ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
প্রায়শ্চিত্ত
চতুর্থ অঙ্ক
১
মন্ত্রী ও প্রতাপাদিত্য
প্রতাপাদিত্য। মাধবপুরের
প্রজারা দিল্লীতে দরখাস্ত নিয়ে চলেছিল—
হাতে হাতে ধরা পড়েছিল সেও কি তুমি অবিশ্বাস কর?
মন্ত্রী। আজ্ঞে না, মহারাজ, অবিশ্বাস করছি নে।
প্রতাপাদিত্য। ওরা তাতে লিখেছে, আমি দিল্লীশ্বরের শত্রু—
ওদের ইচ্ছা আমাকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে উদয়কে সিংহাসন দেওয়া হয়—
এ কথাগুলো তো ঠিক?
মন্ত্রী। আজ্ঞে হাঁ, সে দরখাস্ত তো আমি দেখেছি।
প্রতাপাদিত্য। এর চেয়ে তুমি আর কী প্রমাণ চাও?
মন্ত্রী। কিন্তু এর মধ্যে আমাদের যুবরাজ আছেন এ-কথা আমি কিছুতে
বিশ্বাস করতে পারি নে।
প্রতাপাদিত্য। তোমার বিশ্বাস কিংবা তোমার আন্দাজের উপর নির্ভর
করে তো আমি রাজকার্য চালাতে পারি নে । যদি বিপদ ঘটে তবে, 'ঐ যা, মন্ত্রী আমার ভুল
বিশ্বাস করেছিল' বলে তো নিষ্কৃতি পাব না।
মন্ত্রী। কিন্তু যুবরাজকে যে সন্দেহে কারাদণ্ড দিয়েছেন তার যদি
কোনো মূল না থাকে তা হলেও রাজকার্যের মঙ্গল হবে না।
প্রতাপাদিত্য। রাজ্য রক্ষা সহজ ব্যাপার নয় মন্ত্রী! অপরাধ
নিশ্চয় প্রমাণ হলে তার পরে দণ্ড দেওয়াই যে রাজার কর্তব্য তা আমি মনে করি নে। যেখানে
সন্দেহ করা যায় কিংবা যেখানে ভবিষ্যতেও অপরাধের সম্ভাবনা আছে সেখানেও রাজা দণ্ড
দিতে বাধ্য।
মন্ত্রী। আপনি রাগ করবেন, কিন্তু আমি এ ক্ষেত্রে সন্দেহ কিংবা
ভবিষ্যৎ অপরাধের সম্ভাবনা পর্যন্ত কল্পনা করতে পারি নে।
প্রতাপাদিত্য। মাধবপুরের প্রজারা এখানে এসেছিল কি না?
মন্ত্রী। হাঁ।
প্রতাপাদিত্য। তারা ওকেই
রাজা চেয়েছিল কি না?
মন্ত্রী। হাঁ চেয়েছিল।
প্রতাপাদিত্য। তুমি বলতে চাও এ-সকলের মধ্যে উদয়ের কোনো হাত ছিল
না?
মন্ত্রী। যদি হাত থাকত তা হলে এত প্রকাশ্যে একথার আলোচনা হত না।
প্রতাপাদিত্য। আচ্ছা আচ্ছা, তোমার নিঃসংশয় নিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত
হয়েই বসে থাকো—
কিন্তু আমি বরঞ্চ নির্দোষকে দণ্ড দেব কিন্তু যেখানে রাজ্যের কিছুমাত্র অহিত ঘটবার
আশঙ্কা আছে সেখানে বিপদটা একেবারে ঘাড়ে এসে পড়ার জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকব না। রাজার
দায়িত্ব মন্ত্রীর দায়িত্বের চেয়ে ঢের বেশি।
মন্ত্রী। অন্তত বৈরাগীঠাকুরকে ছেড়ে দিন মহারাজ। প্রজাদের মনে
একসঙ্গে এতগুলো বেদনা চাপাবেন না।
প্রতাপাদিত্য। আচ্ছা সে আমি বিবেচনা করে দেখব।
২
রায়গড়। বসন্ত রায়ের প্রাসাদ। বসন্ত রায় একাকী আসীন
পাঠানের প্রবেশ ও সেলাম
বসন্ত রায়। খাঁসাহেব এস এস।
সাহেব, তোমার মুখ এমন মলিন দেখছি কেন? মেজাজ ভালো তো?
