ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি
 

প্রায়শ্চিত্ত

তৃতীয় অঙ্ক


উদয়াদিত্যের ঘরের অলিন্দ
উদয়াদিত্য ও মাধবপুরের একদল প্রজা

 

    উদয়াদিত্য। ওরে তোরা মরতে এসেছিস এখানে? মহারাজ খবর পেলে রক্ষা রাখবেন না। পালা পালা।
    ১। আমাদের মরণ সর্বত্রই। পালাব কোথায়?
    ২। তা মরতে যদি হয় তো তোমার সামনে দাঁড়িয়ে মরব।
    উদয়াদিত্য। তোদের কী চাই বল্‌ দেখি।
    অনেকে। আমরা তোমাকে চাই।
    উদয়াদিত্য। আমাকে নিয়ে তোদের কোনো লাভ হবে না রে
দুঃখই পাবি।
    ৩। আমাদের দুঃখই ভালো কিন্তু তোমাকে আমরা নিয়ে যাব।
    ৪। আমাদের মাধবপুরে ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত কাঁদছে সে কি কেবল ভাত না পেয়ে? তা নয়। তুমি চলে এসেছ বলে। তোমাকে আমরা ধরে নিয়ে যাব।
    উদয়াদিত্য। আরে চুপ কর্‌, চুপ কর্‌। ও-কথা বলিস নে।
    ৫। রাজা তোমাকে ছাড়বে নে। আমরা তোমাকে জোর করে নিয়ে যাব। আমরা রাজাকে মানি নে
আমরা তোমাকে রাজা করব।

                            প্রতাপাদিত্যের প্রবেশ
    প্রতাপাদিত্য। কাকে মানিস নে রে। তোরা কাকে রাজা করবি?
    প্রজাগণ। মহারাজ, পেন্নাম হই।
    ১। আমরা তোমার কাছে দরবার করতে এসেছি।
    প্রতাপাদিত্য। কিসের দরবার?
    ১। আমরা যুবরাজকে চাই।
    প্রতাপাদিত্য। বলিস কী রে!
    সকলে। হাঁ মহারাজ, আমরা যুবরাজকে মাধবপুরে নিয়ে যাব।
    প্রতাপাদিত্য। আর ফাঁকি দিবি? খাজনা দেবার নামটি করবি নে।
    সকলে। অন্ন বিনে মরছি যে।
    প্রতাপাদিত্য। মরতে তো সকলকেই হবে। বেটারা রাজার দেনা বাকি রেখে মরবি?
    ১। আচ্ছা আমরা না খেয়েই খাজনা দেব, কিন্তু যুবরাজকে আমাদের দাও। মরি তো ওঁরই হাতে মরব।
    প্রতাপাদিত্য। সে বড়ো দেরি নেই। তোদের সর্দার কোথায় রে?
    ২। (প্রথমকে দেখাইয়া) এই যে আমাদের গণেশ সর্দার।
    প্রতাপাদিত্য। ও নয়
সেই বৈরাগীটা।
    ১। আমাদের ঠাকুর! তিনি তো পূজোয় বসেছেন। এখনই আসছেন। ওই যে এসেছেন।

                            ধনঞ্জয় বৈরাগীর প্রবেশ
    ধনঞ্জয়। দয়া যখন হয় তখন সাধনা না করেই পাওয়া যায়। ভয় ছিল কাঙালদের দরজা থেকেই ফিরতে হয় বা। প্রভুর কৃপা হল, রাজাকে অমনি দেখতে পেলুম। (উদয়াদিত্যের প্রতি) আর এই আমাদের হৃদয়ের রাজা। ওকে রাজা বলতে যাই বন্ধু বলে ফেলি!
    উদয়াদিত্য। ধনঞ্জয়!
    ধনঞ্জয়। কী রাজা! কী ভাই?
    উদয়াদিত্য। এখানে কেন এলে?
    ধনঞ্জয়। তোমাকে না দেখে থাকতে পারি নে যে।
    উদয়াদিত্য। মহারাজ রাগ করছেন।
    ধনঞ্জয়। রাগই সই। আগুন জ্বলছে তবু পতঙ্গ মরতে যায়।
    প্রতাপাদিত্য। তুমি এই সমস্ত প্রজাদের খেপিয়েছ?
    ধনঞ্জয়। খেপাই বই কি! নিজে খেপি, ওদেরও খেপাই, এই তো আমার কাজ।

                                                গান
                    আমারে,   পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে বেড়ায়
                                                    কোন্‌ খেপা সে।
                    ওরে        আকাশ জুড়ে মোহন সুরে
                                                    কী যে বাজে কোন্‌ বাতাসে।
    ওরে খেপার দল গান ধর্‌ রে
হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? রাজাকে পেয়েছিস আনন্দ করে নে। রাজা আমাদের মাধবপুরের নৃত্যটা দেখে নিক।

                                    সকলে মিলিয়া নৃত্যগীত

                গেল রে গেল বেলা, পাগলের কেমন খেলা

                            ডেকে সে আকুল করে দেয় না ধরা।
                                    তারে কানন-গিরি খুঁজে ফিরি,
                                                কেঁদে মরি কোন্‌ হুতাশে!

