ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
চতুর্থ
অঙ্ক
দ্বিতীয় দৃশ্য
কমলমুখীর অন্তঃপুর
কমল ও ইন্দু
ইন্দু । দিদি , আর বলিস নে
দিদি , আর বলিস নে । পুরুষমানুষকে আমি চিনেছি । তুই বাবাকে বলিস , আমি কাউকে বিয়ে
করব না ।
কমল । তুই ললিতবাবু থেকে সব পুরুষ চিনলি কী করে ইন্দু ?
ইন্দু । আমি জানি , ওরা কেবল কবিতায় ভালোবাসে , তা ছন্দ মিলুক আর না মিলুক । ছি ছি!
ছি ছি দিদি , আমার এমনি লজ্জা করছে! ইচ্ছে করছে মাটির সঙ্গে মাটি হয়ে মিশে যাই ।
কাদম্বিনীকে সে চেনে না ? মিথ্যেবাদী! কাদম্বিনীর নামে কবিতা লিখেছে , সে খাতা এখনো
আমার কাছে আছে ।
কমল । যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে আর কী করবি ? এখন কাকা যাকে বলছেন , তাকে বিয়ে কর্।
[ ইন্দুমতীর প্রস্থান
নিবারণের প্রবেশ
নিবারণ । কী করি বলো তো মা । ললিত চাটুজ্জে যা বলেছে সে তো সব শুনেছ । সে বিনোদকে
কেবল মারতে বাকি রেখেছে । অপমান যা হবার তা হয়েছে —
কমল । না কাকা , তার কাছে ইন্দুর নাম করা হয় নি । আপনার মেয়ের কথা হচ্ছে , তাও সে
জানে না ।
নিবারণ । ইদিকে আবার শিবুকে কথা দিয়েছি , তাকেই বা কী বলি । তুমি মা , ইন্দুকে ব'লে
ক'য়ে ওদের দুজনের দেখা করিয়ে দিতে পারো তো ভালো হয় ।
কমল । গদাইয়ের মনের ইচ্ছে কী সেটাও তো জানতে হবে কাকা । আবার কি এইরকম একটি কাণ্ড
বাধানো ভালো ?
নিবারণ । সে আমি তার বাপের কাছে শুনেছি । সে বলে আমি উপার্জন না করে বিয়ে করব না ।
সে তো আমার মেয়েকে কখনো চক্ষে দেখে নি । একবার দেখলে ও-সব কথা ছেড়ে দেবে ।
কমল । তা , ইন্দুকে আমি সম্মত করাতে পারব ।
[ নিবারণের প্রস্থান
ইন্দুর প্রবেশ
কমল । লক্ষ্মী দিদি আমার , আমার একটি অনুরোধ তোর রাখতে হবে ।
ইন্দু । কী , বল্-না ভাই!
কমল । একবার গদাইবাবুর সঙ্গে তুই দেখা কর্।
ইন্দু । কেন দিদি , তাতে আমার কী প্রায়শ্চিত্তটা হবে ?
কমল । তোর যখন যা ইচ্ছে তাই করেছিস ইন্দু , কাকা তাতে বাধা দেন নি । আজ কাকার একটি
অনুরোধ রাখবি নে ?
ইন্দু । রাখব ভাই , তিনি যা বলবেন তাই শুনব ।
কমল । তবে চল্ , তোর চুলটা একটু ভালো করে দিই । নিজের উপরে এতটা অযত্ন করিস্ নে ।
[ প্রস্থান
গদাইয়ের প্রবেশ
গদাই । চন্দর যখন পীড়াপীড়ি করছে তা নাহয় একবার ইন্দুমতীর সঙ্গে দেখা করাই যাক ।
শুনেছি তিনি বেশ বুদ্ধিমতী সুশিক্ষিতা মেয়ে — তাঁকে আমার অবস্থা বুঝিয়ে বললে তিনি
নিজেই আমাকে বিবাহ করিতে অসম্মত হবেন । তা হলে আমার ঘাড় থেকে দায়টা যাবে — বাবাও আর
পীড়াপীড়ি করবেন না ।
মুখে ঘোমটা টানিয়া ইন্দুমতীর প্রবেশ
ইন্দু । ( স্বগত) বাবা যখন বলেছেন তখন দেখা করতেই হবে , কিন্তু কারো অনুরোধে তো
পছন্দ হয় না । বাবা কখনোই আমার ইচ্ছের বিরূদ্ধে বিয়ে দেবেন না ।
গদাই । ( নতশিরে ইন্দুর প্রতি) আমাদের মা-বাপ আমাদের পরস্পরের বিবাহের জন্যে
পীড়াপীড়ি করছেন , কিন্তু আপনি যদি ক্ষমা করেন তো আপনাকে একটি কথা বলি —
ইন্দু । একি! এ যে ললিতবাবু! (উঠিয়া দাঁড়াইয়া) ললিতবাবু , আপনাকে বিবাহের জন্যে
যাঁরা পীড়াপীড়ি করছেন তাঁদের আপনি জানাবেন , বিবাহ এক পক্ষের সম্মতিতে হয় না । আমাকে
আপনার বিবাহের কথা বলে কেন অপমান করছেন ?
