মাঝে আনি

            আমায়  এমন মরণ হানি

হঠাৎ    আকাশ উজলি  কারে  খুঁজে কে ওই চলে,

চমক    লাগায় বিজুলি    আমার    আঁধার ঘরের তলে।

    তবে নিশীথগগন জুড়ে    আমার যাক সকলই উড়ে,

    এই  দারুণ কল্লোলে  বাজুক আমার প্রাণের বাণী

            কোনো    বাঁধন নাহি মানি

 

                     ৩২৪

পূর্ণ প্রাণে চাবার যাহা রিক্ত হাতে চাস নে তারে,

সিক্তচোখে যাস নে দ্বারে

রত্নমালা আনবি যবে    মাল্যবদন তখন হবে-

পাতবি কি তোর দেবীর আসন শূন্য ধুলায় পথের ধারে

বৈশাখে বন রুক্ষ যখন, বহে পবন দৈন্যজ্বালা,

হায় রে তখন শুকনো ফুলে ভরবি কি তোর বরণডালা।

অতিথিরে ডাকবি যবে    ডাকিস যেন সগৌরবে,

লক্ষ শিখায় জ্বলবে যখন দীপ্ত প্রদীপ অন্ধকারে

 

                   ৩২৫

লুকালে ব'লেই খুঁজে বাহির করা,

ধরা যদি দিতে তবে যেত না ধরা

    পাওয়া ধন আনমনে  হারাই যে অযতনে,

    হারাধন পেলে সে যে হৃদয়-ভরা

আপনি যে কাছে এল দূরে সে আছে,

কাছে যে টানিয়া আনে সে আসে কাছে।

    দূরে বারি যায় চলে,  লুকায় মেঘের কোলে,

    তাই সে ধরায় ফেরে পিপাসাহরা

 
                    ৩২৬

ঘরেতে    ভ্রমর এল    গুন্‌গুনিয়ে।

আমারে    কার কথা সে যায় শুনিয়ে

আলোতে    কোন্‌ ফফনে  মাধবী জাগল বনে,

এল সেই ফুল-জাগানোর খবর নিয়ে।

সারা দিন  সেই কথা সে যায় শুনিয়ে

কেমনে  রহি ঘরে,  মন যে কেমন করে-

কেমনে কাটে যে দিন দিন গুনিয়ে।

কী মায়া দেয় বুলায়ে, দিল সব কাজ ভুলায়ে,

বেলা যায়  গানের সুরে জাল বুনিয়ে।

আমারে  কার কথা সে যায় শুনিয়ে

 

                  ৩২৭

কোথা    বাইরে দূরে    যায় রে উড়ে    হায় রে হায়,

তোমার    চপল আঁখি    বনের পাখি    বনে পালায়

ওগো,    হৃদয়ে যবে    মোহন রবে    বাজবে বাঁশি

তখন    আপনি সেধে    ফিরবে কেঁদে,    পরবে ফাঁসি-

তখন    ঘুচবে ত্বরা    ঘুরিয়া মরা    হেথা    হোথায়।

আহা,    আজি সে আঁখি    বনের পাখি    বনে পালায়

চেয়ে    দেখিস না রে    হৃদয়দ্বারে    কে আসে যায়,

তোরা    শুনিস কানে    বারতা আনে    সখিনবায়।

আজি    ফুলের বাসে    সুখের হাসে    আকুল গানে

চির-    বসন্ত যে    তোমারি খোঁজে    এসেছে প্রাণে-

তারে    বাহিরে খুঁজি    ফিরিছ বুঝি    পাগলপ্রায়।

তোমার    চপল আঁখি    বনের পাখি    বনে পালায়

 

                      ৩২৮

দে তোরা আমার নূতন করে দে নূতন আভরণে

হেমন্তের অভিসম্পাতে রিক্ত অকিঞ্চন কাননভূমি,

বসন্তে হোক দৈন্যবিমোচন নব লাবণ্যধনে।

শূন্য শাখা লজ্জা ভুলে যাক পল্লব-আবরণে

বাজুক প্রেমের মায়ামন্দ্রে

পুলকিত প্রাণের বীণাযন্ত্রে

চিরসুন্দরের অভিবন্দনা।

আনন্দচঞ্চল নৃত্য অঙ্গে অঙ্গে বহে যাক হিল্লোলে হিল্লোলে,

যৌবন পাক সম্মান বাঞ্ছিতসম্মিলনে

 

                        ৩২৯

তোমার    বৈশাখে ছিল প্রখর রৌদ্রের জ্বালা,

            কখন বাদল আনে আষাঢ়ের পালা, হায় হায় হায়।

            কঠিন পাষাণে কেমনে গোপনে ছিল,

            সহসা ঝরনা নামিল অশ্রুঢালা,  হায় হায় হায়।

            মৃগয়া করিতে বাহির হল যে বনে

            মৃগী হয়ে শেষে এল কি অবলা বালা,  হায় হায় হায়।

            যে ছিল আপন শক্তির অভিমানে

            কার পায়ে আনে হার মানিবার ডালা,  হায় হায় হায়

 

                     ৩৩০

আমার এই  রিক্ত ডালি দিব তোমারি পায়ে।

    দিব কাঙালিনীর আঁচল তোমার পথে পথে বিছায়ে

        যে পুষ্পে গাঁথ পুষ্পধনু তারি ফুলে ফুলে, হে অতনু,

            আমার পূজানিবেদনের দৈন্য দিয়ো ঘুচায়ে

        তোমার রণজয়ের অভিযানে তুমি আমায় নিয়ো,

ফুলবাণের টিকা আমার ডালে এঁকে দিয়ো দিয়ো।

আমার  শূন্যতা দাও যদি সুধায় ভরি দিব তোমার জয়ধ্বনি ঘোষণ করি-

        ফাল্গুনের আহ্বান জাগাও আমার কায়ে দক্ষিণবায়ে

 