    (প্রতাপাদিত্যের মুখের দিকে চাহিয়া) আহা, আহা, রাজা আমার, অমন নিষ্ঠুর সেজে এ কী লীলা হচ্ছে। ধরা দেবে না বলে পণ করেছিলে আমরা ধরব বলে কোমর বেঁধে বেরিয়েছি।
    প্রতাপাদিত্য। দেখো বৈরাগী, তুমি অমন পাগলামি করে আমাকে ভোলাতে পারবে না। এখন কাজের কথা হোক। মাধবপুরের প্রায় দু বছরের খাজনা বাকি
দেবে কি না বলো।
    ধনঞ্জয়। না মহারাজ দেব না।
    প্রতাপাদিত্য। দেবে না! এতবড়ো আস্পর্ধা।
    ধনঞ্জয়। যা তোমার নয় তা তোমাকে দিতে পারব না।
    প্রতাপাদিত্য। আমার নয়!
    ধনঞ্জয়। আমাদের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়। যিনি আমাদের প্রাণ দিয়েছেন এ অন্ন যে তাঁর, এ আমি তোমাকে দিই কী ব'লে?
    প্রতাপাদিত্য। তুমিই প্রজাদের বারণ করেছ খাজনা দিতে!
    ধনঞ্জয়। হাঁ মহারাজ, আমিই তো বারণ করেছি। ওরা মূর্খ, ওরা তো বোঝে না
পেয়াদার ভয়ে সমস্তই দিয়ে ফেলতে চায়। আমিই বলি, আরে আরে এমন কাজ করতে নেই প্রাণ দিবি তাঁকে প্রাণ দিয়েছেন যিনি। তোদের রাজাকে প্রাণহত্যার অপরাধী করিস নে।
    প্রতাপাদিত্য। দেখো ধনঞ্জয়, তোমার কপালে দুঃখ আছে।
    ধনঞ্জয়। যে দুঃখ কপালে ছিল তাকে আমার বুকের উপর বসিয়েছি মহারাজ
সেই দুঃখই তো আমাকে ভুলে থাকতে দেয় না। যেখানে ব্যথা সেইখানেই হাত পড়ে ব্যথা আমার বেঁচে থাক।
    প্রতাপাদিত্য। দেখো বৈরাগী, তোমার চাল নেই, চুলো নেই, কিন্তু এরা সব গৃহস্থ মানুষ, এদের কেন বিপদে ফেলতে চাচ্ছ? (প্রজাদের প্রতি) দেখ্‌ বেটারা, আমি বলছি তোরা সব মাধবপুরে ফিরে যা। বৈরাগী তুমি এইখানেই রইলে।

    প্রজাগণ। আমাদের প্রাণ থাকতে সে তো হবে না।
    ধনঞ্জয়। কেন হবে না রে। তোদের বুদ্ধি এখনও হল না। রাজা বললে বৈরাগী তুমি রইলে, তোরা বললি না তা হবে না
আর বৈরাগী লক্ষ্মীছাড়াটা কি ভেসে এসেছে? তার থাকা না-থাকা কেবল রাজা আর তোরা ঠিক করে দিবি?

                                                গান
                                    রইল বলে রাখলে কারে
                                    হুকুম তোমার ফলবে কবে?
                    তোমার       টানাটানি টিকবে না ভাই,
                                            রবার যেটা সেটাই রবে।
                                    যা খুশি তাই করতে পার

                                    গায়ের জোরে রাখ মার;
                                    যাঁর গায়ে সব ব্যথা বাজে
                                            তিনি যা সন সেটাই সবে!
                                    অনেক তোমার টাকাকড়ি,
                                    অনেক দড়া অনেক দড়ি,
                                    অনেক অশ্ব অনেক করী

                                             অনেক তোমার আছে ভবে।
                                    ভাবছ হবে তুমিই যা চাও,
                                    জগৎটাকে তুমিই নাচাও,
                                    দেখবে হঠাৎ নয়ন খুলে
                                            হয় না যেটা সেটাও হবে।

                                        মন্ত্রীর প্রবেশ
    প্রতাপাদিত্য। তুমি ঠিক সময়েই এসেছ। এই বৈরাগীকে এইখানেই ধরে রেখে দাও। ওকে মাধবপুরে যেতে দেওয়া হবে না।
    মন্ত্রী। মহারাজ

    প্রতাপাদিত্য। কী। হুকুমটা তোমার মনের মতো হচ্ছে না বুঝি।
    উদয়াদিত্য। মহারাজ, বৈরাগীঠাকুর সাধুপুরুষ।
    প্রজারা। মহারাজ এ আমাদের সহ্য হবে না। মহারাজ অকল্যাণ হবে।
    ধনঞ্জয়। আমি বলছি তোরা ফিরে যা। হুকুম হয়েছে আমি দুদিন রাজার কাছে থাকব, বেটাদের সেটা সহ্য হল না।
    প্রজারা। আমরা এই জন্যেই কি দরবার করতে এসেছিলুম? আমরা যুবরাজকেও পাব না, তোমাকেও হারাব?
    ধনঞ্জয়। দেখ্‌ তোদের কথা শুনলে আমার গা জ্বালা করে। হারাবি কি রে বেটা? আমাকে তোদের গাঁঠে বেঁধে রেখেছিলি? তোদের কাজ হয়ে গেছে এখন পালা সব পালা।
    প্রজারা। মহারাজ, আমরা কি আমাদের যুবরাজকে পাব না?
    প্রতাপাদিত্য। না।


অন্তঃপুর
সুরমা ও বিভা

 

