গীতবিতান
পূজা (২০১-৩০০
সংখ্যক গান)
২০১
আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন-
আমার ব্যথার পূজা হয় নি সমাপন ॥
যখন বেলা-শেষের ছায়ায় পাখিরা যায় আপন কুলায়-মাঝে,
সন্ধ্যাপূজার ঘণ্টা যখন বাজে,
তখন আপন শেষ শিখাটি জ্বালবে জীবন-
আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন ॥
অনেক দিনের অনেক কথা, ব্যাকুলতা, বাঁধা বেদন-ডোরে,
মনের মাঝে উঠেছে আজ ভ'রে।
যখন পূজার হোমানলে উঠবে জ্বলে একে একে তারা,
আকাশ-পানে ছুটবে বাঁধন-হারা,
অস্তরবির ছবির সাথে মিলবে আয়োজন-
আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন ॥
২০২
আজি বিজন ঘরে নিশীথরাতে আসবে যদি শূন্য হাতে—
আমি তাইতে কি ভয় মানি!
জানি জানি, বন্ধু, জানি—
তোমার আছে তো হাতখানি ॥
চাওয়া-পাওয়ার পথে পথে দিন কেটেছে কোনোমতে,
এখন সময় হল তোমার কাছে আপনাকে দিই আনি ॥
আঁধার থাকুক দিকে দিকে আকাশ-অন্ধ-করা,
তোমার পরশ থাকুক আমার-হৃদয়-ভরা।
জীবনদোলায় দুলে দুলে আপনারে ছিলেম ভুলে,
এখন জীবন মরণ দু দিক দিয়ে নেবে আমায় টানি ॥
২০৩
যখন তোমায় আঘাত করি তখন চিনি।
শত্রু হয়ে দাঁড়াই যখন, লও যে জিনি ॥
এ প্রাণ যত নিজের তরে তোমারি ধন হরণ করে
ততই শুধু তোমার কাছে হয় সে ঋণী॥
উজিয়ে যেতে চাই যতবার গর্বসুখে
তোমার স্রোতের প্রবল পরশ পাই যে বুকে।
আলো যখন আলস-ভরে নিবিয়ে ফেলি আপন ঘরে
লক্ষ তারা জ্বালায় তোমার নিশীথিনী ॥
২০৪
দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে ?
বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে ॥
জ্বলতে দে তোর আগুনটারে, ভয় কিছু না করিস তারে,
ছাই হয়ে সে নিভবে যখন জ্বলবে না আর কভু তবে ॥
এড়িয়ে তাঁরে পালাস না রে, ধরা দিতে হোস না কাতর।
দীর্ঘ পথে ছুটে ছুটে দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর।
মরতে মরতে মরণটারে শেষ ক'রে দে একেবারে,
তার পরে সেই জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে ॥
২০৫
যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি।
ঝড় এসেছে, ওরে, এবার ঝড়কে পেলেম সাথি॥
আকাশকোণে সর্বনেশে ক্ষণে ক্ষণে উঠছে হেসে,
প্রলয় আমার কেশে বেশে করছে মাতামাতি॥
যে পথ দিয়ে যেতেছিলেম ভুলিয়ে দিল তারে,
আবার কোথা চলতে হবে গভীর অন্ধকারে।
বুঝি বা এই বজ্ররবে নূতন পথের বার্তা কবে—
কোন্ পুরীতে গিয়ে তবে প্রভাত হবে রাতি॥
২০৬
না বাঁচাবে আমায় যদি মারবে কেন তবে ?
কিসের তরে এই আয়োজন এমন কলরবে ?।
অগ্নিবাণে তূণ যে ভরা, চরণভরে কাঁপে ধরা,
জীবনদাতা মেতেছে যে মরণ-মহোত্সবে ॥
বক্ষ আমার এমন ক’রে বিদীর্ণ যে করো
উত্স যদি না বাহিরায় হবে কেমনতরো ?
এই-যে আমার ব্যথার খনি জোগাবে ওই মুকুট-মণি-
মরণদুখে জাগাবে মোর জীবনবল্লভে ॥
২০৭
মোর মরণে তোমার হবে জয়।
মোর জীবনে তোমার পরিচয় ॥
মোর দুঃখ যে রাঙা শতদল
আজি ঘিরিল তোমার পদতল,
মোর আনন্দ সে যে মণিহার মুকুটে তোমার বাঁধা রয় ॥
মোর ত্যাগে যে তোমার হবে জয়।
মোর প্রেমে যে তোমার পরিচয়।
মোর ধৈর্য তোমার রাজপথ
সে যে লঙ্ঘিবে বনপর্বত,
মোর বীর্য তোমার জয়রথ তোমারি পতাকা শিরে বয় ॥
২০৮
হৃদয় আমার প্রকাশ হল অনন্ত আকাশে।
বেদন-বাঁশি উঠল বেজে বাতাসে বাতাসে॥
এই-যে আলোর আকুলতা এ তো জানি আমার কথা-
ফিরে এসে আমার প্রাণে আমারে উদাসে॥
বাইরে তুমি নানা বেশে ফের নানা ছলে;
জানি নে তো আমার মালা দিয়েছি কার গলে।
আজকে দেখি পরান-মাঝে, তোমার গলায় সব মালা যে-
সব নিয়ে শেষ ধরা দিলে গভীর সর্বনাশে ॥
২০৯
যখন তুমি বাঁধছিলে তার সে যে বিষম ব্যথা—
বাজাও বীণা, ভুলাও ভুলাও সকল দুখের কথা ॥
এতদিন যা সঙ্গোপনে ছিল তোমার মনে মনে
আজকে আমার তারে তারে শুনাও সে বারতা ॥
আর বিলক্ব কোরো না গো, ওই-যে নেবে বাতি।
দুয়ারে মোর নিশীথিনী রয়েছে কান পাতি।
বাঁধলে যে সুর তারায় তারায় অন্তবিহীন অগ্নিধারায়,
সেই সুরে মোর বাজাও প্রাণে তোমার ব্যাকুলতা ॥
২১০
এই-যে কালো মাটির বাসা শ্যামল সুখের ধরা-
এইখানেতেই আঁধার-আলোয় স্বপন-মাঝে চরা ॥
এরই গোপন হৃদয়-'পরে ব্যথার স্বর্গ বিরাজ করে
দুঃখে-আলো-করা ॥
বিরহী তোর সেইখানে যে একলা বসে থাকে-
হৃদয় তাহার ক্ষণে ক্ষণে নামটি তোমার ডাকে।
দুঃখে যখন মিলন হবে আনন্দলোক মিলাবে তবে
সুধায়-সুধায়-ভরা
॥
২১১
এক হাতে ওর কৃপাণ আছে, আর-এক হাতে হার।
ও যে ভেঙেছে তোর দ্বার ॥
আসে নি ও ভিক্ষা নিতে, না না না- লড়াই করে নিতে জিতে
পরানটি তোমার ॥
মরণেরই পথ দিয়ে ওই আসছে জীবন-মাঝে,
ও যে আসছে বীরের সাজে।
আধেক নিয়ে ফিরবে না রে, না না না- যা আছে সব একেবারে
করবে অধিকার ।
২১২
আগুনের
পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।
এ জীবন
পুণ্য কর দহন-দানে॥
আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো—
নিশিদিন
আলোক-শিখা জ্বলুক গানে॥
আঁধারের
গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত
ফোটাক তারা নব নব।
নয়নের
দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো,
যেখানে
পড়বে সেথায় দেখবে আলো—
ব্যথা মোর
উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব-পানে॥
২১৩
ওরে, কে রে এমন জাগায় তোকে ?
ঘুম কেন নেই তোরই চোখে ?
