ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
প্রায়শ্চিত্ত
দ্বিতীয় অঙ্ক
১
চন্দ্রদ্বীপ। রাজা রামচন্দ্র রায়ের কক্ষ
রামচন্দ্র, রমাই ভাঁড়, ফর্নাণ্ডিজ ও মন্ত্রী
রামচন্দ্র। (তামাকু টানিয়া) ওহে রমাই।
রমাই। আজ্ঞা মহারাজ!
রামচন্দ্র। হাঃ হাঃ হাঃ।
মন্ত্রী। হোঃ হোঃ হোঃ।
ফর্নাণ্ডিজ। (হাততালি দিয়া) হিঃ হিঃ হিঃ— হিঃ হিঃ হিঃ।
রামচন্দ্র। খবর কী হে?
রমাই। পরম্পরায় শুনা গেল, সেনাপতি মশাইয়ের ঘরে চোর পড়েছিল।
রামচন্দ্র। (চোখ টিপিয়া) তার পরে?
রমাই। নিবেদন করি মহারাজ! (ফর্নাণ্ডিজ তাঁর কোর্তার বোতাম খুলছেন ও দিচ্ছেন) আজ দিন
তিন-চার ধরে সেনাপতি মশাইয়ের ঘরে রাত্রে চোর আনাগোনা করছিল। সাহেবের ব্রাহ্মণী
জানতে পেরে কর্তাকে অনেক ঠেলাঠেলি করেন, কিন্তু কোনোমতেই কর্তার ঘুম ভাঙাতে পারেন
নি।
রামচন্দ্র।
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।
মন্ত্রী।
হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ।
সেনাপতি।
হিঃ হিঃ হিঃ।
রমাই। তারপর দিনের বেলায় গৃহিণীর নিগ্রহ আর সইতে না পেরে জোড় হস্তে বললেন, "দোহাই
তোমার, আজ রাত্রে চোর ধরব।" রাত্রি দুই দণ্ডের সময় গিন্নী বললেন, "ওগো চোর এসেছে।"
কর্তা বললেন, "ওই যাঃ ঘরে যে আলো জ্বলছে!" চোরকে ডেকে বললেন,"আজ তুই বড়ো বেঁচে
গেলি। ঘরে আলো আছে, আজ নিরাপদে পালাতে পারবি, কাল আসিস দেখি— অন্ধকারে কেমন না ধরা পড়িস।"
রামচন্দ্র।
হা হা হা হা।
মন্ত্রী।
হো হো হো হো হো।
সেনাপতি।
হি।
রামচন্দ্র।
তার পরে?
রমাই।
জানি না, কী কারণে চোরের যথেষ্ট ভয় হল না তার পর রাত্রেও ঘরে এল। গিন্নী বললেন,
"সর্বনাশ হল, ওঠ।" কর্তা বললেন, "তুমি ওঠ না।" গিন্নী বললেন, "আমি উঠে কী করব?"
কর্তা বললেন, "কেন, ঘরে একটা আলো জ্বালাও না, কিছু যে দেখতে পাচ্ছি না।" গিন্নী
বিষম ক্রুদ্ধ; কর্তা ততোধিক ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, "দেখো দেখি। তোমার জন্যই তো
যথাসর্বস্ব গেল। আলোটা জ্বালাও। বন্দুকটা আনো।" ইতিমধ্যে চোর কাজকর্ম সেরে বললে,
"মশাই এক ছিলিম তামাক খাওয়াতে পারেন? বড়ো পরিশ্রম হয়েছে।" কর্তা বিষম ধমক দিয়ে
বললেন," রোস বেটা! আমি তামাক সেজে দিচ্ছি। কিন্তু আমার কাছে আসবি তো এই বন্দুকে তোর
মাথা উড়িয়ে দেব।" তামাক খেয়ে চোর বললে,"মশাই, আলোটা যদি জ্বালেন তো বড়ো উপকার হয়।
সিঁদকাটিটা পড়ে গেছে, খুঁজে পাচ্ছি না।" সেনাপতি বললেন, "বেটার ভয় হয়েছে। তফাতে
থাক্, কাছে আসিস নে।" বলে তাড়াতাড়ি আলো জ্বালিয়ে দিলেন। ধীরে সুস্থে জিনিসপত্র
বেঁধে চোর তো চলে গেল। কর্তা গিন্নীকে বললেন,"বেটা বিষম ভয় পেয়েছে।"
রামচন্দ্র।
রমাই, শুনেছ আমি শ্বশুরালয়ে যাচ্ছি?
রমাই।
(মুখভঙ্গি করিয়া) অসারং খলু সংসারং সারং শ্বশুরমন্দিরং (সকলের হাস্য) কথাটা মিথ্যা
নয় মহারাজ! (দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলিয়া) শ্বশুরমন্দিরের সকলই সারপদার্থ!
