ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
 

শেষরক্ষা


প্রথম অঙ্ক
দ্বিতীয় দৃশ্য
চন্দ্রবাবুর বাসা
 


চন্দ্র । ভাই বিন্‌দা , তোমাকে দেখে বোধ হচ্ছে , আজ তোমার ভালোমন্দ একটাকিছু হল বলে , কিংবা হয়েই বসেছে ।
বিনোদ । তাই নাকি ?
চন্দ্রকান্ত । আজ তোমার দৃষ্টিটা ছুটেছে যেন কোন্‌ মায়ামৃগীর পিছু পিছু । গেছে তার পথ হারিয়ে! ওহে , আজকের হাওয়ায় তোমার গায়ে কারো ছোঁয়াচ লাগছে নাকি ?
বিনোদ । কিসে ঠাওরালে ?
চন্দ্রকান্ত । মুখের ভাবে ।
বিনোদ । ভাবটা কিরকম দেখছ ?
চন্দ্রকান্ত । যেন ইন্দ্রধনু উঠেছে আকাশে , আর তারই ছায়াটা শিউরে উঠছে নদীর ঢেউয়ে ।
বিনোদ । বলে যাও ।
চন্দ্রকান্ত । যেন আষাঢ়-সন্ধ্যাবেলায় জুঁইগাছের গাঁঠে গাঁঠে কুঁড়ি ধরল বলে , আর দেরি নেই ।
বিনোদ । আরো কিছু আছে ?
চন্দ্রকান্ত । যেন —
                   নব জলধরে বিজুরী-রেহা
                        দ্বন্দ্ব পসারি গেলি ।
বিনোদ । থামলে কেন , বলে যাও ।
চন্দ্রকান্ত । যেন বাঁশিটি আজ ঠেকেছে এসে গুণীর অধরে । সত্যি করে বল্‌ ভাই , লুকোস্‌ নে আমার কাছে ।
বিনোদ । তা হতে পারে । একটা কোন্‌ ইশারা আজ গোধূলিতে উড়ে বেড়াচ্ছে , তাকে কিছুতে ধরতে পারছি নে ।
চন্দ্রকান্ত । ইশারা উড়ে বেড়াচ্ছে! সেটা প্রজাপতির ডানায় নাকি ?
বিনোদ । যেন অন্ধ মৌমাছির কাছে রজনীগন্ধার গন্ধের ইশারা ।
চন্দ্রকান্ত । হায় হায় , হাওয়াটা কোন্‌ দিক থেকে বইছে , তার ঠিকানাই পেলে না ?
বিনোদ । পোস্ট-আপিসের ঠিকানাটা পাওয়া শক্ত নয় চন্দরদা! কিন্তু স্বর্ণরেণু কোথায় আছে লুকিয়ে সেই ঠিকানাটাই-
চন্দ্রকান্ত । সর্বনাশ করলে! এরই মধ্যে স্বর্ণের কথাটা মনে এসেছে ? সাদা ভাষায় ওর মানে হচ্ছে পণের টাকা — তোমার রজনীগন্ধার গন্ধটা তা হলে ব্যাঙ্কশাল স্ট্রীটের দিক থেকেই এল বুঝি ?
বিনোদ । ছি ছি চন্দ্র , এমন কথাটাও তোমার মুখ দিয়ে বেরোল! আমি তুচ্ছ টাকার কথাই কি ভাবছি ?
চন্দ্রকান্ত । আজকালকার দিনে কোন্‌টা তুচ্ছ , কন্যাটা না পণটা , তার হিসেব করা শক্ত নয় । যুবকরা তো সোনার মৃগ দেখেই ছোটে , সীতা পড়ে থাকেন পশ্চাতে ।
বিনোদ । যুবক যে কে , সে কি তার বয়স গুণে বের করতে হবে , আর সোনার রেণু যে কাকে বলে সে কি বুঝবে তার ভরি ওজন করে ?
