ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি
 

প্রায়শ্চিত্ত

উপসংহার

নদীতীরে নৌকা
বিভা ও রামমোহন

 

    বিভা। মোহন।
    রামমোহন। মা, আজ তুমি এলে?
    বিভা। হাঁ মোহন। তুই কি আমায় নিতে এলি।
    রামমোহন। না মা,অত ব্যস্ত হ'য়ো না, আজ থাক্‌!
    বিভা। কেন মোহন, আজ কেন নয়?
    রামমোহন। আজ দিন ভালো নয় যে মা, আজ দিন ভালো নয়!
    বিভা। ভালো দিন নয়? তবে আজ এত উৎসবের আয়োজন কেন? বরাবর দেখলুম রাস্তায় আলোর মালা
বাঁশি বাজছে। আজ বুঝি শুভলগ্ন পড়েছে!
    রামমোহন। শুভলগ্ন! মিথ্যে কথা। সমস্ত ভুল।
    বিভা। মোহন, তোর কথা আমি বুঝতে পারছি নে, কী হয়েছে আমাকে সত্যি করে বল্‌! মহারাজ কি রাগ করেছেন?
    রামমোহন। রাগ করেছেন বই কি।
    বিভা। তিনি তো আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
    রামমোহন। দেরি হয়ে গেছে, মা, দেরি হয়ে গেছে। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
    বিভা। অনেক দেরি হয়ে গেছে? সময় একেবারে ফুরিয়ে গেছে?
    রামমোহন। ফুরিয়ে গেছে
সব ফুরিয়ে গেছে। সময় গেলে আর ফেরে না।
    বিভা। কে বললে ফেরে না? আমি তপস্যা করে ফেরাব
আমি জীবন-মন দিয়ে ফেরাব। মোহন, এখনই তুই আমাকে নিয়ে যা। দেরি হয়ে থাকে, আর এক মুহূর্ত দেরি করব না।
    রামমোহন। যুবরাজ কোথায় গেছেন?
    বিভা। তিনি খবর নিতে গেছেন।
    রামমোহন। তিনি ফিরে আসুন না।
    বিভা। না মোহন, আর বিলম্ব নয়। তিনি কি খবর পেয়েছেন আমি এসেছি? দাদা বললেন, তিনি নৌকার ছাত থেকে দেখেছেন ময়ূরপংখি সাজানো হচ্ছে।
    রামমোহন। হাঁ সাজানো হচ্ছে বটে

    বিভা। এখনও কি সাজানো শেষ হয় নি?
    রামমোহন। ওই ময়ূরপংখির সাজসজ্জায় আগুন লাগুক, আগুন লাগুক।
    বিভা। মোহন, তোর মুখে এ কী কথা! তুই যখন আনতে গেলি আসতে পারি নি বলে এত রাগ করেছিস? তুইও আমার দুঃখ বুঝতে পারিস নি মোহন ?
                [ মোহন নিরুত্তর
    এই দেখ্‌ তোর দেওয়া সেই শাঁখাজোড়া পরে এসেছি-- আজকের দিনে তুই আমার উপর রাগ করিস নে।

    রামমোহন। আমাকে আর দগ্ধ ক'রো না! মিথ্যে দিয়ে তোমার কাছে আর কথা চাপা দিতে পারলুম না। মা জননী, এ রাজ্যের লক্ষ্মী তুমি, কিন্তু এ রাজ্যে তোমার আজ আর স্থান নেই । চলো মা, তুমি ফিরে চলো-- তোমার এই পাদপদ্মের দাস, এই অধম সন্তান তোমার সঙ্গে যাবে।
    বিভা। মোহন, যা তোর বলবার আছে সব তুই বল্‌! আমি যে কত দুঃখ বইতে পারি তা কি তুই জানিস নে?
    রামমোহন। সন্তান যখন ডাকতে গেল তখন কেন এলি নে, তখন কেন এলি নে
আমার পোড়া কপাল, তোকে কেন আনতে পারলুম না।
    বিভা। ওরে মোহন, জগতে এমন কোনো সুখ নেই যার লোভে আমি সেদিন দাদাকে ফেলে আসতে পারতুম
এতে আমার কপালে যা থাকে তাই হবে।
    রামমোহন। তবে শোন্‌ মা, সেই ময়ূরপংখি তোর জন্যে নয়।
    বিভা। নাই হল মোহন, দুঃখ কিসের। আমি হেঁটে চলে যাব।
    রামমোহন। যাবি কোথায়? সেখানে যে আজ আর-এক রানী আসছেন।
    বিভা। আর-এক রানী!
    রামমোহন। হাঁ আর-এক রানী। আজ মহারাজের বিবাহ।
    বিভা। ওঃ
আজ বিবাহের লগ্ন।
    রামমোহন। এক বিবাহের লগ্নে মহারাজ তোমাদের ঘরে গিয়েছিলেন
আজ কোন্‌ বিবাহের লগ্নে তুমি তাঁর ঘরের সামনে এসে পৌঁছোলে! আর আমার এমন কপাল, আজ আমি বেঁচে আছি। চল্‌ মা, ফিরে চল্‌, আর এক দণ্ড নয় ওই বাঁশি আমার কানে বিষ ঢালছে! ওরে, আর একদিন কী বাঁশি শুনেছিলুম সেই কথা মনে পড়ছে! চল্‌ চল্‌ ফিরে চল্‌! অমন চুপ করে বসে রইলে কেন মা! কেমন করে কাঁদতে হয় তাও কি একেবারে ভুলে গেলে? মা, কোন্‌দিকে তাকিয়ে আছ মা? তোমার এই সন্তানের মুখের দিকে একবার চাও।
    বিভা। মোহন, আমার একটি কথা রাখতে হবে।
    রামমোহন। কী কথা?
    বিভা। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। যদি না যাস আমি একলা যাব।
    রামমোহন। সে আজ ময়ূরপংখিতে চড়বে, আর তুমি আজ হেঁটে যাবে?
    বিভা। হেঁটে যাওয়াই আমাকে সাজে
আমি হেঁটেই যাব। তুই সঙ্গে যাবি নে?
    রামমোহন। আমি সঙ্গে যাব না তো কে যাবে? কিন্তু, মা, সে সভায় আজ তুমি কিসের জন্যে যাবে?
    বিভা। কিসের জন্যে যাব? সেখানে আমার কোনো আশা নেই বলেই যাব। আমার রাগ অভিমান আমার সমস্ত বাসনা বিসর্জন করব বলেই যাব। আমি কি এতদূরে এসে অমনি চলে যাব! যে আজ আসছে তাকে আশীর্বাদ করে যাব না? নিজের হাতে করে তার হাতে আমার রাজাকে সমর্পণ করব।
    রামমোহন। তার পরে?
    বিভা। তার পরে! ভগবানের পৃথিবীতে অভাগাদেরও আশ্রয় মেলে। আমারও মিলবে।
    রামমোহন। সেই সঙ্গে আমারও মিলবে। আমি তোমাকে আনতে পারি নি কিন্তু তুমি আমাকে নিয়ে যাবে মা।
    বিভা। মোহন, আমাকে দুঃখ সইতে হবে সে-কথাটা হঠাৎ আমি ভুলে গিয়েছিলুম-- ভেবেছিলুম যা ভোগ হবার তা বুঝি হয়ে চুকে গেছে।
    রামমোহন। কেন মা, তুমি সতীলক্ষ্মী, তুমি দুঃখ কেন পাও।
    বিভা। মোহন, সেদিন অপরাধ যে সত্যি হয়েছিল
সে-কথা তো আর ভোলবার নয়। সে অপরাধের শাস্তি না হয়ে তো মিটবে না। সে শাস্তি আমিই নিলুম প্রায়শ্চিত্ত আমাকে দিয়েই হবে।
    রামমোহন। মা, তোমার পিতার হাতের আঘাত সেও তুমিই মাথায় করে নিয়েছ
আবার তোমার স্বামীর হাতের আঘাত সেও তুমিই নিলে। কিন্তু আমি বলছি মা, সকলের চেয়ে বড়ো দণ্ড পেলে তোমার স্বামী। সে আজ দ্বারের কাছে থেকেও তোমাকে হারালে।