গদাই । একি! এ যে কাদম্বিনী! (উঠিয়া দাঁড়াইয়া) আপনি এখানে আমি তা জানতুম না । আমি
মনে করেছিলুম , নিবারণবাবুর কন্যা ইন্দুমতীর সঙ্গে আমি কথা কচ্ছি — কিন্তু আমার যে
এমন সৌভাগ্য হবে —
ইন্দু । ললিতবাবু , আপনার সৌভাগ্য আপনি মনে মনে রেখে দেবেন , সে কথা আমার কাছে
প্রচার করবার দরকার দেখি নে ।
গদাই । আপনি কাকে ললিতবাবু বলছেন ? ললিতবাবু বারান্দায় বিনোদের সঙ্গে গল্প করছেন —
যদি আবশ্যক থাকে তাঁকে ডেকে নিয়ে আসি ।
ইন্দু । না না , তাঁকে ডাকতে হবে না । আপনি তা হলে কে!
গদাই । এর মধ্যেই ভুলে গেলেন ? চন্দ্রবাবুর বাসায় আপনি নিজে আমাকে চাকরি দিয়েছেন ,
আমি তৎক্ষণাৎ তা মাথায় করে নিয়েছি — ইতিমধ্যে বরখাস্ত হবার মতো কোনো অপরাধ করি নি
তো ।
ইন্দু । আপনার নাম কি ললিতবাবু নয় ?
গদাই । যদি পছন্দ করেন তো ঐ নামই শিরোধার্য করে নিতে পারি , কিন্তু বাপ-মায়ে আদর করে
আমার নাম রেখেছিলেন গদাই ।
ইন্দু । গদাই!
— ছি ছি , এ কথা আমি আগে জানতে পারলুম না কেন!
গদাই । তা হলে চাকরি কি দিতেন না ? এখন কী আদেশ করেন ?
ইন্দু । আমি আদেশ করছি , ভবিষ্যতে যখন কবিতা লিখবেন কাদম্বিনীর পরিবর্তে ইন্দুমতী
নামটি ব্যবহার করবেন আর ছন্দ মিলিয়ে লিখবেন ।
গদাই । দুটোই যে আমার পক্ষে সমান অসাধ্য ।
ইন্দু । আচ্ছা , ছন্দ মেলাবার ভার আমি নিজেই নেব এখন , নামটা আপনি বদলে নেবেন —
গদাই । এমন নিষ্ঠুর আদেশ কেন করছেন ? চোদ্দটা অক্ষরের জায়গায় সতেরোটা বসানো কি এমনি
গুরুতর অপরাধ যে সেজন্যে ভৃত্যকে একেবারে —
ইন্দু । না , সে অপরাধ আমি সহস্রবার মার্জনা করতে পারি , কিন্তু ইন্দুমতীকে
কাদম্বিনী বলে ভুল করলে আমার সহ্য হবে না —
গদাই । আপনার নাম তবে —
ইন্দু । ইন্দুমতী ।
গদাই । হায় হায় , এতদিন কী ভুলটাই করেছি! বাগবাজারের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি
, বাবা আমাকে উঠতে বসতে দু-বেলা বাপান্ত করেছেন , তার উপরে কাদম্বিনী নামটা ছন্দের
ভিতর পুরতে মাথা-ভাঙাভাঙি করতে হয়েছে । —
(মৃদুস্বরে) যেমনি আমায় ইন্দু প্রথম দেখিলে
কেমন করে চকোর বলে তখনি চিনিলে —
কিংবা
কেমন করে চাকর বলে তখনি চিনিলে —
আহা , সে কেমন হত!
ইন্দু । তবে এখন ভ্রমসংশোধন করুন — এই নিন আপনার খাতা । আমি চললুম ।
[ প্রস্থান
গদাই । ( উচ্চস্বরে) শুনে যান , আপনারও বোধ হচ্ছে যেন একটা ভ্রম হয়েছিল — সেটাও
অনুগ্রহ করে সংশোধন করে নেবেন — সুবিধে আছে , আপনাকে সেইসঙ্গে ছন্দ বদলাতে হবে না ।
— হায় রে , সেই মোজার কবিতাটা যে অপরাধের বোঝা হয়ে আমার অ্যানাটমির নোট-বইটা চেপে
রইল । মেজর অপারেশন করলেও যে ওটাকে ছাঁটা যাবে না । আর সেই রিফু-করা মোজা ক-জোড়া ।
আজও যে প্রাণ ধরে সেগুলো ফিরিয়ে দিতে পারি নি । তার উপরে সেদিন থেকে ভরু
ফুলুরিওয়ালার তেলে-ভাজা বেগ্নি খেয়ে খেয়ে অমলশূল হবার জো হল । ঠাকুরদাসীকে খুঁজে
বের করতে হবে । সে বুড়িটাকে — ইচ্ছে করছে — থাক্ , সে আর বলে কাজ নেই ।
নিবারণের প্রবেশ
নিবারণ । দেখো বাপু , শিবু আমার বাল্যকালের বন্ধু — আমার বড়ো ইচ্ছে , তাঁর সঙ্গে
আমার একটা পারিবারিক বন্ধন হয় । এখন তোমাদের ইচ্ছের উপরেই সমস্ত নির্ভর করছে ।
গদাই । আমার ইচ্ছের জন্যে আপনি কিছু ভাববেন না , আপনার আদেশ পেলেই আমি কৃতার্থ হই ।
নিবারণ । ( স্বগত) যা মনে করেছিলুম তাই । বুড়ো বাপ মাথা খোঁড়াখুঁড়ি করে যা করতে না
পারলে , একবার ইন্দুকে দেখবামাত্র সমস্ত ঠিক হয়ে গেল । বুড়োরাই শাস্ত্র মেনে চলে ,
যুবাদের শাস্ত্রই আলাদা । ( প্রকাশ্যে) তা বাপু , তোমার কথা শুনে বড়ো আনন্দ হল । তা
হলে একবার আমার মেয়েকে তার মতটা জিজ্ঞাসা করে আসি । তোমরা শিক্ষিত লোক , বুঝতেই পার
, বয়ঃপ্রাপ্ত মেয়ে , তার সম্মতি না নিয়ে তাকে বিবাহ দেওয়া যায় না ।
গদাই । তা অবশ্য ।
নিবারণ । তা হলে আমি একবার আসি । চন্দ্রবাবুদের এই ঘরে ডেকে দিয়ে যাই ।
[ প্রস্থান
শিবচরণের প্রবেশ
শিবচরণ । তুই এখানে বসে রয়েছিস , আমি তোকে পৃথিবী-সুদ্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছি ।
গদাই । কেন বাবা ?