    সুরমা। বিভা, ভাই বিভা, তোর চোখে যদি জল দেখতুম তাহলে আমার মনটা যে খোলসা হত। তোর হয়ে যে আমার কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছা করে ভাই, সব কথাই কি এমনি করে চেপে রাখতে হয়!
    বিভা। কোনো কথাই তো চাপা রইল না বউরানী। ভগবান তো লজ্জা রাখলেন না!
    সুরমা। আমি কেবল এই কথাই ভাবি যে জগতে সব দাহই জুড়িয়ে যায়। আজকের মতো এমন কপাল-পোড়া সকাল তো রোজ আসবে না; সংসার লজ্জা দিতেও যেমন, লজ্জা মিটিয়ে দিতেও তেমনি! সব ভাঙাচোরা জুড়ে আবার দেখতে দেখতে ঠিক হয়ে যায়।
    বিভা। ঠিক নাও যদি হয়ে যায় তাতেই বা কী? যেটা হয় সেটা তো সইতেই হয়।
    সুরমা। শুনেছিস তো বিভা, মাধবপুর থেকে ধনঞ্জয় বৈরাগী এসেছেন। তাঁর তো খুব নাম শুনেছি, বড়ো ইচ্ছা করে তাঁর গান শুনি। গান শুনবি বিভা? ওই দেখ, কেবল অতটুকু মাথা নাড়লে হবে না। লোক দিয়ে বলে পাঠিয়েছি আজ যেন একবার মন্দিরে গান গাইতে আসেন তা হলে আমরা উপরের ঘর থেকে শুনতে পাব। ও কী, পালাচ্ছিস কোথায়?
    বিভা। দাদা আসছেন।
    সুরমা। তা এলই বা দাদা।
    বিভা। না, আমি যাই বউরানী! [ প্রস্থান
    সুরমা। আজ ওর দাদার কাছেও মুখ দেখাতে পারছে না।

                        উদয়াদিত্যের প্রবেশ

    সুরমা। আজ ধনঞ্জয় বৈরাগীকে আমাদের মন্দিরে গান গাবার জন্যে ডেকে পাঠিয়েছি।
    উদয়াদিত্য। সে তো হবে না।
    সুরমা। কেন?
    উদয়াদিত্য। তাঁকে মহারাজ কয়েদ করেছেন।
    সুরমা। কী সর্বনাশ, অমন সাধুকে কয়েদ করেছেন!
    উদয়াদিত্য। ওটা আমার উপর রাগ করে। তিনি জানেন আমি বৈরাগীকে ভক্তি করি
মহারাজের কঠিন আদেশেও আমি তাঁর গায়ে হাত দিই নি সেই জন্যে আমাকে দেখিয়ে দিলেন রাজকার্য কেমন করে করতে হয়।
    সুরমা। কিন্তু এগুলো যে অমঙ্গলের কথা
শুনলে ভয় হয়। কী করা যাবে।
    উদয়াদিত্য। মন্ত্রী আমার অনুরোধে বৈরাগীকে গারদে না দিয়ে তাঁর বাড়িতে লুকিয়ে রাখতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু ধনঞ্জয় কিছুতেই রাজি হলেন না। তিনি বললেন আমি গারদেই যাব সেখানে যত কয়েদি আছে তাদের প্রভুর নামগান শুনিয়ে আসব। তিনি যেখানেই থাকুন তাঁর জন্যে কাউকেই ভাবতে হবে না
তাঁর ভাবনার লোক উপরে আছেন।
    সুরমা। মাধবপুরের প্রজাদের জন্যে আমি সব সিধে সাজিয়ে রেখেছি
কোথায় সব পাঠাব?
    উদয়াদিত্য। গোপনে পাঠাতে হবে। নির্বোধগুলো আমাকে রাজা রাজা করে চেঁচাচ্ছিল, মহারাজ সেটা শুনতে পেয়েছেন
নিশ্চয় তাঁর ভালো লাগে নি। এখন তোমার ঘর থেকে তাদের খাবার পাঠানো হলে মনে কী সন্দেহ করবেন বলা যায় না।
    সুরমা। আচ্ছা সে আমি বিভাকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু আমি ভাবছি, কাল রাত্রে যারা পাহারায় ছিল সেই সীতারাম-ভাগবতের কী দশা হবে!
    উদয়াদিত্য। মহারাজ ওদের গায়ে হাত দেবেন না
সে ভয় নেই।
    সুরমা। কেন?
    উদয়াদিত্য। মহারাজ কখনো ছোটো শিকারকে বধ করেন না। দেখলে না, রমাই ভাঁড়কে তিনি ছেড়ে দিলেন।
    সুরমা। কিন্তু শাস্তি তো তিনি একজন কাউকে না দিয়ে থাকবেন না।
    উদয়াদিত্য। সে তো আমি আছি।
    সুরমা। ও-কথা ব'লো না।
    উদয়াদিত্য। বলতে বারণ কর তো বলব না। কিন্তু বিপদের জন্যে কি প্রস্তুত হতে হবে না?
    সুরমা। আমি থাকতে তোমার বিপদ ঘটবে কেন? সব বিপদ আমি নেব।
    উদয়াদিত্য। তুমি নেবে? তার চেয়ে বিপদ আমার আর আছে নাকি? যাই হোক সীতারাম-ভাগবতের অন্নবস্ত্রের একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
    সুরমা। তুমি কিন্তু কিছু ক'রো না। তাদের জন্যে যা করবার ভার সে আমি নিয়েছি।
    উদয়াদিত্য। না, না, এতে তুমি হাত দিয়ো না।
    সুরমা। আমি দেবো না তো কে দেবে। ও তো আমার কাজ। আমি সীতারাম-ভাগবতের স্ত্রীদের ডেকে পাঠিয়েছি।
    উদয়াদিত্য। সুরমা, তুমি বড়ো অসাবধান।
    সুরমা। আমার জন্যে তুমি কিছু ভেবো না। আসল ভাবনার কথা কী জান?
    উদয়াদিত্য। কী বলো দেখি?
    সুরমা। ঠাকুরজামাই তাঁর ভাঁড়কে নিয়ে যে কাণ্ডটি করলেন বিভা সেজন্যে লজ্জায় মরে গেছে।
    উদয়াদিত্য। লজ্জার কথা বই কি।
    সুরমা। এতদিন স্বামীর অনাদরে বাপের 'পরেই তার অভিমান ছিল
আজ যে তার সে অভিমান করবারও মুখ রইল না। বাপের নিষ্ঠুরতার চেয়ে তার স্বামীর এই নীচতা তাকে অনেক বেশি বেজেছে। একে তো ভারি চাপা মেয়ে তার পরে এই কাণ্ড। আজ থেকে দেখো, ওর স্বামীর কথা আমার কাছেও বলতে পারবে না। স্বামীর গর্ব যে স্ত্রীলোকের ভেঙেছে জীবন তার পক্ষে বোঝা, বিশেষত বিভার মতো মেয়ে।
    উদয়াদিত্য। ভগবান বিভাকে দুঃখ যথেষ্ট দিলেন, তেমনি সহ্য করবার শক্তিও দিয়েছেন।
    সুরমা। সে-শক্তির অভাব নেই
বিভা তোমারই তো বোন বটে!
    উদয়াদিত্য। আমার শক্তি যে তুমি।
    সুরমা। তাই যদি হয় তো সে'ও তোমারই শক্তিতে।
    উদয়াদিত্য। আমার কেবলই ভয় হয় তোমাকে যদি হারাই তাহলে--
    সুরমা। তাহলে তোমার কোনো অনিষ্ট হবে না। দেখো এক দিন ভগবান প্রমাণ করিয়ে দেবেন যে, তোমার মহত্ত্ব একলা তোমাতেই আছে।
    উদয়াদিত্য। আমার সে-প্রমাণে কাজ নেই।
    সুরমা। ভাগবতের স্ত্রী অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে।
    উদয়াদিত্য। আচ্ছা চললুম কিন্তু দেখো।
                          [ প্রস্থান

