নবীন
দ্বিতীয় পর্ব
| কেন ধরে রাখা, ও-যে যাবে চলে মিলনলগন গত হলে। স্বপনশেষে নয়ন মেলো, নিবু নিবু দীপ নিবায়ে ফেলো, কী হবে শুকানো ফুলদলে। |
এখনো কোকিল ডাকছে, এখনো শিরীষবনের পুষ্পাঞ্জলি উঠছে ভরে ভরে,
তবু এই চঞ্চলতার অন্তরে অন্তরে একটা বেদনা শিউরিয়ে উঠল। বিদায়দিনের প্রথম হাওয়া
অশথগাছের পাতায় পাতায় ঝর ঝর করে উঠছে। সভার বীণা বুঝি নীরব হবে, দিগন্তে পথের
একতারার সুর বাঁধা হচ্ছে— মনে হচ্ছে, যেন বসন্তী রঙ মলান হয়ে গেরুয়া রঙে নামল।
| চলে যায়, মরি হায়, বসন্তের দিন।
দূর শাখে পিক ডাকে বিরামবিহীন। অধীর সমীরভরে উচ্ছ্বসি বকুল ঝরে, গন্ধসনে হল মন সুদূরে বিলীন। পুলকিত আম্রবীথি ফাল্গুনেরই তাপে, মধুকরগুঞ্জরণে ছায়াতল কাঁপে। কেন জানি অকারণে সারাবেলা আনমনে পরানে বাজায় বীণা কে গো উদাসীন॥ --- বিদায় দিয়ো মোরে প্রসন্ন আলোকে, রাতের কালো আঁধার যেন নামে না ওই চোখে। |
হে সুন্দর, যে কবি তোমার অভিনন্দন করতে এসেছিল তার ছুটি মঞ্জুর
হল। তার প্রণাম তুমি নাও। তার আপন গানের বন্ধনেই চিরদিন সে বাঁধা রইল তোমার দ্বারে।
তার সুরের রাখী তুমি গ্রহণ করেছ আমি জানি; তার পরিচয় রইল তোমার ফুলে ফুলে, তোমার
পদপাতকম্পিত শ্যামল শম্পবীথিকায়।
|
বসন্তে বসন্তে তোমার কবিরে দাও ডাক–
যায় যদি সে যাক। রইল তাহার বাণী , রইল ভরা সুরে , রইবে না সে দূরে– হৃদয় তাহার কুঞ্জে তোমার রইবে না নির্বাক্ । ছন্দ তাহার রইবে বেঁচে কিশলয়ের নবীন নাচে নেচে নেচে। তারে তোমার বীণা যায় না যেন ভুলে, তোমার ফুলে ফুলে মধুকরের গুঞ্জরণে বেদনা তার থাক্॥ --- তবে শেষ করে দাও শেষ গান , তার পরে যাই চলে। তুমি ভুলো না গো এ রজনী আজ রজনী ভোর হলে । |
এর ভয় হয়েছে সব কথা
বলা হল না।
এ দিকে বসন্তের পালা সাঙ্গ হল।
ত্বরা কর্ গো, ত্বরা কর্–
বাতাস তপ্ত হলে এল,
এইবেলা রিক্ত হবার আগে অঞ্জলি পূর্ণ করে দে–
তার পরে আছে করুণ ধূলি তার আঁচল বিছিয়ে।
|
যখন
মল্লিকাবনে
প্রথম ধরেছে কলি |
' শুকনো পাতা
কে যে ছড়ায় ওই দূরে ' বসন্তের ভূমিকায় ঐ পাতাগুলি একদিন আগমনীর গানে তাল দিয়েছিল,
আজ তারা যাবার পথের ধূলিকে ঢেকে দিল,
পায়ে পায়ে প্রণাম করতে লাগল বিদায়পথের পথিককে।
