পূজা ও প্রার্থনা
১
গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে,
তারকামণ্ডল চমকে মোতি রে॥
ধূপ মলয়ানিল, পবন চামর করে,
সকল বনরাজি ফুলন্ত জ্যোতি রে॥
কেমন আরতি, হে ভবখণ্ডন, তব আরতি-
অনাহত শব্দ বাজন্ত ভেরী রে॥
২
এ হরিসুন্দর, এ হরিসুন্দর, মস্তক নমি তব চরণ-’পরে॥
সেবকজনের সেবায় সেবায়, প্রেমিকজনের প্রেমমহিমায়,
দুঃখীজনের বেদনে বেদনে, সুখীর আনন্দে সুন্দর হে,
মস্তক নমি তব চরণ-’পরে॥
কাননে কাননে শ্যামল শ্যামল পর্বতে পর্বতে উন্নত উন্নত,
নদীতে নদীতে চঞ্চল চঞ্চল, সাগরে সাগরে গম্ভীর হে,
হে,মস্তক নমি তব চরণ-’পরে।
চন্দ্র সূর্য জ্বালে নির্মল দীপ- তব জগমন্দির উজল করে,
মস্তক নমি তব চরণ-’পরে॥
৩
আমরা যে শিশু অতি, অতিক্ষুদ্র মন-
পদে পদে হয়, পিতা, চরণস্খলন॥
রুদ্রমুখ কেন তবে দেখাও মোদের সবে।
কেন হেরি মাঝে মাঝে ভ্রুকুটি ভীষণ॥
ক্ষুদ্র আমাদের ’পরে করিয়ো না রোষ-
স্নেহবাক্যে বলো, পিতা, কী করেছি দোষ!
শতবার লও তুলে, শতবার পড়ি ভুলে-
কী আর করিতে পারে দুর্বল যে জন॥
পৃথ্বীর ধূলিতে, দেব, মোদের ভবন-
পৃথ্বীর ধূলিতে অন্ধ মোদের নয়ন।
জন্মিয়াছি শিশু হয়ে, খেলা করি ধূলি লয়ে -
মোদের অভয় দাও দুর্বলশরণ॥
একবার ভ্রম হলে আর কি লবে না কোলে,
অমনি কি দূরে তুমি করিবে গমন।
তা হলে যে আর কভু উঠিতে নারিব প্রভু,
ভূমিতলে চিরদিন রব অচেতন॥
৪
মহাসিংহাসনে বসি শুনিছ, হে বিশ্বপিত,
তোমারি রচিত ছন্দে মহান্ বিশ্বের গীত॥
মর্তের মৃত্তিকা হয়ে ক্ষুদ্র এই কণ্ঠ লয়ে
আমিও দুয়ারে তব হয়েছি হে উপনীত॥
কিছু নাহি চাহি, দেব, কেবল দর্শন মাগি।
তোমারে শুনাব গীত, এসেছি তাহারি লাগি।
গাহে যেথা রবি শশী সেই সভামাঝে বসি
একান্তে গাহিতে চাহে এই ভকতের চিত॥
৫
দিবানিশি করিয়া যতন
হৃদয়েতে রচেছি আসন-
জগতপতি হে, কৃপা করি হেথা কি করিবে আগমন॥
অতিশয় বিজন এ ঠাঁই, কোলাহল কিছু হেথা নাই-
হৃদয়ের নিভৃত নিলয় করেছি যতনে প্রক্ষালন।
বাহিরের দীপ রবি তারা ঢালে না সেথায় করধারা-
তুমিই করিবে শুধু দেব, সেথায় কিরণবরিষণ।
দূরে বাসনা চপল, দূরে প্রমোদ-কোলাহল-
বিষয়ের মান-অভিমান করেছে সুদূরে পলায়ন।
কেবল আনন্দ বসি সেথা, মুখে নাই একটিও কথা-
তোমারি সে পুরোহিত, প্রভু, করিবে তোমারি আরাধন
নীরবে বসিয়া অবিরল চরণে দিবে সে অশ্রুজল,
দুয়ারে জাগিয়া রবে একা মুদিয়া সজল দু’নয়ন॥
৬
কোথা আছ, প্রভু, এসেছি দীনহীন,
আলয় নাহি মোর অসীম সংসারে!
অতি দূরে দূরে ভ্রমিছি আমি হে ‘প্রভু প্রভু’ ব’লে ডাকি কাতরে॥
সাড়া কি দিবে না। দীনে কি চাবে না। রাখিবে ফেলিয়া অকূল আঁধারে?
পথ যে জানি নে, রজনী আসিছে, একেলা আমি যে এ বনমাঝারে॥
জগতজননী, লহো লহো কোলে, বিরাম মাগিছে শ্রান্ত শিশু এ।
পিয়াও অমৃত, তৃষিত সে অতি- জুড়াও তাহারে স্নেহ বরষিয়ে॥
ত্যজি সে তোমারে গেছিল চলিয়া, কাঁদিছে আজিকে পথ হারাইয়ে-
আর সে যাবে না, রহিবে সাথ-সাথ ধরিবে তব হাত ভ্রমিবে নির্ভয়ে॥
এসো তবে, প্রভু, স্নেহনয়নে এ-মুখ-পানে চাও-ঘুচিবে যাতনা,
পাইব নব বল, মুছিব অশ্রুজল, চরণ ধরিয়ে পূরিবে কামনা॥
৭
কী করিলি মোহের ছলনে।
গৃহ তেয়াগিয়া প্রবাসে ভ্রমিলি, পথ হারাইলি গহনে॥
ওই সময় চলে গেল, আঁধার হয়ে এল, মেঘ ছাইল গগনে।
শ্রান্ত দেহ আর চলিতে চাহে না, বিঁধিছে কণ্টক চরণে॥
গৃহে ফিরে যেতে প্রাণ কাঁদিছে, এখন ফিরিব কেমনে।
‘পথ বলে দাও’ ‘পথ বলে দাও’ কে জানে কারে ডাকি সঘনে॥
বন্ধু যাহারা ছিল সকলে চলে গেল, কে আর রহিল এ বনে।
ওরে, জগতসখা আছে, যা রে তাঁর কাছে, বেলা যে যায় মিছে রোদনে॥
দাঁড়ায়ে গৃহদ্বারে জননী ডাকিছে, আয় রে ধরি তাঁর চরণে।
পথের ধূলি লেগে অন্ধ আঁখি মোর, মায়েরে দেখেও দেখিলি নে।
কোথা গো কোথা তুমি জননী, কোথা তুমি,
ডাকিছ কোথা হতে এ জনে।
হাতে ধরিয়ে সাথে লয়ে চলো তোমার অমৃতভবনে॥
৮
দেখ্ চেয়ে দেখ্ তোরা জগতের উৎসব।
শোন্ রে অনন্তকাল উঠে জয়-জয় রব॥
জগতের যত কবি গ্রহ তারা শশী রবি
অনন্ত আকাশে ফিরি গান গাহে নব নব।
কী সৌন্দর্য অনুপম না জানি দেখেছে তারা,
না জানি করেছে পান কী মহা অমৃতধারা।
না জানি কাহার কাছে ছুটে তারা চলিয়াছে-
আনন্দে ব্যাকুল যেন হয়েছে নিখিল ভব।
দেখ্ রে আকাশে চেয়ে, কিরণে কিরণময়।
দেখ্ রে জগতে চেয়ে, সৌন্দর্যপ্রবাহ বয়।
আঁখি মোর কার দিকে চেয়ে আছে অনিমিখে-
কী কথা জাগিছে প্রাণে কেমনে প্রকাশি কব॥
৯
আজি শুভদিনে পিতার ভবনে অমৃতসদনে চলো যাই,
চলো চলো, চলো ভাই॥
না জানি সেথা কত সুখ মিলিবে আনন্দের নিকেতনে-
চলো চলো, চলো যাই॥
মহোৎসবে ত্রিভুবন মাতিল, কী আনন্দ উথলিল-
চলো চলো, চলো ভাই॥
দেবলোকে উঠিয়াছে জয়গান গাহো সবে একতান-
বলো সবে জয়-জয়॥
১০
বড়ো আশা ক’রে এসেছি গো, কাছে ডেকে লও,
ফিরায়ো না জননী॥
দীনহীনে কেহ চাহে না, তুমি তারে রাখিবে জানি গো।
আর আমি-যে কিছু চাহি নে, চরণতলে বসে থাকিব।
আর আমি-যে কিছু চাহি নে, জননী ব’লে শুধু ডাকিব।
তুমি না রাখিলে, গৃহ আর পাইব কোথা, কেঁদে কেঁদে কোথা বেড়াব-
ওই-যে হেরি তমসঘনঘোরা গহন রজনী॥
১১
বর্ষ ওই গেল চলে।
কত দোষ করেছি যে, ক্ষমা করো-লহো কোলে॥
শুধু আপনারে লয়ে সময় গিয়েছে বয়ে-
চাহি নি তোমার পানে, ডাকি নাই পিতা ব’লে॥
অসীম তোমার দয়া, তুমি সদা আছ কাছে-
অনিমেষ আঁখি তব মুখপানে চেয়ে আছে।
স্মরিয়ে তোমার স্নেহ পুলকে পূরিছে দেহ-
প্রভু গো, তোমারে কভু আর না রহিব ভুলে॥
১২
তুমি কি গো পিতা আমাদের!