চন্দ্রকান্ত । এটা বেশ বলেছ , তোমার কবিতায় লিখে ফেলো হে , কথাটা আজ বাদে কাল হারিয়ে না যায় । আমার একটা লাইন মনে এল , তুমি কবি , তার পাদপূরণ করে দাও দেখি —
                            ও ভোলা মন , বল্‌ দেখি ভাই ,
                                    কোন্‌ সোনা তোর সোনা ।
বিনোদ ।                 কেনাবেচার দেনালেনায়
                                     যায় না তারে গোনা ।
চন্দ্রকান্ত । ভ্যালা মোর দাদা! আচ্ছা , আর-এক লাইন —
                            ও ভোলা মন , বল্‌ সে সোনা
                                    কেমন করে গলে ।
বিনোদ ।                 গলে বুকের দুখের তাপে ,
                                    গলে চোখের জলে ।
চন্দ্রকান্ত । বহুৎ আচ্ছা! আর-এক লাইন —
                            ও ভোলা মন , সেই সোনা তোর
                                    কোন্‌ খনিতে পাই ?
বিনোদ ।                সেই বিধাতার খেয়ালে যার
                                    ঠিক-ঠিকানা নাই ।
চন্দ্রকান্ত । ক্যা বাৎ । আচ্ছা , আর-এক লাইন —
                            ও ভোলা মন , সোনার সে ধন
                                    রাখবি কেমন করে ?
বিনোদ ।                 রাখব তারে ধ্যানের মাঝে
                                    মনের মধ্যে ভরে ।
চন্দ্রকান্ত । বাস্‌ , আর দরকার নেই , ফুল মার্ক পেয়েছ — পাস্‌ড্‌ উইথ্‌ অনার্স । আর ভয় নেই , সন্ধানে বেরিয়ে পড়া যাক —
                            সোনার স্বপন ধরুক-না রূপ
                                    অপরূপের হাটে ।
                            সোনার বাঁশি বাজাও , রসিক ,
                                    রসের নবীন নাটে ।
বিনোদ । চন্দরদা , কে বলে তুমি কবি নও ?
চন্দ্রকান্ত । ছায়ায় পড়ে গেছি ভাই , চন্দ্রগ্রহণ লেগেছে — তোমরা না থাকলে আমিও কবি বলে চলে যেতে পারতুম , কবিসম্রাট নাও যদি হতুম অন্তত কবি-তালুকদার হওয়া অসম্ভব ছিল না । দেখেছি , প্রাণের ভিতরটাতে মাঝে মাঝে রস উছলে ওঠে , কিন্তু তার ধারাটা মাসিকপত্র পর্যন্ত পৌঁছয় না ।
বিনোদ । ঘরে আছে রসসমুদ্র , সেইখানেই লুপ্ত হয়ে যায়!
চন্দ্রকান্ত । এক্‌সেলেন্ট্‌ । কবি না হলে এই গূঢ় খবর আন্দাজ করতে পারত কে বলো । ঐ যে আসছে আমাদের মেডিকাল স্টুডেন্ট ।
                            গদাইয়ের প্রবেশ
চন্দ্রকান্ত । এই যে , গদাই! শরীরতত্ত্ব ছেড়ে হঠাৎ কবির দরবারে যে ? তোমার বাবা জানলে যে শিউরে উঠবেন ।
গদাই । না ভাই , প্যাথলজি স্টাডি করবার পক্ষে তোদের সংসর্গটা একেবারেই ব্যর্থ নয় । তোদের হৃদয়টা যে সর্বদাই আইঢাই করছে , সেটা অজীর্ণ রোগের একটি নামান্তর তা জানিস ? বেশ ভালো করে আহারটি করলে এবং সেটি হজম করতে পারলে কবিত্বরোগ কাছে ঘেঁষতে পারে না । আধ-পেটা করে খাও , অম্বলের ব্যামোটি বাধাও , আর অমনি কোথায় আকাশের চাঁদ , কোথায় দক্ষিণের বাতাস , কোথায় কোকিলপক্ষীর ডাক , এই নিয়ে প্রাণ আনচান করতে থাকে ; জানলার কাছে বসে বসে মনে হয় কী যেন চাও , যা চাও সেটি যে বাই-কার্বোনেট্‌-অফ-সোডা তা কিছুতেই বুঝতে পার না ।
