|
প্রথম অঙ্ক
যতীনের পাশের ঘরে
প্রতিবেশিনী ও যতীনের বোন হিমি
প্রতিবেশিনী। যতীন আজ কেমন আছে, হিমি।
হিমি। ভালো না, কায়েতপিসি।
প্রতিবেশিনী। বলি, খিধেটা তো আছে এখনো?
হিমি। না, একচামচ বার্লিও সইছে না।
প্রতিবেশিনী। আমি যা বলি, একবার দেখোই-না, বাছা। আমার ঠাকুরজামাইয়ের ঠিক
ঐরকম হয়েছিল। ঠাকুরের কৃপায় খেতে পারত, খিধে ছিল বেশ, তাই রক্ষে। কিন্তু
একটু পাশ ফিরতে গেলেই— যতীনেরও তো ঐরকম পাঁজরের ব্যথা—
হিমি। না, ওঁর তো কোনো ব্যথা নেই।
প্রতিবেশিনী। তা নাই রইল। কিন্তু ঠাকুরজামাইও ঠিক এইরকম কত মাস ধরে শয্যাগত
ছিল। তাই বলি বাছা, ফরিদপুর থেকে আনিয়ে নে-না সেই কপিলেশ্বর ঠাকুরের— যদি
বলিস তো নাহয় আমার ছেলে অতুলকে—
হিমি। তুমি একবার মাসিকে ব’লে দেখো তিনি যদি—
প্রতিবেশিনী। তোর মাসি? সে তো কানেই আনে না। সে কি কিছু মানে। যদি মানত তবে
তার এমন দশা হয়?— বলি হিমি, তোদের বউ তো যতীনের ঘরের দিক দিয়েও যায় না।
হিমি। না, না, মাঝে মাঝে তো—
প্রতিবেশিনী। আমার কাছে ঢেকে কী হবে, বাছা। তোমরা যে বড়ো সাধ করে এমন রূপসী
মেয়ে ঘরে আনলে— এখন দুঃখের দিনে তোমাদের পরী বউয়ের রূপ নিয়ে কী হবে বলো তো।
এর চেয়ে যে কালো কুচ্ছিৎ—
হিমি। অমন করে বোলো না, কায়েতপিসি। আমাদের বউ ছেলেমানুষ—
প্রতিবেশিনী। ওমা, ছেলেমানুষ বলিস কাকে। বয়েস ভাঁড়িয়ে বিয়ে দিয়েছিল বলেই কি
আমাদের চোখ নেই। অমন ছেলে যতীন, তার কপালে এমন— ঐ যে আসছে মণি—
মণির প্রবেশ
এসো বাছা, এসো। ছাতে ছিলে বুঝি?
মণি। হাঁ।
প্রতিবেশিনী। শীলেদের বাড়ির বর বেরিয়েছে, তাই বুঝি দেখতে গিয়েছিলে? আহা,
ছেলেমানুষ দিনরাত রুগীর ঘরে কি—
মণি। আমার টবের গাছে জল দিতে গিয়েছিলুম।
প্রতিবেশিনী। ভালো কথা মনে করিয়ে দিলে। তোমার গোলাপের কলম আমাকে গোটাদুয়েক
দিতে হবে। অতুলের ভারি গাছের শখ, ঠিক তোমার মতো।
মণি। তা দেব।
প্রতিবেশিনী। আর, শোনো বাছা— তোমার গ্রামোফোন তো আজকাল আর ছোঁও না— যদি বল
তো ওটা না-হয় নিজের খরচায় মেরামত করিয়ে—
মণি। তা নিয়ে যাও-না।
প্রতিবেশিনী। তোমাদের বউয়ের হাত খুব দরাজ। হবে না কেন। কত বড়ো ঘরের মেয়ে।
বড়ো লক্ষ্মী। ঐ আসছেন তোমাদের মাসি— আমি যাই। যতীনের দরজা আগলে বসেই আছেন।
ব্যামোকে তো ঠেকাতে পারেন না, আমাদেরই ঠেকিয়ে রাখেন।
[ প্রস্থান]
হিমি। কী খুঁজছ, বউদিদি।
মণি। আমার কুকুরছানাকে দুধ খাওয়াবার সেই পিরিচটা।
মাসির প্রবেশ
মাসি। বউমা, তোমার পায়ের শব্দের জন্যে যতীন কান পেতে আছে তা জানো। এই
সন্ধের মুখে রুগীর ঘরে ঢুকে নিজের হাতে আলোটি জ্বেলে দাও, তার মন খুশি হোক।
কী হল। বলি, কথার একটা জবাব দাও।
মণি। এখনি আমাদের—
মাসি। যেই আসুক-না কেন, তোমাকে তো বেশিক্ষণ থাকতে বলছি নে। এই তার মকরধ্বজ
খাবার সময় হল। তোমার জন্যেই রেখে দিয়েছি। তুমি খলটা নিয়ে ওর পাশতলায়
দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে মধু দিয়ে মেড়ে দাও। তার পরে ওষুধটা খাওয়া হলেই চলে
এসো।
মণি। আমি তো দুপুরবেলায় ওঁর ঘরে গিয়েছিলুম।
মাসি। তখন তো ও ঘুমিয়ে পড়েছিল।
মণি। সন্ধের সময় ঐ ঘরে ঢুকলে কেমন আমার ভয় করতে থাকে।
মাসি। কেন, তোর ভয় কিসের।
মণি। ঐ ঘরেই আমার শ্বশুরের মৃত্যু হয়েছিল— সে আমার খুব মনে পড়ে।
ৱৱৱমাসি। কেউ মরে নি,
সমস্ত পৃথিবীতে কোথাও এমন একটু জায়গা আছে?
মণি। বোলো না, মাসি, বোলো না, সত্যি বলছি, মরাকে আমি ভারি ভয় করি।
মাসি। আচ্ছা বাপু, দিনের বেলাতেই নাহয় তুই আরেকটু ঘন ঘন—
মণি। আমি চেষ্টা করেছি যেতে। কিন্তু আমার কেমন গা ছম্ ছম্ করে। উনি আমার
মুখের দিকে এমন একরকম করে চান— চোখদুটো জ্বলজ্বল করতে থাকে।
মাসি। তাতে ভয়ের কথাটা কী।
মণি। মনে হয় যেন উনি অনেক দূর থেকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন এ
পৃথিবীতে না।
মাসি। আচ্ছা বাপু, বাইরে থেকেই নাহয় এই পথ্যিটথ্যিগুলো তৈরি করে দে। তুই
মনে করে নিজের হাতে কিছু করেছিস শুনলে, সেও তবু কতকটা—
মণি। মাসি, আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও। আমি দিনরাত এই-সব রোগের কাজ নিয়ে
নাড়াচাড়া করতে পারব না।
মাসি। একবার জিজ্ঞাসা করি, তুই নিজে যদি কখনো শক্ত ব্যামোয় পড়িস, তা হলে—
মণি। কখনো তো ব্যামো হয়েছে মনে পড়ে না। কোন্নগরের বাগানে থাকতে একবার জ্বর
হয়েছিল। মা আমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলেন। আমি লুকিয়ে পালিয়ে একটা
পচাপুকুরে চান করে এলুম। সবাই ভাবলে ন্যুমোনিয়া হবে। কিচ্ছু হল না। সেই
দিনই জ্বর ছেড়ে গেল।
মাসি। তোদের বাড়িতে কারো কি কখনো বিপদ-আপদ কিছু ঘটে নি।
মণি। আমি তো কখনো দেখি নি। এই বাড়িতে এসে প্রথম মৃত্যু দেখলুম। কেবলই ইচ্ছে
করছে, ছাড়া পাই, কোথাও চলে যাই। মালিশের গন্ধ পেলে মনে হয়, বাতাসকে যেন
হাঁসপাতালের ভূতে পেয়েছে।
মাসি। তোর যদি এমনিই মেজাজ হয় তা হলে তোকে নিয়ে সংসারে—
মণি। জানি নে। আমাকে তোমাদের বাগানের মালী করে দাও না— সে আমি ঠিক পারব। [
দ্রুত প্রস্থান]
হিমি। দেখো মাসি, বউদিদির এমন স্বভাব যে চেষ্টা করেও রাগ করতে পারি নে। মনে
হয় যেন বিধাতা ওর উপরে কোনো দায় দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান নি। ওর কাছে
দুঃখকষ্টের কোনো মানেই নেই।
মাসি। ভগবান ওর বাইরের দিকটা বহু যত্নে গড়তে গিয়ে ভিতরের দিকটা শেষ করবার
এখনো সময় পান নি। তোর দাদার এই বাড়ির মতো আর-কি। খুব ঘটা করে আরম্ভ করেছিল—
বাইরের মহল শেষ হতে হতেই দেউলে— ভিতরের মহলের ভারা আর নামল না। আজ ওকে
কেবলই ভোলাতে হচ্ছে। বাড়িটাকে নিয়েও, মণিকে নিয়েও।
হিমি। বুঝতে পারি নে, এটা কি আমাদের ভালো হচ্ছে।
মাসি। কী জানিস, হিমি? মৃত্যু যখন সামনে, তখন ঘর তৈরি সারা হোক না-হোক, কী
এল গেল। তাই ওকে বলি, একান্তমনে সংকল্প করেছ যা সেইটেই সম্পূর্ণ হয়েছে।
হিমি, সেইটেই তো সত্য।
হিমি। বাড়িটা যেন তাই হল। কিন্তু বউদিদি?
মাসি। হিমি, তোর বউদিদিকে যিনি সুন্দর করেছেন, তাঁর সংকল্পের মধ্যে ও
সম্পূর্ণ। চিরদিনের যে-মণি, ভগবানের আপন বুকের ধন যে-মণি সেই তো
কৌস্তভরত্ন— তার মধ্যে কোথাও কোনো খুঁত নেই। মৃত্যুকালে যতীন বিধাতার সেই
মানসের মণিকেই দেখে যাক।
হিমি। মাসি, তোমার কথা শুনলে আমার মন আলোয় ভরে ওঠে।
মাসি। হিমি, আমি কেবল কথাই বলি, কিন্তু বউয়ের উপরে রাগ করতেও ছাড়ি নে। সব
বুঝি, তবু ক্ষমাও করতে পারি নে। কিন্তু হিমি, তুই যে ঐ বললি, তোর বউদিদির
উপর রাগ করতে পারিস নে, তাতেই বুঝলুম, তুই যতীনেরই বোন বটে। যাই যতীনের
কাছে। [ প্রস্থান]
রোগীর ঘরে
যতীন। মাসি, তেতলার ঘরের সব পাথর বসানো হয়ে গেছে?
মাসি। হাঁ। কাল হয়ে গেছে সব।
যতীন। যাক, এতদিন পরে শেষ হয়ে গেল। আমার কতকালের ঘরবাঁধা সারা হল, আমার
কতদিনের স্বপ্ন।
মাসি। কত লোক দেখতে আসছে তোর এই বাড়িটা, যতীন।
যতীন। তারা বাইরে থেকে দেখছে, আমি ভিতরে থেকে যা দেখতে পাচ্ছি তা এখনো শেষ
হয় নি। কোনোকোলে শেষ হবে না। কল্পলোকের শেষ পাথরটি বসিয়ে আজ পর্যন্ত কোন্
শিল্পী বলেছে, এইবার আমার সাঙ্গ হল? বিশ্বের সৃষ্টিকর্তাও বলতে পারেন নি,
তাঁরও কাজ চলছে।
মাসি। যতীন, কিন্তু আর না বাবা, এইবার তুই একটু ঘুমো।
যতীন। না মাসি, আজ তুমি আমাকে সকাল সকাল ঘুমোতে বোলো না—
মাসি। কিন্তু ডাক্তার—
যতীন। থাক্ ডাক্তার। আজ আমার জগৎ তৈরি হয়ে গেল। আজ আমি ঘুমোব না— আজ বাড়ির
সব আলোগুলো জ্বেলে দাও, মাসি। মণি কোথায়। তাকে একবার—
মাসি। তাকে সেই তেতালার নতুন ঘরটায় ফুল দিয়ে সাজিয়ে বসিয়ে দিয়েছি।
যতীন। এ তোমার মাথায় কী করে এল। ভারি চমৎকার। দরজার দুধারে মঙ্গলঘট দিয়েছ?
মাসি। হাঁ, দিয়েছি বৈকি।
যতীন। আর, মেঝেতে পদ্মফুলের আলপনা?
মাসি। সে আর বলতে?
যতীন। একবার কোনোরকম করে ধরাধরি করে আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পার না? একবার
কেবল দেখে আসি, আমার মণি আপন-তৈরি ঘরের মাঝখানটিতে বসে।
মাসি। না যতীন, সে কিছুতেই হতে পারে না, ডাক্তার ভারি রাগ করবে।
যতীন। আমি মনে মনে ছবিটা দেখতে পাচ্ছি। কোন্ শাড়িটা পরেছে।
মাসি। সেই বিয়ের লাল শাড়িটা।
যতীন। আমার এই বাড়ির নাম কী হবে জান, মাসি?