পাঠান। মেজাজের কথা আর বলবেন না মহারাজ। একটি বয়েত আছে-- রাত্রি বলে,
আমার কি হাসবার ক্ষমতা আছে? যখন চাঁদ হাসে তখনই আমি হাসি, নইলে সব অন্ধকার! মহারাজ,
আমরাই বা কে। আপনি না হাসলে যে আমাদের হাসি ফুরিয়ে যায়! আমাদের আর সুখ নেই প্রভু!
বসন্ত রায়। সে কী কথা সাহেব! আমার তো অসুখ কিছুই নেই।
পাঠান। এখন আপনার আর তেমন গানবাজনা শুনি নে। আপনার যে সেতার
কোলে কোলেই থাকত সে তো আর দেখতেই পাই নে।
বসন্ত রায়। সেতার! সেতারে তো নাড়া দিলেই বেজে ওঠে। কিন্তু
মানুষের মনে যখন সুর লাগে না তখন কার সাধ্য তাকে বাজায়।
সীতারামের প্রবেশ
সীতারাম। জয় হোক মহারাজ! [
প্রণাম
বসন্ত রায়। আরে সীতারাম যে। ভালো আছিস তো? মুখ শুকনো যে। খবর সব
ভালো তো? শীঘ্র বল্।
সীতারাম। খবর বড়ো খারাপ—
সব বলছি।
পাঠান। হুজুর, তবে এখন আসি।
[ সেলাম ও প্রস্থান
বসন্ত রায়। সীতারাম, কী হয়েছে সব বল্, বল্, আমার প্রাণ বড়ো
অধীর হচ্ছে। আমার দাদার—
সীতারাম। নিবেদন করছি মহারাজ। যুবরাজকে আমাদের মহারাজ কারাদণ্ড
দিয়েছেন।
বসন্ত রায়। কারাদণ্ড! সে কী কথা! কেন, উদয় কী অপরাধ করেছিল?
সীতারাম। সে তো আমরা কিছু বুঝতে পারলুম না। হঠাৎ একদিন শুনলুম
যুবরাজ বন্দী।
বসন্ত রায়। অ্যাঁ! বন্দী!
সীতারাম। আজ্ঞা হাঁ মহারাজ।
বসন্ত রায়। সীতারাম, এ কি কথা! তাকে কি একেবারে জেলখানায় ফৌজ
পাহারায় বন্ধ করে রেখেছে?
সীতারাম। আজ্ঞে হাঁ মহারাজ!
বসন্ত রায়। তাকে কি একবার বেরোতেও দেয় না?
সীতারাম। আজ্ঞা না।
বসন্ত রায়। সে একলা কারাগারে?
সীতারাম। হাঁ মহারাজ!
বসন্ত রায়। প্রতাপ আমাকে বন্দী করুক না-- আমি আপনি গিয়ে ধরা
দিচ্ছি।
সীতারাম। তাতে কোনো ফল হবে না।
বসন্ত রায়। কিন্তু কী হবে সীতারাম! কী করা যায়?
সীতারাম। আমার মাথায় একটা মতলব এসেছে। আপনাকে যেতে হচ্ছে। একবার
যশোরে চলুন।
বসন্ত রায়। সে তো যাবই। একবার তো প্রতাপকে বলে কয়ে চেষ্টা করে
দেখতেই হবে।
৩
চন্দ্রদীপ। রামচন্দ্রের কক্ষ
রামচন্দ্র, মন্ত্রী,রমাই,দেওয়ান ও ফর্নাণ্ডিজ
রামমোহন প্রবেশ করিয়া জোড়হস্তে দণ্ডায়মান
রামচন্দ্র। (বিস্মিত ভাবে)
কী হল রামমোহন?