চন্দ্রকান্ত । হৃদযন্ত্রটির বাসা পাকযন্ত্রটির ঠিক উপরেই , এ কথা কবিরা মানে না , কিন্তু কবিরাজরা মানে ।
গদাই । ঐ যে যাকে ভালোবাসা বল সেটা যে শুদ্ধ একটা স্নায়ুর ব্যামো , তার আর সন্দেহ নেই । আমার বিশ্বাস অন্যান্য ব্যামোর মতো তারও একটা ওষুধ বের হবে ।
চন্দ্রকান্ত । হবে বৈকি । কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোবে — ‘ হৃদয়-বেদনার জন্য অতি উত্তম মালিশ , উত্তম মালিশ , উত্তম মালিশ! বিরহনিবারণী বটিকা ; রাত্রে একটি সকালে একটি সেবন করিলে বিরহভার একেবারে নিঃশেষে অবসান ' ।
আচ্ছা , ভাই বিনু , এক কথায় বলে দে দেখি কিরকম মেয়ে তোর পছন্দ ।
বিনোদ । আমি কিরকম চাই জান ? যাকে কিছু বোঝবার জো নেই । যাকে ধরতে গেলে পালিয়ে যায় , পালাতে গেলে যে ধরে টেনে নিয়ে আসে ।
চন্দ্রকান্ত । বুঝেছি । যে কোনো কালেই পুরোনো হবে না । মনের কথা টেনে বলেছ ভাই! পাওয়া শক্ত । আমরা ভুক্তভোগী , জানি কিনা , বিয়ে করলেই মেয়েগুলো দুদিনেই বহুকেলে পড়া পুঁথির মতো হয়ে আসে ; মলাটটা আধখানা ছিঁড়ে ঢল্‌ ঢল্‌ করছে , পাতাগুলো দাগি হয়ে খুলে আসছে , কোথায় সে আঁটসাঁট বাঁধুনি , কোথায় সে সোনার জলের ছাপ! আচ্ছা , সে যেন হল , আর চেহারা কেমন ?
বিনোদ । ছিপ্‌ছিপে , মাটির সঙ্গে অতি অল্পই সম্পর্ক , যেন সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতেব ।
চন্দ্রকান্ত । আর বেশি বলতে হবে না , বুঝে নিয়েছি । তুমি চাও পদ্যের মতো চোদ্দটি অক্ষরে বাঁধাছাঁদা , চলতে ফিরতে ছন্দটি রেখে চলে ; এ দিকে মল্লিনাথ , ভরত শিরোমণি , জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন তার টিকে-ভাষ্য করে থই পায় না । বুঝেছ বিন্‌দা , চাইলেই তো পাওয়া যায় না —
বিনোদ । কেন , তোমার কপালে তো মন্দ জোটে নি ।
চন্দ্রকান্ত । মন্দ বলতে সাহস করি নে , কিন্তু ভাই , সে গদ্য , তাতে ছাঁদ নেই , ঢিল কলমে লেখা ।
গদাই । আর ছাঁদে কাজ নেই ভাই! আবার তোমার কিরকম ছাঁদ সেটাও তো দেখতে হবে ।
চন্দ্রকান্ত । তোরা বুঝবি নে , গদাই , ভিতরে গীতগোবিন্দের অল্প একটু আমেজ আছে ; সুযোগ ঘটলে ললিতলবঙ্গলতার সঙ্গে ছন্দের মিল হতেও পারত । চাঁদের আলোয় মুখের দিকে চেয়ে বেলফুলের মালা হাতে প্রেয়সী যদি বলত —
                    জনম অবধি হাম রূপ নেহারনু
                            নয়ন না তিরপিতা ভেল
নেহাত অসহ্য হত না । প্রেয়সী সর্বদা এসেও থাকেন , কিছুই যে বলেন না এত বড়ো বদনাম দিতে পারব না । কিন্তু বাক্যগুলো , বিশেষত তার সুরটা এমনটি হয় না —
                   গৌড়জন যাহে আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি ।
গদাই । দেখো চন্দরদা , বিয়ে করবার প্রসঙ্গে পছন্দ করার কথাটা একেবারেই খাটে না । বিয়েটা হল মনোথিইজ্‌ম আর
পছন্দটা হল পলিথিইজ্‌ম । দুটোর থিওলজি একেবারে উলটো । বিয়ের ডেফিনিশন্‌ই হচ্ছে জন্মের মতো পছন্দ-বায়ুটাকে খতম করে দেওয়া । তেত্রিশ কোটিকে একের মধ্যে নিঃশেষে বিসর্জন করা ।
পাশের বাড়ি হইতে গানের শব্দ
বিনোদ । ঐ শোনো , গান ।
গদাই । কার গান হে ?
