গীতবিতান
পূজা (১০১-২০০
সংখ্যক গান)
১০১
দাঁড়াও আমার আঁখির আগে।
তোমার দৃষ্টি হৃদয়ে লাগে॥
সমুখ-আকাশে চরাচরলোকে এই অপরূপ আকুল আলোকে দাঁড়াও হে,
আমার পরান পলকে পলকে চোখে চোখে তব দরশ মাগে॥
এই-যে ধরণী চেয়ে ব’সে আছে ইহার মাধুরী বাড়াও হে।
ধুলায় বিছানো শ্যাম অঞ্চলে দাঁড়াও হে নাথ, দাঁড়াও হে।
যাহা-কিছু আছে সকলই ঝাঁপিয়া, ভুবন ছাপিয়া, জীবন ব্যাপিয়া দাঁড়াও হে।
দাঁড়াও যেখানে বিরহী এ হিয়া তোমারি লাগিয়া একেলা জাগে॥
১০২
যদি এ আমার হৃদয়দুয়ার বন্ধ রহে গো কভু
দ্বার ভেঙে তুমি এসো মোর প্রাণে, ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু ॥
যদি কোনো দিন এ বীণার তারে তব প্রিয়নাম নাহি ঝঙ্কারে
দয়া ক’রে তবু রহিয়ো দাঁড়ায়ে, ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু ॥
যদি কোনো দিন তোমার আহ্বানে সুপ্তি আমার চেতনা না মানে
বজ্রবেদনে জাগায়ো আমারে, ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু।
যদি কোনো দিন তোমার আসনে আর-কাহারেও বসাই যতনে,
চিরদিবসের হে রাজা আমার, ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু ॥
১০৩
তোমারি রাগিণী জীবনকুঞ্জে বাজে যেন সদা বাজে গো।
তোমারি আসন হৃদয়পদ্মে রাজে যেন সদা রাজে গো॥
তব নন্দনগন্ধমোদিত ফিরি সুন্দর ভুবনে
তব পদরেণু মাখি লয়ে তনু সাজে যেন সদা সাজে গো।
সব বিদ্বেষ দূরে যায় যেন তব মঙ্গলমন্ত্রে,
বিকাশে মাধুরী হৃদয়ে বাহিরে তব সঙ্গীতছন্দে।
তব নির্মল নীরব হাস্য হেরি অম্বর ব্যাপিয়া
তব গৌরবে সকল গর্ব লাজে যেন সদা লাজে গো॥
১০৪
চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে,নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে—
জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে॥
স্খলিত শিথিল কামনার ভার বহিয়া বহিয়া ফিরি কত আর—
নিজ হাতে তুমি গেঁথে নিয়ো হার, ফেলো না আমারে ছড়ায়ে॥
চিরপিপাসিত বাসনা বেদনা বাঁচাও তাহারে মারিয়া।
শেষ জয়ে যেন হয় সে বিজয়ী তোমারি কাছেতে হারিয়া।
বিকায়ে বিকায়ে দীন আপনারে পারি না ফিরিতে দুয়ারে দুয়ারে—
তোমারি করিয়া নিয়ো গো আমারে বরণের মালা পরায়ে॥
১০৫
তোমারি নাম বলব নানা ছলে,
বলব একা বসে আপন মনের ছায়াতলে॥
বলব বিনা ভাষায়, বলব বিনা আশায়,
বলব মুখের হাসি দিয়ে, বলব চোখের জলে॥
বিনা প্রয়োজনের ডাকে ডাকব তোমার নাম,
সেই ডাকে মোর শুধু-শুধুই পূরবে মনস্কাম।
শিশু যেমন মাকে নামের নেশায় ডাকে,
বলতে পারে এই সুখেতেই মায়ের নাম সে বলে॥
১০৬
আমার এ ঘরে আপনার করে গৃহদীপখানি জ্বালো হে।
সব দুখশোক সার্থক হোক লভিয়া তোমারি আলো হে।
কোণে কোণে যত লুকানো আঁধার মিলাবে ধন্য হয়ে,
তোমারি পুণ্য-আলোকে বসিয়া সবারে বাসিব ভালো হে॥
পরশমণির প্রদীপ তোমার, অচপল তার জ্যোতি
সোনা ক’রে লবে পলকে আমার সকল কলঙ্ক কালো।
আমি যত দ্বীপ জ্বালিয়াছি তাহে শুধু জ্বালা, শুধু কালী—
আমার ঘরের দুয়ারে শিয়রে তোমারি কিরণ ঢালো হে ॥
১০৭
সংসারে তুমি রাখিলে মোরে যে ঘরে
সেই ঘরে রব সকল দুঃখ ভুলিয়া।
করুণা করিয়া নিশিদিন নিজ করে
রাখিয়ো তাহার একটি দুয়ার খুলিয়া॥
মোর সব কাজে মোর সব অবসরে
সে দুয়ার রবে তোমারি প্রবেশ-তরে,
সেথা হতে বায়ু বহিবে হৃদয় ’পরে
চরণ হইতে তব পদধূলি তুলিয়া॥
যত আশ্রয় ভেঙে ভেঙে যায়, স্বামী,
এক আশ্রয়ে রহে যেন চিত লাগিয়া।
যে অনলতাপ যখনি সহিব আমি
এক নাম বুকে বার বার দেয় দাগিয়া।
যবে দুখদিনে শোকতাপ আসে প্রাণে
তোমারি আদেশ
বহিয়া যেন সে আনে,
পরুষ বচন যতই আঘাত হানে
সকল আঘাতে তব সুর উঠে জাগিয়া॥
১০৮
আমার মুখের কথা তোমার নাম দিয়ে দাও ধুয়ে,
আমার নীরবতায় তোমার নামটি রাখো থুয়ে।
রক্তধারার ছন্দে আমার দেহবীণার তার
বাজাক আনন্দে তোমার নামেরই ঝঙ্কার।
ঘুমের ’পরে জেগে থাকুক নামের তারা তব,
জাগরণের ভালে আঁকুক অরুণলেখা নব।
সব আকাঙ্ক্ষা আশায় তোমার নামটি জ্বলুক শিখা,
সকল ভালোবাসায় তোমার নামটি রহুক লিখা।
সকল কাজের শেষে তোমার নামটি উঠুক ফ’লে,
রাখব কেঁদে হেসে তোমার নামটি বুকে কোলে।
জীবনপদ্মে সঙ্গোপনে রবে নামের মধু,
তোমায় দিব মরণ-ক্ষণে তোমারি নাম বঁধু॥
১০৯
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান॥
আরো আলো আরো আলো
এই
নয়নে, প্রভু, ঢালো।
সুরে সুরে বাঁশি পুরে
তুমি
আরো আরো আরো দাও তান॥
আরো বেদনা আরো বেদনা
প্রভু,
দাও মোরে আরো চেতনা।
দ্বার ছুটায়ে বাধা টুটায়ে
মোরে করো ত্রাণ মোরে করো ত্রাণ।
আরো প্রেমে আরো প্রেমে
মোর
আমি ডুবে যাক নেমে।
সুধাধারে আপনারে
তুমি
আরো আরো আরো করো দান॥
১১০
বল দাও মোরে বল দাও, প্রাণে দাও মোর শকতি
সকল হৃদয় লুটায়ে তোমারে করিতে প্রণতি ॥
সরল সুপথে ভ্রমিতে, সব অপকার ক্ষমিতে,
সকল গর্ব দমিতে খর্ব করিতে কুমতি ॥
হৃদয়ে তোমারে বুঝিতে, জীবনে তোমারে পূজিতে,
তোমার মাঝারে খুঁজিতে চিত্তের চিরবসতি।
তব কাজ শিরে বহিতে, সংসারতাপ সহিতে,
ভবকোলাহলে রহিতে, নীরবে করিতে ভকতি ॥
তোমার বিশ্বছবিতে তব প্রেমরূপ লভিতে,
গ্রহ-তারা-শশী-রবিতে হেরিতে তোমার আরতি।
বচনমনের অতীতে ডুবিতে তোমার জ্যোতিতে,
সুখে দুখে লাভে ক্ষতিতে শুনিতে তোমার ভারতী ॥
১১১
অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে—
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে ॥
জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে।
মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে ॥
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ।
সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।
চরণপদ্মে মম চিত নিস্পন্দিত করো হে।
নন্দিত করো, নন্দিত করো, নন্দিত করো হে ॥
১১২
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে।
দিনের কর্ম আনিনু তোমার বিচারঘরে ॥
যদি পূজা করি মিছা দেবতার, শিরে ধরি যদি মিথ্যা আচার,
যদি পাপমনে করি অবিচার কাহারো ’পরে,
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে ॥
লোভে যদি কারে দিয়ে থাকি দুখ, ভয়ে হয়ে থাকি ধর্মবিমুখ,
পরের পীড়ায় পেয়ে থাকি সুখ ক্ষণেক-তরে—
তুমি যে জীবন দিয়েছ আমায় কলঙ্ক যদি দিয়ে থাকি তায়,
আপনি বিনাশ করি আপনায় মোহের ভয়ে,
