ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি
 

প্রায়শ্চিত্ত

পঞ্চম অঙ্ক

রায়গড়। বসন্ত রায়ের প্রাসাদসংলগ্ন প্রান্তর
উদয়াদিত্যের প্রবেশ

 

    উদয়াদিত্য। মহারাজ যে দাদামশায়কে সহজে নিষ্কৃতি দেবেন তার সম্ভাবনা নেই। আমি এখানে থেকে তাঁর এই বিপদ ঘনিয়ে তোলা কোনোমতেই উচিত হচ্ছে না। আর দেরি করা না। আজই আমাকে পালাতে হবে। দাদামশায়কে বলে যাওয়া মিথ্যা। তিনি কিছুতেই ছাড়বেন না। উঃ আজ সমস্ত দিনটা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে, দুই-এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে, দেখি দাদামহাশয় কী করছেন, তাঁকে ওদিকে কে একটা লোক সরে গেল, ও আবার কে?
                        পশ্চাৎ হইতে মুক্তিয়ার খাঁর প্রবেশ ও সেলাম সম্মুখ হইতে দুইজন সৈন্যের প্রবেশ ও সেলাম

    উদয়াদিত্য। কে, মুক্তিয়ার খাঁ, কী খবর।
    মুক্তিয়ার। জনাব, আমাদের মহারাজের কাছ থেকে আদেশ নিয়ে এসেছি।
    উদয়াদিত্য। কী আদেশ মুক্তিয়ার।
                    [ উদয়াদিত্যের হস্তে মুক্তিয়ার খাঁর আদেশপত্র প্রদান
    উদয়াদিত্য। এর জন্য এত সৈন্যের প্রয়োজন কী? আমাকে একখানা পত্র লিখে আদেশ করলেই তো আমি যেতুম। আমি তো আপনিই যাচ্ছিলুম, যাব বলেই স্থির করেছি। তবে আর বিলম্বে প্রয়োজন কী। এখনই চলো। এখনই যশোরে ফিরে যাই।
    মুক্তিয়ার। (করজোড়ে) এখনই ফিরতে পারব না তো হুজুর, আমার যে আরো কাজ আছে।
    উদয়াদিত্য। (ভীত হইয়া) কেন! কী কাজ?
    মুক্তিয়ার। আরও এক আদেশ আছে, তা পালন না করে যেতে পারব না।
    উদয়াদিত্য। কী আদেশ? বলছ না কেন?
    মুক্তিয়ার। রায়গড়ের রাজার প্রতি মহারাজা প্রাণদণ্ডের আদেশ করেছেন।
    উদয়াদিত্য। (চমকিয়া উচ্চস্বরে) না,
করেন নি, মিথ্যা কথা।
    মুক্তিয়ার। আজ্ঞে যুবরাজ মিথ্যে নয়। আমার কাছে মহারাজের স্বাক্ষরিত পত্র আছে।
    উদয়াদিত্য। (সেনাপতির হাত ধরিয়া) মুক্তিয়ার খাঁ, তুমি ভুল বুঝেছ। মহারাজ আদেশ করেছেন যে যদি উদয়াদিত্যকে না পাও তা হলে বসন্ত রায়ের
আমি যখন ধরা দিচ্ছি, তখন আর কী। আমাকে এখনই নিয়ে চলো এখনই নিয়ে চলো বন্দী করে নিয়ে চলো আর দেরি ক'রো না।

    মুক্তিয়ার। যুবরাজ, আমি ভুল বুঝি নি! মহারাজ স্পষ্ট আদেশ করেছেন
    উদয়াদিত্য। তুমি নিশ্চয় ভুল বুঝেছ, তাঁর অভিপ্রায় এরূপ নয়। আচ্ছা চলো, যশোরে চলো। আমি মহারাজের সাক্ষাতে তোমাদের বুঝিয়ে দেব। তিনি যদি দ্বিতীয় বার আদেশ করেন সম্পন্ন ক'রো।
    মুক্তিয়ার। (করজোড়ে) যুবরাজ মার্জনা করুন। তা পারব না।
    উদয়াদিত্য। (অধীরভাবে) মুক্তিয়ার, মনে আছে আমি এককালে সিংহাসন পাব। আমার কথা রাখো, আমাকে সন্তুষ্ট করো।
                                                [ মুক্তিয়ার খাঁ নীরব

    (সেনাপতির হাত দৃঢ়ভাবে ধরিয়া) মুক্তিয়ার খাঁ, বৃদ্ধ নিরপরাধ পুণ্যাত্মাকে বধ করলে নরকেও তোমার স্থান হবে না!