চেয়ে আছিস আপন-মনে- ওই-যে দূরে গগন-কোণে
রাত্রি মেলে রাঙা নয়ন রুদ্রদেবের দীপ্তলোকে ॥
রক্তশতদলের সাজি
সাজিয়ে কেন রাখিস আজি ?
কোন্ সাহসে একেবারে শিকল খুলে দিলি দ্বারে-
জোড়হাতে তুই ডাকিস কারে, প্রলয় যে তোর ঘরে ঢোকে ॥
২১৪
আঘাত করে নিলে জিনে,
কাড়িলে মন দিনে দিনে ॥
সুখের বাধা ভেঙে ফেলে তবে আমার প্রাণে এলে—
বারে বারে মরার মুখে অনেক দুখে নিলেম চিনে ॥
তুফান দেখে ঝড়ের রাতে
ছেড়েছি হাল তোমার হাতে।
বাটের মাঝে, হাটের মাঝে, কোথাও আমার ছাড়লে না-যে—
যখন আমার সব বিকালো তখন আমায় নিলে কিনে ॥
২১৫
ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর,
তোমার প্রেম তোমারে এমন ক’রে করেছে নিষ্ঠুর ॥
তুমি বসে থাকতে দেবে না যে, দিবানিশি তাই তো বাজে
পরান-মাঝে এমন কঠিন সুর ॥
ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর,
তোমার লাগি দুঃখ আমার হয় যেন মধুর।
তোমার খোঁজা খোঁজায় মোরে, তোমার বেদন কাঁদায় ওরে,
আরাম যত করে কোথায় দূর ॥
২১৬
সুখে আমায় রাখবে কেন, রাখো তোমার কোলে।
যাক-না গো সুখ জ্বলে॥
যাক-না পায়ের তলার মাটি, তুমি তখন ধরবে আঁটি—
তুলে নিয়ে দুলাবে ওই বাহুদোলার দোলে॥
যেখানে ঘর বাঁধব আমি আসে আসুক বান॥
তুমি যদি ভাসাও মোরে চাই নে পরিত্রাণ।
হার মেনেছি, মিটেছে ভয়— তোমার জয় তো আমারি জয়;
ধরা দেব, তোমায় আমি ধরব যে তাই হলে॥
২১৭
ও নিঠুর, আরো কি বাণ তোমার তূণে আছে ?
তুমি মর্মে আমায় মারবে হিয়ার কাছে ॥
আমি পালিয়ে থাকি, মুদি আঁখি, আঁচল দিয়ে মুখ যে ঢাকি গো-
কোথাও কিছু আঘাত লাগে পাছে ॥
আমি মারকে তোমার ভয় করেছি ব'লে
তাই তো এমন হৃদয় ওঠে জ্বলে।
যে দিন সে ভয় খুচে যাবে সে দিন তোমার বাণ ফুরাবে গো-
মরণকে প্রাণ বরণ করে বাঁচে ॥
২১৮
আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি, সেথায় চরণ পড়ে,
তোমার সেথায় চরণ পড়ে।
তাই তো আমার সকল পরান কাঁপছে ব্যথার ভরে গো,
কাঁপছে থরোথরে ॥
ব্যথাপথের পথিক তুমি, চরণ চলে ব্যথা চুমি-
কাঁদন দিয়ে সাধন আমার চিরদিনের তরে গো,
চিরজীবন ধ’রে ॥
নয়নজলের বন্যা দেখে ভয় করি নে আর,
আমি ভয় করি নে আর।
মরণ-টানে টেনে আমায় করিয়ে দেবে পার,
আমি তরব পারাবার।
ঝড়ের হাওয়া আকুল গানে বইছে আজি তোমার পানে-
ডুবিয়ে তরী ঝাঁপিয়ে পড়ি ঠেকব চরণ-‘পরে,
আমি বাঁচব চরণ ধরে ॥
২১৯
তোমার কাছে শান্তি
চাব না,
থাক্-না আমার দুঃখ ভাবনা॥
অশান্তির এই দোলার ’পরে বোসো বোসো লীলার ভরে,
দোলা দিব এ মোর কামনা॥
নেবে নিবুক প্রদীপ বাতাসে,
ঝড়ের কেতন উড়ুক আকাশে-
বুকের কাছে ক্ষণে ক্ষণে তোমার চরণ-পরশনে
অন্ধকারে আমার সাধনা॥
২২০
যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে
জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে॥
সব যে হয়ে গেল কালো, নিবে গেল দীপের আলো,
আকাশ-পানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে?।
অন্ধকারে রইনু পড়ে স্বপন মানি।
ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা তাই কি জানি!
সকালবেলায় চেয়ে দেখি, দাঁড়িয়ে আছ তুমি এ কি
ঘর-ভরা মোর শূন্যতারই বুকের
’পরে॥
২২১
ভয়েরে মোর আঘাত করো ভীষণ, হে ভীষণ !
কঠিন করে চরণ-'পরে প্রণত করো মন ॥
বেঁধেছে মোরে নিত্য কাজে প্রাচীরে-ঘেরা ঘরের মাঝে,
নিত্য মোরে বেঁধেছে সাজে সাজের আভরণ ॥
এসো হে, ওহে আকস্মিক, ঘিরিয়া ফেলো সকল দিক,
মুক্ত পথে উড়ায়ে নিক নিমেষে এ জীবন।
তাহার 'পরে প্রকাশ হোক উদার তব সহাস চোখ-
তব অভয় শান্তিময় স্বরূপ পুরাতন ॥
২২২
বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি, সেকি সহজ গান !
সেই সুরেতে জাগব আমি, দাও মোরে সেই কান ॥
আমি ভুলব না আর সহজেতে, সেই প্রাণে মন উঠবে মেতে
মৃত্যু-মাঝে ঢাকা আছে যে অন্তহীন-প্রাণ ॥
সে ঝড় যেন সই আনন্দে চিত্তবীণার তারে
সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত নাচাও যে ঝঙ্কারে।
আরাম হতে ছিন্ন ক’রে সেই গভীরে লও গো মোরে
অশান্তির অন্তরে যেথায় শান্তি সুমহান ॥
২২৩
এই করেছ ভালো, নিঠুর হে, নিঠুর হে, এই করেছ ভালো।
এমনি ক'রে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো ॥
আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে,
আমার এ দীপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো ॥
যখন থাকি অচেতনে এ চিত্ত আমার
আঘাত সে যে পরশ তব, সেই তো পুরস্কার।
অন্ধকারে মোহ লাজে চোখে তোমায় দেখি না যে,
বজ্রে তোলো আগুন ক'রে আমার যত কালো ॥
২২৪
আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারো।
আরো কঠিন সুরে জীবন-তারে ঝঙ্কারো॥
যে রাগ জাগাও আমার প্রাণে বাজে নি তা চরম তানে,
নিঠুর মূর্ছনায় সে গানে মূর্তি সঞ্চারো ॥
লাগে না গো কেবল যেন কোমল করুণা,
মৃদু সুরের খেলায় এ প্রাণ ব্যর্থ কোরো না।
জ্ব’লে উঠুক সকল হুতাশ, গর্জি উঠুক সকল বাতাস,
জাগিয়ে দিয়ে সকল আকাশ পূর্ণতা বিস্তারো ॥
২২৫
আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।
এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর জীবন ভ’রে ॥
না চাহিতে মোরে যা করেছ দান - আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ,
দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায় সে মহা দানেরই যোগ্য ক’রে
অতি-ইচ্ছার সঙ্কট হতে বাঁচায়ে মোরে ॥
আমি কখনো বা ভুলি কখনো বা চলি তোমার পথের লক্ষ্য ধ’রে ;
তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে যাও যে সরে।
এ যে তব দয়া, জানি জানি হায়, নিতে চাও ব’লে ফিরাও আমায়-
পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন তব মিলনেরই যোগ্য ক’রে
আধা-ইচ্ছার সঙ্কট হতে বাঁচায়ে মোরে ॥
২২৬
প্রচণ্ড গর্জনে আসিল একি দুর্দিন-
দারুণ ঘনঘটা, অবিরল অশনিতর্জন ॥
ঘন ঘন দামিনী-ভুজঙ্গ-ক্ষত যামিনী,
অম্বর করিছে অন্ধনয়নে অশ্রু-বরিষন ॥
ছাড়ো রে শঙ্কা, জাগো ভীরু অলস,
আনন্দে জাগাও অন্তরে শকতি।
অকুণ্ঠ আঁখি মেলি হেরো প্রশান্ত বিরাজিত
মহাভয়-মহাসনে অপরূপ মৃত্যুঞ্জয়রূপে ভয়হরণ ॥
২২৭
বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা—
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়॥
সহায় মোর না যদি জুটে নিজের বল না যেন টুটে—
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্চনা,
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়॥
আমারে তুমি করিবে ত্রাণ এ নহে মোর প্রার্থনা—
তরিতে পারি শকতি যেন রয়।
আমার ভার লাঘব করি নাই বা দিলে সান্ত্বনা,
বহিতে পারি এমনি যেন হয়॥
নম্রশিরে সুখের দিনে তোমারি মুখ লইব চিনে—
দুখের রাতে নিখিল ধরা যে দিন করে বঞ্চনা
তোমারে যেন না করি সংশয়॥
২২৮
আরো আরো, প্রভু, আরো আরো
এমনি ক’রে আমায় মারো ॥
লুকিয়ে থাকি, আমি পালিয়ে বেড়াই-
ধরা পড়ে গেছি, আর কি এড়াই!
