গীতবিতান
প্রকৃতি
(১০১-২০০)
১০১
আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে,
মেঘ-আঁচলে নিলে ঘিরে॥
সূর্য হারায়, হারায় তারা আঁধারে পথ হয়-যে হারা,
ঢেউ দিয়েছে নদীর নীরে॥
সকল আকাশ, সকল ধরা বর্ষণেরই-বাণী-ভরা।
ঝরো ঝরো ধারায় মাতি বাজে আমার আঁধার রাতি,
বাজে আমার শিরে শিরে॥
১০২
ধরণী, দূরে চেয়ে কেন আজ আছিস জেগে
যেন কার উত্তরীয়ের পরশের হরষ লেগে॥
আজি কার মিলনগীতি ধ্বনিছে কাননবীথি,
মুখে চায় কোন্ অতিথি আকাশের নবীন মেঘে॥
ঘিরেছিস মাথায় বসন কদমের কুসুমডোরে,
সেজেছিস নয়নপাতে নীলিমার কাজল প’রে।
তোমার ওই বক্ষতলে নবশ্যাম দূর্বাদলে
আলোকের ঝলক ঝলে পরানের পুলকবেগে॥
১০৩
হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু গুরু গুরু,
ঘন মেঘের ভুরু কুটিল কুঞ্চিত,
হল রোমাঞ্চিত বন বনান্তর-
দুলিল চঞ্চল বক্ষোহিন্দোলে মিলনস্বপ্নে সে কোন্ অতিথি রে।-
সঘনবর্ষণশব্দমুখরিত বজ্রসচকিত ত্রস্ত শর্বরী,
মালতীবল্লরী কাঁপায় পল্লব করুণ কল্লোলে-
কানন শঙ্কিত ঝিল্লিঝঙ্কৃত॥
১০৪
মধু -গন্ধে ভরা মৃদু -স্নিগ্ধছায়া নীপ -কুঞ্জতলে
শ্যাম -কান্তিময়ী কোন্ স্বপ্নমায়া ফিরে বৃষ্টিজলে॥
ফিরে রক্ত-অলক্তক-ধৌত পায়ে ধারা -সিক্ত বায়ে,
মেঘ -মুক্ত সহাস্য শশাঙ্ককলা সিঁথি -প্রান্তে জ্বলে॥
পিয়ে উচ্ছল তরল প্রলয়মদিরা উন্ -মুখর তরঙ্গিণী ধায় অধীরা,
কার নির্ভীক মূর্তি তরঙ্গদোলে কল -মন্দ্ররোলে।
এই তারাহারা নিঃসীম অন্ধকারে কার তরণী চলে॥
১০৫
আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে
যখন বৃষ্টি নামল তিমিরনিবিড় রাতে।
দিকে দিকে সঘন গগন মত্ত প্রলাপে প্লাবন-ঢালা শ্রাবণধারাপাতে
সে দিন তিমিরনিবিড় রাতে॥
আমার স্বপ্নস্বরূপ বাহির হয়ে এল, সে যে সঙ্গ পেল
আমার সুদূর পারের স্বপ্নদোসর-সাথে
সে দিন তিমিরনিবিড় রাতে॥
আমার দেহের সীমা গেল পারায়ে- ক্ষুব্ধ বনের মন্দ্ররবে গেল হারায়ে।
মিলে গেল কুঞ্জবীথির সিক্ত যূথীর গন্ধে মত্তহাওয়ার ছন্দে,
মেঘে মেঘে তড়িৎ শিখায় ভুজঙ্গপ্রয়াতে সে দিন তিমিরনিবিড় রাতে॥
১০৬
আমি শ্রাবণ-আকাশে ওই দিয়েছি পাতি
মম জল-ছলো-ছলো আঁখি মেঘে মেঘে।
বিরহদিগন্ত পারায়ে সারা রাতি অনিমেষে আছে জেগে॥
যে গিয়েছে দেখার বাহিরে আছে তারি উদ্দেশে চাহি রে,
স্বপ্নে উড়িছে তারি কেশরাশি পুরবপবনবেগে॥
শ্যামল তমালবনে
যে পথে সে চলে গিয়েছিল বিদায়গোধূলি-খনে
বেদনা জড়ায়ে আছে তারি ঘাসে, কাঁপে নিশ্বাসে-
সেই বারে বারে ফিরে ফিরে চাওয়া ছায়ায় রয়েছে লেগে॥
১০৭
ভোর থেকে আজ বাদল ছুটেছে- আয় গো আয়।
কাঁচা রোদখানি পড়েছে বনের ভিজে পাতায়॥
ঝিকি ঝিকি করি কাঁপিতেছে বট-
ওগো ঘাটে আয়, নিয়ে আয় ঘট-
পথের দু ধারে শাখে শাখে আজি পাখিরা গায়॥
তপন-আতপে আতপ্ত হয়ে উঠেছে বেলা,
খঞ্জন-দুটি আলস্যভরে ছেড়েছে খেলা।
কলস পাকড়ি আঁকড়িয়া বুকে
ভরা জলে তোরা ভেসে যাবি সুখে
তিমিরনিবিড় ঘনঘোরে ঘুমে স্বপনপ্রায়- আয় গো আয়॥
মেঘ ছুটে গেল, নাই গো বাদল- আয় গো আয়।
আজিকে সকালে শিথিল কোমল বহিছে বায়- আয় গো আয়।
এ ঘাট হইতে ও ঘাটে তাহার
কথা বলাবলি নাহি চলে আর,
একাকার হল তীরে আর নীরে তাল-তলায়- আয় গো আয়॥
১০৮
নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে॥
বাদলের ধারা ঝরে ঝরো-ঝরো, আউষের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো,
কালিমাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্ চাহি রে॥
ওই শোনো শোনো পারে যাবে ব’লে কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে।
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।
পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ, দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ-
দরো-দরো বেগে জলে পড়ি জল ছলো-ছল উঠে বাজি রে।
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে॥
ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘন ঘন, ধবলীরে আনো গোহালে-
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখি্ দেখি, মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি,
রাখালবালক কী জানি কোথায় সারা দিন আজি খোয়ালে।
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে॥
ওগো, আজ তোরা যাস নে গো তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে।
ঝরো-ঝরো ধারে ভিজিবে নিচোল, ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল-
ওই বেণুবন দোলে ঘন ঘন পথপাশে দেখো চাহি রে॥
১০৯
থামাও রিমিক-ঝিমিক বরিষন, ঝিল্লিঝনক-ঝন-নন, হে শ্রাবণ।
ঘুচাও ঘুচাও স্বপ্নমোহ-অবগুণ্ঠন ঘুচাও॥
এসো হে, এসো হে, দুর্দম বীর এসো হে।
ঝড়ের রথে অগম পথে জড়ের বাধা যত করো উন্মূলন॥
জ্বালো জ্বালো বিদ্যুৎশিখা জ্বালো,
দেখাও তিমিরভেদী দীপ্তি তোমার দেখাও।
দিগ্বিজয়ী তব বাণী দেহো আনি, গগনে গগনে সুপ্তিভেদী তব গর্জন জাগাও॥
১১০
আজি পল্লিবালিকা অলকগুচ্ছ সাজালো বকুলফুলের দুলে,
যেন মেঘরাগিণীরচিত কী সুর দুলালো কর্ণমূলে॥
ওরা চলেছে কুঞ্জচ্ছায়াবীথিকায় হাস্যকল্লোল-উছল গীতিকায়
বেণুমর্মরমুখর পবনে তরঙ্গ তুলে॥
আজি কূলে কূলে তরল প্রলাপে যমুনা কলরোলা।
মেঘপুঞ্জ গরজে গুরু গুরু, বনের বক্ষ কাঁপে দুরু দুরু-
স্বপ্নলোকে পথ হারানু মনের ভুলে॥
১১১
ওই মালতীলতা দোলে
পিয়ালতরুর কোলে পুব-হাওয়াতে॥
মোর হৃদয়ে লাগে দোলা, ফিরি আপনভোলা-
মোর ভাবনা কোথায় হারা মেঘের মতন যায় চলে॥