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে ॥
১১৩
তোমারি ইচ্ছা হউক পূর্ণ করুণাময় স্বামী।
তোমারি প্রেম স্মরণে রাখি, চরণে রাখি আশা—
দাও দুঃখ, দাও তাপ, সকলই সহিব আমি॥
তব প্রেম-আঁখি সতত জাগে,জেনেও না জানি।
ওই মঙ্গলরূপ ভুলি, তাই শোকসাগরে নামি॥
আনন্দময় তোমার বিশ্ব শোভাসুখপূর্ণ,
আমি আপন দোষে দুঃখ পাই বাসনা-অনুগামী॥
মোহবন্ধ ছিন্ন করো কঠিন আঘাতে,
অশ্রুসলিলধৌত হৃদয়ে থাকো দিবসযামী॥
১১৪
অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ—
তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান ॥
শুষ্ক হৃদয় মম কঠিন পাষাণসম,
প্রেমসলিলধারে সিঞ্চহ শুষ্ক নয়ান ॥
যে তোমারে ডাকে না হে তারে তুমি ডাকো-ডাকো।
তোমা হতে দূরে যে যায় তারে তুমি রাখো রাখো।
তৃষিত যেজন ফিরে তব সুধাসাগরতীরে
জুড়াও তাহারে স্নেহনীরে, সুধা করাও হে পান ॥
তোমারে পেয়েছিনু যে, কখন্ হারানু অবহেলে,
কখন্ ঘুমাইনু হে, আঁধার হেরি আঁখি মেলে।
বিরহ জানাইব কায়, সান্ত্বনা কে দিবে হায়,
বরষ বরষ চলে যায়, হেরি নি প্রেমবয়ান—
দরশন দাও হে, দাও হে দাও, কাঁদে হৃদয় ম্রিয়মাণ ॥
১১৫
হেমহাজীবন, হে মহামরণ, লইনু শরণ, লইনু শরণ॥
আঁধার প্রদীপে জ্বালাও শিখা,
পরাও পরাও জ্যোতির টিকা— করো হে আমার লজ্জহরণ॥
পরশরতন তোমারি চরণ— লইনু শরণ,লইনু শরণ।
যা-কিছু মলিন, যা-কিছু কালো,
যা-কিছু বিরূপ হোক তা ভালো— ঘুচাও ঘুচাও সব আবরণ॥
১১৬
পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে।
পিছিয়ে পড়েছি আমি, যাব যে কী করে?।
এসেছে নিবিড় নিশি, পথরেখা গেছে মিশি—
সাড়া দাও, সাড়া দাও আঁধারের ঘোরে॥
ভয় হয়, পাছে ঘুরে ঘুরে যত আমি যাই তত যাই চলে দূরে—
মনে করি আছ কাছে, তবু ভয় হয়, পাছে
আমি আছি তুমি নাই কালি নিশিভোরে॥
১১৭
দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া নিত্য কল্যাণ-কাজে হে।
ফিরিব আহ্বান মানিয়া তোমারি রাজ্যের মাঝে হে ॥
মজিয়া অনুখন লালসে রব না পড়িয়া আলসে,
হয়েছে জর্জর জীবন ব্যর্থ দিবসের লাজে ॥
আমারে রহে যেন না ঘিরি সতত বহুতর সংশয়,
বিবিধ পথে যেন না ফিরি বহুল-সংগ্রহ-আশয়ে।
অনেক নৃপতির শাসনে না রহি শঙ্কিত আসনে,
ফিরিব নির্ভয়গৌরবে তোমারি ভৃত্যের সাজে ॥
১১৮
ধনে জনে আছি জড়ায়ে হায়,
তবু জানো মন তোমারে চায় ॥
অন্তরে আছ অন্তর্যামী,
আমা চেয়ে আমার জানিছ স্বামী—
সব সুখে দুখে ভুলে থাকায়
জানো মম মন তোমারে চায় ॥
ছাড়িতে পারি নি অহঙ্কারে,
ঘুরে মরি শিরে বহিয়া তারে,
ছাড়িতে পারিলে বাঁচি যে হায়—
তুমি জানো মন তোমারে চায়।
যা আছ আমার সকলই কবে
নিজ হাতে তুমি তুলিয়া লবে—
সব ছেড়ে সব পাব তোমায়।
মনে মনে মন তোমারে চায় ॥
১১৯
তোমারি সেবক করো হে আজি হতে আমারে।
চিত্ত-মাঝে দিবারাত আদেশ তব দেহো নাথ,
তোমার কর্মে রাখো বিশ্বদুয়ারে॥
করো ছিন্ন মোহপাশ সকল লুব্ধ আশ,
লোকভয় দূর করি দাও দাও।
রত রাখো কল্যাণে নীরবে নিরভিমানে,
মগ্ন করো আনন্দরসধারে॥
১২০
তুমি এবার আমায় লহো হে নাথ, লহো।
এবার তুমি ফিরো না হে—
হৃদয় কেড়ে নিয়ে রহো ॥
যে দিন গেছে তোমা বিনা তারে আর ফিরে চাহি না,
যাক সে ধুলাতে।
এখন তোমার আলোয় জীবন মেলে যেন জাগি অহরহ ॥
কী আবেশে কিসের কথায় ফিরেছি হে যথায় তথায়
পথে প্রান্তরে,
এবার বুকের কাছে ও মুখ রেখে তোমার আপন বাণী কহো ॥
কত কলুষ কত ফাঁকি এখনো যে আছে বাকি
মনের গোপনে,
আমায় তার লাগি আর ফিরায়ো না—
তারে আগুন দিয়ে দহো ॥
১২১
হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাই।
সংসারে যা দিবে মানিব তাই,
হৃদয়ে তোমায় যেন পাই॥
তব দয়া জাগিবে স্মরণে
নিশিদিন জীবনে মরণে,
দুঃখে সুখে সম্পদে বিপদে তোমারি দয়া-পানে চাই—
তোমার দয়া যেন পাই।
তব দয়া শান্তিনীরে অন্তরে নামিবে ধীরে।
তব দয়া মঙ্গল-আলো
জীবন-আঁধারে জ্বালো—
প্রেমভক্তি মম সকল শক্তি মম তোমারি দয়ারূপে পাই,
আমার ব’লে কিছু নাই॥
১২২
ভুবনেশ্বর হে,
মোচন কর’ বন্ধন সব মোচন কর’ হে ॥
প্রভু, মোচন কর’ ভয়,
সব দৈন্য করহ লয়,
নিত্য চকিত চঞ্চল চিত কর’ নিঃসংশয়।
তিমিররাত্রি, অন্ধ যাত্রী,
সমুখে তব দীপ্ত দীপ তুলিয়া ধর’ হে ॥
ভুবনেশ্বর হে,
মোচন কর’ জড়বিষাদ মোচন কর’ হে।
প্রভু তব প্রসন্ন মুখ
সব দুঃখ করুক সুখ,
ধূলিপতিত দুর্বল চিত করহ জাগরূক।
তিমিররাত্রি, অন্ধ যাত্রী,
সমুখে তব দীপ্ত দীপ তুলিয়া ধর’ হে ॥
ভুবনেশ্বর হে,
মোচন কর’ স্বার্থপাশ মোচন কর’ হে।
প্রভু, বিরস বিকল প্রাণ,
কর’ প্রেমসলিল দান,
ক্ষতিপীড়িত শঙ্কিত চিত কর’ সম্পদবান।
তিমিররাত্রি, অন্ধ যাত্রী,
সমুখে তব দীপ্ত দীপ তুলিয়া ধর’ হে ॥
১২৩
আমার সত্য মিথ্যা সকলই ভুলায়ে দাও,
আমার আনন্দে ভাসাও ॥
না চাহি তর্ক না চাহি যুক্তি, না জানি বন্ধ না জানি মুক্তি,
তোমার বিশ্বব্যাপিনী ইচ্ছা আমার অন্তরে জাগাও ॥
সকল বিশ্ব ডুবিয়া যাক শান্তিপাথারে,
সব সুখ দুখ থামিয়া যাক হৃদয়মাঝারে।
সকল বাক্য সকল শব্দ সকল চেষ্টা হউক স্তব্ধ—
তোমার চিত্তজয়িনী বাণী আমার অন্তরে শুনাও ॥
১২৪
ভয় হতে তব অভয়মাঝে নূতন জনম দাও হে ॥
দীনতা হতে অক্ষয় ধনে, সংশয় হতে সত্যসদনে,
জড়তা হতে নবীন জীবনে নূতন জনম দাও হে ॥
আমার ইচ্ছা হইতে, প্রভু, তোমার ইচ্ছামাঝে—
আমার স্বার্থ হইতে প্রভু, তব মঙ্গলকাজে—
অনেক হইতে একের ডোরে, সুখদুখ হতে শান্তিক্রোড়ে—
আমা হতে, নাথ, তোমাতে মোরে নূতন জনম দাও হে ॥
১২৫
পাদপ্রান্তে রাখ’ সেবকে,
শান্তিসদন সাধনধন দেবদেব হে ॥
সর্বলোকপরমশরণ, সকলমোহকলুষহরণ,
দুঃখতাপবিঘ্নতরণ, শোকশান্তস্নিগ্ধচরণ,
সত্যরূপ প্রেমরূপ হে,
দেবমনুজবন্দিতপদ বিশ্বভূপ হে ॥
হৃদয়ানন্দ পূর্ণ ইন্দু, তুমি অপার প্রেমসিন্ধু।
যাচে তৃষিত অমিয়বিন্দু, করুণালয় ভক্তবন্ধু
প্রেমনেত্রে চাহ’ সেবকে,
বিকশিতদল চিত্তকমল হৃদয়দেব হে ॥
পুণ্যজ্যোতিপূর্ণ গগন, মধুর হেরি সকল ভুবন,
সুধাগন্ধমুদিত পবন, ধ্বনিতগীত হৃদয়ভবন।
এস’ এস’ শূন্য জীবনে,
মিটাও আশ সব তিয়াষ অমৃতপ্লাবনে ॥
দেহ’ জ্ঞান, প্রেম দেহ’, শুষ্ক চিত্ত বরিষ স্নেহ।
ধন্য হোক হৃদয় দেহ’, পুণ্য হোক সকল গেহ।
পাদপ্রান্তে রাখ' সেবকে,
শান্তিসদন সাধনধন দেবদেব হে ॥
১২৬
বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি
শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে
উধ্বমুখে নরনারী ॥
না থাকে অন্ধকার, না থাকে মোহপাপ,
না থাকে শোকপরিতাপ।
হৃদয় বিমল হোক, প্রাণ সবল হোক,
বিঘ্ন দাও অপসারি ॥
কেন এ হিংসাদ্বেষ, কেন এ ছদ্মবেশ,
কেন এ মান-অভিমান।
বিতর' বিতর' প্রেম পাষাণহৃদয়ে,
জয় জয় হোক তোমারি ॥
১২৭
সার্থক কর’ সাধন,
সান্ত্বন কর’ ধরিত্রীর বিরহাতুর কাঁদন
প্রাণভরণ দৈন্যহরণ অক্ষয়করুণাধন॥
বিকশিত কর’ কলিকা,
চম্পকবন করুক রচন নব কুসুমাঞ্জলিকা।
কর’ সুন্দর গীতমুখর নীরব আরাধন
অক্ষয়করুণাধন॥
চরণপরশহরষে
লজ্জিত বনবীথিধূলি সজ্জিত তুমি কর’ সে।
মোচন কর’ অন্তরতর
হিমজড়িমা-বাঁধন
অক্ষয়করুণাধন॥
১২৮
আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে !
তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায় রাখবে কোথায় ঢেকে ?।
কতকালের সকাল-সাঁঝে তোমার চরণধ্বনি বাজে,
গোপনে দূত হৃদয়-মাঝে গেছে আমায় ডেকে ॥
ওগো পথিক, আজকে আমার সকল পরান ব্যেপে
থেকে থেকে হরষ যেন উঠছে কেঁপে কেঁপে।
যেন সময় এসেছে আজ ফুরালো মোর যা ছিল কাজ—
বাতাস আসে, হে মহারাজ, তোমার গন্ধ মেখে ॥
১২৯
কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো !
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো ॥
রয়েছে দীপ, না আছে শিখা, এই কি ভালে ছিল রে লিখা—
ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো
বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো ॥
বেদনাদূতী গাহিছে, ওরে প্রাণ,
তোমার লাগি জাগেন ভগবান।
নিশীথে ঘন অন্ধকারে ডাকেন তোরে প্রেমাভিসারে,
দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান।
তোমার লাগি জাগেন ভগবান।'
গগনতল গিয়েছে মেঘে ভরি,
বাদলজল পড়িছে ঝরি ঝরি।
এ ঘোর রাতে কিসের লাগি পরান মম সহসা জাগি
এমন কেন করিছে মরি মরি।
বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি ॥
বিজুলি শুধু ক্ষণিক আভা হানে,
নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।
জানি না কোথা অনেক দূরে বাজিল গান গভীর সুরে,
সকল প্রাণ টানিছে পথ পানে
নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।
কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো !
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
ডাকিছে মেঘ, হাঁকিছে হাওয়া, সময় হবে না যাওয়া—
নিবিড় নিশা নিকষঘনকালো।
পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো ॥
১৩০
তোরা শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি,
ওই যে আসে, আসে, আসে।
যুগে যুগে পলে পলে দিন-রজনী
সে যে আসে, আসে, আসে ॥
গেয়েছি গান যখন যত আপন মনে খ্যাপার মতো,
সকল সুরে বেজেছে তার আগমনী—
সে যে আসে, আসে, আসে ॥
কত কালের ফাগুন-দিনে বনের পথে
সে যে আসে, আসে, আসে।
কত শ্রাবণ-অন্ধকারে মেঘের রথে
সে যে আসে, আসে, আসে।
দুখের পরে পরম দুখে তারি চরণ বাজে বুকে,
সুখে কখন বুলিয়ে সে দেয় পরশমণি।
সে যে আসে, আসে, আসে॥
১৩১
হে অন্তরের ধন,
তুমি যে বিরহী, তোমার শূন্য এ ভবন॥
আমার ঘরে তোমায় আমি একা রেখে দিলাম স্বামী—
কোথায় যে বাহিরে আমি ঘুরি সকল ক্ষণ॥
হে অন্তরের ধন,
এই বিরহে কাঁদে আমার নিখিল ভুবন।
তোমার বাঁশি নানা সুরে আমায় খুঁজে বেড়ায় দূরে,
পাগল হল বসন্তের এই দখিন-সমীরণ॥
১৩২
তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি।
বুঝতে নারি কখন্ তুমি দাও-যে ফাঁকি ॥
ফুলের মালা দীপের আলো ধূপের ধোঁওয়ার
পিছন হতে পাই নে সুযোগ চরণ-ছোঁয়ার,
স্তবের বাণীর আড়াল টানি তোমায় ঢাকি ॥
দেখব ব’লে এই আয়োজন মিথ্যা রাখি,
আছে তো মোর তৃষা-কাতর আপন-আঁখি।
কাজ কী আমার মন্দিরেতে আনাগোনায়—
পাতব আসন আপন মনের একটি কোণায়,
সরল প্রাণে নীরব হয়ে তোমায় ডাকি ॥
১৩৩
নীরবে আছ কেন বাহিরদুয়ারে—
আঁধার লাগে চোখে, দেখি না তুহারে ॥
সময় হল জানি, নিকটে লবে টানি,
আমার তরীখানি ভাসাবে জুয়ারে ॥
সফল হোক প্রাণ এ শুভলগনে,
সকল তারা তাই গাহুক গগনে।
করো গো সচকিত আলোকে পুলকিত
স্বপননিমীলিত হৃদয়গুহারে ॥
১৩৪
তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে
কত আর সেতু বাঁধি সুরে সুরে তালে তালে ॥
তবু যে পরানমাঝে গোপনে বেদনা বাজে—
এবার সেবার কাজে ডেকে লও সন্ধ্যাকালে ॥
বিশ্ব হতে থাকি দূরে অন্তরের অন্তঃপুরে,
চেতনা জড়ায়ে রহে ভাবনার স্বপ্নজালে।
দুঃখ সুখ আপনারই সে বোঝা হয়েছে ভারী,
যেন সে সঁপিতে পারি চরম পূজার থালে ॥
১৩৫
নিশা-অবসানে কে দিল গোপনে আনি
তোমার বিরহ-বেদনা-মানিকখানি ॥
সে ব্যথার দান রাখিব পরানমাঝে—
হারায় না যেন জটিল দিনের কাজে,
বুকে যেন দোলে সকল ভাবনা হানি ॥
চিরদুখ মম চিরসক্পদ হবে,
চরম পূজায় হবে সার্থক কবে।
স্বপনগহন নিবিড়তিমিরতলে
বিহ্বল রাতে সে যেন গোপনে জ্বলে,
সেই তো নীরব তব আহ্বানবাণী ॥
১৩৬
বিশ্ব যখন নিদ্রামগন, গগন অন্ধকার,
কে দেয় আমার বীণার তারে এমন ঝঙ্কার॥
নয়নে ঘুম নিল কেড়ে, উঠে বসি শয়ন ছেড়ে—
মেলে আঁখি চেয়ে থাকি, পাই নে দেখা তার॥
গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া প্রাণ উঠিল পুরে,
জানি নে কোন্ বিপুল বাণী বাজে ব্যাকুল সুরে।
কোন্ বেদনায় বুঝি না রে হৃদয় ভরা অশ্রুভারে,
পরিয়ে দিতে চাই কাহারে আপন কণ্ঠহার॥
১৩৭
যে দিন ফুটল কমল কিছুই জানি নাই,
আমি ছিলেম অন্যমনে।
আমার সাজিয়ে সাজি তারে আনি নাই,
সে যে রইল সঙ্গোপনে॥
মাঝে মাঝে হিয়া আকুলপ্রায়
স্বপন দেখে চমকে উঠে চায়,
মন্দ মধুর গন্ধ আসে হায়
কোথায় দখিন-সমীরণে॥
ওগো, সেই সুগন্ধে ফিরায় উদাসিয়া
আমায় দেশে দেশান্তে।
যেন সন্ধানে তার উঠে নিশ্বাসিয়া
ভুবন নবীন বসন্তে।
কে জানিত দূরে তো নেই সে,
আমারি গো আমারি সেই যে,
এ মাধুরী ফুটেছে হায় রে
আমার হৃদয়-উপবনে॥
১৩৮
প্রভু, তোমা লাগি আঁখি জাগে;
দেখা নাই পাই
পথ চাই,
সেও মনে ভালো লাগে ॥
ধুলাতে বসিয়া দ্বারে ভিখারি হৃদয় হা রে
তোমারি করুণা মাগে;
কৃপা নাই পাই
শুধু চাই,
সেও মনে ভালো লাগে ॥
আজি এ জগতমাঝে কত সুখে কত কাজে
চলে গেল সবে আগে;
সাথি নাই পাই
তোমায় চাই,
সেও মনে ভালো লাগে।
চারি দিকে সুধা-ভরা ব্যাকুল শ্যামল ধরা
কাঁদায় রে অনুরাগে ;
দেখা নাই পাই
ব্যথা পাই.
