নবীন
পরিশিষ্ট
প্রথম অভিনয়কালে 'নবীন' যে আকারে মুদ্রিত হইয়াছিল তাহা এই পরিশিষ্টে সংকলিত হইল। যে গানগুলি প্রচলিত 'নবীন' গ্রন্থে বা অন্য গ্রন্থে স্থান পাইয়াছে তাহাদের প্রথম ছত্রই কেবল দেওয়া গেল। 'হদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে' গানের পাঠান্তর ‘হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর ফাল্গুনী ঢেউ আসে' গানটি পুনর্মুদ্রিত হইল। 'বেদনা কী ভাষায় রে' প্রচলিত গ্রন্থে বর্জিত হইলেও, প্রথম প্রকাশিত নবীনের অন্তর্ভুক্ত নবরচিত গান হিসাবে সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হইল।
নবীন
প্রথম পর্ব
বাসন্তী , হে ভুবনমোহিনী
শুনেছ অলিমালা, ওরা বড়ো ধিক্কার দিচ্ছে, ঐ ওপাড়ার মল্লের দল, উৎসবে তোমাদের চাপল্য ওদের ভালো লাগছে না। শৈবালপুঞ্জিত গুহাদ্বারে কালো কালো শিলাখণ্ডের মতো তমিস্রগহন গাম্ভীর্যে ওরা নিশ্চল হয়ে ভ্রূকুটি করছে , নির্ঝরিণী ওদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে এই আনন্দময় বিশ্বের আনন্দপ্রবাহ দিকে দিগন্তে বইয়ে দিতে, নাচে গানে কল্লোলে হিল্লোলে কলহাস্যে– চূর্ণ চূর্ণ সূর্যের আলো উদ্বেল তরঙ্গভঙ্গের ছন্দে ছন্দে বিকীর্ণ করে দিতে। এই আনন্দ-আবেগের অন্তরে অন্তরে যে অক্ষয় শৌর্যের অনুপ্রেরণা আছে, সেটা ওদের শাস্ত্রবচনের বেড়ার বাইরে দিয়ে চলে গেল। ভয় কোরো না তোমরা; যে রসরাজের নিমন্ত্রণে তোমরা এসেছ, তাঁর প্রসন্নতা যেমন নেমেছে আমাদের নিকুঞ্জে অন্তঃস্মিত গন্ধরাজমুকুলের প্রচ্ছন্ন গন্ধরেণুতে তেমনি নামুক তোমাদের কণ্ঠে কণ্ঠে, তোমাদের দেহলতার নিরুদ্ধ নটনোৎসাহে। সেই যিনি সুরের গুরু, তাঁর চরণে তোমাদের নৃত্যের অর্ঘ্য নিবেদন করে দাও ।
সুরের গুরু , দাও গো সুরের দীক্ষা
একটা ফর্মাশ এসেছে বসন্ত-উৎসবে নতুন কিছু চাই– কিন্তু যাদের রসবেদনা আছে তারা বলছে, আমরা নতুন চাই নে, আমরা চাই নবীনকে। তারা বলে, মাধবী বছরে বছরে সাজ বদলায় না, অশোক পলাশ পুরাতন রঙেই বারে বারে রঙিন। এই চিরপুরাতন ধরণী সেই চিরপুরাতন নবীনের দিকে তাকিয়ে বলছে, 'লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু তবু হিয়া জুড়ন না গেল।' সেই নবীনের উদ্দেশে তোমাদের গান শুরু করে দাও।
আন্ গো তোরা কার কী আছে