    মুক্তিয়ার। মনিবের আদেশ পালন করতে পাপ নেই।
    উদয়াদিত্য। মিথ্যা কথা। যে ধর্মশাস্ত্রে তা বলে, সে ধর্মশাস্ত্রও মিথ্যা। নিশ্চয় জেনো মুক্তিয়ার পাপ আদেশ পালন করলে পাপ।
                                              [ মুক্তিয়ার খাঁ নীরব
    তবে আমাকে ছেড়ে দাও আমি গড়ে ফিরে যাই। তোমার সৈন্যসামন্ত নিয়ে সেখানে যেয়ো
আমি তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করছি। সেখানে রণক্ষেত্রে জয়লাভ করে তার পর তোমার আদেশ পালন ক'রো।
                [ কতিপয় সৈন্যের প্রবেশ ও উদয়াদিত্যকে বেষ্টন
    উদয়াদিত্য। (উচ্চৈস্বরে) দাদামহাশয় সাবধান।   [ সৈন্যগণ কতৃক বন্দী
                    দাদামশায়, সাবধান!

                                            জনৈক পথিকের প্রবেশ

    পথিক। কে গো।
    উদয়াদিত্য। যাও যাও
গড়ে ছুটে যাও মহারাজকে সাবধান করে দাও।
    মুক্তিয়ার। বাঁধো ওকে।      [ পথিক গ্রেপ্তার

 


কতিপয় বালককে লইয়া বসন্ত রায়

 

    বসন্ত রায়। বাবা, খুব ভালো করে শিখে নাও। এবারকার রাসলীলায় খুব ধুম হবে। আমি নিজে পদ বচনা করেছি একেবারে নিখুঁত করে গাইতে হবে। রায়গড়ে এবার আমাদের উদয় এসেছে আমার সেই বঁধু (গাহিতে গাহিতে)
        বাবা, ধরো তোমাদের গান ধরো


                            ভৈরবী
        ওকে     ধরিলে তো ধরা দেবে না,
        ওকে     দাও ছেড়ে, দাও ছেড়ে!
        মন       নাই যদি দিল, নাই দিল,
        মন       নেয় যদি নিক কেড়ে।
                   এ কী খেলা মোরা খেলেছি,
        শুধু       নয়নের জল ফেলেছি,
        ওরি      জয় যদি হয় জয় হোক,
        মোরা    হারি যদি, যাই হেরে!
                  একদিন মিছে আদরে
        মনে     গরব সোহাগ না ধরে,
        শেষে    দিন না ফুরাতে ফুরাতে,
        সব      গরব দিয়েছে সেরে।
                  ভেবেছিনু ওকে চিনেছি,
        বুঝি     বিনা পণে ওকে কিনেছি
        ও যে    আমাদেরি কিনে নিয়েছে,
        ও যে    তাই আসে, তাই ফেরে।

    দাদা এখনও কেন এল না? ওরে দাদা কি ফিরেছে?
    অনুচর। না, তিনি তো ফেরেন নি।
    বসন্ত রায়। দাদা যে অনেকক্ষণ বেরিয়েছে রে! সঙ্গে লোক আছে তো?
    অনুচর। না তিনি লোক ফিরিয়ে দিয়েছেন।
    বসন্ত রায়। ওরে তোরা একজন কেউ যা। ও কে ও। এ কী, এ যে মুক্তিয়ার খাঁ। খাঁসাহেব ভালো তো?