রামমোহন। সকলই নিষ্ফল হয়েছে।
রামচন্দ্র। (চমকিয়া) আনতে পারলি নে?
রামমোহন। আজ্ঞে না মহারাজ। কুলগ্নে যাত্রা করেছিলুম।
রামচন্দ্র। (ক্রুদ্ধ হইয়া) বেটা তোকে যাত্রা করতে কে বলেছিল?
তখন তোকে বার বার করে বারণ করলুম, তখন যে তুই বুক ফুলিয়ে গেলি, আর আজ—
রামমোহন। (কপালে হাত দিয়া) মহারাজ, আমার অদৃষ্টের দোষ।
রামচন্দ্র। (আরও ক্রুদ্ধ হইয়া) রামচন্দ্র রায়ের অপমান! তুই
বেটা, আমার নাম করে ভিক্ষা চাইতে গেলি, আর প্রতাপাদিত্য দিলে না! এতবড়ো অপমান
আমাদের বংশে আর কখনো হয় নি।
রামমোহন। (নত শির তুলিয়া) ওকথা বলবেন না। প্রতাপাদিত্য যদি না
দিতেন, আমি যেমন করে পারি আনতুম। প্রতাপাদিত্য রাজা বটেন কিন্তু আমার রাজা তো নন।
রামচন্দ্র। ওরে হতভাগা বেটা, তবে হল না কেন? (রামমোহন নীরব)
রামমোহন, শীঘ্র বল্।
রামমোহন। মহারাজ, তাঁর ভাই আজ কারাগারে।
রামচন্দ্র। তাতে কী হল?
রামমোহন। ভাইয়ের এই বিপদের দিনে তাঁকে একলা ফেলে চলে আসেন, এমন
মা কি আমার?
রামচন্দ্র। বটে। আসতে চাইলেন না বটে! আমার লোক গিয়ে ফিরে এল!
রামমোহন। রাগ করেন কেন মহারাজ। রাগ যদি করতে হয় তাহলে যারা
আপনার বুদ্ধি নষ্ট করেছে তাদের উপর রাগ করুন।
রামচন্দ্র। তার মানে কী হল?
রামমোহন। যুবরাজ যে আজ বন্দী তার গোড়াকার কথাটা কি এরই মধ্যে
ভুললেন? এ সমস্ত তো আমাদেরই জন্যে! এমন স্থলে আমাদের মহারানীমাকেও তো জোর করে বলতে
পারলুম না যে আমাদের কর্মের ফল তোমার ভাইয়ের উপরে চাপিয়ে তুমি চলে এস।
রামচন্দ্র। বেরো বেটা, বেরো তুই; এখনই আমার সুমুখ হতে দূর হয়ে
যা।
রামমোহন। যাচ্ছি মহারাজ, কিন্তু এ-কথা বলে যাব যে সতীলক্ষ্মী
যদি এবার তাঁর ভাইকে ছেড়ে চলে আসতেন তা হলে তাঁর স্বামীর পাপ বৃদ্ধি হত-- সেই ভয়েই
তিনি হৃদয় পাষাণ করে রইলেন, আসতে পারলেন না।
[ প্রস্থান
মন্ত্রী। মহারাজ আর-একটি বিবাহ করুন।
দেওয়ান। মন্ত্রী ঠিক কথাই বলেছেন। তাহলে প্রতাপাদিত্য এবং তাঁর
কন্যাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হবে।
রমাই। এ শুভকার্যে আপনার বর্তমান শ্বশুরমশাইকে একখানা
নিমন্ত্রণপত্র পাঠাতে ভুলবেন না, নইলে কী জানি তিনি মনে দুঃখ করতে পারেন।
সকলে। হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ হোঃ!
রমাই। বরণ করবার জন্য এয়োস্ত্রীদের মধ্যে যশোরে আপনার
শাশুড়ীঠাকরুনকে ডেকে পাঠাবেন, আর মিষ্টান্নমিতরে জন—
প্রতাপাদিত্যের মেয়েকে যখন একথাল মিষ্টান্ন পাঠাবেন—
তখন তার সঙ্গে দুটো কাঁচা রম্ভা পাঠিয়ে দেবেন।
রামচন্দ্র। হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ হাঃ হাঃ!