চন্দ্রকান্ত । চুপ করে খানিকটা শোনোই-না । পরে পরিচয় দেব ।
                        নেপথ্যে গান
                কাছে যবে ছিল , পাশে
                        হল না যাওয়া ।
                চলে যবে গেল , তারি
                        লাগিল হাওয়া ।
                যবে ঘাটে ছিল নেয়ে
                তারে দেখি নাই চেয়ে ,
                দূর হতে শুনি স্রোতে
                    তরণী বাওয়া ।
                যেখানে হল না খেলা
                        সে খেলাঘরে
                আজি নিশিদিন মন
                        কেমন করে ।
                হারানো দিনের ভাষা
                স্বপ্নে আজি বাঁধে বাসা ,
                আজ শুধু আঁখিজলে
                        পিছনে চাওয়া ।
চন্দ্রকান্ত । বিন্‌দা , আজকাল রাধিকার দলই বাঁশি বাজাতে শিখেছে , কলির কৃষ্ণগুলোকে বাসা থেকে পথে বের করবে । দেখো-না নাড়ীটা বেশ একটু দ্রুত চলছে ।
বিনোদ । চন্দ্র , আজ কী করব ভাবছিলুম , একটা মতলব মাথায় এসেছে ।
চন্দ্রকান্ত । কী বলো দেখি ।
বিনোদ । চলো , যে মেয়েটি গান গায় ওর সঙ্গে আজই আমার বিয়ের সম্বন্ধ করে আসি গে ।
চন্দ্রকান্ত । বলো কী!
বিনোদ । আর তো বসে বসে ভালো লাগছে না ।
চন্দ্রকান্ত । কিন্তু দেখাশুনা তো করবে , আলাপ-পরিচয় তো করতে হবে ? আমরা বিয়ে করেছিলুম চোখ বুজে বড়ি গেলার
মতো , মুখে স্বাদ পেলুম না , পেটের মধ্যে পৌঁছে খুব কষে ক্রিয়া করতে লাগল , কিন্তু তোদের তা তো চলবে না ।
বিনোদ । না , তাকে দেখতে চাই নে । আমি ঐ গানরূপটিকে বরন করব ।
চন্দ্রকান্ত । বিনু , এই কথাটা তোর মুখেও একটু বাড়াবাড়ি শোনাচ্ছে । তার চেয়ে একটা গ্রামোফোন কেন্‌-না ? এ যে ভাই মানুষ , দেখেশুনে নেওয়া ভালো।
বিনোদ । মানুষকে কি চোখ চাইলেই দেখা যায় ? তুমিও যেমন! রাখো জীবনটা বাজি , চোখ বুজে দান তুলে নাও , তার পরে হয় রাজা নয় ফকির ; একেই তো বলে খেলা ।
চন্দ্রকান্ত । উঃ! কী সাহস! তোমার কথা শুনলে আমার মরচে-পড়া বুকেও ঝলক মারে , ফের আর-একটা বিয়ে করতে ইচ্ছে করে । না দেখে বিয়ে তো আমরাও করেছি , কিন্তু এমনতরো মরিয়া করে তোলে নি ।
গদাই । তা বলি , যদি বিয়ে করতে হয় নিজে না দেখে বিয়ে করাই ভালো । ডাক্তারের পক্ষে নিজের চিকিৎসা করাটা কিছু নয় । মেয়েটি কে বলো তো হে চন্দরদা ।
চন্দ্রকান্ত । আমাদের নিবারণবাবুর বাড়িতে থাকেন , নাম কমলমুখী । আদিত্যবাবু আর নিবারণবাবু পরম বন্ধু ছিলেন । আদিত্য মরবার সময় মেয়েটিকে নিবারণবাবুর হাতে সমর্পণ করে দিয়ে গেছেন ।
গদাই । তুমি তোমার প্রতিবেশিনীকে আগে থাকতেই দেখো নি তো ?
