ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি
 

প্রায়শ্চিত্ত

প্রথম অঙ্ক


উদয়াদিত্যের শয়নকক্ষ
উদয়াদিত্য ও সুরমা

    উদয়াদিত্য। যাক চুকল!
    সুরমা। কী চুকল?
    উদয়াদিত্য। আমার উপর মাধবপুর পরগনা শাসনের ভার মহারাজ রেখেছিলেন। জান তো, দু বৎসর থেকে সেখানে কিরকম অজন্মা হয়েছে
আমি তাই খাজনা আদায় বন্ধ করেছিলুম। মহারাজ আমাকে বলেছিলেন, যেমন করে হোক টাকা চাই।
‌    সুরমা। আমি তো তোমাকে আমার গহনাগুলো দিতে চেয়েছিলুম।
    উদয়াদিত্য। তোমার গহনা টাকা দিয়ে কেনে এত বড়ো বুকের পাটা এ রাজ্যে আছে কার? মহারাজার কানে গেলে কি রক্ষা আছে? আমি মহারাজকে বললুম মাধবপুর থেকে টাকা আমি কোনোমতেই আদায় করতে পারব না। শুনে তিনি মাধবপুর আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। তিনি এখন সৈন্য বাড়াচ্ছেন, টাকা তাঁর চাই!
    সুরমা। পরগনা তো কেড়ে নিলেন, কিন্তু তুমি চলে এলে প্রজারা যে মরবে।
    উদয়াদিত্য। আমি ঠিক করেছি, যে করে হোক তাদের পেটের ভাতটা জোগাব। শুনতে পেলে মহারাজ খুশি হবেন না
দয়া জিনিসটাকে তিনি মেয়েমানুষের লক্ষণ বলেই জানেন। কিন্তু তোমার ঘরে আজ এত ফুলের মালার ঘটা কেন?
    সুরমা। রাজপুত্রকে রাজসভায় যখন চিনল না, তখন যে তাকে চিনেছে সে তাকে মালা দিয়ে বরণ করবে।
    উদয়াদিত্য। সত্যি নাকি! তোমার ঘরে রাজপুত্র আসা-যাওয়া করেন? তিনি কে শুনি? এ খবরটা তো জানতুম না।
    সুরমা। রামচন্দ্র যেমন ভুলেছিলেন তিনি অবতার, তোমারও সেই দশা হয়েছে। কিন্তু ভক্তকে ভোলাতে পারবে না।
    উদয়াদিত্য। রাজপুত্র! রাজার ঘরে কোনো জন্মে পুত্র জন্মাবে না, বিধাতার এই অভিশাপ।
    সুরমা। সে কী কথা?
    উদয়াদিত্য। হাঁ, রাজার ঘরে উত্তরাধিকারীই জন্মায়, পুত্র জন্মায় না।
    সুরমা। এ তুমি মনের ক্ষোভে বলছ।
    উদয়াদিত্য। কথাটা কি আমার কাছে নূতন যে ক্ষোভ হবে? যখন এতটুকূ ছিলুম তখন থেকে মহারাজ এইটেই দেখেছেন যে আমি তাঁর রাজ্যভার বইবার যোগ্য কি না । কেবলই পরীক্ষা, স্নেহ নেই।
    সুরমা। প্রিয়তম, দরকার কী স্নেহের! খুব কঠোর পরীক্ষাতেও তোমার জিত হবে। তোমার মতো রাজার ছেলে কোন্‌ রাজা পেয়েছে?
    উদয়াদিত্য। বল কী? পরীক্ষক তোমার পরামর্শ নিয়ে বিচার করবেন না, সেটা বেশ বুঝতে পারছি।
    সুরমা। কারো পরামর্শ নিয়ে বিচার করতে হবে না
আগুনের পরীক্ষাতেও সীতার চুল পোড়ে নি। তুমি রাজ্যভার বহনের উপয়ুক্ত নও, এ কথা কি বললেই হল? এতবড়ো অবিচার কি জগতে কখনো টিকতে পারে?
    উদয়াদিত্য। রাজ্যভারটা নাই-বা ঘাড়ের উপর পড়ল, তাতেই বা দুঃখ কিসের?
    সুরমা। না না, ও কথা তোমার মুখে আমার সহ্য হয় না। ভগবান তোমাকে রাজার ছেলে করে পাঠিয়েছেন, সে কথা বুঝি অমন করে উড়িয়ে দিতে আছে? না হয় দুঃখই পেতে হবে
তা বলে
    উদয়াদিত্য। আমি দুঃখের পরোয়া রাখি নে। তুমি আমার ঘরে এসেছ, তোমাকে সুখী করতে পারি নে আমার পৌরুষে সেই ধিক্‌কার বাজে।
    সুরমা। যে সুখ দিয়েছ তাই যেন জন্ম-জন্মান্তর পাই।
    উদয়াদিত্য। সুখ যদি পেয়ে থাক তো সে নিজের গুণে, আমার শক্তিতে নয়। এ-ঘরে আমার আদর নেই বলে তোমারও যে অপমান ঘটে! এমন কি, মাও যে তোমাকে অবজ্ঞা করেন।
    সুরমা। আমার সব সম্মান যে তোমার প্রেমে, সে তো কেউ কাড়তে পারে নি।
    উদয়াদিত্য। তোমার পিতা শ্রীপুররাজ কিনা যশোরের অধীনতা স্বীকার করেন না, সেই হয়েছে তোমার অপরাধ
মহারাজ তোমার উপরে রাগ দেখিয়ে তার শোধ তুলতে চান।
    নেপথ্যে। দাদা, দাদা।
    উদয়াদিত্য। ও কে ও। বিভা বুঝি! (দ্বার খুলিয়া) কী বিভা! কী হয়েছে? এত রাত্রে কেন?
    বিভা। (চুপি চুপি কিছু বলিয়া সরোদনে) দাদা, কী হবে?
    উদয়াদিত্য। ভয় নেই, আমি যাচ্ছি।
    বিভা। না না, তুমি যেয়ো না।
    উদয়াদিত্য। কেন বিভা?
    বিভা। বাবা যদি জানতে পারেন?
    উদয়াদিত্য। জানতে পারবেন তো কী? তাই বলে বসে থাকব?
    বিভা। যদি রাগ করেন?
    সুরমা। ছি বিভা, এখন সে কথা কি ভাববার সময়?
    বিভা। (উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া) দাদা, তুমি যেয়ো না, তুমি লোক পাঠিয়ে দাও। আমার ভয় করছে।
    উদয়াদিত্য। ভয় করবার সময় নেই বিভা! [ প্রস্থান
    বিভা। কী হবে ভাই? বাবা জানতে পারলে জানি নে কী কাণ্ড করবেন।
‌    সুরমা। যাই করুন না বিভা, নারায়ণ আছেন।