সেও মনে ভালো লাগে ॥
১৩৯
যদি তোমার দেখা না পাই, প্রভু, এবার এ জীবনে
তবে তোমায় আমি পাই নি যেন সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই শয়নে স্বপনে ॥
এ সংসারের হাটে
আমার যতই দিবস কাটে,
আমার যতই দু হাত ভরে উঠে ধনে
তবু কিছুই আমি পাই নি যেন সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই শয়নে স্বপনে ॥
যদি আলসভরে
আমি বসি পথের ’পরে,
যদি ধুলায় শয়ন পাতি সযতনে,
যেন সকল পথই বাকি আছে সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই শয়নে স্বপনে॥
যতই উঠে হাসি,
ঘরে যতই বাজে বাঁশি,
ওগো যতই গৃহ সাজাই আয়োজনে,
যেন তোমায় ঘরে হয় নি আনা সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই শয়নে স্বপনে ॥
১৪০
হেরি অহরহ তোমারি বিরহ ভুবনে ভুবনে রাজে হে,
কত রূপ ধরে কাননে ভূধরে আকাশে সাগরে সাজে হে ॥
সারা নিশি ধরি তারায় তারায় অনিমেষ চোখে নীরবে দাঁড়ায়,
পল্লবদলে শ্রাবণধারায় তোমারি বিরহ বাজে হে ॥
ঘরে ঘরে আজি কত বেদনায় তোমারি গভীর বিরহ ঘনায়
কত প্রেমে হায়, কত বাসনায়, কত সুখে দুখে কাজে হে।
সকল জীবন উদাস করিয়া কত গানে সুরে গলিয়া ঝরিয়া
তোমার বিরহ উঠিছে ভরিয়া আমার হিয়ার মাঝে হে ॥
১৪১
আমার গোধূলিলগন এল বুঝি কাছে গোধূলিলগন রে।
বিবাহের রঙে রাঙা হয়ে আসে সোনার গগন রে।
শেষ ক’রে দিল পাখি গান গাওয়া, নদীর উপরে পড়ে এল হাওয়া;
ও পারের তীর, ভাঙা মন্দির আঁধারে মগন রে।
আসিছে মধুর ঝিল্লিনূপুরে গোধূলিলগনে রে ॥
আমার দিন কেটে গেছে কখনো খেলায়, কখনো কত কী কাজে।
এখন কী শুনি পূরবীর সুরে কোন্ দূরে বাঁশি বাজে।
বুঝি দেরি নাই, আসে বুঝি আসে, আলোকের আভা লেগেছে আকাশে—
বেলাশেষে মোরে কে সাজাবে, ওরে, নবমিলনের সাজে !
সারা হল কাজ, মিছে কেন আজ ডাক মোরে আর কাজে ॥
আমি জানি যে আমার হয়ে গেছে গণা গোধূলিলগনে রে।
ধূসর আলোকে মুদিবে নয়ন অস্তগগন রে।
তখন এ ঘরে কে খুলিবে দ্বার, কে লইবে টানি বাহু আমার,
আমায় কে জানে কী মন্ত্রে গানে করিবে মগন রে—
সব গান সেরে আসিবে যখন গোধূলিলগন রে ॥
১৪২
নাই বা ডাকো রইব তোমার দ্বারে,
মুখ ফিরালে ফিরল না এইবারে ॥
বসব তোমার পথের ধুলার ’পরে,
এড়িয়ে আমায় চলবে কেমন করে-
তোমার তরে যে জন গাঁথে মালা
গানের কুসুম জুগিয়ে দেব তারে ॥
রইব তোমার ফসল-খেতের কাছে
যেথায় তোমার পায়ের চিহ্ন আছে।
জেগে রব গভীর উপবাসে
অন্ন তোমার আপনি যেথায় আসে-
যেথায় তুমি লুকিয়ে প্রদীপ জ্বালো
বসে রব সেথায় অন্ধকারে ॥
১৪৩
সকাল-সাঁজে
ধায় যে ওরা নানা কাজে ॥
আমি কেবল বসে আছি, আপন মনে কাঁটা বাছি
পথের মাঝে সকাল-সাঁঝে ॥
এ পথ বেয়ে
সে আসে তাই আছি চেয়ে।
কতই কাঁটা বাজে পায়ে, কতই ধুলা লাগে গায়ে-
মরি লাজে সকাল-সাঁজে ॥
১৪৪
জগত জুড়ে উদার সুরে আনন্দগান বাজে,
সে গান কবে গভীর রবে বাজিবে হিয়া-মাঝে॥
বাতাস জল আকাশ আলো সবারে কবে বাসিব ভালো,
হৃদয়সভা জুড়িয়া তারা বসিবে নানা সাজে॥
নয়ন দুটি মেলিলে কবে পরান হবে খুশি,
যে পথ দিয়া চলিয়া যাব সবারে যাব তুষি।
রয়েছ তুমি এ কথা কবে জীবনমাঝে সহজ হবে,
আপনি কবে তোমারি নাম ধ্বনিবে সব কাজে॥
১৪৫
কোন্ শুভখনে উদিবে নয়নে অপরূপ রূপ-ইন্দু
চিত্তকুসুমে ভরিয়া উঠিবে মধুময় রসবিন্দু॥
নব নন্দনতানে চিরবন্দনগানে
উৎসববীণা মন্দমধুর ঝঙ্কৃত হবে প্রাণে-
নিখিলের পানে উথলি উঠিবে উতলা চেতনাসিন্ধু।
জাগিয়া রহিবে রাত্রি নিবিড়মিলনদাত্রী,
মুখরিয়া দিক চলিবে পথিক অমৃতসভার যাত্রী-
গগনে ধ্বনিবে ‘নাথ নাথ বন্ধু বন্ধু বন্ধু’॥
১৪৬
আজ জ্যোত্স্নারাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে॥
যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে—
এই নিরালায় রব আপন কোণে।
যাব না এই মাতাল সমীরণে॥
আমার এ ঘর বহু যতন ক’রে
ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।
আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে॥
১৪৭
তুমি এ-পার ও-পার কর কে গো ওগো খেয়ার নেয়ে ?