—দুধের সরটি পাওয়া যায়, মাছের মুড়োটি পাওয়া যায়—
সকলই সারপদার্থ! কেবল সর্বাপেক্ষা অসার ওই যিনি—
রামচন্দ্র। (হাসিয়া) সে কী হে, তোমার অর্ধাঙ্গ—
রমাই।
(জোড়হস্তে ব্যাকুলভাবে) মহারাজ, তাকে অর্ধাঙ্গ বলবেন না। তিন জন্ম তপস্যা করলে আমি
বরঞ্চ একদিন তার অর্ধাঙ্গ হতে পারব এমন ভরসা আছে। আমার মতন পাঁচটা অর্ধাঙ্গ জুড়লেও
তার আয়তনে কুলোয় না।
[ যথাক্রমে সকলের হাস্য
রামচন্দ্র।
আমি তো শুনেছি, তোমার ব্রাহ্মণী বড়োই শান্তস্বভাবা, ঘরকন্নায় বিশেষ পটু।
রমাই।
সেকথায় কাজ কী! ঘরে আর সকল রকমই জঞ্জাল আছে, কেবল আমি তিষ্ঠতে পারি না। প্রত্যুষে
গৃহিণী এমনি ঝেঁটিয়ে দেন যে একেবারে মহারাজের দুয়ারে এসে পড়ি।
[ সকলের হাস্য
রামচন্দ্র।
ওহে রমাই, তোমাকে এবার যে যেতে হবে, সেনাপতিকে সঙ্গে নেব। (সেনাপতিকে) যাত্রার জন্য
সমস্ত উদ্যোগ করো। আমার চৌষট্টি দাঁড়ের নৌকা যেন প্রস্তুত থাকে।
[ মন্ত্রী ও সেনাপতির প্রস্থান
রামচন্দ্র।
রমাই, তুমি তো সমস্তই শুনেছ। গতবারে শ্বশুরালয়ে আমাকে বড়োই মাটি করেছিল!
রমাই।
আজ্ঞে হাঁ, মহারাজের লেজ বানিয়ে দিয়েছিল।
রামচন্দ্র।
(কাষ্ঠ হাসিয়া তাম্রকূট সেবন)
রমাই।
আপনার এক শ্যালক এসে আমাকে বললেন, বাসরঘরে তোমাদের রাজার লেজ প্রকাশ পেয়েছে। তিনি
রামচন্দ্র না রামদাস? এমন তো পূর্বে জানতাম না। আমি তৎক্ষণাৎ বললুম, "পূর্বে জানবেন
কী করে? পূর্বে তো ছিল না। আপনাদের ঘরে বিবাহ করতে এসেছেন, তাই যস্মিন্ দেশে
যদাচার।"
রামচন্দ্র।
রমাই, এবারে গিয়ে জিতে আসতে হবে। যদি জয় হয় তবে তোমাকে আমার আংটি উপহার দেব।
রমাই।
মহারাজ, জয়ের ভাবনা কী? রমাইকে যদি অন্তঃপুরে নিয়ে যেতে পারেন, তবে স্বয়ং
শাশুড়ীঠাকরুনকে পর্যন্ত মনের সাধে ঘোল খাইয়ে আসতে পারি।
রামচন্দ্র।
তার ভাবনা? তোমাকে আমি অন্তঃপুরেই নিয়ে যাব।
রমাই।
আপনার অসাধ্য কী আছে?
২
পথপার্শ্বে ধনঞ্জয় বৈরাগী ও মাধবপুরের একদল প্রজা
১।
বাবাঠাকুর, রাজার কাছে যাচ্ছ, কিন্তু তিনি তোমাকে সহজে ছাড়বেন না।
ধনঞ্জয়।
ছাড়বেন কেন বাপসকল! আদর করে ধরে রাখবেন।
১।
সে আদরের ধরা নয়।
ধনঞ্জয়। ধরে রাখতে কষ্ট আছে বাপ— পাহারা দিতে হয়— যে-সে লোককে কি রাজা এত আদর করে?
রাজবাড়িতে কত লোক যায়, দরজা থেকেই ফেরে— আমাকে ফেরাবে না।
গান
আমাকে যে বাঁধবে ধরে এই হবে যার সাধন,
সে কি অমনি হবে!
আপনাকে সে বাঁধা দিয়ে আমায় দেবে বাঁধন।
সে কি অমনি হবে!
আমাকে যে দুঃখ দিয়ে আনবে আপন বশে—
সে কি অমনি হবে!
তার আগে তার পাষাণ হিয়া গলবে করুণ রসে
সে কি অমনি হবে!
আমাকে যে কাঁদাবে তার ভাগ্যে আছে কাঁদন
সে কি অমনি হবে!
২।
বাবাঠাকুর, তোমার গায়ে যদি রাজা হাত দেন তাহলে কিন্তু আমরা সইতে পারব না।
ধনঞ্জয়। আমার এই গা যাঁর তিনি যদি সইতে পারেন বাবা, তবে তোমাদেরও সইবে। যেদিন থেকে
জন্মেছি আমার এই গায়ে তিনি কত দুঃখই সইলেন—
কত মার খেলেন, কত ধুলোই মাখলেন—
হায় হায়—
কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে?