জানি নে কোথায় জাগো ওগো বন্ধু পরবাসী-
কোন্ নিভৃত বাতায়নে।
সেথা নিশিথের জল-ভরা কণ্ঠে
কোন্ বিরহিণীর বাণী তোমারে কী যায় ব’লে॥
১১২
আঁধার অম্বরে প্রচণ্ড ডম্বরু বাজিল গম্ভীর গরজনে।
অশত্থপল্লবে অশান্ত হিল্লোলে সমীরচঞ্চল দিগঙ্গনে॥
নদীর কল্লোল, বনের মর্মর, বাদল-উচ্ছল নির্ঝরঝর্ঝর,
ধ্বনি তরঙ্গিল নিবিড় সঙ্গীতে- শ্রাবণসন্ন্যাসী রচিল রাগিণী॥
কদম্বকুঞ্জের সুগন্ধমদিরা অজস্র লুটিছে দুরন্ত ঝটিকা।
তড়িৎ শিখা ছুটে দিগন্ত সন্ধিয়া, ভয়ার্ত যামিনী উঠিছে ক্রন্দিয়া-
নাচিছে যেন কোন্ প্রমত্ত দানব মেঘের দুর্গের দুয়ার হানিয়া॥
১১৩
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে।
শত বরনের ভাব-উচ্ছ্বাস কলাপের মতো করেছে বিকাশ,
আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে॥
ওগো, নির্জনে বকুলশাখায় দোলায় কে আজি দুলিছে, দোদুল দুলিছে॥
ঝরকে ঝরকে ঝরিছে বকুল, আঁচল আকাশে হতেছে আকুল,
উড়িয়া অলক ঢাকিছে পলক- কবরী খসিয়া খুলিছে।
ঝরে ঘনধারা নবপল্লবে, কাঁপিছে কানন ঝিল্লির রবে-
তীর ছাপি নদী কলকল্লোলে এল পল্লির কাছে রে॥
১১৪
আজ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে-
চলেছে গরজি, চলেছে নিবিড় সাজে॥
হৃদয়ে তাহার নাচিয়া উঠিছে ভীমা,
ধাইতে ধাইতে লোপ ক’রে চলে সীমা,
কোন্ তাড়নায় মেঘের সহিত মেঘে
বক্ষে বক্ষে মিলিয়া বজ্র বাজে॥
পুঞ্জে পুঞ্জে দূরে সুদূরের পানে
দলে দলে চলে, কেন চলে নাহি জানে।
জানে না কিছুই কোন্ মহাদ্রিতলে
গভীর শ্রাবণে গলিয়া পড়িবে জলে,
নাহি জানে তার ঘনঘোর সমারোহে
কোন্ সে ভীষণ জীবন মরণ রাজে॥
১১৫
মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ আসিতে তোমার দ্বারে
মরুতীর হতে সুধাশ্যামলিম পারে॥
পথ হতে আমি গাঁথিয়া এনেছি সিক্ত যূথীর মালা
সকরুণ-নিবেদনের-গন্ধ-ঢালা-
লজ্জা দিয়ো না তারে॥
সজল মেঘের ছায়া ঘনাইছে বনে বনে,
পথ-হারানোর বাজিছে বেদনা সমীরণে।
দূর হতে আমি দেখেছি তোমার ওই বাতায়নতলে নিভৃতে প্রদীপ জ্বলে-
আমার এ আঁখি উৎসুক পাখি ঝড়ের অন্ধকারে॥
১১৬
তৃষ্ণার শান্তি, সুন্দরকান্তি,
তুমি এলে নিখিলের সন্তাপভঞ্জন॥
আঁকো ধরাবক্ষে দিগ্বধূচক্ষে
সুশীতল সুকোমল শ্যামরসরঞ্জন।
এলে বীরছন্দে তব কটিবন্ধে
বিদ্যুৎ-অসিলতা বেজে ওঠে ঝঞ্ঝন॥
তব উত্তরীয়ে ছায়া দিলে ভরিয়া-
তমালবনশিখরে নবনীল-অঞ্জন।
ঝিল্লির মন্দ্রে মালতীর গন্ধে
মিলাইলে চঞ্চল মধুকরগুঞ্জন।
নৃত্যের ভঙ্গে এলে নব রঙ্গে,
সচকিত পল্লবে নাচে যেন খঞ্জন॥
১১৭
মম মন-উপবনে চলে অভিসারে আঁধার রাতে বিরহিণী।
রক্তে তারি নূপুর বাজে রিনিরিনি॥
দুরু দুরু করে হিয়া, মেঘ ওঠে গরজিয়া,
ঝিল্লি ঝনকে ঝিনিঝিনি॥
মম মন-উপবনে ঝরে বারিধারা, গগনে নাহি শশীতারা।
বিজুলির চমকনে মিলে আলো ক্ষণে ক্ষণে,
ক্ষণে ক্ষণে পথ ভোলে উদাসিনী॥
১১৮
আজি বরিষনমুখরিত শ্রাবণরাতি,
স্মৃতিবেদনার মালা একেলা গাঁথি॥
আজি কোন্ ভুলে ভুলি আঁধার ঘরেতে রাখি দুয়ার খুলি,
মনে হয় বুঝি আসিছে সে মোর দুখরজনীর সাথি॥
আসিছে সে ধারাজলে সুর লাগায়ে,
নীপবনে পুলক জাগায়ে।
যদিও বা নাহি আসে তবু বৃথা আশ্বাসে
ধূলি-’পরে রাখিব রে মিলন-আসনখানি পাতি॥
১১৯
যায় দিন, শ্রাবণদিন যায়।
আঁধারিল মন মোর আশঙ্কায়,
মিলনের বৃথা প্রত্যাশায় মায়াবিনী এই সন্ধ্যা ছলিছে॥
আসন্ন নির্জন রাতি, হায়, মম পথ-চাওয়া বাতি
ব্যাকুলিছে শূন্যের কোন্ প্রশ্নে॥
দিকে দিকে কোথাও নাহি সাড়া,
ফিরে খ্যাপা হাওয়া গৃহছাড়া।
নিবিড়-তমিস্র-বিলুপ্ত-আশা ব্যথিতা যামিনী খোঁজে ভাষা-
বৃষ্টিমুখরিত মর্মরছন্দে, সিক্ত মালতীগন্ধে॥
১২০
আমি কী গান গাব যে ভেবে না পাই-
মেঘলা আকাশে উতলা বাতাসে খুঁজে বেড়াই॥
বনের গাছে গাছে জেগেছে ভাষা ভাষাহারা নাচে-
মন ওদের কাছে চঞ্চলতার রাগিণী যাচে,
সারাদিন বিরামহীন ফিরি যে তাই॥
আমার অঙ্গে সুরতরঙ্গে ডেকেছে বান,
রসের প্লাবনে ডুবিয়া যাই।
কী কথা রয়েছে আমার মনের ছায়াতে
স্বপ্নপ্রদোষে- আমি তারে যে চাই॥
১২১
কিছু বলব ব’লে এসেছিলেম,
রইনু চেয়ে না ব’লে॥
দেখিলাম খোলা বাতায়নে মালা গাঁথো আপন-মনে,
গাও গুন্-গুন্ গুঞ্জরিয়া যূথীকুঁড়ি নিয়ে কোলে॥
সারা আকাশ তোমার দিকে
চেয়ে ছিল অনিমিখে।
মেঘ-ছেঁড়া আলো এসে পড়েছিল কালো কেশে,
বাদল-মেঘে মৃদুল হাওয়ায় অলক দোলে॥
১২২
মন মোর মেঘের সঙ্গী,
উড়ে চলে দিগ্দিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে
রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম॥
মন মোর হংসবলাকার পাখায় যায় উড়ে
ক্বচিৎ ক্বচিৎ চকিত তড়িত-আলোকে।
ঝঞ্ঝনমঞ্জীর বাজায় ঝঞ্ঝা রুদ্র আনন্দে।
কলো-কলো কলমন্দ্রে নির্ঝরিণী
ডাক দেয় প্রলয়-আহ্বানে॥
বায়ু বহে পূর্বসমুদ্র হতে
উচ্ছল ছলো-ছলো তটিনীতরঙ্গে।
মন মোর ধায় তারি মত্ত প্রবাহে
তাল-তমাল-অরণ্যে
ক্ষুব্ধ শাখার আন্দোলনে॥
১২৩
মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো,
দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।
হৃদয়গগনে সজল ঘন নবীন মেঘে
রসের ধারা বরষে॥
তাহারে দেখি না যে দেখি না,
শুধু মনে মনে ক্ষণে ক্ষণে ওই শোনা যায়
বাজে অলখিত তারি চরণে
রুনুরুনু রুনুরুনু নূপুরধ্বনি॥
গোপন স্বপনে ছাইল
অপরশ আঁচলের নব নীলিমা।
উড়ে যায় বাদলের এই বাতাসে
তার ছায়াময় এলো কেশ আকাশে।
সে যে মন মোর দিল আকুলি
জল-ভেজা কেতকীর দূর সুবাসে॥
১২৪
আমার প্রিয়ার ছায়া
আকাশে আজ ভাসে, হায় হায়!