যা-কিছু আছে সব কাড়ো কাড়ো ॥
এবার যা করবার তা সারো সারো,
আমি হারি কিম্বা তুমিই হারো।
হাটে ঘাঠে বাটে করি মেলা।
কেবল হেসে খেলে গেছে বেলা-
দেখি কেমনে কাঁদাতে পারো ॥
২২৯
তোমার সোনার থালায় সাজাব আজ দুখের অশ্রুধার।
জননী গো, গাঁথব তোমার গলার মুক্তাহার॥
চন্দ্র সূর্য পায়ের কাছে মালা হয়ে জড়িয়ে আছে,
তোমার বুকে শোভা পাবে আমার দুখের অলঙ্কার॥
ধন ধান্য তোমারি ধন কী করবে তা কও।
দিতে চাও তো দিয়ো আমায়, নিতে চাও তো লও।
দুঃখ আমার ঘরের জিনিস, খাঁটি রতন তুই তো চিনিস—
তোর প্রসাদ দিয়ে তারে কিনিস এ মোর অহঙ্কার॥
২৩০
দুখের বেশে এসেছ ব'লে তোমারে নাহি ডরিব হে।
যেখানে ব্যথা তোমারে সেথা নিবিড় ক'রে ধরিব হে ॥
আঁধারে ঢাকিলে, স্বামী, তোমারে তবু চিনিব আমি-
মরণরূপে আসিলে, প্রভু, চরণ ধরি মরিব হে।
যেমন করে দাও-না দেখা তোমারে নাহি ডরিব হে ॥
নয়নে আজি ঝরিছে জল, ঝরুক জল নয়নে হে।
বাজিছে বুকে বাজুক তব কঠিন বাহু-বাঁধনে হে।
তুমি যে আছ বক্ষে ধরে, বেদনা তাহা জানাক মোরে-
চাব না কিছু, কব না কথা, চাহিয়া রব বদনে হে ॥
২৩১
তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি।
তোমার সেবার মহান দুঃখ সহিবারে দাও ভকতি ॥
আমি তাই চাই ভরিয়া পরান দুঃখের সাথে দুঃখের ত্রাণ,
তোমার হাতের বেদনার দান এড়ায়ে চাহি না মুকতি।
দুখ হবে মম মাথার ভূষণ সাথে যদি দাও ভকতি ॥
যত দিতে চাও কাজ দিয়ো যদি তোমারে না দাও ভুলিতে,
অন্তর যদি জড়াতে না দাও জালজঞ্জালগুলিতে।
বাঁধিয়া আমায় যত খুশি ডোরে মুক্ত রাখিয়ো তোমা-পানে মোরে,
ধুলায় রাখিয়ো পবিত্র ক'রে তোমার চরণধূলিতে-
ভুলায়ে রাখিয়ো সংসারতলে, তোমারে দিয়ো না ভুলিতে ॥
যে পথে ঘুরিতে দিয়েছ ঘুরিব- যাই যেন তব চরণে,
সব শ্রম যেন বহি লয় মোরে সকলশ্রান্তিহরণে।
দুর্গম পথ এ ভবগহন, কত ত্যাগ শোক বিরহদহন-
জীবনে মৃতু্য করিয়া বহন প্রাণ পাই যেন মরণে-
সন্ধ্যাবেলায় লভি গো কুলায় নিখিলশরণ চরণে ॥
২৩২
দুখ দিয়েছ, দিয়েছ ক্ষতি নাই, কেন গো একেলা ফেলে রাখ ?
ডেকে নিলে ছিল যারা কাছে, তুমি তবে কাছে কাছে থাকো ॥
প্রাণ কারো সাড়া নাহি পায়, রবি শশী দেখা নাহি যায়,
এ পথে চলে যে অসহায়- তারে তুমি ডাকো, প্রভু, ডাকো ॥
সংসারের আলো নিভাইলে, বিষাদের আঁধার ঘনায়-
দেখাও তোমার বাতায়নে চির-আলো জ্বলিছে কোথায়।
শুষ্ক নির্ঝরের ধারে রই, পিপাসিত প্রাণ কাঁদে ওই-
অসীম প্রেমের উত্স কই, আমারে তৃষিত রেখো নাকো ॥
কে আমার আত্মীয় স্বজন- আজ আসে, কাল চলে যায়।
চরাচর ঘুরিছে কেবল- জগতের বিশ্রাম কোথায়।
সবাই আপনা নিয়ে রয় কে কাহারে দিবে গো আশ্রয়-
সংসারের নিরাশ্রয় জনে তোমার স্নেহেতে, নাথ, ঢাকো ॥
২৩৩
হে মহাদুঃখ, হে রুদ্র, হে ভয়ঙ্কর, ওহে শঙ্কর, হে প্রলয়ঙ্কর।
হোক জটানিঃসৃত অগ্নিভুজঙ্গম -দংশনে জর্জর স্থাবর জঙ্গম,
ঘন ঘন ঝন ঝন ঝননন ঝননন পিনাক টঙ্করো ॥
২৩৪
সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ-
হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্ত-পানে চাহ ॥
দূর করো মহারুদ্র যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র-
মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উত্সাহ॥
দুঃখের মন্থনবেগে উঠিবে অমৃত,
শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত।
তব দীপ্ত রৌদ্র তেজে নির্ঝরিয়া গলিবে যে
প্রস্তরশৃঙ্খলোন্মুক্ত ত্যাগের প্রবাহ ॥
২৩৫
নয় এ মধুর খেলা-
তোমায় আমায় সারাজীবন সকাল-সন্ধ্যাবেলা নয় এ মধুর খেলা ॥
কতবার যে নিবল বাতি, গর্জে এল ঝড়ের রাতি-
সংসারের এই দোলায় দিলে সংশয়েরই ঠেলা ॥
বারে বারে বাঁধ ভাঙিয়া বন্যা ছুটেছে।
দারুণ দিনে দিকে দিকে কান্না উঠেছে।
ওগো রুদ্র, দুঃখে সুখে এই কথাটি বাজল বুকে-
তোমার প্রেমে আঘাত আছে, নাইকো অবহেলা ॥
২৩৬
জাগো হে রুদ্র, জাগো-
সুপ্তিজড়িত তিমিরজাল সহে না, সহে না গো ॥
এসো নিরুদ্ধ দ্বারে, বিমুক্ত করো তারে,
তনুমনপ্রাণ ধনজনমান, হে মহাভিক্ষু, মাগো ॥
২৩৭
পিণাকেতে লাগে টঙ্কার-
বসুন্ধরার পঞ্জরতলে কম্পন জাগে শঙ্কার ॥
আকাশেতে ঘোরে ঘূর্ণি সৃষ্টির বাঁধ চূর্ণি,
বজ্রভীষণ গর্জনরব প্রলয়ের জয়ডঙ্কার ॥
স্বর্গ উঠিছে ক্রন্দি, সুরপরিষদ বন্দী-
তিমিরগহন দুঃসহ রাতে উঠে শৃঙ্খলঝঙ্কার।
দানবদম্ভ তর্জি রুদ্র উঠিল গর্জি-
লণ্ডভণ্ড লুটিল ধুলায় অভ্রভেদী অহঙ্কার ॥
২৩৮
প্রাণে গান নাই, মিছে তাই ফিরিনু যে
বাঁশিতে সে গান খুঁজে।
প্রেমের বিদায় ক’রে দেশান্তরে