                            ভাগবতের স্ত্রীর প্রবেশ
    সুরমা। ভোর-রাত্রে আমি যে টাকা আর কাপড় পাঠিয়েছি তা তোদের হাতে গিয়ে পৌঁছেছে তো?
    ভাগবতের স্ত্রী। পৌঁছেছে মা, কিন্তু তাতে আমাদের কতদিন চলবে? তোমরা আমাদের সর্বনাশ করলে।
    সুরমা। ভয় নেই কামিনী! আমার যতদিন খাওয়াপরা জুটবে তোদেরও জুটবে। আজও কিছু নিয়ে যা। কিন্তু এখানে বেশিক্ষণ থাকিস নে।
                                                                                        [ উভয়ের প্রস্থান

                                                মহিষী ও বামীর প্রবেশ

    মহিষী। এত বড়ো একটা কাণ্ড হয়ে গেল, আমি জানতেও পারলুম না।
    বামী। মহারানীমা, জেনেই বা লাভ হত কী। তুমি তো ঠেকাতে পারতে না।
    মহিষী। সকালে উঠে আমি ভাবছি হল কী
জামাই বুঝি রাগ করেই গেল। এদিকে যে এমন সর্বনাশের উদ্‌যোগ হচ্ছিল তা মনে আনতেও পারি নি। তুই সে-রাত্রেই জানতিস আমাকে ভাঁড়িয়েছিলি।
    বামী। জানলে তুমি যে ভয়েই মরে যেতে। তা মা, আর ও-কথায় কাজ নেই
যা হয়ে গেছে সে হয়ে গেছে।
    মহিষী। হয়ে চুকলে তো বাঁচতুম
এখন যে আমার উদয়ের জন্যে ভয় হচ্ছে।
    বামী। ভয় খুব ছিল কিন্তু সে কেটে গেছে।
    মহিষী। কী করে কাটল।
    বামী। মহারাজার রাগ বউরানীর উপর পড়েছে। তিনিও আচ্ছা মেয়ে যা হোক
আমাদের মহারাজের ভয়ে যম কাঁপে কিন্তু ওঁর ভয় ডর নেই। যাতে তাঁরই উপরে সব রাগ পড়ে তিনি ইচ্ছে করেই যেন তার জোগাড় করছেন।
    মহিষী। তার জন্যে তো বেশি জোগাড় করবার দরকার দেখি নে। মহারাজ যে ওকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচেন। এবারে আর তো ঠেকিয়ে রাখতে পারা যাবে না। তা তোকে যা বলেছিলুম সেটা ঠিক আছে তো?
    বামী। সে সমস্তই তৈরি হয়ে রয়েছে, সেজন্যে ভেবো না।
    মহিষী। আর দেরি করিস নে আজকেরই যাতে

    বামী। সে আমাকে বলতে হবে না কিন্তু

    মহিষী। যা হয় হবে
এত ভাবতে পারি নে ওকে বিদায় করতে পারলেই আপাতত মহারাজের রাগ পড়ে যাবে নইলে উদয়কে বাঁচাতে পারা যাবে না। তুই যা, শীঘ্র কাজ সেরে আয়।
    বামী। আমি সে ঠিক করেই এসেছি
এতক্ষণে হয়তো
    মহিষী। কি জানি বামী, ভয়ও হয়।