মাসি। কী বল্ তো।
যতীন। মণিসৌধ।
মাসি। বেশ নামটি।
যতীন। তুমি এর সবটার মানে বুঝতে পারছ না, মাসি।
মাসি। না, সবটা হয়তো পারছিনে।
যতীন। সৌধ বলতে কেবল বাড়ি বুঝলে চলবে না। ওর মধ্যে সুধা আছে—
মাসি। তা আছে, যতীন— এ তো কেবল টাকা দিয়ে তৈরি হয় নি— তোর মনের সুধা এতে
ঢেলেছিস।
যতীন। তোমরা হয়তো শুনলে হাসবে—
মাসি। না, হাসব কেন, যতীন।— বল্, কী বলছিলি।
যতীন। আমি আজ বুঝতে পারছি, তাজমহল তৈরি করে শাজাহান কী সান্ত্বনা
পেয়েছিলেন। সে সান্ত্বনা তাঁর মৃত্যুকেও অতিক্রম ক’রে আজ পর্যন্ত—
মাসি। আর কথা কোস্ নে, যতীন— ঘুমোতে না চাস ঘুমোস নে, চুপ করে একটু ভাব
নাহয়।
যতীন। মণি তার বিয়ের সেই লাল বেনারসি পরেছে! আজ তাকে একবার—
মাসি। ডাক্তার যে বারণ করে, যতীন—
যতীন। ডাক্তার ভাবে, পাছে আমার—
মাসি। তোমার জন্যে নয়, মণির জন্যেই— ওকে বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু ওর
ভিতরটাতে—
যতীন। দুর্বলতা আছে, ডাক্তার বললে বুঝি—
মাসি। সে আমরা সকলেই লক্ষ্য করেছি—
যতীন। আহা, বেচারা, তা হলে সাবধান হোয়ো— কাজ নেই, রুগীর ঘর থেকে দূরে দূরে
থাকাই ভালো।
মাসি। ও তো আসতে পেলে বাঁচে, কিন্তু আমরা—
যতীন। না, না, কাজ নেই, কাজ নেই। মাসি, ঐ শেলফের উপর আল্বামটা আছে, দিতে
পার?—
[ আল্বাম আনিয়া
দিল
]
তোমাকে তাজমহলের কথা বলছিলুম। এখন মনে হচ্ছে, আমার যেন সেই শাজাহানের মতোই
হল— আমি ক্ষীণ জীবনের এপারে,—
সে পূর্ণ জীবনের ওপারে— অনেক দূরে, আর তার নাগাল পাওয়া যায় না। যেমন সেই
সম্রাটের মম্তাজ! তাকেই নিবেদন করে দিলুম আমার এই বাড়িটি— আমার এই তাজমহল।
এরই মধ্যে সে আছে, চিরকাল থাকবে, অথচ আমার চোখের কাছে সে নেই।
মাসি। ও যতীন, আর কেন কথা বলছিস। একবার একটু থাম্— ঘুমের ওষুধটা এনে দিই।
যতীন। না মাসি, না। আজ ঘুম নয়। আমি জেগে থেকে কিছু কিছু পাই, ঘুমের মধ্যে
আরো সব হারিয়ে যায়।— মাসি, তোমার কাছে কেবলই আমি মণির কথা বলি, কিছু মনে কর
না তো?
মাসি। কিছু না, যতীন। কত ভালো লাগে বলতে পারি নে। জানিস, কার কথা মনে পড়ে?
যতীন। কার কথা।
মাসি। তোর মায়ের। এমনি ক’রে যে একদিন তারও মনের কথা আমাকে শুনতে হত। তোর
বাবা তখন আমাদের বাড়িতে থেকে মেডিক্যাল কলেজে পড়তেন। তোর মায়ের সেদিনকার
মনের কথা আমি ছাড়া বাড়িতে কেউ জানত না। বাবা যখন বিয়ের জন্যে অন্য পাত্র
জুটিয়ে আনলেন, তখন আমিই তো তাঁকে—
যতীন। সে তোমারই কাছে শুনেছি। মাকে বুঝি দাদামশাই কিছুতেই পারলেন না,
শেষকালে বাবার সঙ্গেই বিয়ে দিতে হল। সেদিনের কথা কল্পনা করতে এত আনন্দ হয়।
মাসি। তোর মায়ের ভালোবাসা, সে যে তপস্যা ছিল। পাঁচ বৎসর ধরে তার হোমের আগুন
জ্বলল, তার পরে সে বর পেলে। যতীন, তোর মধ্যে সেই আগুনই আমি দেখি, আর অবাক
হয়ে ভাবি।
যতীন। মা তাঁর হোমের আগুন আমার রক্তের মধ্যে ঢেলে দিয়ে গেছেন— আমার
তপস্যাতেও বর পাব। কী জানি মনে হচ্ছে মাসি, সেই বর পাবার সময় আমার খুব কাছে
এসেছে।— কোথায় ঐ বাঁশি বাজছে?
মাসি। বিয়ের সানাই। আজ যে বিয়ের লগ্ন।
যতীন। কী আশ্চর্য। আজই তো মণি লাল বেনারসি পরেছে। জীবনে বিয়ের লগ্ন বারে
বারে আসে। আজ আলোগুলো সব জ্বালাতে বলে দাও-না, মাসি। দেউড়ি থেকে আরম্ভ করে—
মাসি। চোখে বেশি আলো লাগলে ঘুমোতে পারবি নে যে, যতীন—
যতীন। কোনো ক্ষতি হবে না। জেগে থেকে ঘুমের চেয়ে বেশি শান্তি পাব। জান,
মাসি? মন্দির হল সারা— এখন হবে
দেবীমূর্তির প্রাণপ্রতিষ্ঠা। আমি বেঁচে থাকতে থাকতে যে এতটা হতে পারবে,
মনেও করি নি।
মাসি। আমি ঘরে থাকলে তোর কথা থামবে না। আমি যাই। ঘুমোতে না চাস, অন্তত চুপ
করে থাক্।
যতীন। আচ্ছা, বাড়ির যে প্ল্যান করেছিলুম সেইটে আমাকে দিয়ে যাও— আর আমার সেই
খেলাঘরের বাক্সটা। খেলাঘর বলতে গিয়ে সেই গানটা মনে পড়ে গেল— হিমি, হিমি—
মাসি। ব্যস্ত হোস নে যতীন, আমি ডেকে দিচ্ছি।
[
প্রস্থান]
হিমির প্রবেশ
হিমি। কী দাদা।
যতীন। ঐ গানটা গা বোন— সেই যে খেলাঘর—
হিমির গান
খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি
মনের ভিতরে ।
কত রাত তাই তো জেগেছি
বলব কি তোরে ।
পথে যে পথিক ডেকে যায়,
অবসর পাই নে আমি হায়,
বাহিরের খেলায় ডাকে যে —
যাব কী ক'রে ।
যাহাতে সবার অবহেলা,
যায় যা ছড়াছড়ি,
পুরানো ভাঙা দিনের ঢেলা,
তাই দিয়ে ঘর গড়ি ।
যে আমার নিত্যখেলার ধন,
তারি এই খেলার সিংহাসন,
ভাঙারে জোড়া দেবে সে
কিসের মন্তরে ।
ডাক্তারের প্রবেশ
ডাক্তার। গান হচ্ছে, বেশ বেশ, খুব ভালো— ওষুধের চেয়ে ভালো। যতীন, মনটা খুশি
রাখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। পঁচানব্বইয়ের চেয়ে কম বাঁচা একটা মস্ত অপরাধ।
ফাঁসির যোগ্য।
যতীন। মন আমার খুব খুশি আছে। জানেন ডাক্তারবাবু, এতদিন পরে আমার বাড়ি-তৈরি
শেষ হয়ে গেল। সব আমার নিজেরই প্ল্যান।
ডাক্তার। এই তো চাই। নিজের তৈরি বাড়িতে নিজে বাস করলে তবে সেটা মাপসই হয়।
আসলে পৈতৃক বাড়িও ভাড়াটে বাড়ি, নিজের নয়। তোমার বাবা আমার ক্লাসফ্রেণ্ড্
ছিল; প্রাণটা ছাড়া পূর্বপুরুষের বলে কোনো বালাই কেদারের ছিল না। নিজের
যা-কিছু নিজে দেখতে দেখতে গড়ে তুললে। সে কি কম আনন্দ। তার শ্বশুর তার
বিবাহে নারাজ ছিলেন বলে শ্বশুরের সম্পত্তি রাগ করে নিলেই না। তুমিও নিজের
বাসা নিজে বেঁধে তুললে, সেও খুশির কথা বৈকি।
যতীন। ভারি খুশিতে আছি।
ডাক্তার। বেশ, বেশ। এবার গৃহপ্রবেশ হোক। আমাদের খাওয়াও, অমন শুয়ে পড়ে থাকলে
তো হবে না।
যতীন। আমার আজ মনে হচ্ছে, গৃহপ্রবেশ হবে। একবার পাঁজিটা দেখে নেব। যেদিন
প্রথম শুভদিন হবে সেইদিনই—
ডাক্তার। বেশ, বেশ। পাঁজি নয় বাবা, সব মনের উপর নির্ভর করে। মন যখনই শুভদিন
ঠিক করে দেয়, তখনই শুভদিন আসে।
যতীন। মন আমার বলছে, শুভদিন এল। তাই তো হিমিকে ডেকে গান শুনছি। গৃহপ্রবেশের
সানাই যেন আজ শরতের আকাশে বাজতে আরম্ভ করেছে।
ডাক্তার। বাজুক। ততক্ষণ নাড়ীটা দেখি, বুকটা পরীক্ষা করে নিই। সন্দেশ-মেঠাই
ফরমাশ দেবার আগে এই-সব বাজে উৎপাতগুলো চুকিয়ে নেওয়া যাক। কী বল, বাবা।
যতীন। নাড়ী যাই হোক-না কেন, তাতে কী আসে যায়।
ডাক্তার। কিচ্ছু না, কিচ্ছু না। মন ভোলাবার জন্যে ওগুলো করতে হয়। আমরা তো
ধন্বন্তরির মুখোশটা পরে রুগীর বুকে পিঠে পেটে পকেটে কষে হাত বুলোই, যম বসে
বসে হাসে। স্বয়ং ডাক্তার ছাড়া যমের গাম্ভীর্য কেউ টলাতে পারে না। হিমি, মা,
তুমি পাশের ঘরে যাও, গিয়ে গান করো, পাখির মতো গান করো। আমি একটা বই লিখতে
বসেছি, তাতে বুঝিয়ে দেব, গানের ঢেউ এলে বাতাস থেকে ব্যামো কী রকম ভেসে যায়।
ব্যামোগুলো সব বেসুর কিনা— ওরা সব বেতালা বেতালের দল; শরীরের তাল কাটিয়ে
দেয়। যা মা, বেশ-একটু গলা তুলে গান করিস।
হিমি। কোন্টা গাব, দাদা।
যতীন। সেই নূতন বিয়ের গানটা।
ডাক্তার। হাঁ হাঁ, সে ঠিক হবে। আজ একটা লগ্ন আছে বটে। পথে তিনটে বিয়ের দল
পার হয়ে আসতে হল; তাই তো দেরি হয়ে গেল।
পাশের ঘরে আসিয়া হিমির গান
বাজো রে বাঁশরি বাজো ।
সুন্দরী, চন্দনমাল্যে
মঙ্গলসন্ধ্যায় সাজো ।
আজি মধুফাল্গুন-মাসে,
চঞ্চল পান্থ কি আসে ।
মধুকরপদভর-কম্পিত চম্পক
অঙ্গনে ফোটে নি কি আজো ।
রক্তিম অংশুক মাথে,
কিংশুককঙ্কণ হাতে —
মঞ্জীরঝংকৃত পায়ে,
সৌরভসিঞ্চিত বায়ে,
বন্দনসংগীত-গুঞ্জন-মুখরিত
নন্দনকুঞ্জে বিরাজো।
পাশের ঘরে ডাক্তার ও মাসি
ডাক্তার। যেটা সত্যি সেটা জানা ভালোই। যে-দুঃখ পেতেই হবে সেটা স্বীকার করাই
চাই, ভুলিয়ে দুঃখ বাঁচাতে গেলে দুঃখ বাড়িয়েই তোলা হয়।
মাসি। ডাক্তার, এত কথা কেন বলছ।
ডাক্তার। আমি বলছি আপনাকে প্রস্তুত হতে হবে।
মাসি। ডাক্তার, তুমি কি আমাকে কেবল ঐ দুটো মুখের কথা বলেই প্রস্তুত করবে
ভাবছ। আমার যখন আঠারো বছর বয়স, তখন থেকে ভগবান স্বয়ং আমাকে প্রস্তুত করছেন—
যেমন করে পাঁজা পুড়িয়ে ইঁট প্রস্তুত করে। আমার সর্বনাশের গোড়া বাঁধা হয়েছে
অনেকদিন, এখন কেবল সবশেষের টুকুই বাকি আছে। বিধাতা আমাকে যা-কিছু বলবার
খুবই পষ্ট করে বলেছেন, তুমি আমাকে ঘুরিয়ে বলছ কেন।
ডাক্তার। যতীনের আর আশা নেই, আর অল্প কয়দিন মাত্র।
মাসি। জেনে রাখলুম। সেই শেষ কদিনের সংসারের কাজ চুকিয়ে দিই— তার পরে ঠাকুর
যদি দয়া করেন ছুটির দিনে তাঁর নিজের কাজে ভর্তি করে নেবেন।
ডাক্তার। ওষুধ কিছু বদল করে দেওয়া গেল। এখন সর্বদা ওর মনটাকে প্রফুল্ল রাখা
চাই। মনের চেয়ে ডাক্তার নেই।
মাসি। মন! হায় রে। তা আমি যা পারি তা করব।
ডাক্তার। আপনার বউমাকে প্রায় মাঝে মাঝে রোগীর কাছে যেতে দেবেন। আমার মনে হয়
যেন আপনারা ওঁকে একটু বেশি ঠেকিয়ে রাখেন।
মাসি। হাজার হোক, ছেলেমানুষ, রুগীর সেবার চাপ কি সইতে পারে।
ডাক্তার। তা বললে চলবে না। আপনিও ওঁর ’পরে একটু অন্যায় করেন। দেখেছি বউমার
খুব মনের জোর আছে। এতবড়ো ভাবনা মাথার উপরে ঝুলছে কিন্তু ভেঙে পড়েন নি তো।
মাসি। তবু ভিতরে ভিতরে তো একটা—
ডাক্তার। আমরা ডাক্তার, রোগীর দুঃখটাই জানি, নীরোগীর দুঃখ ভাববার জিনিস নয়।
বউমাকে বরঞ্চ আমার কাছে ডেকে
দিন, আমি নিজে তাঁকে বলে দিয়ে যাচ্ছি।
মাসি। না না, তার দরকার নেই— সে আমি তাকে—
ডাক্তার। দেখুন, আমাদের ব্যবসায়ে মানুষের চরিত্র অনেকটা বুঝে নেবার অনেক
সুবিধা আছে। এটা জেনেছি যে, বউয়ের উপরে শাশুড়ির যে-একটা স্বাভাবিক রীষ
থাকে, ঘোর বিপদের দিনেও সে যেন মরতে চায় না। বউ ছেলের সেবা করে তার মন
পাবে, এ আর কিছুতেই—
মাসি। কথাটা মিথ্যে নয়, তা রীষ থাকতেও পারে। মনের মধ্যে কত পাপ লুকিয়ে
থাকে, অন্তর্যামী ছাড়া আর কে জানে।
ডাক্তার। শুধু বোনপো কেন। বউয়ের প্রতিও তো একটা কর্তব্য আছে। নিজের মন
দিয়েই ভেবে দেখুন-না, তার মনটা কী রকম হচ্ছে। বেচারা নিশ্চয়ই ঘরে আসবার