ওই-যে নেহারি মুখ অতুল স্নেহের॥
ওই-যে নয়নে তব অরুণকিরণ নব,
বিমল চরণতলে ফুল ফুটে প্রভাতের॥
ওই কি স্নেহের রবে ডাকিছ মোদের সবে।
তোমার আসন ঘেরি দাঁড়াব কি কাছে গিয়া!
হৃদয়ের ফুলগুলি যতনে ফুটায়ে তুলি
দিবে কি বিমল করি প্রসাদসলিল দিয়া॥
১৩
প্রভু, এলেম কোথায়।
কখন বরষ গেল, জীবন বহে হায়।
কখন কী-যে হল জানি নে হায়।
আসিলাম কোথা হতে, যেতেছি কোন্ পথে
ভাসিয়ে কালস্রোতে তৃণের প্রায়।
মরণসাগর-পানে চলেছি প্রতিক্ষণ,
তবুও দিবানিশি মোহেতে অচেতন।
এ জীবন অবহেলে আঁধারে দিনু ফেলে-
কত-কী গেল চলে, কত-কী যায়।
শোকে তাপে জরজর অসহ যাতনায়
শুকায়ে গেছে প্রেম, হৃদয় মরুপ্রায়।
কাঁদিয়ে হলেম সারা, হয়েছি দিশাহারা-
কোথা গো ধ্রুবতারা কোথা গো হায়।
১৪
সংসারেতে চারি ধার করিয়াছে অন্ধকার,
নয়নে তোমার জ্যোতি অধিক ফুটেছে তাই।
চৌদিকে বিষাদঘোরে ঘেরিয়া ফেলেছে মোরে,
তোমার আনন্দমুখ হৃদয়ে দেখিতে পাই।
ফেলিয়া শোকের ছায়া মৃত্যু ফিরে পায় পায়,
যতনের ধন যত কেড়ে কেড়ে নিয়ে যায়।
তবু সে মৃত্যুর মাঝে অমৃতমুরতি রাজে,
মৃত্যুশোক পরিহরি ওই মুখপানে চাই।
তোমার আশ্বাসবাণী শুনিতে পেয়েছি প্রভু,
মিছে ভয় মিছে শোক আর করিব না কভু।
হৃদয়ের ব্যথা কব অমৃত যাচিয়া লব-
তোমার অভয়-কোলে পেয়েছি পেয়েছি ঠাঁই।
১৫
কী দিব তোমায়। নয়নেতে অশ্রুধার,
শোকে হিয়া জরজর হে॥
দিয়ে যাব হে, তোমারি পদতলে
আকুল এ হৃদয়ের ভার॥
১৬
তোমারেই প্রাণের আশা কহিব!
সুখে-দুখে-শোকে আঁধারে-আলোকে চরণে চাহিয়া রহিব॥
কেন এ সংসারে পাঠালে আমারে তুমিই জান তা প্রভু গো।
তোমারি আদেশে রহিব এ দেশে, সুখ দুখ যাহা দিবে সহিব॥
যদি বনে কভু পথ হারাই, প্রভু, তোমারি নাম লয়ে ডাকিব।
বড়োই প্রাণ যবে আকুল হইবে চরণ হৃদয়ে লইব॥
তোমারি জগতে প্রেম বিলাইব, তোমারি কার্য যা সাধিব-
শেষ হয়ে গেলে ডেকে নিয়ো কোলে। বিরাম আর কোথা পাইব॥
১৭
হাতে লয়ে দীপ অগণন চরাচর কার সিংহাসন
নীরবে করিছে প্রদক্ষিণ।
চারি দিকে কোটি কোটি লোক লয়ে নিজ সুখ দুঃখ শোক
চরণে চাহিয়া চিরদিন।
সূর্য তাঁরে কহে অনিবার, ‘মুখপানে চাহো একবার,
ধরণীরে আলো দিব আমি।’
চন্দ্র কহিতেছে গান গেয়ে, ‘হাসো প্রভু, মোর পানে চেয়ে,
জ্যোৎস্নাসুধা বিতরিব স্বামী।’
মেঘ গাহে চরণে তাঁহার ‘দেহো, প্রভু, করুণা তোমার,
ছায়া দিব, দিব বৃষ্টিজল।’
বসন্ত গাহিছে অনুক্ষণ, ‘হৃদয়ে দেহো গো প্রেমবারি,
জগতে বিলাব ভালোবাসা।’
‘পূরাও পূরাও মনস্কাম’ কাহারে ডাকিছে অবিশ্রাম
জগতের ভাষাহীন ভাষা॥
১৮
সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।
কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা॥
ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।
যা- কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্ত্বনা॥
সুখ-আশে দিশে দিশে বেড়ায় কাতরে-
মরীচিকা ধরিতে চায় এ মরুপ্রান্তরে॥
ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা, সন্ধ্যা হয়ে আসে-
কাঁদে তখন আকুল-মন, কাঁপে তরাসে॥
কী হবে গতি, বিশ্বপতি, শান্তি কোথা আছে-
তোমারে দাও, আশা পূরাও, তুমি এসো কাছে॥
১৯
রজনী পোহাইল- চলেছে যাত্রীদল,
আকাশ পূরিল কলরবে।
সবাই যেতেছে মহোৎসবে॥
কুসুম ফুটেছে বনে, গাহিছে পাখিগণে-
এমন প্রভাত কি আর হবে।
নিদ্রা আর নাই চোখে বিমল অরুণালোকে
জাগিয়া উঠেছে আজি সবে॥
চলো গো পিতার ঘরে, সারা বৎসরের তরে