প্রতাপাদিত্যের কক্ষ
মহিষী ও প্রতাপাদিত্য

      প্রতাপাদিত্য। মহিষী।
    মহিষী। কি মহারাজ!
    প্রতাপাদিত্য। এ-সব কাজ কি আমাকে নিজের হাতে করতে হবে!
    মহিষী। কী কাজ।
    প্রতাপাদিত্য। ওই যে আমি তোমাকে বলেছিলুম, শ্রীপুরের মেয়েকে তার পিত্রালয়ে দূর করে দিতে হবে-- এ কাজটা কি আমার সৈন্য-সেনাপতি নিয়ে করতে হবে?
    মহিষী। আমি তার জন্যে বন্দোবস্ত করছি।
    প্রতাপাদিত্য। বন্দোবস্ত! এর আবার বন্দোবস্ত কিসের। আমার রাজ্যে ক-জন পালকির বেহারা জুটবে না নাকি?
    মহিষী। সে জন্যে নয় মহারাজ!
    প্রতাপাদিত্য। তবে কী জন্যে?
    মহিষী। দেখো তবে খুলে বলি। ওই বউ আমার উদয়কে যেন জাদু করে রেখেছে সে তো তুমি জান। ওকে যদি বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিই তাহলে

    প্রতাপাদিত্য। এমন জাদু তো ভেঙে দিতে হবে
এবাড়ি থেকে ওই মেয়েটাকে নির্বাসিত করে দিলেই জাদু ভাঙবে।
    মহিষী। মহারাজ, এ-সব কথা তোমরা বুঝবে না
সে আমি ঠিক করেছি।
    প্রতাপাদিত্য। কী ঠিক করেছ জানতে চাই।
    মহিষী। আমি বামীকে দিয়ে মঙ্গলার কাছ থেকে ওষুধ আনিয়েছি।
    প্রতাপাদিত্য। ওষুধ কিসের জন্যে?
    মহিষী। ওকে ওষুধ খাওয়ালেই ওর জাদু কেটে যাবে। মঙ্গলার ওষুধ অব্যর্থ, সকলেই জানে।
    প্রতাপাদিত্য। আমি তোমার ওষুধ-টষুধ বুঝি নে। আমি এক ওষুধ জানি
শেষকালে সেই ওষুধ প্রয়োগ করব। আমি তোমাকে বলে রাখছি, কাল যদি ঐ শ্রীপুরের মেয়ে শ্রীপুরে ফিরে না যায় তাহলে আমি উদয়কে সুদ্ধ নির্বাসনে পাঠাব এখন যা করতে হয় করো গে।
    মহিষী। আর তো বাঁচি নে! কী যে করব মাথামুণ্ডু ভেবে পাই নে।  [ প্রস্থান

                                    উদয়াদিত্যের প্রবেশ
    প্রতাপাদিত্য। সীতারাম-ভাগবতের বেতন বন্ধ হয়েছে সে কি রাজকোষে অর্থ নেই বলে?
    উদয়াদিত্য। না মহারাজ, আমি বলপূর্বক তাদের কর্তব্যে বাধা দিয়েছি, আমাকে তারই দণ্ড দেবার জন্যে।
    প্রতাপাদিত্য। বউমা তাদের গোপনে অর্থসাহায্য করছেন।
    উদয়াদিত্য। আমি তাঁকে সাহায্য করতে বলেছি।
    প্রতাপাদিত্য। আমার ইচ্ছার অপমান করবার জন্যে?
    উদয়াদিত্য। না মহারাজ, যে দণ্ড আমারই প্রাপ্য তা নিজে গ্রহণ করবার জন্যে।
    প্রতাপাদিত্য। আমি আদেশ করছি, ভবিষ্যতে তাদের আর যেন অর্থ সাহায্য না করা হয়।
    উদয়াদিত্য। আমার প্রতি আরও গুরুতর শাস্তির আদেশ হল।
    প্রতাপাদিত্য। আর বউমাকে ব'লো, তিনি আমাকে একেবারেই ভয় করেন না-- দীর্ঘকাল তাঁকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে বলেই এরকম ঘটতে পেরেছে, কিন্তু তিনি জানতে পারবেন স্পর্ধা প্রকাশ করা নিরাপদ নয়। তিনি মনে রাখেন যেন আমার রাজবাড়ি আমার রাজত্বের বাইরে নয়।
                    [ উভয়ের প্রস্থান
                            মহিষী ও বামীর প্রবেশ
    মহিষী। ওষুধের কী করলি?
    বামী। সে তো এনেছি-- পানের সঙ্গে সেজে দিয়েছি।
    মহিষী। খাঁটি ওষুধ তো?
    বামী। খুব খাঁটি।
    মহিষী। খুব কড়া ওষুধ হওয়া চাই এক দিনেই যাতে কাজ হয়। মহারাজ বলেছেন কালকের মধ্যে যদি সুরমা বিদায় না হয় তাহলে উদয়কে সুদ্ধ নির্বাসনে পাঠাবেন। আমি যে কী কপাল করেছিলুম!
    বামী। কড়া ওষুধ তো বটে। বড়ো ভয় হয় মা, কী হতে কী ঘটে।
    মহিষী। ভয়ভাবনা করবার সময় নেই বামী! একটা কিছু করতেই হবে। মহারাজকে তো জানিস
কেঁদেকেটে মাথা খুঁড়ে তাঁর কথা নড়ানো যায় না। উদয়ের জন্যে আমি দিনরাত্রি ভেবে মরছি। ওই বউটাকে বিদায় করতে পারলে তবু মহারাজের রাগ একটু কম পড়বে। ও যেন ওঁর চক্ষুশূল হয়েছে।
    বামী। তা তো জানি। কিন্তু ওষুধের কথা তো বলা যায় না। দেখো, শেষকালে মা আমি যেন বিপদে না পড়ি। আর আমার বাজুবন্দর কথাটা মনে রেখো।
    মহিষী। সে আমাকে বলতে হবে না। তোকে তো গোটছড়াটা আগাম দিয়েছি।
    বামী। শুধু গোট নয় মা, বাজুবন্দ চাই।
 

