শাপমোচন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

     শাপমোচন ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের [১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ] ১৫ই পৌষ তারিখে 'রবীন্দ্রজয়ন্তী-ছাত্রছাত্রী-উৎসবপরিষৎ' কর্তৃক প্রকাশিত হয়। ১৫ ও ১৬ পৌষ রাতে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এই গীতি আলেখ্যটি নৃত্য সহযোগে প্রথম পরিবেশিত হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন  সময়ে এর গান এর সাথে যুক্ত হয়েছে বা বাদ পড়েছে। বর্তমানে বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী দ্বাদশ খণ্ডে (আষাঢ় ১৩৯৩) যেভাবে মুদ্রিত আছে, সেই পাঠ অনুসারে নিচের পাঠটি দেওয়া হলো।

 

 ভূমিকা

যে বৌদ্ধ আখ্যান অবলম্বন করে রাজা নাটক রচিত তারই আভাসে শাপমোচন কথিকাটি রচনা করা হল। এর গানগুলি পূর্বরচিত নানা গীতিনাটিকা হতে সংকলিত।

                                                                                                                                                            রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।


 ভূমিকার গান। ভাবটা এই, মনের নানা গভীর আকাঙ্ক্ষা কাহিনীতে রূপকে গানে রূপ নেয় ছন্দে বন্ধে, সঙ্গ রচনা করে কল্পনায়, বস্তুজগৎ থেকে ক্ষণকালের ছুটি নিয়ে কল্পজগতে করে লীলা।

                                 
এ শুধু অলস মায়া
এ শুধু মেঘের খেলা,

    এ শুধু মনের সাধ বাতাসেতে বিসর্জন।

    এ শুধু আপনমনে মালা গেঁথে ছিড়ে ফেলা,

    নিমেষের হাসিকান্না গান গেয়ে সমাপন।

    শ্যামল পল্লবপাতে রবিকরে সারা বেলা

    আপনারই ছায়া লয়ে খেলা করে ফুলগুলি,

    এও সেই ছায়া-খেলা বসন্তের সমীরণে।

    কুহদের দেশে যেন সাধ ক’রে পথ ভুলি

    হেথা হোথা ঘুরি ফিরি সারা দিন আনমনে।

    কারে যেন দেব’ ব’লে কোথা যেন ফুল তুলি,

    সন্ধ্যায় বনের ফুল উড়ে যায় বনে বনে।

    এ খেলা খেলিবে, হায়, খেলার সাথি কে আছে।

    ভুলে ভুলে গান গাই— কে শোনে, কে নাই শোনে—

    যদি কিছু মনে পড়ে, যদি কেহ আসে কাছে

 

গন্ধর্ব সৌরসেন সুরসভায় গীতনায়কদের অগ্রণী। সেদিন তার প্রেয়সী মধুশ্রী গেছে সুমেরুশিখরে সূর্যপ্রদক্ষিণে। সৌরসেনের বিরহীচিত্ত ছিল উৎকণ্ঠিত। অনবধানে তার মৃদঙ্গের তাল গেল কেটে, নৃত্যে উর্বশীর শমে পড়লো বাধা, ইন্দ্রাণীর কপোল উঠল রাঙা হয়ে।

                       

          পাছে    সুর ভুলি এই ভয় হয়,

          পাছে    ছিন্ন তারের জয় হয়॥

পাছে উৎসবক্ষণ তন্দ্রালসে হয় নিমগন,

                 পুণ্য লগন

           হেলায় খেলায় ক্ষয় হয়-

পাছে    বিনা গানেই মিলনবেলা ক্ষয় হয়।

       যখন তাণ্ডবে মোর ডাক পড়ে,

পাছে    তার তালে মোর তাল না মেলে

              সেই ঝড়ে।

যখন    মরণ এসে ডাকবে শেষে বরণগানে

              পাছে প্রাণে

        মোর বাণী সব লয় হয়,

পাছে    বিনা গানেই বিদায়বেলা লয় হয়॥

 

স্খলিতচ্ছন্দ সুরসভার অভিশাপে গন্ধর্বের দেহশ্রী হল বিকৃত, অরুণেশ্বর নামে তার জন্ম হল গান্ধাররাজগৃহে।

মধুশ্রী ইন্দ্রাণীর পাদপীঠে মাথা রেখে পড়ে রইল, বললে, "ঘটিয়ো না বিচ্ছেদ দেবী, গতি হোক আমাদের একই লোকে, একই দুঃখভোগে, একই অবমাননায়।"