প্রসাদ-অমৃত ভিক্ষা লবে॥
ওই হেরো তাঁর দ্বার জগতের পরিবার
হেথায় মিলেছে আজি সবে-
ভাই বন্ধু সবে মিলি করিতেছে কোলাকুলি,
মাতিয়াছে প্রেমের উৎসবে॥
যত চায় তত পায়- হৃদয় পূরিয়া যায়,
গৃহে ফিরে জয়-জয়-রবে
সবার মিটেছে সাধ- লভিয়াছে আশীর্বাদ,
সম্বৎসর আনন্দে কাটিবে।
২০
আজি এনেছে তাঁহারি আশীর্বাদ প্রভাতকিরণে।
পবিত্র করপরশ পেয়ে ধরণী লুটিছে তাঁহারি চরণে।
আনন্দে তরুলতা নোয়াইছে মাথা, কুসুম ফুটাইছে শত বরণে॥
আশা উল্লাসে চরাচর হাসে-
কী ভয়, কী ভয় দুঃখ-তাপ-মরণে॥
২১
চলিয়াছি গৃহপানে, খেলাধুলা অবসান।
ডেকে লও, ডেকে লও, বড়ো শ্রান্ত মন প্রাণ॥
ধুলায় মলিন বাস, আঁধারে পেয়েছি ত্রাস-
মিটাতে প্রাণের তৃষা বিষাদ করেছি পান॥
খেলিতে সংসারের খেলা কাতরে কেঁদে্ছি হায়,
হারায়ে আশার ধন অশ্রুবারি ব’হে যায়।
ধুলাঘর গড়ি যত ভেঙে ভেঙে পড়ে তত-
চলেছি নিরাশ-মনে, সান্ত্বনা করো গো দান॥
২২
দিন তো চলি গেল, প্রভু, বৃথা- কাতরে কাঁদে হিয়া।
জীবন অহরহ হতেছে ক্ষীণ- কী হল এ শূন্য জীবনে।
দেখাব কেমনে এই ম্লান মুখ, কাছে যাব কী লইয়া
প্রভু হে, যাইবে ভয়, পাব ভরসা
তুমি যদি ডাকো এ অধরে॥
২৩
ভবকোলাহল ছাড়িয়ে
বিরলে এসেছি হে॥
জুড়াব হিয়া তোমায় দেখি,
সুধারসে মগন হব হে॥
২৪
তাঁহার প্রেমে কে ডুবে আছে।
চাহে না সে তুচ্ছ সুখ ধন মান-
বিরহ নাহি তার, নাহি রে দুখতাপ,
সে প্রেমের নাহি অবসান॥
২৫
তবে কি ফিরিব ম্লানমুখে সখা,
জরজর প্রাণ কি জুড়াবে না।
আঁধার সংসারে আবার ফিরে যাব?
হৃদয়ের আশা পূরাবে না?
২৬
দেখি যদি দিলে ছেড়ো না আর, আমি অতি দীনহীন॥
নাহি কি হেথা পাপ মোহ বিপদরাশি।
তোমা বিনা একেলা নাহি ভরসা॥
২৭
দুখ দূর করিলে, দরশন দিয়ে মোহিলে প্রাণ॥
সপ্ত লোক ভুলে শোক তোমারে চাহিয়ে-
কোথায় আছি আমি দীন অতি দীন॥
২৮
দাও হে হৃদয় ভরে দাও।
তরঙ্গ উঠে উথলিয়া সুধাসাগরে,
সুধারসে মাতোয়ারা করে দাও॥
সেই সুধারসপানে ত্রিভুবন মাতে তাহা মোরে দাও॥
২৯
দুয়ারে বসে আছি, প্রভু, সারা বেলা-নয়নে বহে অশ্রুবারি।
সংসারে কী আছে হে, হৃদয় না পূরে-
প্রাণের বাসনা প্রাণে লয়ে ফিরেছি হেথা দ্বারে দ্বারে।
সকল ফেলি আমি এসেছি এখানে, বিমুখ হোয়ো না দীনহীনে-
যা করো হে রব প’ড়ে॥
৩০
ডেকেছেন প্রিয়তম, কে রহিবে ঘরে।
ডাকিতে এসেছি তাই, চলো ত্বরা ক’রে॥
তাপিতহৃদয় যারা মুছিবি নয়নধারা,
ঘুচিবে বিরহতাপ কত দিন পরে॥
আজি এ আকাশমাঝে কী অমৃতবীণা বাজে,
পুলকে জগত আজি কী মধু শোভায় সাজে!
আজি এ মধুর ভবে মধুর মিলন হবে-
তাঁহার সে প্রেমমুখ জেগেছে অন্তরে॥
৩১
চলেছে তরণী প্রসাদপবনে, কে যাবে এলো হে শান্তিভবনে।
এ ভব সংসারে ঘিরিছে আঁধারে, কেন রে ব’সে হেথা ম্লানমুখ।
প্রাণের বাসনা হেথায় পূরে না, হেথায় কোথা প্রেম কোথা সুখ।
এ ভবকোলাহল, এ পাপহলাহল, এ দুখশোকানল দূরে যাক।
সমুখে চাহিয়ে পুলকে গাহিয়ে চলো রে শুনে চলি তাঁর ডাক।
বিষয়ভাবনা লইয়া যাব না, তুচ্ছ সুখদুখ পড়ে থাক্।
ভবের নিশীথিনী ঘিরিবে ঘনঘোরে, তখন কার মুখ চাহিবে।
সাধের ধনজন দিয়ে বিসর্জন কিসের আশে প্রাণ রাখিবে॥
৩২
পিতার দুয়ারে দাঁড়াইয়া সবে ভুলে যাও অভিমান।
এসো, ভাই, এসো প্রাণে প্রাণে আজি রেখো না রে ব্যবধান॥
সংসারের ধুলা ধুয়ে ফেলে এসো, মুখে লয়ে এসো হাসি।
হৃদয়ের থালে লয়ে এসো, ভাই প্রেমফুল রাশি রাশি॥
নীরস হৃদয়ে আপনা লইয়ে রহিলে তাঁহারে ভুলে-
অনাথ জনের মুখপানে, আহা, চাহিলে না মুখ তুলে!