চন্দ্রকান্ত । আমার কি আর আশে পাশে দৃষ্টি দেবার জো আছে! আমার এ দুটি চক্ষুই একেবারে দস্তখতি সীলমোহর করা , অন্‌ হার্‌ ম্যাজিস্টিস্‌ সার্ভিস্‌ । তবে শুনেছি বটে , দেখতে ভালো এবং স্বভাবটিও ভালো ।
গদাই । আচ্ছা , এখন তা হলে আমরা কেউ দেখব না , একেবারে সেই বিবাহের রাত্রে চমক লাগবে ।
চন্দ্রকান্ত । তোমরা একটু বোসো ভাই , আমি অমনি চট করে চাদরটা পরে আসি । এই পাশের ঘরেই ।  [ প্রস্থান
                                পাশের ঘরে
                            চন্দ্রকান্ত ও ক্ষান্তমণি
চন্দ্রকান্ত । বড়োবউ , ও বড়োবউ! চাবিটা দাও দেখি ।
ক্ষান্তমণি । কেন জীবনসর্বস্ব নয়নমণি , দাসীকে কেন মনে পড়ল ?
চন্দ্রকান্ত । ও আবার কি! যাত্রার দল খুলবে নাকি ? আপাতত একটা সাফ দেখে চাদর বের করে দাও দেখি , এখুনি বেরোতে হবে —
ক্ষান্তমণি । ( অগ্রসর হইয়া) আদর চাই! প্রিয়তম , তা আদর করছি ।
চন্দ্রকান্ত । ( পশ্চাতে হঠিয়া) আরে , ছি ছি ছি! ও কী ও!
ক্ষান্তমণি । নাথ , বেলফুলের মালা গেঁথে রেখেছি , এখন কেবল চাঁদ উঠলেই হয় —
চন্দ্রকান্ত । ও! গুণবর্ণনা আড়াল থেকে সমস্ত শোনা হয়েছে দেখছি । বড়োবউ , কাজটা ভালো হয় নি । ওটা বিধাতার অভিপ্রায় নয় । তিনি মানুষের শ্রবণশক্তির একটা সীমা করে দিয়েছেন , তার কারণই হচ্ছে পাছে অসাক্ষাতে যে কথাগুলো হয় তাও মানুষ শুনতে পায় ; তা হলে পৃথিবীতে বন্ধুত্ব বলো , আত্মীয়তা বলো , কিছুই টিকতে পারে না ।
ক্ষান্তমণি । ঢের হয়েছে গোঁসাইঠাকুর , আর ধর্মোপদেশ দিতে হবে না । আমাকে তোমার পছন্দ হয় না , না ?
চন্দ্রকান্ত । কে বললে পছন্দ হয় না ?
ক্ষান্তমণি । আমি গদ্য , আমি পদ্য নই , আমি শোলোক পড়ি নে , আমি বেলফুলের মালা পরাই নে —
চন্দ্রকান্ত । আমি গললগ্নীকৃতবস্ত্র হয়ে বলছি , দোহাই তোমার , তুমি শোলোক পোড়ো না , তুমি মালা পরিয়ো না , ওগুলো সবাইকে মানায় না —
ক্ষান্তমণি । কী বললে ?
