ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


শেষরক্ষা


চতুর্থ অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
সুসজ্জিত গৃহ


বিনোদ । এরা বেছে বেছে এত দেশ থাকতে আমাকে উকিল পাকড়ালে কী ক'রে আমি তাই ভাবছি । আমার অদৃষ্ট ভালো বলতে হবে । এখন টিকতে পারলে হয় ।
                                    ঘোমটা পরিয়া কমলের প্রবেশ
বিনোদ । ( স্বগত) আহা , মুখটি দেখতে পেলে বেশ হত! (প্রকাশ্যে) আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন ?
কমল । হাঁ । আপনি বোধ হয় আমার অবস্থা সবই জানেন ।
বিনোদ । কিছু-কিছু শুনেছি । ( স্বগত) গলাটা যে তারই মতন শোনাচ্ছে । সব মেয়েরই গলা প্রায় একরকম দেখছি । কিন্তু তার চেয়ে কত মিষ্টি!
কমল । সে কথা থাক্‌ । আমার যা-কিছু সমস্তর কর্তৃত্বভার আপনাকে নিতে হবে ।
বিনোদ । আপনি যে আমাকে এত বড়ো বিশ্বাসের যোগ্য মনে করলেন , এতেই আমাকে যোগ্যতা দেবে । আপনার বিশ্বাসই আমাকে মানুষ করে তুলবে ।
কমল । আপনাকে আর বেশিক্ষণ আবদ্ধ করে রাখতে চাই নে , আপনার বোধ করি অনেক কাজ আছে —
বিনোদ । না না , সেজন্যে আপনি ভাববেন না । আমার সহস্র কাজ থাকলেও সমস্ত পরিত্যাগ করে আমি —
কমল । কাল পয়লা তারিখ , কাল থেকে তা হলে আমার কর্মচারীদের কাছ থেকে আপনি বুঝ-পড়ে নিন । নিবারণবাবু এখনি আসবেন , তিনি এলে তাঁর কাছ থেকেও অনেকটা জেনেশুনে নিতে পারবেন ।
বিনোদ । নিবারণবাবু!
কমল । আপনি তাঁকে চেনেন বোধ হয় , কারণ , তিনিই প্রথমে আপনার জন্যে আমার কাছে অনুরোধ করে দিয়েছেন ।
বিনোদ । ( স্বগত) ছি ছি ছি , বড়ো লজ্জা বোধ হচ্ছে । আমি কালই আমার স্ত্রীকে ঘরে নিয়ে আসব । এখন তো আমার কোনো অভাব নেই ।
কমল । আপনি বরঞ্চ নীচের ঘরে একটু অপেক্ষা করুন , নিবারণবাবু এলেই খবর পাঠিয়ে দেব । আর-একটা কথা , আমি যে কাল আপনাকে চিঠিতে জানিয়েছি , আপনার বন্ধু ললিত চাটুজ্জেকে একবার এখানে আনতে , সেটার কিছু ব্যবস্থা হয়েছে ?
বিনোদ । সব ঠিক আছে । তিনি এলেন ব'লে , আর দেরি নেই ।
কমল । তবে আমি আসি ।
            [ প্রস্থান
বিনোদ । হায় হায় , এতটাই যখন বিশ্বাস করলেন তখন কেবল আর তিন ইঞ্চি পরিমাণ বিশ্বাস ক'রে ঘোমটা খুললে বাঁচা যেত , তা হলেই চোখদুটি দেখতে পেতুম । কিন্তু নিবারণবাবুকে নিয়ে কী করা যায় ।

                                   নিবারণ ও কমলমুখীর প্রবেশ
কমল । আমার জন্যে আপনি আর কিছু ভাববেন না । এখন ইন্দুর এই গোলটা চুকে গেলেই বাঁচা যায় ।
নিবারণ । তাই তো মা , আমাকে ভারি ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছে । আমি এ দিকে শিবু ডাক্তারের সঙ্গে কথাবার্তা একরকম স্থির করে বসে আছি , এখন তাকেই বা কী বলি , ললিত চাটুজ্জেকেই বা কোথায় পাওয়া যায় , আর সে বিয়ে করতে রাজি হয় কি না তাই বা কে জানে ।
কমল । সেজন্যে ভাববেন না কাকা! আমাদের ইন্দুকে চোখে দেখলে বিয়ে করতে নারাজ হবে , এমন ছেলে কেউ জন্মায় নি।
নিবারণ । ওদের দেখাশোনা হয় কী করে ?