                          ৩৩১

আমার    অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি।    আনন্দে বিষাদে মন উদাসী

            পুষ্পবিকাশের সুরে দেহ মন উঠে পূরে,

                কী মাধুরীসুগন্ধ    বাতাসে যায় ভাসি

সহসা মনে জাগে আশা, মোর আহুতি পেয়েছে অগ্নির ভাষা।

            আজ মম রূপে বেশে লিপি লিখি কার উদ্দেশে-

                এল মর্মের বন্দিনী বাণী বন্ধন নাশি

 

                          ৩৩২

কোন্ দেবতা সে   কী পরিহাসে    ভাসালো মায়ার ভেলায়।

স্বপ্নের সাথি,    এসো মোরা মাতি    স্বর্গের কৌতুকখেলায়

সুরের প্রবাহের হাসির তরঙ্গে বাতাসে বাতাসে ভেসে যাব রঙ্গে

                নৃত্যবিভঙ্গে

মাধবীবনের মধুগন্ধে মোদিত    মোহিত মন্থর বেলায়

যে ফুলমালা দুলায়েছ আজি     রোমাঞ্চিত বক্ষতলে

মধুরজনীতে রেখো সরসিয়া     মোহের মদির জলে।

নবোদিত সূর্যের করসম্পাতে    বিকল হবে হায় লজ্জা-আঘাতে,

দিন গত হলে নূতন প্রভাতে    মিলাবে ধুলার তলে কার অবহেলায়

 

                       ৩৩৩

নারীর ললিত লোভন লীলায়    এখনি কেন এ ক্লান্তি।

    এখনি কি, সখা, খেলা হল অবসান

        যে মধুর রসে ছিলে বিহ্বল    সে কি মধুমাখা ভ্রান্তি-

    সে কি স্বপ্নের দান। সে কি সত্যের অপমান

    দূর দুরাশায় হৃদয় ভরিছ, কঠিন প্রেমের প্রতিমা গড়িছ-

কী মনে ভাবিয়া নারীতে করিছ  পৌরুষসন্ধান

        এও কি মায়ার দান

                সহসা মন্ত্রবলে

    নমনীয় এই কমনীয়তারে যদি আমাদের সখী একেবারে

           পরের বসন-সমান ছিন্ন করি ফেলে ধূলিতলে

    সবে না সবে না সে নৈরাশ্য-ভাগ্যের সেই অট্টহাস্য

জানি জানি, সখা, ক্ষুবন্ধ করিবে লুব্ধ পুরুষপ্রাণ- হানিবে নিঠুর বাণ

 

                        ৩৩৪

ওরে চিত্ররেখাডোরে বাঁধিল কে-বহু- পূর্বস্মৃতিময় হেরি ওকে।

কার তুলিকা নিল মন্ত্রে জিনি এই মঞ্জুল রূপের নির্ঝরিণী-স্থির নির্ঝরিণী।

    যেন ফাল্গুন-উপবনে শুক্লরাতে দোল পূর্ণিমাতে

        এল ছন্দমুরতি কার নব-অশোকে

            নৃত্যকলা যেন চিত্রে-লিখা

        কোন্  স্বর্গের মোহিনী-মরীচিকা।

    শরৎ-নীলাম্বরে তড়িৎলতা কোথা হারাইল-চঞ্চলতা।

হে স্তব্ধবাণী, কারে দিবে আনি   নন্দনমন্দারমাল্যখানি-বরমাল্যখানি

    প্রিয়- বন্দনাগান-জাগানো রাতে

            শুভ দর্শন দিবে তুমি কাহার চোখে

  

                     ৩৩৫

চিনিলে না আমারে কি।

দীপহারা কোণে  আমি ছিনু অন্যমনে,  ফিরে গেলে কারেও না দেখি

দ্বারে এসে গেলে ভুলে  পরশনে দ্বার যেত খুলে-

মোর ভাগ্যতরী  এটুকু বাধায় গেল ঠেকি

ঝড়ের রাতে ছিনু প্রহর গণি।

হায়, শুনি নাই,  তব রথের ধ্বনি।

গুরুগুরু গরজনে কাঁপি  বক্ষ ধরিয়াছিনু চাপি,

আকাশে বিদ্যুতবহ্ন  অভিশাপ গেল লেখি


                     ৩৩৬

কঠিন বেদনার তাপস দোঁহে  যাও চিরবিরহের সাধনায়।

    ফিরো না, ফিরো না, ভুলো না মোহে।

    গভীর বিষাদের শান্তি পাও হৃদয়ে,

    জয়ী হও অন্তরবিদ্রোহে

যাক পিয়াসা,  ঘুচুক দুরাশা,  যাক মিলায়ে কামনাকুয়াশা।

    স্বপ্ন-আবেশ-বিহীন পথে যাও বাঁধনহারা

    তাপবিহীন মধুর স্মৃতি নীরবে ব'হে

 

                      ৩৩৭

সব কিছু কেন নিল না, নিল না, নিল না ভালোবাসা-

        ভালো আর মন্দোরে।

    আপনাতে কেন মিটালো না যত কিছু দ্বন্দ্বেরে-

            ভালো আর মন্দোরে

নদী নিয়ে আসে পঙ্কিল জলধারা, সাগরহৃদয়ে গহনে হয় হারা।

        ক্ষমার দীপ্তি দেয় স্বর্গের আলো প্রেমের আনন্দেরে-

            ভালো আর মন্দেরে

 