[ সভাসদগণের হাস্য। সকলের অলক্ষ্যে ফর্নাণ্ডিজের প্রস্থান
দেওয়ান। তা মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ
যদি ইতর লোকের ভাগ্যেই মিষ্টান্ন থাকে
তা হলে তো যশোরেই সমস্ত মিষ্টান্ন খরচ হয়ে যায় চন্দ্রদীপে আর খাবার উপযুক্ত লোক
থাকে না।
রামচন্দ্র। আমার শ্বশুরকে এখনই একটা চিঠি লিখে দিতে হচ্ছে।
মন্ত্রী। কী লিখব।
রমাই। লেখো, তোমার রাজত্ব এবং রাজকন্যা তোমারই থাক-- জগতে
শালা-শ্বশুরের অভাব নেই।
সকলে। হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ ওঃ হোঃ হোঃ!
মন্ত্রী। তা বেশ, ওই কথাই গুছিয়ে লেখা যাবে।
রামচন্দ্র। আজই ও-চিঠি রওনা করে দিয়ো।
৪
যশোহর। প্রতাপাদিত্যের কক্ষ
বসন্ত রায়ের প্রবেশ
বসন্ত রায়। বাবা প্রতাপ,
উদয়কে আর কেন কষ্ট দাও? পদে পদেই যদি সে তোমাদের কাছে অপরাধ করে, তবে তাকে এই বুড়োর
কাছে দাও না। (প্রতাপ নিরুত্তর) তুমি যা মনে করে উদয়কে শাস্তি দিচ্ছ সেই অপরাধ যে
যথার্থ আমার। অমিই যে রামচন্দ্র রায়কে রক্ষা করবার জন্যে চক্রান্ত করেছিলুম।
প্রতাপাদিত্য। খুড়োমশায়, বৃথা কথা বলে আমার কাছে কোনোদিন কেউ ফল
পায় নি।
বসন্ত রায়। ভালো, আমার আর একটি ক্ষুদ্র প্রার্থনা আছে। আমি
একবার কেবল উদয়কে দেখে যেতে চাই—
আমাকে তার সেই কারাগৃহে প্রবেশ করতে কেউ যেন বাধা না দেয় এই অনুমতি দাও।
প্রতাপাদিত্য। সে হতে পারবে না।
বসন্ত রায়। তা হলে আমাকে তার সঙ্গে এক সঙ্গে বন্দী করে রাখো।
আমাদের দুজনেরই অপরাধ এক, দণ্ডও এক হোক—
যতদিন সে কারাগারে থাকবে আমিও থাকব।
[ নীরবে প্রতাপের প্রস্থান
সীতারামের প্রবেশ ও প্রণাম
বসন্ত রায়। কী সীতারাম খবর কী?
সীতারাম। খবর পরে বলব। এখন শীঘ্র একবার আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে
হবে। বিলম্ব করবেন না।
বসন্ত রায়। কেন সীতারাম। কোথায় যেতে হবে?
[ বসন্ত রায়ের কানে কানে সীতারামের ভাষণ
(বিস্ফারিত নেত্রে) অ্যাঁ। সত্যি নাকি।
সীতারাম। মহারাজ কথা কবার সময় নেই শীঘ্র আসুন।
বসন্ত রায়। একবার বিভার সঙ্গে দেখাটা করে আসি না?
সীতারাম। না, সে হয় না—
আর দেরি না।
বসন্ত রায়। তবে কাজ নেই—
চলো (অগ্রসর হইয়া) কিন্তু বেশি দেরি হত না-- একবার দেখা করেই চলে আসতুম।
সীতারাম। না মহারাজ, তাহলে বিপদ হবে।
[ প্রস্থান
৫
কারাগার
উদয়াদিত্য । অনুচরের প্রবেশ
উদয়াদিত্য। লোচনদাস।
লোচনদাস। যুবরাজ।
উদয়াদিত্য। যুবরাজ কাকে বলছ।
লোচনদাস। আজ্ঞে, আপনাকে।
উদয়াদিত্য। আমার এই যৌবরাজ্য যেন পরম শত্রুর ভাগ্যেও না পড়ে।
লোচন।
লোচনদাস। আজ্ঞে।
উদয়াদিত্য। সময় এখন কত? বিভার কি আসবার সময় হয় নি?