 

                            উদয়াদিত্যের প্রবেশ

    উদয়াদিত্য। ওরে বিভা।
    বিভা। দাদা সব জানি। কিছু ভেবো না।
    উদয়াদিত্য। এখন কী করবি বোন ?
    বিভা। ভেবেছিলুম রাজবাড়িতে একবার যাব, কিন্তু যাব না।
    রামমোহন। মা, যেয়ো না, যেয়ো না। গেলে তোমার অপমান হত
সেই অপমানে তোমার স্বামীর পাপ আরও বাড়ত।
    বিভা। আমার মান অপমান সব চুকে গেছে। কিন্তু দাদার অপমান হত যে। দাদা এবার নৌকা ফেরাও।

    উদয়াদিত্য। তুই কোথায় যাবি বিভা।
    বিভা। তোমার সঙ্গে কাশী যাব।
    উদয়াদিত্য। হায় রে অদৃষ্ট।
    বিভা। দাদা, আমি আজ মুক্তি পেয়েছি। এখন তোমার চরণসেবা করে আমার জীবন আনন্দে কাটবে। মোহন, তুই তোর প্রভুর কাছে ফিরে যা।
    রামমোহন। ওই দেখো মা, ফেরবার পথে আগুন লেগেছে, ওই যে মশালের আলো
ওই যে ময়ূরপংখি চলেছে। ও পথ আমার পথ নয়।
 

                     ধনঞ্জয়ের প্রবেশ

    বিভা। বৈরাগীঠাকুর।
    ধনঞ্জয়। কেন দিদি।
    বিভা। আমাকে তোমাদের সঙ্গ দিয়ো ঠাকুর।
    উদয়াদিত্য। ঠাকুর, শেষকালে বিভাকেও আমাদের পথ নিতে হল।
    ধনঞ্জয়। সে তো বেশ কথা! দয়াময় হরি। কী আনন্দ! তোমার এ কী আনন্দ! ছাড় না, কিছুতেই ছাড় না। শ্বশুরবাড়ির রাস্তার ধারেও ডাকাতের মতো বসে আছ। দিদি এই মাঝরাস্তায় আমাদের পাগল প্রভুর তলব পড়েছে! একেবারে জোর তলব। চল্‌ চল্‌। চল্‌ চল্‌। পা ফেলে চল্‌। খুশি হয়ে চল্‌। হাসতে হাসতে চল্‌। রাস্তা এমন করে পরিস্কার করে দিয়েছে
আর ভয় কিসের!

                                    গান
            আমি ফিরব না রে, ফিরব না আর ফিরব না রে

            এমন হাওয়ার মুখে ভাসল তরী
            কূলে ভিড়ব না আর ভিড়ব না রে।
            ছড়িয়ে গেছে সুতো ছিঁড়ে
            তাই খুঁটে আজ মরব কি রে
            এখন ভাঙা ঘরের কুড়িয়ে খুঁটি
            বেড়া ঘিরব না আর ঘিরব না রে।
            ঘাটের রশি গেছে কেটে,
            কাঁদব কি তাই বক্ষ ফেটে?
            এখন পালের রশি ধরব কষি
            এ রশি ছিঁড়ব না আর ছিঁড়ব না রে