বেলা যায় কারে পূজে ॥
বনে তোর লাগাস আগুন, তবে ফাগুন কিসের তরে-
বৃথা তোর ভস্ম-’পরে মরিস যুঝে ॥
ওরে, তোর নিবিয়ে দিয়ে ঘরের বাতি
কী লাগি ফিরিস পথে দিবারাতি-
যে আলো শতধারায় আঁখিতারায় পড়ে ঝ’রে
তাহারে কে পায় ওরে নয়ন বুজে ?।
২৪০
আনন্দ তুমি স্বামি, মঙ্গল তুমি,
তুমি হে মহাসুন্দর, জীবননাথ ॥
শোকে দুখে তোমারি বাণী জাগরণ দিবে আনি,
নাশিবে দারুণ অবসাদ ॥
চিত মন অর্পিনু তব পদপ্রান্তে-
শুভ্র শান্তিশতদল-পুণ্যমধু-পানে
চাহি আছে সেবক, তব সুদৃষ্টিপাতে
কবে হবে এ দুখরাত প্রভাত ॥
২৪১
ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার।
হালের কাছে মাঝি আছে করবে তরী পার ॥
তুফান যদি এসে থাকে তোমার কিসের দায়-
চেয়ে দেখো ঢেউয়ের খেলা, কাজ কি ভাবনায় ?
আসুক-নাকো গহন রাতি, হোক-না অন্ধকার-
হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার ॥
পশ্চিমে তুই তাকিয়ে দেখিস মেঘে আকাশ ডোবা,
আনন্দে তুই পুবের দিকে দেখ্-না তারার শোভা।
সাথি যারা আছে তারা তোমার আপন ব'লে
ভাবো কি তাই রক্ষা পাবে তোমারি ওই কোলে ?
উঠবে রে ঝড়, দুলবে রে বুক, জাগবে হাহাকার-
হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার ॥
২৪২
ওই) আলো যে যায় রে দেখা-
হৃদয়ের পূব-গগনের সোনার রেখা ॥
এবারে ঘুচল কি ভয়, এবারে হবে কি জয় ?
আকাশে হল কি ক্ষয় কালীর লেখা ?।
কারে ওই যায় গো দেখা,
হৃদয়ের সাগরতীরে দাঁড়ায় একা।
ওরে তুই সকল ভুলে চেয়ে থাক্ নয়ন তুলে-
নীরবে চরণমূলে মাথা ঠেকা ॥
২৪৩
তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলেই যে যাই, কতই কী চাই-
দিনের শেষে ঘরে এসে লজ্জা যে পাই॥
সে-সব চাওয়া সুখে দুখে ভেসে বেড়ায় কেবল মুখে,
গভীর বুকে
যে চাওয়াটি গোপন তাহার কথা যে নাই॥
বাসনা সব বাঁধন যেন কুঁড়ির গায়ে-
ফেটে যাবে, ঝরে যাবে দখিন-বায়ে।
একটি চাওয়া ভিতর হতে ফুটবে তোমার ভোর-আলোতে
প্রাণের স্রোতে-
অন্তরে সেই গভীর আশা বয়ে বেড়াই॥
২৪৪
তুমি জানো, ওগো অন্তর্যামী,
পথে পথেই মন ফিরালেম আমি ॥
ভাবনা আমার বাঁধল নাকো বাসা,
কেবল তাদের স্রোতের ’পরেই ভাসা-
তবু আমার মনে আছে আশা,
তোমার পায়ে ঠেকবে তারা স্বামী ॥
টেনেছিল কতই কান্নাহাসি,
বারে বারেই ছিন্ন হল ফাঁসি।
শুধায় সবাই হতভাগ্য ব’লে,
’মাথা কোথায় রাখিবি সন্ধ্যা হলে।’
জানি জানি নামবে তোমার কোলে
আপনি যেথায় পড়বে মাথা নামি ॥
২৪৫
তোমার দুয়ার খোলার ধ্বনি ওই গো বাজে হৃদয়মাঝে॥
তোমার ঘরে নিশি-ভোরে আগল যদি গেল সরে
আমার ঘরে রইব তবে কিসের লাজে ?।
অনেক বলা বলেছি, সে মিথ্যা বলা।
অনেক চলা চলেছি, সে মিথ্যা চলা।
আজ যেন সব পথের শেষে তোমার দ্বারে দাঁড়াই এসে-
ভুলিয়ে যেন নেয় না মোরে আপন কাজে॥
২৪৬
আমার যে আসে কাছে, যে যায় চলে দূরে,
কভু পাই বা কভু না পাই যে বন্ধুরে,
যেন এই কথাটি বাজে মনের সুরে-
তুমি আমার কাছে এসেছ ॥
কভু মধুর রসে ভরে হৃদয়খানি,
কভু নিঠুর বাজে প্রিয়মুখের বাণী,
তবু নিত্য যেন এই কথাটি জানি-
তুমি স্নেহের হাসি হেসেছে ॥
ওগো, কভু সুখের কভু দুখের দোলে
মোর জীবন জুড়ে কত তুফান তোলে,
যেন চিত্ত আমার এই কথা না ভোলে-
তুমি আমায় ভালোবেসেছ।
যবে মরণ আসে নিশীথে গৃহদ্বারে
যবে পরিচিতের কোল হতে সে কাড়ে,
যেন জানি গো সেই অজানা পারাবারে
এক তরীতে তুমি ভেসেছ ॥
২৪৫
তোমার দুয়ার খোলার ধ্বনি ওই গো বাজে হৃদয়মাঝে॥
তোমার ঘরে নিশি-ভোরে আগল যদি গেল সরে
আমার ঘরে রইব তবে কিসের লাজে ?।
অনেক বলা বলেছি, সে মিথ্যা বলা।
অনেক চলা চলেছি, সে মিথ্যা চলা।
আজ যেন সব পথের শেষে তোমার দ্বারে দাঁড়াই এসে-
ভুলিয়ে যেন নেয় না মোরে আপন কাজে॥
২৪৬
আমার যে আসে কাছে, যে যায় চলে দূরে,
কভু পাই বা কভু না পাই যে বন্ধুরে,
যেন এই কথাটি বাজে মনের সুরে-
তুমি আমার কাছে এসেছ ॥
কভু মধুর রসে ভরে হৃদয়খানি,
কভু নিঠুর বাজে প্রিয়মুখের বাণী,
তবু নিত্য যেন এই কথাটি জানি-
তুমি স্নেহের হাসি হেসেছে ॥
ওগো, কভু সুখের কভু দুখের দোলে
মোর জীবন জুড়ে কত তুফান তোলে,
যেন চিত্ত আমার এই কথা না ভোলে-
তুমি আমায় ভালোবেসেছ।
যবে মরণ আসে নিশীথে গৃহদ্বারে
যবে পরিচিতের কোল হতে সে কাড়ে,
যেন জানি গো সেই অজানা পারাবারে
এক তরীতে তুমি ভেসেছ ॥
২৪৭
হার-মানা হার পরাব তোমার গলে-
দূরে রব কত আপন বলের ছলে॥
জানি আমি জানি ভেসে যাবে অভিমান-
নিবিড় ব্যথায় ফাটিয়া পড়িবে প্রাণ,
শূন্য হিয়ার বাঁশিতে বাজিবে গান,
পাষাণ তখন গলিবে নয়নজলে॥