আপনি কেন এলে বঁধু আমার বোঝা বইতে?
প্রাণের বন্ধু বুকের বন্ধু
সুখের বন্ধু দুখের বন্ধু
(তোমায়) দেব না দুখ পাব না দুখ
হেরব তোমার প্রসন্ন মুখ,
(আমি) সুখে দুঃখে পারব বন্ধু চিরানন্দে
রইতে—
তোমার সঙ্গে বিনা কথায় মনের কথা কইতে।
৩।
বাবা, আমরা রাজাকে গিয়ে কী বলব?
ধনঞ্জয়।
বলব, আমরা খাজনা দেব না।
৩।
যদি শুধোয় কেন দিবি নে?
ধনঞ্জয়। বলব, ঘরের ছেলেমেয়েকে কাঁদিয়ে যদি তোমাকে টাকা দিই তা হলে আমাদের ঠাকুর
কষ্ট পাবে। যে অন্নে প্রাণ বাঁচে সেই অন্নে ঠাকুরের ভোগ হয়; তিনি যে প্রাণের ঠাকুর।
তার বেশি যখন ঘরে থাকে তখন তোমাকে দিই— কিন্তু ঠাকুরকে ফাঁকি দিয়ে তোমাকে খাজনা দিতে পারব
না।
৪।
বাবা, এ কথা রাজা শুনবে না।
ধনঞ্জয়।
তবু শোনাতে হবে। রাজা হয়েছে বলেই কি সে এমন হতভাগা যে ভগবান তাকে সত্য কথা শুনতে
দেবেন না? ওরে জোর করে শুনিয়ে আসব।
৫। ও ঠাকুর, তাঁর জোর যে আমাদের চেয়ে বেশি— তাঁরই জিত হবে।
ধনঞ্জয়। দূর বাঁদর, এই বুঝি তোদের বুদ্ধি! যে হারে তার বুঝি জোর নেই! তার জোর যে
একেবারে বৈকুণ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছোয় তা জানিস?
৬। কিন্তু ঠাকুর, আমরা দূরে ছিলুম, লুকিয়ে বাঁচতুম— একেবারে রাজার দরজায় গিয়ে পড়ব,
শেষে দায়ে ঠেকলে আর পালাবার পথ থাকবে না।
ধনঞ্জয়।
দেখ্ পাঁচকড়ি, অমন চাপাচুপি দিয়ে রাখলে ভালো হয় না। যতদূর পর্যন্ত হবার তা হতে দে,
নইলে কিছুই শেষ হতে চায় না। যখন চূড়ান্ত হয় তখনই শান্তি হয়।
৭।
তোরা অত ভয় করছিস কেন? বাবা যখন আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন উনি আমাদের বাঁচিয়ে আনবেন।
ধনঞ্জয়। তোদের এই বাবা যার ভরসায় চলেছে তার নাম কর্। বেটারা কেবল তোরা বাঁচতেই
চাস্— পণ
করে বসেছিস যে মরবি নে। কেন, মরতে দোষ কী হয়েছে? যিনি মারেন তাঁর গুণগান করবি নে
বুঝি! ওরে সেই গানটা ধর্।
গান
বলো ভাই ধন্য হরি।
বাঁচান বাঁচি, মারেন মরি।
ধন্য হরি সুখের নাটে,
ধন্য হরি রাজ্যপাটে।
ধন্য হরি শ্মশান-ঘাটে—
ধন্য হরি, ধন্য হরি।
সুধা দিয়ে মাতান যখন
ধন্য হরি, ধন্য হরি।
ব্যথা দিয়ে কাঁদান যখন
ধন্য হরি, ধন্য হরি।
আত্মজনের কোলে বুকে
ধন্য হরি হাসিমুখে—
ছাই দিয়ে সব ঘরের সুখে
ধন্য হরি, ধন্য হরি।
আপনি কাছে আসেন হেসে
ধন্য হরি, ধন্য হরি।
খুঁজিয়ে বেড়ান দেশে দেশে
ধন্য হরি, ধন্য হরি।
ধন্য হরি স্থলে জলে,
ধন্য হরি ফুলে ফলে—
ধন্য হৃদয়পদ্মদলে
চরণ-আলোয় ধন্য করি।
৩
বিভার কক্ষ
রামমোহনের প্রবেশ ও প্রণাম
বিভা।
মোহন তুই এতদিন আসিস নি কেন?
