ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


শেষরক্ষা


তৃতীয় অঙ্ক
দ্বিতীয় দৃশ্য
চন্দ্রকান্তের বাসা

 


চন্দ্রকান্ত । নাঃ , এ আগাগোড়া কেবল ছেলেমানুষি করা হয়েছে । আমার এখন অনুতাপ হচ্ছে! মনে হচ্ছে যেন আমিই এ সমস্ত কাণ্ডটি ঘটিয়েছি । ইদিকে এত কল্পনা , এত কবিত্ব , এত মাতামাতি , আর বিয়ের দু দিন না যেতে যেতেই কিছু আর মনে ধরছে না ।
                                  গদাইয়ের প্রবেশ
 গদাই । কী হচ্ছে চন্দরদা ?
চন্দ্রকান্ত । না গদাই , তোরা আর বিয়েথাওয়া করিস নে ।
গদাই । কেন বলো দেখি । তোমার ঘাড়ে ম্যাল্‌থসের ভূত চপল নাকি ?
চন্দ্রকান্ত । এখনকার ছেলেরা তোরা মেয়েমানুষকে বিয়ে করবার যোগ্য নোস । তোরা কেবল লম্বাচওড়া কথা কবি আর কবিতা লিখবি , তাতে যে পৃথিবীর কী উপকার হবে ভগবান জানেন ।
গদাই । কবিতা লিখে পৃথিবীর কী উপকার হয় বলা শক্ত , কিন্তু এক-এক সময় নিজের কাজে লেগে যায় সন্দেহ নেই । যা হোক , এত রাগ কেন ?
চন্দ্রকান্ত । শুনেছ তো সমস্তই! আমাদের বিনুর তাঁর স্ত্রীকে পছন্দ হচ্ছে না ।
গদাই । বাস্তবিক , এরকম গুরুতর ব্যাপার নিয়ে খেলা করাটা ভালো হয় নি ।
চন্দ্রকান্ত । বিনুটা যে অত অপদার্থ তা কি জানতুম! একটা স্ত্রীলোককে ভালোবাসার ক্ষমতাটুকুও নেই ।
গদাই । আমি জানি , কবিতা লেখার চেয়েও সেটা সহজ কাজ ।
চন্দ্রকান্ত । আমি ওর মুখদর্শন করছি নে ।
গদাই । তুমি তাকে ছাড়লে সে যে নেহাত অধঃপাতে যাবে ।
চন্দ্রকান্ত । না , তার সঙ্গে কিছুতেই মিশছি নে , পায়ে এসে ধরে পড়লেও না । তুমি ঠিক বলেছিলে গদাই , আজকাল সবাই যাকে ভালোবাসা বলে সেটা একটা স্নায়ুর ব্যামো — হঠাৎ চিড়িক মেরে আসে , তার পরে ছেড়ে যেতেও তর সয় না ।
গদাই । সে-সব বিজ্ঞানশাস্ত্রের কথা পরে হবে , আপাতত আমার একটা কাজ করে দিতে হচ্ছে ।
চন্দ্রকান্ত । যে কাজ বল তাতেই রাজি আছি , কিন্তু ঘটকালি আর করছি নে ।
গদাই । ঐ ঘটকালিই করতে হবে ।
চন্দ্রকান্ত । ( ব্যগ্রভাবে) কী রকম শুনি ।
গদাই । বাগবাজারের চৌধুরীদের বাড়ির কাদম্বিনী , তার সঙ্গে আমার —
চন্দ্রকান্ত । ( উচ্চস্বরে) গদাই , তোমারও কবিত্ব । তবে আমারও স্নায়ু বলে একটা বালাই আছে ।
গদাই । তা আছে ভাই । বোধ হয় , একটু বেশি পরিমাণেই আছে । অবস্থা এমনি হয়েছে যে শিগগির আমার একটা সদ্‌গতি না করলে —
চন্দ্রকান্ত । বুঝেছি । কিন্তু গদাই , আর স্ত্রীহত্যার পাতকে আমাকে লিপ্ত করিস নে ।
গদাই । কিছু ভেবো না ভাই । পাপ করেছে বিনোদ , তার রিডেম্‌প্‌শন্‌ আমার দ্বারা ।
চন্দ্রকান্ত । ভ্যালা মোর দাদা! আমি এক্‌খনি যাচ্ছি । চাদরখানা নিয়ে আসি । অমনি বড়োবউয়ের পরামর্শটাও জানা ভালো।
                    [ প্রস্থান
                        অনতিবিলম্বে ছুটিয়া আসিয়া
চন্দ্রকান্ত । বড়োবউ রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে! তোদের সংসর্গ লাভ করতে আসি , আর হারাই আমার স্ত্রীর সংসর্গ— আমার ঘটল মুকুতার বদলে শুকুতা ।
                              বিনোদের প্রবেশ
বিনোদ । চন্দরদা , তুমি আমার উপর রাগ করে চলে এলে ভাই! আমি আর থাকতে পারলুম না ।