                    উদয়াদিত্যের প্রবেশ
    মহিষী। বাবা উদয়, সুরমাকে বাপের বাড়ি পাঠানো যাক!
    উদয়াদিত্য। কেন মা, সুরমা কী অপরাধ করেছে?
    মহিষী। কী জানি বাছা, আমরা মেয়েমানুষ কিছু বুঝি না, বউমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে মহারাজার রাজকার্যের যে কী সুযোগ হবে, মহারাজই জানেন।
    উদয়াদিত্য। মা, রাজবাড়িতে যদি আমার স্থান হয়ে থাকে তবে সুরমার কি হবে না? কেবল স্থানটুকুমাত্রই তার ছিল, তার বেশি তো আর কিছু সে পায় নি!
    মহিষী। (সরোদনে) কী জানি বাবা, মহারাজ কখন কী যে করেন কিছুই বুঝতে পারি নে। কিন্তু তাও বলি বাছা, আমাদের বউমা বড়ো ভালো মেয়ে নয়। ও রাজবাড়িতে প্রবেশ করে অবধিই এখানে আর শান্তি নেই। হাড় জ্বালাতন হয়ে গেল। তা, ও দিনকতক বাপের বাড়িতেই যাক না কেন, দেখা যাক
কী বল বাছা? ও দিনকতক এখান থেকে গেলেই দেখতে পাবে, বাড়ির শ্রী ফেরে কি না।
                [ উদয় নীরব থাকিয়া কিয়ৎকাল পরে প্রস্থান

            সুরমার প্রবেশ
    সুরমা। কই এখানে তো তিনি নেই।
    মহিষী। পোড়ামুখী, আমার বাছাকে তুই কী করলি? আমার বাছাকে আমায় ফিরিয়ে দে। এসে অবধি তুই তার কী সর্বনাশ না করলি? অবশেষে
সে রাজার ছেলে তার হাতে বেড়ি না দিয়ে কি তুই ক্ষান্ত হবি নে?
    সুরমা। কোনো ভয় নেই মা। বেড়ি এবার ভাঙল। আমি বুঝতে পারছি আমার বিদায় হবার সময় হয়ে এসেছে-- আর বড়ো দেরি নেই। আমি আর দাঁড়াতে পারছি নে। বুকের ভিতর যেন আগুনে জ্বলে যাচ্ছে। তোমার পায়ের ধুলো নিতে এলুম। অপরাধ যা কিছু করেছি মাপ ক'রো। ভগবান করুন যেন আমি গেলেই শান্তি হয়।
                                [ পদধূলি লইয়া প্রস্থান

    মহিষী। ওষুধ খেয়েছে বুঝি। বিপদ কিছু ঘটবে না তো? যে যা বলুক, বউমা কিন্তু লক্ষ্মী মেয়ে। ওকে এমন জোর করে বিদায় করলে কি ধর্মে সইবে? বামী, বামী!
                                বামীর প্রবেশ
    বামী। কী মা।
    মহিষী। ওষুধটা কি বড্ড কড়া হয়েছে?
    বামী। তুমি তো কড়া ওষুধের কথাই বলেছিলে।
    মহিষী। কিন্তু বিপদ ঘটবে না তো?
    বামী। আপদবিপদের কথা বলা যায় কি।
    মহিষী। সত্যি বলছি বামী, আমার মনটা কেমন করছে। ওষুধটা কি খেয়েছে ঠিক জানিস?
    বামী। বেশিক্ষণ নয়
এই খানিকক্ষণ হল খেয়েছে।
    মহিষী। দেখলুম, মুখ একেবারে সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে? কী করলুম কে জানে। হরি রক্ষা করো।
    বামী। তোমরা তো ওকে বিদায় করতেই চেয়েছিলে!
    মহিষী। না না, ছি ছি
অমন কথা বলিস নে। দেখ্‌ আমি তোকে আমার এই গলার হারগাছাটা দিচ্ছি, তুই শিগগির দৌড়ে গিয়ে মঙ্গলার কাছ থেকে এর উলটো ওষুধ নিয়ে আয় গে। যা বামী, যা! শিগগির যা!
                        [ বামীর প্রস্থান

                    বিভার সরোদনে প্রবেশ
    বিভা। মা মা, কী হল মা?
    মহিষী। কী হয়েছে বিভু।
    বিভা। বউদিদির এমন হল কেন মা। তোমরা তাকে কী করলে মা? কী খাওয়ালে?
    মহিষী। (উচ্চস্বরে) ওরে, বামী, বামী, শিগগির দৌড়ে যা
ওরে ওষুধ নিয়ে আয়।
                    উদয়াদিত্যের প্রবেশ

    মহিষী। বাবা, উদয়, কী হয়েছে বাপ।
    উদয়াদিত্য। সুরমা বিদায় হয়েছে মা, এবার আমি বিদায় হতে এসেছি-- আর এখানে নয়।
    মহিষী। (কপালে করাঘাত করিয়া) কী সর্বনাশ হল রে, কী সর্বনাশ হল।
    উদয়াদিত্য। (প্রণাম করিয়া) চললুম তবে।
    মহিষী। (হাত ধরিয়া) কোথায় যাবি বাপ। আমাকে মেরে ফেলে দিয়ে যা।
    বিভা। (পা জড়াইয়া) কোথায় যাবে দাদা। আমাকে কার হাতে দিয়ে যাবে।
    উদয়াদিত্য। তোকে কার হাতে দিয়ে যাব। আমি হতভাগা ছাড়া তোর কে আছে। ওরে বিভা, তুই-ই আমাকে টেনে রাখলি
নইলে এ পাপ-বাড়িতে আমি আর এক মুহূর্ত থাকতুম না।
    বিভা। বুক ফেটে গেল দাদা, বুক ফেটে গেল।
    উদয়াদিত্য। দুঃখ করিস নে বিভা, যে গেছে সে সুখে গেছে। এবাড়িতে এসে সেই সোনার লক্ষ্মী এই আজ প্রথম আরাম পেল।