শচী সকরুণ দৃষ্টিতে ইন্দ্রের পানে তাকালেন। ইন্দ্র বললেন, "তথাস্তু, যাও মর্তে, সেখানে দুঃখ পাবে, দুঃখ দেবে। সেই দুঃখে ছন্দঃপাতন অপরাধের ক্ষয়।"
 

ভরা থাক্ স্মৃতিসুধায়

              বিদায়ের পাত্রখানি,

মিলনের উৎসবে তায়

              ফিরায়ে দিয়ো আনি।

বিষাদের অশ্রুজলে

নীরবের মর্মতলে

গোপনে উঠুক ফ'লে 

              হৃদয়ের নূতন বাণী॥

যে পথে যেতে হবে 

             সে পথে তুমি একা,

নয়নে আঁধার রবে,

             ধেয়ানে আলোকরেখা।

সারাদিন সঙ্গোপনে

সুধারস ঢালবে মনে

পরানের পদ্মবনে 

              বিরহের বীণাপাণি॥

----------

 

মধুশ্রী জন্ম নিল মদ্ররাজকুলে, নাম নিল কমলিকা। স্বর্গলোক থেকে যে আত্মবিস্মৃত বিরহবেদনা সঙ্গে এনেছে অরুণেশ্বর, যৌবনে তার তাপ উঠল প্রবল হয়ে।

 

জাগরণে যায় বিভাবরী,

আঁখি হতে ঘুম নিল হরি।

        যার লাগি ফিরি একা একা,

        আঁখি পিপাসিত, নাহি দেখা,

        তারি বাঁশি ওগো তারি বাঁশি

               তারি বাঁশি বাজে হিয়া ভরি।

বাণী নাহি তবু কানে কানে 

কী যে শুনি তাহা কেবা জানে।

         এই হিয়া-ভরা বেদনাতে 

         বারি-ছলছল আঁখিপাতে

         ছায়া দোলে তারি ছায়া দোলে

                 ছায়া দোলে দিবানিশি ধরি

 

তাপার্ত মন খুঁজে বেড়ায় অনাবৃষ্টিতে তৃষ্ণার জল, বীণা কোলে নিয়ে গান করে-
 

   

      এসো এসো হে তৃষ্ণার জল, 

ভেদ করো কঠিনের বক্ষস্থল,  কলকল্ ছলছল্।

এসো এসো উৎসস্রোতে  গূঢ় অন্ধকার হতে,

          এসো হে নির্মল, কলকল্ ছলছল্

 

                রবিকর রহে তব প্রতীক্ষায়,

তুমি যে খেলার সাথি, সে তোমারে চায়।

তাহারি সোনার তান  তোমাতে জাগায় গান,

          এসো হে উজ্জ্বল, কলকল্ ছলছল্

                 হাঁকিছে অশান্ত বায়-

‘আয়, আয়, আয়।’ সে তোমায় খুঁজে যায়।

তাহার মৃদঙ্গরবে  করতালি দিতে হবে,

          এসো হে চঞ্চল, কলকল্ ছল্‌ছল্

 

          অনাবৃষ্টি কোন্ মায়াবলে

তোমারে করেছে বন্দী পাষাণশৃঙ্খলে।

ভেঙে নীরসের কারা  এসো বন্ধহীন ধারা,

          এসো হে প্রবল, কলকল্ ছলছল্

 

কেমন করে কমলিকার ছবি এসে পড়ল গান্ধারে রাজ-অন্তঃপুরে। মনে হল, যা হারিয়েছিল এই-জন্মের আড়ালে, তাই যেন ফিরে ধরা দিল অপরূপ স্বপ্নরূপে।
 

ও আমার চাঁদের আলো, আজ ফাগুনের সন্ধ্যাকালে

ধরা দিয়েছ যে আমার পাতায় পাতায় ডালে ডালে

যে গান তোমার সুরের ধারায়  বন্যা জাগায় তারায় তারায়

মোর আঙিনায় বাজল সে সুর আমার প্রাণের তালে তালে

 

সব কুঁড়ি মোর ফুটে ওঠে তোমার হাসির ইশারাতে,

স্বপ্নে-ছাওয়া দখিন-হাওয়া আমার ফুলের গন্ধে মাতে

শুভ্র, তুমি করলে বিলোল  আমার প্রাণে রঙের হিলোল;

মর্মরিত মর্ম গো, মর্ম আমার জড়ায় তোমার হাসির জালে

 

ছবিখানি দিনের চিন্তা রাতের স্বপ্নের 'পরে আপন ভূমিকা রচনা করলে।

 

তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা।

ওই যে সুদূর নীহারিকা

            যারা করে আছে ভিড়         

                    আকাশের নীড়,

ওই যারা দিনরাত্রি

আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী   

                গ্রহ তারা রবি,

তুমি কি তাদের মতো সত্য নও—

হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি!