রামমোহন।
তা মা, কুপুত্র যদি-বা হয়, কুমাতা কখনো নয়, তুমি কোন্ আমাকে মনে করেছ? সে কথা বলো।
একবার ডাকলেই তো হত। অমনি লজ্জা হল। আর মুখে উত্তরটি নেই! না না, মা, অবসর পাই নে
বলেই আসতে পারি নে—
নইলে মনে মনে ঐ চরণপদ্ম দুখানি কখনো তো ভুলি নে।
বিভা।
মোহন তুই বোস, তোদের দেশের গল্প আমায় বল্।
রাম।
মা, তোমার জন্যে চারগাছি শাঁখা এনেছি, তোমাকে ওই হাতে পরতে হবে, আমি দেখব।
মহিষীর প্রবেশ
বিভা।
(স্বর্ণালংকার খুলিয়া, হাতে শাঁখা পরিয়া) এই দেখো মা। মোহন তোমার চুড়ি খুলে আমায়
চারগাছি শাঁখা পরিয়ে দিয়েছে।
মহিষী।
(হাসিয়া) তা বেশ তো মানিয়েছে। মোহন, এই বারে তোর সেই আগমনী গানটি গা। তোর গান শুনতে
আমার বড়ো ভালো লাগে।
রামমোহন।
গান
সারা বরষ দেখি নে মা,
মা তুই আমার কেমন ধারা?
নয়নতারা
হারিয়ে আমার
অন্ধ হল নয়নতারা।
এলি কি পাষাণী
ওরে?
দেখব তোরে আঁখি ভরে,
কিছুতেই থামে না যে মা,
পোড়া এ নয়নের ধারা।
মহিষী।
মোহন চল্, তোকে খাইয়ে আনি গে।
[রামমোহন ও মহিষীর প্রস্থান
সুরমা ও বসন্ত রায়ের প্রবেশ
বসন্ত রায়।
সুরমা, ও সুরমা। একবার দেখে যাও। তোমাদের বিভার মুখখানি দেখো। বয়স যদি না যেত তো আজ
তোর ঐ মুখ দেখে এইখানে মাথা ঘুরে পড়তুম আর মরতুম। হায় হায়— মরবার বয়স গেছে!
যৌবনকালে ঘড়ি ঘড়ি মরতুম। বুড়োবয়সে রোগ না হলে আর মরণ হয় না।
গান
হাসিরে কি লুকাবি লাজে
চপলা সে বাঁধা পড়ে না যে।
রুধিয়া অধর-দ্বারে
ঝাঁপিতে চাহিলি তারে
অমনি সে ছুটে এল নয়নমাঝে!
৪
প্রমোদসভা। নৃত্যগীত
রামচন্দ্র রায়
নটীর গান
পরজ বসন্ত। কাওয়ালি
না বলে যেয়ো না চলে মিনতি করি!
গোপনে জীবন মন লইয়া হরি।
সারা নিশি জেগে থাকি,
ঘুমে ঢুলে পড়ে আঁখি,
ঘুমালে হারাই পাছে সে ভয়ে মরি।
চকিতে চমকি বঁধু, তোমারে খুঁজি
থেকে থেকে মনে হয় স্বপন বুঝি!
নিশিদিন চাহে হিয়া
পরান পসারি দিয়া
অধীর চরণ তব বাঁধিয়া ধরি।
[রামচন্দ্র রায় মাঝে মাঝে বাহবা দিতেছেন, মাঝে মাঝে উৎকণ্ঠিত
হইয়া দ্বারের দিকে চাহিতেছেন ]
রামচন্দ্র।
(দ্বারের কাছে উঠিয়া আসিয়া অনুচরের প্রতি) রমাইয়ের খবর কী?
অনুচর।
কিছু তো জানি নে!
রামচন্দ্র।
এখনও ফিরল না কেন? ধরা পড়ে নি তো?
অনুচর।
হুজুর, বলতে তো পারি নে।
রামচন্দ্র। (ফিরিয়া আসিয়া আসনে বসিয়া) গাও, গাও, তোমরা গাও! কিন্তু ওটা নয়— একটা জলদ তাল
লাগাও!
নটীর গান
ভৈরবী। কাওয়ালি
ও যে মানে না মানা।
আঁখি ফিরাইলে বলে, "না, না, না।'
যত বলি "নাই রাতি,
মলিন হয়েছে বাতি,'
মুখপানে চেয়ে বলে, "না, না, না।'
বিধুর বিকল হয়ে খেপা পবনে
ফাগুন করিছে হাহা ফুলের বনে।
আমি যত বলি "তবে
এবার যে যেতে হবে'
দুয়ারে দাঁড়ায়ে বলে, "না, না, না।'
রামচন্দ্র।
এ কী রকম হল! গান শুনে যে কেবলই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে!
রামমোহনের প্রবেশ
রামমোহন।
একবার উঠে আসুন।
রামচন্দ্র।
কেন, উঠব কেন?
রামমোহন।
শীঘ্র আসুন আর দেরি করবেন না।
রামচন্দ্র। চমৎকার গান জমেছে— এখন আর বিরক্ত করিস নে।
রামমোহন। যুবরাজ ডেকে পাঠিয়েছেন— বিশেষ কথা আছে।
রামচন্দ্র।
আচ্ছা, তোমরা গান করো, আমি আসছি। রমাইয়ের কী হল জান? এখনও সে এলো না কেন?