 


প্রাসাদের দ্বারের বাহিরে
মাধবপুরের প্রজাদল

    ১। (উচ্চস্বরে) আমরা এখানে হত্যা দিয়ে পড়ে থাকব।
   ২। আমরা এখানে না খেয়ে মরব।

                                        প্রহরীর প্রবেশ

    প্রহরী। এরা সব বৈরাগীঠাকুরের চেলা, এদের গায়ে হাত দিতে ভয় করে। কিন্তু যে-রকম গোলমাল লাগিয়েছে, এখনই মহারাজের কানে যাবে
মুশকিলে পড়ব। কী বাবা, তোমরা মিছে চেঁচামেচি করছ কেন বলো তো।
    সকলে। আমরা রাজার কাছে দরবার করব।
    প্রহরী। আমার পরামর্শ শোন্‌ বাবা
দরবার করতে গিয়ে মরবি। তোরা নেহাত ছোটো বলেই মহারাজ তোদের গায়ে হাত দেন নি কিন্তু হাঙ্গামা যদি করিস তো একটি প্রাণীও রক্ষা পাবি নে।
    ১। আমরা আর তো কিছু চাই নে, যে-গারদে বাবা আছেন আমরাও সেখানে থাকতে চাই।
    প্রহরী। ওরে চাই বললেই হবে এমন দেশ এ নয়।
    ২। আচ্ছা আমরা আমাদের যুবরাজকে দেখে যাব।
    প্রহরী। তিনি তোদের ভয়েই লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন।
    ৩। তাঁকে না দেখে আমরা যাব না।
    সকলে। (ঊর্ধ্বস্বরে) দোহাই যুবরাজ বাহাদুর।

                                    উদয়াদিত্যের প্রবেশ

    উদয়াদিত্য। আমি তোদের হুকুম করছি তোরা দেশে ফিরে যা।
    ১। তোমার হুকুম মানব
আমাদের ঠাকুরও হুকুম করেছেন তাঁর হুকুমও মানব কিন্তু তোমাকে আমরা নিয়ে যাব।
                            উদয়াদিত্য।
    আমায় নিয়ে কী হবে।
    ১। তোমাকে আমাদের রাজা করব।
    উদয়াদিত্য। তোদের তো বড়ো আস্পর্ধা! এমন কথা মুখে আনিস! তোদের কি মরবার জায়গা ছিল না।
    ২। মরতে হয় মরব, কিন্তু আমাদের আর দুঃখ সহ্য হয় না।
    ৩। আমাদের যে বুক কেমন করে ফাটছে তা বিধাতাপুরুষ জানেন।
    ৪। রাজা, তোমার দুঃখে আমাদের কলিজা জ্বলে গেল।
    ৫। আমাদের মা-লক্ষ্মী কোথায় গেল রাজা?
    ১। আমাদের দয়া করেছিল বলেই সে গেল।
    ২। এ রাজ্যে কেউ আমাদের মুখ তুলে চায় নি
সন্তানের সেই অনাদর কেবল আমাদের মার মনে সয় নি।
    ৩। দু'বেলা মা আমাদের কত যত্ন করে কত খাবার পাঠিয়েছে। সেই মাকে রাখতে পারলুম না রে।
    ৪। কিন্তু রাজা, তুমি মুখ ফিরিয়ে চলেছ কোথায়? তোমাকে ছাড়ছি নে।
    ৫। আমরা জোর করে নিয়ে যাব, কেড়ে নিয়ে যাব।
    উদয়াদিত্য। আচ্ছা শোন্‌ আমি বলি
তোরা যদি দেরি না করে এখনই দেশে চলে যাস তাহলে আমি মহারাজের কাছে নিজে মাধবপুরে যাবার দরবার করব।
    ১। সঙ্গে আমাদের ঠাকুরকেও নিয়ে যাবে?
    উদয়াদিত্য। চেষ্টা করব। কিন্তু আর দেরি না
এই মুহূর্তে তোরা এখান থেকে বিদায় হ।
    প্রজারা। আচ্ছা আমরা বিদায় হলুম। জয় হোক। তোমার জয় হোক।

 


চন্দ্রদীপ। রাজা রামচন্দ্রের কক্ষ
রামচন্দ্র, মন্ত্রী, দেওয়ান, রমাই ও অন্যান্য সভাসদগণ
রামচন্দ্র গদির উপর তাকিয়া হেলান দিয়া গুড়গুড়ি টানিতে টানিতে
সম্মুখস্থ একজন অপরাধীর বিচার করিতেছেন

 

    রামচন্দ্র। বেটা, তোর এতবড়ো যোগ্যতা!