বৃষ্টিসজল বিষণ্ণ নিশ্বাসে, হায়॥
আমার প্রিয়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
সন্ধ্যাতারায় লুকিয়ে দেখে কাকে,
সন্ধ্যাদীপের লুপ্ত আলো স্মরণে তার আসে, হায়॥
বারি-ঝরা বনের গন্ধ নিয়া
পরশ-হারা বরণমালা গাঁথে আমার প্রিয়া।
আমার প্রিয়া ঘন শ্রাবণধারায়
আকাশ ছেয়ে মনের কথা হারায়।
আমার প্রিয়ার আঁচল দোলে
নিবিড় বনের শ্যামল উচ্ছ্বাসে, হায়॥
১২৫
ওগো সাঁওতালি ছেলে,
শ্যামল সঘন নববরষার কিশোর দূত কি এলে॥
ধানের ক্ষেতের পারে শালের ছায়ার ধারে
বাঁশির সুরেতে সুদূর দূরেতে চলেছ হৃদয় মেলে॥
পুবদিগন্ত দিল তব দেহে নীলিমলেখা,
পীত ধড়াটিতে অরুণরেখা,
কেয়াফুলখানি কবে তুলে আনি
দ্বারে মোর রেখে গেলে॥
আমার গানের হংসবলাকাপাঁতি
বাদল-দিনের তোমার মনের সাথি।
ঝড়ে চঞ্চল তমালবনের প্রাণে
তোমাতে আমাতে মিলিয়াছি একখানে,
মেঘের ছায়ায় চলিয়াছি ছায়া ফেলে॥
১২৬
বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান॥
মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে রেখেছি ঢেকে তারে
এই-যে আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান॥
আজ এনে দিলে, হয়তো দিবে না কাল-
রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।
এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে তব বিস্মৃতিস্রোতের প্লাবনে
ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী বহি তব সম্মান॥
১২৭
আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে
যে কথা শুনায়েছি বারে বারে॥
আমার পরানে আজি যে বাণী উঠিছে বাজি
অবিরাম বর্ষণধারে॥
কারণ শুধায়ো না, অর্থ নাহি তার,
সুরের সঙ্কেত জাগে পুঞ্জিত বেদনার।
স্বপ্নে যে বাণী মনে মনে ধ্বনিয়া উঠে ক্ষণে ক্ষণে
কানে কানে গুঞ্জরিব তাই
বাদলের অন্ধকারে॥
১২৮
এসো গো, জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি
বিজন ঘরের কোণে, এসো গো।
নামিল শ্রাবণসন্ধ্যা, কালো যূথীমালিকার মৃদু গন্ধে-
নীলবসন-অঞ্চল-ছায়া
সুখরজনী-সম মেলুক মনে॥
হারিয়ে গেছে মোর বাঁশি,
আমি কোন্ সুরে ডাকি তোমারে।
পথে চেয়ে-থাকা মোর দৃষ্টিখানি
শুনিতে পাও কি তাহার বাণী-
কম্পিত বক্ষের পরশ মেলে কি সজল সমীরণে॥
১২৯
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না॥
এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উদ্ভ্রান্ত মেঘে মন চায়
মন চায় ওই বলাকার পথখানি নিতে চিনে॥
মেঘমল্লারে সারা দিনমান
বাজে ঝরনার গান।
মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা- মন চায়
মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে॥
১৩০
শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়।
ক্ষণে ক্ষণে শর্বরী শিহরিয়া উঠে, হায়॥
তেমনি তোমার বাণী মর্মতলে যায় হানি সঙ্গোপনে,
ধৈরজ যায় যে টুটে, হায়॥
যেমন বরষাধারায় অরণ্য আপনা হারায় বারে বারে
ঘন রস-আবরণে
তেমনি তোমার স্মৃতি ঢেকে ফেলে মোর গীতি
নিবিড় ধারে আনন্দ-বরিষনে, হায়॥
১৩১
স্বপ্নে আমার মনে হল কখন ঘা দিলে আমার দ্বারে, হায়।
আমি জাগি নাই জাগি নাই গো,
তুমি মিলালে অন্ধকারে, হায়॥
অচেতন মনো-মাঝে তখন রিমিঝিমি ধ্বনি বাজে,
কাঁপিল বনের ছায়া ঝিল্লিঝঙ্কারে।
আমি জাগি নাই জাগি নাই গো, নদী বহিল বনের পারে॥
পথিক এল দুই প্রহরে পথের আহ্বান আনি ঘরে।
শিয়রে নীরব বীণা বেজেছিল কি জানি না-
জাগি নাই জাগি নাই গো,
ঘিরেছিল বনগন্ধ ঘুমের চারি ধারে॥
১৩২
শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে, শেষ কথা যাও ব’লে॥
সময় পাবে না আর, নামিছে অন্ধকার,
গোধূলিতে আলো-আঁধারে
পথিক যে পথ ভোলে॥
পশ্চিমগগনে ওই দেখা যায় শেষ রবিরেখা,
তমাল-অরণ্যে ওই শুনি শেষ কেকা।
কে আমার অভিসারিকা বুঝি বাহিরিল অজানারে খুঁজি,
শেষবার মোর আঙিনার দ্বার খোলে॥
১৩৩
এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে
সমুখের পথ দিয়ে পলাতকা ছায়া ফেলে॥
তোমার সে উদাসীনতা সত্য কিনা জানি না সে,
চঞ্চল চরণ গেল ঘাসে ঘাসে বেদনা মেলে॥
তখন পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু ঝরে জল,
শ্যামল বনান্তভূমি করে ছলোছল্।
তুমি চলে গেছ ধীরে ধীরে সিক্ত সমীরে,
পিছনে নীপবীথিকায় রৌদ্রছায়া যায় খেলে॥
১৩৪
এসেছিনু দ্বারে তব শ্রাবণরাতে,
প্রদীপ নিভালে কেন অঞ্চলঘাতে॥
অন্তরে কালো ছায়া পড়ে আঁকা
বিমুখ মুখের ছবি মনে রয় ঢাকা,
দুঃখের সাথি তারা ফিরিছে সাথে॥
কেন দিলে না মাধুরীকণা, হায় রে কৃপণা।
লাবণ্যলক্ষ্মী বিরাজে ভুবনমাঝে,
তারি লিপি দিলে না হাতে॥
১৩৫
নিবিড় মেঘের ছায়ায় মন দিয়েছি মেলে,
ওগো প্রবাসিনী, স্বপনে তব
তাহার বারতা কি পেলে॥
আজি তরঙ্গকলকল্লোলে দক্ষিণসিন্ধুর ক্রন্দনধ্বনি
আনে বহিয়া কাহার বিরহ॥
লুপ্ত তারার পথে চলে কাহার সুদূর স্মৃতি
নিশীথরাতের রাগিণী বহি।
নিদ্রাবিহীন ব্যথিত হৃদয়
ব্যর্থ শূন্যে তাকায়ে রহে॥
১৩৬
আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে
তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণগগনতলে॥
সে দিন যে রাগিণী গেছে থেমে, অতল বিরহে নেমে গেছে থেমে,
আজি পুবের হাওয়ায় হাওয়ায় হায় হায় হায় রে
কাঁপন ভেসে চলে॥
নিবিড় সুখে মধুর দুখে জড়িত ছিল সেই দিন-
দুই তারে জীবনের বাঁধা ছিল বীন।
তার ছিঁড়ে গেছে কবে একদিন কোন্ হাহারবে,
সুর হারায়ে গেল পলে পলে॥
১৩৭
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে॥
চেনাশোনার কোন্ বাইরে যেখানে পথ নাই নাই রে
সেখানে অকারণে যায় ছুটে॥
ঘরের মুখে আর কি রে কোন দিন সে যাবে ফিরে।
যাবে না, যাবে না-
দেয়াল যত সব গেল টুটে॥
বৃষ্টি-নেশা-ভরা সন্ধ্যাবেলা কোন্ বলরামের আমি চেলা,
আমার স্বপ্ন ঘিরে নাচে মাতাল জুটে-
যত মাতাল জুটে।
যা না চাইবার তাই আজি চাই গো,
যা না পাইবার তাই কোথা পাই গো।
পাব না, পাব না,
মরি অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে॥
১৩৮
আজি মেঘ কেটে গেছে সকালবেলায়,
এসো এসো এসো হাসিমুখে।
এসো আমার অলস দিনের খেলায়॥