 


মন্ত্রগৃহে প্রতাপাদিত্য ও মন্ত্রী

    মন্ত্রী। মহারাজ, কাজটা কি ভালো হবে?

    প্রতাপাদিত্য। কোন্‌ কাজটা?
    মন্ত্রী। আজ্ঞে, কাল যেটা আদেশ করেছিলেন।
    প্রতাপাদিত্য। কাল কী আদেশ করেছিলুম?
    মন্ত্রী। আপনার পিতৃব্য সম্বন্ধে

    প্রতাপাদিত্য। আমার পিতৃব্য সম্বন্ধে কী?
    মন্ত্রী। মহারাজ আদেশ করেছিলেন, যখন রাজা বসন্ত রায় যশোরে আসবার পথে শিমুলতলির চটিতে আশ্রয় নেবেন, তখন

    প্রতাপাদিত্য। তখন কী? কথাটা শেষ করেই ফেলো।
    মন্ত্রী। তখন দুজন পাঠান গিয়ে

    প্রতাপাদিত্য। হাঁ

    মন্ত্রী। তাঁকে নিহত করবে।
    প্রতাপাদিত্য। নিহত করবে! অমরকোষ খুঁজে বুঝি আর কোনো কথা খুঁজে পেলে না? নিহত করবে! মেরে ফেলবে কথাটা মুখে আনতে বুঝি বাধছে?
    মন্ত্রী। মহারাজ আমার ভাবটি ভালো বুঝতে পারেন নি।
    প্রতাপাদিত্য। বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছি।
    মন্ত্রী। আজ্ঞে মহারাজ আমি

    প্রতাপাদিত্য। তুমি শিশু! খুন করাকে তুমি জুজু বলে জান! তোমার বুড়ি দিদিমার কাছে শিখেছ খুন করাটা পাপ! খুন করাটা যেখানে ধর্ম, সেখানে না করাটাই পাপ, এটা এখনো তোমার শিখতে বাকি আছে। যে মুসলমান আমাদের ধর্ম নষ্ট করেছে, তাদের যারা মিত্র, তাদের বিনাশ না করাই অধর্ম। পিতৃব্য বসন্ত রায় নিজেকে ম্লেচ্ছের দাস বলে স্বীকার করেছেন। ক্ষত হলে নিজের বাহুকে কেটে ফেলা যায়, সে কথা মনে রেখো মন্ত্রী।
    মন্ত্রী। যে আজ্ঞে।
    প্রতাপাদিত্য। অমন তাড়াতাড়ি 'যে আজ্ঞে' বললে চলবে না। তুমি মনে করছ নিজের পিতৃব্যকে বধ করা সকল অবস্থাতেই পাপ। 'না' ব'লো না, ঠিক এই কথাটাই তোমার মনে জাগছে। কিন্তু মনে ক'রো না এর উত্তর নেই। পিতার অনুরোধে ভৃগু তাঁর মাকে বধ করেছিলেন, আর ধর্মের অনুরোধে আমি আমার পিতৃব্যকে কেন বধ করব না?

    মন্ত্রী। কিন্তু দিল্লীশ্বর যদি শোনেন তবে
    প্রতাপাদিত্য। আর যাই কর, দিল্লীশ্বরের ভয় আমাকে দেখিয়ো না।
    মন্ত্রী। প্রজারা জানতে পারলে কী বলবে?
    প্রতাপাদিত্য। জানতে পারলে তো।
    মন্ত্রী। এ কথা কখনোই চাপা থাকবে না।
    প্রতাপাদিত্য। দেখো মন্ত্রী, কেবল ভয় দেখিয়ে আমাকে দুর্বল করে তোলবার জন্যেই কি তোমাকে রেখেছি?
    মন্ত্রী। মহারাজ, যুবরাজ উদয়াদিত্য