জন্যে ছটফট করে সারা হল।
মাসি। বিবেচনাশক্তি কম, অতটা ভেবে দেখি নি তো।
ডাক্তার। দেখুন, আমি ঠোঁটকাটা মানুষ, উচিত কথা বলতে আমার মুখে বাধে না।
কিছু মনে করবেন না।
মাসি। মনে করব কেন, ডাক্তার। অন্যায় কোথাও থাকে যদি, নিন্দে না হলে তার
শোধন হবে কী করে। তা তোমার কথা মনে রইল, কোনো ত্রুটি হবে না—
[ ডাক্তারের প্রস্থান]
হিমি, কী করছিস।
হিমি। দাদার জন্যে দুধ গরম করছি।
মাসি। আচ্ছা, দুধ আমি গরম করব। তুই যা, যতীনকে একটু গান শোনাগে যা। তোর গান
শুনতে শুনতে ওর চোখে তবু একটু ঘুম আসে।
প্রতিবেশিনীর প্রবেশ
প্রতিবেশিনী। দিদি, যতীন কেমন আছে আজ।
মাসি। ভালো নেই, সুরো।
প্রতিবেশিনী। আমার কথা শোনো, দিদি। একবার আমাদের জগু ডাক্তারকে দেখাও দেখি।
আমার নাতনি নাক ফুলে ব্যথা হয়ে যায় আর-কি। শেষকালে জগু ডাক্তার এসে তার ডান
নাকের ভিতর থেকে এতবড়ো একটা কাঁচের পুঁতি বের করে দিলে। ওর ভারি হাতযশ।
আমার ছেলে তার ঠিকানা জানে।
মাসি। আচ্ছা, বোলো ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিতে।
প্রতিবেশিনী। সেদিন তোমাদের বউকে আলিপুরে জু-তে দেখলুম যে।
মাসি। ও জন্তু-জানোয়ার ভারি ভালোবাসে, প্রায় সেখানে যায়।
প্রতিবেশিনী। জন্তু ভালোবাসে ব’লে কি স্বামীকে ভালোবাসতে নেই।
মাসি। কে বললে, ভালোবাসে না! ছেলেমানুষ, দিনরাত রুগীর কাছে থাকলে বাঁচবে
কেন। আমরাই তো ওকে জোর ক’রে—
প্রতিবেশিনী। তা যাই বল, পাড়াসুদ্ধ মেয়েরা সবাই কিন্তু ওর কথা—
মাসি। পাড়ার মেয়েরা তো ওকে বিয়ে করে নি, সুরো। আমার যতীন ওকে বোঝে, সে তো
কোনোদিন—
প্রতিবেশিনী। তা দিদি, সে কিছু বলে না ব’লেই কি—
মাসি। শুধু বলে না? ও-যে কখনো জাদুঘরে কখনো-বা বাঘভাল্লুক দেখতে যায়, এতেই
তার আনন্দ।
প্রতিবেশিনী। বল কী দিদি। সেবাটা কি তার চেয়ে—
মাসি। ও তো বলে মণির পক্ষে এইটেই সেবা। যতীন নিজে বিছানায় বদ্ধ থাকে, মণি
ঘুরে বেড়িয়ে এলে সেইটেতেই যতীন যেন ছুটি পায়। রুগীর পক্ষে সে কি কম।
প্রতিবেশিনী। কী জানি ভাই, আমরা সেকেলে মানুষ, ও-সব বুঝতে পারি নে। তা যা
হোক, আমার ছেলেকে পাঠিয়ে দেব, দিদি। সে জগু ডাক্তারের ঠিকানা জানে। একবার
তাকে ডেকে দেখাতে দোষ কী।
[ প্রস্থান]
রোগীর ঘরে
যতীন। এই যে, হিমি এসেছিস। আঃ বাঁচলুম। সেই ফোটোটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি নে,
তুই একবার দেখ-না, বোন।
হিমি। কোন্ ফোটো, দাদা।
যতীন। সেই-যে বোটানিকেল
গার্ডনে মণির সঙ্গে গাছতলায় আমার যে-ছবি তোলা
হয়েছিল।
হিমি। সেটা তো তোমার আলবামে ছিল।
যতীন। এই-যে খানিক আগে আলবাম থেকে খুলে নিয়েছি। বিছানার মধ্যেই কোথাও আছে—
কিংবা নীচে পড়ে গেছে।
হিমি। এই-যে দাদা, বালিশের নীচে।
যতীন। মনে হয় যেন আর-জন্মের কথা। সেই নিমগাছের তলা। মণি পরেছিল কুসমি রঙের
শাড়ি। খোঁপাটা ঘাড়ের কাছে নিচু করে বাঁধা। মনে আছে হিমি, কোথা থেকে একটা
বউ-কথা-কও ডেকে ডেকে অস্থির হচ্ছিল। নদীতে জোয়ার এসেছে— সে কী হাওয়া, আর
ঝাউগাছের ডালে ডালে কী ঝর্ঝরানি শব্দ। মণি ঝাউয়ের ফলগুলো কুড়িয়ে তার ছাল
ছাড়িয়ে শুঁকছিল— বলে, আমার এই গন্ধ খুব ভালো লাগে। তার যে কী ভালো লাগে না,
তা জানি নে। তারই ভালো লাগার ভিতর দিয়ে এই পৃথিবীটা আমি অনেক ভোগ করেছি।
সেদিন যেটা গেয়েছিলি, সেই গানটি গা তো হিমি। লক্ষ্মী মেয়ে। মনে আছে তো?
হিমি। হাঁ মনে আছে।
গান
যৌবনসরসীনীরে
মিলনশতদল,
কোন্ চঞ্চল বন্যায় টলমল টলমল।
শরম-রক্তরাগে
তার গোপন স্বপ্ন জাগে,
তারি গন্ধকেশর-মাঝে
এক বিন্দু নয়নজল।
ধীরে বও ধীরে বও সমীরণ,
সবেদন পরশন।
শঙ্কিত চিত্ত মোর
পাছে ভাঙে বৃন্তডোর,
তাই অকারণ করুণায়
মোর আঁখি করে ছলছল।
যতীন। সেদিন গাছের তলা কথা কয়ে উঠেছিল। আজ এই দেয়ালের মধ্যে সমস্ত পৃথিবী
একেবারে চুপ। ঐ দেয়ালগুলো তার ফ্যাকাসে ঠোঁটের মতো। হিমি, আলোটা আর-একটু কম
করে দে। এপারে গাছে গাছে কতরকমের সবুজের উচ্ছ্বাস আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে, আর
ওপারে কলের চিমনি থেকে ধোঁয়াগুলো পাক দিয়ে আকাশে উঠছে, তারও কী সুন্দর রঙ,
আর কী সুন্দর ডৌল। সবই ভালো লাগছিল। আর তোদের সেই কুকুরটা— জলে মণি বারবার
গোলা ফেলে দিচ্ছিল, আর সে সাঁতার দিয়ে—
হিমি। দাদা, তুমি কিন্তু আর কথা কোয়ো না।
যতীন। আচ্ছা কব না; আমি চোখ বুজে শুনব, সেই ঝাউগাছের ঝর ঝর শব্দ। কিন্তু
হিমি, তুই আজ গাইলি, ও যেন ঠিক তেমন— কে জানে। আর-একটু অন্ধকার হয়ে আসুক,
আপনা-আপনি শুনতে পাব— ধীরে বও, ধীরে বও, সমীরণ। আচ্ছা, তুই যা। ছবিটা কোথায়
রাখলুম?
হিমি। এই-যে!
[ প্রস্থান
পাশের ঘরে মাসি ও অখিল
অখিল। কেন ডেকে পাঠিয়েছ কাকি।
মাসি। বাবা, তুই তো উকিল, তোকে একটা-কিছু করে দিতেই হচ্ছে।
অখিল। তারা তো আর সবুর করতে পারছে না— ডিক্রি করেছে, এখন জারি করবার জন্যে—
মাসি। বেশিদিন সবুর করতে হবে না। তারা তো তোরই মক্কেল। একটু বুঝিয়ে বলিস,
ডাক্তার বলেছে—
অখিল। ডাক্তার আরো একবার বলেছিল কিনা, এবার তারা বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না।
বাড়ি বন্ধক রেখে বাড়ি তৈরি করা, যতীনের এ কী রকম বুদ্ধি হল।
মাসি। ওর দোষ নেই, দোষ নেই, ওর বুদ্ধির জায়গায় মণি বসেছে শনি হয়ে। ভেবেছিল
ওর মণিকে, ওর ঐ আলেয়ার আলোকে, ইঁটের বেড়া দিয়ে ধরে রাখবে।
অখিল। ওর তো নগদ টাকা কিছু ছিল।
মাসি। সমস্তই পাটের ব্যাবসায় ফেলেছে।
অখিল। যতীনের পাটের ব্যাবসা! কলম দিয়ে লাঙল-চাষ। হাসব না কাঁদব?
মাসি। অসাধ্যরকম খরচ করতে বসেছিল, ভেবেছিল পাট বেচাকেনা করে তাড়াতাড়ি মুনফা
হবে। আকাশ থেকে মাছি কেমন করে ঘায়ের খবর পায়, সর্বনাশের একটু গন্ধ পেলেই
কোথা থেকে সব কুমন্ত্রী এসে জোটে।
অখিল। সর্বনাশ! এখন বাজার এমন যে খেতের পাট চাষীদের কাটবার খরচ পোষাচ্ছে
না।
মাসি। থাক্ থাক্, আর বলিস নে। ভাববারও আর দরকার নেই— দিন ফুরিয়ে এল।
অখিল। কাকি, পাওনাদার বোধ হয় ওর পাটের ব্যাবসার খবর পেয়েছে— বুঝেছে অনেক
শকুনি জমবে, তাই তাড়াতাড়ি নিজের পাওনা আদায় করবার জোগাড় করছে।
মাসি। ওরে অখিল, এ ক’টা দিন সবুর করতে বল— যমদূতের সঙ্গে আদালতের পেয়াদা
যেন পাল্লা দিতে না আসে। নাহয় নিয়ে চল আমাকে তোর মক্কেলের কাছে। আমি
বামুনের মেয়ে তার পায়ে মাথা খুঁড়ে আসিগে।
অখিল। আচ্ছা, তাদের সঙ্গে একবার কথা কয়ে দেখি যদি দরকার হয় তোমাকে হয়তো
যেতে হবে। একবার যতীনের সঙ্গে দেখা করে যাই।
মাসি। না, তোকে দেখলেই ওর ব্যাবসার কথা মনে পড়ে যাবে।
অখিল। আচ্ছা, ও-যে মণির নামে অনেক টাকা লাইফ ইনস্যোর করেছিল, তার কী হল।
মাসি। সে আমি যেমন করে হোক টিকিয়ে রেখেছি। আমার যা-কিছু ছিল তাতেই তো গেল,
আর এই ডাক্তার-খরচে। যতীনকে তো বাঁচাতে পারব না, যতীনের এই দানটিকে বাঁচাতে
পারলুম, আমার মনে এই সুখ থাকবে। মনে তো আছে, মাঝে মাঝে ইনস্যোরের মাশুল যখন
তাকে জোগাতে হত তখন সে কী হাঙ্গাম। দোহাই অখিল, তোর মক্কেলকে বলে—
অখিল। দেখো কাকি, আমি সত্যি কথা বলি, ওর ’পরে আমার একটুও দয়া হয় না। এতবড়ো
বাদশাই বোকামি—
মাসি। কিন্তু ওর ’পরে ভগবানের দয়া কত একবার দেখ। সমস্ত প্রাণ দিয়ে ও এই
বাড়িটি তৈরি করতে বসেছিল, শেষ হল না বটে, কিন্তু ওর খেলার সাথি ভাঙা খেলনা
কুড়িয়ে নিয়ে ওকে সঙ্গে নিয়েই যাচ্ছেন। আর কোন্ খেলায় নিমন্ত্রণ পড়েছে কে
জানে।
অখিল। কাকি, আমাদের আইনের বইয়ে ভাগ্যে তোমাদের এই খেলার কথাটা কোথাও লেখে
নি। তাই অন্ন করে দুটো খেতে পাচ্ছি নইলে ঐরকমই খেয়ালের হাওয়ায় একেবারে
দেউলের ঘাটে গিয়ে মরতুম।
[ প্রস্থান]
মণির প্রবেশ
মাসি। বউ, তোমার বাপের বাড়ি থেকে কিছু খবর এসেছে নাকি? তোমার জ্যাঠ্তত ভাই
অনাথকে দেখলুম।
মণি। হাঁ, মা বলে পাঠিয়েছেন আসছে শুক্রবারে আমার ছোটো বোনের অন্নপ্রাশন।
তাই ভাবছি—
মাসি। বেশ তো বাছা, একগাছি সোনার হার পাঠিয়ে দাও, তোমার মা খুশি হবেন।
মণি। ভাবছি, আমি যাব। আমার ছোটো বোনকে তো দেখি নি, দেখতে ইচ্ছে করে।
মাসি। ওমা, সে কী কথা। যতীনকে একলা ফেলে যাবে?
মণি। ফিরতে আমার খুব বেশি দেরি হবে না।
মাসি। খুব বেশি দেরি হবে কি না তা কে বলতে পারে, মা। সময় কি আমাদের হাতে।
চোখের এক পলকে দেরি হয়ে যায়।
মণি। তিন ভাইয়ের পরে বড়ো আদরের মেয়ে, ধুম করে অন্নপ্রাশন হবে। আমি না গেলে
মা ভারি—
মাসি। তোমার মায়ের ভাব, বাছা, বুঝতে পারি নে— কান্নার সাত সমুদ্রে ঘেরা
যাদের প্রাণ, তোমার মাও তো সেই মায়েরই জাত, তবু তিনি মানুষের এতবড়ো ব্যথা
বোঝেন না, ঘন ঘন কেবলই তোমাকে ডেকে ডেকে নিয়ে যান-
মণি। দেখো মাসি, তুমি আমার মাকে খোঁটা দিয়ে কথা কোয়ো না বলছি। তবু যদি আপন
শাশুড়ি হতে, তা হলেও নয় সহ্য করতুম, কিন্তু—
মাসি। আচ্ছা মণি, অপরাধ হয়েছে, আমাকে মাপ করো। আমি শাশুড়ি হয়ে তোমাকে কিছু
বলছি নে, আমি একজন সামান্য মেয়েমানুষের মতোই মিনতি করছি— যতীনের এই সময়ে
তুমি যেয়ো না। যদি যাও তোমার বাবা রাগ করবেন, সে আমি নিশ্চয় জানি।
মণি। তা জানি, তোমাকে একলাইন লিখে দিতে হবে মাসি। এই কথা বোলো যে, আমি গেলে
বিশেষ কোনো—
মাসি। তুমি গেলে কোনো ক্ষতিই নেই, সে কি আমি জানি নে। কিন্তু তোমার বাপকে
যদি লিখতে হয়, আমার মনে যা আছে খুলেই লিখব।
মণি। আচ্ছা বেশ, তোমাকে লিখতে হবে না। আমি ওঁকে গিয়ে বললেই উনি—
মাসি। দেখো বউ, অনেক সয়েছি, কিন্তু এই নিয়ে যদি তুমি যতীনের কাছে যাও
কিছুতেই সইব না।
মণি। আচ্ছা, থাক্ তোমাদের চিঠি। বাপের বাড়ি যাব তার এত হাঙ্গামা কিসের।
উনি যখন জর্মনিতে পড়তে যেতে চেয়েছিলেন তখনই তো পাসপোর্টের দরকার হয়েছিল।
আমার বাপের বাড়ি জর্মনি নাকি?