শিবচরণ । তোকে যে আজ তারা দেখতে আসবে ।
গদাই । কারা ?
শিবচরণ । বাগবাজারের চৌধুরীরা ।
গদাই । কেন!
শিবচরণ । কেন! না দেখে-শুনে অমনি ফস করে বিয়ে হয়ে যাবে ? তোর বুঝি আর সবুর সইছে না
?
গদাই । বিয়ে কার সঙ্গে হবে ?
শিবচরণ । ভয় নেই রে বাপু , তুই যাকে চাস তারই সঙ্গে হবে । আমার ছেলে হয়ে তুই যে এত
টাকা চিনেছিস , তা তো জানতুম না । তা সেই বাগবাজারের ট্যাকশালের সঙ্গেই তোর বিয়ে
স্থির করে এসেছি ।
গদাই । সে কি বাবা! আপনার মতের বিরুদ্ধে আমি বিয়ে করতে চাই নে — বিশেষ আপনি
নিবারণবাবুকে কথা দিয়েছেন—
শিবচরণ । ( অনেকক্ষণ হাঁ করিয়া গদাইয়ের মুখের দিকে নিরীক্ষণ) তুই খেপেছিস না আমি
খেপেছি , আমাকে কে বুঝিয়ে দেবে! কথাটা একটু পরিষ্কার করে বল্ , আমি ভালো করে বুঝি
।
গদাই । আমি সেই চৌধুরীদের মেয়ে বিয়ে করব না ।
শিবচরণ । চৌধুরীদের মেয়ে বিয়ে করবি নে! তবে কাকে করবি ?
গদাই । নিবারণবাবুর মেয়ে ইন্দুমতীকে ।
শিবচরণ । ( উচ্চস্বরে) কী! হতভাগা পাজি লক্ষ্মীছাড়া বেটা! যখন ইন্দুমতীর সঙ্গে
সম্বন্ধ করি তখন বলিস কাদম্বিনীকে বিয়ে করবি আবার যখন কাদম্বিনীর সঙ্গে সম্বন্ধ করি
তখন বলিস ইন্দুমতীকে বিয়ে করবি — তুই তোর বুড়ো বাপকে একবার বাগবাজার একবার
মির্জাপুর খেপিয়ে নিয়ে , নাচিয়ে নিয়ে বেড়াতে চাস!
গদাই । আমাকে মাপ করো বাবা , আমার একটা মস্ত ভুল হয়ে গিয়েছিল —
শিবচরণ । ভুল কী রে বেটা , তোর সেই বাগবাজারে বিয়ে করতেই হবে । তাদের কোনো পুরুষে
চিনি নে , আমি নিজে গিয়ে তাদের স্তুতি মিনতি করে এলুম যেন আমারই কন্যাদায় হয়েছে ।
তার পরে যখন সমস্ত ঠিকঠাক হয়ে গেল , আজ তারা আশীর্বাদ করতে আসবে , তখন বলে কিনা ‘
বিয়ে করব না ' ! আমি এখন চৌধুরীদের বলি কী!
চন্দ্রকান্তের প্রবেশ
চন্দ্রকান্ত । ( গদাইয়ের প্রতি) সমস্ত শুনলুম । ভালো একটি গোল বাধিয়েছ যা হোক । —
এই যে ডাক্তারবাবু , ভালো আছেন তো ?
শিবচরণ । ভালো আর থাকতে দিলে কই । এই দেখো-না চন্দর , ওর নিজেরই কথামত একটি পাত্রী
স্থির করলুম , যখন সমস্ত ঠিক হয়ে গেল তখন বলে কিনা ‘ তাকে বিয়ে করব না ' । আমি এখন
চৌধুরীদের বলি কী ?