আমি ঘরের দ্বারে বসে বসে দেখি যে সব চেয়ে ॥
ভাঙিলে হাট দলে দলে সবাই যবে ঘরে চলে
আমি তখন মনে ভাবি আমিও যাই ধেয়ে ॥
দেখি সন্ধ্যাবেলা ও পার-পানে তরণী যাও বেয়ে।
দেখে মন যে আমার কেমন করে, ওঠে যে গান গেয়ে
ওগো খেয়ার নেয়ে ॥
কালো জলের কলকলে আঁখি আমার ছলছলে,
ও পার হতে সোনার আভা পরান ফেলে ছেয়ে।
দেখি তোমার মুখে কথাটি নাই ওগো খেয়ার নেয়ে—
কী যে তোমার চোখে লেখা আছে দেখি যে সব চেয়ে
ওগো খেয়ার নেয়ে।
আমার মুখে ক্ষণতরে যদি তোমার আঁখি পড়ে
আমি তখন মনে ভাবি আমিও যাই ধেয়ে
ওগো খেয়ার নেয়ে ॥
১৪৮
বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে।
শূন্য ঘাটে একা আমি, পার ক'রে লও খেয়ার নেয়ে ॥
ভেঙে এলেম খেলার বাঁশি, চুকিয়ে এলেম কান্না হাসি,
সন্ধ্যাবায়ে শ্রান্তকায়ে ঘুমে নয়ন আসে ছেয়ে ॥
ও পারেতে ঘরে ঘরে সন্ধ্যাদীপ জ্বলিল রে,
আরতির শঙ্খ বাজে সুদূর মন্দির-'পরে।
এসো এসো শ্রান্তিহরা, এসো শান্তি-সুপ্তি-ভরা,
এসো এসো তুমি এসো, এসো তোমার তরী বেয়ে ॥
১৪৯
তোর ভিতরে জাগিয়া কে যে,
তারে বাঁধনে রাখিলি বাঁধি।
হায় আলোর পিয়াসি সে যে
তাই গুমরি উঠিছে কাঁদি ॥
যদি বাতাসে বহিল প্রাণ
কেন বীণায় বাজে না গান,
যদি গগনে জাগিল আলো
কেন নয়নে লাগিল আঁধি ?।
পাখি নবপ্রভাতের বাণী
দিল কাননে কাননে আনি,
ফুলে নবজীবনের আশা
কত রঙে রঙে পায় ভাষা।
হোথা ফুরায়ে গিয়েছে রাতি,
হেথা জ্বলে নিশীথের বাতি-
তোর ভবনে ভুবনে কেন
হেন হয়ে গেল আধা-আধি ?।
১৫০
তুমি বাহির থেকে দিলে বিষম তাড়া
তাই ভয়ে ঘোরায় দিক্বিদিকে,
শেষে অন্তরে পাই সাড়া ॥
যখন হারাই বন্ধ ঘরের তালা—
যখন অন্ধ নয়ন, শ্রবণ কালা,
তখন অন্ধকারে লুকিয়ে দ্বারে
শিকলে দাও নাড়া ॥
যত দুঃখ আমার দুঃস্বপনে,
সে যে ঘুমের ঘোরেই আসে মনে—
ঠেলা দিয়ে মায়ার আবেশ
কর গো দেশছাড়া।
আমি আপন মনের মারেই মরি,
শেষে দশ জনারে দোষী করি—
আমি চোখ বুজে পথ পাই নে ব’লে
কেঁদে ভাসাই পাড়া॥
১৫১
এখনো গেল না আঁধার, এখনো রহিল বাধা।
এখনো মরণব্রত জীবনে হল না সাধা ॥
কবে যে দুঃখজ্বালা হবে রে বিজয়মালা,
ঝলিবে অরুণরাগে নিশীথরাতের কাঁদা ॥
এখনো নিজেরই ছায়া রচিছে কত যে মায়া।
এখনো কেন যে মিছে চাহিছে কেবলই পিছে,
চকিতে বিজলি-আলো চোখেতে লাগালো ধাঁদা ॥
১৫২
লক্ষ্মী যখন আসবে তখন কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই?
দেখ্ রে চেয়ে আপন-পানে, পদ্মটি নাই, পদ্মটি নাই ॥
ফিরছে কেঁদে প্রভাতবাতাস, আলোকে যে তার ম্লান হতাশ,
মুখে চেয়ে আকাশ তোরে শুধায় আজি নীরবে তাই ॥
কত গোপন আশা নিয়ে কোন্ সে গহন রাত্রিশেষে
অগাধ জলের তলা হতে অমল কুঁড়ি উঠল ভেসে।
হল না তার ফুটে ওঠা, কখন ভেঙে পড়ল বোঁটা-
মর্ত-কাছে স্বর্গ যা চায় সেই মাধুরী কোথা রে পাই॥
১৫৩
যেতে যেতে চায় না যেতে, ফিরে ফিরে চায়-
সবাই মিলে পথে চলা হল আমার দায় গো॥
দুয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকে- দেয় না সাড়া হাজার ডাকে-
বাঁধন এদের সাধনধন, ছিঁড়তে যে ভয় পায়॥
আবেশভরে ধুলায় প’ড়ে কতই করে ছল,
যখন বেলা যাবে চলে ফেলবে আঁখিজল।
নাই ভরসা, নাই যে সাহস, চিত্ত অবশ, চরণ অলস-
লতার মতো জড়িয়ে ধরে আপন বেদনায়॥
১৫৪
বেসুর বাজে রে,
আর কোথা নয়, কেবল তোরই আপন-মাঝে রে ॥
মেলে না সুর এই প্রভাতে আনন্দিত আলোর সাথে,
সবারে সে আড়াল করে, মরি লাজে রে ॥
ওরে থামা রে ঝঙ্কার।
নীরব হয়ে দেখ্ রে চেয়ে, দেখ্ রে চারি ধার।
তোরই হৃদয় ফুটে আছে মধুর হয়ে ফুলের গাছে,
নদীর ধারা ছুটছে ওই তোরই কাজে রে ॥
১৫৫
আমার কণ্ঠ তারে ডাকে,
তখন হৃদয় কোথায় থাকে ॥
যখন হৃদয় আসে ফিরে আপন নীরব নীড়ে
আমার জীবন তখন কোন্ গহনে বেড়ায় কিসের পাকে ॥
যখন মোহ আমায় ডাকে
তখন লজ্জা কোথায় থাকে!
যখন আনেন তমোহারী আলোক-তরবারী
তখন পরান আমার কোন্ কোণে যে
লজ্জাতে মুখ ঢাকে ॥
১৫৬
দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে,
আপন জেনে আদর করি নে।
পিতা ব’লে প্রণাম করি পায়ে,
বন্ধু ব’লে দু হাত ধরি নে ॥
আপনি তুমি অতি সহজ প্রেমে
আমার হয়ে যেথায় এলে নেমে
সেথায় সুখে বুকের মধ্যে ধ’রে সঙ্গী ব’লে তোমায় বরি নে ॥
ভাই তুমি যে ভাইয়ের মাঝে, প্রভু,
তাদের পানে তাকাই না যে তবু—
ভাইয়ের সাথে ভাগ ক’রে মোর ধন তোমার মুঠা কেন ভরি নে।
ছুটে এসে সবার সুখে দুখে
দাঁড়াই নে তো তোমারি সম্মুখে,
সঁপিয়ে প্রাণ ক্লান্তিবিহীন কাজে প্রাণসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ি নে ॥
১৫৭
ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু,
পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু॥
এই-যে হিয়া থরোথরো কাঁপে আজি এমনতরো
এই বেদনা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু॥
এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু,
পিছন-পানে তাকাই যদি কভু।
দিনের তাপে রৌদ্রজ্বালায় শুকায় মালা পূজার থালায়,
সেই ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু॥
১৫৮
অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন ক’রে!
আকাশ কাঁপে তারার আলোর গানের ঘোরে ॥
তেমনি ক’রে আপন হাতে ছুঁলে আমার বেদনাতে,
নূতন সৃষ্টি জাগল বুঝি জীবন-’পরে ॥
বাজে ব’লেই বাজাও তুমি সেই গরবে,
ওগো প্রভু, আমার প্রাণে সকল সবে।
বিষম তোমার বহ্নিঘাতে বারে বারে আমার রাতে
জ্বালিয়ে দিলে নূতন তারা ব্যথায় ভ’রে ॥
১৫৯
পথ চেয়ে যে কেটে গেল কত দিনে রাতে,
আজ, তোমায় আমায় প্রাণের বঁধু মিলব গো এক সাথে ॥
রচবে তোমার মুখের ছায়া চোখের জলে মধুর মায়া,
নীরব হয়ে তোমার পানে চাইব গো জোড় হাতে ॥
এরা সবাই কী বলে গো লাগে না মন আর,
আমার হৃদয় ভেঙে দিল তোমার কী মাধুরীর ভার !
বাহুর ঘেরে তুমি মোরে রাখবে না কি আড়াল করে,
তোমার আঁখি চাইবে না কি আমার বেদনাতে ?।
১৬০
সন্ধ্যা হল গো- ও মা, সন্ধ্যা হল, বুকে ধরো।
অতল কালো স্নেহের মাঝে ডুবিয়ে আমায় স্নিগ্ধ করো॥
ফিরিয়ে নে মা, ফিরিয়ে নে গো- সব যে কোথায় হারিয়েছে গো
ছড়ানো এই জীবন, তোমার আঁধার-মাঝে হোক-না জড়ো॥
আর আমারে বাইরে তোমার কোথাও যেন না যায় দেখা।
তোমার রাতে মিলাক আমার জীবনসাঁজের রশ্মিরেখা।
আমায় ঘিরি আমায় চুমি কেবল তুমি, কেবল তুমি-
আমার ব’লে যা আছে, মা, তোমার ক’রে সকল হরো॥
১৬১
তুমি ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে কেউ তা জানে না,
আমার মন যে কাঁদে আপন-মনে কেউ তা মানে না ॥
ফিরি আমি উদাস প্রাণে, তাকাই সবার মুখের পানে,
তোমার মতো এমন টানে, কেউ তো টানে না ॥
বেজে উঠে পঞ্চমে স্বর, কেঁপে ওঠে বন্ধ এ ঘর,
বাহির হইতে দুয়ারে কর কেউ তো হানে না।
আকাশে কার ব্যাকুলতা, বাতাস বহে কার বারতা,
এ পথে সেই গোপন কথা কেউ তো আনে না ॥
১৬২
এ যে মোর আবরণ
ঘুচাতে কতক্ষণ !