স্বপ্ন যত জমেছিল আশা-নিরাশায়
তরুণ প্রাণের বিফল ভালোবাসায়
দিব অকূল-পানে ভাসায়ে ভাঁটার গাঙের ভেলায়।
দুঃখসুখের বাঁধন তারি গ্রন্থি দিব খুলে,
আজি ক্ষণেক-তরে মোরা রব আপন ভুলে।
যে গান হয় নি গাওয়া যে দান হয় নি পাওয়া-
আজি পুরব-হাওয়ায় তারি পরিতাপ
উড়াব অবহেলায়॥
১৩৯
সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণধারা-
অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরশহারা॥
চেয়ে থাকি যে শূন্যে অন্যমনে
সেথায় বিরহিনীর অশ্রু হরণ করেছে ওই তারা॥
অশত্থ পল্লবে বৃষ্টি ঝরিয়া মর্মরশব্দে
নিশীথের অনিদ্রা দেয় যে ভরিয়া।
মায়ালোক হতে ছায়াতরণী
ভাসায় স্বপ্ন পারাবারে-
নাহি তার কিনারা॥
১৪০
ওগো তুমি পঞ্চদশী,
পৌছিলে পূর্ণিমাতে।
মৃদুস্মিত স্বপ্নের আভাস তব বিহ্বল রাতে॥
ক্বচিৎ জাগরিত বিহঙ্গকাকলী
তব নবযৌবনে উঠিছে আকুলি ক্ষণে ক্ষণে।
প্রথম আষাঢ়ের কেতকীসৌরভ তব নিদ্রাতে॥
যেন অরণ্যমর্মর
গুঞ্জরি উঠে তব বক্ষে থরথর।
অকারণ বেদনার ছায়া ঘনায় মনের দিগন্তে,
ছলোছলো জল এনে দেয় তব নয়নপাতে॥
১৪১
আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়।
ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো॥
আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে, রহে না আবাসে মন হায়-
কোন্ কুসুমের আশে কোন্ ফুলবাসে সুনীল আকাশে মন ধায় গো॥
আজি কে যেন গো নাই, এ প্রভাতে তাই জীবন বিফল হয় গো-
তাই চারি দিকে চায়, মন কেঁদে গায় ‘এ নহে, এ নহে, নয় গো’।
কোন্ স্বপনের দেশে আছে এলোকেশে কোন্ ছায়াময়ী অমরায়।
আজি কোন্ উপবনে, বিরহবেদনে আমারি কারণে কেঁদে যায় গো॥
আমি যদি গাঁথি গান অথিরপরান, সে গান শুনাব কারে আর
আমি যদি গাঁথি মালা লয়ে ফুলডালা, কাহারে পরাব ফুলহার॥
আমি আমার এ প্রাণ যদি করি দান, দিব প্রাণ তবে কার পায়।
সদা ভয় হয় মনে পাছে অযতনে মনে মনে কেহ ব্যথা পায় গো॥
১৪২
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি। আহা, হাহা, হা।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি। আহা, হাহা, হা॥
কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন্ বনে যাই,
কোন্ মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি। আহা, হাহা, হা॥
কেয়া-পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে-
তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেব, চলবে দুলে দুলে।
রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে বেণু,
মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি। আহা, হাহা, হা॥
১৪৩
আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা-
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই- লুকোচুরি খেলা।
আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে- উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে,
আজ কিসের তরে নদীর চরে চখা-চখীর মেলা॥
ওরে, যাব না আজ ঘরে রে ভাই, যাব না আজ ঘরে।
ওরে, আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ নেব রে লুট ক’রে॥
যেন জোয়ার-জলে ফেনার রাশি বাতাসে আজ ছুটছে হাসি,
আজ বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা॥
১৪৪
আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা-
নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা॥
এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,
এসো নির্মল নীলপথে,
এসো ধৌত শ্যামল আলো-ঝলমল বনগিরিপর্বতে-
এসো মুকুটে পরিয়া শ্বেতশতদল শীতল-শিশির-ঢালা॥
ঝরা মালতীর ফুলে
আসন বিছানো নিভৃত কুঞ্জে ভরা গঙ্গার কূলে
ফিরিছে মরাল ডানা পাতিবারে তোমার চরণমূলে।
গুঞ্জরতান তুলিয়ো তোমার সোনার বীণার তারে
মৃদুমধু ঝঙ্কারে,
হাসি-ঢালা সুর গলিয়া পড়িবে ক্ষণিক অশ্রুধারে।
রহিয়া রহিয়া যে পরশমণি ঝলকে অলককোণে
পলকের তরে সকরুণ করে বুলায়ো বুলায়ো মনে-
সোনা হয়ে যাবে সকল ভাবনা, আঁধার হইবে আলা॥
১৪৫
অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া-
দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া॥
কোন্ সাগরের পার হতে আনে কোন্ সুদূরের ধন-
ভেসে যেতে চায় মন,
ফেলে যেতে চায় এই কিনারায় সব চাওয়া সব পাওয়া॥
পিছনে ঝরিছে ঝরো ঝরো জল, গুরু গুরু দেয়া ডাকে,
মুখে এসে পড়ে অরুণকিরণ ছিন্ন মেঘের ফাঁকে।
ওগো কাণ্ডারী, কে গো তুমি, কার হাসিকান্নার ধন
ভেবে মরে মোর মন-
কোন্ সুরে আজ বাঁধিবে যন্ত্র, কী মন্ত্র হবে গাওয়া॥
১৪৬
আমার নয়ন-ভুলানো এলে,
আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে॥
শিউলিতলার পাশে পাশে ঝরা ফুলের রাশে রাশে
শিশির-ভেজা ঘাসে ঘাসে অরুণরাঙা চরণ ফেলে
নয়ন-ভুলানো এলে॥
আলোছায়ার আঁচলখানি লুটিয়ে পড়ে বনে বনে,
ফুলগুলি ওই মুখে চেয়ে কী কথা কয় মনে মনে॥
তোমায় মোরা করব বরণ, মুখের ঢাকা করো হরণ,
ওইটুকু ওই মেঘাবরণ দু হাত দিয়ে ফেলো ঠেলে॥
বনদেবীর দ্বারে দ্বারে শুনি গভীর শঙ্খধ্বনি,
আকাশবীণার তারে তারে জাগে তোমার আগমনী।
কোথায় সোনার নূপুর বাজে, বুঝি আমার হিয়ার মাঝে
সকল ভাবে সকল কাজে পাষাণ-গালা সুধা ঢেলে-
নয়ন-ভুলানো এলে॥
১৪৭
শিউলি ফুল, শিউলি ফুল, কেমন ভুল এমন ভুল॥
রাতের বায় কোন্ মায়ায় আনিল হায় বনছায়ায়,
ভোরবেলায় বারে বারেই ফিরিবারে হলি ব্যাকুল॥
কেন রে তুই উন্মনা! নয়নে তোর হিমকণা।
কোন্ ভাষায় চাস বিদায়, গন্ধ তোর কী জানায়-
সঙ্গে হায় পলে পলেই দলে দলে যায় বকুল॥
১৪৮
শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে।
আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে॥
নীল আকাশের নীরব কথা শিশির-ভেজা ব্যাকুলতা
বেজে উঠুক আজি তোমার বীণার তারে তারে॥
শস্যক্ষেতের সোনার গানে যোগ দে রে আজ সমান তানে,
ভাসিয়ে দে সুর ভরা নদীর অমল জলধারে।
যে এসেছে তাহার মুখে দেখ্ রে চেয়ে গভীর সুরে,
দুয়ার খুলে তাহার সাথে বাহির হয়ে যা রে॥
১৪৯
আজ প্রথম ফুলের পাব প্রসাদখানি, তাই ভোরে উঠেছি।