    প্রতাপাদিত্য। দিল্লীশ্বর গেল, প্রজারা গেল, শেষকালে উদয়াদিত্য! সেই স্ত্রৈণ বালকটার কথা আমার কাছে তুলো না।
    মন্ত্রী। তাঁর সম্বন্ধে একটি সংবাদ আছে। কাল তিনি রাত্রে ঘোড়ায় চড়ে একলা বেরিয়েছেন, এখনো ফেরেন নি।
    প্রতাপাদিত্য। কোন্‌ দিকে গেছে?
    মন্ত্রী। পুবের দিকে।
    প্রতাপাদিত্য। কখন গেছে?
    মন্ত্রী। তখন রাত দেড় প্রহর হবে।
    প্রতাপাদিত্য। নাঃ, আর চলল না! ঈশ্বর করুন আমার কনিষ্ঠ পুত্রটি যেন উপযুক্ত হয়। এখনও ফেরে নি!
    মন্ত্রী। আজ্ঞে না।
    প্রতাপাদিত্য। একজন প্রহরী তার সঙ্গে যায় নি কেন?
    মন্ত্রী। যেতে চেয়েছিল, তিনি নিষেধ করেছিলেন।
    প্রতাপাদিত্য। তাকে না জানিয়ে, তার পিছনে পিছনে যাওয়া উচিত ছিল।
    মন্ত্রী। তারা তো কোনো সন্দেহ করে নি।
    প্রতাপাদিত্য। বড়ো ভালো কাজই করেছিল! মন্ত্রী, তুমি কি বোঝাতে চাও এজন্যে কেউ দায়ী নয়? তা হলে এ দায় তোমার।
 


পথপার্শ্বে গাছতলায় বাহকহীন পালকিতে বসন্ত রায় আসীন, পাশে একজন পাঠান দণ্ডায়মান
 

    পাঠান। নাঃ, এ বুড়োকে মারার চেয়ে বাঁচিয়ে রেখে লাভ আছে। মারলে যশোরের রাজা কেবল একবার বকশিশ দেবে, কিন্তু একে বাঁচিয়ে রাখলে এর কাছে অনেক বকশিশ পাব।
    বসন্ত রায়। খাঁ সাহেব, তুমিও যে ওদের সঙ্গে গেলে না?
    পাঠান। হুজুর, যাই কী করে? আপনি তো ডাকাতের হাত থেকে আমাদের ধনপ্রাণ রক্ষার জন্যে আপনার সব লোকজনদেরই পাঠিয়ে দিলেন
আপনাকে মাঠের মধ্যে একলা ফেলে যাব এমন অকৃতজ্ঞ আমাকে ঠাওরাবেন না। দেখুন, আমাদের কবি বলেন, যে আমার অপকার করে সে আমার কাছে ঋণী, পরকালে সে ঋণ তাকে শোধ করতেই হবে, যে আমার উপকার করে আমি তার কাছে ঋণী, কোনো কালেই সে ঋণ শোধ করতে পারব না।
    বসন্ত রায়। বা বা বা! লোকটা তো বেশ! খাঁ সাহেব, তোমাকে বড়ো ঘরের লোক বলে মনে হচ্ছে।
    পাঠান। (সেলাম করিয়া) ক্যা তাজ্জব! মহারাজ ঠিক ঠাউরেছেন।
    বসন্ত রায়। এখন তোমার কি করা হয়?
    পাঠান। (সনিশ্বাসে) হুজুর, গরিব হয়ে পড়েছি, চাষবাস করেই দিন চলে। কবি বলেন, হে অদৃষ্ট, তৃণকে তৃণ করে গড়েছ সেজন্যে তোমাকে দোষ দিই নে। কিন্তু বটগাছকে বটগাছ করেও তাকে ঝড়ের ঘায়ে তৃণের সঙ্গে এক মাটিতে শোয়াও, এতেই বুঝেছি তোমার হৃদয়টা পাষাণ!
    বসন্ত রায়। বাহবা, বাহবা! কবি কী কথাই বলেছেন! সাহেব, যে দুটো বয়েত আজ বললে ও তো আমাকে লিখে দিতে হবে। আচ্ছা খাঁসাহেব, তোমার তো বেশ মজবুত শরীর, তুমি তো ফৌজের সিপাহি হতে পার।
    পাঠান। হুজুরের মেহেরবানি হলেই পারি। আমার বাপ-পিতামহ সকলেই তলোয়ার হাতে মরেছেন। কবি বলেন

    বসন্ত রায়। (হাসিয়া) কবি যাই বলুন, আমার কাজ যদি নাও তবে তলোয়ার হাতে নিয়ে মরার শখ মিটতে পারে, কিন্তু সে তলোয়ার খাপ থেকে খোলবার সুযোগ হবে না। প্রজারা শান্তিতে আছে
ভগবান করুন আর লড়াইয়ের দরকার না হয়। বুড়ো হয়েছি তলোয়ার ছেড়েছি, এখন তার বদলে আর-একজন আমার পাণিগ্রহণ করেছে। (সেতারে ঝংকার)
    পাঠান। (ঘাড় নাড়িয়া) হায় হায়, এমন অস্ত্র কি আছে! একটি বয়েত আছে
তলোয়ারে শত্রুকে জয় করা যায় কিন্তু সংগীতে শত্রুকে মিত্র করা যায়।