কঠোর আঘাতে ব্যথা পেলে কত, ব্যথিলে পরের প্রাণ-
তুচ্ছ কথা নিয়ে বিবাদে মাতিয়ে দিবা হল অবসান॥
তাঁর কাছে এসে তবুও কি আজি আপনারে ভুলিবে না।
হৃদয়মাঝারে ডেকে নিতে তাঁরে হৃদয় কি খুলিবে না।
লইব বাঁটিয়া সকলে মিলিয়া প্রেমের অমৃত তাঁরি-
পিতার অসীম ধনরতনের সকলেই অধিকারী॥
৩৩
তোমায় যতনে রাখিব হে, রাখিব কাছে-
প্রেমকুসুমের মধুসৌরভে, নাথ, তোমারে ভুলাব হে।
তোমার প্রেমে, সখা, সাজিব সুন্দর-
হৃদয়হারী, তোমারি পথ রহিব চেয়ে॥
আপনি আসিবে, কেমনে ছাড়িবে আর-
মধুর হাসি বিকাশি রবে হৃদয়াকাশে॥
৩৪
আইল আজি প্রাণসখা, দেখো রে নিখিলজন।
আসন বিছাইল নিশীথিনী গগনতলে,
গ্রহ তারা সভা ঘেরিয়ে দাঁড়াইল।
নীরবে বনগিরি আকাশে রহিল চাহিয়া,
থামাইল ধরা দিবসকোলাহল॥
৩৫
দুখের কথা তোমায় বলিব না, দুখ ভুলেছি ও করপরশে।
যা-কিছু দিয়েছ তাই পেয়ে, নাথ, সুখে আছি, আছি হরষে॥
আনন্দ-আলয় এ মধুর ভব, হেথা আমি আছি এ কী স্নেহ তব-
তোমার চন্দ্রমা তোমার তপন মধুর কিরণ বরষে॥
কত নব হাসি ফুটে ফুলবনে প্রতিদিন নবপ্রভাতে।
প্রতিনিশি কত গ্রহ কত তারা তোমার নীরব সভাতে।
জননীর স্নেহ সুহৃদের প্রীতি শত ধারে সুধা ঢালে নিতি নিতি,
জগতের প্রেমমধুমাধুরী ডুবায় অমৃতসরসে॥
ক্ষুদ্র মোরা তবু না জানি মরণ, দিয়েছ তোমার অভয় শরণ-
শোক তাপ সব হয় হে হরণ তোমার চরণদরশে।
প্রতিদিন যেন বাড়ে ভালোবাসা, প্রতিদিন মিটে প্রাণের পিপাসা-
পাই নব প্রাণ- জাগে নব আশা নব নব নব-বরষে॥
৩৬
তাঁহার আনন্দধারা জগতে যেতেছে বয়ে,
এসো সবে নরনারী আপন হৃদয় ল’য়ে॥
সে আনন্দে উপবন বিকাশিত অনুক্ষণ,
সে আনন্দে ধায় নদী আনন্দবারতা ক’য়ে॥
সে পুণ্যনির্ঝরস্রোতে বিশ্ব করিতেছে স্নান,
রাখো সে অমৃতধারা পূরিয়া হৃদয় প্রাণ।
তোমরা এসেছ তীরে- শূন্য কি যাইবে ফিরে,
শেষে কি নয়ননীরে ডুবিবে তৃষিত হয়ে॥
চিরদিন এ আকাশ নবীন নীলিমাময়,
চিরদিন এ ধরণী যৌবন ফুটিয়া রয়।
সে আনন্দরসপানে চিরপ্রেম জাগে প্রাণে,
দহে না সংসারতাপ সংসার-মাঝারে র’য়ে॥
৩৭
হরি, তোমায় ডাকি, সংসারে একাকী
আঁধার অরণ্যে ধাই হে।
গহন তিমিরে নয়নের নীরে
পথ খুঁজে নাহি পাই হে॥
সদা মনে হয় ‘কী করি’ কি’ করি’,
কখন আসিবে কালবিভাবরী-
তাই ভয়ে মরি, ডাকি হরি! হরি!
হরি বিনে কেহ নাই হে॥
নয়নের জল হবে না বিফল,
তোমায় সবে বলে ভকতবৎসল-
সেই আশা মনে করেছি সম্বল,
বেঁচে আছি শুধু তাই হে।
আঁধারেতে জাগে তব আঁখিতারা,
তোমার ভক্ত কভু হয় না পথহারা-
প্রাণ তোমায় চাহে, তুমি ধ্রুবতারা-
আর কার পানে চাই হে॥
৩৮
আমায় ছজনায় মিলে পথ দেখায় বলে পদে পদে পথ ভুলি হে।
নানা কথার ছলে নানা মুনি বলে, সংশয়ে তাই দুলি হে॥
তোমার কাছে যাব এই ছিল সাধ,
তোমার বাণী শুনে ঘুচাব প্রমাদ,
কানের কাছে সবাই করিছে বিবাদ-
শত লোকের শত বুলি হে॥
কাতর প্রাণে আমি তোমায় যখন যাচি
আড়াল ক’রে সবাই দাঁড়ায় কাছাকাছি,
ধরণীর ধুলো তাই নিয়ে আছি-
পাই নে চরণধূলি হে॥
শত ভাগ মোর শত দিকে ধায়,
আপনা-আপনি বিবাদ বাধায়-
কারে সামালিব, একি হল দায়-
একা যে অনেকগুলি হে॥
আমায় এক করো তোমার প্রেমে বেঁধে,
এক পথ আমায় দেখাও অবিচ্ছেদে-
ধাঁদার মাঝে প’ড়ে কত মরি কেঁদে-
চরণেতে লহো তুলি হে॥
৩৯
ঘোরা রজনী, এ মোহঘনঘটা-
কোথা গৃহ হায়। পথে ব’সে॥
সারাদিন করি’ খেলা, খেলা যে ফুরাইল- গৃহ চাহিয়া প্রাণ কাঁদে॥
৪০
সুমধুর শুনি আজি, প্রভু, তোমার নাম।
প্রেম সুধাপানে প্রাণ বিহ্বলপ্রায়,
রসনা অলস অবশ অনুরাগে॥
৪১
মিটিল সব ক্ষুধা, তাঁহার প্রেমসুধা, চলো রে ঘরে লয়ে যাই।
সেথা যে কত লোক পেয়েছে কত শোক, তৃষিত আছে কত ভাই॥
ডাকো রে তাঁর নামে সবারে নিজধামে, সকলে তাঁর গুণ গাই।