গদাই । বাবা , তুমি তাদের একটু বুঝিয়ে বললেই —
শিবচরণ । তোমার মাথা! তাদের বোঝাতে হবে , আমার ভীমরতি ধরেছে আর আমার ছেলেটি আস্ত
খেপা — তা তাদের বুঝতে বিলম্ব হবে না ।
চন্দ্রকান্ত । আপনি কিছু ভাববেন না । সে মেয়েটির আর-একটি পাত্র জুটিয়ে দিলেই হবে ।
শিবচরণ । সে তেমন মেয়েই নয় । তার টাকা আছে ঢের , কিন্তু চেহারা দেখে পাত্র এগোয় না
। আমার বংশের এই অকাল কুষ্মাণ্ডের মতো এত বড়ো বাঁদর দ্বিতীয় আর কোথায় পাবে যে তাকে
বিয়ে করতে রাজি হবে ।
চন্দ্রকান্ত । সে আমার উপর ভার রইল । আমি সমস্ত ঠিকঠাক করে দেব । এখন নিশ্চিন্ত মনে
নিবারণবাবুর মেয়ের সঙ্গে বিবাহ স্থির করুন ।
শিবচরণ । যদি পার চন্দর , তো বড়ো উপকার হয় । এই বাগবাজারের হাত থেকে মানে মানে
নিস্তার পেলে বাঁচি । এ দিকে আমি নিবারণের কাছে মুখ দেখাতে পারছি নে , পালিয়ে পালিয়ে
বেড়াচ্ছি ।
চন্দ্রকান্ত । সেজন্যে কোনো ভাবনা নেই । আমি প্রায় অর্ধেক কাজ গুছিয়ে এসে তবে আপনাকে
বলছি । এখন বাকিটুকু সেরে আসি ।
[ প্রস্থান
নিবারণের প্রবেশ
শিবচরণ । আরে এসো ভাই , এসো ।
নিবারণ । ভালো আছ ভাই ? যা হোক শিবু , কথা তো স্থির ?
শিবচরণ । সে তো বরাবরই স্থির আছে , এখন তোমার মরজি হলেই হয় ।
নিবারণ । আমারও তো সমস্ত ঠিক হয়ে আছে , এখন হয়ে গেলেই চুকে যায় ।
শিবচরণ । তবে আর কি , দিনক্ষণ দেখে —
নিবারণ । সে-সব কথা পরে হবে — এখন কিছু মিষ্টিমুখ করবে চলো ।
শিবচরণ । না ভাই , আমার অভ্যাস নেই , এখন থাক্ — অসময়ে খেয়েছি কি আর আমার মাথা
ধরেছে —
নিবারণ । না না , সে হবে না , কিছু খেতে হচ্ছে । বাপু , তুমিও এসো ।
[ প্রস্থান
কমল ও ইন্দুর প্রবেশ
কমল । ছি ছি , ইন্দু , তুই কী কাণ্ডটাই করলি বল্ দেখি ?
ইন্দু । তা বেশ করেছি । ভাই , পরে গোল বাধার চেয়ে আগে গোল চুকে যাওয়া ভালো ।
কমল । এখন পুরুষ জাতটাকে কীরকম লাগছে ।
ইন্দু । মন্দ না ভাই , একরকম চলনসই ।
কমল । তুই যে বলেছিলি ইন্দু , গদাই গয়লাকে তুই কক্খনো বিয়ে করবি নে!
ইন্দু । না ভাই , গদাই নামটি খারাপ নয় , তা তোমরা যাই বলো । তোমার কল্লোলকুমার ,
লাবণ্যকিশোর , কাকলীকণ্ঠ , সুস্মিতমোহনের চেয়ে সহস্র গুণে ভালো । গদাই নামটি খুব
আদরের নাম , অথচ পুরুষমানুষকে বেশ মানায় । রাগ করিস নে দিদি , তোর বিনোদের চেয়ে ঢের
ভালো —
কমল । কী হিসেবে ভালো শুনি ।
ইন্দু । বিনোদবিহারী নামটা বাণভট্টের কাদম্বরীতেই চলে , আঠারো-গজি সমাসের মধ্যে ।
গদাই বেশ সাদা সিধে , ওর মধ্যে বোপদেবের হস্তক্ষেপ করবার জো নেই । আমি তোমাকে
নিশ্চয় বলছি , মা দুর্গা কার্তিকের চেয়ে গণেশকেই বেশি ভালোবাসেন । গদাই নামটি আমার
গদাইগণেশ , তোমার বিনোদকার্তিকের চেয়ে ভালো।
কমল । কিন্তু যখন বই ছাপাবে , বইয়ে ও নাম তো মানাবে না ।
ইন্দু । আমি তো ছাপতে দেব না , খাতাখানি আগে আটক করে রাখব । আমার ততটুকু বুদ্ধি আছে
দিদি!
কমল । তা , যে নমুনা দেখিয়েছিলি! তোর সেটুকু বুদ্ধি আছে জানি , কিন্তু শুনেছি বিয়ে
করলে স্বামীর লেখা সম্বন্ধে মত বদলাতে হয় ।
ইন্দু । আমার তো তার দরকার হবে না । আমার কবি কেবল আমারই কবি , পৃথিবীতে তাঁর কেবল
একটিমাত্র পাঠক ।
কমল । ছাপবার খরচ বেঁচে যাবে —
ইন্দু । সবাই তাঁর কবিত্বের প্রশংসা করলে আমার প্রশংসার মূল্য থাকবে না ।
কমল । সবাই প্রশংসা করবে , ঐ আশঙ্কাটা তাকে করতে হবে না । যা হোক , তোর গয়লাটিকে
তোর পছন্দ হয়েছে , তা নিয়ে তোর সঙ্গে ঝগড়া করতে চাই নে। তাকে নিয়ে তুই চিরকাল সুখে
থাক্ বোন! তোর গোয়াল দিনে দিনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক।
ইন্দু । ঐ বিনোদবাবু আসছেন । মুখটা ভারি বিমর্ষ দেখছি ।
[ ইন্দুর প্রস্থান
বিনোদের প্রবেশ
কমল । তাঁকে এনেছেন ?