কমল । সে আমি সব ঠিক করেছি ।
নিবারণ । তুমি কী করে ঠিক করলে মা ?
কমল । আমি ওঁকে বলে দিয়েছি , ওঁর বন্ধু ললিতবাবুকে এখানে নিয়ে আসবেন । তার পর একটা উপায় করা যাবে ।
নিবারণ । তা সব যেন হল , আমি ভাবছি শিবুকে কী বলব ।
কমল । ঐ উনি আসছেন । আমি তবে যাই ।
   [ প্রস্থান
                          বিনোদের প্রবেশ
বিনোদ । এই যে , আমি আপনার কথাই ভাবছিলুম ।
নিবারণ । কেন বাপু , আমি তো তোমার মক্কেল নই ।
বিনোদ । আজ্ঞে , আমাকে লজ্জা দেবেন না — আপনি বুঝতেই পারছেন —
নিবারণ । না বাপু , আমি কিছুই বুঝতে পারি নে । আমরা সেকালের লোক ।
বিনোদ । আমার স্ত্রী আপনার ওখানে আছেন —
নিবারণ । তা অবশ্য — তাকে তো আমরা ত্যাগ করতে পারি নে ।
বিনোদ । আমার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে তাঁকে যদি আমার ওখানে পাঠিয়ে দেন —
নিবারণ । বাপু , আবার কেন পালকি-ভাড়াটা লাগবে ?
বিনোদ । আপনারা আমাকে কিছু ভুল বুঝছেন । আমার অবস্থা খারাপ ছিল বলেই আমার স্ত্রীকে — তা যাই হোক — তাঁকে ত্যাগ করার অভিপ্রায় ছিল না । এখন আপনারই অনুগ্রহে তো — তা এখন তো অনায়াসে —
নিবারণ । বাপু , এ তো তোমার পোষা পাখি নয় । সে যে সহজে তোমার ওখানে যেতে রাজি হবে , এমন আমার বোধ হয় না ।
বিনোদ । আপনি অনুমতি দিলে আমি নিজে গিয়ে তাঁকে অনুনয় বিনয় করে নিয়ে আসতে পারি ।
নিবারণ । আচ্ছা , সে বিষয় বিবেচনা করে পরে বলব ।
   [ প্রস্থান
বিনোদ । বুড়োও তো কম একগুঁয়ে নয় দেখছি । যা হোক এ পর্যন্ত রানীকে কিছু বলে নি বোধ হয় ।
                                 চন্দ্রকান্তের প্রবেশ
বিনোদ । কী হে চন্দর! তুমি এখানে যে!
চন্দ্রকান্ত । নিবারণবাবু এই বাড়িতে কী কাজে এসেছেন শুনলুম । আজ তাঁরই ওখানে আমার খাওয়ার পালা পড়েছে , বুড়ো ভুলে গেছেন কি না খবর নিতে এসেছি । খিদে পেয়েছে । তুমিও বুঝি নিবারণবাবুর খোঁজে এখানে এসেছ ?
বিনোদ । সে কথা পরে হবে । কিন্তু , তুমি পালা করে খাচ্ছ , তার মানে তো বুঝতে পারছি নে চন্দরদা!
চন্দ্রকান্ত । আর ভাই , মহা বিপদে পড়েছি ।
বিনোদ । কেন , কী হয়েছে ?
চন্দ্রকান্ত । কী জানি ভাই , কখন তোদের সাক্ষাতে কথায় কথায় কী কতকগুলো মিছে কথা বলেছিলুম , তাই শুনে ব্রাহ্মণী বাপের বাড়ি এমনি গা-ঢাকা হয়েছেন যে , কিছুতেই তাঁর আর নাগাল পাচ্ছি নে ।
বিনোদ । বলো কী দাদা! তোমার বাড়িতে তো এ দন্ডবিধি পূর্বে প্রচলিত ছিল না ।
চন্দ্রকান্ত । না ভাই , কালক্রমে কতই যে হচ্ছে , কিছু বুঝতে পারছি নে ।
বিনোদ । এখন তা হলে তোমার ছুটি চলছে বলো । জীবনে এই বোধ হয় ডোমেস্‌টিক সার্ভিসে তোমার প্রথম ফার্লো ।
চন্দ্রকান্ত । হাঁ রে , কিন্তু উইদাউট পে । বিনু , আমার দুঃখ তোরা বুঝতেই পারবি নে । তুই সেদিন বলছিলি , বিয়ে না করটাই তোর মুখস্থ হয়ে গেছে । আমার ঠিক তার উলটো । ঐ স্ত্রীটিকে এমনই বিশ্রী অভ্যেস করে ফেলেছি যে , হঠাৎ বুকের হাড়-কখানা খসে গেলে যেমন একদম খালি ঠেকে , ঐ স্ত্রীটি আড়াল হলেই তেমনি জগৎ টা যেন ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়।
বিনোদ । এখন উপায় কী ?