৫
প্রতাপাদিত্যের শয়নকক্ষ
প্রতাপাদিত্য ও লছমন সর্দার
প্রতাপাদিত্য।
দেখো লছমন, আজ রাত্রে আমি রামচন্দ্র রায়ের ছিন্ন মুণ্ডু দেখতে চাই।
লছমন।
(সেলাম করিয়া) যো হুকুম মহারাজ!
রাজশ্যালকের প্রবেশ
রাজশ্যালক।
(পদতলে পড়িয়া) মহারাজ, মার্জনা করুন, বিভার কথা একবার মনে করুন। অমন কাজ করবেন না।
প্রতাপাদিত্য।
কী মুশকিল! আজ রাত্রে এরা আমাকে ঘুমোতে দেবে না নাকি।
[ পাশ ফিরিয়া শয়ন
রাজশ্যালক।
মহারাজ, রাজজামাতা এখন অন্তঃপুরে আছেন। তাঁকে মার্জনা করুন। লছমনকে সেখানে যেতে
নিষেধ করুন। তাতে আপনার অন্তঃপুরের অবমাননা হবে।
প্রতাপাদিত্য।
এখন আমার ঘুমোবার সময়। কাল সকালে তোমাদের দরবার শোনা যাবে। তুমি বলছ রাজজামাতা এখন
অন্তঃপুরে। আচ্ছা, লছমন।
লছমন।
মহারাজ।
প্রতাপাদিত্য। কাল সকালে রামচন্দ্র যখন শয়নঘর হতে বাহিরে আসবে তখন আমার আদেশ পালন
করবে। এখন সব যাও— আমার ঘুমের ব্যাঘাত ক'রো না।
[ লছমন ও রাজশ্যালকের প্রস্থান
বসন্ত রায়ের প্রবেশ
বসন্ত রায়।
প্রতাপ! (প্রতাপাদিত্য নিরুত্তরে নিদ্রার ভান করিয়া রহিলেন) বাবা প্রতাপ।
(প্রতাপাদিত্য নিরুত্তর) বাবা প্রতাপ, এও কি সম্ভব?
প্রতাপাদিত্য।
(দ্রুত বিছানায় উঠিয়া বসিয়া) কেন সম্ভব নয়?
বসন্ত রায়।
ছেলেমানুষ, অপরিণামদর্শী, সে কি তোমার ক্রোধের যোগ্য পাত্র?
প্রতাপাদিত্য। ছেলেমানুষ! আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যায় এ বোঝবার বয়স তার হয় নি?
ছেলেমানুষ! কোথাকার একটা লক্ষ্মীছাড়া মূর্খ ব্রাহ্মণ, নির্বোধদের কাছে দাঁত দেখিয়ে
যে রোজকার করে খায়, তাকে স্ত্রীলোক সাজিয়ে, আমার মহিষীর সঙ্গে বিদ্রূপ করবার জন্যে
এনেছে—
এতটা বুদ্ধি যার জোগাতে পারে, তার ফল কী হতে পারে সে বুদ্ধিটা আর তার মাথায় জোগাল
না! দুঃখ এই, বুদ্ধিটা যখন মাথায় জোগাবে, তখন তার মাথাও শরীরে থাকবে না।
বসন্ত রায়।
আহা, সে ছেলেমানুষ। সে কিছুই বোঝে না।
প্রতাপাদিত্য।
দেখো পিতৃব্যঠাকুর, যশোরের রায়-বংশের কিসে মান-অপমান সে জ্ঞান যদি তোমার থাকবে, তবে
কি ওই পাকা মাথার উপর মোগল-বাদশার শিরোপা জড়িয়ে বেড়াতে পার। তোমার ওই মাথাটা ধূলিতে
লুটাবার সাধ ছিল, বিধাতার বিড়ম্বনায় তাতে বাধা পড়ল। এই তোমাকে স্পষ্টই বললুম।
খুড়ামহাশয় এখন আমার নিদ্রার সময়।
[ বসন্ত রায়ের দিকে পিছন করিয়া চোখ বুজিয়া শয়ন
বসন্ত রায়।
প্রতাপ আমি সব বুঝেছি - তুমি যখন একবার ছুরি তোল তখন সে ছুরি একজনের উপর পড়তেই চায়,
আমি তার লক্ষ্য হতে সরে পড়লুম বলে আর-এক জন তার লক্ষ্য হয়েছে। ভালো প্রতাপ, তোমার
ক্ষুধিত ক্রোধ একজনকে যদি গ্রাস করতেই চায়, তবে আমাকেই করুক। প্রতাপ। (প্রতাপ
নিদ্রার ভানে নিরুত্তর) প্রতাপ। (প্রতাপ নিরুত্তর) বাবা, প্রতাপ, একবার বিভার কথা
ভেবে দেখো। (প্রতাপ নিরুত্তর) করুণাময় হরি।
[ বসন্ত রায়ের প্রস্থান
৬
নটনটীগণ
প্রথমা।
কই, এখনও তো ফিরলেন না!
দ্বিতীয়া।
আর তো ভাই পারি নে। ঘুম পেয়ে আসছে।
তৃতীয়া।
ফের কি সভা জমবে নাকি?