শতদলদল খুলে যাবে থরে থরে,
লুকানো রবে না মধু চিরদিন-তরে।
আকাশ জুড়িয়া চাহিবে কাহার আঁখি,
ঘরের বাহিরে নীরবে লইবে ডাকি,
কিছুই সেদিন কিছুই রবে না বাকি-
পরম মরণ লভিব চরণতলে ॥
২৪৮
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ॥
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ—
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে ॥
২৪৯
অন্তরে জাগিছ অন্তরযামী।
তবু সদা দূরে ভ্রমিতেছি আমি ॥
সংসার সুখ করেছি বরণ,
তবু তুমি মম জীবনস্বামী ॥
না জানিয়া পথ ভ্রমিতেছি পথে
আপন গরবে অসীম জগতে।
তবু স্নেহনেত্র জাগে ধ্রুবতারা,
তব শুভ আশিস আসিছে নামি ॥
২৫০
দীর্ঘ জীবনপথ, কত দুঃখতাপ, কত শোকদহন-
গেয়ে চলি তবু তাঁর করুণার গান ॥
খুলে রেখেছেন তাঁর অমৃতভবনদ্বার-
শ্রান্তি ঘুচিবে, অশ্রু মুছিবে, এ পথের হবে অবসান ॥
অনন্তের পানে চাহি আনন্দের গান গাহি-
ক্ষুদ্র শোকতাপ নাহি নাহি রে।
অনন্ত আলয় যার কিসের ভাবনা তার-
নিমেষের তুচ্ছ ভারে হব না রে ম্রিয়মাণ ॥
২৫১
আজি কোন্ ধন হতে বিশ্বে আমারে
কোন জনে করে বঞ্চিত—
তব চরণ-কমল-রতন-রেণুকা
অন্তরে আছে সঞ্চিত ॥
কত নিঠুর কঠোর দরশে ঘরষে মর্মমাঝারে শল্য বরষে,
তবু প্রাণ মন পীযুষপরশে পলে পলে পুলকাঞ্চিত ॥
আজি কিসের পিপাসা মিটিল না ওগো
পরম পরানবল্লভ !
চিতে চিরসুধা করে সঞ্চার তব
সকরুণ করপল্লব।
নাথ, যার যাহা আছে তার তাই থাক্, আমি থাকি চিরলাঞ্ছিত—
শুধু তুমি এ জীবনে নয়নে নয়নে থাকো চিরবাঞ্ছিত ॥
২৫২
কে যায় অমৃতধামযাত্রী।
আজি এ গহন তিমিররাত্রি,
কাঁপে নভ জয়গানে ॥
আনন্দরব শ্রবণে লাগে, সুপ্ত হৃদয় চমকি জাগে,
চাহি দেখে পথপানে ॥
ওগো রহো রহো, মোরে ডাকি লহো, কহো আশ্বাসবাণী।
যাব অহরহ সাথে সাথে
সুখে দুখে শোকে দিবসে রাতে
অপরাজিত প্রাণে ॥
২৫৩
চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।
অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে ॥
ধরায় যখন দাও না ধরা হৃদয় তখন তোমায় ভরা,
এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহি রে ॥
তোমায় নিয়ে খেলেছিলেম খেলার ঘরেতে।
খেলার পুতুল ভেঙে গেছে প্রলয় ঝড়েতে।
থাক্ তবে সেই কেবল খেলা, হোক্-না এখন প্রাণের মেলা—
তারের বীণা ভাঙল, হৃদয়-বীণায় গাহি রে ॥
২৫৪
এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে।
তার হৃদয়বাঁশি আপনি কেড়ে বাজাও গভীরে ॥
নিশীথরাতের নিবিড় সুরে বাঁশিতে তান দাও হে পুরে,
যে তান দিয়ে অবাক্ কর গ্রহশশীরে॥
যা-কিছু মোর ছড়িয়ে আছে জীবন-মরণে
গানের টানে মিলুক এসে তোমার চরণে।
বহুদিনের বাক্যরাশি এক নিমেষে যাবে ভাসি—
একলা বসে শুনব অকূল তিমিরে ॥
২৫৫
একমনে তোর একতারাতে একটি যে তার সেইটি বাজা-
ফুলবনে তোর একটি কুসুম, তাই নিয়ে তোর ডালি সাজা ॥
যেখানে তোর সীমা সেথায় আনন্দে তুই থামিস এসে,
যে কড়ি তোর প্রভুর দেওয়া সেই কড়ি তুই নিস রে হেসে।
লোকের কথা নিস নে কানে, ফিরিস নে আর হাজার টানে,
যেন রে তোর হৃদয় জানে হৃদয়ে তোর আছেন রাজা-
একতারাতে একটি যে তার আপন মনে সেইটি বাজা ॥
২৫৬
গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে, আর কোলাহল নাই।
রহি রহি শুধু সুদূর সিন্ধুর ধ্বনি শুনিবারে পাই ॥
সকল বাসনা চিত্তে এল ফিরে, নিবিড় আঁধার ঘনালো বাহিরে-
প্রদীপ একটি নিভৃত অন্তরে জ্বলিতেছে এক ঠাঁই ॥
অসীম মঙ্গলে মিলিল মাধুরী, খেলা হল সমাধান।
চপল চঞ্চল লহরীলীলা পারাবারে অবসান।
নীরব মন্ত্রে হৃদয়মাঝে শান্তি শান্তি শান্তি বাজে,
অরূপকান্তি নিরিখ অন্তরে মুদিতলোচনে চাই ॥
২৫৭
ভুবন হইতে ভুবনবাসী এসো আপন হৃদয়ে।
হৃদয়মাঝে হৃদয়নাথ আছে নিত্য সাথ সাথ-
কোথা ফিরিছ দিবারাত, হেরো তাঁহারে অভয়ে ॥
হেথা চির-আনন্দধাম, হেথা বাজিছে অভয় নাম,
হেথা পূরিবে সকল কাম নিভৃত অমৃত-আলয়ে ॥
২৫৮
জীবন যখন ছিল ফুলের মতো
পাপড়ি তাহার ছিল শত শত ॥
বসন্তে সে হ’ত যখন দাতা
ঝরিয়ে দিত দু-চারটি তার পাতা,
তবুও যে তার বাকি রইত কত ॥
আজ বুঝি তার ফল ধরেছে, তাই
হাতে তাহার অধিক কিছু নাই।
হেমন্তে তার সময় হল এবে
পূর্ণ করে আপনাকে সে দেবে,
রসের ভারে তাই সে অবনত ॥
২৫৯
বাধা দিলে বাধবে লড়াই, মরতে হবে।
পথ জুড়ে কি করবি বড়াই, সরতে হবে ॥
লুঠ-করা ধন ক’রে জড়ো কে হতে চাস সবার বড়ো—
এক নিমেষে পথের ধুলায় পড়তে হবে।
নাড়া দিতে গিয়ে তোমায় নড়তে হবে ॥
নীচে বসে আছিস কে রে, কাঁদিস কেন ?
লজ্জাডোরে আপনাকে রে বাঁধিস কেন ?