                            মুক্তিয়ার খাঁর প্রবেশ

    মুক্তিয়ার। (সেলাম করিয়া) হাঁ মহারাজ।
    বসন্ত রায়। আহারাদি হয়েছে?
    মুক্তিয়ার। আজ্ঞা হাঁ । গোপনে কিছু কথা আছে।
    বসন্ত রায়। আচ্ছা, তোমরা সব যাও।
                    [ সকলের প্রস্থান

    আজ তবে তোমার এখানে থাকবার বন্দোবস্ত করে দিই।
    মুক্তিয়ার। আজ্ঞা না প্রয়োজন নেই। কাজ সেরে এখনই যেতে হবে।
    বসন্ত রায়। না তা হবে না খাঁ সাহেব, আজ তোমাকে ছাড়ব না। আাজ এখানে থাকতেই হবে। লোকজন তো সঙ্গে অনেক দেখছি। কোথাও লড়াইয়ে বেরিয়েছ না কি? রসদের বন্দোবস্ত করে দিতে হবে তো। ওরে--
    মুক্তিয়ার। না মহারাজ, কিছুই করতে হবে না, শীঘ্রই যাব।
    বসন্ত রায়। কেন বলো দেখি, বিশেষ কাজ আছে বুঝি, প্রতাপ ভালো আছে তো?
    মুক্তিয়ার। মহারাজ ভালো আছেন।
    বসন্ত রায়। তবে কী তোমার কাজ শীঘ্র বলো, বিশেষ জরুরি শুনে উদ্‌বেগ হচ্ছে। প্রতাপের তো কোনো বিপদ ঘটে নি ?
    মুক্তিয়ার। আজ্ঞা না, তাঁর কোনো বিপদ ঘটে নি। মহারাজের একটি আদেশ পালন করতে এসেছি।
    বসন্ত রায়। কী আদেশ এখনই বলো।
 

    আদেশপত্র বাহির করিয়া বসন্ত রায়ের হস্তে প্রদান এবং বসন্ত রায়ের

    বসন্ত রায়। এ কি প্রতাপের লেখা

    মুক্তিয়ার। হাঁ।
    বসন্ত রায়। খাঁসাহেব, এ কি প্রতাপের স্বহস্তে লেখা?
    মুক্তিয়ার। হাঁ মহারাজ।
    বসন্ত রায়। খাঁসাহেব, আমি প্রতাপকে নিজের হাতে মানুষ করেছি। (কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া) প্রতাপ যখন এতটুকু ছিল সে আমাকে একমুহূর্ত ছেড়ে থাকতে চাইত না। দাদা কোথায়? উদয় কোথায়?
    মুক্তিয়ার। তিনি বন্দী হয়েছেন, মহারাজের নিকট বিচারের জন্যে পাঠানো হয়েছে।
    বসন্ত রায়। উদয় বন্দী হয়েছে! বন্দী হয়েছে খাঁসাহেব! আমি একবার তাকে কি দেখতে পাব না?
    মুক্তিয়ার। (করজোড়ে) না জনাব হুকুম নেই।
    বসন্ত রায়। (মুক্তিয়ার খাঁর হাত ধরিয়া) একবার তাকে দেখতে দেবে না খাঁসাহেব?
    মুক্তিয়ার। আমি আদেশপালক ভৃত্য মাত্র।
    বসন্ত রায়। এস সাহেব তোমার অন্য আদেশটাও পালন করো।
    মুক্তিয়ার। (মাটি ছুঁইয়া সেলাম করিয়া জোড়হস্তে) মহারাজ আমাকে মার্জনা করবেন
আমি প্রভুর আদেশ পালন করছি মাত্র, আমার কোনো দোষ নেই।
    বসন্ত রায়। না সাহেব
তোমার দোষ কী। তোমার কোনো দোষ নেই। প্রতাপকে ব'লো, এই পাপে তার প্রয়োজন ছিল না আমি আর কতদিনই বা বাঁচতুম। আমি মরতে ভয় করি নে। কিন্তু এইখানেই পাপের শান্তি হোক শান্তি হোক আর নয়। উদয়কে যেন খাঁসাহেব, কী আর বলব ঈশ্বর যা করেন তাই হবে আমাদের কেবল কান্নাই সার।

 


প্রতাপাদিত্যের কক্ষ
বন্দীভাবে উদয়াদিত্য

 