লোচনদাস। আজ্ঞে, এখনও কিছু দেরি আছে। মায়ের ভোগ সারা হলে তিনি
নিজের হাতে প্রসাদ নিয়ে আসবেন।
উদয়াদিত্য। সন্ধ্যারতি এতক্ষণে হয়ে গেছে বোধ হয়।
লোচনদাস। আজ্ঞে হাঁ হয়ে গেছে।
উদয়াদিত্য। পাখিরা সব বাসায় ফিরে গেছে। নহবতখানায় এতক্ষণে
ইমনকল্যাণের সুর বাজছে। লোচন, বিভার শ্বশুরবাড়ি থেকে কি আজও লোক আসে নি।
লোচনদাস। একবার মোহন এসেছিল।
উদয়াদিত্য। তবে? বিভা কি—
লোচনদাস। দিদিঠাকরুন আপনাকে একলা রেখে যেতে পারলেন না।
উদয়াদিত্য। সে হবে না, সে হবে না। তাকে যেতে হবে। যেতেই হবে।
আমার জন্যে ভাবনা নেই-- আমার সমস্ত সইবে। এই যে তার ফুলগুলি এখনও শুকোয় নি।
সকালবেলায় পূজোর পরে প্রসাদী ফুল এনে দিয়ে গেল-- তখন তার মুখে দেবীকে প্রত্যক্ষ
দেখতে পেয়েছিলুম।
লোচনদাস। আহা দেবীই বটে।
উদয়াদিত্য। কিন্তু তাকে যেতেই হবে। আমি সইতে পারব। তাকে ধরে
রাখব না।
বাহিরে। আগুন আগুন।
প্রহরীর প্রবেশ
প্রহরী। আগুন লেগেছে! পালান পালান!
৬
খালের ধারে নৌকার সম্মুখে
সীতারামের সহিত যুবরাজের দ্রুত প্রবেশ
সীতারাম। এই নৌকা, এই নৌকা,
আসুন, উঠে পড়ুন—
নৌকার ভিতর হইতে বসন্ত রায়ের অবতরণ
বসন্ত রায়। দাদা এসেছিস? আয় দাদা আয়। [ বাহু প্রসারণ
উদয়াদিত্য। দাদামশায়! [ আলিঙ্গন
বসন্ত রায়। কী দাদা?
উদয়াদিত্য। (উদ্ভ্রান্তভাবে চারিদিকে চাহিয়া) দাদামশায়।
বসন্ত রায়। এই যে আমি দাদা—
কেন ভাই।
উদয়াদিত্য। (দুই হস্ত ধরিয়া) আজ আমি ছাড়া পেয়েছি—
তোমাকে পেয়েছি, আর আমার সুখের কী অবশিষ্ট রইল? এ মুহূর্ত আর কতক্ষণ থাকবে?
সীতারাম। (করজোড়ে) যুবরাজ, নৌকায় উঠুন।
উদয়াদিত্য। (চমকিত হইয়া) কেন? নৌকায় কেন?
সীতারাম। নইলে এখনই আবার প্রহরীরা আসবে, এখনই ধরে ফেলবে।
উদয়াদিত্য। (বিস্মিত হইয়া) আমরা কি পালিয়ে যাচ্ছি?
বসন্ত রায়। (হাত ধরিয়া) হাঁ ভাই—
আমি তোকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছি। এ যে পাষাণ-হৃদয়ের দেশ।
সীতারাম। যুবরাজ, আমি তোমাকে উদ্ধার করবার জন্যে কারাগারে আগুন
লাগিয়েছি।
উদয়াদিত্য। কী সর্বনাশ—
মরবি যে।
সীতারাম। তুমি যতদিন কয়েদে ছিলে প্রতিদিনই আমি মরেছি।
উদয়াদিত্য। (অনেকক্ষণ ভাবিয়া) না আমি পালাতে পারব না।
বসন্ত রায়। কেন দাদা, এ বুড়োকে কি ভুলে গেছিস?