আজ শুনতে পাব প্রথম আলোর বাণী, তাই বাইরে ছুটেছি॥
এই হল মোদের পাওয়া, তাই ধরেছি গান-গাওয়া,
আজ লুটিয়ে হিরণ-কিরণ-পদ্মদলে সোনার রেণু লুটেছি॥
আজ পারুলদিদির বনে মোরা চলব নিমন্ত্রণে,
আজ চাঁপা-ভায়ের শাখা-ছায়ের তলে মোরা সবাই জুটেছি।
আজ মনের মধ্যে ছেয়ে সুনীল আকাশ ওঠে গেয়ে,
আজ সকালবেলায় ছেলেখেলার ছলে সকল শিকল টুটেছি॥
১৫০
ওগো শেফালিবনের মনের কামনা,
কেন সুদূর গগনে গগনে
আছ মিলায়ে পবনে পবনে।
কেন কিরণে কিরণে ঝলিয়া।
যাও শিশিরে শিশিরে গলিয়া।
কেন চপল আলোতে ছায়াতে
আছ লুকায়ে আপন মায়াতে।
তুমি মুরতি ধরিয়া চকিতে নামো-না,
ওগো শেফালিবনের মনের কামনা॥
আজি মাঠে মাঠে চলো বিহরি,
তৃণ উঠুক শিহরি শিহরি।
নামো তালপল্লববীজনে,
নামো জলে ছায়াছবিসৃজনে।
এসো সৌরভ ভরি আঁচলে,
আঁখি আঁকিয়া সুনীল কাজলে।
মম চোখের সমুখে ক্ষণেক থামো-না,
ওগো শেফালিবনের মনের কামনা॥
ওগো সোনার স্বপন, সাধের সাধনা,
কত আকুল হাসি ও রোদনে,
রাতে দিবসে স্বপনে বোধনে
জ্বালি জোনাকি প্রদীপমালিকা,
ভরি নিশীথতিমিরথালিকা,
প্রাতে কুসুমের সাজি সাজায়ে,
সাঁঝে ঝিল্লি-ঝাঁঝর বাজায়ে,
কত করেছে তোমার স্তুতি-আরাধনা,
ওগো সোনার স্বপন, সাধের সাধনা॥
ওই বসেছ শুভ্র আসনে
আজি নিখিলের সম্ভাষণে।
আহা শ্বেতচন্দনতিলকে
আজি তোমারে সাজায়ে দিল কে।
আহা বরিল তোমারে কে আজি
তার দুঃখশয়ন তেয়াজি-
তুমি ঘুচালে কাহার বিরহকাঁদনা,
ওগো সোনার স্বপন, সাধের সাধনা॥
১৫১
শরত-আলোর কমলবনে
বাহির হয়ে বিহার করে যে ছিল মোর মনে মনে॥
তারি সোনার কাঁকন বাজে আজি প্রভাতকিরণ-মাঝে.
হাওয়ায় কাঁপে আঁচলখানি- ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে॥
আকুল কেশের পরিমলে
শিউলিবনে উদাস বায়ু পড়ে থাকে তরুতলে।
হৃদয়মাঝে হৃদয় দুলায়, বাহিরে সে ভুবন ভুলায়-
আজি সে তার চোখের চাওয়া ছড়িয়ে দিল নীল গগনে॥
১৫২
তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে।
জানি না কি মরণ নাচে, নাচে গো ওই চরণমূলে॥
শরৎ-আলোর আঁচল টুটে কিসের ঝলক নেচে উঠে,
ঝড় এনেছ এলোচুলে॥
কাঁপন ধরে বাতাসেতে-
পাকা ধানের তরাস লাগে, শিউরে ওঠে ভরা ক্ষেতে।
জানি গো আজ হাহারবে তোমার পূজা সারা হবে
নিখিল অশ্রু-সাগর-কূলে॥
১৫৩
শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি॥
শরৎ, তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে
বনের-পথে-লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি॥
মানিক-গাঁথা ওই-যে তোমার কঙ্কণে
ঝিলিক লাগায় তোমার শ্যামল অঙ্গনে।
কুঞ্জছায়া গুঞ্জরণের সঙ্গীতে
ওড়না ওড়ায় একি নাচের ভঙ্গীতে,
শিউলিবনের বুক যে ওঠে আন্দোলি॥
১৫৪
তোমরা যা বলো তাই বলো, আমার লাগে না মনে।
আমার যায় বেলা, বয়ে যায় বেলা কেমন বিনা কারণে॥
এই পাগল হাওয়া কী গান-গাওয়া
ছড়িয়ে দিয়ে গেল আজি সুনীল গগনে॥
সে গান আমার লাগল যে গো লাগল মনে,
আমি কিসের মধু খুঁজে বেড়াই ভ্রমরগুঞ্জনে।
ওই আকাশ-ছাওয়া কাহার চাওয়া
এমন ক’রে লাগে আজি আমার নয়নে॥
১৫৫
কোন্ খেপা শ্রাবণ ছুটে এল আশ্বিনেরই আঙিনায়।
দুলিয়ে জটা ঘনঘটা পাগল হাওয়ার গান সে গায়॥
মাঠে মাঠে পুলক লাগে ছায়ানটের নৃত্যরাগে,
শরৎ-রবির সোনার আলো উদাস হয়ে মিলিয়ে যায়॥
কী কথা সে বলতে এল ভরা ক্ষেতের কানে কানে
লুটিয়ে-পড়া কিসের কাঁদন উঠেছে আজ নবীন ধানে।
মেঘে অধীর আকাশ কেন ডানা-মেলা গরুড় যেন-
পথ-ভোলা এই পথিক এসে পথের বেদন আনল ধরায়॥
১৫৬
আকাশ হতে খসল তারা আঁধার রাতে পথহারা॥
প্রভাত তারে খুঁজতে যাবে- ধরার ধুলায় খুঁজে পাবে॥
তৃণে তৃণে শিশিরধারা॥
দুখের পথে গেল চলে- নিবল আলো, মরল জ্বলে।
রবির আলো নেমে এসে মিলিয়ে নেবে ভালোবেসে,
দুঃখ তখন হবে সারা॥
১৫৭
হৃদয়ে ছিলে জেগে,
দেখি আজ শরতমেঘে॥
কেমনে আজকে ভোরে গেল গো গেল সরে
তোমার ওই আঁচলখানি শিশিরের ছোঁওয়া লেগে॥
কী-যে গান গাহিতে চাই,
বাণী মোর খুঁজে না পাই।
সে যে ওই শিউলিদলে ছড়ালো কাননতলে,
সে যে ওই ক্ষণিক ধারায় উড়ে যায় বায়ুবেগে॥
১৫৮
সারা নিশি ছিলেম শুয়ে বিজন ভুঁয়ে
আমার মেঠো ফুলের পাশাপাশি,
তখন শুনেছিলেম তারার বাঁশি॥
যখন সকালবেলা খুঁজে দেখি স্বপ্নে-শোনা সে সুর একি
আমার মেঠো ফুলের চোখের জলে উঠে ভাসি॥
এ সুর আমি খুঁজেছিলেম রাজার ঘরে,
শেষে ধরা দিল ধরার ধূলির ’পরে।
এ যে ঘাসের কোলে আলোর ভাষা আকাশ-হতে-ভেসে-আসা-
এ যে মাটির কোলে মানিক-খসা হাসিরাশি॥
১৫৯
দেখো দেখো, দেখো, শুকতারা আঁখি মেলি চায়
প্রভাতের কিনারায়।
ডাক দিয়েছে রে শিউলি ফুলেরে-
আয় আয় আয়॥
ও যে কার লাগি জ্বালে দীপ,
কার ললাটে পরায় টিপ,
ও যে কার আগমনী গায়- আয় আয় আয়॥
জাগো জাগো সখী,
কাহার আশায় আকাশ উঠিল পুলকি।
মালতীর বনে বনে ওই শোনো ক্ষণে ক্ষণে
কহিছে শিশিরবায়- আয় আয় আয়॥
১৬০
ওলো শেফালি, ওলো শেফালি,
আমার সবুজ ছায়ার প্রদোষে তুই জ্বালিস দীপালি॥
তারার বাণী আকাশ থেকে তোমার রূপে দিল এঁকে
শ্যামল পাতার থরে থরে আখর রুপালি॥
তোমার বুকের খসা গন্ধ-আঁচল রইল পাতা সে
আমার গোপন কাননবীথির বিবশ বাতাসে।
সারাটা দিন বাটে বাটে নানা কাজে দিবস কাটে,
আমার সাঁঝে বাজে তোমার করুণ ভূপালি॥
১৬১
এসো শরতের অমল মহিমা, এসো হে ধীরে।
চিত্ত বিকাশিবে চরণ ঘিরে॥
বিরহতরঙ্গে অকূলে সে দোলে
দিবাযামিনী আকুল সমীরে॥
১৬২
এবার অবগুণ্ঠন খোলো।
গহন মেঘমায়ায় বিজন বনছায়ায়
তোমার আলসে অবলুণ্ঠন সারা হল॥
শিউলিসুরভি রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে
মৃদু মর্মরগানে তব মর্মের বাণী বোলো॥
বিষাদ-অশ্রুজলে মিলুক শরমহাসি-
মালতীবিতানতলে বাজুক বঁধুর বাঁশি।
শিশিরসিক্ত বায়ে বিজড়িত আলোছায়ে
বিরহ-মিলনে-গাঁথা নব প্রণয়দোলায় দোলো॥
১৬৩
তোমার নাম জানি নে, সুর জানি।
তুমি শরৎ-প্রাতের আলোর বাণী॥
সারা বেলা শিউলিবনে আছি মগন আপন মনে,
কিসের ভুলে রেখে গেলে আমার বুকে ব্যথার বাঁশিখানি॥
আমি যা বলিতে চাই হল বলা
ওই শিশিরে শিশিরে অশ্রু-গলা।
আমি যা দেখিতে চাই প্রাণের মাঝে
সেই মুরতি এই বিরাজে-
ছায়াতে-আলোতে-আঁচল-গাঁথা