    প্রতাপাদিত্য। কোন্‌ শাস্তি তোমার উপযুক্ত?
    উদয়াদিত্য। আপনি যা আদেশ করেন।
    প্রতাপাদিত্য। তুমি আমার এ রাজ্যের যোগ্য নও।
    উদয়াদিত্য। না মহারাজ, আমি যোগ্য নই। আপনার এই সিংহাসন হতে আমাকে অব্যাহতি দিন এই ভিক্ষা।
    প্রতাপাদিত্য। তুমি যা বলছ তা যে সত্যই তোমার হৃদয়ের ভাব তা কী করে জানব?
    উদয়াদিত্য। আজ আমি মা কালীর চরণ স্পর্শ করে শপথ করব
আপনার রাজ্যের সূচ্যগ্র ভূমিও আমি কখনো শাসন করব না, সমরাদিত্যই আপনার রাজ্যের উত্তরাধিকারী।
    প্রতাপাদিত্য। তুমি তবে কী চাও?
    উদয়াদিত্য। মহারাজ, আমি আর কিছুই চাই নে
কেবল আমাকে পিঞ্জরের পশুর মতো গারদে পুরে রাখবেন না। আমাকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করুন, আমি একাকী কাশী চলে যাই।
    প্রতাপাদিত্য। আচ্ছা, বেশ। আমি এর ব্যবস্থা করছি।

    উদয়াদিত্য। আমার আর-একটি প্রার্থনা আছে মহারাজ। আমি বিভাকে নিজে তার শ্বশুরবাড়ি পৌছে দিয়ে আসবার অনুমতি চাই।
    প্রতাপাদিত্য। তার আবার শ্বশুরবাড়ি কোথায়?
    উদয়াদিত্য। তাই যদি মনে করেন তবে সেই অনাথা কন্যাকে আমার কাছে থাকবার অনুমতি দিন। এখানে তো তার সুখও নেই কর্মও নেই।
    প্রতাপাদিত্য। তার মাতার কাছে অনুমতি নিতে পার।
    উদয়াদিত্য। তাঁর অনুমতি নিয়েছি।

 

                                        মহিষী ও বিভার প্রবেশ

    মহিষী। বাবা উদয়, তবে কি তুই কাশী যাওয়াই স্থির করলি? আমাকেও তোর সঙ্গে নিয়ে চল্‌।
                                        [ প্রতাপের প্রস্থান

    (সরোদনে) বাছা এই বয়সে তুই যদি সংসার ছেড়ে গেলি, আমি কোন্‌ প্রাণে সংসার নিয়ে থাকব? রাজ্য-সংসার পরিত্যাগ করে তুই সন্ন্যাসী হয়ে থাকবি
আর আমার মুখে এই রাজবাড়ির অন্ন যে বিষের মতো ঠেকবে! [ রোদন

    উদয়াদিত্য। মা মিথ্যা কেন কাঁদছ? যে মুক্তি পেয়েছে তার জন্যেও আবার কান্না। আমাকে আশীর্বাদ করে বিদায় করো।
    মহিষী। রাজবাড়িতে জন্ম দিয়ে তোকে চিরদিন কেবল দুঃখ দিয়েছি
আমার ভাগ্য নিয়ে যখন তোর সুখ হল না তখন আমি আর তোকে কী বলে এখানে রাখব। ঈশ্বর তোকে যেখানে রাখেন সুখে রাখুন কিন্তু বাবা, বিভার কী হবে।
    উদয়াদিত্য। কী করে বলব মা! মহারাজের কাছে হুকুম নিয়েছি, ওকে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দেব। সেখানে যদি সুখে থাকে তো ভালো
না যদি থাকে তবু ভালো ভগবান যদি প্রসন্ন থাকেন ওর ভালো তো কেউ কেড়ে নেবে না।
    বিভা। দাদা, দাদামহাশয় কেমন আছেন?

 

                            প্রতাপাদিত্যের পুনঃপ্রবেশ

    প্রতাপাদিত্য। এস উদয়, কালীর মন্দিরে এস
মার পা ছুঁয়ে শপথ করবে এস।
                                        [ সকলের প্রস্থান

 


বাটীর বাহিরে
উদয়াদিত্য ও ধনঞ্জয়

 

    ধনঞ্জয়। আজ রাস্তায় মিলন আজ বড়ো আনন্দ। আজ আর ভণ্ডামির কোনো দরকার নেই আজ যুবরাজ নয়। আজ তো তুমি ভাই! আয় ভাই কোলাকুলি করে নিই। (কোলাকুলি) দাদা, যেখানে দীনদরিদ্র সবাই এসে মেলে সেই দরাজ জায়গাটাতে এসে দাঁড়িয়েছ আজ আর কিছু ভাবনা নেই।

