প্রথম দৃশ্য
পথে বালকগণ
গান
বিভাস। একতালা
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে,
বাদল গেছে টুটি —
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই,
আজ আমাদের ছুটি।
কী করি আজ ভেবে না পাই,
পথ হারিয়ে কোন্ বনে যাই,
কোন্ মাঠে যে ছুটে বেড়াই
সকল ছেলে জুটি!
কেয়া-পাতার নৌকো গড়ে
সাজিয়ে দেব-ফুলে,
তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেব —
চলবে দুলে দুলে।
রাখাল-ছেলের সঙ্গে ধেনু
চরাব আজ বাজিয়ে বেণু,
মাখব গায়ে ফুলের রেণু
চাঁপার বনে লুটি।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই,
আজ আমাদের ছুটি।
লক্ষেশ্বর। (ঘর হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া) ছেলেগুলো তো জ্বালালে! ওরে চোবে! ওরে
গিরিধারীলাল! ধর্ তো ছোঁড়াগুলোকে ধর্ তো।
ছেলেরা। (দূরে ছুটিয়া গিয়া হাততালি দিয়া) ওরে লক্ষ্মীপেঁচা বেরিয়েছে রে,
লক্ষ্মীপেঁচা বেরিয়েছে।
লক্ষেশ্বর। হনুমন্ত সিং, ওদের কান পাকড়ে আন্ তো; একটাকেও ছাড়িস নে।
একজন বালক। (চুপি চুপি পশ্চাৎ হইতে আসিয়া কান হইতে কলম টানিয়া লইয়া )—
কাক লেগেছে লক্ষ্মীপেঁচা,
লেজে ঠোকর খেয়ে চেঁচা।
লক্ষেশ্বর। হতভাগা, লক্ষ্মীছাড়া সব, আজ একটাকেও আস্ত রাখব না!
ঠাকুরদাদার প্রবেশ
ঠাকুরদাদা। কী হয়েছে লখাদাদা? মারমূর্তি কেন?
লক্ষেশ্বর। আরে, দেখো-না! সক্কালবেলা কানের কাছে চেঁচাতে আরম্ভ করেছে।
ঠাকুরদাদা। আজ যে শরতে ওদের ছুটি, একটু আমোদ করবে না? গান গাইলেও
তোমার কানে খোঁচা মারে! হায় রে হায়, ভগবান তোমাকে এত শাস্তিও দিচ্ছেন!
লক্ষেশ্বর। গান গাবার বুঝি আর সময় নেই! আমার হিসাব লিখতে ভুল হয়ে যায়
যে। আজ আমার সমস্ত দিনটাই মাটি করলে।
ঠাকুরদাদা। তা ঠিক। হিসেব ভুলিয়ে দেবার ওস্তাদ ওরা। ওদের সাড়া পেলে
আমার বয়সের হিসাবে প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের গরমিল হয়ে যায়।—ওরে বাঁদরগুলো, আয়
তো রে! চল্ তোদের পঞ্চাননতলার মাঠটা ঘুরিয়ে আনি।—যাও দাদা, তোমার দপ্তর নিয়ে বোসো
গে। আর হিসেবে ভুল হবে না।
ঠাকুরদাদাকে ঘিরিয়া ছেলেদের নৃত্য
প্রথম। হাঁ ঠাকুরদাদা, চলো।
দ্বিতীয়। আমাদের আজ গল্প বলতে হবে।
তৃতীয়। না, গল্প না, বটতলায় ব’সে আজ ঠাকুর্দার পাঁচালি হবে।
চতুর্থ। বটতলায় না, ঠাকুর্দা, আজ পারুলডাঙায় চলো।
ঠাকুরদাদা। চুপ, চুপ, চুপ! অমন গোলমাল লাগাস যদি তো লখাদাদা
আবার ছুটে আসবে।
লক্ষেশ্বরের পুনঃপ্রবেশ
লক্ষেশ্বর। কোন্ পোড়ারমুখো আমার কলম নিয়েছে রে!
[ কলম ফেলিয়া দিয়া সকলের প্রস্থান
উপনন্দের প্রবেশ
লক্ষেশ্বর। কী রে, তোর প্রভু কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলে? অনেক পাওনা
বাকি।
উপনন্দ। কাল রাত্রে আমার প্রভুর মৃত্যু হয়েছে।
লক্ষেশ্বর। মৃত্যু! মৃত্যু হলে চলবে কেন? আমার টাকাগুলোর কী
হবে?
উপনন্দ। তাঁর তো কিছুই নেই। যে বীণা বাজিয়ে উপার্জন ক’রে তোমার
ঋণ শোধ করতেন সেই বীণাটি আছে মাত্র।
লক্ষেশ্বর। বীণাটি আছে মাত্র! কী শুভসংবাদটাই দিলে!