অশোকবনের রঙমহলে আজ লাল রঙের তানে তানে পঞ্চমরাগে সানাই বাজিয়ে দিলে, কুঞ্জবনের বীথিকায় আজ সৌরভের অবারিত দানসত্র। আমরাও তো শূন্যহাতে আসি নি। দানের জোয়ার যখন লাগে অতল জলে তখন ঘাটে ঘাটে দানের বোঝাইতরী রশি খুলে দিয়ে ভেসে পড়ে। আমাদের ভরা নৌকো দখিন হাওয়ায় পাল তুলে সাগর-মুখো হল, সেই কথাটা কণ্ঠ খুলে জানিয়ে দাও।
ফাগুন , তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি-যে দান
ভরে দাও একেবারে ভরে দাও, কোথাও কিছু সংকোচ না থাকে। পূর্ণের উৎসবে দেওয়া আর পাওয়া একই কথা। ঝর্নার এক প্রান্তে পাওয়া রয়েছে অভ্রভেদী শিখরের দিক থেকে, আর-এক প্রান্তে দেওয়া রয়েছে অতলস্পর্শ সাগরের দিকে, এর মাঝখানে তো কোনো বিচ্ছেদ নেই। অন্তহীন পাওয়া আর অন্তহীন দেওয়ার আবর্তন নিয়ে এই বিশ্ব ।
গানের ডালি ভরে দে গো উষার কোলে ।
মধুরিমা, দেখো, দেখো, চাঁদের তরণীতে আজ পূর্ণতা পরিপুঞ্জিত। কত দিন ধরে এক তিথি থেকে আর-এক তিথিতে এগিয়ে এগিয়ে আসছে। নন্দনবন থেকে আলোর পারিজাত ভরে নিয়ে এল– কোন্ মাধুরীর মহাশ্বেতা সেই ডালি কোলে নিয়ে বসে আছে; ক্ষণে ক্ষণে রাজহংসের ডানার মতো তার শুভ্র মেঘের বসনপ্রান্ত আকাশে এলিয়ে পড়ছে। আজ ঘুমভাঙা রাতের বাঁশিতে বেহাগের তান লাগল।
নিবিড় অমা-তিমির হতে
দোল লেগেছে এবার। পাওয়া আর না-পাওয়ার মাঝখানে দোল। এক প্রান্তে বিরহ, আর প্রান্তে মিলন, স্পর্শ করে দুলছে বিশ্বের হৃদয়। পরিপূর্ণ আর অপূর্ণের মাঝখানে এই দোলন। আলোতে ছায়াতে ঠেকতে ঠেকতে রূপ জাগছে– জীবন থেকে মরণে, মরণ থেকে জীবনে, অন্তর থেকে বাহিরে, আবার বাহির থেকে অন্তরে। এই দোলার তালে না মিলিয়ে চললেই রসভঙ্গ হয়। ও পাড়ার ওরা-যে দরজার আগল এঁটে বসেই রইল– হিসেবের খাতার উপর ঝুঁকে পড়েছে। একবার ওদের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দোলের ডাক দাও।
ওরে গৃহবাসী , তোরা খোল্ দ্বার খোল্
কিন্তু পূর্ণিমার চাঁদ-যে ধ্যানস্তিমিতলোচন পুরোহিতের মতো আকাশের বেদীতে বসে উৎসবের মন্ত্র জপ করতে লাগল। ওকে দেখাচ্ছে যেন জ্যোৎস্নাসমুদ্রের ঢেউয়ের চূড়ায় ফেনপুঞ্জের মতো– কিন্তু সে ঢেউ-যে চিত্রার্পিতবৎ স্তব্ধ। এ দিকে আজ বিশ্বের বিচলিত চিত্ত দক্ষিণের হাওয়ায় ভেসে পড়েছে, চঞ্চলের দল মেতেছে বনের শাখায়, পাখির ডানায়– আর ঐ কি একা অবিচলিত হয়ে থাকবে নিবাতনিষ্কম্পমিবপ্রদীপম্? নিজে মাতবে না আর বিশ্বকে মাতাবে, সে কেমন হল? এর একটা যা-হয় জবাব দিয়ে দাও।
কে দেবে চাঁদ তোমায় দোলা১