মাসি। আচ্ছা, আচ্ছা, অত চেঁচিয়ে কথা কোয়ো না। ঐ বুঝি আমাকে ডাকছে। যাই,
যতীন। কী জানি, শুনতে পেয়েছে কি না।
[ প্রস্থান
]
যতীনের ঘরে
মাসি। আমাকে ডাকছিলে, যতীন?
যতীন। হাঁ, মাসী। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলুম, উপায় নেই, আমি তো বন্দী; অসুখের জাল
দিয়ে জড়ানো, দেয়াল দিয়ে ঘেরা— সঙ্গে সঙ্গে মণিকে কেন এমন বেঁধে রাখি।
মাসি। কী যে বলিস যতীন, তার ঠিক নেই। তোর সঙ্গে যে ওর জীবন বাঁধা, তুই
খালাস দিতে চাইলেই কি ওর বাঁধন খসবে।
যতীন। একদিন ছিল যখন স্ত্রী সহমরণে যেত, সে অন্যায় তো এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
কিন্তু মণির আজ এ যে পলে পলে সহমরণ, বেঁচে থেকে সহমরণ। মনে করে আমার প্রাণ
হাঁপিয়ে ওঠে— এর থেকে ওকে দাও মুক্তি মাসি, দাও মুক্তি।
মাসি। আজ এমন কথা হঠাৎ কেন বলছিস, যতীন। স্বপ্নের ঘোরে এক কথা আর হয়ে তোর
কানে পৌঁচেছিল নাকি।
যতীন। না না, অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিলুম, ঝাউগাছের ঝরঝর শব্দ, নদীতে জোয়ার,
দূরে বউ-কথা-কও পাখির ডাক। মনে পড়ছিল, মণির সেই কুসমিরঙের শাড়ি, আর কুকুরের
সঙ্গে দেখাল, আর বিনা-কারণে হাসি। ওর দুরন্ত প্রাণ, এই মরা দেওয়ালগুলোর
মধ্যে কেন। দাও ছুটি ওকে। কতদিন এ বাড়িতে ওর হাসিই শুনতে পাই নি। ওর স্রোতে
নবীন জোয়ার, সে কি ঐসব ওষুধের শিশি, আর রুগীর পথ্যের বাঁধ বেঁধে আটকে দেবে।
আমার মনে হচ্ছে, অন্যায়— ভারি অন্যায়।
মাসি। কিচ্ছু অন্যায় না, একটুও অন্যায় না। যার প্রাণ আছে সেই তো প্রাণ দিতে
পারে! বর্ষণ তো ভরা মেঘের। উঠে বসিস্ নে যতীন, শো— অমন ছটফট করতে নেই।
কোথায় মণিকে পাঠাতে চাস, বল্, আমি বুঝতে পারছি নে।
যতীন। নাহয় মণিকে ওর বাপের বাড়ি— ভুলে যাচ্ছি ওর বাবা এখন কোথায়—
মাসি। সীতারামপুরে।
যতীন। হাঁ, সীতারামপুরে। সে খোলা জায়গা, সেখানে ওকে পাঠিয়ে দাও।
মাসি। শোনো একবার। এই অবস্থায় তোমাকে ফেলে বাপের বাড়ি যেতে চাইবেই বা কেন।
যতীন। ডাক্তার কী বলেছে, সে কথা কি সে—
মাসি। তা সে নাই জানলে। চোখে তো দেখতে পাচ্ছে। সেদিন বাপের বাড়ি যাবার কথা
যেমনি একটু ইশারায় বলা, অমনি বউ কেঁদে অস্থির।
যতীন। সত্যি মাসি, বউ কাঁদলে? সত্যি? তুমি দেখেছ?
মাসি। যতীন, উঠিস্ নে উঠিস্ নে, শো। ঐ যাঃ, ভাঁড়ার ঘর বন্ধ করতে ভুলে
গেছি— এখনই ঘরে কুকুর ঢুকবে। আমি যাই, তুমি একটু ঘুমোও যতীন।
যতীন। আমি এইবার ঠিক ঘুমোব, তুমি ভেবো না। কেবল একটা কথা— গৃহপ্রবেশের
শুভদিন ঠিক করে দাও।
মাসি। কী বলছিস যতীন, তোর এ অবস্থায়—
যতীন। তোমরা বিশ্বাস করতে পার না— আমার মন বলছে, গৃহপ্রবেশের দিন এল ব’লে।
আমি যেতে পারব, নিশ্চয় যেতে পারব। এইবেলা থেকে সব প্রস্তুত করোগে। তখন যেন
আবার দেরি না হয়।
মাসি। তা হবে, হবে, কিছু ভাবিস্ নে।
যতীন। মণিকেও এইবেলা বলে রাখো। তারও তো কাজ আছে?
মাসি। আছে বৈকি যতীন, আছে।
যতীন। তুমি আমাদের দুজনকে বরণ করে নেবে।— আচ্ছা মাসি, আমার একটা প্রশ্ন মনে
আসে, ভয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারি নে। তুমি বলতে পার? পাটের বাজার কি এর
মধ্যে চড়েছে।
মাসি। ঠিক তো জানি নে। অখিল কী যেন বলছিল।
যতীন। কী, কী, কী বলছিল। তোমাকে ভয় দেখাতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু এ কথা
নিশ্চয়, যদি বাজার না চড়ে থাকে তা হলে—
মাসি। কী আর হবে।
যতীন। তা হলে আমার এ বাড়ি— এক মুহূর্তে হয়ে যাবে মরীচিকা। ঐ-যে, ঐ-যে,
আমাদের আড়তের গোমস্তা। নরহরি, নরহরি—
মাসি। যতীন, চেঁচিয়ো না, মাথা খাও, স্থির হয়ে শোও। আমি যাচ্ছি, ওর সঙ্গে
কথা কয়ে আসছি।
যতীন। আমার ভয় হচ্ছে, যেন— মাসি, যদি বাজার খারাপই হয়, তুমি অখিলকে ব’লে
কোনোরকম করে—
মাসি। আচ্ছা, অখিলের সঙ্গে কথা কব। তুই এখন—
যতীন। জান, মাসি? আমি যে টাকা ধার নিয়েছিলুম সে অখিলেরই টাকা অন্যের নাম
করে—
মাসি। আমিও তাই আন্দাজ করেছি।
যতীন। কিন্তু দেখো, নরহরিকে তুমি আমার কাছে আসতে দিয়ো না— আমার ভয় হচ্ছে
পাছে কী ব’লে বসে। আমি সইতে পারব না, তুমি ওকে অখিলের কাছে নিয়ে যাও।
মাসি। তাই যাচ্ছি—
যতীন। তোমার কাছে পাঁজিটা যদি থাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো তো।
মাসি। এখন পাঁজি থাক্, তুই ঘুমো।
যতীন। মণি বাপের বাড়ি যাবার কথায় কাঁদলে? আমার ভারি আশ্চর্য ঠেকছে।
মাসি। এতই বা আশ্চর্য কিসের।
যতীন। ও যে সেই অমরাবতীর উর্বশী যেখানে মৃত্যুর ছায়া নেই— ওকে তোমরা করে
তুলতে চাও প্রাইভেট হাঁসপাতালের নার্স?
মাসি। যতীন, ওকে কি তুই কেবল ছবির মতোই দেখবি। দেয়ালে টাঙিয়ে রাখবার?
যতীন। তাতে দোষ কী। ছবি পৃথিবীতে বড়ো দুর্লভ। দেখার জিনিসকে দেখতে পাবার
সৌভাগ্য কি কম। তা হোক, তুমি বলেছিলে মণি কেঁদেছিল? লক্ষ্মীর আসন পদ্ম, সেও
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সুগন্ধে বাতাসকে কাঁদিয়ে দেয়?
মাসি। মেয়েমানুষ যদি সেবা করতে না পারলে তা হলে—
যতীন। শাজাহানের ঘরে ঘরকরনা করবার লোক ঢের ছিল— তাদের সকলের মধ্যে কেবল
একজনকে তিনি দেখেছিলেন যার কিছুই করবার দরকার ছিল না। নইলে তাজমহল তাঁর মনে
আসত না। তাজমহলেরও কোনো দরকার নেই। মাসি, আমি সেরে উঠলেই আবার এই বাড়িটি
নিয়ে পড়ব। যতদিন বেঁচে থাকি, এই বাড়িটিকে সম্পূর্ণ করে তোলাই আমার একমাত্র
কাজ হবে, আমার এই মণিসৌধ। বিধাতার স্বপ্নকে যে আমি চোখে দেখলুম, আমার
স্বপ্নকে সাজিয়ে তুলে কেবল সেই খবরটি রেখে যেতে চাই। মাসি, তুমি হয়তো আমার
কথা ঠিক বুঝতে পারছ না।
মাসি। তা সত্যি বলছি বাবা, তোদের এ পুরুষমানুষের কথা আমি ঠিক বুঝি নে।
যতীন। এ জানালাটা আরেকটু খুলে দাও।— [ মাসি জানালা খুলিয়া দিলেন] ঐ দেখো, ঐ
দেখো, অনাদি অন্ধকারের সমস্ত চোখের জলের ফোঁটা তারা হয়ে রইল।— হিমি কোথায়,
মাসি।
সে কি ঘুমোতে গেছে।
মাসি। না, এখনো বেশি রাত হয় নি। ও হিমি, শুনে যা।
হিমির প্রবেশ
যতীন। আমাকে গাইতে বারণ করেছে বলেই বারে বারে তোকে ডাকতে হয়— কিছু মনে
করিস্ নে, বোন।
হিমি। না দাদা, তুমি তো জানো, আমার গাইতে কত ভালো লাগে। কোন্ গানটা শুনতে
চাও, বলো।
যতীন। সেই যে— আমার মন চেয়ে রয়।
হিমির গান
আমার মন চেয়ে রয় মনে মনে হেরে মাধুরী ।
নয়ন আমার কাঙাল হয়ে মরে না ঘুরি ।
চেয়ে চেয়ে বুকের মাঝে
গুঞ্জরিল একতারা যে,
মনোরথের পথে পথে বাজল বাঁশুরি,
রূপের কোলে ওই-যে দোলে অরূপ মাধুরী ।
কূলহারা কোন্ রসের সরোবরে,
মূলহারা ফুল ভাসে জলের 'পরে ।
হাতের ধরা ধরতে গেলে
ঢেউ দিয়ে তায় দিই-যে ঠেলে,
আপন-মনে স্থির হয়ে রই, করি নে চুরি ।
ধরা দেওয়ার ধন সে তো নয়, অরূপ মাধুরী।
যতীন। মাসি, তোমরা কিন্তু বরাবর মনে করে এসেছ, মণির মন চঞ্চল— আমাদের ঘরে
ওর মন বসে নি—কিন্তু দেখো—
মাসি। না বাবা, ভুল বুঝেছিলুম, সময় হলেই মানুষকে চেনা যায়।
যতীন। তুমি মনে করেছিলে, মণিকে নিয়ে আমি সুখী হতে পারি নি, তাই তার উপরে
রাগ করতে। কিন্তু সুখ জিনিসটি ঐ তারাগুলির মতো অন্ধকারের ফাঁকে ফাঁকে দেখা
দেয়। জীবনের ফাঁকে ফাঁকে কি স্বর্গের আলো জ্বলে নি। আমার যা পাবার তা
পেয়েছি, কিছু বলবার নেই। কিন্তু মাসি, ওর তো অল্প বয়েস, ও কী নিয়ে থাকবে।
মাসি। অল্প বয়েস কিসের। আমরাও তো বাছা, ঐ বয়সেই দেবতাকে সংসারের দিকে
ভাসিয়ে দিয়ে অন্তরের দিকে টেনে নিয়েছি। তাতে ক্ষতি হয়েছে কী। তাও বলি,
সুখেরই বা এত বেশি দরকার কিসের।
যতীন। যখন থেকে শুনেছি মণি কেঁদেছে, তখন থেকেই বুঝেছি, ওর মন জেগেছে। ওকে
একবার ডেকে দাও, মাসি। দুপুরবেলা একবার এসেছিল। তখন দিনের প্রথম আলো, দেখে
হঠাৎ মনে হল, ওর মধ্যে ছায়া একটুও কোথাও নেই। একবার এই সন্ধের অন্ধকারে
দেখতে দাও, হয়তো ওর ভিতরের সেই চোখের জলটুকু দেখতে পাব।
মাসি। তোমার কাছে ওর ভালোবাসা ঘোমটা খুলতে এখনো লজ্জা পায়, তাই ওর যত
কান্না সবই আড়ালে।
যতীন। আচ্ছা, থাক্, থাক্, নাহয় আড়ালেই থাক্। কিন্তু সেই আড়ালের খবরটি
মাসি, তুমি আমাকে দিয়ে যেয়ো। কেননা, যখন তার আড়ালটি সরে যাবে, তখন হয়তো— আজ
কিন্তু সন্ধেবেলায় আমি তার সঙ্গে বিশেষ করে একটু কথা বলতে চাই।
মাসি। কী তোর এমন বিশেষ কথা আছে বল্ তো।
যতীন। আমার মণিসৌধ তৈরি শেষ হয়ে গেল, সেই খবরটা আপন মুখে তাকে দিতে চাই।
গৃহপ্রবেশ আমার নয়, গৃহপ্রবেশ তাকেই করতে হবে— তার জন্যেই আমার এই সৃষ্টি,
আমার এই ইঁটকাঠের বীণায় গান।
মাসি। সে বুঝি জানে না?