দুখি কাতর জনে রেখো রে রেখো মনে, হৃদয়ে সবে দেহো ঠাঁই॥
সতত চাহি তাঁরে ভোলো রে আপনারে, সবারে করো রে আপন।
শান্তি-আহরণে, শান্তি বিতরণে, জীবন করো রে যাপন।
এত যে সুখ আছে কে তাহা শুনিয়াছে! চলো রে সবারে শুনাই।
বলো রে ডেকে বলো ‘পিতার ঘরে চলো, হেথায় শোকতাপ নাই’॥
৪২
তারো তারো, হরি, দীনজনে।
ডাকো তোমার পথে, করুণাময়, পূজনসাধনহীন জনে॥
অকূল সাগরে না হেরি ত্রাণ, পাপে তাপে জীর্ণ এ প্রাণ-
মরণমাঝারে শরণ দাও হে, রাখো এ দুর্বল ক্ষীণজনে॥
ঘেরিল যামিনী, নিভিল আলো, বৃথা কাজে মম দিন ফুরালো-
পথ নাহি, প্রভু পাথেয় নাহি- ডাকি তোমারে প্রাণপণে।
দিকহারা সদা মরি যে ঘুরে, যাই তোমা হতে দূর সুদূরে,
পথ হারাই রসাতলপুরে- অন্ধ এ লোচন মোহঘনে॥
৪৩
তব প্রেম সুধারসে মেতেছি,
ডুবেছে মন ডুবেছে॥
কোথা কে আছে নাহি জানি-
তোমার মাধুরীপানে মেতেছি, ডুবেছে মন ডুবেছে॥
৪৪
আমারে করো মার্জনা।
আমারেও দেহো, নাথ, অমৃতের কণা॥
গৃহ ছেড়ে পথে এসে বসে আছি ম্লানবেশে,
আমারো হৃদয়ে করো আসন রচনা॥
জানি আমি, আমি তব মলিন সন্তান-
আমারেও দিতে হবে পদতলে স্থান।
আপনি ডুবেছি পাপে, কাঁদিতেছি মনস্তাপে-
শুন গো আমারো এই মরমবেদনা॥
৪৫
ফিরো না ফিরো না আজি- এসেছ দুয়ারে।
শূন্য প্রাণে কোথা যাও শূন্য সংসারে॥
আজ তাঁরে যাও দেখে, হৃদয়ে আনো গো ডেকে-
অমৃত ভরিয়া লও মরমমাঝারে॥
শুষ্ক প্রাণ শুষ্ক রেখে কার পানে চাও।
শূন্য দুটো কথা শুনে কোথা চলে যাও।
তোমার কথা তাঁরে কয়ে তাঁর কথা যাও লয়ে-
চলে যাও তাঁর কাছে রাখি আপনারে॥
৪৬
সবে মিলি গাও রে, মিলি মঙ্গলাচরো।
ডাকি লহো হৃদয়ে প্রিয়তমে॥
মঙ্গল গাও আনন্দমনে। মঙ্গল প্রচারো বিশ্বমাঝে॥
৪৭
স্বরূপ তাঁর কে জানে, তিনি অনন্ত মঙ্গল-
অযুত জগত মগন সেই মহাসমুদ্রে॥
তিনি নিজ অনুপম মহিমামাঝে নিলীন-
সন্ধান তাঁর কে করে, নিষ্ফল বেদ বেদান্ত।
পরব্রহ্ম, পরিপূর্ণ, অতি মহান-
তিনি আদিকারণ, তিনি বর্ণন-অতীত॥
৪৮
তোমারে জানি নে হে, তবু মন তোমাতে ধায়।
তোমারে না জেনে বিশ্ব তবু তোমাতে বিরাম পায়॥
অসীম সৌন্দর্য তব কে করেছে অনুভব হে,
সে মাধুরী চিরনব-
আমি না জেনে প্রাণ সঁপেছি তোমায়॥
তুমি জ্যোতির জ্যোতি, আমি অন্ধ আঁধারে।
তুমি মুক্ত মহীয়ান, আমি মগ্ন পাথারে।
তুমি অন্তহীন, আমি ক্ষুদ্র দীন-কী অপূর্ব মিলন তোমায় আমায়।
৪৯
এবার বুঝেছি সখা, এ খেলা কেবলই খেলা-
মানবজীবন লয়ে এ কেবলই অবহেলা॥
তোমারে নহিলে আর ঘুচিবে না হাহাকার-
কী দিয়ে ভুলায়ে রাখো, কী দিয়ে কাটাও বেলা॥
বৃথা হাসে রবিশশী, বৃথা আসে দিবানিশি-
সহসা পরান কাঁদে শূন্য হেরি দিশি দিশি।
তোমারে খুঁজিতে এসে কী লয়ে রয়েছি শেষে-
ফিরি গো কিসের লাগি এ অসীম মহামেলা॥
৫০
চাহি না সুখে থাকিতে হে, হেরো কত দীনজন কাঁদিছে॥
কত শোকের ক্রন্দন গগনে উঠিছে, জীবনবন্ধন নিমেষে টুটিছে,
কত ধূলিশায়ী জন মলিন জীবন শরমে চাহে ঢাকিতে হে॥
শোকে হাহাকারে বধির শ্রবণ, শুনিতে না পাই তোমার বচন,
হৃদয়বেদন করিতে মোচন কারে ডাকি কারে ডাকিতে হে॥
আশার অমৃত ঢালি দাও প্রাণে, আশীর্বাদ করো আতুর সন্তানে-
পথহারা জনে ডাকি গৃহপানে চরণে হবে রাখিতে হে।
প্রেম দাও শোকে করিতে সান্ত্বনা- ব্যথিত জনের ঘুচাতে যন্ত্রণা,
তোমার কিরণ করহ প্রেরণ অশ্রু-আকুল আঁখিতে হে॥
৫১
আজ বুঝি আইল প্রিয়তম, চরণে সকলে আকুল ধাইল॥
কত দিন পরে মন মাতিল গানে,
পূর্ণ আনন্দ জাগিল প্রাণে,
ভাই ব’লে ডাকি সবারে- ভুবন সুমধুর প্রেমে ছাইল॥
৫২
হে মন, তাঁরে দেখো আঁখি খুলিয়ে
যিনি আছেন সদা অন্তরে॥
সবারে ছাড়ি প্রভু করো তাঁরে,
দেহ মন ধন যৌবন রাখো তাঁর অধীনে॥
৫৩
জয় রাজরাজেশ্বর! জয় অরূপসুন্দর!
জয় প্রেমসাগর! জয় ক্ষেম-আকর!