আমার অকারণ বেদনার বীণাপাণি॥
১৬৪
মরি লো) কার বাঁশি নিশিভোরে বাজিল মোর প্রাণে
ফুটে দিগন্তে অরুণকিরণকলিকা॥
শরতের আলোতে সুন্দর আসে,
ধরণীর আঁখি যে শিশিরে ভাসে,
হৃদয়কুঞ্জবনে মুঞ্জরিল মধুর শেফালিকা॥
১৬৫
আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে।
বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে॥
তোমার বুকে বাজল ধ্বনি
বিদায়গাথা আগমনী কত যে-
ফাল্গুনে শ্রাবণে কত প্রভাতে রাতে॥
কে কথা রয় প্রাণের ভিতর অগোচরে
গানে গানে নিয়েছিলে চুরি ক’রে॥
সময় যে তার হল গত
নিশিশেষের তারার মতো-
শেষ করে দাও শিউলিফুলের মরণ-সাথে॥
১৬৬
নির্মল কান্ত, নমো হে নমো, নমো হে, নমো হে।
স্নিগ্ধ সুশান্ত, নমো হে নমো, নমো হে, নমো হে।
বন-অঙ্গন-ময় রবিকররেখা
লেপিল আলিম্পনলিপি-লেখা,
আঁকিব তাহে প্রণতি মম।
নমো হে নমো, নমো হে নমো, নমো হে নমো॥
১৬৭
আলোর অমল কমলখানি কে ফুটালে,
নীল আকাশের ঘুম ছুটালে॥
আমার মনের ভাবনাগুলি বাহির হল পাখা তুলি,
ওই কমলের পথে তাদের সেই জুটালে॥
শরতবাণীর বীণা বাজে কমলদলে।
ললিত রাগের সুর ঝরে তাই শিউলিতলে।
তাই তো বাতাস বেড়ায় মেতে কচি ধানের সবুজ ক্ষেতে,
বনের প্রাণে মর্মরানির ঢেউ উঠালে॥
১৬৮
সেই তো তোমার পথের বঁধু সেই তো।
দূর কুসুমের গন্ধ এনে খোঁজায় মধু সেই তো॥
সেই তো তোমার পথের বঁধু সেই তো।
এই আলো তার এই তো আঁধার, এই আছে এই নেই তো॥
১৬৯
পোহালো পোহালো বিভাবরী,
পূর্বতোরণে শুনি বাঁশরি॥
নাচে তরঙ্গ, তরী অতি চঞ্চল, কম্পিত অংশুককেতন-অঞ্চল,
পল্লবে পল্লবে পাগল জাগল আলসলালস পাসরি॥
উদয়-অচলতল সাজিল নন্দন, গগনে গগনে বনে জাগিল বন্দন,
কনককিরণঘন শোভন স্যন্দন- নামিছে শারদসুন্দরী।
দশদিক-অঙ্গনে দিগঙ্গনাদল ধ্বনিল শূন্য ভরি শঙ্খ সুমঙ্গল-
চলো রে চলো চলো তরুণযাত্রীদল তুমি নব মালতীমঞ্জরী॥
১৭০
নব কুন্দধবলদলসুশীতলা,
অতি সুনির্মলা, সুখসমুজ্জ্বলা,
শুভ সুবর্ণ-আসনে অচঞ্চলা॥
স্মিত-উদয়ারুণ-কিরণ-বিলাসিনী,
পূর্ণসিতাংশুবিভাসবিকাশিনী,
নন্দনলক্ষ্মী সুমঙ্গলা॥
১৭১
হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে॥
ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো- ‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’
শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,
কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।
যাক অবসাদ বিষাদ কালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো-
জ্বালাও আলো, আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে॥
দেবতারা আজ আছে চেয়ে- জাগো ধরার ছেলে মেয়ে,
আলোয় জাগাও যামিনীরে।
এল আঁধার দিন ফুরালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, জয় করো এই তামসীরে॥
১৭২
হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা-
হিমের ধন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা॥
সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,
কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা॥
ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।
আপন দানের আড়ালেতে রইলে কেন আসন পেতে,
আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন ক’রে রাখা॥
১৭৩
হেমন্তে কোন্ বসন্তেরই বাণী পূর্ণশশী ওই-যে দিল আনি॥
বকুল ডালের আগায় জ্যোৎস্না যেন ফুলের স্বপন লাগায়।
কোন্ গোপন কানাকানি পূর্ণশশী ওই-যে দিল আনি॥
আবেশ লাগে বনে শ্বেতকরবীর অকাল জাগরণে
ডাকছে থাকি থাকি ঘুমহারা কোন্ নাম-না জানা-পাখি।
কার মধুর স্মরণখানি পূর্ণশশী ওই-যে দিল আনি॥
১৭৪
সে দিন আমায় বলেছিলে আমার সময় হয় নাই-
ফিরে ফিরে চলে গেলে তাই॥
তখনো খেলার বেলা- বনে মল্লিকার মেলা,
পল্লবে পল্লবে বায়ু উতলা সদাই॥
আজি এল হেমন্তের দিন
কুহেলীবিলীন, ভূষণবিহীন।
বেলা আর নাই বাকি, সময় হয়েছে নাকি-
দিনশেষে দ্বারে বসে পথপানে চাই॥
১৭৫
নমো, নমো, নমো।
নমো, নমো, নমো॥
তুমি ক্ষুধার্তজনশরণ্য,
অমৃত-অন্ন-ভোগধন্য করো অন্তর মম॥
১৭৬
শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আম্লকির এই ডালে ডালে।
পাতাগুলি শির্শিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে॥
উড়িয়ে দেবার মাতন এসে কাঙাল তারে করল শেষে,
তখন তাহার ফলের বাহার রইল না আর অন্তরালে॥
শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা
তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা॥
শীতের পরশ থেকে থেকে যায় বুঝি ওই ডেকে ডেকে,
সব খোওয়াবার সময় আমার হবে কখন কোন্ সকালে॥
১৭৭
শিউলি-ফোটা ফুরোল যেই ফুরোল শীতের বনে
এলে যে-
আমার শীতের বনে এলে যে সেই শূন্যক্ষণে॥
তাই গোপনে সাজিয়ে ডালা দুখের সুরে বরণমালা।
গাঁথি মনে মনে শূন্যক্ষণে॥
দিনের কোলাহলে
ঢাকা সে যে রইবে হৃদয়তলে-
আমার বরণমালা রইবে হৃদয়তলে॥
রাতের তারা উঠবে যবে সুরের মালা বদল হবে
তখন তোমার সনে মনে মনে॥
১৭৮
এল যে শীতের বেলা বরষ-পরে।
এবার ফসল কাটো, লও গো ঘরে॥
করো ত্বরা, করো ত্বরা, কাজ আছে মাঠ-ভরা-
দেখিতে দেখিতে দিন আঁধার করে॥
বাহিরে কাজের পালা হইবে সারা
আকাশে উঠিবে যবে সন্ধ্যাতারা-
আসন আপন হাতে পেতে রেখো আঙিনাতে
যে সাথি আসিবে রাতে তাহারি তরে॥
১৭৯
পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আয় আয় আয়।
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, মরি হায় হায় হায়॥
হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে দিগ্বধূরা ধানের ক্ষেতে-
রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে, মরি হায় হায় হায়॥
মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হল।
ঘরেতে আজ কে রবে গো, খোলো খোলো দুয়ার খোলো।
ধরার খুশি ধরে না গো, ওই-যে উথলে, মরি হায় হায় হায়॥
১৮০
ছাড়্ গো তোরা ছাড়্ গো,
আমি চলব সাগর-পার গো॥
বিদায়বেলায় একি হাসি, ধরলি আগমনীর বাঁশি—
যাবার সুরে আসার সুরে করলি একাকার গো॥
সবাই আপন-পানে আমায় আবার কেন টানে।
পুরানো শীত পাতা-ঝরা, তারে এমন নূতন-করা!