উপনন্দ। আমি শুভসংবাদ দিতে আসি নি। আমি একদিন পথের ভিক্ষুক
ছিলেম, তিনিই আমাকে আশ্রয় দিয়ে তাঁর বহু দুঃখের অন্নের ভাগে আমাকে মানুষ করেছেন।
তোমার কাছে দাসত্ব করে আমি সেই মহাত্মার ঋণ শোধ করব।
লক্ষেশ্বর। বটে! তাই বুঝি তাঁর অভাবে আমার বহু দুঃখের অন্নে ভাগ
বসাবার মতলব করেছ। আমি তত বড়ো গর্দভ নই।—আচ্ছা, তুই কী করতে পারিস বল দেখি।
উপনন্দ। আমি চিত্রবিচিত্র করে পুঁথি নকল করতে পারি। তোমার অন্ন
আমি চাই নে। আমি নিজে উপার্জন করে যা পারি খাব—তোমার ঋণও শোধ করব।
লক্ষেশ্বর। আমাদের বীনকারটিও যেমন নির্বোধ ছিল ছেলেটাকেও দেখছি
ঠিক তেমনি করেই বানিয়ে গেছে। হতভাগা ছোঁড়াটা পরের দায় ঘাড়ে নিয়েই মরবে। এক-এক জনের
ঐরকম মরাই স্বভাব!—আচ্ছা বেশ, মাসের ঠিক তিন তারিখের মধ্যেই নিয়মমত টাকা দিতে হবে।
নইলে—
উপনন্দ। নইলে আবার কী! আমাকে ভয় দেখাচ্ছ মিছে। আমার কী আছে যে তুমি
আমার কিছু করবে? আমি আমার প্রভুকে স্মরণ করে ইচ্ছা করেই তোমার কাছে বন্ধন স্বীকার
করেছি। আমাকে ভয় দেখিয়ো না বলছি।
লক্ষেশ্বর। না না, ভয় দেখাব না। তুমি লক্ষ্মীছেলে, সোনার চাঁদ ছেলে!
টাকাটা ঠিকমত দিয়ো বাবা! নইলে আমার ঘরে দেবতা আছে, তার ভোগ কমিয়ে দিতে হবে—সেটাতে
তোমারই পাপ হবে।
[উপনন্দের প্রস্থান
ঐ যে! আমার ছেলেটা এইখানে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি কোন্খানে
টাকা পুঁতে রাখি ও নিশ্চয়ই সেই খোঁজে ফেরে। ওদেরই ভয়েই তো আমাকে এক সুরঙ্গ হতে
আর-এক সুরঙ্গে টাকা বদল করে বেড়াতে হয়।–ধনপতি, এখানে কেন রে? তোর মতলবটা কী বল্
দেখি!
ধনপতি। ছেলেরা আজ সকলেই বেতসিনীর ধারে আমোদ করতে গেছে—আমাকে
ছুটি দিলে আমিও যাই।
লক্ষেশ্বর। বেতসিনীর ধারে! ঐ রে, খবর পেয়েছে বুঝি! বেতসিনীর
ধারেই তো আমি সেই গজমোতির কৌটো পুঁতে রেখেছি। (ধনপতির প্রতি) না, না, খবরদার বলছি,
সে-সব না। চল্, শীঘ্র চল্, নামতা মুখস্থ করতে হবে।
ধনপতি। ( নিশ্বাস ফেলিয়া ) আজ এমন সুন্দর দিনটা!
লক্ষেশ্বর। দিন আবার সুন্দর কী রে! এইরকম বুদ্ধি মাথায় ঢুকলেই
ছোঁড়াটা মরবে আর-কি! যা বলছি ঘরে যা।
[ধনপতির প্রস্থান
ভারি বিশ্রী দিন! আশ্বিনের এই রোদ্দুর দেখলে আমার সুদ্ধ মাথা
খারাপ করে দেয়, কিছুতে কাজে মন দিতে পারি নে। মনে করছি মলয়দ্বীপে গিয়ে কিছু চন্দন
জোগাড় করবার জন্যে বেরিয়ে পড়লে হয়। যাই হোক, সে পরে হবে, আপাতত বেতসিনীর ধারটায়
একবার ঘুরে আসতে হচ্ছে। ছোঁড়াগুলো খবর পায় নি তো! ওদের যে ইঁদুরের স্বভাব! সব জিনিস
খুঁড়ে বের করে ফেলে—কোনো জিনিসের মূল্য বোছে না, কেবল কেটেকুটে ছারখার করতেই
ভালোবাসে।