                     ৩৩৮

নীরবে থাকিস, সখী,  ও তুই নীরবে থাকিস।

    তোর প্রেমেতে আছে যে কাঁটা

তারে আপন বুকে বিঁধিয়ে রাখিস

দয়িতেরে দিয়েছিলি সুধা  আজিও তাহার মেটে নি ক্ষুধা

            এখনি তাহে মিশাবি কি বিষ।

        যে জ্বলনে তুই মরিবি মরমে মরমে

            কেন তারে বাহিরে ডাকিস 

 

                          ৩৩৯

প্রেমের জোয়ারে    ভাসাবে দোঁহারে-বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও দাও 

ভুলিব ভাবনা,   পিছনে চাব না- পাল তুলে দাও, দাও দাও দাও 

    প্রবল পবনে তরঙ্গ তুলিল,    হৃদয় দুলিল, দুলিল দুলিল-

পাগল হে নাবিক,    ভুলাও দিগ্‌বিদিক- পাল তুলে দাও দাও দাও 

 

                            ৩৪০

জানো প্রেম চিরঋণী আপনারই হরষে, জেনো প্রিয়ে।

    সব পাপ ক্ষমা করি ঋণশোধ করে সে।

        কলঙ্ক যাহা আছে দূর    হয় তার কাছে,

            কালিমার 'পরে তার অমৃত সে বরষে 

 

                        ৩৪১

      কোন্ অযাচিত আশার আলো

দেখা দিল রে তিমিররাত্রি ভেদি    দুর্দিনদুর্যোগে-

        কাহার মাধুরী বাজাইল করুণ বাঁশি।

            অচেনা নির্মম ভুবনে দেখিনু একি সহসা-

                কোন্‌ অজানার সুন্দর মুখে সান্ত্বনাহাসি 

 

                     ৩৪২

যদি আসে তবে কেন যেতে চায়।

দেখা দিয়ে তবে কেন গো লুকায় 

চেয়ে থাকে ফুল, হৃদয় আকুল-

    বায়ু বলে এসে 'ভেসে যাই।

    ধরে রাখো, ধরে রাখো-

    সুখপাখি ফাঁকি দিয়ে উড়ে যায় 

    পথিকের বেশে সুখনিশি এসে

    বলে হেসে হেসে 'মিশে যাই'।

    জেগে থাকো সখী, জেগে থাকো-

    বরষের সাধ নিমেষে মিলায় 

 

                      ৩৪৩

আমার    মন বলে 'চাই, চা ই, চাই গো-যারে নাহি পাই গো'।

    সকল পাওয়ার মাঝে    আমার মনে বেদন বাজে-

            'নাই, না ই, নাই গো' 

        হারিয়ে যেতে হবে,

            আমায়    ফিরিয়ে পাব তবে।

সন্ধ্যাতারা যায় যে চলে    ভোরের তারায় জাগবে ব'লে-

            বলে সে 'যা ই, যাই গো' 

  

                        ৩৪৪

আমি ফুল তুলিতে এলেম বনে-

        জানি না, আমার কী ছিল মনে।

            এ তো ফুল তোলা নয়, বুঝি নে কী মনে হয়,

                জল ভরে যায় দু' নয়নে 

 

                     ৩৪৫

প্রাণ চায় চক্ষু না চায়, মরি    একি তোর দুস্তরলজ্জা।

সুন্দর এসে ফিরে যায়,    তবে  কার লাগি মিথ্যা এ সজ্জা 

মুখে নাহি নিঃসরে ভাষ, দহে অন্তরে নির্বাক্ বহ্নি।

ওষ্ঠে কী নিষ্ঠুর হাস, তব মর্মে যে ক্রন্দন তন্বী!

মাল্য যে দংশিছে হায়, তোর শয্যা যে কণ্টকশয্যা

মিলনসমুদ্রবেলায়     চির‌-    বিচ্ছেদজর্জর মজ্জা 

  

                     ৩৪৬

      দ্বারে কেন দিলে নাড়া ওগো মালিনী!

      কার কাছে পাবে সাড়া ওগো মালিনী 

তুমি তো তুলেছ ফুল, গেঁথেছ মালা, আমার আঁধার ঘরে লেগেছে তালা।

       খুঁজে তো পাই নি পথ, দীপ জ্বালি নি 

        ওই দেখো গোধূলির ক্ষীণ আলোতে

         দিনের শেষের সোনা ডোবে কালোতে।

আঁধার নিবিড় হলে আসিয়ো পাশে,  যখন দূরের আলো জ্বালে আকাশে

        অসীম পথের রাতি  দীপশালিনী 

 
                     ৩৪৭

   তুমি মোর পাও নাই পরিচয়।

তুমি যারে জান সে যে কেহ নয়, কেহ নয় 

    মালা দাও তারি গলে, শুকায় তা পলে পলে,

        আলো তার ভয়ে ভয়ে রয়-

    বায়ুপরশন নাহি সয় 

    এসো এসো দুঃখ, জ্বালো শিখা,

দাও ভালে অগ্নিময়ী টিকা।

মরণ আসুক চুপে পরমপ্রকাশরূপে,

    সব আবরণ হোক লয়-

        ঘুচুক সকল পরাজয়


                    ৩৪৮

এবার, সখী, সোনার মৃগ দেয় বুঝি দেয় ধরা।

আয় গো তোরা পুরাঙ্গনা, আয় সবে আয় ত্বরা 

    ছুটেছিল পিয়াস-ভরে মরীচিকাবারির তরে,

    ধ'রে তারে কোমল করে কঠিন ফাঁসি পরা 

দয়ামায়া করিস নে গো, ওদের নয় সে ধারা।

দয়ার দোহাই মানবে না গো একটু পেলেই ছাড়া।

    বাঁধন-কাটা বন্যটাকে মায়ার ফাঁদে ফেলাও পাকে,

    ভুলাও তাকে বাঁশির ডাকে, বুদ্ধিবিচার-হরা 

 