মাঘ মরিল ফাগুন হয়ে খেয়ে ফুলের মার গো॥
রঙের খেলার ভাই রে, আমার সময় হাতে নাই রে।
তোমাদের ওই সবুজ ফাগে চক্ষে আমার ধাঁদা লাগে—
আমায় তোদের প্রাণের দাগে দাগিস নে, ভাই, আর গো ॥
১৮১
আমরা নূতন প্রাণের চর, হা হা।
আমরা থাকি পথে ঘাটে, নাই আমাদের ঘর। হা হা ॥
নিয়ে পক্ব পাতার পুঁজি পালাবে শীত ভাবছ বুঝি গো?
ও-সব কেড়ে নেব, উড়িয়ে দেব দখিন হাওয়ার ’পর। হা হা ॥
তোমায় বাঁধব নূতন ফুলের মালায়
বসন্তের এই বন্দীশালায়।
জীর্ণ জরার ছদ্মরূপে এড়িয়ে যাবে চুপে চুপে?
তোমার সকল ভূষণ ঢাকা আছে, নাই যে অগোচর হা হা ॥
১৮২
আর নাই যে দেরি, নাই যে দেরি।
সামনে সবার পড়ল ধরা তুমি যে, ভাই, আমাদেরই॥
হিমের বাহু বাঁধন টুটি পাগ্লাঝোরা পাবে ছুটি,
উত্তরে এই হাওয়া তোমার বইবে উজান কুঞ্জ ঘেরি॥
আর নাই যে দেরি, নাই যে দেরি।
শুনছ না কি জলে স্থলে জাদুকরের বাজল ভেরী।
দেখছ নাকি এই আলোকে খেলছ হাসি রবির চোখে—
সাদা তোমার শ্যামল হবে, ফিরব মোরা তাই যে হেরি॥
১৮৩
এ কী মায়া, লুকাও কায়া জীর্ণ শীতের সাজে।
আমার সয় না, সয় না, সয় না প্রাণে, কিছুতে সয় না যে॥
কৃপণ হয়ে হে মহারাজ, রইবে কি আজ
আপন ভুবন-মাঝে॥
বুঝতে নারি বনের বীণা তোমার প্রসাদ পাবে কিনা,
হিমের হাওয়ায় গগন-ভরা ব্যাকুল রোদন বাজে॥
কেন মরুর পারে কাটাও বেলা রসের কাণ্ডারী।
লুকিয়ে আছে কোথায় তোমার রূপের ভাণ্ডারী।
রিক্তপাতা শুষ্ক শাখে কোকিল তোমার কই গো ডাকে-
শূন্য সভা, মৌন বাণী, আমরা মরি লাজে॥
১৮৪
মোরা ভাঙব তাপস, ভাঙব তোমার কঠিন তপের বাঁধন-
এবার এই আমাদের সাধন॥
চল্ কবি, চল্ সঙ্গে জুটে, কাজ ফেলে তুই আয় আয় আয় রে ছুটে,
গানে গানে উদাস প্রাণে
জাগা রে উন্মাদন, এবার জাগা রে উন্মাদন॥
বকুলবনের মুগ্ধ হৃদয় উঠুক-না উচ্ছ্বাসি,
নীলাম্বরের মর্ম-মাঝে বাজাও তোমার সোনার বাঁশি বাজাও।
পলাশরেণুর রঙ মাখিয়ে নবীন বসন এনেছি এ,
সবাই মিলে দিই ঘুচিয়ে
পুরানো আচ্ছাদন, তোমার পুরানো আচ্ছাদন॥
১৮৫
শীতের বনে কোন্ সে কঠিন আসবে ব’লে
শিউলিগুলি ভয়ে মলিন বনের কোলে॥
আম্লকি-ডাল সাজাল কাঙাল, খসিয়ে দিল পল্লবজাল,
কাশের হাসি হাওয়ায় ভাসি যায় যে চলে॥
সইবে না সে পাতায় ঘাসে চঞ্চলতা,
তাই তো আপন রঙ ঘুচালো ঝুম্কোলতা।
উত্তরবায় জানায় শাসন, পাতাল তপের শুষ্ক আসন,
সাজ-খসাবার এই লীলা কার অট্টরোলে॥
১৮৬
নমো, নমো। নমো, নমো। নমো, নমো।
নির্দয় অতি করুণা তোমার- বন্ধু, তুমি হে নির্মম॥
যা-কিছু জীর্ণ করিবে দীর্ণ
দণ্ড তোমার দুর্দম॥
১৮৭
হে সন্ন্যাসী,
হিমগিরি ফেলে নীচে নেমে এলে কিসের জন্য।
কুন্দমালতী করিছে মিনতি, হও প্রসন্ন॥
যাহা-কিছু ম্লান বিরস জীর্ণ দিকে দিকে দিলে করি বিকীর্ণ।
বিচ্ছেদভারে বনচ্ছায়ারে করে বিষণ্ণ- হও প্রসন্ন॥
সাজাবে কি ডালা, গাঁথিবে কি মালা মরণসত্রে!
তাই উত্তরী নিলে ভরি ভরি শুকানো পত্রে?