    বসন্ত রায়। (উৎসাহে উঠিয়া দাঁড়াইয়া) কী বললে, খাঁ সাহেব! সংগীতে শত্রুকে মিত্র করা যায়! কী চমৎকার! তলোয়ার যে এমন ভয়ানক জিনিস, তাতেও শত্রুর শত্রুত্ব নাশ করা যায় না। কেমন করে বলব নাশ করা যায়? রোগীকে বধ করে রোগ আরোগ্য করা সে কেমনতরো আরোগ্য? কিন্তু সংগীত যে এমন মৃদু জিনিস, তাতে শত্রু নাশ না করেও শত্রুত্ব নাশ করা যায়। একি সাধারণ কবিত্বের কথা! বাঃ, কী তারিফ! খাঁ সাহেব, তোমাকে একবার রায়গড়ে যেতে হচ্ছে। আমি যশোর থেকে ফিরে গিয়েই আমার সাধ্যমতো তোমার কিছু
    পাঠান। আপনার পক্ষে যা 'কিছু' আমার পক্ষে তাই ঢের। হুজুর, আপনার সেতার বাজানো আসে?
    বসন্ত রায়। বাজানো আসে কেমন করে বলি? তবে বাজাই বটে।   [ সেতার বাদন
    পাঠান। বাহবা! খাসী!

উদয়াদিত্যের প্রবেশ

    উদয়াদিত্য। আঃ, বাঁচলুম! দাদামশায়, পথের ধারে এত রাত্রে কাকে বাজনা শোনাচ্ছ?
    বসন্ত রায়। খবর কী দাদা? সব ভালো তো? দিদি ভালো আছে?
    উদয়াদিত্য। সমস্তই মঙ্গল।
    বসন্ত রায়।
                                    সেতার লইয়া গান
                                        ভূপালী - যৎ
 

                বঁধুয়া অসময়ে কেন হে প্রকাশ?
                সকলি যে স্বপ্ন বলে হতেছে বিশ্বাস।
                        তুমি গগনেরই তারা
                        মর্ত্যে এলে পথহারা,
                এলে ভুলে অশ্রুজলে আনন্দেরই হাস।

    উদয়াদিত্য। দাদামশায়, এ লোকটি কোথা থেকে জুটল?
    বসন্ত রায়। খাঁ সাহেব বড়ো ভালো লোক। সমজদার ব্যক্তি। আজ রাত্রে এঁকে নিয়ে বড়ো আনন্দেই কাটানো গেছে।
    উদয়াদিত্য। তোমার সঙ্গের লোকজন কোথায়? চটিতে না গিয়ে এই পথের ধারে রাত কাটাচ্ছ যে?
    বসন্ত রায়। ভালো কথা মনে করিয়ে দিলে! খাঁ সাহেব, তোমাদের জন্যে আমার ভাবনা হচ্ছে। এখনও তো কেউ ফিরল না। সেই ডাকাতের দল কি তবে

    পাঠান। হুজুর, অভয় দেন তো সত্য কথা বলি। আমরা রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রজা, যুবরাজ বাহাদুর আমাদের বেশ চেনেন। মহারাজ আমাকে আর আমার ভাই রহিমকে আদেশ করেন যে, আপনি যখন নিমন্ত্রণ রাখতে যশোরের দিকে আসবেন তখন পথে আপনাকে খুন করা হয়।
    বসন্ত রায়। রাম, রাম!
    উদয়াদিত্য। বলে যাও।
    পাঠান। আমার ভাই গ্রামে ডাকাত পড়েছে বলে কেঁদেকেটে আপনার অনুচরদের নিয়ে গেলেন। আমার উপরেই এই কাজের ভার ছিল। কিন্তু মহারাজ, যদিও রাজার আদেশ, তবু এমন কাজে আমার প্রবৃত্তি হল না। কারণ আমাদের কবি বলেন, রাজা তো পৃথিবীরই রাজা, তাঁর আদেশে পৃথিবী নষ্ট করতে পার, কিন্তু সাবধান, স্বর্গের এক কোণও নষ্ট ক'রো না। গরিব এখন মহারাজের শরণাগত। দেশে ফিরে গেলে আমার সর্বনাশ হবে।
    বসন্ত রায়। তোমাকে পত্র দিচ্ছি তুমি এখান থেকে রায়গড়ে চলে যাও।
    উদয়াদিত্য। দাদামশায়, তুমি এখান থেকে যশোরে যাবে নাকি?
    বসন্ত রায়। হাঁ ভাই।
    উদয়াদিত্য। সে কী কথা!
    বসন্ত রায়। আমি তো ভাই ভবসমুদ্রের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছি
একটা ঢেউ লাগলেই বাস। আমার ভয় কাকে? কিন্তু আমি যদি না যাই তবে প্রতাপের সঙ্গে ইহজন্মে আমার আর দেখা হওয়া শক্ত হবে। এইযে ব্যাপারটা ঘটল এর সমস্ত কালি মুছে ফেলতে হবে যে এইখেন থেকেই যদি রায়গড়ে ফিরে যাই তা হলে সমস্তই জমে থাকবে। চল্‌ দাদা চল্‌। রাত শেষ হয়ে এল।
 