যতীন। তবু নিবেদন করে দিতে হবে। হিমিকে বলব, দরজার বাইরে থেকে ঐ গানটা
গাইবে—
মোর জীবনের দান,
করো গ্রহণ করার পরম মূল্যে চরম মহীয়ান।—
যাও মাসি, তুমি ডেকে দাও। মাসি, ঐ দেখো, নরহরি বুঝি আমার সঙ্গে দেখা করতে
আসছে— আমার পাটের আড়তের গোমস্তা— ওকে আজ এখানে আসতে দিয়ো না। না, না, না,
আমি কিছুই শুনতে চাই নে। ওর খবর যাই থাক্-না, সে আমি পরে বুঝব।
[ মাসির প্রস্থান
যতীন। হিমি, শোন্ শোন্।—
হিমির প্রবেশ
তোকে একটা গান শুনিয়ে দিই। এটা তোকে শিখতে হবে।
হিমি। না দাদা, তুমি গেয়ো না, ডাক্তার বারণ করে।
যতীন। আমি গুন্গুন্ করে গাব। অনেক দিন পরে আমাদের কিনু বাউলের সেই গানটা
আমার মনে পড়েছে।
গান
ওরে মন যখন জাগলি না রে
তখন মনের মানুষ এল দ্বারে।
তার চলে যাবার শব্দ শুনে
ভাঙল রে ঘুম,
ও তোর ভাঙল রে ঘুম অন্ধকারে।
তার ফিরে যাওয়ার হাওয়াখানা
বুকের মাঝে দিল হানা,
ওরে সেই হাওয়া তোর প্রাণের ভিতর
তুলবে তুফান হাহাকারে।—
তোর মাসির কাছে শুনে বুঝেছি হিমি, মণির মন জেগেছে। তুই হয়তো আমার কথা বুঝতে
পারছিস নে। আচ্ছা থাক্ সে। এ বাড়ির সবটা তুই দেখেছিস?
হিমি। চমৎকার হয়েছে।
যতীন। উপরের যে ঘরটাতে পাথর বসাতে দিয়েছিলুম— কই, প্ল্যানটা কোথায়। এই যে,
এই ঘরে— এর কড়িকাঠ ঢেকে একটা কাঠের চাঁদোয়া হয়েছে তো?
হিমি। হাঁ, হয়েছে বৈকি।
যতীন। তাতে কী রকম কাজ বল্ তো।
হিমি। চার দিকে মোটা করে নীল পাড়, মাঝখানে লাল পদ্ম আর সাদা হাঁসের জমি—
ঠিক যেমন তুমি বলে দিয়েছিলে।
যতীন। আর দেয়ালে?
হিমি। দেয়ালে বকের সার, ঝিনুক বসিয়ে আঁকা।
যতীন। আর মেঝেতে?
হিমি। মেঝেতে শঙ্খের পাড়। তার মাঝখানে মস্ত একটা পদ্মাসন।
যতীন। দরজার বাইরে দুধারে শ্বেতপাথরের দুটো কলস বসিয়েছে কি।
হিমি। হাঁ, বসিয়েছে। তার মধ্যে দুটো ইলেকট্রিক আলোর শিশি বসানো— কী সুন্দর।
যতীন। জানিস, সে ঘরটার কী নাম?
হিমি। জানি, মণিমন্দির।
যতীন। সেদিন অখিল তোর মাসির কাছে এসেছিল। কী বলছিল, কিছু শুনেছিস কি। এই
বাড়িটার কথা?
হিমি। তিনি বলছিলেন, কলকাতায় এমন সুন্দর বাড়ি আর নেই।
যতীন। না না, সে কথা না। অখিল কি এ বাড়ির— থাক্, কাজ নেই। মাসি বলছিলেন,
আজ দুপুরবেলা মৌরলামাছের যে-ঝোল হয়েছিল সেটা নাকি মণির তৈরি— ভারি সুন্দর
স্বাদ। তুই কি—
হিমি। সে আমি বলতে পারি নে।
যতীন। ছি ছি বোন, তোর বউদিদির সঙ্গে আজ পর্যন্ত তোর ভালো বনল না, এটা আমার—
হিমি। ননদ যে আমি— তাই হয়তো—
যতীন। তুই বুঝি শাস্ত্র মিলিয়ে ভাব করিস, রাগ করিস?
হিমি। হাঁ দাদা, সেই-যে হিন্দি গানে আছে— ননদিয়া রহি জাগি—
যতীন। তুই বুঝি সেটাকে একটু বদলে নিয়ে করেছিস— ননদিয়া রহি রাগি।
হিমি। হাঁ দাদা, সুরে খারাপ শুনতে হয় না (গাহিয়া) ননদিয়া রহি রাগি—
যতীন। কিন্তু বেসুর করিস নে, বোন।
হিমি। সে কি হয়। তোমার কাছেই তো সুর শেখা।
যতীন। ঐরে, আজই যতসব কাজের লোকের ভিড় দেখছি। নরেনখাঁ’র লোক দেউড়ির কাছে
ঘুরে বেড়াচ্ছে। হিমি এক কাজ কর্ তো— কোনোরকম করে আভাসে খবর নিতে পারিস?
এখনকার বাজারে— না না, থাক্গে। ঐ দরজাটা বন্ধ করে দে।
পাশের ঘরে
মাসি। এ কী, বউ। কোথাও যাচ্ছ নাকি।
মণি। সীতারামপুরে যাব।
মাসি। সে কী কথা। কার সঙ্গে যাবে।
মণি। অনাথ নিয়ে যাচ্ছে।
মাসি। লক্ষ্মী, মা আমার, যেয়ো তুমি যেয়ো— তোমাকে বারণ করব না। কিন্তু আজ
না।
মণি। টিকিট কিনে গাড়ি রিজার্ভ হয়ে গেছে। মা খরচ পাঠিয়েছেন।
মাসি। তা হোক, ও লোকসান গায়ে সইবে। নাহয় তুমি কাল ভোরের গাড়িতেই যেয়ো। আজ
রাত্তিরটা—
মণি। মাসি, আমি তোমাদের তিথি-বার মানি নে। আজ গেলে দোষ কী।
মাসি। যতীন তোমাকে ডেকেছে, তোমার সঙ্গে তার একটু বিশেষ কথা আছে।
মণি। বেশ তো, এখনো দশ মিনিট সময় আছে, আমি তাঁকে বলে আসছি।
মাসি। না, তুমি বলতে পারবে না যে যাচ্ছ।
মণি। তা বলব না,কিন্তু দেরি করতে পারব না। কালই অন্নপ্রাশন, আজ না গেলে
চলবেই না।
মাসি। জোড়হাত করছি বউ, আমার কথা একদিনের মতো রাখো। মন একটু শান্ত করে
যতীনের কাছে বোসো। তাড়াতাড়ি কোরো না।
মণি। তা কী করব বলো। গাড়ি তো বসে থাকবে না। অনাথ চলে গেছে। এখনই সে এসে
আমায় নিয়ে যাবে। এইবেলা তাঁর সঙ্গে দেখা সেরে আসিগে।
মাসি। না, তবে থাক্, তুমি যাও। এমন করে তার কাছে যেতে দেব না। ওরে
অভাগিনী, যতদিন বেঁচে থাকবি এদিনের কথা তোকে চিরকাল মনে রাখতে হবে।
মণি। মাসি, আমাকে অমন করে শাপ দিয়ো না বলছি।
মাসি। ওরে বাপ রে, আর কেন বেঁচে আছিস রে বাপ। দুঃখের যে শেষ নেই, আমি আর
ঠেকিয়ে রাখতে পারলুম না।
[ মণির প্রস্থান]
শৈলের প্রবেশ
শৈল। মাসি, তোমাদের বউয়ের ব্যাভারখানা কী রকম বলো তো। কী কাণ্ড। স্বামীর এ
অবস্থায় কোন্ বিবেচনায় বাপের বাড়ি চলল।
মাসি। ঐটুকু তো মেয়ে, মনে হয় যেন ননী দিয়ে তৈরি, কিন্তু কী পাথরে গড়া ওর
প্রাণ।
শৈল। ওকে তো অনেকদিন থেকে দেখছি, কিন্তু এতটা যে পারে তা জানতুম না। এদিকে
দেখো, কুকুর বেড়াল বাঁদর ময়ূর জন্তু-জানোয়ার কত পুষেছে তার ঠিক নেই— তাদের
কিছু হলেই অনর্থপাত করে দেয়, অথচ স্বামীর উপরে— ওকে বুঝতে পারলুম না।
মাসি। যতীন ওকে মর্মে মর্মেই বুঝেছিল। একদিন দেখেছি যতীন মাথা ধরে বিছানায়
পড়ে, মণি দল বেঁধে থিয়েটরে চলেছে। থাকতে না পেরে আমি যতীনকে পাখার বাতাস
করতে গেলুম। ও আমার হাত থেকে পাখা ছিনিয়ে নিয়ে ফেলে দিলে। ওরে বাস্ রে কী
ব্যথা। সে-সব দিনের কথা মনে করলে আমার বুক ফেটে যায়।
শৈল। তাও বলি মাসি, অমনি পাথরের মতো মেয়ে না হলেও পুরুষদের উড়ো মন চাপা
দিয়ে রাখতে পারে না। যতই নরম হবে, ততই ওরা ফসকে যাবে।
মাসি। কী জানি শৈল, ঐটেই হয়তো মানুষের ধর্ম। বাঁধনের মধ্যে কিছু একটু শক্ত
জিনিস না থাকলে সেটা বাঁধনই হয় না, তা কী পুরুষের কী মেয়ের। ভালোবাসার
মালায় ফুল থাকে পারিজাতের, কিন্তু তার সুতোটি থাকে বজ্রের।
শৈল। এখনো যদি গাড়িতে না উঠে থাকে তা হলে ওকে একটু বুঝিয়ে দেখিগে।
[ প্রস্থান]
প্রতিবেশিনীর প্রবেশ
প্রতিবেশিনী। ঠানদি? ওমা এ কী কাণ্ড। তোমার বউ নাকি বাপের বাড়ি চলল।
মাসি। তা কী হয়েছে। তা নিয়ে তোমাদের অত ভাবনা কেন।
প্রতিবেশিনী। তা তো বটেই, আমাদের কী বলো। যতীনবাবুকে পাড়ার লোক সবাই
ভালোবাসে সেইজন্যেই—
মাসি। হাঁ, সেইজন্যেই যতীন যাকে ভালোবাসে তোমরা সক্কলে মিলে তার—
প্রতিবেশিনী। তা বেশ ঠানদিদি, মণি খুবই ভালো কাজ করেছে। অত ভালো খুব কম
মেয়েতেই করতে পারে।
মাসি। স্বামীর ইচ্ছা মেনে যে-স্ত্রী চলে তাকেই তো তোমরা ভালো বল! মণি
আমাদের সেই স্ত্রী।
প্রতিবেশিনী। হাঁ, সে তো দেখতে পাচ্ছি।
মাসি। মণি ছেলেমানুষ, রুগীর কাছে বদ্ধ হয়ে আছে, তাই দেখে যতীন কিছুতে
সুস্থির হতে পারছিল না। শেষকালে ডাক্তারবাবুর মত নিয়ে তবে তো ও— তা
থাক্গে। তোমরা যত পার পাড়ায় পাড়ায় নিন্দে করে বেড়াওগে। যতীনের কানের কাছে
আর চেঁচামেচি কোরো না।
প্রতিবেশিনী। বাস্ রে। মণি যে কোন্ দুঃখে ঘন ঘন বাপের বাড়ি যায় সে বোঝা
যাচ্ছে।
[ প্রস্থান]
ডাক্তারের প্রবেশ
ডাক্তার। ব্যাপারখানা কী। দরজার কাছে এসে দেখি, বাক্স তোরঙ্গ গাড়ির মাথায়
চাপিয়ে বউমা তার ভাইয়ের সঙ্গে কোথায় চলল। আমাকে দেখে একটুও সবুর করলে না।
রোগীর অবস্থার কথা কিছু জিজ্ঞাসা করা, তাও না। ওর সঙ্গে ঝগড়া করেছেন
বুঝি?—
[মাসি নিরুত্তর]
দেখুন, রোগীর এই অবস্থায় অন্তত এই কিছুদিনের জন্যে বউয়ের সঙ্গে আপনার
শাশুড়িগিরি না-হয় বন্ধই রাখতেন।
মাসি। পারি কই, ডাক্তার। স্বভাব মলেও যায় না। একসঙ্গে ঘরে থাকতে গেলেই দুটো
বকাবকি হয় বৈকি।
ডাক্তার। তা বউ-যে গাড়ি ডাকিয়ে এনে চলে গেল, আপনি একটু নিবারণ করলেই তো
হত।—
[মাসি নিরুত্তর
]
কী জানি, বোধ করি গেল বলেই আপনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু আমি আপনাকে
স্পষ্টই বলছি, এমনি করে বউকে নির্বাসনে দিয়ে আপনি প্রতি মুহূর্তে যে যতীনের
আশাভঙ্গ করছেন, তাতে তার কেবলই প্রাণহানি হচ্ছে। রুগীর প্রতি আমাদের
কর্তব্য সব আগে, সেইজন্যেই আমাকে এমন পষ্ট কথা বলতে হল, নইলে আপনাদের
শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়ার মধ্যে কথা কবার অধিকার আমার নেই।
মাসি। যদি দোষ করে থাকি, তা নিয়ে তর্ক করে তো কোনো ফল নেই। আমি-যে নিজেকে
খাটো করে বউকে ফিরে আসতে চিঠি লিখব, সে প্রাণ ধরে পারব না, তা তুমি আমাকে
গালই দাও আর যাই কর। এখন তুমি এক কাজ করতে পার ডাক্তার?