                         ৩৪৯

কী হল আমার!  বুঝি বা সখী,  হৃদয় আমার হারিয়েছি।

পথের মেঝেতে খেলাতে গিয়ে  হৃদয় আমার হারিয়েছি 

প্রভাতকিরণে সকালবেলাতে

মন লয়ে, সখী, গেছিনু খেলাতে-

মন কুড়াইতে, মন ছড়াইতে,  মনের মাঝারে খেলি বেড়াইতে,

মনোফুল দলি চলি বেড়াইতে-

সহসা, সজনী, চেতনা পেয়ে

সহসা, রজনী, দেখিনু চেয়ে

রাশি রাশি ভাঙা হৃদয়-মাঝে  হৃদয় আমার হারিয়েছি 

যদি কেহ, সখী, দলিয়া যায়,

তার প'র দিয়া চলিয়া যায়-

শুকায়ে পড়িবে, ছিঁড়িয়া পড়িবে, দলগুলি তার ঝরিয়া পড়িবে-

যদি কেহ, সখী, দলিয়া যায়।

আমার কুসুমকোমল হৃদয়  কখনো সহে নি রবির কর,

আমার মনের কামিনীপাপড়ি  সহে নি ভ্রমরচরণভর।

চিরদিন, সখী, হাসিত খেলিত,

জোছনা-আলোকে নয়ন মেলিত-

সহসা আজ সে হৃদয় আমার  কোথায়, সজনী, হারিয়েছি 

 

                      ৩৫০

               আজি আঁখি জুড়ালো হেরিয়ে

আহা   আঁখি জুড়ালো হেরিয়ে  মনোমোহন মিলনমাধুরী, যুগলমুরতি 

        ফুলগন্ধে আকুল করে,    বাজে বাঁশরি উদাস স্বরে,

                নিকুঞ্জ প্লাবিত চন্দ্রকরে-

        তারি মাঝে    মনোমোহন মিলনমাধুরী,    যুগলমুরতি 

        আনো আনো ফুলমালা,    দাও দোঁহে বাঁধিয়ে।

        হৃদয় পশিবে ফুলপাশ,  অক্ষয় হবে প্রেমবন্ধন,

চিরদিন হেরিব হে    মনোমোহন মিলনমাধুরী, যুগলমুরতি 

 

                       ৩৫১

সকল হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছি যারে    সে কি ফিরাতে পারে সখী!

সংসারবাহিরে থাকি,    জানি নে কী ঘটে সংসারে 

        কে জানে হেথায়    প্রাণপণে প্রাণ যারে চায়

        তারে পায় কি না-জানি নে-

        ভয়ে ভয়ে তাই এসেছি গো    অজানা হৃদয়দ্বারে 

        তোমার সকলই ভালোবাসি-ওই রূপরাশি,

        ওই খেলা, ওই গান, ওই মধু হাসি।

        ওই দিয়ে আছ ছেয়ে জীবন আমারই।

        কোথায় তোমার সীমা ভুবনমাঝারে 

 

                      ৩৫২

তারে    কেমনে ধরিবে, সখী, যদি ধরা দিলে।

তারে    কেমনে কাঁদাবে যদি আপনি কাঁদিলে 

         যদি মন পেতে চাও মন রাখো গোপনে।

         কে তারে বাঁধিবে তুমি আপনায় বাঁধিলে 

কাছে আসিলে তো কেহ কাছে রহে না।

কথা কহিলে তো কেহ কথা কহে না।

        হাতে পেলে ভূমিতলে ফেলে চলে যায়।

        হাসিয়ে ফিরায় মুখ কাঁদিয়া সাধিলে 

 

                    ৩৫৩

ওই মধুর মুখ জাগে মনে।

ভুলিব না এ জীবনে,    কী স্বপনে কী জাগরণে 

তুমি জান বা না জান

মনে সদা যেন মধুর বাঁশরি বাজে-

হৃদয়ে সদা আছ ব'লে।

আমি   প্রকাশিতে পারি নে,  শুধু চাহি কাতরনয়নে 

 

                      ৩৫৪

সুখে আছি, সুখে আছি   সখা আপনমনে।

কিছু  চেয়ো না, দূরে যেয়ো না,

শুধু  চেয়ে দেখো, শুধু ঘিরে থাকো কাছাকাছি 

সখা,  নয়নে শুধু জানাবে প্রেম,  নীরবে দিবে প্রাণ,

রচিয়া ললিতমধুর বাণী    আড়ালে গাবে গান।

গোপনে তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া রেখে যাবে মালাগাছি 

মন  চেয়ো না, শুধু  চেয়ে থাকো, শুধু ঘিরে থাকো কাছাকাছি 

মধুর জীবন, মধুর রজনী,  মধুর মলয়বায়।

এই  মাধুরী বহিছে আপনি  কেহ কিছু নাহি চায়।

আমি   আপনার মাঝে আপনি হারা,  আপন সৌরভে সারা-

যেন    আপনার মন আপনার প্রাণ   আপনারে সঁপিয়াছি 

 