মন্ত্রসভায় প্রতাপাদিত্য ও মন্ত্রী

    প্রতাপাদিত্য। দেখো দেখি মন্ত্রী সে পাঠান দুটো এখনও এল না।
    মন্ত্রী। সেটা তো আমার দোষ নয় মহারাজ!
    প্রতাপাদিত্য। দোষের কথা হচ্ছে না। দেরি কেন হচ্ছে তুমি কী অনুমান কর তাই জিজ্ঞাসা করছি।
    মন্ত্রী। শিমুলতলি তো কাছে নয়। কাজ সেরে আসতে দেরি তো হবেই।
    প্রতাপাদিত্য। উদয় কাল রাত্রেই বেরিয়ে গেছে?
    মন্ত্রী। আজ্ঞে হাঁ সে তো পূর্বেই জানিয়েছি।
    প্রতাপাদিত্য। কী উপযুক্ত সময়েই জানিয়েছ। আমি তোমাকে নিশ্চয় বলছি মন্ত্রী এ সমস্তই সে তার স্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে করেছে। কী বোধ হয়?
    মন্ত্রী। কেমন করে বলব মহারাজ?
    প্রতাপাদিত্য। আমি কি তোমার কাছে বেদবাক্য শুনতে চাচ্ছি? তুমি কী আন্দাজ কর তাই জিজ্ঞাসা করছি।
 

এক জন পাঠানের প্রবেশ

    প্রতাপাদিত্য। কী হল?
    পাঠান। মহারাজ, এতক্ষণে কাজ নিকেশ হয়ে গেছে।
    প্রতাপাদিত্য। সে কী রকম কথা? তবে তুমি জান না?
    পাঠান। জানি বই কি। কাজ শেষ হয়ে গেছে ভুল নেই, তবে আমি সে সময়ে উপস্থিত ছিলুম না। আমার ভাই হোসেন খাঁর উপর ভার আছে, সে খুব হুঁশিয়ার। মহারাজের পরামর্শমতে আমি খুড়ারাজা-সাহেবের লোকজনদের তফাত করেই চলে আসছি।
    প্রতাপাদিত্য। হোসেন যদি ফাঁকি দেয়?
    পাঠান। তোবা! সে তেমন বেইমান নয়। মহারাজ, আমি আমার শির জামিন রাখলুম।
    প্রতাপাদিত্য। আচ্ছা, এইখানে হাজির থাকো, তোমার ভাই ফিরে এলে বকশিশ মিলবে। (পাঠানের বাহিরে গমন) এটা যাতে প্রজারা টের না পায় সে চেষ্টা করতে হবে।
    মন্ত্রী। মহারাজ, এ কথা গোপন থাকবে না।
    প্রতাপাদিত্য। কিসে তুমি জানলে?
    মন্ত্রী। আপনার পিতৃব্যের প্রতি বিদ্বেষ আপনি তো কোনোদিন লুকোতে পারেন নি। এমন-কি, আপনার কন্যার বিবাহেও আপনি তাঁকে নিমন্ত্রণ করেন নি
তিনি বিনা নিমন্ত্রণেই এসেছিলেন। আর আজ আপনি অকারণে তাঁকে নিমন্ত্রণ করলেন, আর পথে এই কাণ্ডটি ঘটল, এমন অবস্থায় প্রজারা আপনাকেই এর মূল বলে জানবে।
    প্রতাপাদিত্য। তাহলেই তুমি খুশি হও! না?
    মন্ত্রী। মহারাজ, এমন কথা কেন বলছেন? আপনার ধর্ম-অধর্ম পাপপুণ্যের বিচার আমি করি নে, কিন্তু রাজ্যের ভালোমন্দর কথাও যদি আমাকে ভাবতে না দেবেন তবে আমি আছি কী করতে? কেবল প্রতিবাদ করে মহারাজের জেদ বাড়িয়ে তোলবার জন্যে?
    প্রতাপাদিত্য। আচ্ছা, ভালোমন্দর কথাটা কী ঠাওরালে শুনি।
    মন্ত্রী। আমি এই কথা বলছি, পদে পদে প্রজাদের মনে অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলবেন না। দেখুন, মাধবপুরের প্রজারা খুব প্রবল এবং আপনার বিশেষ বাধ্য নয়। তারা রাজ্যের সীমানার কাছে থাকে, পাছে আপনার প্রতিবেশী শত্রুপক্ষের সঙ্গে যোগ দেয় এই ভয়ে তাদের গায়ে হাত তোলা যায় না। সেইজন্য মাধবপুর-শাসনের ভার যুবরাজের উপর দেবার কথা আমিই মহারাজকে বলেছিলেম।
    প্রতাপাদিত্য। সে তো বলেছিলে। তার ফল কী হল দেখো না। আজ দু-বৎসরের খাজনা বাকি। সকল মহল থেকে টাকা এল, আর ওখান থেকে কী আদায় হল?
    মন্ত্রী। আজ্ঞে আশীর্বাদ। তেমন সব বজ্জাত প্রজাও যুবরাজের পায়ের গোলাম হয়ে গেছে। টাকার চেয়ে কি তার কম দাম? সেই যুবরাজের কাছ থেকে আপনি মাধবপুরের ভার কেড়ে নিলেন। সমস্তই উলটে গেল। এর চেয়ে তাঁকে না পাঠানোই ভালো ছিল। সেখানকার প্রজারা তো হন্যে কুকুরের মত খেপে রয়েছে
তার পরে আবার যদি এই কথাটা প্রকাশ হয় তা হলে কী হয় বলা যায় না। রাজকার্যে ছোটোদেরও অবজ্ঞা করতে নেই মহারাজ! অসহ্য হলেই ছোটোরা জোট বাঁধে, জোট বাঁধলেই ছোটোরা বড়ো হয়ে ওঠে।
    প্রতাপাদিত্য। সেই ধনঞ্জয় বৈরাগী তো মাধবপুরে থাকে!
    মন্ত্রী। আজ্ঞে হাঁ।
    প্রতাপাদিত্য। সেই বেটাই যত নষ্টের গোড়া। ধর্মের ভেক ধরে সেই তো যত প্রজাকে নাচিয়ে তোলে। সেই তো প্রজাদের পরামর্শ দিয়ে খাজনা বন্ধ করিয়েছে। উদয়কে বলেছিলুম যেমন করে হোক তাকে আচ্ছা করে শাসন করে দিতে। কিন্তু উদয়কে জান তো? এদিকে তার না আছে তেজ, না আছে পৌরুষ, কিন্তু একগুঁয়েমির অন্ত নেই। ধনঞ্জয়কে শাসন দূরে থাক্ তাকে আস্পর্ধা দিয়ে বাড়িয়ে তুলেছে। এবারে তার কণ্ঠীসুদ্ধ কণ্ঠ চেপে ধরতে হচ্ছে, তার পরে দেখা যাবে তোমার মাধবপুরের প্রজাদের কতবড়ো বুকের পাটা! আর দেখো, লোকজন আজই সব ঠিক করে রাখো
খবরটা পাবামাত্রই রায়গড়ে গিয়ে বসতে হবে। সেইখানেই শ্রাদ্ধশান্তি করব আমি ছাড়া উত্তরাধিকারী আর তো কাউকে দেখি নে।


