ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
 

শেষরক্ষা


তৃতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
বাগবাজারের রাস্তা
 

 

গদাই । আহা , এই বাড়িটা আমার শরীর থেকে আমার মনটুকুকে যেন শুষে নিচ্ছে , ব্লটিং যেমন কাগজ থেকে কালি শুষে নেয় । কিন্তু কোন্‌ দিকে সে থাকে এ পর্যন্ত কিছুই সন্ধান করতে পারলুম না । ঐ যে পশ্চিমের জানলার ভিতর দিয়ে একটা সাদা কাপড়ের মতন যেন দেখা গেল না ? না , ও তো নয় , ও তো একজন দাসী দেখছি । ও কী করছে ? একটা ভিজে শাড়ি শুকুতে দিচ্ছে । বোধ হয় তাঁরই শাড়ি । আহা , নাগাল পেলে একবার স্পর্শ করে নিতুম । তা হলে এতক্ষণে তাঁর সনান হল । পিঠের উপরে ভিজে চুল ফেলে সাফ কাপড়টি পরে এখন কী করছেন!
[ এই বাড়ির চৌকাঠ পার হইতে হুঁচট খাইয়া একজন বুড়ির কক্ষ হইতে তরকারির ঝুড়ি পড়িয়া গেল । ]
গদাই । ( ছুটিয়া নিকটে গিয়া ধরিয়া উঠাইয়া) আহাহাহা , কী তোমার নাম গো ?
বুড়ি । আমার নাম ঠাকুরদাসী , এই বাড়ির ঝি ।
গদাই । এই বাড়ির ঝি! আহা , লাগে নি তো ?
বুড়ি । না , কিছু লাগে নি ।
গদাই । আলুগুলো সব যে ছড়িয়ে পড়েছে । রোসো , কুড়িয়ে দিচ্ছি । তুমি বুঝি এই বাড়ির ঝি!
বুড়ি । হাঁ বাবু ।
গদাই । চৌধুরীদের বাড়ির ঝি ?
বুড়ি । হাঁ গো , গঙ্গামাধব চৌধুরী ।
গদাই । আহাহা , ভাঁড়টা উলটে গিয়ে তেল যে সব গড়িয়ে গেছে । তোমার দিদিঠাকরুন হয়তো রাগ করবেন ।
বুড়ি । না , দিদিঠাকরুন কথাটি কবেন না , কিন্তু গিন্নি মা —
গদাই । কথাটি কবেন না । আহা! (দীর্ঘনিশ্বাস) তা এক কাজ করো । এই টাকাটি দিচ্ছি , নাহয় বাজার থেকে তেল কিনে আনো , আমি ততক্ষণ তোমার তরকারি আগলাচ্ছি । তোমার দিদিঠাকরুণ বুঝি কথাটি কবেন না , অ্যাঁ ঠাকুরদাসী ?
বুড়ি । তিনি বড়ো লক্ষ্মী ।
গদাই । লক্ষ্মী! আহা , তা তোমার দিদিঠাকরুন কী খেতে ভালোবাসেন বলো দেখি ।
বুড়ি । ছাতাওয়ালা গলির মোড়ে ভরু ফুলুরিওয়ালা গরম গরম বেগ্‌নি ভেজে দেয় , তাই দিয়ে আমের আচার দিয়ে খেতে তাঁর খুব শখ ।
গদাই । বটে! তা এই নাও , ঠাকুরদাসী , একটাকার বেগ্‌নি কিনে আনো তো ।
বুড়ি । একটাকার বেগ্‌নি! সে যে অনেক হবে ।
গদাই । তা হোক , নাহয় কিছু বেশিই হল ।
বুড়ি । তা আমি কিনে নাহয় আনব পরে , তুমি এই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকবে কতক্ষণ ।
গদাই । তাতে ক্ষতি নেই , ওটা আমার একটা শখ ।
বুড়ি । দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা!
গদাই । না , না , ঐ যে তোমার বেগ্‌নি — ঐ যে তুমি বললে না —
বুড়ি । নাহয় দিদিঠাকরুনকে বেগ্‌নি খাওয়াব , তাই বলে কি —
গদাই । আমি এইরকম খাওয়াতে বড়ো ভালোবাসি , ওটা আমার একটা বাতিক বললেই হয়। বিশেষত গরম গরম বেগ্‌নি। বেগ্‌নির ঝুড়ি চক্ষে দেখে তবে নড়ব।
বুড়ি । তা হলে দাঁড়াও , দেরি করব না ।
    [ প্রস্থান
                 মোড়ক হস্ত এক ব্যক্তির প্রবেশ
ঐ ব্যক্তি । সরকারমশায় বুঝি ?
গদাই । কেন বলো তো ?
ঐ ব্যক্তি । এই বাড়ির কোন্‌ মাঠাকরুন সাত জোড়া সিল্কের মোজা রিফু করতে আমাদের দোকানে পাঠিয়েছিলেন , সেগুলি এনেছি ।