 

                                গান
                    সকল ভয়ের ভয় যে তারে
                            কোন্‌ বিপদে কাড়াবে?
                    প্রাণের সঙ্গে যে প্রাণ গাঁথা
                            কোন্‌ কালে সে ছাড়বে?
                    না হয় গেল সবই ভেসে

                   রইবে তো সেই সর্বনেশে!
                   যে লাভ সকল ক্ষতির শেষে
                            সে লাভ কেবল বাড়বে!
                   সুখ নিয়ে ভাই ভয়ে থাকি
                   আছে আছে দেয় সে ফাঁকি,
                   দুঃখে যে সুখ থাকে বাকি
                            কেই বা সে সুখ নাড়বে?
                   যে পড়েছে পড়ার শেষে
                   ঠাঁই পেয়েছে তলায় এসে,
                   ভয় মিটেছে বেঁচেছে সে
                            তারে কে আর পাড়বে?

    উদয়াদিত্য। বৈরাগীঠাকুর, আমি তোমার সঙ্গ ধরলুম, আর ছাড়ছি নে কিন্তু।
    ধনঞ্জয়। তুমি ছাড়ালে আমি ছাড়ি কই ভাই। মনে বেশ আনন্দ আছে তো? খুঁতমুত কিছু নেই তো?
    উদয়াদিত্য। কিছু না
বেশ আছি।
    ধনঞ্জয়। তবে দাও একটু পায়ের ধুলো!
    উদয়াদিত্য। ও কী কর। ও কী কর! অপরাধ হবে যে।
    ধনঞ্জয়। দাদা, অত বড়ো বোঝা নিজের হাতে ভগবান যার কাঁধ থেকে নামিয়ে দেন সে যে মহাপুরুষ। তোমাকে দেখে আজ আমার সর্ব গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। একবার দিদিকে আনো
তাকে একবার দেখি!
    উদয়াদিত্য। সে তোমাকে দেখবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছে
তাকে ডেকে আনছি।
                        বিভার প্রবেশ ও বৈরাগীকে প্রণাম

    ধনঞ্জয়। ভয় নেই দিদি,ভয় নেই, কোনো ভয় নেই। এই দেখ
না আমাকে দেখ্‌-না আমি তাঁর রাস্তার ছেলে রাস্তার কোলে কোলেই দিন কেটে গেল, দিনরাত্রি একেবারে ধুলোয় ধুলোময় হয়ে বেড়াই মায়ের আদরে লাল হয়ে উঠি। আমার মায়ের এই ধুলোঘরে আজ তোমার নতুন নিমন্ত্রণ কিন্তু মনে কোনো ভয় রেখো না।
    বিভা। বৈরাগীঠাকুর, তুমি কোথায় যাচ্ছ? তুমি কি আমাদের সঙ্গে যাবে?
    ধনঞ্জয়। কোথায় যাব সেকথা আমার মনে থাকে না। ওই রাস্তাই তো আমাকে মজিয়েছে। এই মাটি দেখলে আমাকে মাটি করে দেয়।

 

                               গান
                        সারি গানের সুর

            গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ

                 আমার মন ভুলায় রে!
ওরে     কার পানে মন হাত বাড়িয়ে
               লুটিয়ে যায় ধুলায় রে!
ও যে   আমায় ঘরের বাহির করে,
               পায়ে পায়ে পায়ে ধরে

ও যে   কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে
              যায় রে কোন্‌ চুলায় রে!
ও       কোন্‌ বাঁকে কী ধন দেখাবে,
         কোন্‌ খানে কী দায় ঠেকাবে,
         কোথায় গিয়ে শেষ মেলে যে

                 ভেবেই না কুলায় রে!
 