বসন্ত রায়ের প্রবেশ। প্রতাপাদিত্য চমকিয়া উঠিয়া দণ্ডায়মান
 

    বসন্ত রায়। আমাকে কিসের ভয় প্রতাপ? আমি তোমার পিতৃব্য; তাতেও যদি বিশ্বাস না হয়, আমি বৃদ্ধ, তোমার কোনো অনিষ্ট করি এমন শক্তিই নেই। (প্রতাপ নীরব) প্রতাপ একবার রায়গড়ে চলো ছেলেবেলা কতদিন সেখানে কাটিয়েছ তারপরে বহুকাল সেখানে যাও নি।
    প্রতাপাদিত্য। (নেপথ্যের দিকে চাহিয়া সগর্জনে) খবরদার! ঐ পাঠানকে ছাড়িস নে! [দ্রুত প্রস্থান
    প্রতাপাদিত্য। দেখো মন্ত্রী, রাজকার্যে তোমার অত্যন্ত অমনোযোগ দেখা যাচ্ছে।
    মন্ত্রী। মহারাজ, এ বিষয়ে আমার কোনো অপরাধ নেই।
    প্রতাপাদিত্য। এ বিষয়ের কথা তোমাকে কে বলছে? আমি বলছি রাজকার্যে তোমার অত্যন্ত অমনোযোগ দেখছি। সেদিন তোমাকে চিঠি রাখতে দিলেম, হারিয়ে ফেললে! আর একদিন মনে আছে উমেশ রায়ের কাছে তোমাকে যেতে বলেছিলুম, তুমি লোক দিয়ে কাজ সেরেছিলে।
    মন্ত্রী। আজ্ঞে মহারাজ

    প্রতাপাদিত্য। চুপ করো। দোষ কাটাবার জন্যে মিথ্যে চেষ্টা ক'রো না। যাহোক তোমাকে জানিয়ে রাখছি রাজকার্যে তুমি কিছুমাত্র মনোযোগ দিচ্ছ না। যাও, কাল রাত্রে যারা পাহারায় ছিল তাদের কয়েদ করো গে।



রাজান্তঃপুর
সুরমা ও বিভা

    সুরমা। (বিভার গলা ধরিয়া) তুই অমন চুপ করে থাকিস কেন ভাই? যা মনে আছে বলিস নে কেন?
    বিভা। আমার আর কী বলবার আছে?
    সুরমা। অনেকদিন তাঁকে দেখিস নি। তা তুইই নাহয় তাঁকে একখানা চিঠি লেখ্‌ না। আমি তোর দাদাকে দিয়ে পাঠাবার সুবিধা করে দেব।

    বিভা। যেখানে তাঁর আদর নেই সেখানে আসবার জন্যে আমি কেন তাঁকে লিখব? তিনি আমাদের চেয়ে কিসে ছোটো?
    সুরমা। আচ্ছা গো আচ্ছা, না হয় তিনি খুব মানী, তাই বলে মানটাই কি সংসারে সকলের চেয়ে বড়ো হল? সেটা কি বিসর্জন করবার কোনো জায়গা নেই।
                                    গান
            ওর     মানের এ বাঁধ টুটবে না কি টুটবে না?
            ওর     মনের বেদন থাকবে মনে
                            প্রাণের কথা ফুটবে না?
                    কঠিন পাষাণ বুকে লয়ে
                    নাই রহিল অটল হয়ে।
                    প্রেমেতে ঐ পাথর খ'য়ে
                            চোখের জল কি ছুটবে না?