নবীনকে সন্ন্যাসীর বেশ পরিয়ে দিয়ে বললে,
তোমার উদয় সুন্দর, তোমার অস্তও
সুন্দর।'
|
ঝরা পাতা গো,
আমি তোমারি দলে। |
মন ছিল সুপ্ত,
কিন্তু দ্বার ছিল খোলা, সেইখান
দিয়ে কার নিঃশব্দ চরণের আনাগোনা।
জেগে উঠে দেখি ভুঁইচাঁপা ফুলের ছিন্ন পাপড়ি লুটিয়ে আছে তার যাওয়ার পথে।
আর দেখি,
ললাটে পরিয়ে দিয়ে গেছে বরণমালা,
তার শেষ দান, কিন্তু এ-যে বিরহের
মালা।
|
কখন দিলে পরায়ে স্বপনে বরণমালা, ব্যথার মালা। প্রভাতে দেখি জেগে অরুণ মেঘে বিদায়বাঁশরি বাজে অশ্রু-গালা। গোপনে এসে গেলে দেখি নাই আঁখি মেলে। আঁধারে দুঃখডোরে বাঁধিল মোরে , ভূষণ পরালে বিরহবেদন-ঢালা। |
হে বনস্পতি
শাল, অবসানের অবসাদকে তুমি দূর
করে দিলে। তোমার অক্লান্ত
মঞ্জরীর মধ্যে উৎসবের শেষবেলাকার ঐশ্বর্য,
নবীনের শেষ জয়ধ্বনি তোমার বীরকণ্ঠে।
অরণ্যভূমির শেষ আনন্দিত বাণী তুমি শুনিয়ে দিলে যাবার পথের পথিককে , বললে
পুনর্দর্শনায়'। তোমার আনন্দের
সাহস বিচ্ছেদের সামনে এসে মাথা তুলে দাঁড়াল।
| ক্লান্ত যখন
আম্রকলির কাল, মাধবী ঝরিল ভূমিতলে অবসন্ন, সৌরভধনে তখন তুমি হে শাল, বসন্তে করো ধন্য। সান্ত্বনা মাগি দাঁড়ায় কুঞ্জভূমি রিক্তবেলায় অঞ্চল যবে শূন্য– বনসভাতলে সবার ঊর্ধ্বে তুমি, সব অবসানে তোমার দানের পুণ্য |
এইবার শেষ
দেওয়া-নেওয়া চুকিয়ে দাও। দিয়ে
দাও তোমার বাহিরের দান,
উত্তরীয়ের সুগন্ধ, বাঁশির গান,
আর নিয়ে যাও আমার অন্তরের বেদনা নীরবতার ডালি থেকে।
| তুমি কিছু দিয়ে
যাও মোর প্রাণে গোপনে গো। ফুলের গন্ধে , বাঁশির গানে, মর্মরমুখরিত পবনে। তুমি কিছু নিয়ে যাও বেদনা হতে বেদনে– যে মোর অশ্রু হাসিতে লীন, যে বাণী নীরব নয়নে॥ |
দূরের বাণীকে
জাগিয়ে গিয়ে গেল পথিক। এমনি করেই
বারে বারে সে কাছের বন্ধন আল্গা করে দেয়।
একটা অপরিচিত ঠিকানার উদ্দেশ বলে দিয়ে যায় কানে কানে,
সাহসের সুর এসে পৌঁছয় বিচ্ছেদসমুদ্রের পরপার থেকে মন উদাস হয়ে যায়।
|
বাজে করুণ সুরে (হায় দূরে) তব চরণতলচুম্বিত পন্থবীণা। মম পান্থচিত চঞ্চল জানি না কী উদ্দেশে। যূথীগন্ধ অশান্ত সমীরে ধায় উতলা উচ্ছ্বাসে, তেমনি চিত্ত উদাসী রে নিদারুণ বিচ্ছেদের নিশীথে। |
৩০ ফাল্গুন ১৩৩৭।