    অপরাধী। (সরোদনে) দোহাই মহারাজ, আমি এমন কাজ করি নি।
    মন্ত্রী। বেটা প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে আর আমাদের মহারাজের তুলনা?
    দেওয়ান। বেটা, জানিস নে, যখন প্রতাপাদিত্যের বাপ প্রথম রাজা হয় তখন তাকে রাজটিকা পরাবার জন্যে সে আমাদের মহারাজার স্বর্গীয় পিতামহের কাছে আবেদন করে। অনেক কাঁদাকাটা করাতে তিনি তাঁর বাঁ পায়ের কড়ে আঙুল দিয়ে তাকে টিকা পরিয়ে দেন।
    রমাই। বিক্রমাদিত্যের বেটা প্রতাপাদিত্য, ওরা তো দুই পুরুষে রাজা। প্রতাপাদিত্যের পিতামহ ছিল কেঁচো, কেঁচোর পুত্র হল জোঁক, বেটা প্রজার রক্ত খেয়ে খেয়ে বিষম ফুলে উঠল, সেই জোঁকের পুত্র আজ মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে মাথাটা কুলোপানা করে তুলেছে আর চক্র ধরতে শিখেছে। আমরা পুরুষানুক্রমে রাজসভায় ভাঁড়বৃত্তি করে আসছি; আমরা বেদে, আমরা জাতসাপ চিনি নে?
    রামচন্দ্র। আচ্ছা, যা
যাত্রা বেঁচে গেলি, ভবিষ্যতে সাবধান থাকিস।
                    [ মন্ত্রী, রমাই ও রামচন্দ্র ব্যতীত সকলের প্রস্থান
    রমাই। আপনি তো চলে এলেন, এ দিকে যুবরাজ বাবাজি বিষম গোলে পড়লেন। রাজার অভিপ্রায় ছিল, কন্যাটি বিধবা হলে হাতের লোহা আর বালা দুগাছি বিক্রি করে রাজকোষে কিঞ্চিৎ অর্থাগম হয়। যুবরাজ তাতে ব্যাঘাত করলেন। তা নিয়ে তম্বি কত।
    রামচন্দ্র। (হাসিতে হাসিতে) বটে?
    মন্ত্রী। মহারাজ, শুনতে পাই, প্রতাপাদিত্য আজকাল আপসোসে সারা হচ্ছেন। এখন কী উপায়ে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবেন, তাই ভেবে তাঁর আহারনিদ্রা নেই।
    রামচন্দ্র। সত্যি নাকি ? [ হাস্য ও তাম্রকূট সেবন ]
    মন্ত্রী। আমি বললুম, আর মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে কাজ নেই। তোমাদের ঘরে মহারাজ বিবাহ করেছেন, এতেই তোমাদের সাত পুরুষ উদ্ধার হয়ে গেছে। তার পরে আবার তোমাদের মেয়েকে ঘরে এনে ঘর নিচু করা, এত পুণ্য এখনও তোমরা কর নি। কেমন হে, ঠাকুর?
    রমাই। তার সন্দেহ আছে। মহারাজ, আপনি যে পাঁকে পা দিয়েছেন, সে তো পাঁকের বাবার ভাগ্যি, কিন্তু তাই বলে ঘরে ঢোকবার সময় পা ধুয়ে আসবেন না তো কী?

                        ভৃত্যের প্রবেশ

    ভৃত্য। মহারাজ, আহার প্রস্তুত।               [ রমাই ও মন্ত্রীর প্রস্থান
                রামমোহন মালের প্রবেশ
    রামমোহন। (করজোড়ে) মহারাজ।
    রামচন্দ্র। কী রামমোহন?
    রামমোহন। মহারাজ, আজ্ঞা দিন আমি মাঠাকরুনকে আনতে যাই।
    রামচন্দ্র। সে কি কথা!
    রামমোহন। আজ্ঞে হাঁ। অন্তঃপুর অন্ধকার হয়ে আছে, আমি তা দেখতে পারি নে। অন্দরে যাই, মহারাজের ঘরে কাকেও দেখতে পাই নে, আমার যেন প্রাণ কেমন করতে থাকে। আমার মা-লক্ষ্মী ঘরে এসে ঘর আলো করুন দেখে চক্ষু সার্থক করি।
    রামচন্দ্র। রামমোহন, তুমি পাগল হয়েছ? সে-মেয়েকে আমি ঘরে আনি?
    রামমোহন। (নেত্র বিস্ফারিত করিয়া) কেন মহারাজ!
    রামচন্দ্র। বল কী রামমোহন? প্রতাপাদিত্যের মেয়েকে আমি ঘরে আনব?
    রামমোহন। কেন আনবেন না হুজুর? আপনার রানীকে আপনি যদি ঘরে এনে তাঁর সম্মান না রাখেন তাহলে কি আপনার সম্মানই রক্ষা হবে?
    রামচন্দ্র। যদি প্রতাপাদিত্য মেয়েকে না দেয়?
    রামমোহন। (বক্ষ ফুলাইয়া) কী বললে মহারাজ? যদি না দেয়? এতবড়ো সাধ্য কার যে দেবে না? আমার মা জননী, আমাদের ঘরের মা-লক্ষ্মী, কার সাধ্য তাঁকে আমাদের কাছ হতে কেড়ে রাখতে পারে? আমার মাকে আমি আনব, তুমিই বা বারণ করবার কে?
                                        [ প্রস্থানোদ্যম
    রামচন্দ্র। (তাড়াতাড়ি) রামমোহন, যেয়ো না, শোনো শোনো। আচ্ছা তুমি আনতে যাচ্ছ যাও
তাতে আপত্তি নেই কিন্তু দেখো, এ-কথা যেন কেউ শুনতে না পায়। রমাই কিংবা মন্ত্রীর কানে একথা যেন কোনোমতে না ওঠে।
    রামমোহন। যে আজ্ঞা মহারাজ।