চন্দ্রকান্ত । আমি বললুম যে , বেলফুলের মালা আমাকে মানায় না , তার চেয়ে সাফ চাদরে ঢের বেশি শোভা হয় — পরীক্ষা করে দেখো ।
ক্ষান্তমণি । যাও যাও , আর ঠাট্টা ভালো লাগে না ।
চন্দ্রকান্ত । ( নিকটে আসিয়া) কথাটা বুঝলে না ভাই ? কেবল রাগই করলে! শোনো বুঝিয়ে দিচ্ছি —
ভালোবাসার থার্মোমিটারে তিন মাত্রার উত্তাপ আছে । মানুষ যখন বলে ‘ ভালোবাসি নে ' সেটা হল ৯৫ ডিগ্রি , যাকে বলে সাবনর্মাল । যখন বলে ‘ ভালোবাসি ' সেটা হল নাইন্টিএইট পয়েন্ট ফোর , ডাক্তাররা তাকে বলে নর্মাল , তাতে একেবারে কোনো বিপদ নেই । কিন্তু প্রেমজ্বর যখন ১০৫ ছাড়িয়ে গেছে তখন রুগি আদর করে বলতে শুরু করেছে ‘ পোড়ারমুখি ', তখন চন্দ্রবদনীটা একেবারে সাফ ছেড়ে দিয়েছে । যারা প্রবীণ ডাক্তার তারা বলে এইটেই হল মরণের লক্ষণ । বড়োবউ , নিশ্চয় জেনো , বন্ধুমহলে আমিও যখন প্রলাপ বকি , তোমাকে যা না বলবার তাই বলি , তখন সেটা প্রণয়ের ডিলিরিয়ম , তখন বাঁধা আদরের ভাষায় একেবারে কুলোয় না ; গাল দিতে না পারলে ভালোবাসার ইস্টিমের চাপে বুক ফেটে যায় , বিশ্রী রকমের অ্যাক্‌সিডেন্ট হতে পারে । নাড়ী রসস্থ হলে তাতে ভাষা যে কিরকম এলোমেলো হয়ে ওঠে , তা সেই ডাক্তারই বোঝে রসবোধের যে একেবারে এম.ডি. ।
ক্ষান্তমণি । রক্ষে করো , আমার অত ডাক্তারি জানা নেই ।
চন্দ্রকান্ত । সে তো ব্যবহারেই বুঝতে পারি নইলে লয়াল্‌টিকে সিডিশন বলে সন্দেহ করবে কেন । কিন্তু নিশ্চয় রুগির দশা তোমাকেও মাঝে মাঝে ধরে । আচ্ছা , কলতলায় দাঁড়িয়ে তুমি কখনো পদ্মঠাকুরঝিকে বলো নি — আমার এমনি কপাল যে বিয়ে করে ইস্তিক সুখ কাকে বলে একদিনের তরে জানলুম না? আমার কানে যদি সে কথা আসত তা হলে আনন্দে শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত।
ক্ষান্তমণি। আমি পদ্মঠাকুরঝিকে কখ্‌খনো অমন কথা বলি নি।
চন্দ্রকান্ত। আচ্ছা, তা হলে সাফ চাদরটা এনে দাও।
ক্ষান্তমণি। (চাদর আনিয়া দিয়া) তুমি বাইরে বেরোচ্ছ যদি, চুলগুলো কাগের বাসার মতো করে বেরিয়ো না। একটু বোসো, তোমার চুল ঠিক করে দিই।
                                                                            [চিরুনি ব্রুস লইয়া আঁচড়াইতে প্রবৃত্ত
চন্দ্রকান্ত। হয়েছে, হয়েছে।
ক্ষান্তমণি। না হয় নি, একদন্ড মাথা স্থির করে রাখো দেখি।
চন্দ্রকান্ত। তোমার সামনে আমার মাথার ঠিক থাকে না, দেখতে দেখতে ঘুরে যায়—
ক্ষান্তমণি। অত ঠাট্টায় কাজ কী! নাহয় আমার রূপ নেই, গুণ নেই—একটা ললিতলবঙ্গলতা খোঁজ করে আনো গে, আমি চললুম।
                                                                        [ চিরুনি ব্রুস ফেলিয়া দ্রুত প্রস্থান
চন্দ্রকান্ত। এখন আর সময় নেই, ফিরে এসে রাগ ভাঙাতে হবে।
বিনোদ (নেপথ্য হইতে)। ওহে, আর কতক্ষণ বসিয়ে রাখবে? তোমাদের প্রেমাভিনয় সাঙ্গ হল কি?
চন্দ্রকান্ত। এইমাত্র যবনিকাপতন হয়ে গেল। হৃদয়বিদারক ট্রাজেডি।