নয়নসমুখে তুমি নাই,

নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।

                 আজি তাই

শ্যামলে শ্যামল তুমি নীলিমায় নীল।

            আমার নিখিল   

তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল।

        নাহি জানি, কেহ নাহি জানে

তব সুর বাজে মোর গানে,

কবির অন্তরে তুমি কবি—

নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি

 

 

রাজা লিখলেন চিঠি চিত্ররূপিণীর উদ্দেশ্যে। লিখলেন-

কখন দিলে পরায়ে ব্যথার  মালা, স্বপন বরণমালা।

    প্রভাতে দেখি জেগে    অরুণ মেঘে

         বিদায়বাঁশরি বাজে অশ্রুগালা

গোপনে এসে গেলে,   দেখি নাই আঁখি মেলে।

    আঁধারে দুঃখডোরে    বাঁধিলে মোরে,

        ভূষণ পরালে বিরহবেদন-ঢালা
 

চিঠি পৌঁছল রাজকন্যার হাতে। অজানার আহ্বানে তার মন হলো উতলা। সখীদের নিয়ে বারবার করে পড়লে সেই চিঠি।

         দে পড়ে দে আমায় তোরা কী কথা আজ লিখেছে সে,

তার    দূরের বাণীর পরশমানিক লাগুক আমার প্রাণে এসে

        শস্যখেতের গন্ধখানি একলা ঘরে দিক সে আনি,

        ক্লান্তগমন পান্থ হাওয়া লাগুক আমার মুক্তকেশে

        নীল আকাশের সুরটি নিয়ে বাজাক আমার বিজন মনে,

        ধূসর পথের উদাস বরন মেলুক আমার বাতায়নে।

        সূর্য-ডোবার রাঙা বেলায় ছড়াব প্রাণ রঙের খেলায়,

        আপন-মনে চোখের কোণে অশ্রু-আভাস উঠবে ভেসে

 

গান্ধারের দূত এল মদ্ররাজধানীতে। বিবাহ-প্রস্তাব শুনে রাজা বললে, "আমার কন্যার দুর্লভ ভাগ্য।"

সখীরা রাজকন্যাকে গিয়ে বললে-

 

    বাজিবে, সখী, বাঁশি বাজিবে।

    হৃদয়রাজ হৃদে রাজিবে।

বচন রাশি রাশি  কোথা যে যাবে ভাসি,

    অধরে লাজহাসি সাজিবে।

নয়নে আঁখিজল  করিবে ছলছল,

    সুখবেদনা মনে বাজিবে।

মরমে মুরছিয়া   মিলাতে চাবে হিয়া
   সেই চরণযুগরাজীবে

 

চৈত্রপূর্ণিমার পূণ্যতিথিতে শুভলগ্ন। সেই বিবাহরাত্রে দূরে একলা বসে রাজার বুকের মধ্যে রক্ত ঢেউ খেলিয়ে উঠল। কেবলই তার মনে হতে লাগল, লোকান্তরে কার সঙ্গে এইরকম জ্যোৎস্নারাত্রে সে যেন এক-দোলায় দুলেছিল। ভুলে-যাওয়ার কুহেলিকার ভিতর থেকে পড়েছে মনে। একটা পদ তার মনে গুঞ্জরিয়া উঠছে 'ভুলো না- ভুলো না- ভুলো না'-

সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে,  ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা।

সেই স্মৃতিটুকু কভু খনে খনে    যেন জাগে মনে, ভুলো না।

     সেদিন বাতাসে ছিল তুমি জান

     আমারি মনের প্রলাপ জড়ানো,

আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসির তুলনা

 

যেতে যেতে পথে পূর্ণিমারাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে,

দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে কী জানি কী মহা লগনে।

       এখন আমার বেলা নাহি আর,  

       বহিব একাকী বিরহের ভার-

বাঁধিনু যে রাখী পরানে তোমার সে রাখী খুলো না, খুলো না
 

যথালগ্নে রাজহস্তী পৃষ্ঠে রত্নাসনে রাজার প্রতিনিধি হয়ে এল অরুণেশ্বরের বক্ষোবিহারিণী বীণা, রাজার অশ্রুত আহ্বান সঙ্গে করে। সখীরা দূরোদ্দিষ্ট বন্ধুর আবাহনগান গাইলে-