চন্দ্রকান্ত । মনে করছি , আমি উলটে রাগ করব । আমিও ঘর ছেড়ে তোর এখানেই থাকব । আমার বন্ধুদের মধ্যে তোকেই সে সবচেয়ে বেশি ভয় করে । তার বিশ্বাস , তুই আমার মাথাটি খেয়েছিস!
বিনোদ । তা বেশ কথা । কিন্তু আমাকে যে আবার শ্বশুরবাড়ি যেতে হচ্ছে ।
চন্দ্রকান্ত । কার শ্বশুরবাড়ি ?
বিনোদ । আমার নিজের , আবার কার ।
চন্দ্রকান্ত । ( সানন্দে বিনুর পিঠে চপেটাঘাত করিয়া) সত্যি বলছিস বিনু ?
বিনোদ । স্ত্রীকে আনতে চলেছি , নিতান্ত লক্ষ্মীছাড়ার মতো থাকতে আর ইচ্ছে করছে না ।
চন্দ্রকান্ত । কিন্তু , এতদিন তোর এ আক্কেল ছিল কোথায় ? যতকাল আমার সংসর্গে ছিলি এমন সব সৎ সংকল্পের প্রসঙ্গ তো শুনতে পাই নি , দুদিন আমার দেখা পাস নি আর তোর ধর্মবুদ্ধি এতদূর পরিষ্কার হয়ে এল ?
বিনোদ । কিন্তু , চন্দরদা , বিপদ কী হয়েছে জান ? নিবারণবাবুর যে-রকম মেজাজ দেখলুম , সহজে কমলকে আমার কাছে পাঠাতে রাজি হবেন না । তুমি তো তাঁর ওখানে খেতে যাচ্ছ , আমার হয়ে একটু ওকালতি করতে হবে ।
চন্দ্রকান্ত । নিশ্চয় করব । কিন্তু , ওরা যে বললে নিবারণবাবু এখানে এসেছেন ।
বিনোদ । এই খানিকক্ষণ হল তিনি চলে গেছেন , তুমি আর দেরি কোরো না ।
                                            [ প্রস্থান
                                  ইন্দু ও কমলের প্রবেশ
কমল । তোর জ্বালায় তো আর বাঁচি নে ইন্দু! তুই আবার এ কী জটা পাকিয়ে বসে আছিস! ললিতবাবুর কাছে তোকে কাদম্বিনী বলে উল্লেখ করতে হবে নাকি ?
ইন্দু । তা কী করব দিদি! কাদম্বিনী না বললে যদি সে না চিনতে পারে তা হলে ইন্দু বলে পরিচয় দিয়ে লাভটা কী ?
কমল । ইতিমধ্যে তুই এত কাণ্ড কখন করে তুললি , তা তো জানি নে । একটা যে আস্ত নাটক বানিয়ে বসেছিস!
ইন্দু । তোমার বিনোদবাবুকে বোলো , তিনি লিখে ফেলবেন এখন , তার পর মেট্রপলিটান থিয়েটারে অভিনয় দেখতে যাব । ঐ ভাই , তোমার বিনোদবাবু আসছেন , আমি পালাই । [ প্রস্থান
                            বিনোদের প্রবেশ
বিনোদ । মহারানী , আমার বন্ধু এলে কোথায় তাঁকে বসাব ?
কমল । এই ঘরেই বসাবেন ।
বিনোদ । ললিতের সঙ্গে আপনার যে বন্ধুর বিবাহ স্থির করতে হবে তাঁর নামটি কী ?
কমল । কাদম্বিনী — বাগবাজারের চৌধুরীদের মেয়ে ।
বিনোদ । আপনি যখন আদেশ করছেন আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব । কিন্তু ললিতের কথা আমি কিছুই বলতে পারি নে । সে যে এ-সব প্রস্তাবে আমাদের কারো কথায় কর্ণপাত করবে , এমন বোধ হয় না ।
কমল । আপনাকে সেজন্যে বোধ হয় বেশি চেষ্টা করতেও হবে না — কাদম্বিনীর নাম শুনলেই তিনি আর বড়ো আপত্তি করবেন না ।
বিনোদ । তা হলে তো আর কথাই নেই ।
কমল । মাপ করেন যদি , আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই ।
বিনোদ । এখনি । ( স্বগত) স্ত্রীর কথা না তুললে বাঁচি ।
কমল । আপনার স্ত্রী নেই কি ?