চন্দ্রকান্ত । না ভাই , তোদের উপর কি রাগ করতে পারি ? তবে দুঃখ হয়েছিল তা স্বীকার করি ।
বিনোদ । কী করব চন্দরদা! আমি এত চেষ্টা করছি কিছুতেই পেরে উঠছি নে —
চন্দ্রকান্ত । কেন বল্‌ দেখি । ওর মধ্যে শক্তটা কী ? মেয়েমানুষকে ভালোবাসতে পারিস নে ।
বিনোদ । চন্দরদা , কী জানি ভাই বিয়ে না করাটাই মুখস্থ হয়ে গেছে ।
চন্দ্রকান্ত । তোর পায়ে পড়ি বিনু , তুই আমার গা ছুঁয়ে বল্‌ , নিদেন আমার খাতিরে তোর স্ত্রীকে ভালোবাসবি । মনে কর্, তুই আমার বোনকে বিয়ে করেছিস ।
বিনোদ । চন্দরদা , যাকেই হোক , বিয়ে যে করেছি সেটা বুঝতে তো বাকি নেই । মুশকিল হয়েছে সেটা কিছু অধিক পরিমাণেই বুঝতে পারছি । তার প্রধান কারণ টাকার টানাটানি । যতদিন একলা রাজত্ব করেছিলেম অমর্যাদা ছিল না । আর-একটিকে পাশে বসবামাত্র দেখি , ভাঙা সিংহাসন মড়্‌ মড়্‌ করে উঠছে । আজ অভাবগুলো চার দিক থেকে বড়ো বেআব্রু হয়ে দেখা দিল — সেটা কি ভালো লাগে ?
গদাই । তুমি বলতে চাও , তোমার ভালোবাসার অভাব নেই , অভাব কেবল টাকার ?
বিনোদ । ভালোবাসা আছে বলেই তো বুঝতে পারছি , যথেষ্ট টাকা নেই । পাত্র যে ফুটো সেটা ধরা পড়ল যখন তাতে সুধা ঢালা গেল । ঝাঁঝরি দিয়ে মধু খেতে গিয়ে সমস্ত গা যে যায় ভেসে । হালকা ছিলুম , দারিদ্র্যের উপর দিয়ে সাঁতার কেটে গেছি , আর-একজনকে কাঁধে নেবামাত্র তার তলার দিকে তলাচ্ছি — যেখানটাতে পাঁক ।
গদাই । বিনোদ , তোমার কবিতা যেমন তোমার ব্যবহারটাও তেমনি , একেবারে দুর্বোধ ।
বিনোদ । রেগেছ বলেই সহজ কথাটা বুঝতে পারছ না । ভেবে দেখো-না , আমার ছিল এক মামুলি ছাতা , রোদবৃষ্টির দুঃখ ভোগ করতে হয় নি , এমন সময় হিসেবের ভুলে ডেকে আনলুম ছাতার আর-এক শরিক — আজ আমার কাঁধেও জল পড়ছে , তার কাঁধেও । জিনিসটা ঘোরতর অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে ।
গদাই । কিন্তু ভুলটা তো তোমারই ।
বিনোদ । ভুলটা হচ্ছে ভুল , আর অ-ভুলটা হচ্ছে অ-ভুল , তা সে আমারই হোক আর তোমারই হোক । মোজাটা হচ্ছে মোজা , পাগড়িটা হচ্ছে পাগড়ি । ভুল করে মোজাটাকে যদি পাগড়ি করেই পরি তা হলে আমি ভুল করেছি বলেই মোজাটা কি পাগড়ি হয়ে উঠবে ।
গদাই । ( স্বগত) সর্বনাশ! এ আবার হঠাৎ মোজার কথা তোলে কেন ? খবর পেয়েছে নাকি ? সেদিন যখন মোজাজোড়া মাথায় জড়িয়ে বসেছিলুম হয়তো কোথা দিয়ে দেখে থাকবে । ( প্রকাশ্যে) ওহে মোজা নিয়ে ভুল করলেও তাতে মোজার বুক ফাটে না , বড়োজোর সেলাই ফেঁসে যেতে পারে । কিন্তু মানুষকে নিয়ে ভুল করে তার পরে 'ঐ যাঃ' বলে সরে দাঁড়ালে তো চলে না ।
চন্দ্রকান্ত । বকাবকি করে লাভ কি গদাই ? এখন বলো বিনোদ , কর্তব্য কী ।
বিনোদ । আমি তাঁকে তাঁর বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি ।
চন্দ্রকান্ত । তুমি নিজে চেষ্টা করে ? না তিনি রাগ করে গেছেন ?
বিনোদ । না , আমি তাঁকে একরকম বুঝিয়ে দিলুম —
চন্দ্রকান্ত । যে , এখানে তিনি টিকতে পারবেন না । তুমি সব পার বিনু । আজ আমার মনটা কিছু অস্থির আছে, আজ আর থাকতে পারছি নে।
   [ প্রস্থান