                            ৩৫৫

          ভালোবেসে যদি সুখ নাহি    তবে কেন

              তবে কেন মিছে ভালোবাসা।

          মন দিয়ে মন পেতে চাহি   ওগো, কেন

               ওগো, কেন মিছে এ দুরাশা 

হৃদয়ে জ্বালায়ে বাসনার শিখা,   নয়নে সাজায়ে মায়ামরীচিকা,

           শুধু  ঘুরে মরি মরুভূমে। ওগো, কেন

                    ওগো, কেন মিছে এ পিপাসা 

            আপনি যে আছে আপনার কাছে

            নিখিল জগতে কী আভাব আছে।

            আছে  মন্দ সমীরণ, পুষ্পবিভূষণ,

                     কোকিলকূজিত কুঞ্জ।

বিশ্বচরাচর লুপ্ত হয়ে যায়- একি ঘোর প্রেম অন্ধরাহু-প্রায়

             জীবন যৌবন গ্রাসে। তবে কেন

                      তবে কেন মিছে এ কুয়াশা 

 

                           ৩৫৬

সখা,    আপন মন নিয়ে কাঁদিয়ে মরি,    পরের মন নিয়ে কী হবে।

আপন মন যদি বুঝিতে নারি,    পরের মন বুঝে কে কবে 

অবোধ মন লয়ে ফিরি ভবে,    বাসনা কাঁদে প্রাণে হা-হা-রবে-

এ মন দিতে চাও দিয়ে ফেলো,    কেন গো নিতে চাও মন তবে 

স্বপনসম সব জানিয়ো মনে,    তোমার কেহ নাই এ ত্রিভুবনে-

যে জন ফিরিতেছে আপন আশে   তুমি ফিরিছ কেন তাহার পাশে 

নয়ন মেলি শুধু দেখে যাও,  হৃদয় দিয়ে শুধু শান্তি পাও-

তোমারে মুখ তুলে চায়ে না যে  থাক্ সে আপনার গরবে 

 

                ৩৫৭

প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে।

কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে-

গরব সব হায় কখন টুটে যায়,    সলিল বহে যায় নয়নে।

এ সুখধরণীতে কেবলই চাহ নিতে,  জান না হবে আপনা-

সুখের ছায়া ফেলি কখন যাবে চলি,    বরিবে সাধ করি বেদনা।

কখন বাজে বাঁশি  গরব যায় ভাসি,    পরান পড়ে আসি বাঁধনে 

 

                  ৩৫৮

এসেছি গো এসেছি,   মন দিতে এসেছি    যারে ভালো বেসেছি।

ফুলদলে ঢাকি মন   যাব রাখি চরণে,

পাছে   কঠিন ধরণী পায়ে বাজে।

রেখো  রেখো চরণ হৃদি-মাঝে।

নাহয়   দ'লে যাবে, প্রাণ ব্যথা পাবে-

আমি তো  ভেসেছি, অকূলে ভেসেছি 

 

                   ৩৫৯

যেয়ো না, যেয়ো না ফিরে।

দাঁড়াও বারেক, দাঁড়াও হৃদয়-আসনে 

চঞ্চল সমীরসম ফিরিছ কেন কুসুমে কুসুমে,  কাননে কাননে।

তোমায়   ধরিতে চাহি, ধরিতে পারি নে,  তুমি গঠিত যেন স্বপনে-

এসো হে, তোমারে বারেক দেখি ভরিয়ে আঁখি, ধরিয়ে রাখি যতনে 

প্রাণের দিবসনিশি রহিবে মিশি  কোমল প্রেমশয়নে 

 

                   ৩৬০

         কাছে আছে দেখিতে না পাও।

তুমি     কাহার সন্ধানে দূরে যাও 

         মনের মতো কারে খুঁজে মরো,

         সেকি আছে ভুবনে-

         সে যে রয়েছে মনে।

ওগো,  মনের মতো সেই তো হবে

তুমি    শুভক্ষণে যাহার পানে চাও 

তোমার  আপনার যে জন দেখিলে না তারে

তুমি     যাবে কার দ্বারে।

         যারে চাবে তারে পাবে না,

         যে মন তোমার আছে যাবে তাও 

 

                 ৩৬১

জীবনে আজ কি প্রথম এল বসন্ত।

নবীনবাসনাভরে হৃদয় কেমন করে,

    নবীন জীবনে হল জীবন্ত 

        সুখভরা এ ধরায় মন বাহিরিতে চায়,

            কাহারে বসাতে চায় হৃদয়ে।

            তাহারে খুঁজিব দিকদিগন্ত 

যেমন দখিনে বায়ু ছুটেছে, না জানি কোথায় ফুল ফুটেছে,

তেমনি-আমিও, সখী, যাব- না জানি কোথায় দেখা পাব।

        কার সুধাস্বর-মাঝে জগতের গীত বাজে,

            প্রভাত জাগিছে কার নয়নে,

                কাহার প্রাণের প্রেম অনন্ত

                তাহারে খুঁজিব দিকদিগন্ত 

 

                 ৩৬২

পথহারা তুমি পথিক যেন গো  সুখের কাননে

    ওগো যাও, কোথা যাও।

সুখে ঢলঢল বিবশ বিভল পাগল নয়নে

    তুমি চাও, কারে চাও।

কোথা গেছে তব উদাস হৃদয়, কোথা পড়ে আছে ধরণী।

মায়ার তরণী বাহিয়া যেন গো  মায়াপুরী-পানে ধাও-

    কোন্‌  মায়াপুরী-পানে ধাও 

 