তোমার     আনন্দ ওই এল দ্বারে, এল গো

                               ওগো পুরবাসী।

বুকের       আঁচলখানি ধুলায় ফেলে

                         আঙিনাতে মোলো গো।

         পথে        সেচন করো গন্ধবারি,

                  মলিন না হয় চরণ তারি,

তোমার     সুন্দর ওই এল দ্বারে, এল গো-

আকুল      হৃদয়খানি সম্মুখে তার ছড়িয়ে ফেলো ফেলো গো।

 

                সকল ধন যে ধন্য হল হল গো,

বিশ্বজনের কল্যাণে আজ ঘরের দুয়ার খোলো গো

       হেরো       রাঙা হল সকল গগন,

                    চিত্ত হল পুলকমগন,

তোমার     নিত্য-আলো এল দ্বারে, এল গো-

তোমার     পরানপ্রদীপ তুলে ধরো, ওই আলোতে জ্বেলো গো

 

অন্তঃপুরিকারা বীণাখানিকে বরণ করে নিয়ে এল বিবাহের আসরে, বধূকে আহ্বান করে গাইলে-

 

বাজো রে বাঁশরী বাজো।

           সুন্দরী, চন্দনমাল্যে মঙ্গলসন্ধ্যায় সাজো।

বুঝি মধুফাল্গুনমাসে চঞ্চল পান্থ সে আসে,

          মধুকরপদভরকম্পিত চম্পক

              অঙ্গনে ফোটে নি কি আজো।

রক্তিম অংশুক মাথে,    কিংশুককঙ্কণ হাতে,

       মঞ্জীরঝংকৃত পায়ে, সৌরভমন্থর বায়ে,

বন্দনসংগীতগুঞ্জনমুখরিত

             নন্দনকুঞ্জে বিরাজো

 

বীণার সঙ্গে রাজকুমারীর মালা বদল হল। সখীরা এই বীণা সুন্দরকে উৎসর্গ করে গাইলে-

 

    লহো লহো তুলে লহো নীরব বীণাখানি,

নন্দননিকুঞ্জ হতে সুর দেহো তায় আনি

        ওহে সুন্দর হে সুন্দর।

আঁধার বিছায়ে আছি রাতের আকাশে

          তোমারি আশ্বাসে,

তারায় তারায় জাগাও তোমার আলোক-ভরা বাণী

        ওহে সুন্দর হে সুন্দর।

 

পাষাণ আমার কঠিন দুখে তোমায় কেঁদে বলে-

পরশ দিয়ে সরস করো, ভাসাও অশ্রুজলে

        ওহে সুন্দর হে সুন্দর।

শুষ্ক যে এই নগ্ন মরু নিত্য মরে লাজে

        আমার চিত্তমাঝে,

শ্যামল রসের আঁচল তাহার বক্ষে দেহো টানি

 

বধূ পতিগৃহে যাবার সময় সখীরা সুন্দরকে প্রণাম করে বললে-

 

রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার যাবার আগে—

        আপন রাগে, গোপন রাগে,

        তরুণ হাসির অরুণ রাগে,

        অশ্রুজলের করুণ রাগে

রঙ যেন মোর মর্মে লাগে- আমার সকল কর্মে লাগে-

        সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে-

        গভীর রাতের জাগায় লাগে

যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে,

রক্তে তোমার চরণদোলা লাগিয়ে দিয়ে।

আঁধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে.

পাষাণগুহার কক্ষে নিঝর-ধারা জাগে,

মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে,

বিশ্ব-নাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে-

তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে,

কাঁদন বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে

 

 

রাজ বধূ এল পতিগৃহে।

দীপ জ্বলে না, ঘর থাকে অন্ধকার, সেই ঘরে প্রতি রাত্রে স্বামীর কাছে বধূ সমাগম।

কমলিকা বলে, "প্রভু, তোমাকে দেখবার জন্যে আমার দিন, আমার রাত্রি উৎসুক। আমাকে দেখা দাও।"

       এসো আমার ঘরে,

বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে।

    দুঃখসুখের দোলে এসো,
    প্রাণের হিল্লোলে এসো।

স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে

    মুগ্ধ এ চোখে।

এবার ফুলের প্রফুল্লরূপ এসো বুকের 'পরে॥

 

রাজা বলে, "আমার গানেই তুমি আমাকে দেখো। আগে দেখে নাও অন্তরে, বাইরে দেখবার দিন আসবে তার পরে। নইলে ভুল হবে, ছন্দ যাবে ভেঙে।"