প্রথমা।
কেউ যে জেগে আছে তা তো বোধ হচ্ছে না! এতবড়ো রাজবাড়ি সমস্ত যেন হাঁ হাঁ করছে।
দ্বিতীয়া।
চাকররাও সব-হঠাৎ কে কোথায় যেন চলে গেল!
তৃতীয়া।
বাতিগুলো সব নিবে আসছে, কেউ জ্বালিয়ে দেবে না?
প্রথমা।
আমার কেমন ভয় করছে ভাই।
দ্বিতীয়া। (বাদকদিগকে দেখাইয়া দিয়া) ওরাও যে সব ঘুমোতে লাগল— কী মুশকিলেই পড়া গেল। ওদের তুলে
দে না। কেমন গা ছম ছম করছে।
তৃতীয়া।
মিছে না ভাই! একটা গান ধর্। ওগো তোমরা ওঠো ওঠো।
বাদকগণ।
(ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া) অ্যাঁ অ্যাঁ! এসেছেন নাকি?
প্রথমা।
তোমরা একবার বেরিয়ে গিয়ে দেখো না গো। কেউ কোথাও নেই। আমাদের আজকে বিদায় দেবে না
নাকি?
একজন বাদক।
(বাহিরে গিয়া ফিরিয়া আসিয়া) ওদিকে যে সব বন্ধ।
প্রথমা।
অ্যাঁ। বন্ধ! আমাদের কি কয়েদ করলে নাকি?
দ্বিতীয়া।
দূর। কয়েদ করতে যাবে কেন?
তৃতীয়া।
গান
নয়ন মেলে দেখি আমায় বাঁধন বেঁধেছে।
গোপনে কে এমন করে ফাঁদ ফেঁদেছে।
বসন্ত-রজনীশেষে
বিদায় নিতে গেলেম হেসে
যাবার বেলায় বঁধু আমায় কাঁদিয়ে কেঁদেছে।
প্রথমা।
তোর সকল সময়েই গান। ভালো লাগছে না। কী হল বুঝতে পারছি নে।
৭
অন্তঃপুরের প্রাঙ্গণ
বিভা,উদয়াদিত্য, রামচন্দ্র রায় ও সুরমা। বসন্ত রায়ের প্রবেশ
বসন্ত রায়কে দেখিয়া মুখে কাপড় ঢাকিয়া বিভা কাঁদিয়া উঠিল
বসন্ত রায়।
(উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া) দাদা, একটা উপায় করো।
উদয়াদিত্য।
অন্তঃপুরের প্রহরীদের জন্যে আমি ভাবি নে। সদর-দরজায় এই প্রহরে যে দু-জন পাহারা দেয়
তারাও আমার বশ আছে। কিন্তু দেখলুম বড়ো ফটক বন্ধ, সে তো পার হবার উপায় নেই।
বসন্ত রায়।
উপায় নেই বললে চলবে কেন? উপায় যে করতেই হবে। দাদা, চলো।
উদয়াদিত্য।
যদি বা ফটক পার হওয়া যায়, এ-রাজ্য থেকে পালাবে কী করে?
রামচন্দ্র।
আমার চৌষট্টি দাঁড়ের ছিপ রয়েছে, একবার তাতে চড়ে বসতে পারলে আমি আর কাউকে ভয় করি নে।
বসন্ত রায়।
সে-নৌকা কোথায় আছে ভাই?
উদয়াদিত্য।
সে নৌকা আমি রাজবাটীর দক্ষিণ পাশের খালের মধ্যে আনিয়ে রেখেছি। কিন্তু সে-পর্যন্ত
পৌঁছোব কী করে?
রামচন্দ্র।
রামমোহন কোথায় গেল?
উদয়াদিত্য।
সে বন্ধ ফটকের উপর খাঁচার সিংহের মতো বৃথা ধাক্কা মারছে, তাতে কোনো ফল হবে না।
বিভা।
খাল তো দূরে নয়। তোমার দক্ষিণের ঘরের জানালার একেবারে নিচেই তো খাল।
উদয়াদিত্য।
সে যে অনেক নিচে। লাফিয়ে পড়া চলে না তো।
সুরমা।
(উদয়াদিত্যকে মৃদুস্বরে) আমাদের এখানে যে দাঁড়িয়ে থাকলে কোনো ফল হবে তা তো বোধ হয়
না। মহারাজ কি শুতে গিয়েছেন?
