ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
তৃতীয়
অঙ্ক
তৃতীয় দৃশ্য
নিবারণের বাসা
ইন্দু ও কমল
কমল । না ভাই ইন্দু , ওরকম করে তুই বলিস নে ।
ইন্দু । কিরকম করে বলতে হবে ? বলতে হবে , স্ত্রীর ভরটুকুও সইতে পারেন না ,
বিনোদবিহারী এত বড়োই শৌখিন কবি! তাঁর বড়োজোর সহ্য হয় ফিকে চাঁদের আলো , কিংবা ঝরা
ফুলের গন্ধ । আমি ভাবছি তোর মতো মেয়েকেও সইতে পারল না ওর রুচিটি এতই ফিন্ফিনে , আর
তুই যে ওর মতো পুরুষকেও সহ্য করতে পারছিস তোর রুচিকে বাহাদুরি দিই ।
কমল । তুই বুঝিস নে ইন্দু , ওরা যে পুরুষমানুষ । আমাদের এক ভাব , ওদের আর-এক ভাব ।
মেয়েমানুষের ভালোবাসা সবুর করতে পারে না , বিধাতা তার হাতে সে অবসর দেন নি । পুরুষ
অনেক ঠেকে , অনেক ঘা খেয়ে , তার পরে ভালোবাসতে শেখে ; ততদিনে পৃথিবী সবুর করে থাকে
, কাজের ব্যাঘাত হয় না ।
ইন্দু । ইস! কী সব নবাব! আচ্ছা দিদি , তুই কি বলিস গদাই গয়্লার সঙ্গে আজই যদি আমার
বিয়ে হয় অমনি কাল ভোর থেকেই তাড়াতাড়ি তার চরণদুটো ধরে সেবা করতে বসে যাব — মনে করব
, ইনি আমার চিরকালের গয়লা , পূর্বজন্মের গয়লা , বিধাতা একে এবং এর অন্য গোরুগুলিকে
গোয়ালসুদ্ধ আমারই হাতে সমর্পণ করে দিয়েছেন ।
কমল । ইন্দু , তুই কী যে বকিস আমি তোর সঙ্গে পেরে উঠি নে । গদাই গয়লাকে তুই বিয়ে
করতে যাবি কেন , সে একে গয়লা , তাতে আবার তার দুই বিয়ে ।
ইন্দু । আচ্ছা না হয় গদাই গয়লা না হল — পৃথিবীতে গদাইচন্দ্রের তো অভাব নেই ।
কমল । তা তোর অদৃষ্টে যদি কোনো গদাই থাকে তা হলে অবিশ্যি তাকে ভালোবাসবি —
ইন্দু । কক্খনো বাসব না । আচ্ছা , তুমি দেখো । বিয়ে করেছি বলেই যে অমনি তার পরদিন
থেকে গদাই গদাই করে গদগদ হয়ে বেড়াব , আমাকে তেমন মেয়ে পাও নি । আমি দিদি , তোর মতন
না ভাই!
কমল । আসল জানিস , ইন্দু ? ওদের না হলে আমাদের চলতে পারে , কিন্তু আমাদের না হলে
পুরুষমানুষের চলে না , সেইজন্যে ওদের আমরা ভালোবাসি ।
নিবারণের প্রবেশ
নিবারণ । মা , তোমাকে দেখলে আমি চোখের জল রাখতে পারি নে । আমার মার কাছে আমি অপরাধী
। তোমার কাছে আমার দাঁড়ানো উচিত হয় না ।
কমল । কাকা , আপনি অমন করে বলবেন না , আমার অদৃষ্টে যা ছিল তাই হেয়েছে —
ইন্দু । বাবা , আসলে যার অপরাধ তাকে কিছু না বলে তার অপরাধ তোমরা পাঁচজনে কেন ভাগ
করে নিচ্ছ , আমি তো বুঝতে পারি নে ।
নিবারণ । থাক্ মা , সে-সব আলোচনা থাক্ — এখন একটা কাজের কথা বলি । কমল , মন দিয়ে
শোনো । তোমাকে এতদিন গরিবের মেয়ে বলে পরিচয় দিয়ে এসেছি , সে কথাটা ঠিক নয় । তোমার
বাপের সম্পত্তি নিতান্ত সামান্য ছিল না , আমারই হাতে সে-সমস্ত আছে । ইতিমধ্যে অনেক
টাকা জমেছে এবং সুদেও বেড়েছে ; তোমার কুড়ি বছর বয়স হলে তবে তোমার পাবার কথা । সময়
হয়েছে , এখন নাও তোমার বিষয় । সেই টানে হয়তো স্বামীও এসে পড়বে ।
কমল । কাকা , তাঁকে আপনি এ সংবাদ দেবেন না । কথাটা যাতে কেউ টের না পায় , আপনাকে
তাই করতে হবে ।
নিবারণ । কেন বলো দেখি মা ?