 

কোথা    বাইরে দূরে    যায় রে উড়ে    হায় রে হায়,

তোমার    চপল আঁখি    বনের পাখি    বনে পালায়

ওগো,    হৃদয়ে যবে    মোহন রবে    বাজবে বাঁশি

তখন    আপনি সেধে    ফিরবে কেঁদে,    পরবে ফাঁসি-

তখন    ঘুচবে ত্বরা    ঘুরিয়া মরা    হেথা    হোথায়।

 

চেয়ে    দেখিস না রে    হৃদয়দ্বারে    কে আসে যায়-

তোরা    শুনিস কানে    বারতা আনে    দখিন বায়।

আজি    ফুলের বাসে    সুখের হাসে    আকুল গানে

চির    বসন্ত যে    তোমারি খোঁজে    এসেছে প্রাণে,

তারে    বাহিরে খুঁজি    ফিরিছ বুঝি    পাগলপ্রায়-

আহা    আজি সে আঁখি    বনের পাখি    বনে পালায়

 

অন্ধকারে বীণা বাজে। অন্ধকারে গান্ধর্বীকলার নৃত্যে বধূকে বর প্রদক্ষিণ করে। সেই নৃত্যকলা নির্বাসনের সঙ্গিনী হয়ে এসেছে তার মর্তদেহে। নৃত্যের বেদনা রানীর বক্ষে আঘাত করে; নিশীথরাত্রে সমুদ্রে জোয়ার এলে তার ঢেউ যেমন লাগে তটভূমিতে, অশ্রুতে দেয় প্লাবিত করে।

 

একদিন রাত্রির তৃতীয় প্রহর, শুকতারা পূর্বগগনে; কমলিকা তার সুগন্ধি এলোচুলে দিলে রাজার দুই পা ঢেকে; বললে, "আদেশ করো আজ উষার প্রথম আলোকে তোমাকে প্রথম দেখব। নইলে আমি বিদায় নিয়ে যাই, রেখে যাই আমার কান্না এই অন্ধকারের বুকে- যতক্ষণ না আমাকে ফিরে ডেকে আন তোমার আলোর সভায়।"

 

  আমি    এলেম তোমার দ্বারে,   

    ডাক দিলেম অন্ধকারে।

আগল ধ'রে দিলেম নাড়া, প্রহর গেল, পাই নি সাড়া,

    দেখতে পেলেম না যে তোমারে।

তবে  যাবার আগে এখান থেকে 

এই  লিখনখানি যাব রেখে।

           দেখা তোমার পাই বা না পাই

           দেখতে এলেম জেনো গো তাই,

                ফিরে যাই সুদূরের পারে 

 

রাজা বললে, "প্রিয়ে, না-দেখার নিবিড় মিলনকে নষ্ট কোরো না, এই মিনতি। এখনো তুমি অন্যমনে আছ, শুভদৃষ্টির সময় তাই এল না।"

     আন্‌মনা গো আন্‌মনা,

তোমার কাছে আমার বাণীর মাল্যখানি আনব না।

বার্তা আমার ব্যর্থ হবেসত্য আমার বুঝবে কবে,

    তোমারো মন জানব না

লগ্ন যদি হয় অনুকূল মৌনমধুর সাঁঝে,

নয়ন তোমার মগ্ন যখন ম্লান আলোর মাঝে,

    দেব' তোমায় শান্ত সুরের সান্ত্বনা

 

ছন্দে গাঁথা বাণী তখন পড়ব তোমার কানে মন্দ মৃদুল তানে,

        ঝিল্লি যেমন শালের বনে নিদ্রানীরব রাতে

        অন্ধকারের জপের মালায় একটানা সুর গাঁথে-

        একলা আমি বিজন প্রাণের প্রাঙ্গণে

              প্রান্তে বসে একমনে

এঁকে যাব আমার গানের আল্‌পনা॥

 

 

মহিষী বললে, "প্রিয়প্রসাদ থেকে আমার দুই চক্ষু চিরদিনই কি থাকবে বঞ্চিত। অন্ধতার চেয়ে এ যে বড়ো অভিশাপ।"

অভিমানে মহিষী মুখ কেরালে।

রাজা বললে, "কাল চৈত্রসংক্রান্তি। নাগকেশরের বনে নিভৃতে সখাদের সঙ্গে আমার নৃত্যের দিন। প্রাসাদশিখর থেকে দেখো চেয়ে।"

মহিষীর দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল। বললে, চিনব কী করে।"