নিশ্বাসবায় উড়ে চলে যায়
তুমি কর যদি মন ॥
যদি পড়ে থাকি ভূমে
ধুলার ধরণী চুমে ॥
তুমি তারি লাগি দ্বারে রবে জাগি
এ কেমন তব পণ ॥
রথের চাকার রবে
জাগাও জাগাও সবে,
আপনার ঘরে এসো বলভরে
এসো এসো গৌরবে।
ঘুম টুটে যাক চলে,
চিনি যেন প্রভু ব'লে-
ছুটে এসে দ্বারে করি আপনারে
চরণে সমর্পণ ॥
১৬৩
সকল জনম ভ’রে ও মোর
দরদিয়া
কাঁদি কাঁদাই তোরে ও মোর দরদিয়া
আছ হৃদয়-মাঝে॥
সেথা কতই ব্যথা বাজে,
ওগো এ কি তোমায় সাজে
ও মোর দরদিয়া?।
এই দুয়ার-দেওয়া ঘরে
কভু আঁধার নাহি সরে,
তবু আছ তারি ’পরে
ও মোর দরদিয়া।
সেথা আসন হয় নি পাতা,
সেথা মালা হয় নি গাঁথা,
আমার লজ্জাতে হেঁট মাথা
ও মোর দরদিয়া॥
১৬৪
আমার ব্যথা যখন আনে আমায় তোমার দ্বারে
তখন আপনি এসে দ্বার খুলে দাও, ডাকো তারে ॥
বাহুপাশের কাঙাল সে যে, চলেছে তাই সকল ত্যেজে,
কাঁটার পথে যায় সে তোমার অভিসারে ॥
আমার ব্যথা যখন বাজায় আমায় বাজি সুরে—
সেই গানের টানে পারো না আর রইতে দূরে।
লুটিয়ে পড়ে সে গান মম ঝড়ের রাতের পাখি-সম,
বাহির হয়ে এসো তুমি অন্ধকারে ॥
১৬৫
যতবার আলো জ্বালাতে চাই, নিবে যায় বারে বারে।
আমার জীবন তোমার আসন গভীর অন্ধকারে ॥
যে লতাটি আছে শুকায়েছে মূল— কুঁড়ি ধরে শুধু, নাহি ফোটে ফুল,
আমার জীবনে তব সেবা তাই বেদনার উপহারে ॥
পূজাগৌরব পুণ্যবিভব কিছু নাহি, নাহি লেশ—
এ তব পূজারি পরিয়া এসেছে লজ্জার দীন বেশ।
উত্সবে তার আসে নাই কেহ, বাজে নাই বাঁশি, সাজে নাই গেহ—
কাঁদিয়া তোমায় এনেছে ডাকিয়া ভাঙামন্দির-দ্বারে ॥
১৬৬
আবার এরা ঘিরেছে মার মন।
আবার চোখে নামে আবরণ ॥
আবার এ যে নানা কথাই জমে, চিত্ত আমার নানা দিকে ভ্রমে,
দাহ আবার বেড়ে ওঠে ক্রমে, আবার এ যে হারাই শ্রীচরণ ॥
তব নীরব বাণী হৃদয়তলে
ডোবে না যেন লোকের কোলাহলে।
সবার মাঝে আমার সাথে থাকো, আমায় সদা তোমার মাঝে ঢাকো,
নিয়ত মোর চেতনা- ’পরে রাখো আলোক-ভরা উদার ত্রিভুবন ॥
১৬৭
তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে,
এসো গন্ধে বরনে এসো গানে ॥
এসো অঙ্গে পুলকময় পরশে,
এসো চিত্তে সুধাময় হরষে,
এসো মুগ্ধ মুদিত দু’নয়ানে ॥
এসো নির্মল উজ্জ্বল কান্ত,
এসো সুন্দর স্নিগ্ধ প্রশান্ত,
এসো এসো হে বিচিত্র বিধানে।
এসো দুঃখে সুখে, এসো মর্মে,
এসো নিত্য নিত্য সব কর্মে,
এসো সকল-কর্ম অবসানে ॥
১৬৮
হৃদয়নন্দনবনে নিভৃত এ নিকেতনে
এসো হে আনন্দময়, এসো চিরসুন্দর ॥
দেখাও তব প্রেমমুখ, পাসরি সর্ব দুখ,
বিরহকাতর তপ্ত চিত্ত-মাঝে বিহারো ॥
শুভদিন শুভরজনী আনো এ জীবনে,
ব্যর্থ এ নরজনম সফল করো প্রিয়তম।
মধুর চিরসঙ্গীতে ধ্বনিত করো অন্তর,
ঝরিবে জীবনে মনে দিবানিশা সুধানিঝর ॥
১৬৯
বসে আছি হে কবে শুনিব তোমার বাণী।
কবে বাহির হইব জগতে মম জীবন ধন্য মানি ॥
কবে প্রাণ জাগিবে, তব প্রেম গাহিবে,
দ্বারে দ্বারে ফিরি সবার হৃদয় চাহিবে,
নরনারীমন করিয়া হরণ চরণে দিবে আনি ॥
কেহ শুনে না গান, জাগে না প্রাণ,
বিফলে গীত-অবসান—
তোমার বচন করিব রচন সাধ্য নাহি নাহি।
তুমি না কহিলে কেমনে কব প্রবল অজেয় বাণী তব,
তুমি যা বলিবে তাই বলিব— আমি কিছুই না জানি।
তব নামে আমি সবারে ডাকিব, হৃদয়ে লইব টানি ॥
১৭০
ডাকিছ শুনি জাগিনু প্রভু, আসিনু তব পাশে।
আঁখি ফুটিল, চাহি উঠিল চরণদরশ-আশে ॥
খুলিল দ্বার, তিমিরভার দূর হইল ত্রাসে।
হেরিল পথ বিশ্বজগত, ধাইল নিজ বাসে ॥
বিমলকিরণ প্রেম-আঁখি সুন্দর পরকাশে-
নিখিল তায় অভয় পায়, সকল জগত হাসে ॥
কানন সব ফুল্ল আজি, সৌরভ তব ভাসে-
মুগ্ধ হৃদয় মত্ত মধুপ প্রেমকুসুমবাসে ॥
উজ্জ্বল যত ভকতহৃদয়, মোহতিমির নাশে।
দাও, নাথ, প্রেম-অমৃত বঞ্চিত তব দাসে ॥
১৭১
আমি কারে ডাকি গো,
আমার বাঁধন দাও গো টুটে।
আমি হাত বাড়িয়ে আছি,
আমায় লও কেড়ে লও লুটে ॥
তুমি ডাকো এমনি ডাকে
যেন লজ্জাভয় না থাকে,
যেন সব ফেলে যাই, সব ঠেলে যাই,
যাই ধেয়ে যাই ছুটে ॥
আমি স্বপন দিয়ে বাঁধা—
কেবল ঘুমের ঘোরের বাধা,
সে যে জড়িয়ে আছে প্রাণের কাছে
মুদিয়ে আঁখিপুটে।
ওগো, দিনের পরে দিন
আমার কোথায় হল লীন,
কেবল ভাষাহারা অশ্রুধারায়
পরান কেঁদে উঠে ॥
১৭২
আজি মম মন চাহে জীবনবন্ধুরে,
সেই জনমে মরণে নিত্যসঙ্গী
নিশিদিন সুখে শোকে—
সেই চির-আনন্দ, বিমল চিরসুধা,
যুগে যুগে কত নব নব লোকে নিয়তশরণ ॥
পরাশান্তি, পরমপ্রেম, পরামুক্তি, পরমক্ষেম,
সেই অন্তরতম চিরসুন্দর প্রভু, চিত্তসখা,
ধর্ম-অর্থ-কান-ভরণ রাজা হৃদয়হণ ॥
১৭৩
আমার মন তুমি, নাথ, লবে হ’রে
আমি আছি বসে সেই আশা ধরে ॥
নীলাকাশে ওই তারা ভাসে, নীরব নিশীথে শশী হাসে,
আমার দু নয়নে বারি আসে ভরে— আছি আশা ধরে ॥
স্থলে জলে তব ধূলিতলে, তরুলতা তব ফুলে ফলে,
নরনারীদের প্রেমডোরে,
নানা দিকে দিকে নানা কালে, নানা সুরে সুরে নানা তালে
নানা মতে তুমি লবে মোরে— আছি আশা ধরে ॥
১৭৪
ঘাটে বসে আছি আনমনা যেতেছে বহিয়া সুসময়-
সে বাতাসে তরী ভাসাব না যাহা তোমা-পানে নাহি বয় ॥
দিন যায় ওগো দিন যায়, দিনমণি যায় অস্তে-
নিশার তিমিরে দশ দিক ঘিরে জাগিয়া উঠিছে উঠিছে শত ভয় ॥
ঘরের ঠিকানা হল না গো, মন করে তবু যাই-যাই-
ধ্রুবতারা তুমি যেথা জাগ সে দিকের পথ চিনি নাই॥
এত দিন তরী বাহিলাম যে সুদূর পথ বাহিয়া-
শত বার তরী ডুবুডুবু করি সে পথে ভরসা নাহি পাই ॥
তীর-সাথে হেরো শত ডোরে বাঁধা আছে মোর তরীখান-
রশি খুলে দেবে কবে মোরে, ভাসিতে পারিলে বাঁচে প্রাণ।
কবে অকূলের খোলা হাওয়া দিবে সব জ্বালা জুড়ায়ে,
শুনা যাবে কবে ঘনঘোর রবে মহাসাগরের কলগান ॥
১৭৫
এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে, হবে গো এইবার-
আমার এই মলিন অহঙ্কার॥
দিনের কাজে ধুলা লাগি অনেক দাগে হল দাগি,