ধনী যে তুই দুঃখধনে সেই কথাটি রাখিস মনে—
ধুলার ’পরে স্বর্গ তোমায় গড়তে হবে—
বিনা অস্ত্র, বিনা সহায়, লড়তে হবে ॥
২৬০
তুই কেবল থাকিস সরে সরে,
তাই পাস নে কিছুই হৃদয় ভরে ॥
আনন্দভাণ্ডারের থেকে দূত যে তোরে গেল ডেকে-
কোণে বসে দিস নে সাড়া, সব খোওয়ালি এমনি করে ॥
জীবনটাকে তোল্ জাগিয়ে,
মাঝে সবার আয় আগিয়ে।
চলিস নে পথ মেপে মেপে, আপনাকে দে নিখিল ব্যেপে-
যে ক’টা দিন বাকি আছে কাটাস নে আর ঘুমের ঘোরে ॥
২৬১
দাঁড়াও, মন, অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড-মাঝে আনন্দসভাভবনে আজ ॥
বিপুলমহিমাময়, গগনে মহাসনে বিরাজ করে বিশ্বরাজ ॥
সিন্ধু শৈল তটিনী মহারণ্যে জলধরমালা
তপন চন্দ্র তারা গভীর মর্মে গাহিছে শুন গান।
এই বিশ্বমহোত্সব দেখি মগন হল সুখে কবিচিত্ত,
ভুলি গেল সব কাজ ॥
২৬২
নদীপারের এই আষাঢ়ের প্রভাতখানি
নে রে ও মন, নে রে আপন প্রাণে টানি ॥
সবুজ-নীলে সোনায় মিলে যে সুধা এই ছড়িয়ে দিলে,
জাগিয়ে দিলে আকাশতলে গভীর বাণী,
নে রে ও মন, নে রে আপন প্রাণে টানি ॥
এমনি করে চলতে পথে ভবের কূলে
দুই ধারে যা ফুল ফুটে সব নিস রে তুলে।
সে ফুলগুলি চেতনাতে গেঁথে তুলিস দিবস-রাতে,
দিনে দিনে আলোয় মালা ভাগ্য মানি-
নে রে ও মন, নে রে আপন প্রাণে টানি ॥
২৬৩
শান্ত হ রে মম চিত্ত নিরাকুল, শান্ত হ রে ওরে দীন !
হেরো চিদম্বরে মঙ্গলে সুন্দরে সর্বচরাচর লীন ॥
শুন রে নিখিলহৃদয়নিস্যন্দিত শূন্যতলে উথলে জয়সঙ্গীত,
হেরো বিশ্ব চিরপ্রাণতরঙ্গিত নন্দিত নিত্যনবীন ॥
নাহি বিনাশ বিকার বিশোচন, নাহি দুঃখ সুখ তাপ-
নির্মল নিষ্কল নির্ভয় অক্ষয়, নাহি জরা জ্বর পাপ।
চির আনন্দ, বিরাম চিরন্তন, প্রেম নিরন্তর, জ্যোতি নিরঞ্জন-
শান্তি নিরাময়, কান্তি সুনন্দন,
সান্ত্বন অন্তহীন ॥
২৬৪
শুভ্র নব শঙ্খ তব গগন ভরি বাজে,
ধ্বনিল শুভ জাগরণগীত।
অরুণরুচি আসনে চরণ তব
রাজে,
মম হৃদয়কমল বিকশিত
॥
গ্রহণ কর’
তারে তিমিরপরপারে,
বিমলতর
পূণ্যকরপরশ-হরষিত
॥
২৬৫
পূর্বগগনভাগে
দীপ্ত হইল সুপ্রভাত
তরুণারুণরাগে।
শুভ শুভ্র মুহূর্তে আজি সার্থক কর’ রে,
অমৃতে ভর’ রে-
অমিতপুণ্যভাগী কে
জাগে কে জাগে ॥
২৬৬
মন, জাগ’ মঙ্গললোকে অমল অমৃতময় নব আলোকে
জ্যোতিবিভাসিত চোখে ॥
হের' গগন ভরি জাগে সুন্দর, জাগে তরঙ্গ জীবনসাগর-
নির্মল প্রাতে বিশ্বের সাথে জাগ’ অভয় অশোকে ॥
২৬৭
ভোরের বেলায় কখন এসে পরশ করে গেছ হেসে ॥
আমার ঘুমের দুয়ার ঠেলে কে সেই খবর দিল মেলে-
জেগে দেখি আমার আঁখি আঁখির জলে গেছে ভেসে ॥
মনে হল আকাশ যেন কইল কথা কানে কানে।
মনে হল সকল দেহ পূর্ণ হল গানে গানে।
হৃদয় যেন শিশিরনত ফুটল পূজার ফুলের মতো-
জীবননদী কূল ছাপিয়ে ছড়িয়ে গেল অসীমদেশে ॥
২৬৮
এখনো ঘোর ভাঙে না তোর যে, মেলে না তোর আঁখি—
কাঁটার বনে ফুল ফুটেছে রে জানিস নে তুই তা কি ?
ওরে অলস, জানিস নে তুই তা কি?
জাগো এবার জাগো, বেলা কাটাস না গো ॥
কঠিন পথের শেষে কোথায় অগম বিজন দেশে
ও সেই বন্ধু আমার একলা আছে গো, দিস নে তারে ফাঁকি ॥
প্রখর রবির তাপে নাহয় শুষ্ক গগন কাঁপে,
নাহয় দগ্ধ বালু তপ্ত আঁচলে দিক চারি দিক ঢাকি—
পিপাসাতে দিক চারি দিক ঢাকি।
মনের মাঝে চাহি দেখ্ রে আনন্দ কি নাহি।
পথে পায়ে পায়ে দুখের বাঁশরি বাজবে তোরে ডাকি—
মধুর সুরে বাজবে তোরে ডাকি ॥
২৬৯
আজি নির্ভয়নিদ্রিত ভুবনজাগে, কে জাগে ?
ঘন সৌরভমন্থর পবনে জাগে, কে জাগে ?।
কত নীরব বিহঙ্গকুলায়ে
মোহন অঙ্গুলি বুলায়ে— জাগে, কে জাগে ?
কত অস্ফুট পুষ্পের গোপনে জাগে কে জাগে ?
এই অপার অম্বরপাথারে
স্তম্ভিত গম্ভীর আঁধারে— জাগে, কে জাগে ?
মম গভীর অন্তরবেদনে জাগে, কে জাগে ?