রাজা বললে, "যেমন খুশি কল্পনা করে নিয়ো। সেই কল্পনাই হবে সত্য।"

 

হায় রে,        ওরে যায় না কি জানা।

      নয়ন ওরে খুঁজে বেড়ায়,    পায় না ঠিকানা

অলখ পথেই যাওয়া-আসা,   শুনি চরণধ্বনির ভাষা-

                গন্ধে শুধু হাওয়ায় হাওয়ায় রইল নিশানা

কেমন করে জানাই তারে, বসে আছি পথের ধারে।

প্রাণে এল সন্ধ্যাবেলা     আলোয়ছায়ার রঙিন খেলা,

                ঝরে-পড়া বকুলদলে বিছায় বিছানা
                         -------

              

আমি      দখিন দুয়ার খোলা,

    এসো হে আমার বসন্ত, এসো।

দিব        হৃদয়দোলায় দোলা,

     এসো হে আমার বসন্ত এসো

নব         শ্যামল শোভন রথে

এসো      বকুল-বিছানো পথে,

এসো      বাজায়ে ব্যাকুল বেণু 

মেখে      পিয়ালফুলের রেণু,

      এসো হে আমার বসন্ত, এসো

 

এসো      ঘনপল্লবপুঞ্জে, এসো হে।

সো      বনমল্লিকাকুঞ্জে, এসো হে।

মৃদু         মধুর মদির হেসে 

এসো       পাগল হাওয়ার দেশে-

তোমার     উতলা উত্তরীয়

তুমি        আকাশে উড়ায়ে দিয়ো,

                 এসো হে আমার বসন্ত, এসো

 

চৈত্রসংক্রান্তির রাতে আবার মিলন। মহিষী বললে, "দেখলেম নাচ। যেন মঞ্জরিত শালতরুশ্রেণীতে বসন্তবাতাসের অধৈর্য। যেন চন্দ্রলোকের শুক্লপক্ষে লেগেছে তুফান। কেবল একজন কুশ্রী কেন রসভঙ্গ করলে। ও যেন রাহুর অনুচর। কী গুণে ও পেল প্রবেশের অধিকার।"

 

রাজা স্তব্ধ হয়ে রইল। তার পরে উঠল গেয়ে, অসুন্দরের পরম বেদনায় সুন্দরের আহ্বান। সূর্যরশ্মি কালো মেঘের ললাটে পরায় ইন্দ্রধনু, তার লজ্জাকে সান্ত্বনা দেবার তরে। মর্তের অভিশাপে স্বর্গের করুণা যখন নামে তখনি তো সুন্দরের আবির্ভাব। প্রিয়তমে, সেই করুণাই কি তোমার হৃদয়কে কাল মধুর করে নি।"

"না মহারাজ, না" বলে মহিষী দুই হাতে মুখ ঢাকলে।

রাজার কণ্ঠের সুরে লাগল অশ্রুর ছোঁওয়া। বললে, "যাকে দয়া করলে যেত তোমার হৃদয় ভরে, তাকে ঘৃণা করে কেন পাথর করলে মনকে।"

রসবিকৃতির পীড়া সইতে পারি নে" বলে মহিষী উঠে পড়ল আসন থেকে।

রাজা হাত ধরে বললে, "একদিন সইতে পারবে আপনারই আন্তরিক রসের দাক্ষিণ্যে। কুশ্রীর আত্মত্যাগে সুন্দরের সার্থকতা।"

ভ্রূ কুটিল করে মহিষী বললে, "অসুন্দরের জন্যে তোমার এই অনুকম্পার অর্থ বুঝি নে। ঐ শোনো, উষার প্রথম কোকিলের ডাক। অন্ধকারের মধ্যে তার আলোকের অনুভূতি। আজ সূর্যোদয়মুহূর্তে তোমারও প্রকাশ হোক আমার দিনের মধ্যে, এই আশায় রইলাম।"

রাজা গাইলেন-

বাহিরে ভুল হানবে যখন

      অন্তরে ভুল হানবে কি।

বিষাদ বিষে জ্বলে শেষে

       রসের প্রসাদ মাঙবে কি

রৌদ্রদাহ হলে সারা  নামবে কি ওর বর্ষাধারা,

      লাজের রাঙা মিটলে হৃদয়

           প্রেমের রঙ রাঙবে কি

                যতই যাবে দূরের পানে

বাঁধন ততই কঠিন হয়ে টানবে না কি ব্যথার টানে।

অভিমানের কালো মেঘে  বাদল হাওয়া লাগবে বেগে,

   নয়নজলের আবেগ তখন কোনোই বাধা মানবে কি॥

 