এমনি তপ্ত হয়ে আছে সহ্য করা ভার
আমার এই মলিন অহঙ্কার ॥
এখন তো কাজ সাঙ্গ হল দিনের অবসানে-
হল রে তাঁর আসার সময়, আশা এল প্রাণে।
স্নান ক’রে আয় এখন তবে প্রেমের বসন পরতে হবে,
সন্ধ্যাবনের কুসুম তুলে গাঁথতে হবে হার।
ওরে আয়, সময় নেই যে আর ॥
১৭৬
নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা।
মন রে মোর, পাথারে হোস নে দিশেহারা ॥
বিষাদে হয়ে ম্রিয়মাণ বন্ধ না করিয়ো গান,
সফল করি তোলো প্রাণ টুটিয়া মোহকারা ॥
রাখিয়ো বল জীবনে, রাখিয়ো চির-আশা,
শোভন এই ভুবনে রাখিয়ো ভালোবাসা।
সংসারের সুখে দুখে চলিয়া যেয়ো হাসিমুখে,
ভরিয়া সদা রেখো বুকে তাঁহারি সুধাধারা ॥
১৭৭
প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুর—
তুমি দেহো মোরে কথা, তুমি দেহো মোরে সুর—
তুমি যদি থাক মনে বিকচ কমলাসনে,
তুমি যদি কর প্রাণ তব প্রেমে পরিপূর,
প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুর॥
তুমি শোন যদি গান আমার সমুখে থাকি,
সুধা যদি করে দান তোমার উদার আঁখি,
তুমি যদি দুখ’পরে রাখ কর স্নেহভরে,
তুমি যদি সুখ হতে দম্ভ করহ দূর,
প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুর॥
১৭৮
নিশীথশয়নে ভেবে রাখি মনে, ওগো অন্তরযামী,
প্রভাতে প্রথম নয়ন মেলিয়া তোমারে হেরিব আমি
ওগো অন্তরযামী ॥
জাগিয়া বসিয়া শুভ্র আলোকে তোমার চরণে নমিয়া পুলকে
মনে ভেবে রাখি দিনের কর্ম তোমারে সঁপিব স্বামী
ওগো অন্তরযামী ॥
দিনের কর্ম সাধিতে সাধিতে ভেবে রাখি মনে মনে
কর্ম-অন্তে সন্ধ্যাবেলায় বসিব তোমারি সনে।
দিন-অবসানে ভাবি ব’সে ঘরে তোমার নিশীথবিরামসাগরে
শ্রান্ত প্রাণের ভাবনা বেদনা নীরবে যাইবে নামি
ওগো অন্তরযামী ॥
১৭৯
প্রতিদিন আমি, হে জীবনস্বামী, দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
করি জোড়কর, হে ভুবনেশ্বর, দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে ॥
তোমার অপার আকাশের তলে বিজনে বিরলে হে-
নম্র হৃদয়ে নয়নের জলে দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে ॥
তোমার বিচিত্র এ ভবসংসারে কর্মপারাবারপারে হে-
নিখিল ভুবনলোকের মাঝারে দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে ।
তোমার এ ভবে মম কর্ম যবে সমাপন হবে হে,
ওগো রাজরাজ, একাকী নীরবে দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে ॥
১৮০
জাগিতে হবে রে-
মোহনিদ্রা কভু রবে চিরদিন,
ত্যজিতে হইবে সুখশয়ন অশনিঘোষণে ॥
জাগে তাঁর ন্যায়দণ্ড সর্বভুবনে,
ফিরে তাঁর কালচক্র অসীম গগনে,
জ্বলে তাঁর রুদ্রনেত্র পাপতিমিরে ॥
১৮১
আমার যা আছে আমি সকলই দিতে পারি নি তোমারে নাথ—
আমার লাজ ভয়, আমার মান অপমান, সুখ দুখ ভাবনা ॥
মাঝে রয়েছে আবরণ কত শত, কতোমতো—
তাই কেঁদে ফিরি, তাই তোমারে না পাই,
মনে থেকে যায় তাই হে মনের বেদনা ॥
যাহা রেখেছি তাহে কী সুখ—
তাহে কেঁদে মরি, তাহে ভেবে মরি।
তাই দিয়ে যদি তোমারে পাই কেন তা দিতে পারি না?
আমার জগতের সব তোমারে দেব, দিয়ে তোমায় নেব— বাসনা ॥
১৮২
জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই-
ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে।
মুক্তি চাহিবারে তোমার কাছে যাই,
চাহিতে গেলে মরি লাজে ॥
জানি হে তুমি মম জীবনে শ্রেয়তম,
এমন ধন আর নাহি যে তোমা-সম,
তবু যা ভাঙাচোরা ঘরেতে আছে পোরা
ফেলিয়া দিতে পারি না যে ॥
তোমারে আবরিয়া ধুলাতে ঢাকে হিয়া,
মরণ আনে রাশি রাশি-
আমি যে প্রাণ ভরি তাদের ঘৃণা করি
তবুও তাই ভালোবাসি।
এতই আছে বাকি, জমেছে এত ফাঁকি,
কত যে বিফলতা, কত যে ঢাকাঢাকি,
আমার ভালো তাই চাহিতে যবে যাই
ভয় যে আসে মনোমাঝে ॥
১৮৩
উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে
ওই-যে তিনি, ওই-যে বাহির পথে ॥
আয় রে ছুটে, টানতে হবে রশি-
ঘরের কোণে রইলি কোথায় বসি !
ভিড়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে গিয়ে
ঠাঁই ক'রে তুই নে রে কোনোমতে ॥
কোথায় কী তোর আছে ঘরের কাজ
সে-সব কথা ভুলতে হবে আজ।
টান্ রে দিয়ে সকল চিত্তকায়া,
টান্ রে ছেড়ে তুচ্ছ প্রাণের মায়া,
চল্ রে টেনে আলোয় অন্ধকারে
নগর-গ্রামে অরণ্যে পর্বতে ॥
ওই-যে চাকা ঘুরছে রে ঝন্ঝনি,
বুকের মাঝে শুনছ কি সেই ধ্বনি ?
রক্তে তোমার দুলছে না কি প্রাণ ?
গাইছে না মন মরণজয়ী গান ?
আকাঙ্ক্ষা তোর বন্যাবেগের মতো
ছুটছে না কি বিপুল ভবিষ্যতে ?।
১৮৪
আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনারই আবরণ !
খুলে দেখ্ দ্বার, অন্তরে তার আনন্দনিকেতন ॥
মুক্তি আজিকে নাই কোনো ধারে, আকাশ সেও যে বাঁধে কারাগার,
বিষনিশ্বাসে তাই ভরে আসে নিরুদ্ধ সমীরণ ॥
ঠেলে দে আড়াল ; ঘুচিবে আঁধার— আপনারে ফেল্ দূরে—
সহজে তখনি জীবন তোমার অমৃতে উঠিবে পূরে।
শূন্য করিয়া রাখ্ তোর বাঁশি বাজাবার যিনি বাজাবেন আসি—
ভিক্ষা না নিবি, তখনি জানিবি ভরা আছে তোর ধন্ ॥
১৮৫
বাঁধন ছেঁড়ার সাধন হবে,
ছেড়ে যাব তীর মাভৈ-রবে ॥
যাঁহার হাতের বিজয়মালা
রুদ্রদাহের বহ্নিজ্বালা
নমি নমি নমি সে ভৈরব ॥
কালসমুদ্রে আলোর যাত্রী
শূন্যে যে ধায় দিবস-রাত্রি।
ডাক এল তার তরঙ্গরেই,
বাজুক বক্ষে বজ্রভেরী
অকূল প্রাণের সে উত্সবে ॥
১৮৬
আমায় মুক্তি যদি দাও, বাঁধন খুলে
আমি তোমার বাঁধন নেব তুলে ॥
যে পথে ধাই নিরবধি সে পথ আমার ঘোচে যদি
যাব তোমার মাঝে পথের ভুলে ॥
যদি নেবাও ঘরের আলো
তোমার কালো আঁধার বাসব ভালো।
তীর যদি আর না যায় দেখা তোমার আমি হব একা
দিশাহারা সেই অকূলে ॥
১৮৭
বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছে, কেমনে দিই ফাঁকি !