বসন্ত রায়।
হাঁ শুতে গিয়েছেন, রাত তো কম হয় নি।
সুরমা। মা কি একবার তাঁর কাছে গিয়ে—
উদয়াদিত্য। মা এ-সমস্ত কিছুই জানেন না। জানলে তিনি কান্নাকাটি করে এমনি গোলমাল
বাধিয়ে তুলবেন যে, আর কোনো উপায় থাকবে না। জানই তো তিনি মহারাজের কাছে কিছু বলতে
গেলে সমস্তই উলটো হবে— মাঝের থেকে কেবল তিনিই অস্থির হয়ে উঠবেন।
সুরমা। বিভা, কাঁদিস নে বিভা। এ কখনো ঘটতেই পারে না। এ একটা স্বপ্ন— এ সমস্তই কেটে যাবে।
রামমোহনের প্রবেশ
রামচন্দ্র। কী রামমোহন— কী করবি বল্।
রামমোহন। যতক্ষণ আমার প্রাণ আছে ততক্ষণ—
রামচন্দ্র।
আরে তোর প্রাণ নিয়ে আমার কী হবে? এখন পালাবার উপায় কী?
রামমোহন।
মহারাজ, তুমি যদি ভয় না কর, আমি এক কাজ করতে পারি।
রামচন্দ্র।
কী বল্।
রামমোহন।
তোমাকে পিঠে করে নিয়ে রাজবাটীর ছাতের উপর থেকে আমি খালের মধ্যে লাফিয়ে পড়তে পারি।
বসন্ত রায়।
কী সর্বনাশ! সে কি হয়।
রামচন্দ্র।
না সে হবে না। আর একটা সহজ উপায় কিছু বল্।
রামমোহন।
যুবরাজ, আমাকে গোটাকতক মোটা চাদর এনে দাও— পাকিয়ে শক্ত করে দক্ষিণের দরজার সঙ্গে
বেঁধে নিচে ঝুলিয়ে দিই।
উদয়াদিত্য।
ঠিক বলেছিস রামমোহন। বিপদের সময় সব চেয়ে সহজ কথাটাই মাথায় আসে না। চল্ চল্।
বিভা।
মোহন, কোনো ভয় নেই তো?
রামমোহন।
কোনো ভয় নেই মা! আমি দড়ি বেয়ে স্বচ্ছন্দে নামিয়ে নিয়ে যাব। জয় মা কালী।
৮
অন্তঃপুর ।
মহিষী
মহিষী।
কী হল বুঝতে পারছি নে তো। সকলকেই খাওয়ালুম কিন্তু মোহনকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি নে
কেন? বামী।
বামীর প্রবেশ
এদিককার খাওয়াদাওয়া তো সব শেষ হল মোহনকে খুঁজে পাচ্ছিনে কেন?
বামী।
মা তুমি অত ভাবছ কেন? তুমি শুতে যাও, রাত যে পুইয়ে এল, তোমার শরীরে সইবে কেন?
মহিষী।
সে কি হয়। আমি যে তাকে নিজে বসিয়ে খাওয়াব বলে রেখেছি।
বামী।
সে নিশ্চয় রাজকুমারীর মহলে গেছে, তিনি তাকে খাইয়েছেন। তুমি চলো, শুতে চলো।
মহিষী।
আমি তো ও মহলে খোঁজ করতে যাচ্ছিলুম, দেখি সব দরজা বন্ধ— এর মানে কী, কিছু তো বুঝতে
পারছি নে।
বামী।
বাড়িতে গোলমাল দেখে রাজকুমারী তাঁর মহলের দরজা বন্ধ করেছেন। অনেক দিন পরে জামাই
এসেছেন, আজ লোকজনের ভিড় সইবে কেন? চলো তুমি শুতে চলো।
মহিষী।
কী জানি বামী আজ ভালো লাগছে না। প্রহরীদের ডাকতে বললুম, তাদের কারো কোনো সাড়াই
পাওয়া গেল না।
বামী।
যাত্রা হচ্ছে, তারা তাই আমোদ করতে গেছে।
মহিষী।
মহারাজ জানতে পারলে যে তাদের আমোদ বেরিয়ে যাবে। উদয়ের মহলও যে বন্ধ, তারা ঘুমিয়েছে
বুঝি!
বামী।
ঘুমোবেন না! বল কী! রাত কম হয়েছে?
মহিষী।
গানবাজনা ছিল, জামাইকে নিয়ে একটু আমোদ-আহ্লাদ করবে না! ওরা মনে কী ভাববে বল্ তো?
এ-সমস্তই ওই বউমার কাণ্ড। একটু বিবেচনা নেই। রোজই তো ঘুমোচ্ছে—
একটা দিন কি আর—
বামী।
মা, সে-সব কথা কাল হবে— আজ চলো।
মহিষী।
মঙ্গলার সঙ্গে তোর দেখা হয়েছে তো?
বামী।
হয়েছে বই কি।
মহিষী।
ওষুধের কথা বলেছিস?
বামী।
সে-সব ঠিক হয়ে গেছে।
৯
শয়নকক্ষ
প্রতাপাদিত্য, প্রহরী, পীতাম্বর। অনুচরের প্রবেশ
প্রতাপাদিত্য।
কত রাত আছে?
পীতাম্বর।
এখনও চার দণ্ড রাত আছে।
প্রতাপাদিত্য।
কী যেন একটা গোলমাল শুনলুম।
পীতাম্বর।
আজ্ঞে হাঁ তাই শুনেই আমি আসছি।
প্রতাপাদিত্য।
কী হয়েছে।
পীতাম্বর।
আসবার সময় দেখলুম বাইরের প্রহরীরা দ্বারে নেই।
প্রতাপাদিত্য।
অন্তঃপুরের প্রহরীরা?