আচ্ছা বিভা, তুই যদি পুরুষ হতিস তো কী করতিস? নিমন্ত্রণ-চিঠি না পেলে এক পা নড়তিস নে নাকি?
    বিভা। আমার কথা ছেড়ে দাও
কিন্তু তাই বলে
    সুরমা। বিভা, শুনেছিস দাদামশায় এসে পৌঁছেছেন।
    বিভা। এখানে এলেন কেন ভাই? আবার তো কিছু বিপদ ঘটবে না?
    সুরমা। বিপদের মুখের উপর তেড়ে এলে বিপদ ছুটে পালায়।
    বিভা। না ভাই, আমার বুকের ভিতর এখনও কেঁপে উঠছে। আমার এমন একটা ভয় ধরে গেছে কিছুতে ছাড়ছে না; আমার মনে হচ্ছে কী যেন একটা হবে। মনে হচ্ছে যেন কাকে সাবধান করে দেবার আছে। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আচ্ছা, তিনি আমাদের দেখতে এখনও এলেন না কেন?
                        বসন্ত রায়ের প্রবেশ ও গান

            আজ তোমারে দেখতে এলেম
                    অনেক দিনের পরে।
            ভয় করো না সুখে থাকো
            বেশিক্ষণ থাকব নাকো,
                        এসেছি    দণ্ড দুয়ের তরে।
            দেখব শুধু মুখখানি,
            শোনাও যদি শুনব বাণী,
       না হয় যাব আড়াল থেকে
                হাসি দেখে দেশান্তরে।

    সুরমা। (বিভার চিবুক ধরিয়া) দাদামশায়, বিভার হাসি দেখবার জন্যে তো আড়ালে যেতে হল না। এবার তবে দেশান্তরের উদ্‌যোগ করো।
    বসন্ত রায়। না না, অত সহজে না। অমনি যে ফাঁকি দিয়ে হেসে তাড়াবে আমি তেমন পাত্র না। কেঁদে না তাড়ালে বুড়ো বিদায় হবে না। গোটা পনেরো নতুন গান আর একমাথা পুরানো পাকাচুল এনেছি সমস্ত নিকেশ না করে নড়ছি নে।
    বিভা। মিছে বড়াই কর কেন? আধমাথা বই চুলই নেই!
    বসন্ত রায়। (মাথায় হাত বুলাইয়া) ওরে সে একদিন গেছে রে ভাই। বললে বিশ্বাস করবি নে, বসন্ত রায়েরও মাথায় একেবারে মাথাভরা চুল ছিল। সেদিন কি আর এত রাস্তা পেরিয়ে তোদের খোশামোদ করতে আসতুম। সেদিন একটা চুল পেকেছে কি, অমনি পাঁচটা রূপসী তোলবার জন্যে উমেদার হত। মনের আগ্রহে কাঁচাচুল সুদ্ধ উজাড় করে দেবার জো করত।
    সুরমা। দাদামশায়, টাকের আলোচনা পরে হবে, এখন বিভার একটা যা হয় উপায় করে দাও।
    বসন্ত রায়। সেও কি আমাকে আবার বলতে হবে না কি? এতক্ষণ কী করছিলুম? এই যে বুড়োটা রয়েছে এ কি কোনো কাজেই লাগে না মনে করছ?
                            গান

        মলিন মুখে ফুটুক হাসি, জুড়াক দু-নয়ন
        মলিন বসন ছাড়ো সখী, পরো আভরণ।
                অশ্রুধোয়া কাজলরেখা
                আবার চোখে দিক না দেখা,
        শিথিল বেণী তুলুক বেঁধে কুসুমবন্ধন।

    বিভা। দাদামশায়, সত্যি তুমি বাবার কাছে কিছু বলেছ?
    বসন্ত রায়। একটা কিছু যে বলেছি তার সাক্ষী আমি থাকতে থাকতেই হাজির হবে।
    বিভা। কেন এমন কাজ করতে গেলে?
    বসন্ত রায়। খুব করেছি বেশ করেছি।
    বিভা। না দাদামশায়, আমি ভারি রাগ করেছি।
    বসন্ত রায়। এই বুঝি বকশিশ! যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর!
    বিভা। না, সত্যি বলছি, কেন তুমি বাবাকে অনুরোধ করতে গেলে?
    বসন্ত রায়। দিদি, রাজার ঘরে যখন জন্মেছিস তখন অভিমান করে ফল নেই
এরা সব পাথর।
    বিভা। আমার নিজের জন্যে অভিমান করি বুঝি! তিনি যে মানী, তাঁর অপমান কেন হবে?
    বসন্ত রায়। আচ্ছা বেশ, সে আমার সঙ্গে তার বোঝাপড়া হবে। ওরে তুই এখন


                                    গান
                                পিলু বারোয়াঁ
                    মান অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে
                                এগিয়ে নিয়ে আয়

                    তারে     এগিয়ে নিয়ে আয়।
                   চোখের জলে মিশিয়ে হাসি
                                ঢেলে দে তার পায়

                   ওরে ঢেলে দে তার পায়।
                    আসছে পথে ছায়া পড়ে,
                    আকাশ এল আঁধার করে,
                    শুষ্ক কুসুম পড়ছে ঝরে
                                সময় বহে যায়