ডাক্তার। কী, বলুন।
মাসি। সীতারামপুরে বউয়ের বাবাকে একখানা চিঠি লিখে দাও। তাতে লিখো যতীনের কী
অবস্থা। বউমার বাবাকে আমি যতদূর জানি তাতে আমার নিশ্চয় বিশ্বাস, তিনি সে
চিঠি পেলেই বউমাকে নিয়ে এখানে আসবেন।
ডাক্তার। আচ্ছা, লিখে দিচ্ছি। কিন্তু বউমা-যে বাপের বাড়ি চলে গেছেন, এ খবর
যেন কোনোমতেই যতীন জানতে না পায়। আমি আপনাকে বলেই রাখছি। এ খবরের উপরে আমার
কোনো ওষুধই খাটবে না। হিমি, মা, তুমি যে ঐখানে বসে আছ, এক কাজ করো; ও
যে-গানটা ভালোবাসে সেইটে ওর দরজার কাছে বসে গাও। ও যেন বউমার খবর জিজ্ঞাসা
করবার সময় একটুও না পায়। শুনছ, মা? এখন কান্নার সময় নয়। কান্না পরে হবে।
এখন গান। তোমাকে বলেছি কি? একটা বই লিখছি, তাতে দেখিয়ে দেব, গানের
ভাইব্রেশন আর রোগের বীজের চাল একেবারে উলটো। নোবেল প্রাইজের জোগাড় করছি
আর-কি, বুঝেছ?
[ প্রস্থান]
হিমির গান
ওই মরণের সাগরপারে চুপে চুপে
এলে তুমি ভুবনমোহন স্বপনরূপে ।
কান্না আমার সারা প্রহর তোমায় ডেকে
ঘুরেছিল চারি দিকের বাধায় ঠেকে,
বন্ধ ছিলেম এই জীবনের অন্ধকূপে ;
আজ এসেছ ভুবনমোহন স্বপনরূপে ।
আজ কী দেখি কালোচুলের আঁধার ঢালা,
স্তরে স্তরে সন্ধ্যাতারার মানিক জ্বালা ।
আকাশ আজি গানের ব্যথায় ভরে আছে,
ঝিল্লিরবে কাঁপে তোমার পায়ের কাছে ।
বন্দনা তোর পুষ্পবনের গন্ধধূপে ;
আজ এসেছ ভুবনমোহন স্বপনরূপে ।
হিমি। (নেপথ্যে চাহিয়া) যাচ্ছি দাদা, ভিতরেই যাচ্ছি।
[ প্রস্থান]
অখিলের প্রবেশ
অখিল। কেন ডেকেছ, কাকি।
মাসি। তোকে ডেকে পাঠাবার জন্যে কাল থেকে যতীন আমাকে বারবার অনুরোধ করছে। আর
ঠেকিয়ে রাখা গেল না।
অখিল। ওর সেই বাড়িবন্ধকের ব্যাপার নিয়ে?
মাসি। সে কথাটা ওর মনের মধ্যে খুবই আছে, কিন্তু সেটা ও জিজ্ঞাসা করতে চায়
না। যতবারই ও-ভাবনাটা ধাক্কা দিচ্ছে ততবারই তাকে সরিয়ে সরিয়ে রাখছে। সে কথা
তুমি ওর কাছে কোনোমতেই পেড়ো না— ও-ও পাড়বে না।
অখিল। তবে আমাকে কিসের দরকার পড়ল।
মাসি। উইল করবার জন্যে।
অখিল। উইল? অবাক করলে।
মাসি। জানি, কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু মাথার দিব্যি দিচ্ছি, এই কথাটি
তোমাকে রাখতেই হবে। ও যাকে যা-কিছু দিতে বলে, সম্ভব হোক অসম্ভব হোক, সমস্তই
তোমার ঠিক ঠিক লিখে নেওয়া চাই। হেসো না, প্রতিবাদ কোরো না। তার পরে সে
উইলের যা দশা হবে তা জানি।
অখিল। জানি বৈকি। জর্জ ফিফ্থের সমস্ত সাম্রাজ্যই
আমি যতীনকে দিয়ে উইল করিয়ে নিজের নামে লিখিয়ে নিতে পারি। আমার বিশ্বাস সম্রাটবাহাদুর
আন্ডিউ ইনফ্লুয়েন্সের অভিযোগ তুলে আদালতে নালিশ রুজু করবেন না। কিন্তু দেখো
কাকি, এইবার তোমার সঙ্গে এই বাড়ির কথাটা বলে নিই। আমার মক্কেল—
মাসি। অখিল, এখন দুটো সত্যি কথা কওয়াই যাক। ঘরে-বাইরে কেবলই মিথ্যে বলে বলে
দম বন্ধ হয়ে এল। এখন শোনো, তোমার মক্কেল তুমি নিজেই— এ কথা গোড়া থেকেই
জানি।
অখিল। সে কী কথা, কাকি!
মাসি। থাক্, ভোলাবার কোনো দরকার নেই। ভালোই করেছ। জানি, আমার সম্পত্তিতে
তোমাদেরই অধিকার ব’লে তোমরা বরাবরই তার ’পরে দৃষ্টিপাত করেছ—
অখিল। ছি ছি, এমন কথা—
মাসি। তাতে দোষ কী ছিল বলো। তোমরা আমার ছেলেরই মতো তো বটে। তোমাদেরই সব
দিতুম। কিন্তু আমরা দুই বোন ছিলুম। বাবা দিদির উপরে রাগ করে একলা আমাকেই
তাঁর সম্পত্তি দিয়ে গেলেন। সে রাগ পড়ে যাবার আগেই তাঁর মৃত্যু হল। স্বর্গে
আছেন তিনি, আজ তাঁর সেই রাগ নেই। সেইজন্যেই বাবার সম্পত্তি তাঁরই দৌহিত্রের
ভোগে ঢেলে দিয়েছি। লক্ষ্মীর কৃপায় তোমাদের তো কোনো অভাব নেই।
অখিল। তা নিয়ে তোমাকে কি কোনো কথা বলেছি কোনোদিন।
মাসি। বুদ্ধি থাকলে কথা বলবার তো দরকার হয় না। বাড়ি তৈরির নেশায় যতীনকে
ধরলে। সে নেশার ভিতরে যে কত অসহ্য দুঃখ তা তোরা পাকাবুদ্ধি আইনওয়ালারা
বুঝবি নে। আমি মেয়েমানুষ, ওর মাসি, আমার বুক ফাটতে লাগল। ধার পাব
কোথায়। তোরই কাছে যেতে হল। তুই এক ফাঁকা মক্কেল খাড়া করে—
হিমির প্রবেশ
হিমি। মাসি, বামুনঠাকরুন এসেছেন।
মাসি। লক্ষ্মী মেয়ে, তুই তাঁকে একটু বসতে বল্, আমি এখনই আসছি।
[ হিমির প্রস্থান]
অখিল। কাকি, তোমার এই বোনঝির কত বয়স হবে।
মাসি। সতেরো সবে পেরিয়েছে। এই বছরেই আই. এ. দেবে।
অখিল। গলাটি ভারি মিষ্টি, বাইরে থেকে ওঁর গান শুনেছি।
মাসি। ওরা দুই ভাইবোনে একই জাতের। দাদা বাড়ি করছেন, ইনি গান করছেন, দুটোতেই
একই সুরের খেলা।
অখিল। বিয়ের সম্বন্ধ—
মাসি। না, ওর দাদার অসুখ হয়ে অবধি সে কথা কাউকে মুখে আনতে দেয় না— পড়াশুনো
সব ছেড়ে এইখানেই পড়ে আছে।
অখিল। কিন্তু ভালো পাত্র খুঁজে দিতে পারি কাকি, যদি কখনো—
মাসি। যেমন তুই মক্কেল খুঁজে দিয়েছিলি সেইরকমই, না?
অখিল। না কাকি, ঠাট্টা না— আমি ভাবছি, ওঁকে যদি একটা হার্মোনিয়ম পাঠিয়ে
দিই, তাতে কি তোমাদের—
মাসি। কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু ও তো হার্মোনিয়ম ভালোবাসে না।
অখিল। গানের সঙ্গে?
মাসি। গানের সঙ্গে এসরাজ বাজায়।
অখিল। আচ্ছা, তা হলে এসরাজই না-হয়—
মাসি। ওর তো আছে এসরাজ।
অখিল। নাহয় আরো একটা হল। সম্পত্তি বাড়িয়ে তোলাকেই তো বলে শ্রীবৃদ্ধি।
মাসি। আচ্ছা, দিস এসরাজ। এখন আমার কথাটা শোন্। এতকাল তোর সেই মক্কেলকে সুদ
দিয়ে এসেছি আমারই পৈতৃক গয়না বেচে। মাঝে মাঝে মক্কেল যখনই তিন দিনের মধ্যে
শোধ নেবার কড়া দাবি করে চিঠি দিয়েছে, তখনই সুদ চড়িয়ে চড়িয়ে আজ আমার আর কিছু
নেই। কাজেই কাকির সম্পত্তি দেওরপোর সিন্ধুকেই গেছে। প্রেতলোকে আমার
শ্বশুরের তৃপ্তি হয়েছে— কিন্তু আমার বাবা, যতীনের মা— পরলোকে তাঁদের যদি
চোখের জল পড়ে—
হিমির প্রবেশ
হিমি। দাদা তোমাকে বারবার ডাকছেন, মাসি। ছটফট করছেন আর কেবলই বউদিদির কথা
জিজ্ঞাসা করছেন। তার জবাব কিছুতে আমার মুখ দিয়ে বেরোয় না, আমার গলা আটকে
যায়।
[ দুই হাতে মুখ চাপিয়া কান্না]
মাসি। কাঁদিস্ নে মা, কাঁদিস নে। আমি যতীনের কাছে যাচ্ছি।
অখিল। কাকি, আমি যদি কিছু করতে পারি, বলো, আমি না-হয় যতীনের কাছে গিয়ে—
মাসি। হাঁ, যতীনের কাছে যেতে হবে। তার সেই উইলটা।
[ প্রস্থান]
রোগীর ঘরে
যতীন। মণি এল না? এত দেরি করলে যে?
মাসি। সে এক কাণ্ড। গিয়ে দেখি তোমার দুধ জ্বাল দিতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে বলে
কান্না। বড়োমানুষের ঘরের মেয়ে— দুধ খেতেই জানে, জ্বাল দিতে শেখে নি। তোমার
কাজ করতে প্রাণ চায় বলেই করা। অনেক করে ঠাণ্ডা করে তাকে বিছানায় শুইয়ে রেখে
এসেছি। একটু ঘুমোক।
যতীন। মাসি!
মাসি। কী বাবা।
যতীন। বুঝতে পারছি, দিন শেষ হয়ে এল। কিন্তু কোনো খেদ নেই। আমার জন্যে শোক
কোরো না।
মাসি। না বাবা, শোক করবার পালা আমার ফুরিয়েছে। ভগবান আমাকে এটুকু বুঝিয়ে
দিয়েছেন যে বেঁচে থাকাই যে ভালো আর মরাই যে মন্দ, তা নয়।
যতীন। মৃত্যুকে আমার মধুর মনে হচ্ছে। আজ আমি ওপারের ঘাটের থেকে সানাই শুনতে
পাচ্ছি। হিমি, হিমি কোথায়।
মাসি। ঐ-যে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে।
হিমি। কেন দাদা, কী চাই।
যতীন। লক্ষ্মী বোন আমার, তুই অমন আড়ালে আড়ালে কাঁদিস্ নে— তোর চোখের জলের
শব্দ আমি যেন বুকের মধ্যে শুনতে পাই। দেখি তোর হাতটা। আমি খুব ভালো আছি। ঐ
গানটা গা তো ভাই— যদি হল যাবার ক্ষণ—
হিমির গান
যদি হল যাবার ক্ষণ
তবে যাও দিয়ে যাও শেষের পরশন।
বারে বারে যেথায় আপন গানে
স্বপন ভাসাই দূরের পানে,
মাঝে মাঝে দেখে যেয়ো শূন্য বাতায়ন—
সে মোর শূন্য বাতায়ন।
বনের প্রান্তে ওই মালতীর লতা
করুণ গন্ধে কয় কী গোপন কথা।
ওরি ডালে আর-শ্রাবণের পাখি
স্মরণখানি আনবে না কি—
আজ-শ্রাবণের সজল ছায়ায় বিরহ মিলন—
আমাদের বিরহ মিলন।
মাসি। হিমি, বোতলে গরম জল ভরে আন্। পায়ে দিতে হবে।
[ হিমির প্রস্থান]
যতীন। কষ্ট হচ্ছে মাসি, কিন্তু যত কষ্ট মনে করছ তার কিছুই নয়। আমার সঙ্গে
আমার কষ্টের ক্রমেই যেন বিচ্ছেদ হয়ে আসছে। বোঝাই নৌকোর মতো জীবন-জাহাজের
সঙ্গে সে ছিল বাঁধা— আজ বাঁধন কাটা পড়েছে, তাকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আমার
সঙ্গে সে আর লেগে নেই।— এ তিন দিন মণিকে দিনে রাতে একবারও দেখি নি।
মাসি। বাবা, একটু বেদানার রস খাও, তোমার গলা শুকিয়ে আসছে।
যতীন। আমার উইলটা কাল লেখা হয়ে গেছে— সে কি আমি তোমাকে দেখিয়েছি। ঠিক মনে
পড়ছে না।
মাসি। আমার দেখবার দরকার নেই, যতীন।
যতীন। মা যখন মারা যান, আমার তো কিছুই ছিল না। তোমার খেয়ে তোমার হাতেই
মানুষ। তাই বলছিলুম—
মাসি। সে আবার কী কথা। আমার তো কেবল এই একখানা বাড়ি আর সামান্য কিছু
সম্পত্তি ছিল। বাকি সবই তো তোমার নিজের রোজগার।
যতীন। কিন্তু এই বাড়িটা—
মাসি। কিসের বাড়ি আমার। কত দালান তুমি বাড়িয়েছ, আমার যেটুকু সে তো আর
খুঁজেই পাওয়া যায় না।
যতীন। মণি তোমাকে ভিতরে ভিতরে খুব—
মাসি। সে কি জানি নে, যতীন তুই এখন ঘুমো।
যতীন। আমি মণিকে সব লিখে দিলুম বটে, কিন্তু তোমারই রইল। ও তো কখনো তোমাকে
অমান্য করবে না।
মাসি। সেজন্যে অত ভাবছ কেন, বাছা।
যতীন। তোমার আশীর্বাদই আমার সব। তুমি আমার উইল দেখে এমন কথা কোনোদিন মনে
কোরো না—
মাসি। ও কী কথা, যতীন। তোমার জিনিস তুমি মণিকে দিয়েছ বলে আমি মনে করব— এমন
পোড়া মন?