আধেক ধরা পড়েছি গো, আধেক আছে বাকি ॥
কেন জানি আপনা ভুলে বারেক হৃদয় যায় যে খুলে,
বারেক তারে ঢাকি ॥
বাহির আমার শুক্তি যেন কঠিন আবরণ-
অন্তরে মোর তোমার লাগি একটি কান্না-ধন।
হৃদয় বলে তোমার দিকে রইবে চেয়ে অনিমিখে,
চায় না কেন আঁখি ?।
পূজা-১৮৮
এ আবরণ ক্ষয় হবে গো ক্ষয় হবে,
এ দেহমন ভুমানন্দময় হবে ॥
চোখে আমার মায়ার ছায়া টুটবে গো,
বিশ্বকমল প্রাণে আমার ফুটবে গো,
এ জীবন তোমারি, নাথ, জয় হবে ॥
রক্ত আমার বিশ্বতালে নাচবে যে,
হৃদয় আমার বিপুল প্রাণে বাঁচবে যে।
কাঁপবে তোমার আলো-বীণার তারে সে,
দুলবে তোমার তারামণির হারে সে,
বাসনা তার ছড়িয়ে গিয়ে লয় হবে ॥
১৮৯
সহজ হবি, সহজ হবি,
ওরে মন সহজ হবি-
কাছের জিনিস দূরে রাখে তার থেকে তুই দূরে র’বি॥
কেন রে তোর দু হাত পাতা- দান তো না চাই, চাই যে দাতা-
সহজে তুই দিবি যখন সহজে তুই সকল লবি ॥
সহজ হবি, সহজ হবি, ওরে মন সহজ হবি-
আপন বচন-রচন হতে বাহির হয়ে আয় রে কবি।
সকল কথার বাহিরেতে ভুবন আছে হৃদয় পেতে,
নীরব ফুলের নয়ন-পানে চেয়ে আছে প্রভাত-রবি ॥
১৯০
এই কথাটা ধরে রাখিস- মুক্তি তোরে পেতেই হবে।
যে পথ গেছে পারের পানে সে পথে তোর যেতেই হবে ॥
অভয় মনে কণ্ঠ ছাড়ি গান গেয়ে তুই দিবি পাড়ি,
খুশি হয়ে ঝড়ের হাওয়ায় ঢেউ যে তোরে খেতেই হবে ॥
পাকের ঘোরে ঘোরায় যদি, ছুটি তোরে পেতেই হবে।
চলার পথে কাঁটা থাকে, দ'লে তোমায় যেতেই হবে।
সুখের আশা আঁকড়ে লয়ে মরিস নে তুই ভয়ে ভয়ে,
জীবনকে তোর ভ'রে নিতে মরণ-আঘাত খেতেই হবে ॥
১৯১
সেই তো আমি চাই-
সাধনা যে শেষ হবে মোর সে ভাবনা তো নাই ॥
ফলের তরে নয় তো খোঁজা, কে বইবে সে বিষম বোঝা-
যেই ফলে ফল ধুলায় ফেলে আবার ফুল ফোটাই ॥
এমনি ক’রে মোর জীবনে অসীম ব্যাকুলতা,
নিত্য নূতন সাধনাতে নিত্যনূতন ব্যথা।
পেলেই সে তো ফুরিয়ে ফেলি, আবার আমি দু হাত মেলি-
নিত্য দেওয়া ফুরায় না যে, নিত্য নেওয়া তাই ॥
১৯২
আর রেখো না আঁধারে, আমায় দেখতে দাও।
তোমার মাঝে আমার আপনারে দেখতে চাও ॥
কাঁদাও যদি কাঁদাও এবার, সুখের গ্লানি সয় না যে আর,
নয়ন আমার যাক-না ধুয়ে অশ্রুধারে-
আমায় দেখতে দাও ॥
জানি না তো কোন্ কালো এই ছায়া,
আপন ব’লে ভুলায় যখন ঘনায় বিষম মায়া।
স্বপ্নভারে জমল বোঝা, চিরজীবন শূন্য খোঁজা-
যে মোর আলো লুকিয়ে আছে রাতের পারে
আমায় দেখতে দাও ॥
১৯৩
দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক
তবে তাই হোক।
মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক
তবে তাই হোক ॥
পূজার প্রদীপে তব জ্বলে যদি মম দীপ্ত শোক
তবে তাই হোক।
অশ্রু-আঁখি- ’পরে যদি ফুটে ওঠে তব স্নেহচোখ
তবে তাই হোক ॥
১৯৪
আমার আঁধার ভালো, আলোর কাছে বিকিয়ে দেবে আপনাকে সে ॥
আলোরে যে লোপ ক’রে খায় সেই কুয়াশা সর্বনেশে ॥
অবুঝ শিশু মায়ের ঘরে সহজ মনে বিহার করে,
অভিমানের জ্ঞানী তোমার দ্বারে ঠেকে এসে ॥
তোমার পথ আপনায় আপনি দেখায়, তাই বেয়ে, মা, চলব সোজা।
যারা পথ দেখাবার ভিড় করে গো তারা কেবল বাড়ায় খোঁজা—
ওরা ডাকে আমায় পূজার ছলে, এসে দেখি দেউল-তলে—
আপন মনের বিকারটারে সাজিয়ে রাখে ছদ্মবেশে ॥
১৯৫
এবার দুঃখ আমার অসীম পাথার পার হল যে, পার হল।
তোমার পায়ে এসে ঠেকল শেষে, সকল সুখের সার হল ॥
এত দিন নয়নধারা রয়েছে বাঁধনহারা,
কেন বয় পাই নি যে তার কূলকিনারা—
আজ গাঁথল কে সেই অশ্রুমালা, তোমার গলার হার হল ॥
তোমার সাঁঝের তারা ডাকল আমায় যখন অন্ধকার হল।
বিরহের ব্যথাখানি খুঁজে তো পায় নি বাণী,
এত দিন নীরব ছিল শরম মানি—
আজ পরশ পেয়ে উঠল গেয়ে, তোমার বীণার তার হল ॥
১৯৬
যারে নিজে তুমি ভাসিয়েছিলে দুঃখধারার ভরা স্রোতে
তারে ডাক দিলে আজ কোন্ খেয়ালে
আবার তোমার ও পার হতে ॥
শ্রাবণ-রাতে বাদল-ধারে উদাস ক’রে কাঁদাও যারে
আবার তারে ফিরিয়ে আনো ফুল-ফোটানো ফাগুন-রাতে ॥
এ পার হতে ও পার ক’রে বাটে বাটে ঘোরাও মোরে।
কুড়িয়ে আনা, ছড়িয়ে ফেলা, এই কি তোমার একই খেলা—
লাগাও ধাঁধা বারে বারে এই আঁধারের এই আলোতে ॥
১৯৭
আমায় দাও গো ব’লে
সে কি তুমি আমায় দাও দোলা অশান্তিদোলে।
দেখতে না পাই পিছে থেকে আঘাত দিয়ে হৃদয়ে কে
ঢেউ যে তোলে ॥
মুখ দেখি নে তাই লাগে ভয়— জানি না যে, এ কিছু নয়।
মুছব আঁখি, উঠব হেসে— দোলা যে দেয় যখন এসে
ধরবে কোলে ॥
১৯৮
তোর শিকল আমায় বিকল করবে না।
তোর মারে মরম মরবে না ॥
তাঁর আপন হাতের ছাড়চিঠি সেই যে
আমার মনের ভিতর রয়েছে এই যে,
তোদের ধরা আমায় ধরবে না ॥
যে পথ দিয়ে আমার চলাচল
তোর প্রহরী তার খোঁজ পাবে কি বল্।
আমি তাঁর দুয়ারে পৌঁছে গেছি রে,
মোরে তোর দুয়ারে ঠেকাবে কি রে ?
তোর ডরে পরান ডরবে না ॥
১৯৯
আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে
আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে ॥
মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে
তোমার ওই পারেতেই যাবে তরী ছায়াবটের ছায়ে ॥
পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়-
আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী, এই শুধু মোর দায়।
দিন ফুরালে, জানি জানি, পৌছে ঘাটে দেব আনি
আমার দুঃখদিনের রক্তকমল তোমার করুণ পায়ে ॥
২০০
বাহিরে ভুল হানবে যখন অন্তরে ভুল হানবে কি ?
বিষাদবিষে জ্বলে শেষে তোমার প্রসাদ মাঙবে কি ?।
রৌদ্রদাহ হলে সারা নামবে কি ওর বর্ষাধারা ?
লাজের রাঙা মিটলে হৃদয় প্রেমের রঙ রাঙবে কি ?।
যতই যাবে দূরের পানে
বাঁধন ততই কঠিন হয়ে টানবে না কি ব্যথার টানে !
অভিমানের কালো মেঘে বাদল-হাওয়া লাগবে বেগে,
নয়নজলের আবেগ তখন কোনোই বাধা মানবে কি ?।