২৭০
ভোর হল বিভাবরী, পথ হল অবসান-
শুন ওই লোকে লোকে উঠে আলোকেরই গান ॥
ধন্য হলি ওরে পান্থ রজনীজাগরক্লান্ত,
ধন্য হল মরি মরি ধুলায় ধূসর প্রাণ ॥
বনের কোলের কাছে সমীরণ জাগিয়াছে,
মধুভিক্ষু সারে সারে আগতকুঞ্জের দ্বারে।
হল তব যাত্রা সারা, মোছো মোছো অশ্রুধারা-
লজ্জা ভয় গেল ঝরি, ঘুচল রে অভিমান ॥
২৭১
নিশার স্বপন ছুটল রে, এই ছুটল রে, টুটুল বাঁধন টুটল রে ॥
রইল না আর আড়াল প্রাণে, বেরিয়ে এলেম জগত্-পানে-
হৃদয়শতদলের সকল দলগুলি এই ফুটল রে এই ফুটল রে ॥
দুয়ার আমার ভেঙে শেষে দাঁড়ালে যেই আপনি এসে
নয়নজলে ভেসে হৃদয় চরণতলে লুটল রে।
আকাশ হতে প্রভাত-আলো আমার পানে হাত বাড়ালো,
ভাঙা কারার দ্বারে আমার জয়ধ্বনি উঠল রে এই উঠল রে ॥
২৭২
অনেক দিনের শূন্যতা মোর ভরতে হবে—
মৌনবীণার তন্ত্র আমার জাগাও সুধারবে ॥
বসন্তসমীরে তোমার ফুল-ফোটানো বাণী
দিক পরানে আনি—
ডাকো তোমার নিখিল-উত্সবে ॥
মিলনশতদলে
তোমার প্রেমের অরূপ মূর্তি দেখাও ভুবনতলে।
সবার সাথে মিলাও আমায়, ভুলাও অহঙ্কার,
খুলাও রুদ্ধদ্বার
পূর্ণ করো প্রণতিগৌরবে ॥
২৭৩
হে চিরনূতন, আজি এ দিনের প্রথম গানে
জীবন আমার উঠুক বিকাশি তোমার পানে ॥
তোমার বাণীতে সীমাহীন আশা, চিরদিবসের প্রাণময়ী ভাষা-
ক্ষয়হীন ধন ভরি দেয় মন তোমার হাতের দানে ॥
এ শুভলগনে জাগুক গগনে অমৃতবায়ু,
আনুক জীবনে নবজনমের অমল আয়ু।
জীর্ণ যা-কিছু ক্ষীণ নবীনের মাঝে হোক তা বিলীন-
ধুয়ে যাক যত পুরানো মলিন
নব-আলোকের স্নানে ॥
২৭৪
প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমারি প্রাণে,
অলস রে, ওরে, জাগো জাগো ॥
শোনো রে চিত্তভবনে অনাদি শঙ্খ বাজিছে-
অলস রে, ওরে, জাগো জাগো ॥
২৭৫
জাগো নির্মল নেত্রে রাত্রির পরপারে,
জাগো অন্তরক্ষেত্রে মুক্তির অধিকারে ॥
জাগো ভক্তির তীর্থে পূজাপুষ্পের ঘ্রাণে,
জাগো উন্মুখচিত্তে, জাগো অম্লানপ্রাণে,
জাগো নন্দননৃত্যে সুধাসিন্ধুর ধারে,
জাগো স্বার্থের প্রান্তে প্রেমমন্দিরদ্বারে ॥
জাগো উজ্জ্বল পুণ্যে, জাগো নিশ্চল আশে,
জাগো নিঃসীম শূন্যে পূর্ণের বাহুপাশে।
জাগো নির্ভয়ধামে, জাগো সংগ্রামসাজে,
জাগো ব্রহ্মের নামে, জাগো কল্যাণকাজে,
জাগো দুর্গমযাত্রী দুঃখের অভিসারে,
জাগো স্বার্থের প্রান্তের প্রেমমন্দিরদ্বারে ॥
২৭৬
স্বপন যদি ভাঙিলে রজনীপ্রাতে
পূর্ণ করো হিয়া মঙ্গলকিরণে॥
রাখো মোরে তব কাজে,
নবীন করো এ জীবন হে॥
খুলি মোর গৃহদ্বার ডাকো তোমারি ভবনে হে॥
২৭৭
বাজাও তুমি কবি, তোমার সঙ্গীত সুমধুর
গম্ভীরতর তানে প্রাণে মম—
দ্রব জীবন ঝরিবে ঝর ঝর নির্ঝর তব পায়ে ॥
বিসরিব সব সুখ-দুখ, চিন্তা, অতৃপ্ত বাসনা—
বিচরিবে বিমুক্ত হৃদয় বিপুল বিশ্ব-মাঝে
অনুখন আনন্দবায়ে ॥
২৭৮
মনোমোহন, গহন যামিনীশেষে
দিলে আমারে জাগায়ে ॥
মেলি দিলে শুভপ্রাতে সুপ্ত এ আঁখি
শুভ্র আলোকে লাগায়ে ॥
মিথ্যা স্বপনরাজি কোথা মিলাইল,
আঁধার গেল মিলায়ে।
শান্তিসরসী-মাঝে চিত্তকমল
ফুটিল আনন্দবায়ে ॥
২৭৯
পান্থ, এখনো কেন অলসিত অঙ্গ-
হেরো, পুস্পবনে জাগে বিহঙ্গ ॥
গগন মগন নন্দন আলোক উল্লাসে,
লোকে লোকে উঠে প্রাণতরঙ্গ ॥
রুদ্ধ হৃদয়কক্ষে তিমিরে
কেন আত্মসুখদুঃখে শয়ন-
জাগো জাগো, চলো মঙ্গলপথে
যাত্রীদলে মিলি লহো বিশ্বের সঙ্গ ॥
২৮০
দুঃখরাতে, হে নাথ, কে ডাকিলে-
জাগি হেরিনু তব প্রেমমুখছবি ॥
হেরিনু উষালোকে বিশ্ব তব কোলে,
জাগে তব নয়নে প্রাতে শুভ্র রবি ॥
শুনিনু বনে উপবনে আনন্দগাথা,
আশা হৃদয়ে বহি নিত্য গাহে কবি ॥
২৮১
ডাকো মোরে আজি এ নিশীথে
নিদ্রামগন যবে বিশ্বজগত,
হৃদয়ে আসিয়ে নীরবে ডাকো হে
তোমারি অমৃতে ॥
জ্বালো তব দীপ এ অন্তরতিমিরে,
বার বার ডাকো মম অচেত চিতে ॥
২৮২
হরষে জাগো আজি, জাগো রে তাঁহার সাথে,
প্রীতিযোগে তাঁর সাথে একাকী ॥
গগনে গগনে হেরো দিব্য নয়নে
কোন্ মহাপুরুষ জাগে মহাযোগাসনে-
নিখিল কালে জড়ে জীবে জগতে
দেহে প্রাণে হৃদয়ে ॥
২৮৩
বিমল আনন্দে জাগো রে।
মগন হও সুধাসাগরে ॥
হৃদয়-উদয়াচলে দেখো রে চাহি
প্রথম পরম জ্যোতিরাগ রে ॥
২৮৪
সবে আনন্দ করো
প্রিয়তম নাথে লয়ে যতনে হৃদয়ধামে ॥
সঙ্গীতধ্বনি জাগাও জগতে প্রভাতে
স্তব্ধ গগন পূর্ণ করো ব্রহ্মনামে ॥
২৮৫
তুমি আপনি জাগাও মোরে তব সুধাপরশে-
হৃদয়নাথ, তিমিররজনী-অবসানে হেরি তোমারে ॥
ধীরে ধীরে বিকাশো হৃদয়গগনে বিমল তব মুখভাতি ॥
২৮৬
নূতন প্রাণ দাও, প্রাণসখা, আজি সুপ্রভাতে ॥
বিষাদ সব করো দূর নবীন আনন্দে,
প্রাচীন রজনী নাশো নূতন উষালোকে ॥
২৮৭
শোনো তাঁর সুধাবাণী শুভমুহূর্তে শান্তপ্রাণে-
ছাড়ো ছাড়ো কোলাহল,
ছাড়ো রে আপন কথা
॥
আকাশে দিবানিশি উথলে সঙ্গীতধ্বনি তাঁহার,
কে শুনে সে মধুবীণারব-
অধীর বিশ্ব শূন্যপথে হল বাহির
॥
২৮৮
নিশিদিন চাহো রে তাঁর পানে।
বিকশিত প্রাণ তাঁর গুণগানে ॥
হেরো রে অন্তরে সে মুখ সুন্দর,
ভোলো দুঃখ তাঁর প্রেমমধুপানে ॥
২৮৯
ওঠো ওঠো রে- বিফলে প্রভাত বহে যায় যে।
মেলো আঁখি, জাগো জাগো, থেকো না রে অচেতন ॥
সকলেই তাঁর কাজে ধাইল জগতমাঝে,
জাগিল প্রভাতবায়ু ভানু ধাইল আকাশপথে ॥
একে একে নাম ধরে ডাকিছেন বুঝি প্রভু-
একে একে ফুলগুলি তাই ফুটিয়া উঠিছে বনে।
শুন সে আহ্বানবাণী, চাহো সেই মুখপানে-
তাঁহার আশিস লয়ে
চলো রে যাই সবে তাঁর কাজে ॥
২৯০
ওদের কথায় ধাঁদা লাগে, তোমার কথা আমি বুঝি।
তোমার আকাশ তোমার বাতাস এই তো সবই সোজাসুজি ॥
হৃদয়কুসুম আপনি ফোটে, জীবন আমার ভরে ওঠে-
দুয়ার খুলে চেয়ে দেখি হাতের কাছে সকল পুঁজি ॥
সকল সাঁজে সুর যে বাজে ভুবন-জোড়া তোমার নাটে,
আলোর জোয়ার বেয়ে তোমার তরী আসে আমার ঘাটে।
শুনব কী আর বুঝব কী বা, এই তো দেখি রাত্রিদিবা
ঘরেই তোমার আনাগোনা-
পথে কি আর তোমায় খুঁজি ॥
২৯১
জানি নাই গো সাধন তোমার বলে কারে।
আমি ধুলায় বসে খেলেছি এই
তোমার দ্বারে ॥
অবোধ আমি ছিলেম বলে যেমন খুশি এলেম চলে,
ভয় করি নি তোমায় আমি অন্ধকারে ॥
তোমার জ্ঞানী আমায় বলে কঠিন তিরস্কারে,
পথ দিয়ে তুই আসিস নি যে, ফিরে যা রে।'
ফেরার পন্থা বন্ধ করে আপনি বাঁধো বাহুর ডোরে,
ওরা আমায় মিথ্যা ডাকে বারে বারে ॥
২৯২
আমায় ভুলতে দিতে নাইকো তোমার ভয়।
আমার ভোলার আছে অন্ত, তোমার প্রেমের তো নাই ক্ষয় ॥
দূরে গিয়ে বাড়াই যে ঘুর, সে দূর শুধু আমারি দূর-
তোমার কাছে দূর কভু দূর নয় ॥
আমার প্রাণের কুঁড়ি পাপড়ি নাহি খোলে,
তোমার বসন্তবায় নাই কি গো তাই বলে!