বিনোদ । তিনি তাঁর বাপের বাড়ি গেছেন , তাঁকে আনবার তেমন সুবিধে হচ্ছে না ।
কমল । আমার বোধ হচ্ছে , তিনি যে আমার সঙ্গিনীভাবে এখানে থাকেন সেটা আপনার আন্তরিক
ইচ্ছে নয় ।
বিনোদ । আপনাকে আমি বলতে পারি নে , তিনি এখানে আপনার কাছে থাকলে আমি কত সুখী হই ।
আপনার দৃষ্টান্তে তাঁর কত শিক্ষা হয় ।
কমল । আমার দৃষ্টান্ত হয়তো তাঁর পক্ষ সম্পূর্ণ অনাবশ্যক । শুনেছি আপনি তাঁকে
অল্পদিন হল বিবাহ করেছেন, হয়তো তাঁকে ভালো করে জানেন না ।
বিনোদ । তা বটে । কিন্তু যদিও তিনি আমার স্ত্রী তবু এ কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে
, আপনার সঙ্গে তাঁর তুলনা হতে পারে না ।
কমল । ও কথা বলবেন না । আপনি হয়তো জানেন না , আমি তাঁকে বাল্যকাল হতে চিনি । তাঁর
চেয়ে আমি যে কোনো অংশে শ্রেষ্ঠ এমন বোধ হয় না ।
বিনোদ । আপনি তাঁকে চেনেন ?
কমল । খুব ভালোরকম চিনি ।
বিনোদ । আমার সম্বন্ধ তিনি আপনার কাছে কোনো কথা বলেছেন ?
কমল । কিছু না । কেবল বলেছেন , তিনি আপনার ভালোবাসার যোগ্য নন । আপনাকে সুখী করতে
না পেরে এবং আপনার ভালোবাসা না পেয়ে তাঁর সমস্ত জীবনটা ব্যর্থ হয়ে আছে ।
বিনোদ । এ তাঁর ভারি ভ্রম । তবে আপনার কাছে স্পষ্ট স্বীকার করি , আমিই তাঁর
ভালোবাসার যোগ্য নাই । আমি তাঁর প্রতি বড়ো অন্যায় করেছি , কিন্তু সে তাঁকে ভালোবাসি
নে ব'লে নয় ।
কমল । তবে আর-একটি সংবাদ আপনাকে দিই । আপনার স্ত্রীকে আমি এখানে আনিয়ে রেখেছি ।
বিনোদ । ( আগ্রহে) কোথায় আছেন তিনি , আমার সঙ্গে একবার দেখা করিয়ে দিন ।
কমল । তিনি ভয় করছেন পাছে আপনি তাঁকে ক্ষমা না করেন — যদি অভয় দেন —
বিনোদ । বলেন কী , আমি তাঁকে ক্ষমা করব! তিনি যদি আমাকে ক্ষমা করতে পারেন —
কমল । তিনি কোনোকালেই আপনাকে অপরাধী করেন নি , সেজন্যে আপনি ভাববেন না —
বিনোদ । তবে এত মিনতি করছি , তিনি আমাকে দেখা দিচ্ছেন না কেন ?
কমল । আপনি সত্যিই যে তাঁর দেখা চান , এ জানতে পারলে তিনি এক মুহূর্ত গোপনে থাকতেন
না । তবে নিতান্ত যদি সেই পোড়ার মুখ দেখতে চান তো দেখুন ।
মুখ উদ্ঘাটন
বিনোদ । আপনি! তুমি! কমল! আমাকে মাপ করলে!
ইন্দুর প্রবেশ
ইন্দু । মাপ করিস নে দিদি! আগে উপযুক্ত শাস্তি হোক , তার পরে মাপ ।
বিনোদ । তা হলে অপরাধীকে আর-একবার বাসরঘরে আপনার হাতে সমর্পণ করতে হয় ।
ইন্দু । দেখেছিস ভাই , কত বড়ো নির্লজ্জ! এরই মধ্যে মুখে কথা ফুটেছে । ওঁদের একটু
আদর দিয়েছিস কি , আর ওঁদের সামলে রাখবার জো নেই । মেয়েমানুষের হাতে পড়েই ওঁদের
উপযুক্ত শাসন হয় না । যদি নিজের জাতের সঙ্গে ঘরকন্না করতে হত তা হলে দেখতুম ওঁদের
এত আদর থাকত কোথায়!
বিনোদ । তা হলে ভূ-ভার-হরণের জন্যে মাঝে মাঝে অবতারের আবশ্যক হত না ; পরস্পরকে
কেটেকুটে সংসারটা অনেকটা সংক্ষেপ করে আনতে পারতুম ।
ইন্দু ।
গান
এবার মিলন-হাওয়ায় হাওয়ায় হেলতে হবে ।
ধরা দেবার খেলা এবার খেলতে হবে ।
ওগো পথিক , পথের টানে
চলেছিলে মরণ-পানে —
আঙিনাতে আসন এবার মেলতে হবে ।
মাধবিকার কুঁড়িগুলি আনো তুলে ,
মালতিকার মালা গাঁথো নবীন ফুলে ।
স্বপ্নস্রোতে ভিড়বি পারে ,
বাঁধবি দুজন দুই জনারে —
সেই মায়াজাল হৃদয় ঘিরে ফেলতে হবে ।
ইন্দু । এখন কবিসম্রাট , এর একটা জবাব দিতে হবে তোমাকে ।
বিনোদ । এখনি ? হাতে হাতে ?