তিমিরতিরঙ্কর হৃদয়গগনভাস্কর॥
৫৪
আজি রাজ-আসনে তোমারে বসাইব হৃদয়মাঝারে॥
সকল কামনা সঁপিব চরণে অভিষেক-উপহারে॥
তোমারে, বিশ্বরাজ, অন্তরে রাখিব তোমার ভকতেরই এ অভিমান।
ফিরিবে বাহিরে সর্ব চরাচর- তুমি চিত্ত-আগারে॥
৫৫
হে অনাদি অসীম সুনীল অকূল সিন্ধু, আমি ক্ষুদ্র অশ্রুবিন্দু॥
তোমার শীতল অতলে ফেলো গো গ্রাসি,
তার পরে সব নীরব শান্তিরাশি-
তার পরে শুধু বিস্মৃতি আর ক্ষমা-
শুধাব না আর কখন্ আসিবে অমা,
কখন্ গগনে উদিবে পূর্ণ ইন্দু॥
৫৬
মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকালমাঝে
আমি মানব কী লাগি একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে।
তুমি আছ বিশ্বেশ্বর সুরপতি অসীম রহস্যে
নীরবে একাকী তব আলয়ে।
আমি চাহি তোমা-পানে-
তুমি মোরে নিয়ত হেরিছ, নিমেষবিহীন নত নয়নে॥
৫৭
আইল শান্ত সন্ধ্যা, গেল অস্তাচলে শ্রান্ত তপন॥
নমো স্নেহময়ী মাতা, নমো সুপ্তিদাতা,
নমো অতন্দ্র জাগ্রত মহাশান্তি॥
৫৮
উঠি চলো, সুদিন আইল- আনন্দসৌগন্ধ উচ্ছ্বসিল॥
আজি বসন্ত আগত স্বরগ হতে
ভক্তহৃদয়পুষ্পনিকুঞ্জে- সুদিন আইল॥
৫৯
আমারে করো জীবনদান,
প্রেরণ করো অন্তরে তব আহ্বান॥
আসিছে কত যায় কত, পাই শত হারাই শত-
তোমারি পায়ে রাখো আচল মোর প্রাণ॥
দাও মোরে মঙ্গলব্রত, স্বার্থ করো দূরে প্রহত-
থামায়ে বিফল সন্ধান জাগাও চিত্তে সত্য জ্ঞান।
লাভে ক্ষতিতে সুখে-শোকে অন্ধকারে দিবা-আলোকে
নির্ভয়ে বহি নিশ্চল মনে তব বিধান॥
৬০
রক্ষা করো হে।
আমার কর্ম হইতে আমায় ক্ষমা করো হে।
আপন ছায়া আতঙ্কে মোরে করিছে কম্পিত হে,
আপন চিন্তা গ্রাসিছে আমায়- রক্ষা করো হে।
প্রতিদিন আমি আপনি রচিয়া জড়াই মিথ্যাজালে
ছলনাডোর হইতে মোরে রক্ষা করো হে।
অহঙ্কার হৃদয়দ্বার রয়েছে রোধিয়া হে-
আপনা হতে আপনার, মোরে রক্ষা করো হে॥
৬১
মহানন্দে হেরো গো সবে গীতরবে চলে শ্রান্তিহারা
জগতপথে পশুপ্রাণী রবি শশী তারা॥
তাঁরা হতে নামে জড়জীবনমনপ্রবাহ।
তাঁহারে খুঁজিয়া চলেছে ছুটিয়া অসীম সৃজনধারা॥
৬২
প্রভু, খেলেছি অনেক খেলা- এবে তোমার ক্রোড় চাহি।
শ্রান্ত হৃদয়ে, হে, তোমারি প্রসাদ চাহি॥
আজি চিন্তাতপ্ত প্রাণে তব শান্তিবারি চাহি।
আজি সর্ববিত্ত ছাড়ি তোমায় নিত্য-নিত্য চাহি॥
৬৩
আমি জেনে শুনে তবু ভুলে আছি, দিবস কাটে বৃথায় হে।
আমি যেতে চাই তব পথপানে, ওহে কত বাধা পায় পায় হে।
(তোমার অমৃতপথে, যে পথে তোমার আলো জ্বলে সেই অভয়পথে।)
চারি দিকে হেরো ঘিরেছে কারা, শত বাঁধনে জড়ায় হে।
আমি ছাড়াতে চাহি, ছাড়ে না কেন গো- ডুবায়ে রাখে মায়ায় হে।
(তোরা বাঁধিয়া রাখে, তোমার বাহুর বাঁধন হতে তারা বাঁধিয়া রাখে।)
দাও ভেঙে দাও এ ভবের সুখ, কাজ নেই এ খেলায় হে।
আমি ভুলে থাকি যত অবোধের মতো বেলা বহে তত যায় হে।
(ভুলে যে থাকি, দিন যে মিলায়, খেলা যে ফুরায়, ভুলে যে থাকি।)
হানো তব বাজ হৃদয়গহনে, দুখানল জ্বালো তায় হে।
তুমি নয়নের জলে ভাসায়ে আমারে সে জল দাও মুছায়ে হে।
(নয়নজলে- তোমার-হাতের-বেদনা-দেওয়া নয়নজলে- প্রাণের-সকল-কলঙ্ক-ধোওয়া নয়নজলে।)
শূন্য ক’রে দাও হৃদয় আমার, আসন পাতো সেথায় হে।
ওহে তুমি এসো এসো, নাথ হয়ে বোসো, ভুলো না আমায় হে।
(আমার শূন্য প্রাণে- চির-আনন্দ ভরে থাকো আমার শূন্য প্রাণে।)
৬৪
আমি সংসারে মন দিয়েছিনু, তুমি আপনি সে মন নিয়েছ।
আমি সুখ ব’লে দুখ চেয়েছিনু, তুমি দুখ ব’লে সুখ দিয়েছ।
(দয়া ক’রে দুখ দিলে আমায়, দয়া ক’রে।)
হৃদয় যাহার শতখানে ছিল শত স্বার্থের সাধনে
তাহারে কেমনে কুড়ায়ে আনিলে, বাঁধিলে ভক্তিবাঁধনে।
(কুড়ায়ে এনে, শতখান হতে কুড়ায়ে এনে,
ধুলা হতে তারে কুড়ায়ে এনে।)
সুখ সুখ ক’রে দ্বারে দ্বারে মোরে কত দিকে কত খোঁজালে,
তুমি যে আমার কত আপনার এবার সে কথা বোঝালে।
(বুঝায়ে দিলে, হৃদয়ে আসি বুঝায়ে দিলে,
তুমি কে হও আমার বুঝায়ে দিলে।)
করুণা তোমার কোন্ পথ দিয়ে কোথা নিয়ে যায় কাহারে,
সহসা দেখিনু নয়ন মেলিয়ে- এনেছ তোমারি দুয়ারে।
(আমি না জানিতে, কোথা দিয়ে আমায় এনেছ
আমি না জানিতে।)
৬৫
কে জানিত তুমি ডাকিবে আমারে, ছিলাম নিদ্রামগন।
সংসার মোরে মহামোহঘোরে ছিল সদা ঘিরে সঘন।
(ঘিরে ছিল, ঘিরেছিল হে আমায়-
মোহঘোরে- মহামোহে।)
আপনার হাতে দিবে যে বেদনা, ভাসাবে নয়নজলে,
কে জানিত হবে আমার এমন শুভদিন শুভলগন।
(জানি নে, জানি নে হে, আমি স্বপনে-
আমার এমন ভাগ্য হবে আমি জানি নে, জানি নে হে।)
জানি না কখন্ করুণা-অরুণ উঠিল উদয়াচলে,
দেখিতে দেখিতে কিরণে পূরিল আমার হৃদয়গগন।
(আমার হৃদয়গগন পূরিল তোমার চরণকিরণে-
তোমার করুণা-অরুণে।)
তোমার অমৃতসাগর হইতে বন্যা আসিল কবে-
হৃদয়ে বাহিরে যত বাঁধ ছিল কখন হইল ভগন।
(যেত বাঁধ ছিল যেখানে, ভেঙে গেল, ভেসে গেল হে।)
সুবাতাস তুমি আপনি দিয়েছ, পরানে দিয়েছ আশা-
আমার জীবনতরণী হইবে তোমার চরণে মগন।
(তোমার চরণে গিয়ে লাগিবে আমার জীবনতরণী-
অভয়চরণে গিয়ে লাগিবে।)
৬৬
তুমি কাছে নাই ব’লে হেরো, সখা, তাই
‘আমি বড়ো’ ‘আমি বড়ো’ বলিছে সবাই।
(সবাই বড়ো হল হে।
সবার বড়ো কাছে নেই ব’লে সবাই বড়ো হল হে।
তোমায় দেখি নে ব’লে তোমায় পাই নে ব’লে,
সবাই বড়ো হল হে।)
নাথ, তুমি একবার এসো হাসিমুখে,
এরা ম্লান হয়ে যাক তোমার সম্মুখে।
(লাজে ম্লান হোক হে।
আমারে যারা ভুলায়েছিল লাজে ম্লান হোক হে।
তোমারে যারা ঢেকেছিল লাজে ম্লান হোক হে।)
কোথা তব প্রেমমুখ, বিশ্ব-ঘেরা হাসি-
আমারে তোমার মাঝে করো গো উদাসী।
(উদাস করো হে, তোমার প্রেমে-
তোমার মধুর রূপে উদাস করো হে।)
ক্ষুদ্র আমি করিতেছে বড়ো অহঙ্কার-
ভাঙো ভাঙো ভাঙো, নাথ, অভিমান তার।
(অভিমান চূর্ণ করো হে।
তোমার পদতলে মান চূর্ণ করো হে-
পদানত ক’রে মান চূর্ণ করো হে।)
৬৭
নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে। (নয়নের নয়ন!)
