ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি

 

শেষরক্ষা


চতুর্থ অঙ্ক
তৃতীয় দৃশ্য
বাসরঘরের বাহিরে
লোকারণ্য । শঙ্খ । হুলুধ্বনি । সানাই
নিবারণ ও শিবচরণ

 


নিবারণ । কানাই! ও কানাই! কী করি বলো দেখি! কানাই গেল কোথায় ?
শিবচরণ । তুমি ব্যস্ত হোয়ো না ভাই! এ ব্যস্ত হবার কাজ নয় । আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি । তুমি পাত পাড়া হল কি না দেখে এসো দেখি ।
ভৃত্য । বাবু , আসন এসে পৌঁচেছে , সেগুলো রাখি কোথায় ?
নিবারণ । এসেছে! বাঁচা গেছে । তা সেগুলো ছাতে —
শিবচরণ । ব্যস্ত হচ্ছ কেন দাদা! কী হয়েছে বলো দেখি । কী রে বেটা , তুই হাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন ? কাজকর্ম কিছু হাতে নেই নাকি ?
ভৃত্য । আসন এসেছে , সেগুলো রাখি কোথায় তাই জিজ্ঞাসা করছি ।
শিবচরণ । আমার মাথায়! একটু গুছিয়ে-গাছিয়ে নিজের বুদ্ধিতে কাজ করা , তা তোদের দ্বারা হবে না । চল্‌ , আমি দেখিয়ে দিচ্ছি । ওরে বাতিগুলো যে এখনো জ্বালালে না । এখানে কোনো কাজেরই একটা বিলিব্যবস্থা নেই — সমস্ত বেবন্দোবস্ত। নিবারণ , ভাই , তুমি একটু ঠান্ডা হয়ে বোসো দেখি — ব্যস্ত হয়ে বেড়ালে কোনো কাজই হয় না । আঃ , বেটাদের কেবল ফাঁকি! বেহারা বেটারা সব পালিয়েছে দেখছি , আচ্ছা করে তাদের কানমলা না দিলে —
নিবারণ । পালিয়েছে নাকি! কী করা যায় ?
শিবচরণ । ব্যস্ত হোয়ো না ভাই — সব ঠিক হয়ে যাবে । বড়ো বড়ো ক্রিয়াকর্মের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখা ভারি দরকার । কিন্তু এই রেধো বেটার সঙ্গে তো আর পারি নে! আমি তাকে পইপই করে বললুম ‘ তুমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে লুচি ভাজিয়ো ', কিন্তু কাল থেকে হতভাগা বেটার চুলের টিকি দেখবার জো নেই! লুচি যেন কিছু কম পড়েছে বোধ হচ্ছে ।
নিবারণ । বলো কী শিবু! তা হলে তো সর্বনাশ!
শিবচরণ । ভয় কী দাদা! তুমি নিশ্চিন্তে থাকো , সে আমি করে নিচ্ছি । একবার রাধুর দেখা পেলে হয় , আচ্ছা করে শুনিয়ে দিতে হবে ।
নিবারণ । আহার প্রস্তুত চন্দ্রবাবু , কিছু খাবেন চলুন ।
চন্দ্রকান্ত । আমাদের পরে হবে , আগে সকলের হোক ।
শিবচরণ । না না , একে একে সব হয়ে যাক । চলো চন্দর , তোমাদের খাইয়ে আনি গে । নিবারণ , তুমি কিছু ব্যস্ত হোয়ো না , আমি সব ঠিক করে নিচ্ছি । কিন্তু লুচিটা কিছু কম পড়বে বোধ হচ্ছে ।
নিবারণ । তা হলে কী হবে শিবু!
শিবচরণ । ঐ দেখো! মিছিমিছি ভাব কেন ? সে সব ঠিক হয়ে যাবে । এখন কেবল সন্দেশগুলো এসে পৌঁছলে বাঁচি । আমার তো বোধ হচ্ছে , ময়রা বেটা বায়না নিয়ে ফাঁকি দিলে ।
নিবারণ । বলো কী ভাই!
শিবচরণ । ব্যস্ত হোয়ো না । আমি সব দেখে শুনে নিচ্ছি ।