মহিষী স্তব্ধ হয়ে রইল। রাজা বললে, "আচ্ছা, কথা তোমার রাখব, কিন্তু তাতে ইচ্ছা তোমার পূর্ণ হবে না।"

জ্বলে উঠল, আবরণ গেল ঘুচে, দেখা হল। টলে উঠল যুগলের সংসার। "কী অন্যায়, কী নিষ্ঠুর বঞ্চনা" বলতে বলতে কমলিকা ঘর থেকে ছুটে পালিয়ে গেল।

তাকে ডাক দিলে রাজার জগৎ থেকে-

            না, যেয়ো না, যেয়ো নাকো

    মিলনপিয়াসি মোরা, কথা রাখো, কথা রাখো

        আজ বকুল আপনহারা,   হায় রে, 

        ফুল ফোটানো হয় নি সারা, সাজি ভরে নি,

     পথিক ওগো, থাকো থাকো

                     ----

                                

গেল বহুদূরে, বনের মধ্যে মৃগয়ার জন্যে যে নির্জন রাজগৃহ আছে সেইখানে। কুয়াশায় শুকতারার মতো লজ্জায় সে আচ্ছন্ন।

রাত্রি যখন দুইপ্রহর, আধোঘুমে সে শুনতে পায় এক বীণাধ্বনির আর্তরাগিণী। স্বপ্নে বহুদূরের আভাস আসে। মনে হয়, এই সুর চিরদিনের চেনা। চিরবিরহের সঞ্চিত অশ্রু বুকের মধ্যে উছলে ওঠে।

 

সখী, আঁধারে একেলা ঘর  মন মানে না

কিসের পিয়াসে কোথা যে যাবে সে, পথ জানে না।

    ঝরঝর নীরে,    নিবিড় তিমিরে,   সজল সমীরে গো,

যেন কার বাণী কভু প্রাণে আনে কভু আনে না

 

রাতের পর রাত যায়। অন্ধকারে তরুতলে যে মানুষ ছায়ার মতো নাচে তাকে চোখে দেখি নে, তার হৃদয় দেখি- জনশূন্য দেওদার-বনের দোলায়িত শাখায় যেন দক্ষিণ সমুদ্রের হাওয়ার হাহাকার। রানী মনে ভাবে, যখন সে কাছে এল তখন ছিল কৃষ্ণসন্ধ্যা। যখন চাঁদ উঠল তখন তার মালাখানি রইল, সে রইল না।

যখন    এসেছিলে অন্ধকারে

চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপারে।

     হে অজানা, তোমায় তবে   

     জেনেছিলাম অনুভবে,

গানে তোমার পরশখানি বেজেছিল প্রাণের তারে।

 

তুমি    গেলে যখন একলা চলে

চাঁদ উঠেছে রাতের কোলে।

       তখন দেখি পথের কাছে   

       মালা তোমার পড়ে আছে,

বুঝেছিলাম অনুমানে এ কণ্ঠহার দিলে কারে

 

কী হল রাজমহিষীর। কোন্ হুতাশের বিরহ তার বিরহ জাগিয়ে তোলে। কোন্ রাত-জাগা পাখি নিস্তব্ধ নীড়ের পাশ দিয়ে হূহু করে উড়ে যায়, তার পাখার শব্দে ঘুমন্ত পাখির পাখা উৎসুক হয়ে ওঠে যে।

বীণায় বাজতে থাকে কেদারা বেহাগ, বাজে কালাংড়া। আকাশে আকাশে তারাগুলি যেন তামসী তপস্বিনীর নীরব জপমন্ত্র। বীণাধ্বনি যেন আজ আর বাইরে নেই; এসেছে তার অন্তরের তন্তুতে তন্তুতে।

 

ওই বুঝি বাঁশি বাজে    বনমাঝে কি মনোমাঝে।

          বসন্ত বায় বহিছে কোথায়, কোথায় ফুটেছে ফুল,

বলো গো সজনি, এ সুখরজনী কোন্‌খানে উদিয়াছে-

          বনমাঝে কি মনোমাঝে

 

যাব কি যাব না  মিছে এ ভাবনা, মিছে মরি ভয়ে লাজে।

  কী জানি কোথা সে  বিরহহুতাশে ফিরে অভিসারসাজে-

            বনমাঝে কি মনোমাঝে
 

রাজমহিষী বিছানায় উঠে বসে, স্রস্ত তার বেণী, ত্রস্ত তার বক্ষ। বীণার গুঞ্জরণ আকাশে মেলে দেয় অন্তহীন অভিসারের পথ। রাগিণীবিছানো সেই শূন্যপথে বেরিয়ে পড়ে তার মন।