আজ সব ভীরুদের ভয় ভাঙানো চাই। ঐ মাধবীর দ্বিধা-যে ঘোচে না। এ দিকে আকাশে আকাশে প্রগল্ভতা অথচ ওরা রইল সসংকোচে ছায়ার আড়ালে। ঐ অবগুণ্ঠিতাদের সাহস দাও। বেরিয়ে পড়বার হাওয়া বইল যে– বকুলগুলো রাশি রাশি ঝরতে ঝরতে বলছে 'যা হয় তা হোক গে', আমের মুকুল নির্ভয়ে বলে উঠছে 'দিয়ে ফেলব একেবারে শেষ পর্যন্ত'। যে পথিক আপনাকে বিলিয়ে দেবার জন্যেই পথে বেরিয়েছে তার কাছে আত্মনিবেদনের থালি উপুড় করে দিয়ে তবে তাকে আনতে পারবে নিজের আঙিনায়। কৃপণতা করে সময় বইয়ে দিলে তো চলবে না।
হে মাধবী , দ্বিধা কেন , আসিবে কি ফিরিবে কি
দেখতে দেখতে ভরসা বেড়ে উঠছে, তাকে পাব না তো কী। যখন দেখা দেয় না তখনো যে সাড়া দেয়। যে পথে চলে সেখানে-যে তার চলার রঙ লাগে । যে আড়ালে থাকে তার ফাঁক দিয়ে আসে তার মালার গন্ধ। দুয়ারে অন্ধকার যদি-বা চুপচাপ থাকে, আঙিনায় হাওয়াতে চলে কানাকানি। পড়তে পারি নে সব অক্ষর, কিন্তু চিঠিখানা মনের ঠিকানায় এসে পৌঁছয়। লুকিয়েই ও ধরা দেবে এমনিতরো ওর ভাবখানা।
সে কি ভাবে গোপন রবে লুকিয়ে হৃদয়-কাড়া১
এইবার বেড়া ভাঙল, দুর্বার বেগে। অন্ধকারের গুহায় অগোচরে জমে উঠেছিল বন্যার উপক্রমণিকা, হঠাৎ ঝর্না ছুটে বেরোল, পাথর গেল ভেঙে, বাধা গেল ভেসে। চরম যখন আসেন তখন এক-পা এক-পা পথ গুনে গুনে আসেন না। একেবারে বজ্রে-শান-দেওয়া বিদ্যুতের মতো, পুঞ্জ পুঞ্জ কালো মেঘের বক্ষ এক আঘাতে বিদীর্ণ করে আসেন।
হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর ফাল্গুনী
ঢেউ আসে, বেড়া-ভাঙার মাতন নামে উদ্দাম উল্লাসে। তোমার মোহন এল সোহন বেশে, কুয়াশাভার গেল ভেসে, এল তোমার সাধনধন উদার আশ্বাসে। অরণ্যে তোর সুর ছিল না, বাতাস হিমে ভরা। জীর্ণ পাতায় কীর্ণ কানন, পুষ্পবিহীন ধরা। এবার জাগ্ রে হতাশ, আয় রে ছুটে অবসাদের বাঁধন টুটে, বুঝি এল তোমার পথের সাথি উতল উচ্ছ্বাসে। ২ |
উৎসবের সোনার কাঠি তোমাকে ছুঁয়েছে, চোখ খুলছে; এইবার সময় হল চার
দিক দেখে নেবার। আজ দেখতে পাবে ঐ, শিশু হয়ে এসেছে চির নবীন, কিশলয়ে তার ছেলেখেলা
জমাবার জন্যে। তার দোসর হয়ে তার সঙ্গে যোগ দিল ঐ সূর্যের আলো, সেও সাজল শিশু ,
সারাবেলা সে কেবল ঝিকিমিকি করছে। ঐ তার কলপ্রলাপ। ওদের নাচে নাচে মর্মরিত হয়ে উঠল
প্রাণগীতিকার প্রথম ধুয়োটি।
ওরা অকারণে চঞ্চল