                      ৩৬৩

তুমি    কোন্‌ কাননের ফুল, তুমি  কোন্ গগনের তারা।

তোমায়  কোথায় দেখেছি  যেন কোন্ স্বপনের পারা 

কবে তুমি গেয়েছিলে, আঁখির পানে চেয়েছিলে

            ভুলে গিয়েছে।

শুধু    মনের মধ্যে জেগে আছে  ওই নয়নের তারা 

তুমি  কথা কোয়ো না, তুমি  চেয়ে চলে যাও।

এই  চাঁদের আলোতে তুমি হেসে গ'লে যাও।

      আমি  ঘুমের ঘোরে চাঁদের পানে চেয়ে থাকি মধুর প্রাণে,

      তোমার আঁখির মতন দুটি তারা ঢালুক কিরণধারা 

  

               ৩৬৪

আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি

নাচিবি ঘিরি, গাহিবি গান।

আন্     তবে বীণা-

সপ্তম সুরে বাঁধ্ তবে তান 

পাশরিব ভাবনা, পাশরিব যাতনা,

রাখিব প্রমোদে ভরি দিবানিশি মনপ্রাণ।

আন্ তবে বীণা -

সপ্তম সুরে বাঁধ্ তবে তান 

ঢালো ঢালো শশধর, ঢালো ঢালো জোছনা।

সমীরণ, বহে যা রে ফুলে ফুলে ঢলি ঢলি।

উলসিত তটিনী,

উথলিত গীতরবে খুলে দে রে মনপ্রাণ 

 

                    ৩৬৬

   মনে যে আশা লয়ে এসেছি হল না, হল না হে।

   ওই মুখপানে চেয়ে ফিরিনু লুকাতে আঁখিজল,

        বেদনা রহিল মনেমনে 

তুমি কেন হেসে চাও, হেসে যাও হে,   আমি কেন কেঁদে ফিরি-

         কেন আনি কম্পিত হৃদয়খানি,   কেন যও দূরে না দেখে 

 

                     ৩৬৭

এখনো তারে চোখে দেখি নি, শুধু বাঁশি শুনেছি-

    মন প্রাণ যাহা ছিল দিয়ে ফেলেছি 

        শুনেছি মুরতি কালো  তারে না দেখা ভালো।

    সখী, বলো আমি জল আনিতে যমুনায় যাব কি 

শুধু স্বপনে এসেছিল সে, নয়নকোণে হেসেছিল সে।

    সে অবধি, সই, ভয়ে ভয়ে রই-আঁখি মেলিতে ভেবে সারা হই।

        কাননপথে যে খুশি সে যায়,  কদমতলে যে খুশি সে চায়-

           সখী, বলো আমি  কারো পানে চাব কি

 

                       ৩৬৮

         বঁধু, তোমায় করব রাজা তরুতলে,

বনফুলের বিনোদমালা দেব গলে 

         সিংহাসনে বসাইতে   হৃদয়খানি দেব পেতে,

                অভিষেক করব তোমায় আঁখিজলে 

 

                      ৩৬৯

এরা    পরকে আপন করে, আপনারে পর-

    বাহিরে বাঁশির রবে ছেড়ে যায় ঘর 

        ভালোবাসে সুখে দুখে,  ব্যথা সহে হাসিমুখে,

            মরণেরে করে চিরজীবননির্ভর 

 

                       ৩৭০

সমুখেতে বহিছে তটিনী, দুটি তারা আকাশে ফুটিয়া।

        বায়ু বহে পরিমল লুটিয়া।

    সাঁঝের অধর হতে ম্লান হাসি পড়িছে টুটিয়া 

        দিবস বিদায় চাহে, যমুনা বিলাপ গাহে-

            সায়াহ্নেরই রাঙা পায়ে কেঁদে কেঁদে পড়িছে লুটিয়া 

এসো বঁধু, তোমায় ডাকি-দোঁহে হেথা বসে থাকি,

    আকাশের পানে চেয়ে জলদের খেলা দেখি,

        আঁখি-'পরে তারাগুলি একে একে উঠিবে ফুটিয়া 

 

                    ৩৭১

        বুঝি বেলা বহে যায়,

        কাননে আয় তোরা আয়।

আলোতে ফুল উঠল ফুটে, ছায়ায় ঝরে পড়ে যায় 

সাধ ছিল রে পরিয়ে দেব  মনের মতন মালা গেঁথে-

কই সে হল মালা গাঁথা, কই সে এল হায়।

    যমুনার ঢেউ যাচ্ছে বয়ে, বেলা চলে যায় 

 

                 ৩৭২

বনে এমন ফুল ফুটেছে,

মান ক'রে থাকা আজ কি সাজে।

মান অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে

চলো  চলো কুঞ্জবনে 

আজ কোকিলে গেয়েছে কুহু মুহু্‌মুহু,

আজ কাননে ওই বাঁশি বাজে।

মান ক'রে থাকা আজ কি সাজে 

আজ মধুরে মিশাবি মধু, পরানবঁধু

চাঁদের আলোয় ওই বিরাজে।

মান ক'রে থাকা আজ কি সাজে 

 

                    ৩৭৩

     আমি   কেবল তোমার দাসী

কেমন ক'রে আনব মুখে 'তোমায় ভালোবাসি 

    গুণ যদি মোর থাকত তবে  অনেক আদর মিলত ভবে,

        বিনামূল্যের কেনা আমি শ্রীচরণপ্রয়াসী 

 

                          ৩৭৪

আজ    যেমন ক'রে গাইছে আকাশ    তেমনি ক'রে গাও গো।

আজ    যেমন ক'রে চাইছে আকাশ    তেমনি ক'রে চাও গো 

    আজ  হাওয়া যেমন পাতায় পাতায় মর্মরিয়া বনকে কাঁদায়,

      তেমনি আমার বুকের মাঝে  কাঁদিয়া কাঁদাও গো 

 