ইন্দু । হাঁ , এখুনি ।
বিনোদ । আচ্ছা , দুটো মিনিট সময় দাও ।
[ নোটবই লইয়া লিখিতে প্রবৃত্ত
কমল । এ আবার তুই কী খেলা বের করলি ইন্দু!
ইন্দু । কমলদিদি , তুমি যে-খেলা খেলে নিলে এ তার চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ । উনি
বাঁধছেন কাব্য , তুমি বেঁধেছ কবিকে ।
কমল । ওগো শিকারী , তুমি আর কথা কোয়ো না । তোমার নিজের কবিটির কাহিনী ভুলে গেছ বুঝি
? একবার তাকে হল অস্বীকার , আবার হল স্বীকার — মানুষটাকে কি কম নাকাল করা হয়েছে!
ইন্দু । আমার অকবিটিকে আমি কবি বানিয়েছি , এর বেশি কিছু না — কিন্তু তোমার মানুষটি
আদিতে ছিলেন কবি , মধ্যে হলেন অকবি , আবার অন্তে উলটো রথে ফিরছেন কবিত্বে , এ কী কম
কথা! আমাদের কমল অধিকারীর এই পালাটির নাম দিয়েছি কবি-জগন্নাথের রথযাত্রা । মন্দির
থেকে বেরোনো , আবার মন্দিরে ফিরিয়ে আনা । দুদিন বাদেই দেখবি , থিয়েটার-ওয়ালারা
ঝুলোঝুলি করবে এটা অভিনয় করবার জন্যে । — লেখা হল কবিবর ?
বিনোদ । হয়েছে ।
[ ইন্দু ও কমলে মিলিয়া নোটবই লইয়া মনে মনে পাঠ
ইন্দু । পাকা আম নিঙড়ালে রসের সঙ্গে আঁটি বেরিয়ে আসে , এও যে তাই ।
বিনোদ । অর্থাৎ ?
ইন্দু । অর্থাৎ
, এ তো শুধু কাব্যরস নয় , এ যে রসতত্ত্ব । দিদি , তোমার এ কবিটি যে-সে কবি নয় —
কাব্যকুঞ্জবনে এই মানুষটি নারিকেলজাতীয় । তোমার ভাগ্যে শাঁসও জুটবে , রসও জুটবে!
কমল । আর তোর ভাগ্যে ইন্দু ?
ইন্দু । শুধু ছোবড়া ।
বিনোদ । ছি ছি ভাই , আমার মধ্যে এমন রসের সংকীর্ণতা দেখলে কোথায় ?
ইন্দু । কবিবর , সংকীর্ণতার দর বেশি , ঔদার্যেই সস্তা করে । হীরের টুকরো সংকীর্ণ ,
পাথরের চাঁই মস্ত । আমরা চাই , তুমি একলা আমার দিদির কণ্ঠহারে একটিমাত্র মধ্যমণি হয়ে
থাকো — সরকারি হোটেলের রান্নাঘরে মস্ত শিলনোড়ার কাজে বিশ্বজনীন হয়ে না ওঠো ।
বিনোদ । তাই সই , কিন্তু ঐ যে গানটা তৈরি করলেম ওটাকে সুরের হারে গেঁথে একলা তোমার
কণ্ঠে কি স্থান দেবে না ?
ইন্দু । আচ্ছা , আজ তোমার গুড কন্ডাক্টের প্রাইজ স্বরূপে এই অনুগ্রহ করতে রাজি আছি
।কোন্ সুর তোমার পছন্দ বলো।
বিনোদ । তোমার পছন্দেই আমার পছন্দ ।
ইন্দু । আচ্ছা , সখা , তবে শ্রবণ করো ।
গান
লুকালে বলেই খুঁজে বাহির-করা ।
ধরা যদি দিতে তবে যেত না ধরা।
পাওয়া ধন আনমনে
হারাই যে অযতনে ,
হারাধন পেলে সে যে হৃদয়-ভরা ।
আপনি যে কাছে এল দূরে সে আছে ,
কাছে যে টানিয়া আনে সে আসে কাছে ।
দূরে বারি যায় চ'লে ,
লুকায় মেঘের কোলে ,
তাই সে ধরায় ফেরে পিপাসাহরা ।
কমল । ঐ ক্ষান্তদিদি আসছেন । ( বিনোদের প্রতি) তোমার সাক্ষাতে উনি বেরোবেন না । [
বিনোদের প্রস্থান
ক্ষান্তমণির প্রবেশ
ক্ষান্তমণি । তা বেশ হয়েছে ভাই , বেশ হয়েছে । এই বুঝি তোর নতুন বাড়ি । এ যে রাজার
ঐশ্বর্য! তা বেশ হয়েছে । এখন তোর স্বামী ধরা দিলেই আর কোনো খেদ থাকে না ।
ইন্দু । সে বুঝি আর বাকি আছে ? স্বামী রত্নটিকে আগে-ভাগে ভাঁড়ারে পুরেছেন ।
ক্ষান্তমণি । আহা , তা বেশ হয়েছে , বেশ হয়েছে । কমলের মতো এমন লক্ষ্মী মেয়ে কি কখনো
অসুখী হতে পারে ?