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে। (হৃদয়বিহারী!)
বাসনার বশে মন অবিরত ধায় দশ দিশে পাগলের মতো,
স্থির-আঁখি তুমি মরমে সতত জাগিছ শয়নে স্বপনে।
(তোমার বিরাম নাই, তুমি অবিরাম জাগিছ শয়নে স্বপনে।
তোমার নিমেষ নাই, তুমি অনিমেষ জাগিছ শয়নের স্বপনে।)
সবাই ছেড়েছে, নাই যার কেহ, তুমি আছ তার, আছে তব স্নেহ-
নিরাশ্রয় জনপথ যার গেহ সেও আছে তব ভবনে।
(যে পথের ভিখারি সেও আছে তব ভবনে।
যার কেহ কোথাও নেই সেও আছে তব ভবনে।)
তুমি ছাড়া কেহ সাথি নাই আর, সমুখে অনন্ত জীবনবিস্তার-
কালপারাবার করিতেছ পার কেহ নাহি জানে কেমনে।
(তরী বহে নিয়ে যাও কেহ নাহি জানে কেমনে।
জীবনতরী বহে নিয়ে যাও কেহ নাহি জানে কেমনে।)
জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি, তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
যত পাই তোমায় আরো তত যাচি- যত জানি তত জানি নে।
(জেনে শেষ মেলে না- মন হার মানে হে।)
জানি আমি তোমায় পাব নিরন্তর লোক-লোকান্তরে যুগ-যুগান্তর-
তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে।
(তোমার আমার মাঝে কোনো বাধা নাই ভুবনে।)
৬৮
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না।
(মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না।
অন্ধ করে রাখে, তোমারে দেখিতে দেয় না।)
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে ‘হারাই হারাই’ সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে।
(আশ না মিটিতে হারাইয়া- পলক না পড়িতে হারাইয়া-
হৃদয় না জুড়াতে হারাইয়া ফেলি চকিতে।)
কী করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে-
ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব, নাথ, তোমারে হৃদয়ে রাখিতে।
(আমার সাধ্য কিবা তোমারে-
দয়া না করিলে কে পারে-
তুমি আপনি না এলে কে পারে হৃদয়ে রাখিতে।)
আর-কারো পানে চাহিব না আর, করিব হে আমি প্রাণপণ-
ওহে তুমি যদি বলো এখনি করিব বিষয়-বাসনা বিসর্জন।
(দিব শ্রীচরণে বিষয়- দিব অকাতরে বিষয়-
দিব তোমার লাগি বিষয়-বাসনা বিসর্জন।)
৬৯
ওহে জীবনবল্লভ, ওহে সাধনদুর্লভ,
আমি মর্মের কথা অন্তরব্যথা কিছুই নাহি কব-
শুধু জীবন মন চরণে দিনু বুঝিয়া লহো সব।
(দিনু চরণতলে- কথা যা ছিল দিনু চরণতলে-
প্রাণের বোঝা বুঝে লও, দিনু চরণতলে।)
আমি কী আর কব॥
এই সংসারপথসঙ্কট অতি কণ্টকময় হে,
আমি নীরবে যাব হৃদয়ে লয়ে প্রেমমুরতি তব।
(নীরবে যাব- পথের কাঁটা মানব না, নীরবে যাব।
হৃদয়ব্যথায় কাঁদব না, নীরবে যাব।)
আমি কী আর কব॥
আমি সুখদুখ সব তুচ্ছ করিনু প্রিয়-অপ্রিয় হে-
তুমি নিজ হাতে যাহা সঁপিবে তাহা মাথায় তুলিয়া লব।
(আমি মাথায় লব- যাহা দিবে তাই মাথায় লব-
সুখ দুখ তব পদধূলি ব’লে মাথায় লব।)
আমি কী আর কব॥
অপরাধ যদি ক’রে থাকি পদে, না করো যদি ক্ষমা,
তবে পরানপ্রিয় দিয়ো হে দিয়ো বেদনা নব নব।
(দিয়ো বেদনা- যদি ভালো বোঝ দিয়ো বেদনা-
বিচারে যদি দোষী হই দিয়ো বেদনা।)
আমি কী আর কব॥
তবু ফেলো না দূরে, দিবসশেষে ডেকে নিয়ো চরণে-
তুমি ছাড়া আর কী আছে আমার! মৃত্যু- আঁধার ভব।
(নিয়ো চরণে- ভবের খেলা সারা হলে নিয়ো চরণে-
দিন ফুরাইলে, দীননাথ, নিয়ো চরণে।)
আমি কী আর কব॥
৭০
ওগো দেবতা আমার, পাষাণদেবতা, হৃদিমন্দিরবাসী,
তোমারি চরণে উজাড় করেছি সকল কুসুমরাশি।
প্রভাত আমার সন্ধ্যা হইল, অন্ধ হইল আঁখি।
এ পূজা কি তবে সবই বৃথা হবে। কেঁদে কি ফিরিবে দাসী।
এবার প্রাণের সকল বাসনা সাজায়ে এনেছি থালি।
আঁধার দেখিয়া আরতির তরে প্রদীপ এনেছি জ্বালি।
এ দীপ যখন নিবিবে তখন কী রবে পূজার তরে।
দুয়ার ধরিয়া দাঁড়ায়ে রহিব নয়নের জলে ভাসি॥
৭১
গভীর রাতে ভক্তিভরে কে জাগে আজ, কে জাগে।
সপ্ত ভুবন আলো করে লক্ষ্মী আসেন, কে জাগে।
ষোলো কলায় পূর্ণ শশী, নিশার আঁধার গেছে খসি-
একলা ঘরের দুয়ার-’পরে কে জাগে আজ, কে জাগে।
ভরেছ কি ফুলের সাজি। পেতেছ কি আসন আজি।
সাজিয়ে অর্ঘ্য পূজার তরে কে জাগে আজ, কে জাগে।
আজ যদি রোস্ ঘুমে মগন চলে যাবে শুভলগন,
লক্ষ্মী এসে যাবেন স’রে- কে জাগে আজ, কে জাগে॥
৭২
যাত্রী আমি ওরে,
পারবে না কেউ আমায় রাখতে ধরে॥
দুঃখসুখের বাঁধন সবই মিছে, বাঁধা এ ঘর রইবে কোথায় পিছে,
বিষয়বোঝা টানে আমায় নীচে- ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে যাবে পড়ে॥
যাত্রী আমি ওরে,