উদয়াদিত্য। (দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া) না না,
—আমি
কারাগারে ফিরে যাই।
বসন্ত রায়। (হাত চাপিয়া ধরিয়া) কেমন করে যাবি যা দেখি! আমি যেতে
দেব না।
উদয়াদিত্য। এ হতভাগাকে নিয়ে কেন বিপদ ডাকছ?
বসন্ত রায়। দাদা তোর জন্য যে বিভাও কারাবাসিনী হয়ে উঠল। তার এই
নবীন বয়সে সে কি তার সমস্ত জীবনের সুখ জলাঞ্জলি দেবে?
উদয়াদিত্য। চলো, চলো, চলো। সীতারাম, প্রাসাদে তিনখানি পত্র
পাঠাতে চাই।
সীতারাম। নৌকাতেই লিখে দেবেন। ওইখানেই চলুন। [ প্রস্থান
ধনঞ্জয়ের প্রবেশ
নৃত্যগীত
ওরে
আগুন আমার ভাই
আমি
তোমারি জয় গাই।
তোমার
শিকলভাঙা এমন রাঙা মূর্তি দেখি নাই।
তুমি
দু হাত তুলে আকাশপানে
মেতেছ আজ কিসের গানে।
এ কী
আনন্দময় নৃত্য অভয় বলিহারি যাই।
যে দিন
ভবের মেয়াদ ফুরোবে ভাই,
আগল যাবে সরে
সে দিন হাতের
দড়ি পায়ের বেড়ি
দিবি রে ছাই করে।
সে দিন আমার
অঙ্গ তোমার অঙ্গে
ওই নাচনে নাচবে রঙ্গে,
সকল দাহ মিটবে দাহে
ঘুচবে সব বালাই।
৭
প্রতাপাদিত্যের কক্ষ
প্রতাপাদিত্য ও মন্ত্রী
প্রতাপাদিত্য।দৈবাৎ আগুন
লাগার কথা আমি এক বর্ণ বিশ্বাস করি নে। এর মধ্যে চক্রান্ত আছে। খুড়ো কোথায়?
মন্ত্রী। তাঁকে দেখা যাচ্ছে না।
প্রতাপাদিত্য। হুঁ। তিনিই এই অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে ছোঁড়াটাকে নিয়ে
পালিয়েছেন।
মন্ত্রী। তিনি সরল লোক—
এ সকল বুদ্ধি তো তাঁর আসে না।
প্রতাপাদিত্য। বাইরে থেকে যাকে সরল বলে বোধ না হবে তার কুটিল
বুদ্ধি বৃথা।
মন্ত্রী। কারাগার ভস্মসাৎ হয়ে গেছে, আমার আশঙ্কা হচ্ছে যদি—
প্রতাপাদিত্য। কোনো আশঙ্কা নেই, আমি বলছি উদয়কে নিয়ে খুড়োমহারাজ পালিয়েছেন।
দ্বারীর প্রবেশ
দ্বারী। মহারাজ পত্র—
প্রতাপাদিত্য। কার পত্র?
দ্বারী। হুজুর, যুবরাজের হাতের লেখা।
প্রতাপাদিত্য। কে এনেছে?
দ্বারী। একজন নৌকার মাঝি।
প্রতাপাদিত্য। সে কোথায় গেল?
দ্বারী। সে পালিয়েছে। [ প্রস্থান
প্রতাপাদিত্য। (পত্র পাঠান্তে) এই দেখো মন্ত্রী, উদয় আমার কাছে
মাপ চেয়েছে।
মন্ত্রী। (করজোরে) তাঁকে মাপ করুন মহারাজ।
প্রতাপাদিত্য। তাকে মাপ করব না তো কী! সে আমার দণ্ডেরও যোগ্য
নয়। কিন্তু—মুক্তিয়ার
খাঁ!