ইন্দু । ক্ষান্তদিদি , তুমি যে ভর-সন্ধের সময় ঘরকন্না ফেলে এখানে ছুটে এসেছ ?
ক্ষান্তমণি । আর ভাই , ঘরকন্না! আমি দুদিন বাপের বাড়ি গিয়েছিলুম , এই ওঁর আর সহ্য
হল না । রাগ ক'রে ঘর ছেড়ে , শুনলুম , তোদের এই বাড়িতে এসে রয়েছেন । তা , ভাই , বিয়ে
করেছি বলেই কি বাপ মা একেবারে পর হয়ে গেছে ? দুদিন সেখানে থাকতে পাব না ? যা হোক ,
খবরটা পেয়ে চলে আসতে হল ।
ইন্দু । আবার তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বুঝি ?
ক্ষান্তমণি । তা , ভাই , একলা তো আর ঘরকন্না হয় না । ওদের যে চাই , ওদের যে নইলে নয়
। নইলে আমার কি সাধ ওদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখি ?
ইন্দু । ঐ যে ওঁরা আসছেন । এসো এই পাশের ঘরে ।
[ প্রস্থান
শিবচরণ গদাই নিবারণ ও চন্দ্রকান্তের প্রবেশ
চন্দ্রকান্ত । সমস্ত ঠিক হয়ে গেছে ।
শিবচরণ । কী হলো বলো দেখি ।
চন্দ্রকান্ত । ললিতের সঙ্গে কাদম্বিনীর বিবাহ স্থির হয়ে গেল ।
শিবচরণ । সে কী! সে যে বিবাহ করবে না শুনলুম ?
চন্দ্রকান্ত । সহধর্মিণীকে না । বিয়ে করছে টাকা-কল্পলতিকাকে ; সে ওকে সাতপাকে ঘিরে
বিলেত যাবার পাথেয়-পুষ্পবৃষ্টি করবে । যা হোক , এখন আর-একবার আমাদের গদাইবাবুর মত
নেওয়া উচিত — ইতিমধ্যে যদি আবার বদল হয়ে থাকে ।
শিবচরণ । ( ব্যস্তভাবে) না না , আর মত বদলাতে সময় দেওয়া হবে না । তার পূর্বেই আমরা
পাঁচজনে প'ড়ে চেপেচুপে ধ'রে কোনো গতিকে ওর বিয়েটা দিয়ে দিতে হচ্ছে । চলো গদাই ,
অনেক আয়োজন করবার আছে ।
(নিবারণের প্রতি) তবে চললেম ভাই!
নিবারণ । এসো । —
[ গদাই ও শিবচরণের প্রস্থান
চন্দ্রবাবু , আপনার তো খাওয়া হল না , কেবল ঘুরে ঘুরেই অস্থির হলেন — একটু বসুন ,
আপনার জন্যে জলখাবারের আয়োজন করে আসি গে ।
[ প্রস্থান
ক্ষান্তমণির প্রবেশ
ক্ষান্তমণি । এখন বাড়ি যেতে হবে না কী ?
চন্দ্রকান্ত । ( দেয়ালের দিকে মুখ করিয়া) নাঃ , আমি এখানে বেশ আছি ।
ক্ষান্তমণি । তা তো দেখতে পাচ্ছি । তা চিরকাল এইখানেই কাটাবে নাকি ?
চন্দ্রকান্ত । বিনুর সঙ্গে আমার তো সেইরকমই কথা হয়েছে ।
ক্ষান্তমণি । বিনু তোমার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কিনা! বিনুর সঙ্গে কথা হয়েছে! এখন
ঢের হয়েছে , চলো ।
চন্দ্রকান্ত । ( জিব কাটিয়া , মাথা নাড়িয়া) সে কি হয় । বন্ধুমানুষকে কথা দিয়েছি ,
এখন কি সে ভাঙতে পারি ।
ক্ষান্তমণি । আমার ঘাট হয়েছে , আমাকে মাপ করো তুমি । আমি আর কখনো বাপের বাড়ি গিয়ে
থাকব না । তা তোমার তো অযত্ন হয় নি — আমি তো সেখান থেকে সমস্ত রেঁধে তোমাকে পাঠিয়ে
দিয়েছি ।
চন্দ্রকান্ত । বড়োবউ , আমি কি তোমার রান্নার জন্যে তোমাকে বিয়ে করেছিলুম ? যে-বৎসর
তোমার সঙ্গে অভাগার শুভবিবাহ হয় সে-বৎসর কলকাতা শহরে কি রাঁধুনি বামুনের মড়ক হয়েছিল
?
ক্ষান্তমণি । আমি বলছি , আমার একশোবার ঘাট হয়েছে , আমাকে মাপ করো , আমি আর কখনো এমন
কাজ করবো না । এখন তুমি ঘরে চলো ।
চন্দ্রকান্ত । তবে একটু বোসো । নিবারণবাবু আমার জলখাবারের ব্যবস্থা করতে গেছেন —
উপস্থিত ত্যাগ করে যাওয়াটা শাস্ত্রবিরুদ্ধ ।
ক্ষান্তমণি । আমি সেখানে সব ঠিক রেখেছি , তুমি এখনি চলো ।
চন্দ্রকান্ত । বলো কী , নিবারণবাবু —
বন্ধুগণ । ( নেপথ্য হইয়ে) চন্দরদা!