কমল । একটু কারণ আছে । সমস্তটা ভেবে আপনাকে পরে বলব ।
নিবারণ । আচ্ছা ।
[ প্রস্থান
ইন্দু । তোর মতলবটা কী আমাকে বল্ তো ।
কমল । আমি আর-একটা বাড়ি নিয়ে ছদ্মবেশে ওঁর কাছে অন্য স্ত্রীলোক বলে পরিচয় দেব ।
ইন্দু । সে তো বেশ হবে ভাই! ওরা ঠিক নিজের স্ত্রীকে ভালোবেসে সুখ পায় না । কিন্তু
বরাবর রাখতে পারবি তো ?
কমল । বরাবর রাখবার ইচ্ছে তো আমার নেই , বোন —
ইন্দু । ফের আবার একদিন স্বামী-স্ত্রী সাজতে হবে নাকি ?
কমল । হাঁ , ভাই , যতদিন যবনিকাপতন না হয় । ঐ শিবচরণবাবু বোধ হয় আসছেন , চলো পালাই
।
[ উভয়ের
প্রস্থান
গদাই ও
শিবচরণের প্রবেশ
শিবচরণ । দেখ্ , নিবারণকে আজ শেষ কথা বলব বলেই এখানে এসেছি । এখন তোর মনের কথাটা
স্পষ্ট করেই বল্ ।
গদাই । আমি তো সব কথা স্পষ্ট করেই বলেছি । বিয়ে করবার কথায় এখন মন দিতেই পারছি নে ।
শিবচরণ । এই বুড়ো বয়সে তুই যে একটা সামান্য বিষয়ে আমাকে এত দুঃখ দিবি , তা কে জানত!
গদাই । বাবা , এটা কি সামান্য বিষয় হল!
শিবচরণ । আরে বাপু , সামান্য না তো কী ? বিয়ে করা বৈ তো নয়! রাস্তায় মুটে-মজুরগুলোও
যে বিয়ে করছে । ওতে তো খুব বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয় না , বরঞ্চ কিছু টাকা খরচ আছে ,
তা সেও বাপমায়ে জোগায় । তুই এমন বুদ্ধিমান ছেলে , এতগুলো পাস করে শেষকালে এইখানে এসে
ঠেকল!
গদাই । আপনি তো সব শুনেছেন , আমি তো বিয়ে করতে অসম্মত নই —
শিবচরণ । আরে , তাতেই তো আমার বুঝতে আরো গোল বেধেছে । যদি বিয়ে করতেই আপত্তি না থাকে
, তবে নাহয় একটাকে না করে আর-একটাকেই করলি । নিবারণকে কথা দিয়েছি , আমি তার কাছে
মুখ দেখাই কী করে ?
গদাই । নিবারণবাবুকে ভালো করে বুঝিয়ে বললেই সব —
শিবচরণ । আরে , আমি নিজে বুঝতে পারি নে ; নিবারণকে বোঝাব কী ? আমি যদি তোর মাকে বিয়ে
না ক'রে তোর মাসিকে বিয়ে করবার প্রস্তাব মুখে আনতুম , তা হলে তোর ঠাকুরদাদা কি আমার
দুখানা হাড় একত্র রাখত ? পড়েছিস ভালো মানুষের হাতে —
গদাই । শুনেছি , আমার ঠাকুরদামশায়ের মেজাজ ভালো ছিল না —
শিবচরণ । কী বলিস বেটা! মেজাজ ভালো ছিল না! তোর বাবার চেয়ে তিনশো গুণে ভালো ছিল ।
কিছু বলি নে ব'লে , বটে! সে যা হোক , এখন যা হয় একটা কথা ঠিক্ করেই বল্ ।
গদাই । আমি তো বরাবর এক কথাই বলে আসছি ।
শিবচরণ । ( সরোষে) তুই তো বলছিস এক কথা! আমিই কি এক কথার বেশি বলছি ? মাঝের থেকে কথা
যে আপনিই দুটো হয়ে যাচ্ছে । আমি এখন নিবারণকে বলি কী! তা সে যাই হোক , তুই তা হলে
নিবারণের মেয়ে ইন্দুমতীকে কিছুতেই বিয়ে করবি নে ? যা বলবি এক কথা বল্ ।
গদাই । কিছুতেই না , বাবা ।
শিবচরণ । একমাত্র বাগবাজারের কাদম্বিনীকেই বিয়ে করবি ? ঠিক করে বলিস । এক কথা!
গদাই । সেরকমই স্থির করেছি —
শিবচরণ । বড়ো উত্তম কাজ করেছ — এখন আমি নিবারণকে কী বলব ?
গদাই । বলবেন , আপনার অবাধ্য ছেলে তাঁর কন্যা ইন্দুমতীর যোগ্য নয় ।
শিবচরণ । কোথাকার নির্লজ্জ! আমাকে আর তোর শেখাতে হবে না । কী বলতে হবে তা আমি
বিলক্ষণ জানি । তবে ওর আর কিছুতেই নড়চড় হবে না ? এক কথা —
গদাই । না বাবা , সেজন্যে আপনি ভাববেন না ।
শিবচরণ । আরে মলো! আমি সেইজন্যেই ভেবে মরছি আর-কী! আমি ভাবছি নিবারণকে বলি কী ।