গদাই ।
অ্যাঁঃ, পায়ের মোজা! ঐ জন্যেই তো এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি । দাও দাও ।
দরজি । দামটা নগদ চুকিয়ে দিতে হবে ।
গদাই । কত ?
দরজি । আড়াই টাকা ।
গদাই । এই নিয়ে যাও । তোমার রেট তো খুব শস্তা হে!
    [ দরজির প্রস্থান
হায় হায় , আজ কী শুভক্ষণেই বেরিয়েছিলুম! (বুকের কাছে চাপিয়া) সেই পা দুখানির অদৃশ্য চলন দিয়ে দলন দিয়ে এই মোজার ফাঁকগুলি ভরা । আহাহা , গা শিউরে উঠছে , কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছে —
                            ওগো শূন্য মোজা —
মেলানো বড়ো শক্ত । এই সময়ে থাকত বিন্‌দা! —
                আমার শূন্য হৃদয়ের মতো , ওগো শূন্য মোজা ,
                অনুপস্থিত কোন্‌ দুটি চরণ
                            সদাই করিতেছ খোঁজা ।
কথা আসছে । কিন্তু ঘুলিয়ে যাচ্ছে —
                বিনা পায়েই প্রাণের ভিতরে
                        চলে গিয়েছ সোজা ।
আইডিয়াটা ওরিজিনাল্‌ ।
তিনটে লাইন হল , সাত জোড়া মোজা আছে ; ঠিক সপ্তপদীর নম্বর । আরো চারটে লাইন চাই । ( উপরতলার বারান্দার দিকে চাহিয়া) অনুদ্দেশকে উদ্দেশ করে এই লাইনগুলি আবৃত্তি করতে ইচ্ছা করছে — য়ুরোপের ট্রুবেডোরদের মতো ।
                (আপন মনে)      আমার শূন্য হৃদয়ের মতো , ওগো শূন্য মোজা ,
                                       অনুপস্থিত কোন্‌ দুটি চরণ সদাই করিছ খোঁজা ?
কিন্তু আর তো মিল দেখছি নে , এক আছে ‘ মুসলমানের রোজা ' — মোজাকে বললে দোষ নেই যে ঈদের দিনে প্রতিপদের চাঁদ । না না , ওতে আমার লেখার ক্লাসিক্যাল গ্রেসটা চলে যাবে । তা ছাড়া দিন খারাপ , হয়তো সামান্য মোজার জন্যে শান্তিভঙ্গ হতেও পারে — ওটা থাক্‌ ।
নেপথ্যে । হিঁয়া রাখো ।
                                                শিবচরণের প্রবেশ
শিবচরণ । বেটার তবু হুঁশ নেই । দেখো-না , হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখো-না । যেন খিদে পেয়েছে , এই বাড়ির ইঁটকাঠগুলো গিলে খাবে । ছোঁড়ার হল কী! খাঁচার পাখির দিকে বেড়াল যেমন তাকিয়ে থাকে তেমনি করে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে । হতভাগা কালেজে যাবার নাম করে রোজ বাগবাজারে এসে ঘুর ঘুর করে । (নিকটে আসিয়া) বাপু , মেডিক্যাল কালেজটা কোন্‌দিকে একবার দেখিয়ে দাও দেখি!
গদাই । কী সর্বনাশ! এ যে বাবা!
শিবচরণ । শুনছ ? কালেজ কোন্‌-দিকে ? তোমার অ্যানাটমির নোট কি ঐ দেয়ালের গায়ে লেখা আছে ? তোমার সমস্ত ডাক্তারিশাস্ত্র কি ঐ জানলায় গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে ?
 [গদাই নিরুত্তর
মুখে কথা নেই যে! লক্ষ্মীছাড়া , এই তোর এক্‌জামিন! এইখানে তোর মেডিক্যাল কালেজ!
গদাই । খেয়েই কালেজে গেলে আমার অসুখ করে , তাই একটুখানি বেড়িয়ে নিয়ে —
শিবচরণ । বাগবাজারে তুমি হাওয়া খেতে এস ? শহরে আর কোথাও বিশুদ্ধ বায়ু নেই! এ তোমার দার্জিলিং সিমলে পাহাড়! বাগবাজারের হাওয়া খেয়ে খেয়ে আজকাল যে চেহারা বেরিয়েছে , একবার আয়নাতে দেখা হয় কি ? আমি বলি ছোঁড়াটা এক্‌জামিনের তাড়াতেই শুকিয়ে যাচ্ছে , তোমাকে যে ভূতে তাড়া করে বাগবাজারে ঘোরাচ্ছে তা তো জানতুম না!