যতীন। কিন্তু তোমাকেও আমি—
মাসি। দেখ্ যতীন, এইবার রাগ করব। তুই চলে যাবি, আর টাকা দিয়ে আমাকে ভুলিয়ে
রেখে যাবি?
যতীন। মাসি, টাকার চেয়ে যদি আরো বড়ো কিছু তোমাকে—
মাসি। দিয়েছিস, যতীন, ঢের দিয়েছিস। আমার শূন্য ঘর ভরে ছিলি, এ আমার অনেক
জন্মের ভাগ্যি। এতদিন তো বুক ভরে পেয়েছি, আজ আমার পাওনা যদি ফুরিয়ে থাকে তো
নালিশ করব না। দাও— লিখে দাও বাড়িঘর, জিনিসপত্র— ঘোড়াগাড়ি, তালুকমুলুক— যা
আছে মণির নামে সব লিখে দাও— এ-সব বোঝা আমার সইবে না।
যতীন। তোমার ভোগে রুচি নেই, কিন্তু মণির বয়স অল্প, তাই—
মাসি। ও কথা বলিসনে— ধনসম্পদ দিতে চাস দে, কিন্তু ভোগ করা—
যতীন। কেন ভোগ করবে না, মাসি।
মাসি। না গো না, পারবে না, পারবে না, আমি বলছি, ওর মুখে রুচবে না; গলা
শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে—কিছুতে কোনো রস পাবে না।
যতীন। (চুপ করিয়া থাকিয়া, নিশ্বাস ফেলিয়া) দেবার মতো জিনিস তো কিছুই—
মাসি। কম কী দিয়ে যাচ্ছ। ঘরবাড়ি টাকাকড়ির ছল ক’রে যা দিয়ে গেলে তার মূল্য ও
কি কোনোদিনই বুঝবে না?
যতীন। মণি কাল কি এসেছিল। আমার পড়ে পড়ছে না।
মাসি। এসেছিল। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে। শিয়রের কাছে অনেকক্ষণ ব’সে
ব’সে—
যতীন। আশ্চর্য! আমি ঠিক সেই সময়ে স্বপ্ন দেখছিলুম, যেন মণি আমার ঘরে আসতে
চাচ্ছে— দরজা অল্প একটু ফাঁক হয়েছে— ঠেলাঠেলি করছে কিন্তু কিছুতেই সেইটুকুর
বেশি আর খুলছে না। কিন্তু মাসি, তোমরা একটু বাড়াবাড়ি করছ। ওকে দেখতে দাও যে
সন্ধেবেলাকার আলোর মতো কেমন অতি সহজে আমার ধীরে ধীরে—
মাসি। বাবা, তোমার পায়ের উপর এই পশমের শালটা টেনে দিই— পায়ের তেলো ঠাণ্ডা
হয়ে গেছে।
যতীন। না মাসি, গায়ে কিছু দিতে ভালো লাগছে না।
মাসি। জানিস যতীন, এ শালটা মণির তৈরি— এতদিন রাত জেগে জেগে তোমার জন্যে
তৈরি করছিল। কাল শেষ হয়েছে।
[যতীন শালটা লইয়া দুই হাত দিয়া একটু নাড়াচাড়া করিল। মাসি তার পায়ের উপর
টানিয়া দিলেন।]
যতীন। আমার মনে হচ্ছে যেন ওটা হিমি সেলাই করছিল। মণি তো সেলাই ভালোবাসে না—
ও কি পারে।
মাসি। ভালোবাসার জোরে মেয়েমানুষ শেখে। হিমি ওকে দেখিয়ে দিয়েছে বৈকি। ওর
মধ্যে ভুল সেলাই অনেক আছে—
যতীন। হিমি, তুই পাখা রাখ্, ভাই। আয় আমার কাছে বোস্। আজই পাঁজি দেখে তোকে
বলে দেব কবে গৃহপ্রবেশের লগ্ন আসবে।
হিমি। থাক্ দাদা, ও-সব কথা—
যতীন। আমি উপস্থিত থাকতে পারব না— সেই মনে করে বুঝি— আমি থাকব বোন, সেদিন এ
বাড়ির হাওয়ায় হাওয়ায় আমি থাকব— তোরা বুঝতে পারবি। যে গানটা গাবি সে আমি ঠিক
করে রেখেছি— সেই, অগ্নিশিখা— একবার শুনিয়ে দে—
হিমির গান
অগ্নিশিখা, এসো, এসো,
আনো আনো আলো ।
দুঃখে সুখে শূন্য ঘরে
পুণ্যদীপ জ্বালো ।
আনো শক্তি, আনো দীপ্তি,
আনো শান্তি, আনো তৃপ্তি,
আনো স্নিগ্ধ ভালোবাসা,
আনো নিত্য ভালো ।
এসো শুভ লগ্ন বেয়ে
এসো হে কল্যাণী ।
আনো শুভ সুপ্তি, আনো
জাগরণখানি ।
দুঃখরাতে মাতৃবেশে
জেগে থাকো নির্নিমেষে,
উৎসব -আকাশে তব
শুভ্র হাসি ঢালো ।
যতীন। গানে কোন্ উৎসবের কথাটা আছে জানিস, হিমি?
হিমি। জানি নে।
যতীন। আহা, আন্দাজ কর্-না।
হিমি। আমি আন্দাজ করতে পারি নে।
যতীন। আমি পারি। যেদিন তোর বিয়ে হবে সেদিন উৎসবের ভোরবেলা থেকে—
হিমি। থাক্ দাদা, থাক্।
যতীন। আমি যেন তার বাঁশি শুনতে পাচ্ছি, ভৈরবীতে বাজছে। আমি লিখে দিয়েছি তোর
বিয়ের খরচের জন্যে—
হিমি। দাদা, তবে আমি যাই।
যতীন। না, না, বোস্। কিন্তু গৃহপ্রবেশের দিন আমার হয়েই তোকে সব সাজাতে
হবে— মনে রাখিস, সাদা পদ্ম যত পাওয়া যায়— ঘরে যে-আসন তৈরি হবে তার উপরে
আমার বিয়ের সেই লাল বেনারসী চাদরটা—
শম্ভুর প্রবেশ
শম্ভু। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করছেন, তাঁকে কি আজ রাত্রে থাকতে হবে।
মাসি। হাঁ, থাকতে হবে।
[ শম্ভুর প্রস্থান]
যতীন। কিন্তু আজ ঘুমের ওষুধ না। তাতে আমার ঘুমও যায় ঘুলিয়ে, জাগাও যায়
ঘুলিয়ে। বৈশাখদ্বাদশীর রাত্রে আমাদের বিয়ে হয়েছিল, মাসি। কাল সেই তিথি।
মণিকে সেই কথাটি মনে করিয়ে দিতে চাই। দুমিনিটের জন্যে ডেকে দাও। চুপ করে
রইলে যে। আমার মন তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে বলেই এই দুরাত আমার ঘুম হয় নি। আর
দেরি নয়, এর পরে আর সময় পাব না। না মাসি, তোমার ঐ কান্না আমি সইতে পারি নে।
এতদিন তো বেশ শান্ত ছিলে। আজ কেন—
মাসি। ওরে যতীন, ভেবেছিলুম আমার সব কান্না ফুরিয়ে গেছে— আজ আর পারছি নে।
যতীন। হিমি তাড়াতাড়ি চলে গেল কেন।
মাসি। বিশ্রাম করতে গেল। একটু পরেই আবার আসবে।
যতীন। মণিকে ডেকে দাও।
মাসি। যাচ্ছি বাবা, শম্ভু দরজার কাছে রইল। যদি কিছু দরকার হয় ওকে ডেকো।
[ প্রস্থান]
পাশের ঘরে অখিলের প্রবেশ
[তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া হিমি উঠিয়া দাঁড়াইল]
হিমি। মাসিকে ডেকে দিই।
অখিল। দরকার নেই। তেমন জরুরি কিছু নয়।
হিমি। দাদার ঘরে কি যাবেন।
অখিল। না, এইখান থেকেই খবর নিয়ে যাব। যতীন কেমন আছে।
হিমি। ডাক্তার বলেন, আজ অবস্থা ভালো নয়।
অখিল। কদিন থেকে তোমরা দিনরাত্রিই খাটছ। আমি এলুম তোমাদের একটু জিরোতে
দেবার জন্যে। বোধ হয় রোগীর সেবা
আমিও কিছু কিছু—
হিমি। না, সে হতেই পারে না। আমি কিচ্ছু শ্রান্ত হইনি।
অখিল। আচ্ছা, নাহয় আমি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে কাজ করি।
হিমি। এ-সব কাজ—
অখিল। জানি, ওকালতির চেয়ে অনেক বেশি শক্ত।
হিমি। না, আমি তা বলছিনে।
অখিল। না, সত্যি কথা। আমাকে যদি বার্লি তৈরি করতে হয়, আমি হয়তো ঘরে আগুন
লাগিয়ে দেব।
হিমি। কী বলছেন আপনি।
অখিল। একটুও বাড়িয়ে বলছি নে। ঘরে আগুন লাগানো আমাদের অভ্যেস। বুঝতে পারছ
না?— দেখো-না কেন, তুমি তো যতীনের জন্যে বার্লি তৈরি করছ, আমি হয়তো এমন
কিছু তৈরি করে বসে আছি যেটা রোগীর পথ্য নয়, অরোগীর পক্ষেও গুরুপাক। তুমি
বোসো, দুটো কথা তোমার সঙ্গে কয়ে নিই।
হিমি। এখন কিন্তু গল্প করবার মতো—
অখিল। রামো! গল্প করতে পারলে আমাদের ব্যাবসা ছেড়ে দিতুম, দ্বিতীয় বঙ্কিম
চাটুজ্জে হয়ে উঠতুম। হাসছ কী। আমাদের অনেক কথাই বানাতে হয়, একটুও ভালো লাগে
না— গল্প বানাতে পারলে এ ব্যাবসা ছেড়ে দিতুম। তুমি বোধ হয় গল্প লেখা শুরু
করেছ?
হিমি। না।
অখিল। নাটক তৈরি—
হিমি। না, আমার ও-সব আসে না।
অখিল। কী করে জানলে।
হিমি। ভাষায় কুলোয় না।
অখিল। নাটক তৈরি করতে ভাষার দরকার হয় না। খাতাপত্র কিছুই চাই নে। হয়তো এখনই
তোমার নাটক শুরু হয়েছে-বা, কে বলতে পারে।
হিমি। আমি যাই, মাসিকে ডেকে দিই।
অখিল। না, দরকার হবে না। আমি বাজে কথা বন্ধ করলুম, কাজের কথাই পাড়ব।
ভেবেছিলুম যতীনকেই বলব। কিন্তু তার শরীর যে-রকম এখন—
হিমি। তাঁর ব্যাবসার কোনো গুজব আমার কানে উঠেছে কি না এ কথা প্রায় আমাকে
জিজ্ঞাসা করেন, আপনি হয়তো—
অখিল। আমি জানি, ব্যাবসা গেছে তলিয়ে—
হিমি। পায়ে পড়ি, তাঁকে এ খবর দেবেন না। আর যাই হোক, তাঁর এই বাড়িটা তো—
অখিল। যতীন বাড়ির কথা বলে নাকি।
হিমি। কেবল ঐ কথাই বলছেন। একদিন ধুম করে গৃহপ্রবেশ হবে, তারই প্ল্যান—
অখিল। গৃহপ্রবেশের আয়োজন তো হয়েছে—
হিমি। আপনি কী করে জানলেন।
অখিল। আমার আপিস থেকেই হয়েছে— পেয়াদারা বেশভূষা করে প্রায় তৈরি—
হিমি। দেখুন অখিলবাবু, এ হাসির কথা নয়—
অখিল। সে কি আর আমি জানি নে। তোমার কাছে লুকিয়ে কী হবে। এ বাড়িটা দেনায়—
হিমি। না না না— সে হতেই পারবে না— অখিলবাবু, দয়া করবেন—
অখিল। কিন্তু এত ভাবছ কেন? তুমি তো সব জানই। তোমাদের দাদা তো আর বেশিদিন—
হিমি। জানি জানি, দাদা আর থাকবেন না, সেও সহ্য হবে, কিন্তু তাঁর এই বাড়িটিও
যদি যায় তা হলে বুক ফেটে মরে যাব। এ যে তাঁর প্রাণের চেয়ে—
অখিল। দেখো, তুমি সাহিত্যে গণিতে লজিকে ক্লাসে পুরো মার্কা পেয়ে থাক,
কিন্তু সংসারজ্ঞানে থার্ড্ ক্লাসেও পাস করতে পারবে না। বিষয়কর্মে হৃদয় বলে
কোনো পদার্থ নেই, ওর নিয়ম—
হিমি। আমি জানি নে। আপনার পায়ে পড়ি, এ বাড়ি আপনাকে বাঁচাতে হবে। আপনার
আপিসের—
অখিল। পেয়াদাগুলোকে সাজাতে হবে বাজনদার করে, হাতে দিতে হবে বাঁশি। ল কলেজে
লয়তত্ত্বের সব অধ্যায় শিখেছি, কেবল তানলয়ের পালাটা প্র্যাক্টিস হয় নি। এটা
হয়তো বা তোমার কাছ থেকেই—
মাসির প্রবেশ
মাসি। অখিল, কী হচ্ছে। হিমি কাঁদছে কেন।
অখিল। গৃহপ্রবেশের প্ল্যানে একটু খটকা বেধেছে তাই নিয়ে—
মাসি। তা ওর সঙ্গে এ-সব কথা কেন।
অখিল। ওর দাদা যে ওরই উপরে গৃহপ্রবেশের ভার দিয়েছে, শুনছি কাজটাতে কোনো
বাধা না হয়, এইজন্যে এত লোককে ছেড়ে আমাকেই ধরেছে। তা তোমরা যদি সকলেই মনে
কর, তা হলে চাই-কি গৃহপ্রবেশের কাজে আমিও কোমর বেঁধে লাগতে পারি। কথাটা
বুঝেছ, কাকি?