                           [ শিবচরণ ও নিবারণের প্রস্থান
চন্দ্রকান্ত । ওরে বিনু , খাবার লোভে চলেছিস বুঝি ?
বিনোদ । কেন , তোমার লোভ একেবারে নেই নাকি ?
চন্দ্রকান্ত । কাজ আছে যে ।
বিনোদ । কাজ তো ফতে হয়ে গেছে , আবার কী ?
চন্দ্রকান্ত । যে কাজ হয়ে গেছে সে তো ব্যক্তিগত । এখন লড়াই বাকি আছে হিউম্যানিটির জন্যে ।
বিনোদ । বাস্‌ রে , এই অর্ধেক রাত্তিরে শেষকালে হিউম্যানিটি নিয়ে পড়তে হবে ?
চন্দ্রকান্ত । হিউম্যানিটির জন্যে যত ষড়যন্ত্র সে তো অর্ধেক রাত্তিরেই ।
বিনোদ । কোন্‌ দুঃসাধ্য কাজ করতে হবে বলো শুনি ।
চন্দ্রকান্ত । বাসরঘরের রুদ্ধ দুর্গ আজ আমরা স্টর্ম্‌ করব ।
বিনোদ । আমরা ভীরু , সামান্য পুরুষজাত মাত্র — আমাদের দ্বারা কি এত বড়ো বিপ্লব ঘটতে পারবে ।
চন্দ্রকান্ত । নিজেকে ক্ষুদ্র জ্ঞান কোরো না বিনোদ! ভেবে দেখো , ত্রেতাযুগে যারা সেতুবন্ধন করেছিল জীব হিসাবে তারাও যে আমাদের চেয়ে খুব বেশি শ্রেষ্ঠ ছিল তার প্রমাণ নেই — এমন-কি , এক-আধটা বাহ্য বাহুল্য ছাড়া অনেক বিষয়েই মিল ছিল ; মহৎ লক্ষ্য হৃদয়ে রেখে তারাও হেঁটে সমুদ্র পার হল । আর , আমাদের কেবলমাত্র এই দরজাটুকু পার হতে হবে । এতকাল এই বাসরঘরের সামনে স্ত্রীপুরুষের যে বিচ্ছেদসমুদ্র বিরাজ করছে কেবল একটিমাত্র মহাবীর বরবেশে সেটা লঙ্ঘন করবার অধিকারী ; কিষ্কিন্ধ্যার বাকি সকলকেই এ পারে পড়ে থাকতে হয় , এই অগৌরব যদি আমরা মোচন করতে না পারি তা হলে ধিক্‌ আমাদের পৌরুষ!
বিনোদ । হিয়ার হিয়ার!
চন্দ্রকান্ত । এতদিন সেখানে কেবল ভুজমৃণালের শাসনই বলবান ছিল । আজ বঙ্গোপসাগরের উত্তর তীর থেকে হিমালয়ের দক্ষিণপ্রান্ত পর্যন্ত সকল পুরুষে এককণ্ঠে বলো দেখি , ‘ নাহি কে বল এ ভুজ-অর্গলে ?'
বিনোদ । আছে আছে!
চন্দ্রকান্ত । নবযুগে পুরুষদের কারখানাঘর-আফিসঘরের সামনে ফেমিনিজ্‌ম্‌-এর আক্রমণ চলছে , আজ বাসরঘরের সামনে আমরা ম্যাস্‌কুলিনিজ্‌ম্‌ প্রচার করব । আমরা যুগান্তরের পাইওনিয়ার ।
বিনোদ । জয় , পুরুষজাতিকী জয়!
চন্দ্রকান্ত । অত্যাচারকারিণীদের সিংহাসন আজ বিচলিত হোক । আবার বলো , জয় পুরুষজাতিকী জয় । গদাই , গদাই , গদাই , গদাধর , ভীরু , ট্রেটর্‌ , এসো তুমি , খোলো রুদ্ধদ্বার , ভাঙো পুরুষজাতির অপমানের বাধা ।
বিনোদ । চন্দরদা , ওকে স্পেশ্যাল্‌ কনশেসন দিয়ে এরা কিনে নিয়েছে — ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি । ওকে সহজে পাওয়া যাবে না ।
চন্দ্রকান্ত । সে কিছুতেই হচ্ছে না । আজ অসম্মানিত পুরুষজাতির আহ্বান তার মুগ্ধ হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছবেই । গদাই! গদাধর! বিশ্বাসঘাতক! স্বজাতিবিদ্রোহী কাপুরুষ ।