পীতাম্বর।
হাতপা-বাঁধা পড়ে আছে।
প্রতাপাদিত্য।
তারা কী বললে
পীতাম্বর।
আমার কথায় কোনো জবাব দিলে না— হয়তো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
প্রতাপাদিত্য।
রামচন্দ্র রায় কোথায়? উদয়াদিত্য, বসন্ত রায় কোথায়?
পীতাম্বর।
বোধ করি তাঁরা অন্তঃপুরেই আছেন।
প্রতাপাদিত্য।
বোধ করি! তোমার বোধ করার কথা কে জিজ্ঞাসা করছে? মন্ত্রীকে ডাকো।
[ পীতাম্বরের প্রস্থান
মন্ত্রীর প্রবেশ
মন্ত্রী। মহারাজ, রাজজামাতা—
প্রতাপাদিত্য। রামচন্দ্র রায়—
মন্ত্রী।
তিনি রাজপুরী পরিত্যাগ করে গেছেন।
প্রতাপাদিত্য।
(দাঁড়াইয়া উঠিয়া) পরিত্যাগ করে গেছে, প্রহরীরা গেল কোথা?
মন্ত্রী।
বহির্দ্বারের প্রহরীরা পালিয়ে গেছে।
প্রতাপাদিত্য।
(মুষ্টি বদ্ধ করিয়া) পালিয়ে গেছে? পালাবে কোথায়? যেখানে থাকে তাদের খুঁজে আনতে হবে।
অন্তঃপুরের প্রহরীদের এখনই ডেকে নিয়ে এস। অন্তঃপুরের পাহারায় কে কে ছিল?
মন্ত্রী।
সীতারাম আর ভাগবত।
প্রতাপাদিত্য।
ভাগবত ছিল? সে তো হুঁশিয়ার। সেও কি উদয়ের সঙ্গে যোগ দিলে?
মন্ত্রী।
সে হাতপা-বাঁধা পড়ে আছে।
প্রতাপাদিত্য।
হাত-পা-বাঁধা আমি বিশ্বাস করি নে। হাত পা ইচ্ছা করে বাঁধিয়েছে। আচ্ছা, সীতারামকে
নিয়ে এস। সেই গর্দভের কাছ থেকে কথা বের করা শক্ত হবে না।
মন্ত্রীর প্রস্থান ও সীতারামকে লইয়া পুনঃপ্রবেশ
প্রতাপাদিত্য।
অন্তঃপুরের দ্বার খোলা হল কী করে?
সীতারাম।
(করজোড়ে) দোহাই মহারাজ, আমার কোনো দোষ নেই।
প্রতাপাদিত্য।
সে-কথা তোকে কে জিজ্ঞাসা করছে?
সীতারাম।
আজ্ঞা না, মহারাজ। যুবরাজ— যুবরাজ আমাকে বলপূর্বক বেঁধে অন্তঃপুর হতে বেরিয়েছিলেন।
ব্যস্তভাবে বসন্ত রায়ের প্রবেশ
সীতারাম।
যুবরাজকে নিষেধ করলুম তিনি শুনলেন না।
বসন্ত রায়।
হাঁ, হাঁ সীতারাম, কী বললি? অধর্ম করিস নে সীতারাম, উদয়াদিত্যের এতে কোনো দোষ নেই।
সীতারাম।
আজ্ঞা না, যুবরাজের কোনো দোষ নেই।
প্রতাপাদিত্য।
তবে তোর দোষ!
সীতারাম।
আজ্ঞা না।
প্রতাপাদিত্য।
তবে কার দোষ?
সীতারাম। আজ্ঞা যুবরাজ—
প্রতাপাদিত্য।
তাঁর সঙ্গে আর কে ছিল?
সীতারাম। আজ্ঞা বউরানীমা—
প্রতাপাদিত্য।
বউরানী! ওই সেই শ্রীপুরের (বসন্ত রায়ের দিকে চাহিয়া) উদয়াদিত্যের এ অপরাধের মার্জনা
নেই।
বসন্ত রায়।
বাবা প্রতাপ, উদয়ের এতে কোনো দোষ নেই।
প্রতাপাদিত্য।
দোষ নেই? তুমি দোষ নেই বলছ বলেই তাকে বিশেষরূপে শাস্তি দেব। তুমি মাঝে পড়ে মীমাংসা
করতে এসেছ কেন? শোনো পিতৃব্যঠাকুর! তুমি যদি দ্বিতীয় বার যশোরে এসে উদয়াদিত্যের
সঙ্গে দেখা কর তবে তার প্রাণ বাঁচানো দায় হবে।
বসন্ত রায়।
(কিয়ৎকাল চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া) ভালো প্রতাপ, আজ সন্ধ্যাবেলায় তবে আমি
চললেম।
[ প্রস্থান