এই খেলাতে আমার সনে হার মানো ক্ষণে ক্ষণে-
হারের মাঝে মাঝে আছে তোমার জয় ॥
২৯৩
আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে গো ফুল ফুটবে।
আমার সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে ॥
আমার অনেক দিনের আকাশ-চাওয়া আসবে ছুটে দখিন-হাওয়া,
হৃদয় আমার আকুল করে সুগন্ধধন লুটবে ॥
আমার লজ্জা যাবে যখন পাব দেবার মতো ধন,
যখন রূপ ধরিয়ে বিকশিবে প্রাণের আরাধন।
আমার বন্ধু যখন রাত্রিশেষে পরশ তারে করবে এসে,
ফুরিয়ে গিয়ে দলগুলি সব চরণে তার লুটবে ॥
২৯৪
তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর
তুমি তাই এসেছ নীচে-
আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে ॥
আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,
আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,
মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে
তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে॥
তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে
তবু আমার হৃদয় লাগি
ফিরছ কত মনোহরণ বেশে,
প্রভু, নিত্য আছ জাগি।
তাই তো, প্রভু, যেথায় এল নেমে
তোমারি প্রেম ভক্তপ্রাণের প্রেমে
মুর্তি তোমার যুগলসম্মিলনে সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে ॥
২৯৫
তব সিংহাসনের আসন হতে এলে তুমি নেমে-
মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে, নাথ, থেমে ॥
একলা বসে আপন-মনে গাইতেছিলেম গান ;
তোমার কানে গেল সে সুর, এলে তুমি নেমে-
মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে, নাথ থেমে ॥
তোমার সভায় কত যে গান, কতই আছে গুণী-
গুণহীনের গানখানি আজ বাজল তোমার প্রেমে !
লাগল সকল তানের মাঝে একটি করুণ সুর,
হাতে লয়ে বরণমালা এলে তুমি নেমে-
মোর বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে, নাথ, থেমে ॥
২৯৬
জীবনে যত পূজা হল না সারা
জানি হে জানি তাও হয় নি হারা ॥
যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে
যে নদী মরুপথে হারালো ধারা
জানি হে জানি তাও হয় নি হারা ॥
জীবনে আজো যাহা রয়েছে পিছে
জানি হে জানি তাও হয় নি মিছে।
আমার অনাগত আমার অনাহত
তোমার বীণাতারে বাজিছে তারা-
জানি হে জানি তাও হয় নি হারা ॥
২৯৭
জানি জানি কোন্ আদি কাল হতে
ভাসালে আমারে জীবনের স্রোতে-
সহসা, হে প্রিয়, কত গৃহে পথে
রেখে গেছ প্রাণে কত হরষন ॥
কতবার তুমি মেঘের আড়ালে
এমনি মধুর হাসিয়া দাঁড়ালে,
অরুণকিরণে চরণ বাড়ালে,
ললাটে রাখিলে শুভ পরশন ॥
সঞ্চিত হয়ে আছে এই চোখে
কত কালে কালে কত লোকে লোকে
কত নব নব আলোকে আলোকে
অরূপের কত রূপদরশন।
কত যুগে যুগে কেহ নাহি জানে
ভরিয়া ভরিয়া উঠেছে পরানে
কত সুখে দুখে কত প্রেমে গানে
অমৃতের কত রসবরষন ॥
২৯৮
তুমি যে আমারে চাও আমি সে জানি।
কেন যে মোরে কাঁদাও আমি সে জানি ॥
এ আলোকে এ আঁধারে কেন তুমি আপনারে
ছায়াখানি দিয়ে ছাও আমি সে জানি ॥
সারাদিন নানা কাজে কেন তুমি নানা সাজে
কত সুরে ডাক দাও আমি সে জানি।
সারা হলে দে'য়া-নে'য়া দিনান্তের শেষ খেয়া
কোন্ দিক-পানে বাও আমি সে জানি ॥
২৯৯
জানি হে যবে প্রভাত হবে তোমার কৃপা-তরণী
লইবে মোরে ভবসাগর-কিনারে হে প্রভু।
করি না ভয়, তোমারি জয় গাহিয়া যাব চলিয়া,
দাঁড়াব আসি তব অমৃতদুয়ারে হে প্রভু ॥
জানি হে তুমি যুগে যুগে তোমার বাহু ঘেরিয়া,
রেখেছ মোরে তব অসীম ভুবনে হে-
জনম মোরে দিয়েছ তুমি আলোক হতে আলোকে,
জীবন হতে নিয়েছ নব জীবনে হে প্রভু ॥
জানি হে নাথ, পুণ্যপাপে হৃদয় মোর সতত
শয়ান আছে তব নয়নসমুখে হে প্রভু।
আমার হাতে তোমার হাত রয়েছে দিনরজনী,
সকল পথে-বিপথে সুখে-অসুখে হে প্রভু।
জানি হে জানি জীবন মম বিফল কভু হবে না,
দিবে না ফেলি বিনাশভয়পাথারে হে-
এমন দিন আসিবে যবে করুণাভরে আপনি
ফুলের মতো তুলিয়া লবে তাহারে হে প্রভু ॥
৩০০
নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা,
ভক্ত, সেথায় খোলো দ্বার- আজ লব তাঁর দেখা ॥
সারাদিন শুধু বাহিরে ঘুরে ঘুরে কারে চাহি রে,
সন্ধ্যাবেলার আরতি হয় নি আমার শেখা ॥
তব জীবনের আলোতে জীবনপ্রদীপ জ্বালি,
হে পূজারি, আজ নিভৃতে সাজাব আমার থালি।
যেথা নিখিলের সাধনা পূজালোক করে রচনা
সেথায় আমিও ধরিব একটি জ্যোতির রেখা ॥