ক্ষান্তমণি । ঐ রে , আবার ওরা আসছে! ওদের হাতে পড়লে আর তোমার রক্ষে নেই ।
চন্দ্রকান্ত । ওদের হাতে তুমি আমি দু জনে পড়ার চেয়ে একজন পড়া ভালো । শাস্ত্রে লিখছে
: সর্বনাশে সমুৎপন্নে
অর্ধং ত্যজতি পণ্ডিতঃ
, অতএব এ স্থলে অর্ধাঙ্গের সরাই ভালো ।
ক্ষান্তমণি । তোমার ঐ বন্ধুগুলোর জ্বালায় আমি কি মাথামোড় খুঁড়ে মরব ।
[ প্রস্থান
বিনোদ গদাই ও নলিনাক্ষের প্রবেশ
চন্দ্রকান্ত । কেমন মনে হচ্ছে বিনু ?
বিনোদ । সে আর কী বলব , দাদা!
চন্দ্রকান্ত । গদাই , তোর স্নায়ুরোগের বর্তমান লক্ষণটা কী বল্ দেখি ।
গদাই । অত্যন্ত সাংঘাতিক । ইচ্ছে করছে , দিগ্বিদিকে নেচে বেড়াই ।
চন্দ্রকান্ত । ভাই , নাচতে হয় তো দিকে নেচো , আর বিদিকে নেচো না । পূর্বে তোমার
যেরকম দিগ্ভ্রম হয়েছিল, কোথায় মির্জাপুর — কোথায় বাগবাজার!
গদাই । এখন ঠিক পথেই চলেছি , যাচ্ছি বাসরঘরের দিকে ; এই যে সামনেই ।
[ প্রস্থান
চন্দ্রকান্ত । সদ্দৃষ্টান্ত দেখে আমারও ঠিক পথে যাবার ইচ্ছে প্রবল হল । এখানেও
আহার তৈরি , ঘরেও আহার প্রস্তুত — কিন্তু ঘরের দিকে ডবল টান পড়েছে ।
বিনোদ । ওহে চন্দরদা , চুপ চুপ!
চন্দ্রকান্ত । কেন হে ?
বিনোদ । ঐ-যে সুর বেজে উঠল বাসরঘর থেকে ।
চন্দ্রকান্ত । তাই তো , বিপদ কাছে আসছে । ছিল গলির ও পারে , এখন এল পাশের ঘরে —
ক্রমে আরো কাছে আসবে ।
বিনোদ । চন্দরদা , বেরসিকের মতো কথা বোলো না , বিপদ আরো বেশি ছিল যখন সেটা গলির ও
পারে ছিল — যতই কাছে আসছে ততই হৃদয় ভেঙে যাবার আশঙ্কা কমছে ।
নেপথ্যে গান
মুখ-পানে চেয়ে দেখি , ভয় হয় মনে ,
ফিরেছ কি ফের নাই বুঝিব কেমনে?
আসন দিয়েছি পাতি, মালিকা রেখেছি গাঁথি ,
বিফল হল কি তাহা ভাবি খনে খনে ।
গোধূলিলগনে পাখি ফিরে আসে নীড়ে ,
ধানে-ভরা তরীখানি ঘাটে এসে ভিড়ে ।
আজো কি খোঁজার শেষে
ফেরো নি আপন দেশে ,
বিরামবিহীন তৃষা জ্বলে কি নয়নে ?
চন্দ্রকান্ত । ওরে বিনু , এখনো মামলা চোকে নি , প্রিভিকৌন্সিলে নালিশ চলছে । তোর
তরফের কৌঁসুলির কোনো জবাব তৈরি আছে ? ‘ প্লীড্ গিল্টি ' নাকি ।
বিনোদ । একরকম তাই । কিন্তু দাদা , আমাদের মোটা কণ্ঠে কথা জোটে তো সুর জোটে না ।
চন্দ্র । তা হোক , হার মানতে পারব না । আচ্ছা , দে দেখি কথাটা ; কোনোমতে সবাই মিলে
চেঁচামেচি করে চালিয়ে দিতে পারব ।
বিনোদ । এই যে , আমার বইয়ে ছাপানো আছে ।
চন্দ্রকান্ত । ধন্য কবি , ধন্য — নিদেন কালের উপযুক্ত সকল রকম বটিকা আগে থাকতেই তৈরি
করে রেখেছ! কাফি সুরে ঠিক লাগবে —
গান
জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না ,
হায় ভীরু প্রেম , হায় রে!
আশার আলোয় তবুও ভরসা পায় না ,
মুখে হাসি তবু চোখে জল না শুকায় রে!
বিরহের দাহ আজি হল যদি সারা
ঝরিল মিলনরসের শ্রাবণধারা ,
তবুও এমন গোপন বেদনতাপে
অকারণ দুখে পরান কেন দুখায় রে ?
যদি-বা ভেঙেছে ক্ষণিক মোহের ভুল
এখনো প্রাণে কি যাবে না মানের মূল ?
যাহা খুঁজিবার সাঙ্গ হল তো খোঁজা ,
যাহা বুঝিবার শেষ হয়ে গেল বোঝা ,
তবু কেন হেন সংশয়ঘনছায়ে
মনের কথাটি নীরব মনে লুকায় রে ?