মাসি। বুঝেছি। শুধু কোমর বাঁধা নয়, বাঁধন আরও পাকা করতে চাও। এখন সে
পরামর্শ করবার সময় নয়। আপাতত যতীনকে তুমি আশ্বাস দিয়ো যে তার বাড়িতে কারো
হাত পড়বে না।
অখিল। বেশ তো, বললেই হবে পাটের বাজার চড়েছে। এখন এঁকে চোখের জলটা মুছতে
বলবেন—
ডাক্তারের প্রবেশ
ডাক্তার। উকিল যে! তবেই হয়েছে।
অখিল। দেখুন, শনি বড়ো না কলি বড়ো, তা নিয়ে তর্ক করে লাভ কী। বাংলাদেশে
আপনাদের হাত পার হয়েও যে-কটি লোক টিঁকে থাকে, তাদেরই সামান্য শাঁসটুকু
নিয়েই আমাদের কারবার—
ডাক্তার। এ ঘরে সে কারবার চালাবার আর বড়ো সময় নেই, দেখে এসেছি।
অখিল। ভয় দেখাবেন না মশায়, মৃত্যুতেই আপনাদের ব্যাবসা খতম, আমাদেরটা ভালো
করে জমে তার পর থেকে। না না, থাক্ থাক্, ও-সব কথা থাক্— কাকি, এই বলে
যাচ্ছি, গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানের সমস্ত ভার নিতে রাজি আছি— তার সঙ্গে সঙ্গে
উপরি আরো-কিছু ভারও। বাইরের ঘরে থাকব, যখন দরকার হয় ডেকে পাঠিয়ো।
[ প্রস্থান]
ডাক্তার। এখনো বউমা এল না। আপনিও তো অনেকক্ষণ ওর ঘরে যান নি।
মাসি। মণির কথা জিজ্ঞাসা করলে কী জবাব দেব ভেবে পাচ্ছি নে। আর তো আমি কথা
বানিয়ে উঠতে পারি নে— নিজের উপর ধিক্কার জন্মে গেল। ও একটু ঘুমিয়ে পড়লে তার
পরে ঘরে যাব।
ডাক্তার। আমি বাইরে অপেক্ষা করব। রুগী কেমন থাকে ঘণ্টাখানেক পরে খবর দেবেন।
ইতিমধ্যে উকিলকে ঠেকিয়ে রাখতে হবে, ওদের মুখ দেখলে সহজ অবস্থাতেই নাড়ী ছাড়ব
ছাড়ব করে।
[প্রস্থান ]
দ্বিতীয় অঙ্ক
রোগীর ঘরে দ্বারের কাছে শম্ভু
প্রতিবেশিনীর প্রবেশ
প্রতিবেশিনী। এই যে, শম্ভু।
শম্ভু। হ্যাঁ, দিদি।
প্রতিবেশিনী। একবার যতীনকে দেখে যেতে চাই। মাসি নেই, এইবেলা—
শম্ভু। কী হবে গিয়ে, দিদি।
প্রতিবেশিনী। নাটোরের মহারাজার ওখানে একটা কাজ খালি হয়েছে। আমার ছেলের
জন্যে যতীনের কাছ থেকে একখানা চিঠি লিখিয়ে—
শম্ভু। দিদি, সে কোনোমতেই হবে না। মাসি জানতে পারলে রক্ষে থাকবে না।
প্রতিবেশিনী। জানবে কী করে। আমি ফস্ করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে—
শম্ভু। মাপ করো দিদি, সে কোনোমতেই হবে না।
প্রতিবেশিনী। হবে-না! তোমার মাসি মনে করেন, আমাদের ছোঁয়াচ লাগলে তাঁর বোনপো
বাঁচবে না। এদিকে নিজের কথাটা ভেবে দেখেন না। স্বামীটিকে খেয়েছেন,
একটিমাত্র মেয়ে সেও গেছে, বাপমা কাউকেই রাখলে না। এইবার বাকি আছে ঐ যতীন।
ওকে শেষ করে তবে উনি নড়বেন। নইলে ওঁর আর মরণ নেই। আমি বলে রাখলুম শম্ভু,
দেখে নিস্— মাসিতে যখন ওকে পেয়েছে, যতীনের আশা নেই।
শম্ভু। ঐ আমাকে ডাকছেন। তুমি এখন যাও।
প্রতিবেশিনী। ভয় নেই, আমি চললুম।
[ প্রস্থান
]
ঘরে শম্ভুর প্রবেশ
যতীন। (পায়ের শব্দে চমকাইয়া) মণি!
শম্ভু। কর্তাবাবু, আমি শম্ভু। আমাকে ডাকছিলেন?
যতীন। একবার তোর বউঠাকরুনকে ডেকে দে।
শম্ভু। কাকে।
যতীন। বউঠাকরুনকে।
শম্ভু। তিনি তো এখনো ফেরেন নি।
যতীন। কোথায় গেছেন।
শম্ভু। সীতারামপুরে।
যতীন। আজ গেছেন?
শম্ভু। না, আজ তিন দিন হল।
যতীন। তুই কে? আমি কি চোখে ঠিক দেখছি।
শম্ভু। আমি শম্ভু।
যতীন। ঠিক করে বল্ তো, আমার তো কিছু ভুল হচ্ছে না?
শম্ভু। না, বাবু।
যতীন। কোন্ ঘরে আছি আমি? এই কি সীতারামপুর।
শম্ভু। না, কলকাতায় এ তো আপনার শোবার ঘর।
যতীন। মিথ্যে নয়? এ সমস্তই মিথ্যে নয়?
শম্ভু। আমি মাসিমাকে ডেকে দিই।
[প্রস্থান]
মাসির প্রবেশ
যতীন। আমি যে মরে যাই নি, তা কী করে জানব, মাসি। হয়তো সবই উলটে গেছে।
মাসি। ও কী বলছিস, যতীন।
যতীন। তুমি তো আমার মাসি?
মাসি। না তো কী, যতীন।
যতীন। হিমিকে ডেকে দাও-না, সে আমার পাশে বসুক। সে যেন থাকে আমার কাছে। এখনই
যেন কোথাও না যায়।
মাসি। আয় তো হিমি, এখানে বোস্ তো!
যতীন। ঐ বাঁশিটা থামিয়ে দাও-না। ওটা কি গৃহপ্রবেশের জন্যে আনিয়েছ। ওর আর
দরকার নেই।
মাসি। পাশের বাড়িতে বিয়ে, ও বাঁশি সেইখানে বাজছে।
যতীন। বিয়ের বাঁশি? ওর মধ্যে অত কান্না কেন। বেহাগ বুঝি? তোমাকে কি আমার
স্বপ্নের কথা বলেছি, মাসি।
মাসি। কোন্ স্বপ্ন।
যতীন। মণি যেন আমার ঘরে আসবার জন্যে দরজা ঠেলছিল। কোনোমতেই দরজা এতটুকুর
বেশি ফাঁক হল না। সে বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। কিছুতেই ঢুকতে পারলে না।
অনেক করে ডাকলুম, তার আর গৃহপ্রবেশ হল না। হল না, হল না, হল না।—
[মাসি নিরুত্তর]
বুঝেছি মাসি, বুঝেছি,
আমি দেউলে। একেবারে দেউলে। সব দিকে। এ বাড়িটাও নেই- সব বিক্রি হয়ে গেছে,
কেবল নিজকে ভোলাচ্ছিলুম।
মাসি। না যতীন, না, শপথ করে বলছি তোর বাড়ি ঠিক আছে- অখিল এসেছে, যদি বলিস
তাকে ডেকে দিই।
যতীন। বাড়িটা তবে আছে? সে তো অপেক্ষা করতে পারবে, আমার মতো সে তো ছায়া নয়।
বৎসরের পর বৎসর সে দরজা খুলে থাক্-না দাঁড়িয়ে। কী বল, মাসি।
মাসি। থাকবে বৈকি যতীন, তোর ভালোবাসায় ভরা হয়ে থাকবে।
যতীন। ভাই হিমি, তুই থাকবি আমার ঘরটিতে। একদিন হয়তো সময় হবে, ঘরে প্রবেশ
করবে। সেদিন যে-লোকেই থাকি, আমি জানতে পারব। হিমি, হিমি!
হিমি। কী, দাদা।
যতীন। তোর উপর ভার রইল, বোন। মনে আছে, কোন্ গানটা গাবি?
হিমি। আছে— অগ্নিশিখা, এসো এসো।
যতীন। লক্ষ্মী বোন আমার, কারো উপর রাগ করিস নে। সবাইকে ক্ষমা করিস। আর
আমাকে যখন মনে করবি তখন মনে করিস, ‘আমাকে দাদা চিরদিন ভালোবাসত, আজও
ভালোবাসে’। জান মাসি, আমার এই
বাড়িতেই হিমির বিয়ে হবে? আমাদের সেই পুরোনো দালানে, যেখানে আমার মায়ের বিয়ে
হয়েছিল। সে দালানে আমি একটুও হাত দিই নি।
মাসি। তাই হবে, বাবা।
যতীন। মাসি, আর-জন্মে তুমি আমার মেয়ে হয়ে জন্মাবে, তোমাকে বুকে করে মানুষ
করব।
মাসি। বলিস কী, যতীন। আবার মেয়ে হয়ে জন্মাব? নাহয় তোরই কোলে ছেলে হয়েই জন্ম
হবে। সেই কামনাই কর্-না।
যতীন। না, ছেলে না— ছিঃ! ছোটোবেলায় যেমন ছিলে তেমনি অপরূপ সুন্দরী হয়ে তুমি
আমার ঘরে আসবে। আমি তোমাকে সাজাব।
মাসি। আর বকিস নে, একটু ঘুমো।
যতীন। তোমার নাম দেব লক্ষ্মীরানী—
মাসি। ও তো একেলে নাম হল না।
যতীন। না, একেলে না। তুমি চিরদিন আমার সাবেককেলে। সেই তোমার সুধায়-ভরা
সাবেককাল নিয়েই তুমি আমার ঘরে এসো।
মাসি। তোর ঘরে কন্যাদায়ের দুঃখ নিয়ে আসব, এ কামনা আমি তো করি-নে।
যতীন। তুমি আমাকে দুর্বল মনে কর, মাসি? দুঃখ থেকে বাঁচাতে চাও?
মাসি। বাছা, আমার যে মেয়েমানুষের মন, আমিই দুর্বল। তাই তোকে বড়ো ভয়ে ভয়ে
সকল দুঃখ থেকে চিরদিন বাঁচাতে চেয়েছি। কিন্তু আমার সাধ্য কী আছে। কিছুই
করতে পারি নি।
যতীন। মাসি, একটা কথা গর্ব করে বলতে পারি। যা পাই নি তা নিয়ে কোনোদিন
কাড়াকাড়ি করি নি। সমস্ত জীবন হাতজোড় করে অপেক্ষাই করলুম। মিথ্যাকে চাই নি
বলেই এত সবুর করতে হল। সত্য হয়তো এবার দয়া করবেন।— ও কে ও, মাসি ও কে।
মাসি। কই, কেউ তো না, যতীন।
যতীন। তুমি একবার ও-ঘরটা দেখে এসোগে, আমি যেন—
মাসি। না বাছা, কাউকে দেখছি নে।
যতীন। আমি কিন্তু স্পষ্ট যেন—
মাসি। কিচ্ছু না, যতীন।
ডাক্তারের প্রবেশ
যতীন। ও কে ও। কোথা থেকে আসছ? কিছু খবর আছে?
মাসি। উনি ডাক্তার।
ডাক্তার। আপনি ওঁর কাছে থাকবেন না— আপনার সঙ্গে বড়ো বেশি কথা কন—
যতীন। না, মাসি, যেতে পাবে না।
মাসি। আচ্ছা, বাছা, আমি ঐ কোণটাতে গিয়ে বসছি।
যতীন। না, না, আমার পাশে বোসো, আমার হাত ধ’রে। ভগবান তোমার হাত থেকেই আমাকে
নিজের হাতে নেবেন।
ডাক্তার। আচ্ছা বেশ। কিন্তু কথা কবেন না। আর, সেই ওষুধটা খাবার সময় হল।
যতীন। সময় হল? আবার ভোলাতে এসেছ? সময় পার হয়ে গেছে। মিথ্যে সান্ত্বনায় আমার
দরকার নেই। বিদায় করে দাও, সব বিদায় করে দাও। মাসি, এখন আমার তুমি আছ— কোনো
মিথ্যাকেই চাই নে। আয় ভাই হিমি, আমার পাশে বোস্।
ডাক্তার। এতটা উত্তেজনা ভালো হচ্ছে না।
যতীন। তবে আমাকে আর উত্তেজিত কোরো না।—
[ ডাক্তারের প্রস্থান]
ডাক্তার গেছে, এইবার আমার বিছানায় উঠে বোসো, তোমার কোলে মাথা দিয়ে শুই।
মাসি। শোও বাবা, একটু ঘুমোও।
যতীন। ঘুমোতে বোলো না, এখনো আমার আর-একটু জেগে থাকবার দরকার আছে। শুনতে
পাচ্ছ না? আসছে। এখনই আসবে। চোখের উপর কী রকম সব ঘোর হয়ে আসছে। গোধূলিলগ্ন,
গোধূলিলগ্ন আমার। বাসরঘরের দরজা খুলবে। হিমি ততক্ষণ ঐ গানটা— জীবনমরণের
সীমানা পারায়ে।
হিমির গান
জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে ।
এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে
তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে,
গভীর কী আশায় নিবিড় পুলকে
তাহার পানে চাই দু'বাহু বাড়ায়ে ।
নীরব নিশি তব চরণ নিছায়ে
আঁধার-কেশভার দিয়েছে বিছায়ে
আজি এ কোন্ গান নিখিল প্লাবিয়া
তোমার বীণা হতে আসিল নাবিয়া ।
ভুবন মিলে যায় সুরের রণনে —
গানের বেদনায় যাই যে হারায়ে ।
মণির প্রবেশ
মাসি। বাবা, যতীন, একটু চেয়ে দেখ্। ঐ যে এসেছে।
যতীন। কে। স্বপ্ন?
মাসি। স্বপ্ন নয়। বাবা, মণি। ঐ যে তোমার শ্বশুর।
যতীন। (মণির দিকে চাহিয়া) তুমি কে।
মাসি। চিনতে পারছ না? ঐ তো তোমার মণি।
যতীন। দরজাটা কি সব খুলে গেছে।
মাসি। সব খুলেছে।
যতীন। কিন্তু পায়ের উপর ও শালটা নয়, ও শালটা নয়। সরিয়ে দাও, সরিয়ে দাও।
মাসি। শাল নয়, যতীন। বউ তোর পায়ের উপর পড়েছে। ওর মাথায় হাত রেখে একটু
আশীর্বাদ কর্।
|