                        গদাই , ইন্দু ও কমলের প্রবেশ
কমল । এখানে দাঁড়িয়ে আপনারা করছেন কী ?
চন্দ্রকান্ত । সিডিশন্‌ ।
ইন্দু । আপনাদের সাহস তো কম নয়!
চন্দ্রকান্ত । শর্‌ট্‌হ্যান্ড্‌-লিখিয়ে রিপোর্টার কেউ উপস্থিত ছিল না , তাই ভাষাটা হয়তো কিছু অসংযত হয়েছিল । আর কিছুই নয় , আমরা বলছিলুম , ‘ ভাগ্যদেবীগণ , রুদ্ধদ্বার খোলো — পাপীদের ক্ষমা করবার প্রত্যক্ষ আনন্দটা ভোগ করে নাও , তাতে স্বর্গেরও গৌরব , মর্তেরও পরিত্রাণ ' ।
ইন্দু । যারা ক্ষমা করবার যোগ্য তাদের তো ক্ষমা হয়ে গেছে ।
চন্দ্রকান্ত । এত বড়ো নিষ্ঠুর কথাটা বলতে পারলেন দয়াময়ী ? দেবী , আমিই কি পাপিষ্ঠতম ? এদের দুজনের চেয়েও অধম ?
ইন্দু । তিনি আপনাকে উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন ।
চন্দ্রকান্ত । দেবী , সেটা কি তাঁর পক্ষে আমার চেয়ে কম শোচনীয় ? যিনি তারিণী তাঁর জন্যে যদি একটা বাঁধা পাপীর বরাদ্দ না থাকে তবে তো একেবারে বেকার তিনি । যাকে বলে , আনএমপ্লয়মেন্ট প্রব্লেম্‌! বড়োবউ , তোমার অনুপস্থিতিতে যদি দৈবাৎ আমার সংশোধন হয়ে যায় , যদি তোমার জন্যে সবুর করতে না পারি , যদি পরিত্রাণের দোসরা পথ জুটে যায় , তা হলে সেটাতে কি তোমারই যশ না আমারই!
                                       ক্ষান্তমণির প্রবেশ
ক্ষান্তমণি । আঃ , কী মিছেমিছি চেঁচাচ্ছ!
চন্দ্রকান্ত । মিছেমিছি নয় দেবী! পৃথিবীসুদ্ধ লোক চেঁচাচ্ছে পরিত্রাণের দরবারে — কেউ-বা ধর্মে , কেউ-বা কর্মে , কেউ-বা পলিটিক্‌সে , আর আমিই যদি চুপ করে থাকব তা হলে নিতান্তই ঠকব যে । এই দুটি ভাগ্যবানদের দিকে তাকিয়ে আমি আর থাকতে পারলুম না । একটু চেঁচিয়েছি , ফলও পেয়েছি — এখন যবনিকাপতনের পূর্বে দয়াময়ীদের বন্দনাটা সেরে নিই ।
গান । প্রথমে চন্দ্রকান্ত পরে সকলে মিলিয়া
                          বাউলের সুর
            যার অদৃষ্টে যেমনি জুটেছে
                        সেই আমাদের ভালো ।
            আমাদের এই আঁধার ঘরে
                        সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালো ।
কেউ-বা অতি জ্বলজ্বল , কেউ-বা ম্লান ছলছল —
কেউ-বা কিছু দহন করে , কেউ-বা স্নিগ্ধ আলো ।
নূতন প্রেমে নূতন বধূ আগাগোড়া কেবল মধু ,
            পুরাতনে অম্ল-মধুর — একটুকু ঝাঁঝালো ।
বাক্য যখন বিদায় করে চক্ষু এসে পায়ে ধরে ,
        রাগের সঙ্গে অনুরাগে সমান ভাগে ঢালো ।
                আমরা তৃষ্ণা তোমরা সুধা ,
                তোমরা তৃপ্তি আমরা ক্ষুধা ,
        তোমার কথা বলতে কবির কথা ফুরালো ।
যে মূর্তি নয়নে জাগে সবই আমার ভালো লাগে —
কেউ-বা দিব্যি গৌরবরন , কেউ-বা দিব্যি কালো ।