                     ৩৭৫

যৌবনসরসীনীরে মিলনশতদল

কোন্  চঞ্চল বন্যায় টলোমল টলোমল 

    শরমরক্তরাগে  তার  গোপন স্বপ্ন জাগে,

    তারি  গন্ধকেশর-মাঝে

            এক  বিন্দু নয়নজল 

        ধীরে বও ধীরে বও, সমীরণ,

              সবেদন পরশন।

শঙ্কিত চিত্ত মোর  পাছে ভাঙে বৃন্তডোর-

তাই  অকারণ করুণায় মোর আঁখি করে ছলোছল 

 

                     ৩৭৬

বলো দেখি, সখী লো,

নিরদয় লাজ তোর টুটিবে কি লো।

চেয়ে আছি, ললনা-

মুখানি তুলিবি কি লো,

ঘোমটা খুলিবি কি লো,

আধফোটা অধরে হাসি ফুটিবে কি লো 

শরমের মেঘে ঢাকা বিধুমুখানি-

মেঘ টুটে জোছনা ফুটে উঠিবে কি লো।

তৃষিত আঁখির আশা পূরাবি কি লো-

তবে ঘোমটা খোলো, মুখটি তোলো, আঁখি মেলো 

 

                        ৩৭৭

দেখো যা, দেখো যা, দেখে যা লো তোরা  সাধের কাননে মোর

আমার সাধের কুসুম উঠেছে ফুটিয়া, মলয় বহিছে সুরভি লুটিয়া রে-

হেথায় জোছনা ফুটে, তটিনী ছুটে, প্রমোদে কানন ভোর 

    আয় আয় সখী, আয় লো হেথা, দুজনে কহিব মনের কথা।

        তুলিব কুসুম দুজনে মিলি রে-

সুখে    গাঁথিব মালা, গণিব তারা, করিব রজনী ভোর 

এ কাননে বসি গাহিব গান, সুখের স্বপনে কাটাব প্রাণ,

        খেলিব দুজনে মনের খেলা রে-

প্রাণে  রহিবে মিশি দিবসনিশি  আধো-আধো ঘুমঘোর 

 

                     ৩৭৮

নিমেষের তরে শরমে বাধিল, মরমের কথা হল না।

জনমের তরে তাহারি লাগিয়ে রহিল মরমবেদনা 

    চোখে চোখে সদা রাখিবারে সাধ-পলক পড়িল, ঘটিল বিষাদ।

    মেলিতে নয়ন মিলালো স্বপন  এমনি প্রেমের ছলনা 

 

                     ৩৭৯

আমি    হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ।

সে তো এল না যারে সঁপিলাম এই প্রাণ মন দেহ 

    সে কি  মোর তরে পথ চাহে, সে কি বিরহগীত গাহে

        যার বাঁশরিধ্বনি শুনিয়ে আমি ত্যজিলাম গেহ 

 

                  ৩৮০

ওকে বল, সখী, বল-কেন মিছে করে ছল,

মিছে হাসি কেন সখী,  মিছে আঁখিজল 

জানি নে প্রেমের ধারা, ভয়ে তাই হই সারা-

কে জানে কোথায় দুধা কোথা হলাহল 

কাঁদিতে জানে না এরা, কাঁদাইতে জানে কল-

মুখের বচন শুনে মিছে কী হইবে ফল।

প্রেম নিয়ে শুধু খেলা- প্রাণ নিয়ে হেলাফেলা-

ফিরে যাই এই বেলা, চল্ সখী চল্ 

 

                ৩৮১

কে ডাকে। আমি কভু ফিরে নাহি চাই।

কত ফুল ফুটে উঠে কত ফুল যায় টুটে,

আমি শুধু বহে চলে যাই 

পরশ পুলকরস-ভরা রেখে যাই, নাহি দিই ধরা।

উড়ে আসে ফুলবাস, লতাপাতা ফেলে শ্বাস,

বনে বনে উঠে হাহুতাশ-

চকিতে শুনিতে শুধু পাই। চ'লে যাই 

 

                     ৩৮২

সখী, সে   গেল কোথায়, তারে  ডেকে নিয়ে আয়।

        দাঁড়াব ঘিরে তারে তরুতলায় 

আজি এ মধুর সাঁঝে কাননে ফুলের মাঝে

        হেসে হেসে বেড়াবে সে, দেখিব তায় 

আকাশে    তারা ফুটেছে,  দখিনে বাতাস ছুটেছে,

        পাখিটি ঘুমঘোরে গেয়ে উঠেছে।

    আয় লো আনন্দময়ী, মধুর বসন্ত লয়ে

        লাবণ্য ফুটাবি লো, তরুলতায় 

 

                  ৩৮৩

বিদায় করেছ যারে নয়নজলে,

এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে গো 

আজি মধু সমীরণে নিশীথে কুসুমবনে 

তারে কি পড়েছে মনে বকুলতলে 

সে দিনও তো মধুনিশি প্রাণে গিয়েছিল মিশি,

মুকুলিত দশ দিশি কুসুমদলে।

দুটি সোহাগের বাণী যদি হত কানাকানি,

যদি ওই মালাখানি পরাতে গলে।

এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে গো 

মধুরাতি পূর্ণিমার ফিরে আসে বার বার,

সে জন ফিরে না আর যে গেছে চলে-

ছিল তিথি অনুকূল, শুধু নিমেষের ভুল-

চিরদিন তৃষাকুল পরান জ্বলে।

এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে গো 

 