    উদয়াদিত্য। ঠাকুর, তুমি কি ভাবছ বিভা আমার পথের সঙ্গিনী? ওকে আমি ওর শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।
    ধনঞ্জয়। বেশ, বেশ, হরি যেখানে নিয়ে যান সেইখানেই ভালো। দেখি তিনি কোন্‌খানে পৌঁছিয়ে দেন
আমিও সঙ্গে আছি। কোনো ভয় নেই দিদি কোনো ভয় নেই।

 


বরবেশে রামচন্দ্র
সম্মুখে নৃত্যগীত

 

    রামচন্দ্র। রমাই, তুমি যাও লোকজনদের দেখো গে। [ রমাইয়ের প্রস্থান
                সেনাপতি, তুমি এখানে বসো, রমাইয়ের হাসি আমার ভালো লাগছে না।
    ফর্নাণ্ডিজ। মহারাজ, রমাইয়ের হাসি গন্ধকের আলোর মতো, তার ধোঁয়ায় দম আটকে আসে।
    রামচন্দ্র। ঠিক বলেছ সেনাপতি, আমার ইচ্ছা হচ্ছিল উঠে চলে যাই, আজ গানবাজনা ভাল জমছে না ফর্নাণ্ডিজ।
    ফর্নাণ্ডিজ। না মহারাজ জমছে না! আমার এই বুকে বাজছে, আর-একদিনের কথা মনে পড়ছে।
    রামচন্দ্র। গুজবটা কি সত্যি?
    ফর্নাণ্ডিজ। কিসের গুজব?
    রামচন্দ্র। ওই তাঁরা কি যশোর থেকে আসছেন?
    ফর্নাণ্ডিজ। হাঁ মহারাজ, যশোরের একটি লোকের কাছে শুনলুম তাঁদের আসবার কথা হচ্ছে। আমাকে যদি আদেশ করেন মহারাজ আমি তাঁদের এগিয়ে আনবার জন্যে যাই।
    রামচন্দ্র। এগিয়ে আনবে? তাহলে কিন্তু মন্ত্রী রমাই সবাই হাসবে।
    ফর্নাণ্ডিজ। মহারাজ যদি আদেশ করেন তাদের হাসিসুদ্ধ মুখটা আমি একেবারে সাফ করে দিতে পারি!
    রামচন্দ্র। না, না, গোলমাল করে কাজ নেই। কিন্তু সেনাপতি আমি তোমাকে গোপনে বলছি, কাউকে ব'লো না, আমি তাকে কিছুতে ভুলতে পারছি নে! কালই রাত্রে আমি তাকে স্বপ্নে দেখেছি।
    ফর্নাণ্ডিজ। মহারাজ আমি আর কি বলব
তাঁর জন্যে প্রাণ দিলে যদি কোনো কাজেও না লাগে তবুও দিতে ইচ্ছা হচ্ছে।
    রামচন্দ্র। দেখো সেনাপতি, এক কাজ করলে হয় না?
    ফর্নাণ্ডিজ। কী বলুন।
    রামচন্দ্র। মোহন যদি একবার খবর পায় যে তাঁরা আসছেন তাহলে সে আপনি ছুটে যাবে। এক বার কোনো মতে তাকে সংবাদটা জানাও না। কিন্তু দেখো, আমার নাম ক'রো না।
    ফর্নাণ্ডিজ। যে আজ্ঞা মহারাজ!   [ প্রস্থান

 

                        রমাইয়ের প্রবেশ
    রমাই। মহারাজ, যশোর থেকে তো কেউ নিমন্ত্রণ রাখতে এল না! রাগ করলে বা।
    রামচন্দ্র। হা হা হা হা ।
    রমাই। আপনার প্রথম পক্ষের শ্বশুর তো সেবার তাঁর কন্যার সিঁথির সিঁদুরের উপর হাত বুলোবার চেষ্টায় ছিলেন
এবারে তাঁকে

                    রামমোহনের দ্রুত প্রবেশ

    রামমোহন। চুপ। আর একটি কথা যদি কও তাহলে

    রমাই। বুঝেছি বাবা, আর বলতে হবে না।
    রামমোহন। মহারাজ, হাসবেন না মহারাজ। আজকের দিনে অনেক সহ্য করেছি, কিন্তু মহারাজের ওই হাসি সহ্য করতে পারছি নে।
    রামচন্দ্র। ফের বেয়াদবি করছিস !
    রামমোহন। আমার বেয়াদবি! বেয়াদবি কে করলে বুঝলে না!
    ফর্নাণ্ডিজ। মোহন, একটা কথা আছে ভাই, একটু এদিকে এস।
                                                [ উভয়ের প্রস্থান
    রামচন্দ্র। ওরা সব গান বন্ধ করে হাঁ করে বসে রইল কেন? ওদের একটু গাইতে বলো না। আজ সব যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়ছে।