                    ওরে সময় বহে যায়।
 


মাধবপুরের পথ
ধনঞ্জয় ও প্রজাদল

    ধনঞ্জয়। একেবারে সব মুখ চুন করে আছিস কেন? মেরেছে বেশ করেছে। এতদিন আমার কাছে আছিস বেটারা এখনও ভালো করে মার খেতে শিখলি নে? হাড়গোড় সব ভেঙ্গে গেছে নাকি রে?
    ১। রাজার কাছারিতে ধরে মারলে সে বড়ো অপমান!
    ধনঞ্জয়। আমার চেলা হয়েও তোদের মানসম্ভ্রম আছে? এখনো সবাই তোদের গায়ে ধুলো দেয় না রে? তবে এখনও তোরা ধরা পড়িস নি? তবে এখনও আরও অনেক বাকি আছে!
    ২। বাকি আর রইল কী ঠাকুর। এদিকে পেটের জ্বালায় মরছি, ওদিকে পিঠের জ্বালাও ধরিয়ে দিলে।
    ধনঞ্জয়। বেশ হয়েছে, বেশ হয়েছে
একবার খুব করে নেচে নে!
 

                                গান
            আরো আরো প্রভু আরো আরো।
            এমনি করে আমায় মারো।
            লুকিয়ে থাকি আমি পালিয়ে বেড়াই,
            ধরা পড়ে গেছি আর কি এড়াই?
            যা কিছু আছে সব কাড়ো কাড়ো।
            এবার যা করবার তা সারো সারো।
            আমি হারি কিংবা তুমিই হারো!
            হাটে ঘাটে বাটে করি মেলা,
            কেবল হেসে খেলে গেছে বেলা,
            দেখি কেমনে কাঁদাতে পার।

    ২। আচ্ছা ঠাকুর, তুমি কোথায় চলেছ বলো দেখি।
    ধনঞ্জয়। যশোর যাচ্ছি রে।
    ৩। কী সর্বনাশ! সেখানে কী করতে যাচ্ছ?
    ধনঞ্জয়। একবার রাজাকে দেখে আসি। চিরকাল কি তোদের সঙ্গেই কাটাব? এবার রাজদরবারে নাম রেখে আসব।
    ৪। তোমার উপরে রাজার যে ভারি রাগ। তার কাছে গেলে কি তোমার রক্ষা আছে?
    ৫। জান তো যুবরাজ তোমাকে শাসন করতে চায় নি বলে তাকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
    ধনঞ্জয়। তোরা যে মার সইতে পারিস নে। সেই জন্যে তোদের মারগুলো সব নিজের পিঠে নেবার জন্যে স্বয়ং রাজার কাছে চলেছি। পেয়াদা নয় রে পেয়াদা নয়
যেখানে স্বয়ং মারের বাবা বসে আছে সেইখানে ছুটেছি।
    ১। না, না, সে হবে না ঠাকুর, সে হবে না।
    ধনঞ্জয়। খুব হবে
পেট ভরে হবে, আনন্দে হবে!
    ১। তবে আমরাও তোমার সঙ্গে যাব।
    ধনঞ্জয়। পেয়াদার হাতে আশ মেটে নি বুঝি?
    ২। না ঠাকুর, সেখানে একলা যেতে পারছ না, আমরাও সঙ্গে যাব।
    ধনঞ্জয়। আচ্ছা, যেতে চাস তো চল্‌। এক বার শহরটা দেখে আসবি।
    ৩। কিছু হাতিয়ার সঙ্গে নিতে হবে।
    ধনঞ্জয়। কেন রে? হাতিয়ার নিয়ে কী করবি?
    ৩। যদি তোমার গায়ে হাত দেয় তাহলে

    ধনঞ্জয়। তা হলে তোরা দেখিয়ে দিবি হাত দিয়ে না মেরে কী করে হাতিয়ার দিয়ে মারতে হয়। কী আমার উপকারটা করতেই যাচ্ছ! তোদের যদি এই রকম বুদ্ধি হয় তবে এইখানেই থাক্‌।
    ৪। না, না, তুমি যা বলবে তাই করব কিন্তু আমরা তোমার সঙ্গে থাকব।
    ৩। আমরাও রাজার কাছে দরবার করব।
    ধনঞ্জয়। কী চাইবি রে?
    ৩। আমরা যুবরাজকে চাইব।
    ধনঞ্জয়। বেশ, বেশ, অর্ধেক রাজত্ব চাইবি নে?
    ৩। ঠাট্টা করছ ঠাকুর!
    ধনঞ্জয়। ঠাট্টা কেন করব? সব রাজত্বটাই কি রাজার? অর্ধেক রাজত্ব প্রজার নয় তো কী? চাইতে দোষ নেই রে। চেয়ে দেখিস।
    ৪। যখন তাড়া দেবে?
    ধনঞ্জয়। তখন আবার চাইব। তুই কি ভাবিস রাজা একলা শোনে? আরও একজন শোনবার লোক রাজদরবারে বসে থাকেন-- শুনতে শুনতে তিনি একদিন মঞ্জুর করেন, তখন রাজার তাড়াতে কিছুই ক্ষতি হয় না।

                        গান

            আমরা     বসব তোমার সনে।
            তোমার     শরিক হব রাজার রাজা,
                            তোমার আধেক সিংহাসনে।
            তোমার     দ্বারী মোদের করেছে শির নত,
            তারা         জানে না যে মোদের গরব কত,
            তাই         বাহির হতে তোমায় ডাকি
                            তুমি ডেকে লও গো আপন জনে।