আবার একবার চেয়ে দেখো– অবজ্ঞায় চোখ ঝাপসা হয়ে থাকে, আজ সেই কুয়াশা যদি কেটে যায় তবে যাকে তুচ্ছ বলে দিনে দিনে এড়িয়ে গেছ তাকে দেখে নাও তার আপন মহিমায়। ঐ দেখা ঐ বনফুল, মহাপথিকের পথের ধারে ও ফোটে, তাঁর পায়ের করুণ স্পর্শে সুন্দর হয়ে ওঠে ওর প্রণতি। সূর্যের আলো ওকে আপন বলে চেনে; দখিন হাওয়া ওকে শুধিয়ে যায় 'কেমন আছ'। তোমার গানে আজ ওকে গৌরব দিক। এরা যেন কুরুরাজের সভায় শূদ্রার সন্তান বিদুরের মতো, আসন বটে নীচে, কিন্তু সম্মান স্বয়ং ভীষ্মের চেয়ে কম নয়।
আজ দখিন বাতাসে১
কাব্যলোকের আদরিণী সহকারমঞ্জরীকে আর চিনিয়ে দিতে হবে না। সে আপনাকে তো লুকোতে জানে না। আকাশের হৃদয় সে অধিকার করেছে, মৌমাছির দল বন্দনা করে তার কাছ থেকে অজস্র দক্ষিণা নিয়ে যাচ্ছে। সকলের আগেই উৎসবের সদাব্রত ও শুরু করে দিয়েছিল, সকলের শেষ পর্যন্ত ওর আমন্ত্রণ রইল খোলা। কোকিল ওর গুণগান দিনে রাতে আর শেষ করতে পারছে না– তোমরাও তান লাগাও।
ও মঞ্জরী , ও মঞ্জরী , আমের মঞ্জরী
দীর্ঘ শূন্য পথটাকে এতদিন ঠেকেছিল বড়ো কঠিন, বড়ো নিষ্ঠুর। আজ তাকে প্রণাম। পথিককে সে তো অবশেষে এনে পৌঁছিয়ে দিলে। তারই সঙ্গে এনে দিলে অসীম সাগরের বাণী। দুর্গম উঠল সেই পথিকের মধ্যে গান গেয়ে। কিন্তু আনন্দ করতে করতেই চোখে জল আসে-যে। ভুলব কেমন করে যে, যে পথ কাছে নিয়ে আসে সেই পথই দুরে নিয়ে যায়। পথিককে ঘরে আটক করে না। বাঁধন ছিঁড়ে নিজেও বেরিয়ে না পড়লে ওর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঠেকাবে কী করে? আমার ঘর-যে ওর যাওয়া-আসার পথের মাঝখানে; দেখা দেয় যদি-বা, তার পরেই সে-দেখা আবার কেড়ে নিয়ে চলে যায়।
মোর পথিকেরে বুঝি এনেছ এবার করুণ রঙিন পথ
তবু ওকে ক্ষণকালের বাঁধন পরিয়ে দিতে হবে। টুকরো টুকরো সুখের হার গাঁথব– পরাব ওকে মাধুর্যের মুক্তোগুলি। ফাল্গুনের ভরা সাজি থেকে যা-কিছু ঝরে ঝরে পড়ছে কুড়িয়ে নেব, বনের মর্মর, বকুলের গন্ধ, পলাশের রক্তিমা– আমার বাণীর সূত্রে সব গেঁথে বেঁধে দেব তার মণিবন্ধে। হয়তো আবার আর-বসন্তেও সেই আমার-দেওয়া ভূষণ প'রেই সে আসবে। আমি থাকব না, কিন্তু কী জানি, আমার দানের ভূষণ হয়ত থাকবে ওর দক্ষিণ হাতে।
ফাগুনের নবীন আনন্দে
১ দ্রষ্টব্য : বসন্ত।
রবীন্দ্র-রচনাবলী ১৫শ (সুলভ অষ্টম) খণ্ড
২ তুলনীয় : হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে। নটরাজ।
রবীন্দ্র-রচনাবলী ১৮শ (সুলভ নবম) খণ্ড
৩ দ্রষ্টব্য : ফাল্গুনী। রবীন্দ্র-রচনাবলী ১২শ (সুলভ ষষ্ঠ) খণ্ড