মুক্তিয়ার খাঁর প্রবেশ
মুক্তিয়ার। খোদাবন্দ্। [ সেলাম
প্রতাপাদিত্য। অশ্ব প্রস্তুত আছে—
তুমি এখনই যাও! কাল রাত্রে আছে বসন্ত রায়ের ছিন্ন মুণ্ড দেখতে চাই।
মুক্তিয়ার। যো হুকুম মহারাজ! [ প্রস্থান
প্রতাপাদিত্য। সেই বৈরাগীটার খবর পেয়েছ?
মন্ত্রী। না মহারাজ।
প্রতাপাদিত্য। সে বোধ হয় পালিয়েছে। সে যদি থাকে তো আমার কাছে
পাঠিয়ে দিয়ো।
মন্ত্রী। কেন মহারাজ, তাঁকে আবার কিসের প্রয়োজন?
প্রতাপাদিত্য। আর কিছু নয়—
সেই ভাঁড়টাকে নিয়ে একটু আমোদ করতে পারতুম—
তার কথা শুনতে মজা আছে।
ধনঞ্জয়ের প্রবেশ
ধনঞ্জয়। জয় হোক মহারাজ। আপনি তো আমাকে ছাড়তেই চান না কিন্তু
কোথা থেকে আগুন ছুটির পরোয়ানা নিয়ে হাজির। কিন্তু না বলে যাই কী করে! তাই হুকুম
নিতে এলুম।
প্রতাপাদিত্য। ক-দিন কাটল কেমন?
ধনঞ্জয়। সুখে কেটেছে—
কোনো ভাবনা ছিল না। এ সব তারই লুকোচুরি খেলা ভেবেছিল গারদে লুকোবে, ধরতে পারব না—
কিন্তু ধরেছি, চেপে ধরেছি, তার পরে খুব হাসি, খুব গান। বড়ো আনন্দ গেছে—
আমার গারদ-ভাইকে মনে থাকবে।
গান
ওরে শিকল, তোমায় কোলে করে
দিয়েছি ঝংকার।
তুমি আনন্দে ভাই রেখেছিলে
ভেঙে অহংকার।
তোমায় নিয়ে ক'রে খেলা
সুখে দুঃখে কাটল বেলা,
অঙ্গ বেড়ি দিলে বেড়ি
বিনা দামের অলংকার।
তোমার 'পরে করি নে রোষ,
দোষ থাকে তো আমারি দোষ,
ভয় যদি রয় আপন মনে
তোমায় দেখি ভয়ংকর।
অন্ধকারে সারা রাতি
ছিলে আমার সাথের সাথী,
সেই দয়াটি স্মরি তোমায়
করি নমস্কার।
প্রতাপাদিত্য। বল কি বৈরাগী, গারদে তোমার এত আনন্দ কিসের?
ধনঞ্জয়। মহারাজ, রাজ্যে তোমার যেমন আনন্দ তেমনি আনন্দ, অভাব
কিসের? তোমাকে সুখ দিতে পারেন আর আমাকে পারেন না?
প্রতাপাদিত্য। এখন তুমি যাবে কোথায়?
ধনঞ্জয়। রাস্তায়।
প্রতাপাদিত্য। বৈরাগী, আমার এক-এক বার মনে হয় তোমার ওই রাস্তাই
ভালো—
আমার এই রাজ্যটা কিছু না।
ধনঞ্জয়। মহারাজ, রাজ্যটাও তো রাস্তা। চলতে পারলেই হল! ওটাকে যে
পথ বলে জানে সেই তো পথিক; আমরা কোথায় লাগি? তাহলে অনুমতি যদি হয় তো এবারকার মতো
বেড়িয়ে পড়ি।
প্রতাপাদিত্য। আচ্ছা, কিন্তু মাধবপুরে যেয়ো না ।
ধনঞ্জয়। সে কেমন করে বলি! যখন নিয়ে যাবে তখন কার বাবার সাধ্য
বলে যে যাব না?