গদাই । আজকাল বেশি পড়তে হয় বলে রোজ খানিকটা করে এক্সেসাইজ্‌ করে নিই —
শিবচরণ । রাস্তার ধারে কাঠের পুতুলের মতো হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকে তোমার এক্সেসাইজ্‌ হয় , বাড়িতে তোমার দাঁড়াবারও জায়গা নেই!
গদাই । অনেকটা চলে এসে শ্রান্ত হয়েছিলুম , তাই একটু বিশ্রাম করা যাচ্ছিল ।
শিবচরণ । শ্রান্ত হয়েছিস , তবে ওঠ্‌ আমার গাড়িতে । যা , এখনই কালেজে যা । গেরস্তর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শ্রান্তি দূর করতে হবে না ।
গদাই । সে কী কথা! আপনি কী করে যাবেন ?
শিবচরণ । আমি যেমন করে হোক যাব , তুই এখন গাড়িতে ওঠ্‌ । ওঠ্‌ বলছি ।
গদাই । অনেকটা জিরিয়ে নিয়েছি , এখন আমি অনায়াসে হেঁটে যেতে পারব ।
শিবচরণ । না , সে হবে না — তুই ওঠ্‌ , আমি দেখে যাই —
গদাই । আপনার যে ভারি কষ্ট হবে ।
শিবচরণ । সেজন্য তোকে কিছু ভাবতে হবে না , তুই ওঠ্‌ গাড়িতে । এ ঝুড়িটা কিসের । তুই কি বাগবাজারে তরকারি ফেরি করে বেড়াস নাকি ?
গদাই । তাই তো , ওটা তরকারিই তো বটে । কী আশ্চর্য! কেমন করে এল! এ তো মুলো দেখছি , নটেশাকও আছে । এক কাজ করি বাবা — গেরস্তর জিনিস , ঘরের ভিতরে পৌঁছে দিয়ে আসি-না ।
শিবচরণ । আর তোমার পরোপকার করতে হবে না । এ ঝুড়ির কিনারা আমি করে দিচ্ছি , তুই এখন গাড়িতে ওঠ্‌ ।
গদাই । ( স্বগত) সর্বনাশ! বুড়িটা এর মধ্যে বেগ্‌নি নিয়ে উপস্থিত না হলে বাঁচি । আজ সকাল বেলাটা বেশ জমে আসছিল , মাটি করে দিলে । সাত জোড়া মোজা নিয়ে করি কী! কাল দোকানদার সেজে ফিরিয়ে দিতে হবে ।
শিবচরণ । তোর হাতে ওটা কিসের মোড়ক রে ?
গদাই । আজ্ঞে ওটা —
শিবচরণ । দেখি না । ( হাত টানিয়া লইয়া) এ কী ব্যাপার!
গদাই । আজ্ঞে, উপহার দেবার জন্যে ।
শিবচরণ । কাকে উপহার দিবি ?
গদাই । আমার একটি ক্লাস্‌-ফ্রেন্ড্‌ —
শিবচরণ । ক্লাস্‌-ফ্রেন্ড্‌কে মেয়েদের মোজা দিবি!
গদাই । তার বিয়ে হচ্ছ কিনা , তাই —
শিবচরণ । তাই , কার অনেক দিনের পরা পুরোনো ময়লা মোজা তাকে দিবি ? তাও আবার সাত জোড়া!
গদাই । সেকেন্ড্‌হ্যান্ড্‌ নিলেম থেকে শস্তায় কিনেছি , আপনার কাছ থেকে টাকা চাইতে ভয় করে ।
শিবচরণ । চাইলেই পেতিস কিনা! ফিরিয়ে দে । ছি ছি! ঐ নোংরা মোজাগুলো নিয়ে বেড়াচ্ছিস । কী জানি কোন্‌ ব্যামোর ছোঁয়াচ আছে ওর মধ্যে —
গদাই । আমারও সে ভয় আছে বাবা, ছোঁয়াচ যে কোথায় কী থাকে কিচ্ছু বলবার জো নেই । এখনো ফিরিয়ে দিতে পারব , কালই নাহয় —
 

শিবচরণ । সেই ভালো । এই নে , তোকে দেড় টাকা দিচ্ছি — পাকপ্রণালী দু খন্ড কিনে তাকে দিস । এখন গাড়িতে ওঠ্‌। ( সহিসের প্রতি) দেখ্‌ , একেবারে সেই পটলডাঙার কালেজে নিয়ে যাবি , কোথাও থামাবি নে ।
গদাই । ( জনান্তিকে সহিসের প্রতি) মির্জাপুর চন্দ্রবাবুর বাসায় চল্‌ , তোদের একটাকা বকশিশ দেব , ছুটে চল্‌ ।
                        [ প্রস্থান
শিবচরণ । আজ আর রুগি দেখা হল না । আমার সকাল বেলাটা মাটি করে দিলে ।
                        [ প্রস্থান