কার দিকে। দেখার যাকে চিনেছিল, দেখার পরে যাকে ভুলেছিল তারই দিকে।

একদিন নিমফুলের গন্ধ অন্ধকার ঘরে নিয়ে এল অনির্বচনীয়ের আমন্ত্রণ। মহিষী দাঁড়াল বিছানো ছেড়ে বাতায়নের কাছে। নীচে সেই ছায়ামূর্তির নাচ, বিরহের সেই ঊর্মিদোলা।

 

ও কি এল, ও কি এল না,  বোঝা গেল না।

ও কি মায়া কি স্বপনছায়া, ও কি ছলনা

        ধরা কি পড়ে ও রূপেরই ডোরে,

        গানেরই তানে কি বাঁধিবে ওরে,

ও যে চিরবিরহেরই সাধনা

 

ওর  বাঁশিতে করুণ কী সুর লাগে

      বিরহমিলনমিলিত রাগে।

সুখে কি দুখে ও পাওয়া না-পাওয়া,

হৃদয়বনে ও উদাসী হাওয়া,

বুঝি শুধু ও পরমকামনা

 

মহিষীর সমস্ত দেহ কম্পিত। ঝিল্লিঝংকৃত রাত। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ দিগন্তে। অস্পষ্ট আলোয় অরণ্য কথা কয় যেন স্বপ্নে। বোবা বনের ভাষাহীন বাণী লাগল মহিষীর অঙ্গে অঙ্গে। কখন নাচ আরম্ভ হল সে জানে না। এ নাচ কোন্ জন্মান্তরের, কোন্ লোকান্তরের।

বীণায় বাজে পরজের বিহ্বল মীড়। কমলিকা আপন-মনে বলে, "ওগো কাতর, ওগো হতাশ, আর ডেকো না। আর দেরি নেই, দেরি নেই।'

কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ ডুবেছে অমাবস্যার তলায়। আঁধারের ডাক গভীর। রাজমহিষী উঠে দাঁড়িয়ে বলে, "যাব আজ। আর ভয় করি নে আমার দৃষ্টিকে।"

পথের শুকনো পাতা পায়ে পায়ে বাজিয়ে দিয়ে গেল সে অশথতলায়- সেখানে বীণা বাজছে।

 

মোর     বীণা ওঠে কোন্ সুরে বাজি    

            কোন্ নব চঞ্চল ছন্দে।

মম      অন্তর কম্পিত আজি

          নিখিলের হৃদয়স্পন্দে

আসে কোন্ তরুণ অশান্ত,

উড়ে বসনাঞ্চলপ্রান্ত,

আলোকের নৃত্যে বনান্ত        

      মুখরিত অধীর আনন্দে

 

অম্বরপ্রাঙ্গণমাঝে 

       নিঃস্বর মঞ্জীর গুঞ্জে।

অশ্রুত সেই তালে বাজে

       করতালি পল্লবপুঞ্জে।

কার পদপরশন-আশা

তৃণে তৃণে অর্পিল ভাষা,

সমীরণ বন্ধনহারা 

      উন্মন কোন্ বনগন্ধে

 

বীণা থামল। মহিষী থমকে দাঁড়াল।

রাজা বললে, "ভয় কোরো না, প্রিয়ে কোরো না।"

গলার স্বর জলে-ভরা মেঘের দূর দুরুদুরু ধ্বনির মতো।

"কিছু ভয় নেই আমার, জয় হল তোমারই।"

এই বলে মহিষী আঁচলের আড়াল থেকে প্রদীপ বের করলে। ধীরে ধীরে তুলে ধরলে রাজার মুখের কাছে।

কণ্ঠ দিয়ে কথা বেরোতে চায় না। পলক পড়ে না চোখে। বলে উঠল, "প্রভু আমার, প্রিয় আমার, এ কী সুন্দর রূপ তোমার!"

 

বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে।

কোথা হতে এলে তুমি হৃদিমাঝারে।

      ওই মুখ ওই হাসি কেন এত ভালোবাসি,

            কেন গো নীরবে ভাসি অশ্রুধারে।

তোমারে হেরিয়া যেন জাগে স্মরণে,

       তুমি চিরপুরাতন চিরজীবনে।

তুমি না দাঁড়ালে আসি হৃদয়ে বাজে না বাঁশি,

        এই আলো এই হাসি ডুবে আঁধারে