চলতে পথে গান গাহি প্রাণ ভ’রে।
দেহদুর্গে খুলবে সকল দ্বার, ছিন্ন হবে শিকল বাসনার,
ভালো মন্দ কাটিয়ে হব পার- চলতে রব লোকে লোকান্তরে॥
যাত্রী আমি ওরে,
যা-কিছু ভার যাবে সকল সরে।
আকাশ আমায় ডাকে দূরের পানে ভাষাবিহীন অজানিতের গানে,
সকাল-সাঁঝে আমার পরান টানে কাহার বাঁশি এমন গভীর স্বরে॥
যাত্রী আমি ওরে,
বাহির হলেম না জানি কোন্ ভোরে।
তখন কোথাও গায় নি কোন পাখি, কী জানি রাত কতই ছিল বাকি,
নিমেষহারা শুধু একটি আঁখি জেগে ছিল অন্ধকারের প’রে॥
যাত্রী আমি ওরে,
কোন্ দিনান্তে পৌঁছব কোন্ ঘরে।
কোন্ তারকা দীপ জ্বালে সেইখানে, বাতাস কাঁদে কোন্ কুসুমের ঘ্রাণে,
কে গো সেথায় স্নিগ্ধ দু’নয়ানে অনাদিকাল চাহে আমার তরে॥
৭৩
দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো- গভীর শান্তি এ যে
আমার সকল ছাড়িয়ে গিয়ে উঠল কোথায় বেজে॥
ছাড়িয়ে গৃহ, ছাড়িয়ে আরাম, ছাড়িয়ে আপনারে
সাথে করে নিল আমায় জন্মমরণপারে-
এল পথিক সেজে॥
চরণে তার নিখিল ভুবন নীরব গগনেতে
আলো-আঁধার আঁচলখানি আসন দিল পেতে।
এত কালের ভয় ভাবনা কোথায় যে যায় সরে,
কালিমা যায় মেজে।
৭৪
সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি,
দুঃখে তোমায় পেয়েছি প্রাণ ভ’রে।
হারিয়ে তোমায় গোপন রেখেছি,
পেয়ে আবার হারাই মিলনঘোরে॥
চিরজীবন আমার বীণা-তারে
তোমার আঘাত লাগল বারে বারে,
তাই তো আমার নানা সুরের তানে
প্রাণে তোমার পরশ নিলেম ধ’রে॥
আজ তো আমি ভয় করি নে আর
লীলা যদি ফুরায় হেথাকার।
নূতন আলোয় নূতন অন্ধকারে
লও যদি বা নূতন সিন্ধুপারে
তবু তুমি সেই তো আমার তুমি-
আবার তোমায় চিনব নূতন ক’রে॥
৭৫
বলো বলো, বন্ধু, বলো তিনি তোমার কানে কানে
নাম ধরে ডাক দিয়ে গেছেন ঝড়-বাদলের মধ্যখানে॥
স্তব্ধ দিনের শান্তিমাঝে জীবন যেথায় বর্মে সাজে
বলো সেথায় পরান তিনি বিজয়মাল্য তোমার প্রাণে।
বলো তিনি সাথে সাথে ফেরেন তোমার দুখের টানে॥
বলো বলো, বন্ধু, বলো নাম বলো তাঁর যাকে তাকে-
শুনুক তারা ক্ষণেক থেমে ফেরে যারা পথের পাকে।
বলো বলো তাঁরে চিনি ভাঙন দিয়ে গড়েন যিনি-
বেদন দিয়ে বাঁধো বীণা আপন-মনে সহজ গানে।
দুখীর আঁখি দেখুক চেয়ে সহজ সুখে তাঁহার পানে॥
৭৬
মনের মধ্যে নিরবধি শিকল গড়ার কারখানা।
একটা বাঁধন কাটে যদি বেড়ে ওঠে চারখানা॥
কেমন ক’রে নামবে বোঝা, তোমার আপদ নয় যে সোজা-
অন্তরেতে আছে যখন ভয়ের ভীষণ ভারখানা॥
রাতের আঁধার ঘোচে বটে বাতির আলো যেই জ্বালো,
মূর্ছাতে যে আঁধার ঘটে রাতের চেয়ে ঘোর কালো।
ঝড়-তুফানে ঢেউয়ের মারে তবু তরী বাঁচতে পারে,
সবার বড়ো মার যে তোমার ছিদ্রটার ওই মারখানা॥
পর তো আছে লাখে লাখে, কে তাড়াবে নিঃশেষে।
ঘরের মধ্যে পর যে থাকে পর করে দেয় বিশ্বে সে।
কারাগারের দ্বারী গেলে তখনি কি মুক্তি মেলে।
আপনি তুমি ভিতর থেকে চেপে আছ দ্বারখানা।
শূন্য ঝুলির নিয়ে দাবি রাগ ক’রে রোস্ কার ’পরে।
দিতে জানিস তবেই পাবি, পাবি নে তো ধার ক’রে।
লোভে ক্ষোভে উঠিস মাতি, ফল পেতে চাস রাতারাতি-
আপন মুঠো করলে ফুটো আপন খাঁড়ার ধারখানা॥
৭৭
খেলার সাথি, বিদায়দ্বার খোলো-
এবার বিদায় দাও।
গেল যে খেলার বেলা॥
ডাকিল পথিকে দিকে বিদিকে,
ভাঙিল রে সুখমেলা॥
৭৮
যাওয়া-আসারই এই কি খেলা
খেলিলে, হে হৃদিরাজা, সারা বেলা॥
ডুবে যায় হাসি আঁখিজলে-
বহু যতনে যারে সাজালে
তারে হেলা॥
৭৯
বুঝি ওই সুদূরে ডাকিল মোরে
নিশীথেরই সমীরণ হায়- হায়॥
মম মন হল উদাসী, দ্বার খুলিল-
বুঝি খেলারই বাঁধন ওই যায়॥
৮০
কোন্ ভীরুকে ভয় দেখাবি, আঁধার তোমার সবই মিছে।
ভরসা কি মোর সামনে শুধু। নাহয় আমায় রাখবি পিছে॥
আমায় দূরে যেই তাড়াবি সেই তো রে তোর কাজ বাড়াবি-
তোমায় নীচে নামতে হবে আমায় যদি ফেলিস নীচে॥
যাচাই ক’রে নিবি মোরে এই খেলা কি খেলবি ওরে।
যে তোর হাত জানে না, মারকে জানে, ভয় লেগে রয় তাহার প্রাণে-
যে তোর মার ছেড়ে তোর হাতটি দেখে আসল জানা সেই জানিছে॥
৮১
হৃদয়-আবরণ খুলে গেল তোমার পদপরশে হরষে ওহে দয়াময়।
অন্তরে বাহিরে হেরিনু তোমারে
লোকে লোকে, দিকে দিকে , আঁধারে আলোকে, সুখে দুখে-
হেরিনু হে ঘরে পরে, জগতময়, চিত্তময়॥
৮২
মন প্রাণ কাড়িয়া লও হে হৃদয়স্বামী,
সংসারের সুখ দুখ সকলই ভুলিব আমি।
সকল সুখ দাও তোমার প্রেমসুখে-
তুমি জাগি থাকো জীবনে দিনযামী॥
৮৩
শুভ্র প্রভাতে
পূর্বগগনে উদিল
কল্যাণী শুকতারা॥
তরুণ অরুণরশ্মি
ভাঙে অন্ধতামসী
রজনীর কারা॥