                 ৩৮৪

না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে।

ওগো,  কে আছে চাহিয়া শূন্য পথপানে-

কাহার জীবনে নাহি সুখ, কাহার পরান জ্বলে 

পড় নি কাহার নয়নের ভাষা,

বোঝ নি কাহার মরমের আশা,

দেখ নি ফিরে-

কার ব্যাকুল প্রাণের সাধ এসেছ দ'লে 

 

                   ৩৮৫

নয়ন মেলে দেখি আমায় বাঁধন বেঁধেছে।

গোপনে কে এমন ক'রে এ ফাঁদ ফেঁদেছে।

বসন্তরজনীশেষে বিদায় নিতে গেলেম হেসে-

যাবার বেলায় বঁধু আমায় কাঁদিয়ে কেঁদেছে 

 

                   ৩৮৬

হাসিরে কি লুকাবি লাজে।

চপলা সে বাঁধা পড়ে না যে 

রুধিয়া অধরদ্বারে ঝাঁপিয়া রাখিলি যারে

কখন সে ছুটে এল নয়নমাঝে।

 

                      ৩৮৭

যে ফুল ঝরে সেই তো ঝরে, ফুল তো থাকে ফুটিতে-

বাতাস তারে উড়িয়ে নে যায়, মাটি মেশায় মাটিতে 

    গন্ধ দিলে, হাসি দিলে, ফুরিয়ে গেল খেলা।

    ভালোবাসা দিয়ে গেল, তাই কি হেলাফেলা 

 

                  ৩৮৮

সাজাব তোমারে হে ফুল দিয়ে দিয়ে,

নানা বরনের বনফুল দিয়ে দিয়ে 

আজি বসন্তরাতে পূর্ণিমাচন্দ্রকরে

    দক্ষিণপবনে, প্রিয়ে,

সাজাব তোমারে হে ফুল দিয়ে দিয়ে 

 

                   ৩৮৯

মন জানে মনোমোহন আইল, মন জানে সখা!

তাই কেমন করে আজি আমার প্রাণে 

তারি সৌরভ বহি বহিল কি সমীরণ আমার পরানপানে 

 

                  ৩৯০

হল না লো, হল না, সই হায়-

মরমে মরমে লুকানো রহিল,

বলি বলি বলি তারে কত মনে করিনু-

হল না লো, হল না সই 

না কিছু কহিল, চাহিয়া রহিল,

গেল সে চলিয়া, আর সে ফিরিল না।

ফিরাব ফিরাব ব'লে কত মনে করিনু-

হল না লো, হল না সই 

 

                 ৩৯১

ও কেন  চুরি ক'রে চায়।

নুকোতে গিয়ে হাসি হেসে পালায়।

বনপথে ফুলের মেলা, হেলে দুলে করে খেলা-

চকিতে সে চমকিয়ে কোথা দিয়ে যায় 

কী যেন গানের মতো  বেজেছে কানের কাছে,

যেন তার প্রাণের কথা আধেকখানি শোনা গেছে।

পথেতে যেতে চ'লে মালাটি গেছে ফেলে-

পরানের আশাগুলি গাঁথা যেন তায় 

 

                      ৩৯২

কেহ কারো মন বোঝে না, কাছে এসে সরে যায়।

সোহাগের হাসিটি কেন  চোখের জলে মরে যায় 

    বাতাস যখন কেঁদে গেল  প্রাণ খুলে ফুল ফুটিল না,

সাঁঝের বেলা একাকিনী কেন রে ফুল ঝরে যায় 

মুখের পানে চেয়ে দেখো, আঁখিতে মিলাও আঁখি-

মধুর প্রাণের কথা  প্রাণেতে রেখো না ঢাকি।

    এ রজনী রহিবে না, আর কথা হইবে না-

    প্রভাতে রহিবে শুধু হৃদয়ের হায়-হায় 

 

                   ৩৯৩

        গেল গো-

    ফিরিল না, চাহিল না, পাষাণ সে।

কথাটিও কহিল না, চলে গেল গো 

    না যদি থাকিতে চায় যাক যেথা সাধ যায়,

একেলা আপন-মনে দিন কি কাটিবে না।

    তাই হোক, হোক তবে-

        আর তারে সাধিব না 

 

                      ৩৯৪

      বল্ , গোলাপ, মোরে বল,

         তুই ফুটিবি, সখী, কবে।

ফুল  ফুটেছে চারি পাশ, চাঁদ হাসিছে সুধাহাস,

বায়ু  ফেলিছে মৃদু শ্বাস, পাখি গাইছে মধুরবে-

        তুই ফুটিবি, সখী, কবে 

প্রাতে   পড়েছে, শিশিরকণা, সাঁঝে বহিছে দখিনা বায়,

         কাছে  ফুলবালা সারি সারি-

দূরে  পাতার আড়ালে সাঁঝের তারা মুখানি দেখিতে চায়।

বায়ু দূর  হতে আসিয়াছে, যত ভ্রমর ফিরিছে কাছে,

        কচি কিশলয়গুলি  রয়েছে নয়ন তুলি-

            তারা শুধাইছে মিলি সবে,

                তুই ফুটিবি, সখী, কবে 

 

                   ৩৯৫

        আমার  যেতে সরে না মন-

তোমার দুয়ার পারায়ে  আমি যাই যে হারায়ে

        অতল বিরহে নিমগন 

চলিতে চলিতে পথে সকলই দেখি যেন মিছে,

       নিখিল ভুবন মিছে ডাকে অনুক্ষণ 

            আমার  মনে কেবলই বাজে

তোমায়   কিছু দেওয়া হল না যে।

    যবে চলে যাই    পদে পদে বাধা পাই,

        ফিরে ফিরে আসি অকারণ