বিনোদ । কেন বলুন দেখি ? স্ত্রীর কথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন ?
কমল । আপনি তো অনুগ্রহ করে এই বাড়িতেই বাস করছেন , তা , আপনার স্ত্রীকে আমি আমার সঙ্গিনীর মতো করে রাখতে চাই । অবিশ্যি , যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে ।
বিনোদ । আপত্তি! কোনো আপত্তিই থাকতে পারে না । এ তো আমার সৌভাগ্যের কথা!
কমল । আজ সন্ধ্যার সময় তাঁকে আনতে পারেন না ?
বিনোদ । আমি বিশেষ চেষ্টা করব ।        [ কমলের প্রস্থান
                                          ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্য । একটি সাহেব বাবু এসেছেন ।
বিনোদ । এইখানেই ডেকে নিয়ে আয় ।
সাহেবি বেশে ললিতের প্রবেশ
ললিত । ( শেক্‌হ্যান্ড করিয়া)
Well ! How goes the world? ভালো তো ?
বিনোদ । একরকম ভালোয়-মন্দয় । তোমার কীরকম চলছে ?
ললিত ।
Pretty well ! জানো ? I am going in for studentship next year.
বিনোদ । ওহে , আর কতদিন এক্‌জামিন দিয়ে মরবে ? বিয়েথাওয়া করতে হবে না নাকি ? এ দিকে যৌবনটা যে ভাঁটিয়ে গেল ।
ললিত ।
Halloo ! You seem to have queer ideas on the subject . কেবল যৌবনটুকু নিয়ে one can't marry . I suppose first of all you must get a girl whom you —
বিনোদ । আহা , তা তো বটেই । আমি কি বলছি , তুমি তোমার নিজের হাত-পাগুলোকে বিয়ে করবে । অবিশ্যি , মেয়ে
একটি আছে ।
ললিত ।
I know that ! একটি কেন ? মেয়ে there is enough and to spare ! কিন্তু তা নিয়ে তো কথা হচ্ছে না।
বিনোদ । আহা , তোমাকে নিয়ে তো ভালো বিপদে পড়া গেল । পৃথিবীর সমস্ত কন্যাদায় তোমাকে হরণ করতে হবে না । কিন্তু যদি একটি সুন্দরী সুশিক্ষিত বয়ঃপ্রাপ্ত মেয়ে তোমাকে দেওয়া যায় , তা হলে কী বলো ?
ললিত ।
I admire your cheek বিনু! তুমি wife select করবে আর আমি marry করব! I don't seem any rhyme or reason in such cooperation . পোলিটিক্যাল ইকনমিতে division of labour আছে , কিন্তু there is no such thing in marriage .
বিনোদ । তা বেশ তো , তুমি দেখো , তার পরে পছন্দ না হয় বিয়ে কোরো না ।
ললিত ।
My dear fellow, you are very kind কিন্তু আমি বলি কী , you need not bother yourself about my happiness, আমার বিশ্বাস , আমি যদি কখনো কোনো girlকে love করি , I will love her without your help এবং তার পরে যখন বিয়ে করব you'll get your invitation in due from .
বিনোদ । আচ্ছা ললিত , যদি সে মেয়েটির নাম শুনলেই তোমার পছন্দ হয় ?
ললিত ।
The idea ! নাম শুনে পছন্দ! যদি মেয়েটিকে বাদ দিয়ে simply নামটিকে বিয়ে করতে বল , that's a safe proposition .
বিনোদ । আগে শোনো , তার পর যা বলতে হয় বোলো — মেয়েটির নাম — কাদম্বিনী ।
ললিত । কাদম্বিনী!
She may be all that is nice and good, কিন্তু I must confess, তার নাম নিয়ে তাকে
congratulate করা যায় না । যদি তার নামটাই তার best qualification হয় তা হলে I should try my luck in some other quarter .

বিনোদ । ( স্বগত) এর মানে কী! তবে যে রানী বললেন , কাদম্বিনীর নাম শুনলেই লাফিয়ে উঠবে! দূর হোক গে । একে খাওয়ানোটাই বাজে খরচ হল — আবার এই ম্লেচ্ছটার সঙ্গে আরো আমাকে নিদেন দু ঘণ্টা কাটাতে হবে দেখছি ।
ললিত ।
I say, it's infernally hot here - চলো-না বারান্দায় গিয়ে বসা যাক ।