ধরণী যে তব তাণ্ডবে সাথি প্রলয়বেদনা নিল বুকে পাতি।
রুদ্র, এবারে বরবেশে তারে করো গো ধন্য- হও প্রসন্ন॥
১৮৮
নব বসন্তের দানের ডালি
এনেছি তোদেরই দ্বারে,
আয় আয় আয়
পরিবি গলার হারে॥
লতার বাঁধন হারায়ে মাধবী মরিছে কেঁদে,
বেণীর বাঁধনে রাখিবি, বেঁধে-
অলকদোলায় দোলাবি তারে
আয় আয় আয়॥
বনমাধুরী করিবি চুরি আপন নবীন মাধুরীতে-
সোহিণী রাগিণী জাগাবে সে তোদের
দেহের বীণার তারে তারে,
আয় আয় আয়॥
১৮৯
এস’ এস’ বসন্ত, ধরাতলে।
আন’ মুহু মুহু নব তান, আন’ নব প্রাণ নব গান।
আন’ গন্ধমদভরে অলস সমীরণ।
আন’ বিশ্বের অন্তরে অন্তরে নিবিড় চেতনা।
আন’ নব উল্লাসহিল্লোল।
আন’ আন’ আনন্দছন্দের হিন্দোলা ধরাতলে।
ভাঙ’ ভাঙ’ বন্ধনশৃঙ্খল।
আন’ আন’ উদ্দীপ্ত প্রাণের বেদনা ধরাতলে।
এস’ থরথরকম্পিত মর্মরমুখরিত নবপল্লবপুলকিত
ফুল- আকুল মালতীবল্লিবিতানে- সুখছায়ে, মধুবায়ে।
এস’ বিকশিত উন্মুখ, এস’ চির-উৎসুক নন্দনপথচিরযাত্রী।
এস’ স্পন্দিত নন্দিত চিত্তনিলয়ে গানে গানে, প্রাণে প্রাণে।
এস’ অরুণচরণ কমলবরন তরুণ উষার কোলে।
এস’ জ্যোৎস্নাবিবশ নিশীথে, কলকল্লোল তটিনী-তীরে,
সুখ- সুপ্ত সরসী নীরে। এস’ এস’।
এস’ তড়িৎ-শিখা-সম ঝঞ্ঝাচরণে সিন্ধুতরঙ্গদোলে।
এস’ জাগর মুখর প্রভাতে।
এস’ নগরে প্রান্তরে বনে।
এস’ কর্মে বচনে চরণে। এস’ এস’
এস’ মঞ্জীরগুঞ্জর চরণে।
এস’ গীতমুখর কলকণ্ঠে।
এস’ মঞ্জুল মল্লিকামাল্যে।
এস’ কোমল কিশলয়বসনে।
এস’ সুন্দর, যৌবনবেগে।
এস’ দৃপ্ত বীর, নবতেজে।
ওহে, দুর্মদ, কর জয়যাত্রা,
চল’ জরাপরাভব সমরে
পবনে কেশররেণু ছড়ায়ে,
চঞ্চল কুন্তল উড়ায়ে॥
১৯০
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে॥
আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,
আজি ভুলিয়ো আপন পর ভুলিয়ো,
এই সঙ্গীতমুখরিত গগনে
তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো।
এই বাহির-ভুবনে দিশা হারায়ে
দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে॥
একি নিবিড় বেদনা বনমাঝে
আজি পল্লবে পল্লবে বাজে-
দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া
আজি ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে।
মোর পরানে দখিনবায়ু লাগিছে,
কারে দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে-
এই সৌরভবিহ্বল রজনী
কার চরণে ধরণীতলে জাগিছে।
ওহে সুন্দর, বল্লভ, কান্ত,
তব গম্ভীর আহ্বান কারে॥
১৯১
এনেছ ওই শিরীষ বকুল আমের মুকুল সাজিখানি হাতে করে।
কবে যে সব ফুরিয়ে দেবে, চলে যাবে দিগন্তরে॥
পথিক, তোমায় আছে জানা, করব না গো তোমায় মানা-
যাবার বেলায় যেয়ো যেয়ো বিজয়মালা মাথায় প’রে॥
তবু তুমি আছ যতক্ষণ
অসীম হয়ে ওঠে হিয়ায় তোমারি মিলন।
যখন যাবে তখন প্রাণে বিরহ মোর ভরবে গানে-
দূরের কথা সুরে বাজে সকল বেলা ব্যথায় ভ’রে॥
১৯২
ও মঞ্জরী, ও মঞ্জরী আমের মঞ্জরী,
আজ হৃদয় তোমার উদাস হয়ে পড়ছে কি ঝরি॥
আমার গান যে তোমার গন্ধে মিশে দিশে দিশে
ফিরে ফিরে ফেরে গুঞ্জরি॥
পূর্ণিমাচাঁদ তোমার শাখায় শাখায়
তোমার গন্ধ-সাথে আপন আলো মাখায়।
ওই দখিন-বাতাস গন্ধে পাগল ভাঙল আগল,
ঘিরে ঘিরে ফিরে সঞ্চরি॥
১৯৩
কার যেন এই মনের বেদন চৈত্রমাসের উতল হাওয়ায়,
ঝুমকোলতার চিকন পাতা কাঁপে রে কার চম্কে-চাওয়ায়॥
হারিয়ে-যাওয়া কার সে বাণী কার সোহাগের স্মরণখানি
আমের বোলের গন্ধে মিশে
কাননকে আজ কান্না পাওয়ায়॥
কাঁকন-দুটির রিনিঝিনি কার বা এখন মনে আছে।
সেই কাঁকনের ঝিকিমিকি পিয়ালবনের শাখায় নাচে।
যার চোখের ওই আভাস দোলে নদী-ঢেউয়ের কোলে কোলে
তার সাথে মোর দেখা ছিল
সেই সেকালের তরী-বাওয়ায়॥
১৯৪
দোলে দোলে দোলে প্রেমের দোলন-চাঁপা হৃদয়-আকাশে,
দোল-ফাগুনের চাঁদের আলোর সুধায় মাখা সে॥
কৃষ্ণরাতের অন্ধকারে বচনহারা ধ্যানের পারে
কোন্ স্বপনের পর্ণপুটে ছিল ঢাকা সে॥
দখিন-হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল গোপন রেণুকা।
গন্ধে তারি ছন্দে মাতে কবির বেণুকা।
কোমল প্রাণের পাতে পাতে লাগল যে রঙ পূর্ণিমাতে
আমার গানের সুরে সুরে রইল আঁকা সে॥
১৯৫
অনন্তের বাণী তুমি, বসন্তের মাধুরী-উৎসবে
আনন্দের মধুপাত্র পরিপূর্ণ করি দিবে কবে॥
বঞ্জুলনিকুঞ্জতলে সঞ্চরিবে লীলাচ্ছলে,
চঞ্চল অঞ্চলগন্ধে বনচ্ছায়া রোমাঞ্চিত হবে॥
মন্থর মঞ্জুল ছন্দে মঞ্জীরের গুঞ্জনকল্লোল
আন্দোলিবে ক্ষণে ক্ষণে অরণ্যের হৃদয়হিল্লোল।
নয়নপল্লবে হাসি হিল্লোলি উঠিবে ভাসি,
মিলনমল্লিকামাল্য পরাইবে পরানবল্লভে॥
১৯৬
এবার এল সময় রে তোর শুক্নো-পাতা-ঝরা-
যায় বেলা যায়, রৌদ্র হল খরা॥
অলস ভ্রমর ক্লান্তপাখা মলিন ফুলের দলে
অকারণে দোল দিয়ে যায় কোন্ খেয়ালের ছলে।
স্তব্ধ বিজন ছায়াবীথি
বনের-ব্যথা-ভরা॥
মনের মাঝে গান থেমেছে সুর নাহি আর লাগে-
শ্রান্ত বাঁশি আর তো নাহি জাগে।
যে গেঁথেছে মালাখানি সে গিয়েছে ভুলে,
কোন্কালে সে পারে গেল সুদূর-নদীকূলে।
রইল রে তোর অসীম আকাশ,
অবাধপ্রসার ধরা॥
১৯৭
ওরে গৃহবাসী খোল্, দ্বার খোল্ লাগল যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥
রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে,
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে,
নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥
বেণুবন মর্মরে দখিন বাতাসে,
প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে।
মউমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিনা,
পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা,
মাধবীবিতানে বায়ুগন্ধে বিভোল।
দ্বার খোল্ দ্বার খোল্॥
১৯৮
একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি-
তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী॥
কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা,
তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি॥
যেটুকু কাছেতে আসে ক্ষণিকের ফাঁকে ফাঁকে
চকিতে মনের কোণে স্বপনের ছবি আঁকে।
যেটুকু যায় রে দূরে ভাবনা কাঁপায় সুরে,
তাই নিয়ে যায় বেলা নূপুরের তাল গুনি॥
১৯৯
ওগো বধূ সুন্দরী, তুমি মধুমঞ্জরী,
পুলকিত চম্পার লহো অভিনন্দন-
পর্ণের পাত্রে ফাল্গুনরাত্রে মুকুলিত মল্লিকা-মাল্যের বন্ধন।
এনেছি বসন্তের অঞ্জলি, গন্ধের,
পলাশের কুঙ্কুম চাঁদিনির চন্দন-
পারুলের হিল্লোল, শিরীষের হিল্লোল, মঞ্জল বল্লীর বঙ্কিম কঙ্কণ-
উল্লাস-উতরোল বেণুবনকল্লোল,
কম্পিত কিশলয়ে মলয়ের চুম্বন।
তব আঁখিপল্লবে দিয়ো আঁখি বল্লভে
গগনের নবনীল স্বপনের অঞ্জন॥
২০০
আমার বনে বনে ধরল মুকুল,
বহে মনে মনে দক্ষিণহাওয়া।
মৌমাছিদের ডানায় ডানায়
যেন উড়ে মোর উৎসুক চাওয়া॥
গোপন স্বপনকুসুমে কে এমন সুগভীর রঙ দিল এঁকে-
নব কিশলয়শিহরনে ভাবনা আমার হল ছাওয়া॥
ফাল্গুনপূর্ণিমাতে
এই দিশাহারা রাতে
নিদ্রাবিহীন গানে কোন্ নিরুদ্দেশের পানে
উদ্বেল গন্ধের জোয়ারতরঙ্গে হবে মোর তরণী বাওয়া॥